মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১২

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১২
সাদিয়া

মাথার উপর প্রকাণ্ড অসহনীয় এক ভাঁজ পড়ার পীড়ায় ছটফট করছে তুহিনের ৮ বন্ধু। তুহিন কে এক প্রকার বগলদাবা করে নিয়ে গিয়েছে এক কোণায়। নাদিম চাঁপা গলায় বলল,
“এই হালার ব্যাটা তোর বোনের এই হিটলার জামাই কয় কি এসব? চলে যাবো মানে টা কি?”
তুহিন শান্ত স্বরে কিছু বুঝিয়ে বলবে তার আগে জিদান রাগ দেখিয়ে বলল,
“ওরে আর কি জিগাস? আমি আগেই টের পাইছিলাম এই বোকাচো* তো এক হাডুর বয়সী ল্যাদিরে পছন্দ করছে। যার নাক টিইপা দেখ গা এখনো হিঙ্গুল খায় কিনা। ওদের জন্যেই যত ঝামেলা।”

তুহিন চটল না। ওদের রাগটাও বেশ বুঝতে পারছে সে। সে নিজেও এক বিন্দু চাইছে না ভ্রমণপিপাসা না মিটিয়ে চলে যেতে। তবুও তার মন ভীত। সংশয় তার চিন্তায়। একটু আগে মায়রার সাথে যা হলো। তারউপর শিফুকেও টেনে নিয়ে এসেছে। নিজের প্রতি মায়া না লাগলেও ওদের বিপদের আশংকায় সংকুচিত হচ্ছে তার হৃদয়। শান্ত গলায় সে জানাল,
“দেখ যেহেতু একটা ঝামেলা হয়ে গিয়েছে। আর বিপদ এখনো কাটেনি তাই আমার মনে হয় চলে যাওয়া উচিৎ। আমরা না হয়,”
তুহিনের কথা শেষ হবার আগে ইফাত বলে উঠল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তোদের মন চাইলে তোরা চলে যা আমি একাই ট্যুর শেষ করে যাবো।”
নাদিম কিছু বলবে তার আগেই কায়েস বিড়বিড় করে বলে উঠল,
“হু’গা মা* এর কাজ হইছে। আসলাম একসাথে এর মাঝে একেক বাই* পল্টি মারা শুরু করছে।”
কায়েসের কথায় তুহিনরা কেউ চমকাল না। কারণ তারা সবাই জানে কায়েস একটা খাপছাড়া লোক। ওর মুখে কোনো কিছু আটকায় না। স্থান কাল পাত্রবেদে সে কখনোই নিজের মুখের লাগাম টানে না। বড় লোক বাবার উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে একটা। কায়েস আরো কিছু অশ্লীল বাক্য ছুড়বে তার আগেই সৌরভ তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
“আরে এত প্যারা নিচ্ছিস কেন? বান্দরবন ট্যুর দিতে পারব না তো কি হয়েছে আমরা খাগড়াছড়ি চলে যাই। তোর বোন জামাই তো সেনাবাহিনীতে আছে। বিশেষ ট্রেইল রয়েছে যাতে করে আমরা এখান থেকে খাগড়াবাড়ি চলে যেতে পারি। তবে সর্বসাধারণের জন্যে এটা প্রযোজ্য নয়। উনাকে বলে দেখ আমাদের জন্যে একটু সুপারিশ করতে যাতে করে এখান থেকে যেতে পারি। নয়তো আবার চট্টগ্রাম যেতে হবে তারপর আবার খাগড়াছড়ি ভাই যাইতেই যদি ক্লান্ত হয়ে যাই তবে ঘুরে দেখার আগেই তো বিছানায় চিতপটাং হতে হবে।”

“তুই পাগল হইছোস? এমন সময় সেনাবাহিনীর ট্রেইল দিয়ে আমাদের যেতে দিবে কিভাবে ভাবিস? এটা আমি বলতে পারব না। আমার কাছে এই মুহূর্তে ফিরে যাওয়াই সেভ মনে হচ্ছে।”
তুহিনদের ৯ বন্ধুর সবচেয়ে শান্তশিষ্ট ভদ্র ছেলে মিজান বলে উঠল,
“আরে থাম তোরা। এত প্যারা না নিয়ে তোর বোন জামাই কে বল আমরা এখানে রিসোর্টেই না হয় থাকি দুদিন এরপর ঝামেলা শেষ হলে ঘুরে ফিরে চলে যাবো না হয়। আমার মতে এটা বেস্ট অপশন।”
পাশ থেকে ফোঁড়নকাটার মতো তৌফিক বলল,
“বা*ল আমার। ঝামেলা কত দিন চলবে তার হিসাব নাই। এতদিন রিসোর্টে থাকব। এরপর ঘুরতে আরো ২/৩ দিন যাবে। এত বাজেট কে দিবে?”
কায়েস বিরক্ত হচ্ছে। চোখ মুখ কুঁচকে জবাব দিল,

“শালার ভাই তুমি হে* র চিন্তা করো? এমন বা*ল ফালানির চিন্তা নিয়া মাথা ঘামাও তুই? চু* ভাই আমার।”
কায়েসের ব্যবহারে তাদের বন্ধু কেউ কিছু মনেই করে না। কারণ তারা অভ্যস্ত। অতঃপর মিজানের অফারে সবাই সন্তুষ্ট হলো। একসাথে আলোচনা করে তুহিন এগিয়ে গেল ইহামের দিকে। ভয় সংকোচ নিয়েই বলল,
“ইহাম ভাই আমরা সবাই দুদিন রিসোর্ট এ থাকতে চাইছি। বিপদ শেষ হয়ে গেলে ট্যুর দিয়ে ঢাকায় ফিরতে চায় সবাই।”
ইহাম রাগান্বিত চোখে একবার তুহিনের দিকে তাকাল। পরক্ষণে ওর সব বন্ধুদের দিকে। সঙ্গেসঙ্গে তেজস্বী কন্ঠে জানিয়ে দিল,

“ছেলেখেলার একটা লিমিট আছে। তোমরা বাচ্চা কিংবা অবুঝ নও যে ঘুরতে পারবে না বলে বায়না ধরবে। যেটা বললাম সেটাই করো। আজই ঢাকায় ফিরবে। ডোন্ট ওয়েন্ট টু হেয়ার এনি এক্সকিউজ।”
কায়েস বাদে তুহিনের ৭ বন্ধু এগিয়ে এলো ইহামের কাছে। তারাও অনুনয় করল। একপ্রকার চেঁপেই ধরল ইহাম কে। অনন্তর ছেলেটা কি ভাবল কে জানে। সে অদূরে জড়সড় হয়ে থাকা শিফুর সাথে দাঁড়ানো মায়রার দিকে তাকালো। মেয়েটা তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখে চোখ পড়তেই বিব্রতে নাকি ভয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল বুঝল না সে। গূঢ় হাসিটা সংগোপনেই নিগূঢ় রইল। তার ভেতরেও যেন এত দিনেও যে পাহাড়ি আবহাওয়ার শীতলতাটা ঢুকতে পারেনি। এই মুহূর্তে বুঝি সেটা সক্ষম হলো। শিথিল হলো তার কঠোর অন্তর। শেষবার অনুরোধ করে তুহিন বলল,
“ভাইয়া এই ট্যুর শেষে মালয়েশিয়া যাবার কাগজপত্র তৈরি করতে হবে। প্লিজ এরপর আর সুযোগ হবে না আমার। আপনি..”

“ঠিক আছে তবে শর্ত মোতাবেক এখন নীলাচল থাকা যাবে না।”
সবাই খুশি হবে নাকি চিন্তায় গড়াগড়ি খাবে তা কেউই বুঝতে পারল না। মানে লোকটা তাদের থাকার অনুমিত দিয়েছে তাও আবার এই রূপ কথা? নীলাচল থাকবে না তো কোথায় যাবে? দুইদিনের এডভান্স টাকা জমা দেওয়া আছে রিসোর্টে। সেটার কি হবে? এই মুহূর্তে ইমারজেন্সি থাকার ব্যবস্থাও হবে বলে মনে হচ্ছে না। সবাই যেন দারুন নির্ভেজাল ঝামেলা পড়ে বোকার মতো একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এই ক্যাপ্টেন সৈনিকের কাঠিন্যতা, গম্ভীর মুখের আদল তাদের চঞ্চল চনমনে গ্রুপটাকেও কেমন নীরবে দাবিয়ে রাখছে। ভীষণ ব্যাকুল হলো সবাই। সবটাই নির্নিমেষ দেখল ইহাম। তবে সেসবে বিশেষ পাত্তা দিল না। কেমন রাশভারী গলায় বলে উঠল,

“সেসব পরে হবে। চলো সবার ব্রেকফাস্ট করা যাক।”
খাবারের কথা শুনে সবার পেট যেন ডেকে উঠল। খিদের তাড়না বাড়ল বুঝি উদরে। নাদিম বলে উঠল,
“খিদে পেটটা মড়মড় করতাছেরে মামা। আগে পেট ভরে তারপর ভা*…”
কথাটা বোধহয় নাদিম শেষ করতে পারল না। সবার নীরব নির্বাক মুখ দেখে সে থামিয়ে পাশ কাটিয়ে দেখল ইহামের তীক্ষ্ণ তবুও শান্ত শীতল চোখের দৃষ্টি। ওই দৃষ্টিতে মুখের বেচাক্কা কথা টা সম্পূর্ণ না করেই দমল সে। বোকা হেসেই চুপ বনে গেল। ইহাম ততক্ষণে দৃষ্টি সরিয়ে তাকাল শুকনো মুখের মায়রার দিকে। দেখে স্পষ্ট বুঝার উপায় আছে খিদে, জড়তা, ইতস্তত বোধ মেয়েটাকে কেমন বিড়ালের মতো মিয়ে দিয়েছে।

রেস্টুরেন্টে সবাই পরোটা খেতে ব্যস্ত। কেউ কেউ খিচুড়ির সাথে হাঁসের গোশতও নিয়েছে। ইহাম মায়রা আর শিফু এক টেবিলে বসেছে। ইহাম খাবার মুখে দিয়ে একপলক দেখল মায়রার নুয়ানো মুখশ্রী টা। মেয়েটার গালে এখনো তার আঙ্গুলের ছাপ বুঝা যাচ্ছে। অচমকা এক দলা অস্থিরতা তার হৃদয়ে ঝেঁকে বসল। ওই রঙ্গিম গালের দিকে তাকিয়ে তার কেমন হাসপাস লাগছিল। বুক হঠাৎ ভার হয়ে আসতে চাইল লঘুমাত্রায়। সে দমল খানিক। খেয়াল করল মায়রা তেমন কিছু খাচ্ছে না। মুখও বেশি নাড়াচ্ছে না। ব্যথা করছে কি মেয়েটার গালে? তাই কি খাচ্ছে না? ইহাম একজন কে ডাকল। শান্ত মিষ্টি স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আপনাদের এখানে যে কোনো ধরনের স্যুপ পাওয়া যাবে?”
“ইয়েজ স্যার। কোনটা অর্ডার নিব স্যার?”
ইহাম তাকাল মায়রার দিকে। জিজ্ঞেস করল,
“মায়রা নরমাল কোনো কিছু নিবে নাকি স্পাইসি?”

মায়রা হকচকিয়ে তাকাল। দেখতে পেল ইহাম শান্ত দৃষ্টি দিয়ে দেখছে তাকে। ভালো ভাবে তাকিয়ে খেয়াল করল কিছু একটা। লোকটার ভাবভঙ্গি তার মুটেও ভালো লাগল না। সে কি বুঝাতে চাইছে? স্যুপ কেনো খেতে যাবে? মানুষটা কি কোনো ভাবে তাকে এটা বুঝাতে চাইছে যে তার চরের কারণে সে খেতে পারছে না? চিবুতে খুব কষ্ট হবে? তাই এত খিদের মাঝেও ওই একটু মাশরুম চিকেন মেশানো পানি খাবে? কিছুতেই না।
“আমার জন্যে একটু জাউ নয়তো ল্যাটকা পানি পানি খিচুড়ি নিয়ে আসুন।”
মায়রার চেঁচিয়ে এই কথা বলতে মন চাইছে। তবুও সে সেটা বলল না। দমল একটু। এমনটা করলে ওই বদ নির্দয় ক্যাপ্টেন টা তাকে বেয়াদব অসভ্য তকমা ছুড়তে এক সেকেন্ড সময় ব্যয় করবে না। এত লোকের সামনের কি করে বসে তাও একটা চিন্তার বিষয়। মায়রা নিজেকে শক্ত করল। তারপর কাঠগলাতেই জোর নিয়ে বলল,
“পারলে আমায় এক প্লেট বিফকারী দিয়ে যান। পরোটার সাথে খাবো। আপনাদের চিকেন একদম ভালো না। বিফ হবে তো?”

শিফু হতবিহ্বলের মতো তাকিয়ে রইল মায়রার দিকে। এই মেয়েটা তার রাগী রগচটা ভাইকে অমান্য করে মুখের উপর কথা বলছে? কি দুঃসাহস। না জানি তার ভাই কি করে। শিফু আস্তে করে তাকায় ভাইয়ের দিকে। শান্ত গভীর চোখ দেখে নিজেই থমকায় সে। পরক্ষণে তাকায় মায়রার দিকে। দুজন দুজন কে দেখছে নীরবে নিশ্চুপে। তবে প্রেমময় দৃষ্টিতে তো একেবারই নয় তা বেশ ধরতে পারল শিফু। নিয়মিত চাইনিজ কোরিয়ান পাকিস্তানি ড্রামা দেখা মেয়ে সে। তবুও দুজনের এই অদ্ভুত চোখের সঠিক ভাষা বুঝতে খুব বেগ পেতে হচ্ছে তার। আবারও হতবাক হয়ে দুজনকেই দেখল। দুজনই শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একে অন্যের দিকে। তবে সেই দৃষ্টির ভাষা অত্যন্ত অস্থির বেসামাল। উগ্র ব্যাকুলতার ভাব সেই গভীর দৃষ্টি ছুঁয়েছুঁয়ে যাচ্ছিল বোধহয়। একজনের চোখে বুঝি সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষোভ, অপমানের তেজ তো আরেকজনের চোখে রয়েছে কথা অমান্য করার আক্রোশ।

মায়রার চাপায় সত্যি খুব ব্যথা করছিল। ওই দানব হাতের চরের জোর নিহাত কম নয়। তবুও সে পরাজিত হলো না ইহামের কাছে। একেতো সবার সামনে চর মেরে ঠিক করেনি তারউপর আপমান জনক আলগা দরদ দেখাতে এসেছিল। ওই শক্ত বিফকারী দিয়ে বেশ সময় লাগিয়েই মায়রা পরোটা চিবিয়েছে। ইহাম শুধু নীরবে শান্ত স্থির ভঙ্গিতে দেখে গিয়েছিল শুধু মেয়েটার জেদ। ওই জেদের পিঠে বুঝি আক্রোশ বাড়ল ওর। স্থির থেকেও মনে মনে ক্রুর হাসছিল বুঝি ছেলেটা এক নিগূঢ় মননে।

জিপে করে ওদের গন্তব্যে আসতে আসতে তাদের প্রায় দুপুর একটার কাছাকাছি ধরেছিল। ওখান থেকে রওনা দিয়েছিল তারা প্রায় দশটা নাগাদ। রাস্তার পাশে একটা রেস্টুরেন্ট তাদের গাড়ি পার্ক করে হেটেহেটে যেতে শুরু করল ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে। ইহামের কয়েকজন সৈনিক আগে আগে। তুহিনের বন্ধুদের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। ইহাম স্বভাব সুলভের বিপরীতেই ধীর বেগে হেটে আসছে। তার পিছনেই রয়েছে শিফু আর মায়রা। দুজন হাত ধরে ধরে হাটছে। আর অবাক বিস্মিত নজরে চেয়ে দেখছে জঙ্গল পরিবেশ। যেতে যেতে অনুধাবন করছে আস্তেধীরে তারা খাড়া রাস্তা ধরে এগুচ্ছে। ছোটখাটো টিলার মতো যেন চারপাশ। হুশিয়ারি কন্ঠে ইহাম বলল,

“সাবধানে পা বাড়িয়ো দুজন। হ্যাল্প লাগছে সংকোচ করো না।”
মায়রা তাকিয়েই মুখ ভেংচি দিয়ে উঠল। ইহাম দাঁত খিঁচে সেটা দেখেও না দেখার ভাব করেছে। বেয়াদব ম্যানারলেসমেয়ে বৈকি!
আগেই পায়ে খানিক ব্যথা লেগেছিল মায়রার। এবার আর হাটতে পারছে না সে। শিফুর দিকে তাকিয়েই পা চালাল। মুখ বাড়িয়ে ফিসফিস করল,
“ও শিফু। তোমার ভাইয়ারে জিজ্ঞেস করো না আর কত দূর?”
“কেন ভাবি? হাটতে পারছো না? আমার তো ভালোই লাগছে। দেখো কি সুন্দর।”
মায়রা আনমনে তাকিয়ে কিছু বলবে তার আগেই পা মুচড়ে পড়ল নিচে। ব্যথায় আর্তনাদ তুলে মেয়েটা ধপ করে নিচে বসে পড়ল। শক্ত আদলের অভিজাতপূর্ণ পুরুষটা চকিতে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল। মায়রা কে ওভাবে বসে থাকতে দেখে হাত পাঁচ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইহাম শিফুর আগেই যেন তড়িত গতিতে এগিয়ে গেল। ঈষৎ ঝুঁকে চোখে মুখে বিরাট সংশয় তুলে জিজ্ঞেস করল,

“ইডিয়ট দেখেও হাটতে পারো না?”
ব্যথায় বিবর্ণ মুখ তুলে মায়রা তাকাল ইহামের দিকে। তার খুব রাগ হলো। দেখতে পাচ্ছে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে অথচ গলার স্বরের অবস্থা যেন শত্রুকে ধমকাচ্ছে। ব্যথায় মায়রা আর কিছু জবাব দেওয়ার উপায়ে থাকল না। ওখানে বসেই পায়ের গোড়ালিতে হাত চেঁপে বসে রইল। চোখ মুখ ব্যথায় বিষবর্ণ ধারণ করেছে তার। শিফু দুঃখ প্রকাশের আভাস গলায় তুলে বলল,
“ভাবি বেশি ব্যথা পেয়েছো?”

মায়রার থেকে জবাব আসে না। চোখ বন্ধ করেই যন্ত্রণায় ছটফট করে নিভৃতে। ইহাম এক হাটু তে ভর দিয়ে নিচে মায়রার পাশেই বসল। রুক্ষ মুখাবয়ব তুলে হাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল,
“মুখ চলার মতো পা টা চললে তো এতক্ষণে আমাদের আগে চলে যেতে পারতে।”
ইহাম হাত বাড়িয়ে খানিক ছুঁয়ে দিতেই ঝটকা দিয়ে সরিয়ে নিল মায়রা। ফোঁসফোঁস করে কিছু বলবে তার আগে খেয়ালে আসে পিছন থেকে কিছু লোক এগিয়ে আসছে। তাই চুপ করে গোড়ালিতে হাত বুলায়। তোফায়েল এসে সম্মান জানিয়ে টানটান বুক নিয়ে দাঁড়ায়। ধাতস্থ কন্ঠে শুধায়,
“এ্যানি থিংক রং স্যার?”

ইহাম বসা অবস্থাতেই ঘাড় উঁচু করে তাকাল। দুপুরের কড়া রোদ ঝিলিক দিচ্ছে চারিপাশে। ঘাড় খানিক উঁচু করতেই এক ফলা রোদ ছুঁয়ে গেল ইহামের ভরাট পৌরুষ মুখশ্রীতে। মোটা গলায় জবাব দিল সে,
“নাথিং। তুমি বরং সামনে এগোয় তোফায়েল।”
“ইয়েস ক্যাপ্টেন।”
লোকগুলি চলে যেতেই মায়রা শিফুকে বলল,
“শিফু আমায় একটু টেনে তুলো তো।”
শিফু ভ্যাবলার মতো তাকাল ভাইয়ের দিকে। ভাই কে নির্লিপ্ত দেখে আবার দৃষ্টি দিল ব্যথায় জর্জরিত মায়রার পানে। ওর ছটফট দেখে ভাইয়ের ভয় নিয়ে সে এগুতেই নিঃশব্দে ইহাম ভাঁজ হাটু সটান করে দাঁড়াল। শিফু মায়রার হাত ধরে টেনে তুলল। মেয়েটা ঠিক ভাবে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছে না। রীতিমত টলছে ডান পায়ের যন্ত্রণায়। শিফু কপাল কুঁচকে সন্দিহানি কন্ঠে প্রশ্ন করল,

“ভাবি তুমি হাটতে পারবে? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে পায়ের কন্ডিশন জটিল।”
মায়রা শুকনো ঢোক গিলল। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল ওই গম্ভীর মানুষটার নীরবতা। পরক্ষণে দৃষ্টি সামনে ফেলে দেখল তুহিন ভাইয়া কে কোথাও দেখা যায় কিনা। কিন্তু না তারা যেন মিলিয়ে গিয়েছে। ওরা তিন জনই বুঝি পিছনে পড়েছে। মায়রা জিহ্ব দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিল,
“আমায় একটু ধরে ধরে নিয়ে যাও শিফু।”
“ঠিক আছে।”

মায়রা লম্বা করে শ্বাস নিল। পা নাড়াতে চাইলেই পীড়ায় “আহহ” বলে মৃদু আওয়াজ তুলতেই ইহাম নড়ল। শক্ত মুখ আরো দারাজ করে তুলল ছেলেটা। শিফুকে হাত দিয়ে ঠেলে আচমকা একদম অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মায়রা কে কোলে তুলে নিল নির্নিমেষ ভঙ্গিতে। শক্ত গলায় কেবল স্বল্প ভাষায় বলল,
“শিফু আমার পিছু পিছু খুব সাবধানে পা ফেল। গাধার মতো তোর পাও মচকালে দুইটাকে এখানেই ঢিল মেরে ফেলে যাবো। তখন বুঝবি বাসা থেকে মিথ্যে বলে বের হবার মজা।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১১

মায়রা নিশ্চুপ। গলা দিয়ে তার আর কোনো কথা বের হচ্ছে না। অনুভব করল কাঠিন্য মানুষটা চোখ মুখ গভীর গম্ভীর করে কেবল টানটান বুকে সামনে তাকিয়ে হাটছে। মায়রা কেবল শূন্যে এগিয়ে যাচ্ছে। তার দুই হাত দিয়ে ওই শক্তপোক্ত মানুষটার ঘাড় আঁকড়ে রেখেছে দৃঢ়ভাবে। বুকের ভেতর থেকে ঢিপঢিপ করে শব্দ তরঙ্গ বের হচ্ছে আবলিল ধারায়। স্থীর থাকলেও মেয়েটার ভেতরটা অস্থির বেসামাল অনুভূতিতে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৩