মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৪
সাদিয়া
বিশাল বিশাল এই বনালি গাছপালার মাঝে এই ছোটখাটো পরিসরের কটেজটা কেন বানানো হলো তা তুহিনেরা জানে না। কটেজটার পরিসর এতই ছোট যে গুটিকয়েক মাত্র রুম এখানে। তুহিনদের থাকার জন্যে একটা রুমই বরাদ্দ করা হয়েছে। বড়বড় দুই বিছানায় অনায়াসে ৯ জন বন্ধু থাকতে পারবে। তবুও তাদের থাকার সমস্যা হলে ২ জন কে তারা ইহামের গাইডে থাকা সৈনিক দুই রুমে শেয়ার করে নিতে পারবে।
শিফু তখন ফ্রেশ হয়ে এসে নিজের হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা চিপসের প্যাকেট বের করল। এমনিতে সারাদিন মেয়েটার মুখ চলে খাবারে। শুধু তার প্রধান সমস্যা হয় ভাত খেতে গেলে। এতে অবশ্য শায়লা বেগম বেজার চটে। লাগাতার বকবক করতে করতে বলেন,
“সারাদিন আগরবাগর খাস খালি। কেন বাথরুমে গিয়ে গু খেতে পারিস না? তাহলে তো টাকা গুলি বেঁচে যায়।”
ঠকঠক করে দরজায় আওয়াজ হয়। শিফু ভাবনা রেখে বন্ধ দরজার দিকেই তাকায়। আবারও দরজায় টুকা পড়ে। পাশের রুমে ভাইয়া আছে। নিশ্চয় কোনো দরকার নয়তো খাবারের জন্যে ডাকছে। হাতে চিপসের প্যাকেট টা বালিশের এক কোণায় রেখে হাত ঝাড়ে। এ অবেলায় এসব খেতে দেখলে আলবাত ভাইয়া বকবে। মুখ মুছতে মুছতে দরজা খুলল সে। ওমনি হুড়মুড় করে ভেতরে চলে এলো তুহিন। এসেই লাগিয়ে দিল দরজা টা। প্রথমে ভয় হলো শিফুর পরক্ষণে শক্ত গলায় বলে উঠল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“এই আপনি এখানে কেন এসেছেন? এক্ষনি বের হন বলছি। না হলে কিন্তু আমি ভাইয়া কে বলব আমার রুমে বাঁদর এসেছে।”
বিশেষ গায়ে মাখল না কথাটা তুহিন। সে বরং এগিয়ে গিয়ে আয়েশ করে বসল বিছানায়। বালিশের কাজটায় নজর যেতেই হাতে তুলে নিল চিপসের প্যাকেট।
“এই এই, আপনি আমার চিপস খাচ্ছেন কেন? দিন দিন বলছি।”
শিফু ছুটে গিয়ে প্যাকেট ধরতে চাইল। তবে তুহিন সেটা দিল না। এ হাত ও হাত করতে করতে বেচারার দুইটা তিনটা করে মুখে দেওয়া হচ্ছে। বেশি অর্ধেক টা যখন শেষের পথে তখন ক্লান্ত হলো শিফু। চোখ গরম করে রাগ দেখিয়ে বলল,
“দেখুন আপনি কিন্তু বেশি করছেন। আমার চিপস দিয়ে বের হন এখান থেকে নয়তো আমি ভাইয়া কে ডাকব।”
“তোমার ভাইয়া তো নিচে আছে।”
বজ্জাৎ মেয়েটা পারে কিনা গলা ফাটিয়ে চেঁচানো শুরু করল। তুহিন প্যাকেট টা ফিকা মেরে হুড়মুড় করে বিছানা থেকে উঠল। দ্রুততার সাথে চেঁপে ধরল শিফুর মুখটা। এ মেয়ে তো তার ঘাম ছুটিয়ে দিবে। বন্ধুবান্ধব সবার সামনে তার ইজ্জতের প্যান্ট খুলে ল্যাং’টা বানিয়ে ছাড়বে। এমনিতেই একেকটা কানের কাছে প্যানপ্যান করছে। এটা তো আর তার নিজের বাসা না সেদিন না জোর গলায় বলতে পেরেছিল। তবে আজ কি বলবে? কেন এসেছে শিফুর একান্ত রুমটা? তখন কি তার পা’ছায় ধড়াম ধড়াম বাজাবে না সবাই? তাই দৌড়ে এসে প্রথম দিনের মতোই মেয়েটার মুখ ধরল চেঁপে। তবুও বেচারার মনের কোথাও এলো না সেদিনও মেয়েটা এভাবেই তার হাতে নিজের হিরক দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল মুখ চেঁপে ধরার অপরাধে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। টুস করে দাঁত ফুটাতে ভুলল না মেয়েটা এক অনুও। এবার তুহিন নিজে “আহহ” করে মৃদু চেঁচিয়ে উঠল।
“ওই রাক্ষসী নাকি তুমি? মাংস খাওনি কোনো দিন? আমার হাতের মাংস এত পছন্দ তোমার?”
“বারে আপনি না সারাক্ষণ বলেন আমি কালনাগিনী তো কালনাগিনীর দাঁতে যে বিষ থাকে সেটা কি আপনার অজানা?”
“এবার তো আমার হাতের মাংস উঠিয়ে ফেলতে রাক্ষসীর মতো। তুমি তো ড্যাঞ্জা’রাস!”
“এই কারণেই আমার থেকে আপনি দূরে থাকবেন। শুনেছেন? যান এবার। অসভ্য বাঁদর।”
তুহিন তাকাল ফ্লাটিং করার ভঙ্গিতে শিফুর দিকে এক পা বাড়িয়েই বলল,
“তোমার মতো ড্যাঞ্জা’রাস মেয়েলোকের সাথে তুহিনের জমবে বেশ। কি বলো শিফুটিফু?”
শিফুর হাসি পেল। বুকের ভেতরটা ছলাৎছলাৎ করে উঠল। তবুও তুহিনের পায়ে পা চেঁপে বলে,
“আপনার লো ক্লাসের ফ্লাটিং বন্ধ করে বের হয়ে যান এবার। নয়তো আমি আপনার হাতের শিরা কামড়ে তুলে আনব।”
“মেয়ে তুমি কি জানো তুমি আমার এমন জায়গায় কামড় দিয়েছো যে আমি নিজেকে ভুলে কেবল তোমার বিষে আচ্ছন্ন হয়ে আছি?”
শিফু দরজাটা খুলে চুপচাপ তুহিন কে ধাক্কা মারে। আচানক ঠ্যালা টা বোধহয় সামলাতে পারেনি তুহিন। খানিক সরে গেল। হেয়ালি গা সংবিতে দুলল। পরপর আবার ধাক্কা খেয়ে একেবারে বাহিরে আসতেই শিফু তড়িতে কপাট লাগায়। দরজার সাথে দাঁড়িয়ে বুকের ভেতর উথালপাতাল ঢেউ এর সাথে এলোমেলো নিশ্বাস নেয়। তার কিশোরী মনে সদ্য ফোটতে চাওয়া এক তরজাতা গোলাপ বুঝি তুহিন।
খিদের জ্বালায় মচকানো পা নিয়ে নিঃশব্দ রুমে একা একা ছটফট করছে মেয়েটা। বাড়ি হলে এতক্ষণ নির্ঘাত চেঁচামেচি করত। কিন্তু এখানে কাকে কি বলবে সে? কারো ধন্না না ধরে নিজে গিয়ে যে খেয়ে আসবে তার পথও বন্ধ করে বসে আছে। নিরুপায়ের মতো বসে কেবল অধৈর্যের ভাব বিলাচ্ছে।
দরজার নব ঘুরানোর আওয়াজ পেয়ে মায়রা সেদিকে তাকাল। ট্রে হাতে খাডাস লোকটা এদিকেই এগিয়ে আসছে গমগম পায়ের আওয়াজ তুলে। আড়ালে মায়রা মুখ ঝামটাল।
“এ্যা। দরদ দেখাতে আসছে খাবার নিয়ে। ভাব দেখে যেন বুঝা যাচ্ছে, দেখো আমি তোমার জন্যে খাবার নিয়ে আসছি। আমি কত মহান। অসভ্য খচ্চর প্রকৃতির লোক যত্তসব।”
বিছানার উপর খাবারটা রেখে। ইহাম পাশে বসল। কড়া কন্ঠেই বলল,
“তাড়াতাড়ি খাবারটা ফিনিশ করে মেডিসিন নিবে। আমি ঘণ্টা খানিক পর এসে ব্যান্ডেজ টা কিছুক্ষণের জন্যে খুলে দিব। পায়ে কি খুব বেশি ব্যথা?”
মায়রা জবাব দিল না। উল্টে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে অন্যদিকে। মেজাজ বিগড়ালো বোধহয়। কর্কশ কন্ঠে ধমকে উঠল ইহাম।
“এই মেয়ে তুমি এত বেয়াদব কেন? আদবের বালাই নেই তোমার মাঝে? সহজ কথা সহজ ভাবে নিতে জানো না? পরিবার থেকে ভদ্রতা শেখায়নি?”
ফুঁসে উঠল মায়রা। সেও তাকাল ইহামের দিকে। চোখ বড়বড় করে আঙ্গুল তুলে বলল,
“একদম পরিবার নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। শুরুর দিন থেকে আমাকে নিয়ে পড়েছেন ভুলেও পরিবার নিয়ে কিছু বলবেন না।”
ইহাম রক্তচক্ষু করে তাকাল মায়রার আঙ্গুলের দিকে। নামিয়ে আনার পূর্বেই ছেলেটা খপ করে ধরল সেটা। মুচড়ে ধরে দাঁত পিষে বলল,
“বেয়াদবি আমার সাথে করতে আসবে না মেয়ে। কোনো গর্হিত আচারণ আমি বরদাস্ত করি না কখনো। পা মচকে বসে আছো না? শান্তি পাচ্ছো না বুঝি? নাকি হাতও মচকাতে চাও?”
ভয় পেল মায়রা। নির্দয় লোকটা বেশ রয়েসয়ে চেঁপেছে আঙ্গুল। ভীষণ ব্যথা হচ্ছে। কন্ঠ খানিক নিস্তেজ করেই জানাল,
“হাত ছাড়ুন বলছি। আপনি আমার হাত মচকানোর কে?”
“তাই নাকি?” হাত ছেড়ে দিল ইহাম। চমৎকার ভাবে এক চিমটি হেসে শুধালো,
“বলার কে আছে আমার বিরুদ্ধে?”
“আপনি বলতে চাইছেন আমাকে কিছু করলে কেউ আপনাকে কিছু বলবে না?”
“তোমার ঘিলুর গেইট কি মাঝে মাঝে খুলে যায় নাকি মায়রা?”
“চুপ।” দাঁত কটমট করল মায়রা। “আমার অতি ভালো বাবা মা কেউ কিছু না বললেও আমি নিজেই আপনার নামে নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকবো। তখন আপনার শখের চাকরির কি হবে দেখবো আমি।”
ইহাম যেন নগণ্য হাসল। সেই হাসিটাও অবাক হয়ে দেখল মায়রা। শয়তানি হাসি দিলেও মানুষকে এত মুগ্ধ লাগে? সে বুঝতে পারছে চোখ ফেরাতে পারছে না ওই লোকটার থেকে। তাকে অবাক করে দিয়ে ইহাম অনেক খানিক ঝুঁকল তার দিকে। ফিসফিস করে অদ্ভুত কন্ঠস্বরে বলল,
“মিসেস ইহাম আপনি কি দেখতে চান নারী নির্যাতন কিভাবে করতে হয়?”
সংবিৎ হারিয়ে মায়রা কেবল আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে। মস্তিষ্ক সূক্ষ্ম কথাটা বুঝিয়ে দিতেই মায়রা দুই হাত দিয়ে ইহামের কাঁধ ঠেলে দিল। গজগজ করতে করতে বলল,
“আমার সাথে বাজে কিছু করতে গেলে আপনার মাথা ফাটিয়ে ফেলব কিন্তু ক্যাপ্টেন সাহেব। অসভ্য লোক আপনি। বের হয়ে যান এই রুম থেকে।”
ইহাম খিঁচে জবাব দিল,
“লেহাজের বালাই মাত্র নেই এই বেয়াদব মেয়ের মাঝে। জাস্ট ইম্পসিবল। রিডিকিউলাস, ম্যানারলেস মেয়ে।”
সোফার উপর থেকে ল্যাপটপ টা নিয়ে ইহান দুপদাপ পায়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে নিজের ক্রোধ প্রকাশ করে গেল বুঝি নির্দোষ জড় বস্তু কাঠের দরজার উপর।
“আরে এই শা’লা মদনা হাবিবের গালফ্রেন্ড আরেক বেডার সাথে গেছে গা শুনছোস সবাই?”
রাত তখন ১১ টার কাছাকাছি। একটা রুমের দুই পাশে দুই বিছানায় এলোমেলো ভাবে শুয়ে আছে ৯ বন্ধু। শাওনের কথায় ফেসবুকে ঢু মারতে মারতে কায়েস বলল,
“তুমি খালি থাকো মানুষের ধো’নের প্যাঁচাল লইয়া। সারা দিন বাল ছিঁড়ারও কাম নাই তোমার?”
নাদিম বিরক্ত হলো। রুষ্ট গলায় বলল,
“ভাই তোর এই কাচ্চি ভাষা গুলা একটু কন্ট্রোল কর মামা। কয়দিন পর বিয়া করবি। তোর মুহের কথা শুনলে বউ বাথরুম দিয়া পালাইব ব্যাটা।”
পাশ থেকে নাজিফ বলে উঠল,
“ওয় একটা গেলে দশটা আনব। সেটার চিন্তা তুই তোর বদনায় নিস না মগা। নিজের হু’গায় তেলা মারো শা’লা।”
মিজান ওদের থামিয়ে বলল,
“আরে থাম তোরা। আমাদের তুহিন মামার কথা বল। দেখছোস আমাদের কথায় তার কোনো কিছু যায় আসতাছে? সে মগ্ন তার চিন্তায়।”
জিদান খ্যাঁক করে বলে উঠল,
“আরে দূর এই মদনার কথা বলে কি হবে? সে ল্যাদিরে নিয়া ভাবতাছে। কি যে পাইল ওই নাক দিয়া হিঙ্গুল পড়া মেয়ের মাঝে।”
তুহিন শুনল। জিদানের দিকে তাকিয়ে মাথার নিচের বালিশ তুলে ফিকা মারল তার নাক বরাবর। ছুঁয়েছেও সইসই। ও কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“আর একবার যদি আমার কালনাগিনীরে নিয়ে কিছু কবি তো তোদের প্যান্ট খুলে পা’ছায় লাথ্থি দিয়া খাদে ফালাব।”
“চেতিস না মামা। আমরা তো তোর ভালোর জন্যেই বলছি। দেখ মেয়েটা অনেক ছোট। তোর সাথে কোনো দিক দিয়া মানায় বল? আরে ওই মেয়ে তো তোর শরীরের ভরটাই নিতে পারবে না মামা। শুধু শুধু কষ্ট..”
নাদিমের কথা শেষ হবার পূর্বেই তুহিন উঠে বসল। নাদিমের ঘাড়টা বিছানায় চেঁপে ধরে মনের শান্তিতে কয়েকটা গা বসিয়ে দিয়ে রাগান্বিত রূপে উঠে বসল। হাবভাব বেশ সিরিয়াস করেই সে সবাই কে জানাল,
“আমার এই বিষয় নিয়ে আর কোনো হারা’মিরবাচ্চা যদি কথা বলিস তো তোদের বন্ধুত্বের খেতায় আগুন। আমি আমার বিষয়ে সিরিয়াস। জীবনটায় এই একটা বিষয়ে কেউ টলাতে পারবে না আমায়। দরকার পরলে ওর জন্যে ১০ বছর অপেক্ষায় থাকব। ওকে নিয়ে যে আমি কোনো মজা করছি না তোরা নিশ্চয় বুঝেছিস? আর কেউ এসব নিয়ে যদি উসকানি মূলক কিছু বলিস তো খবর আছে। মনে রাখিস সব হারামজাদার দল।”
তুহিনের ক্রোধ দেখে বাকি ৮ জনের মাঝে একটা থতমত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তুহিনের এমন আচারণ তারা খুব একটা আশা করেনি। সবটাই হেয়ালি ভাবে নিয়েছে। তবে ওর এমন রাগের বহিঃপ্রকাশ তাদের সবাই কে বাকরুদ্ধ করার মতোই।
নিশীথের রাত চারিদিকে টইটুম্বুর। তারউপর ঈষৎ কুয়াশাও বাড়ছে ধীর গতিতে। অন্ধকার আর ধোঁয়াশায় একটু দূরের কিছুও দেখা যাচ্ছে না। ঝিঁঝিঁপোকা আর বানালি পোকার ডাক পরিবেশটাকে থমথমে করে দিয়েছে। গায়ে পাহাড়ি এলাকার হিমেল বাতাস ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব করে দিচ্ছে। আধোআধো চোখ খুলে মায়রার ঘুমটা এমনি করেই ভেঙ্গে গেল। চোখ জড়ানো ঘুমে তাকিয়ে দেখতে পেল একটু দূরে সোফায় বসে ক্যাপ্টেন মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কিছু করছে। মায়রা চোখ ঢলতে ঢলতে উঠে বসল। বিছানার হেডে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসল সে। শঙ্কিত নজরে ইহাম তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
“উঠে গেলে কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে কি মায়রা?”
সদ্য ঘুম জড়ানো চোখের নিভে আসা পাপড়ি কপাল ও ভ্রু দ্বয়ের সংকুচতা, বিরক্তি প্রকাশ করার জন্যে নিশপিশ করা ওই অধরযোগল তাকে বড্ড ভ্রমে ফেলে দিচ্ছে। তাকে তার গণ্ডি থেকে বের করে লাগামছাড়া করতে মত্ত হয়েছে। নিজের এই বেসামাল স্পৃহা দমাতে সে নজর ঘুরালো।
“সব সমস্যা আপনাকে বলতে যাবো কেন আপনি? আমার ইচ্ছা তাই উঠেছি।”
“এই মেয়ে সহজ কথা কি তুমি সহজ ভাবে নিতে পারো না? ত্যাড়ামি করতে খুব ভালো লাগে তোমার?”
“লাগে। আমার গার্ডিয়ানের মতো জেরা না করে এবার পায়ের এটা খুলুন। আমি তখন খুলতে পারিনি?”
“তোমার কি ডাউট আছে এতে কোনো প্রকার?”
মস্তিষ্ক খুব বেশি জাগ্রত হয়নি বোধহয় মেয়েটার। সে ইহামের কথা না বুঝার ভঙ্গিতে প্রশ্নাত্মক চাউনিতে তাকিয়ে রয়েছে। লোকটা কি বুঝাতে চাইছে তাকে? সে তার গার্ডিয়ান? এটাই দাবী করছে নয় কি? লোকটা কি জানে না একজন অভিভাবক হবার আগে তাকে তার দায়িত্ব টা পালন করতে হয়। সঠিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই তৈরি হয় একজন অভিভাবক। এই লোকটা তার কোন দায়িত্ব টা পালন করেছে? এসব কথা তার কাছে নিহাত ফালতু অনর্থক মনে হলো। তাই বুঝি মাঝরাতেই রাগ হলো তার। অপ্রসন্ন স্বরে বলে উঠল,
“আপনি আপনার ফাউল কথা আমার সামনে বলতে আসবেন না। নিজেকে গার্ডিয়ান ভাবার কোনো অবকাশ আছে আপনার? একজন মানুষের কোনো দায়িত্ব পালন না করে কোন মুখে অভিভাবক হওয়া যায় শুনি? অবাস্তব কথাবার্তা কিভাবে বলেন আপনি?”
“পুরনো কথা বাদ দাও।”
“কেন দিব? কিসের সুখে দিব পুরনো কথা বাদ? নাকি আপনি ভয় পাচ্ছেন আপনার সেই কলেজের সুন্দরি শাড়ি পরা মেয়েটার কথা না তুলি? তাকে তো আপনি পছন্দ করেন এই কারণেই তো আমাকে সেদিন বারণ করেছিলেন আর শাড়ি না পরতে। এই আপনি না করার কে শুনি?”
ইহাম চুপচাপ তাকিয়ে থাকল। মায়রার রাগান্বিত চেহারায় অদ্ভুত জৌলুশ বের হয়েছে বোধহয়। কেমন তাণ্ডবী তবুও মুগ্ধকর লাগছে। মায়রা কি সেই কথা এখনো মনে ধরে বসে আছে নাকি? সেই কথার জোর কি আরো বেশি রাগিয়ে তুলছে তাকে? ইহাম ঘাড় বাঁকিয়ে ঈষৎ হাসল। তারপর এগিয়ে গেল মায়রার কাছে। উপর থেকে চাদরটা সরিয়ে পাটা কোমল ভাবে টেনে আনল। আস্তে করে পায়ের ব্যান্ডেজ টা খুলতে খুলতে আবারও তাকাল মায়রার দিকে। মেয়েটা চট করে চোখ ফিরিয়ে নিতে চাইলেও বুঝি ব্যর্থ হলো। সেই চোরের মতো ধরা খেলোই ইহামের কাছে। ছেলেটা চেয়েও পারছে না ওই পুচকে অবাধ্য মেয়েটার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। কেমন ছন্নছাড়া বাঁধনহারার মতো লাগে।
“চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি ওয়াশরুমে।”
মায়রা তাকাল তার দিকে। পরক্ষণে দৃষ্টি সরিয়ে শক্ত আওয়াজে জবাব দিল,
“দরকার নেই আমি পারব। আমার প্রতি এতটা উদারতা আপনার দেখাতে হবে না।”
পায়ের ব্যান্ডেজ খুলতেই স্বস্তি পেল মায়রা। ব্যথাটাও বোধহয় আগের তুলনায় অনেকটা কমেছে। আগের মতো এতটা যন্ত্রণা নেই পায়ে। এইটুক পথ নিজের পায়ে হেটে যেতে পারবে বলে একাই বিছানা থেকে নামল। বিছানায় হাত চেঁপে আস্তেধীরে দাঁড়াল। পা বাড়ানোর আগে ইহাম হাতটা ধরতে চাইলে মেয়েটা আত্মগরিমা দেখিয়ে দূরে সরাতে গিয়েও পারল না। উল্টে ইহাম শক্ত হাতে কোমর পেঁচিয়ে একেবারে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। আচানক থাবাটার জন্য মুটেও প্রস্তুত ছিল না মেয়েটা। তাই ভীষণ আতঙ্কে আঁতকে উঠল মায়রা। হকচকিয়ে তাকাল ইহামের দিকে। মানুষটার ওই অব্যক্ত চাউনির তরে। চঞ্চল ব্যাকুল ভাবে মায়রা নিজেও পরখ করতে লাগল সেই চাউনি।
“এতটা অহংকার কোথায় রাখো তুমি মায়রা?”
“আপনি এটাকে অহংকার ভাবলে ভুল করবেন মিস্টার ফাহাদ ইহাম চৌধুরী। এটা আমার আত্মসম্মান। যে মানুষটা বিয়ে করে স্ত্রী মানে না। কোনো দায়িত্ব রাখে না, খুঁজখবরটায় নেয়নি তার কাছ থেকে আমার…”
“শুহহহ। চুপ করো মেয়ে।” আঙ্গুল চেঁপে ধরল মায়রার ঠোঁটে। নরম ওষ্টের পরশ হাতে পেতেই শরীরটা নড়েচড়ে উঠল তার। বুকের ভেতর যেন হাতুড়ি দিয়ে কেউ পিটিয়ে উঠল। সেখান থেকে তীব্র ধ্বনিতে তাকে কেমন দিশেহারা করে দিচ্ছে। মায়রা খুব করে খেয়াল করল ইহাম তার ঠোঁটের দিকে এক নাগারে তাকিয়ে আছে। আচমকা তার হৃদয়টা কেমন অস্থির হয়ে উঠল। এক অস্বস্তিকর অনুভূতি তার বুকের উপর চেঁপে বসল। মায়রার নিশ্বাসও ঘন হয়ে আসল। অবাঞ্ছিত এক সময়েই মায়রা নিজের থেকে দূরে ঠেলে সরাল ইহাম কে। স্তম্ভিত ফিরলেও সে চুপ থাকল।
হঠাৎ বিকট এক শব্দ কর্ণকুহরে এসে হানা দিল দুজনেরই। মায়রা চোখ মুখ এক করে বিবৎস এক চিৎকার দেওয়ার পূর্বেই ইহাম আবারও হাত দিয়ে পেঁচিয়ে চতুরতার সাথে বুকের সাথে চেঁপে ধরল তাকে। একটা আশ্রয় পেয়েই মেয়েটা চোখ খিঁচে শক্ত ভাবে জড়িয়ে নিল ইহামের টিশার্ট।
“শা’লা সময় দিল না। ভোর হলে আমিই যেতাম তোদের কাছে। তার আগেই শু’য়োরের দল চলে এসেছিস মরতে।”
আবারও ভয়ংকর শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। বুকের মাঝ থেকে মায়রা কে তুলে আলতো করে গালের দুই পাশের এলোমেলো চুল গুলিকে ঠিক করে দিল ইহাম। ভয়ে মেয়েটা যবথব অবস্থা। তা দেখে মুচকি হাসল ইহাম। বাহির থেকে তখনো অসংখ্য এলোপাথাড়ি ভাবে ছুড়ে আসা গুলির বিকট ধ্বনি। ভয়াবহ আতঙ্কে মায়রা বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। ভয়ার্ত ফ্যালফ্যাল চোখে কেমন তাকাল তার দিক।
বুকের সাথে মিশিয়ে ইহাম মায়রা কে নিয়ে খাটের পিছনের দিক টায় গেল। শ্লথ ভাবে মায়রা কে বসিয়ে দিয়ে আবারও মেয়েটার চুল গুলিত ঠিক করে দিল হাতের তালুর সাহায্যে। ভয়ার্ত মায়রা তখন থরথর করে কাঁপছে। অভয় জানাতে নাকি অন্য কিছু ভেবে ইহাম এই প্রথম মনে হয় স্বেচ্ছায় মায়রার মাথার পেছনে হাত গলিয়ে টেনে এনে কপালে উষ্ণ পরশ বুলিয়ে দিল। আচমকা কি হলো মায়রার কে জানে। সম্পূর্ণ নতুন এক অনুভূতিতে মেয়েটা পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে উঠল। বরফের ন্যায় জমে আসা শরীর নিয়ে বিহ্বল চোখে তাকাল ভাসমানে। ইহাম কপালের উপর থেকে গাঢ় ভাবে ছুঁয়ে দেওয়া ঠোঁট নামিয়ে এনে হাতের তালুতে তুলল মায়রার মুখটা। শান্ত শীতল কন্ঠে বলল,
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৩
“চুপচাপ এখানে বসে থাকবে। আমি যতক্ষণ না এই রুমে আসব খবরদার একচুল নড়বে না। কথার অবাধ্য হয়ে কোনো ত্যাড়ামি করলে জানে মেরে ফেলব কিন্তু মায়রা।”