মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১
সাদিয়া
“ক্যাপ্টেন সাহেব কাবিনের পর থেকে তোর সাথে একবারও কথা বলেনি?”
মিথিলার কথায় মায়রা নীরব রইল। মাথাটা বুঝি আরো নুয়ে এসেছে তার। মুখটা কালচে বর্ণ ধারন করেছে অচিরেই। মিথিলার কপাল আরো কুঁচকে এলো। মনে মনে যা ভাবার ভেবেও নিয়েছে সে। মায়রা কিছু বলার আগেই বিস্ময় সন্দিহানি কন্ঠে মিথিলা প্রশ্ন করল,
“কি রে মায়রা? তুই বলতে চাইছিস কাবিনের তিন মাস হতে চলল আর ওই আর্মির ক্যাপ্টেন একবারও তোর সাথে কথা বলেনি?”
মায়রা শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল মিথিলার দিকে। মায়রার মলিন মুখ খানা দেখে মিথিলার বুক মুচড়ে উঠল। মেয়েটার কপালে কি বিয়ের পর সুখ জুটবে না? মায়রা শান্ত মৃদু কন্ঠে জবাব দিল,
“এই তিন মাসে ওই ফাহাদ ইহাম চৌধুরীর সাথে আমার একবারও কথা হয়নি আপু। কথা তো পরের বিষয় আমার মনে হয় উনি আমাকে একবারও দেখেও নি বিয়ের সময়।”
ভীষণ চমকে উঠল মিথিলা। কি বলবে কিচ্ছু খুঁজে পাচ্ছে না সে। আর্মিতে জব করে বলে কি বউ এর সাথে ফোনেও কথা বলা যায় না? এত ব্যস্ততার মাঝে কি তিন মাসেও এক মিনিট সময় হয়নি নতুন বউ এর সাথে কথা বলার? নাকি মায়রা কে তিনি পছন্দ করেনি? মায়রার মতো একটা মেয়েকেও কেউ অপছন্দ করতে পারে তা বুঝি মিথিলার বিস্তর চমকের বিষয়। এমন উদ্ভট কথা এই পর্যন্ত শুনেনি সে। তিন মাসের ভেতর একটা বার কল করেনি সদ্য বিয়ে করা বউ কে এটা বিস্ময়ের বাহিরে নয় কারো কাছেই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তুই কারো কাছে জানাস নি?”
“কার কাছে জানাব? কি বলব? যে আমার স্বামী আমাকে কল দেয়না? কথা বলে না? এটা কেনো অভিযোগ হলো?”
“তাই বলে তুই মামি কেও একবার বলবি না কথাটা?”
“না আপু আমার কিছু বলার নেই। আর না কখনো কিছু বলব।”
“আচ্ছা মায়রা তুই উনাকে একবার কল দিয়েছিলি?”
“কি বলো আপু? যেখানে বিয়ের পর থেকে একবারও উনি আমাকে কল করেনি সেখানে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে আমি কল করব উনাকে? কি যা তা বলছো আপু?”
মিথিলা কিছু বলবে তার আগেই মায়রার ফোনে তার শাশুড়ির কল এলো। মায়রা একপলক মিথিলার দিকে তাকিয়ে কল রিসিভ করল। সুরেলা মিহি কন্ঠে জানাল,
“আসসালামু আলাইকুম মা। কেমন আছেন?”
ওপাশ থেকে ভদ্র মহিলা বুঝি তৃপ্তি নিয়ে জবাব দিলেন,
“ওলাইকুম আসসালাম আম্মা। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ ভালো রাখছে। তুমি ভালো আছো আম্মা?”
“জ্বি মা ভালো। বাবা ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ মা তোমার বাবাও ভালো আছেন। শুনো মা তোমার আম্মুর কাছে একটু ফোনটা দাও তো। আমরা সবাই কিন্তু তোমাদের বাড়িতে আসব তৈরি থেকো কিন্তু।”
“জ্বি মা।”
বলে মায়রা দ্রুত ফোন মায়ের কাছে দিয়ে এসে আবার মিথিলার কাছে এলো। মিথিলা কেমন উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কি বলল রে মায়রা? ওরা সবাই আসবে মানে?”
মিথিলার আনন্দের কোনো কারণ খুঁজে পেল না মায়রা। সে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল তার একমাত্র ফুপির মেয়ের দিকে। মিথিলা আবার হাসি মুখে প্রশ্ন করল,
“সবাই মানে কি আর্মির ওই বদ ক্যাপ্টেন টাও আসবে?”
হঠাৎ ই বুকটা বুঝি কেঁপে উঠল মায়রার। আচমকা বুঝি সবকিছু তার নিকট থমকে গেল। কানে বারবার সুড়সুড়ি দিল একটা কথাই ক্যাপ্টেন সাহেব কি সত্যি আসবে? বুকের ভেতর দারুণ আলোড়ন শুরু হয়েছে তার। যার রেশ তার পুরো অঙ্গে স্রোতের মতো বয়ে গেল প্রবল গতিতে। ভেতরটা হঠাৎ ই কেন চঞ্চল হয়ে উঠল তার? মিথিলা তার হাত স্পর্শ করতেই স্তম্ভিত ফিরল মেয়েটার। অজানা কারণে লজ্জায় মুখ রঙ্গিম হলো তার। দৃষ্টি নত করে নিল নির্নিমেষ।
“মায়রা আমার মনে হচ্ছে ওরা সবাই মিলে এ বাসায় আসবে। সাথে শিওর ক্যাপ্টেনটাও আসবে।”
ফোন নিয়ে চটজলদি করে এগিয়ে এলেন ফাতেমা বেগম। মায়রার কাছে ফোন টা দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন,
“মায়রা মা তাড়াতাড়ি কর। ঘরের সব গোছগাছ শুরু করে দে মা। হাতে একটুও সময় নেই কাল সকালেই ওরা সবাই চলে আসবে এখানে। জামাই বাবাও আসবে। অনেক দিনের ছুটিতে আসছে সে। এই ছুটিতেই বোধহয় তোকে তুলে নিয়ে যাবে। আর ইহাম বাবা মনে হয় এখানে থাকবেও দুদিন। তাড়াতাড়ি সব তৈরি কর মা। অনেক কাজ বাকি। মিথিলা মা তুইও একটু হাত লাগা। আমি তোর মামা কে বলি বাজারে যেতে সন্ধ্যার পর আবার ভালো মাছ মাংস পাবে না।”
ফাতেমা বেগম তাড়াতাড়ি করে আবারও চলে গেলেন মহিন সাহেবের নিকট বাজারে পাঠাবেন বলে। মিথিলার চোখে মুখে উচ্ছ্বাস দেখা গেলেও মায়রা চুপচাপ। তবুও বুঝি বুকের ভেতর অশান্ত ঢেউ এর জোয়ার বইছে। শরীরটা বুঝি তার দাপটে বলহীন হয়ে আসছে। হঠাৎ এমন শরীর অসাড় অনুভূতির স্রোত কেন বইছে? কোথা থেকে উৎপন্ন হচ্ছে এই অশান্ত অস্থির অনুভূতির স্ফীতি?
খুব সকালে উঠে ফাতেমা বেগম হাতের কাজ শেষ করেই রান্নাঘরে ঢুকেছেন। মিথিলা সেই কখন থেকে ডাকছে মায়রা কে তবুও ঘুম থেকে তার উঠার নাম নেই। নয়টা বাজতে চলে তবুও উঠছে না মেয়েটা। কখন না কখন তারা সবাই চলে আসে। ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে হবে সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। মেয়েটা যে এত ঘুম পাগলা কি করবে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার পর? সে যতটুক জানে ডিফেন্সে জব করা প্রতিটা সৈনিক খুব নিয়ম শৃঙ্খলার মাঝে অভ্যস্ত। এই এলোমেলো মেয়েটার সাথে কি করে থাকবে বাংলাদেশ আর্মির একজন ক্যাপ্টেন? মিথিলা জানে না কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না তার। ভীষণ জোরাজুরি করে একপ্রকার টেনেটুনে মায়রা কে ঘুম থেকে উঠাল সে।
১১ টা নাগাদ ইহাম এর বাবা মা বোন এসে উপস্থিত হয়েছে। মায়রাকে খুব সুন্দর করে মিথিলা একটা শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। সাদা কালো শাড়ি টা তে একেবারে অপরূপ লাগছে যেন তাকে। দুধে আলতা গায়ে পদ্ম ফুলের মতো ভেসে উঠেছে যেন তার রূপ মাধুরী। মায়রা দরজা খুলে দিয়ে বিনয়ের সাথে সালাম জানাল সবাই কে। তার শাশুড়ি শায়লা বেগম এসেই মায়রা কে জড়িয়ে ধরল। দরজার সামনেই এক প্রকার মমতার কুশল বিনিময় পর্ব সেরে ভেতরে ঢুকল তারা। মায়রার অশান্ত বেহারা মন দরজা লাগাতে গিয়ে বারবার উঁকি দিচ্ছিল বাহিরে। কোথায় মানুষটা? কাল না তার আম্মু বলল ক্যাপ্টেন ফাহাদ ইহাম চৌধুরী আজ আসবে? তাহলে কোথায় সে? তাকে তো দেখা যাচ্ছে না। আসেনি নাকি? এই লোকটার সমস্যা কি সে বুঝতে পারছে না। এভাবে কেন তার থেকে দূরে থাকছে? কি চায় কি সে? তাকে এতই অপছন্দ হলে বিয়ে কেন করতে গেল? ভেতরে যত্ন করে জমানো দুঃখ রাগ ক্ষোভ গুলি দলা পাকানো কান্না হয়ে উপছে আসতে চাইছে তার। নাকের পাটা লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। খুব চেষ্টা করছে চোখের বাঁধ কে মজবুত দৃঢ় করতে।
“তুমি কাকে খুঁজছো আম্মা? ইহাম কে?”
শাশুড়ির কথায় চমকে উঠল মায়রা। বিস্তর লজ্জায় কষ্ট কান্না সব উবে গিয়েছে যেন। দ্রুত দরজা চাপিয়ে পিছন ফিরল সে। মাথা নুয়ে রেখেছে ইতস্তত বোধে। শায়লা বেগম হেসে জানালেন,
“ইহাম শিমলা আর ওর জামাই কে নিয়ে আধঘণ্টার মাঝেই ফিরে আসবে। আসো ভেতরে যাই।”
লজ্জা সংশয়ে মায়রার মরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে। ছিঃ কতটা বিব্রত হলো শাশুড়ির সামনে। চোখ তুলে আর তাকানোর সাহস হলো না তার।
ফাতেমা বেগম আর শায়লা বেগম দুই বেয়ানের ভীষণ ভাব জমেছে। দুজনই রসেরসে কথা বলছেন। এদিকে ইহাম এর বাবা ইসহাক চৌধুরী কে নিয়ে তার বাবা গিয়েছে বাহিরে। মিথিলা আপুও টুকটাক কাজ করছে। তার একমাত্র ননদ শিফু এক রুমে গিয়ে একা একা ফোনে মশগুল। কোনো কাজ না পেয়ে মায়রা নিঃশব্দে শাড়ির আঁচল টেনে টেনে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। একে তো শাড়ি পরতে একটুও ভালো লাগে না তার। তারউপর প্রতিমাসে নির্দিষ্ট সময়ে আগত অতিথি বিদায় নিয়েছে কাল। একটু সময়ের জন্য আবার ফিরে আসে কিনা তাই নিয়ে ঢের চিন্তায় গুটিয়ে যাচ্ছে সে। পর্যবেক্ষণ করতেই দ্রুত ওয়াশরুমে চলল সে গুটগুট পায়ে।
১২ টার দিকে এক গাদা ফল আর মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে উপস্থিত হয়েছে বাসার একমাত্র নতুন জামাই। সাথে নিয়ে এসেছে বড় বোন আর দুলাভাই কে। বাসায় ঢুকে অনাকাঙ্ক্ষিত মিথিলার মুখ দেখে খানিক সরু হলো ইহামের ললাট। তার যতদূর মনে আছে এটা তার বিয়ে করা বউ নয়। তার তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক একপল বউ কে দেখলেও নিঃসন্দেহে বলতে পারবে এই মেয়েকে সে বিয়ে করেনি। কঠিন পাষাণ মানুষটা দ্বিতীয় বার নিজের না দেখা বউ কে আর খুঁজার চেষ্টাও করেনি বাসার আনাচেকানাচে।
ইহাম খেয়াল করল এখানে শুধু তার মা বড় বোন শাশুড়ি আর মিথিলা নামের মেয়েটাই আছে। নিজেদের মতো করে তারা কথা বার্তা বলছে। সোফার এক কোণায় ফোনে ব্যবসার কাজ তার দুলাভাই রাইয়ান। তার তীক্ষ্ণ চোখে আবার দেখল ড্রয়িংরুম টা। সে যতদূর জানে সে যাকে বিয়ে করেছে তার নাম মায়রা। যাকে না দেখে বিয়ে করেছে, যার সাথে তার কোনো সম্পর্ক দেখা কথাবার্তা কিছুই হয়নি অথচ তাদের বিবাহিত জীবনের তিন মাস পূরণ হবে কিছু দিন পর। তবুও সেই মেয়ের প্রতি যেন কোনো আগ্রহ কিংবা কৌতূহল কোনোটাই নেই তার মাধ্যে। সবার মাঝে কেমন গম্ভীর ধারালো মুখভঙ্গি নিয়ে বসে আছে নিশ্চুপে। যেন অনুভূতি প্রাণ শূন্য একটা রোবট। দূর থেকে মিথিলা আড়চোখে চোখে খেয়াল করছে ওই শক্তপেটা মানুষটাকে। হাভবঙ্গি সবই খেয়াল করছে সে। এদিক ওদিক তাকিয়ে মায়রা কে খুঁজল। গাধা মেয়েটা কোথায় গিয়ে বসে আছে? আসছে না কেন এই মানুষটার সামনে? এক ঝলক তার রূপের আগুনে এই পাষাণ হৃদয় কে ঝলসে দিতে? মিথিলা যেন উতলা হলো এদের দেখা হবার অপেক্ষায়।
অনেকটা সময় অতিবাহিত হবার ইতস্তত বোধ করেই ইহাম বলল,
“আম্মু আপনাদের ওয়াশরুম টা কোথায়? একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার।”
ফাতেমা বেগম দ্রুত উনাদের কমন বাথরুমের কথা বলতে গিয়েও থামলেন। কিছু বলবেন তার আগে শায়লা বেগম বললেন,
“মায়রা আম্মা কোথায়? ইহাম কাল রাতেই জার্নি করে এসেছে তো চট্টগ্রাম থেকে তেমন রেস্ট করা হয়নি ছেলেটার। মায়রা আম্মা ওকে নিয়ে ওর রুমে যাক একটু। কোথায় ও?”
মিথিলার মন হাকুবাকু করে উঠল। আনন্দে লাফ দিতে ইচ্ছা হলেও দমল সে। ঠোঁটের হাসিটা নিবারণ করে সে স্পষ্ট ভাষায় বলল,
“মায়রা বোধহয় ওর ঘরে আছে। আসুন ভাইয়া আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।”
ইহাম নিঃশব্দে উঠল। তার মাঝে বিশেষ কোনো হেলদোল না থাকলেও মিথিলা খুব উতলা হয়ে আছে। দ্রুত সে ইহাম কে নিয়ে এগিয়ে গেল মায়রার রুমের দিকে।