মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৮

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৮
সাদিয়া

ক্যাম্পে গার্ডেন এর দিকটায় ইহাম চুপচাপ নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দুটি খুব শক্ত ভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে পেছনে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। বুক ফুলিয়ে টানটান সিনা নিয়ে দম্ভের সাথে দাঁড়িয়ে আছে আনমনেই। গোধূলির আভার চারদিকে নিজেস্ব কিরণে মনোহর করে ফুটিয়ে তুলছে বসুমতিকে। ব্যক্তিজীবন কে খুব একটা প্রাধান্য সে কোনো কালেই দেয়নি। চাকরির আগের সময়টায় পড়ালেখা আর ক্যারিয়ার নিয়ে কাটিয়েছে। নিজের পছন্দ মতো এত ভালো একটা পদে চাকরি পাবার পর থেকে নিজের সবটা উজাড় করে দিয়েছে কেবল নিজের দায়িত্বে।

খুব নিয়মকানুনে চলা ওই শক্ত মানুষটাও যেমন এখন কোনো কারণে হাপিয়ে যায়। যেন কোনো একটা কিন্তুতে এসেই সর্বস্ব টা থমকে যায় তার। বুকটা আজকাল তার ভার লাগছে।ভেতরটা কেমন ফাঁপাফাঁপা লাগে বড্ড বেশি। তার এই অবস্থার মূল কেন্দ্রবিন্দু যে কোথায় এসে ঠেকেছে তার হদিসও আছে তার কাছে। এই পর্যায়ে এসে মন বারবার বলে এখন একটু নিজেকে সময় দেওয়া প্রয়োজন। একান্ত ব্যক্তিগত কিছু সময় তার বেশ অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ঠেকেছে। আর যাই হোক এই ফাঁপা অস্থির ভাবটা কাটিয়ে শান্তি স্থাপনের জন্য হলেও আবশ্যক।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মায়রা নামক অস্থিরতা টাকে এবার লাগাম টানা প্রয়োজন। সম্পর্কটার স্রোত টা কোন দিক দিয়ে বেগতিক হারে বয়ে যাচ্ছে তা বেশ অনুধাবন করতে সক্ষম সে। শুধু ওই বোকা মাথা মোটা মেয়েটাই নিজের ঘাড়ত্যাড়ামি আর বাচ্চামি তে আটকে আছে। চার মাস ১০ দিনের কাছাকাছি চলে তাদের বিয়ের। তবুও কোনো কিছুই ঠিক নেই তাদের মাঝে। যত যাই হোক এবার সরাসরি বসে হলেও একটা পর্যায়ে যাওয়া খুব প্রয়োজন। বিয়ে কি আর বউয়ের সাথে শুধু ঝগড়া আর তার ত্যাড়ামি সহ্য করবে বলে করেছে নাকি? বউ এর বয়সের অপেক্ষা করতে করতে কি বুড়ো বয়সে আদর সোহাগ পাবে তার?

ভাবনার ছেদন ঘটে ইবরাহিমের ডাকে। হঠাৎ নিরিবিলি পরিবেশটা ঝনঝন করে উঠে,
“ক্যাপ্টেন কর্নেল সিহাবুউদ্দীন স্যার আপনার অপেক্ষা করছে। জরুরি বিষয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন উনি।”
কপাল কুঁচকেই তাকাল ইহাম। চকিতেই বিড়বিড় করল,
“জরুরি তলব? আবার দায়িত্ব চাঁপিয়ে দিবে নাকি স্যার? ওদিকে বউয়ের রোগে আমি আধমরা হয়ে যাচ্ছি। এবারও কি যাওয়া হবে না নাকি? এ জীবনে মনে হয় না আমার বাচ্চা বউয়ের সোহাগ পাওয়া হবে। কাজ আর দায়িত্বের ঘাড়ে চরতে চরতে কবর অপেক্ষা করবে গো মাবুদ।”

মায়রা একটু স্বস্তি বোধ করছে। কালকেই টেস্ট এক্সাম শেষ হয়েছে। এবার যেন একটু হলেও দম নিতে পারছে। পরীক্ষা আসলেই মনে হয় কেউ তার গলায় ছুড়ি ঢেবে ধরছে। দমটা সবসময় আটকে থাকে। অতঃপর পরীক্ষা শেষের কয়েকটা দিন যেন আকাশ বাতাস এক হয়ে যায়। যদিও এমন মরোমরো করে কখনোই বইয়ের সামনে বসে থাকে না সে। কেবল ওই জাঁদরেল টার কথার রেশে জিদ ধরেই পড়াতে বসে ছিল। যদিও একদিক থেকে তার খুব ভালোই হয়েছে। পরীক্ষা গুলি খুবই ভালো হয়েছে। তাই মনটাও ফুরফুরা। মাকে খুব করে রাজি করিয়ে নিয়েছে আজই ফুপির বাসা থেকে ৪/৫ দিন থেকে আসবে। সেই জন্যেই রেডি হচ্ছে সে। তিন মাস পর আবার ফাইনাল এক্সাম। এখন কয়দিন একটু রিলেক্স না থাকলে ব্রেইন আউট হয়ে সে মারাই যাবে।

তাছাড়া মিথিলা আপুর সাথেও একটু জমপেশ কথা বলা যাবে। ওই বদ মানুষটা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাবে। সেদিন জবরীলের মতো যে ধমকিয়েছে তারপর আর কথা তেমন কথা হয়নি। পরীক্ষার দিন ম্যাসেজ করেছিল “এক্সাম টা মন দিয়ে দিও মায়রা। বেস্ট অফ লাক।” নিকুচি করেছে তোর বেস্ট অফ লাকের। গুলি মারি তোর লাকের। আমার সাথে রাক্ষসের মতো করে আবার শুভকামনা জানানো হয়। ছেদরের হাড্ডি, ঢেঁড়সের ঢেঁড়স।বকতে বকতে সে আর রিপ্লে করেনি।
অনবদ্য বাতাসে বেসামাল ভাবে উড়ছে মায়রার উন্মুক্ত চুল। গাড়িও চলছে আপন গতিতে। গটগট করে কয়েকটা পিক তুলে ডে তে দিল। আজ আসলেই অনেকদিন বাদে তার মনটা ভালো। অনেকদিন পর মিথিলা আপুর সাথে দেখা হবে। বাবাও বলে দিয়েছেন ২ থেকে ৩ দিনের উপরে সে যেন না থাকে। বাবা দিয়ে আসতে চাইলেও সে রাজি হয়নি। অনেক আবদার করে একা আসতে পেরেছে। আজ কেবলি মুক্ত পাখির মতো উড়তে মন চায়ছে।

“তো ক্যাপ্টেন সাহেব এই খবর আমার তনয়া শুনলে কি করবো কি করে ঝড় সামাল দিব সেটাই আগে বলো। তারপর না হয় দাওয়াত না পাবার জন্যে চিন্তা করব তোমায় কি শাস্তি দেবার আছে।”
ইহাম মাথা নত করে চমৎকার করে হাসল। কর্নেল সিহাবুউদ্দীন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছেলেটার হাসি দেখল। এই নম্রভদ্র স্বল্প ভাষী ছেলেটাকে উনার ভীষণ পছন্দ। মেয়ে তনয়া যেমন ইহাম কে পছন্দ করে তিনিও ঠিকই করে রেখেছিলেন প্রস্তাব দিবেন তার কাছে। কিন্তু ভাগ্য এর আগেই নিজের পথ বেছে নিয়েছে। ইশশ আর একটু আগেই করার দরকার ছিল। এখন বুঝি মনে মনে তিনি বড্ড আফসোসই করছেন।
“প্রথমত আপনার মেয়ে কে স্যার আমার চেয়ে আপনিই ভালো বুঝবেন কি করে তাকে সামলানো যায়। আর দ্বিতীয়ত বিয়েটা তাড়াহুড়োয় হয়ে গিয়েছে। তাই দাওয়াত কাউকে দেওয়া হয়নি। অনুষ্ঠান হলে নিশ্চয় পাবেন।”

“এর শাস্তি কি হতে পারে ধারনা আছে তোমার?”
“এই সামান্য কারনে কোনো শাস্তি হতে পারে এই রকম কোনো নিয়ম কিন্তু নেই স্যার।”
“হাহা হা তোমার সাথে কি আর পারা যায় ক্যাপ্টেন। তা আমাদের ট্রিট রেডি করো।”
“স্যার আমাকে ফকির করতে চাইছেন বুঝতে পারছি। এই শাস্তিই মঞ্জুর তবে?”
“গড ব্রেস ইউ ফাহাদ ইহাম চৌধুরী। বিবাহিত জীবন সুখের মধুময় হোক। দোয়া করি আমার মতো তিক্ত স্বাদ যেন তোমাকে সহ্য করতে নয় হয়। জীবনটা ত্যানা ত্যানা বানিয়ে ফেলল মহিলাটা।”
“আর আমারটা ধ্বংস করে ফেলছে ওই ঘাড়ত্যাড়া মেয়েটা। ত্যানাত্যানা না ভষ্ম হওয়াটাই বুঝি বাকি। চিন্তা করবেন না স্যার সেটাও মনে হয় করে ছাড়বে ওই বেয়াদব মেয়েটা। আমাদের বিবাহিত জীবনটাই বেদনার তিক্ততার। হায়!”

বিড়বিড়িয়ে মাথা কাত করেই ইহাম কথাটা বলে আবারও তাকাল কর্নেলের দিকে। অতঃপর মেকি হেসে গুরুত্বপূর্ণ আলাপে মনোনিবেশ করল।
রাত তখন ১০ টা। ইহাম নিজের কেবিনে বসে আছে। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তার চোখ মুখ। চেয়ারে গা এলিয়ে দিলে ঠোঁট গোল করে দম ছাড়ল। খানিকটা সময় পর ফোনটা নিয়ে ডাটা অন করল। ফেসবুকে ঢুকতেই মায়রার স্টোরিটা সবার আগে চোখে পড়ল। কারণ প্রতিদিনই সে খেয়ালে রাখে মায়রার ফেসবুকে আইডিতে। ঘুমানোর আগে এটা যেন তার চাকরির মতোই একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মেয়েটা কি কোথাও ঘুরতে গিয়েছে? এমনই তো দেখা যাচ্ছে। কি আশ্চর্য টেস্ট শেষ করে কি কেউ ঘুরতে যায়? তিন মাস পরেই ফাইনাল এক্সাম আর এই মেয়ে কিনা গায়ে হাওয়া লাগাচ্ছে। কপালের সরু ভাঁজ আরো তীব্র হলো তার। মেয়েটাকে অফ লাইনে দেখে ফোনেই কল দিল দ্রুত। একবার রিং হয়ে কেটে যাবার পর আবারও কল দিল।

মায়রা তখন মিথিলার সাথে শুয়ে শুয়ে মুভি দেখছে আর চানাচুর চিবাচ্ছে। স্কিনে তখন সানাম তেরি কাসাম মুভির দুর্দান্ত সীন। ইশশ ছেলেটা মেয়েটাকে নিজের সবটা উজার করে ভালোবাসল। নিঃস্বার্থ ভালোবেসে নিজের ভালোবাসা কেই কেমন আরেকজনের কাছে তুলেও দিতে পারছে এক বুক নীরব যাতনা নিয়ে। ইশশ এভাবেও ভালোবাসা যায়? মায়রার বুকটা কেমন দুরুদুরু করছে। ছেলেটার মুখের ইমোশনাল ভঙ্গিটা যেন একদম বলার মতো না। ইশশ কতটা নিখুঁত এক্সপ্রেশন। যেন জীবন্ত। মায়রা পুরো মুভিটা যেন ছেলেটার ওই মুখের আদলের দিকেই মায়ামায়া চোখে তাকিয়ে আছে। ইশশ ভালোবাসার অনুভূতি টা কেমন অন্যরকম। এক কাঙ্ক্ষিত মানুষের কথা মনে এসে তার হৃদয়ের অস্থির দোলাচল ক্রমাগত ভারি করেছে। ধকধক করে উঠানামা করছে সেটা।

আচমকা ফোনে কল আসায় বড্ড বিরক্ত হলো সে। পাশ ফিরে নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে ইহামের নাম্বারটা দেখেই আঁতকে উঠল। এই বেটা এখন কল দিয়েছে কেন তাকে? একটু নড়েচড়ে উঠে বসল সে। মিথিলা আপুর দিকে তাকিয়ে দেখল সে গভীর ধ্যানে আছে মুভির দিকে তাকিয়ে। আস্তেআস্তে করে উঠে গেল সে। ব্যালকুনির দিকে ত্রাস গতিতে এগুলো। আবারও পিছন ফিরে মিথিলা আপুকে পরখ করে কল রিসিভ করল।
“এই মেয়ে টেস্ট এক্সাম দিয়েই কি পড়ালেখা আকাশে বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছো? তিন মাস পর যে ফাইনাল এক্সাম সেটা কি ভুলে গিয়েছো বেয়াদব?”
ভেতরের সব অনুভূতি গুলি ভোতা হয়ে গেল মায়রার। মেজাজটাও খিটখিট করে উঠল। এই লোকের মুখে কি একটুও ভালো কথা নেই? মুখে মিষ্টি লাগিয়ে কি কথা বলতে শিখেনি সে? ওই বেরস মুখের কথা তার পিন্ড জ্বালিয়ে দেয়। কটকট করে জবাব দিল,

“আমি আকাশে বাতাসে উড়ি বা বাঁচি মরি তাতে আপনার কি? আপনি এত কৈফিয়ত চাইছেন কেন?”
“ঠিক ভাবে কথা বলো বেয়াদব।”
“আপনি নিজে ঠিক ভাবে কথা বলতে জানেন? আমাকে যে বলছেন? যেটা নিজে পারেন না সেটা অন্যকে বলেন কি করে উদ্ভট পুরুষ মানুষ।”
কিছু বলতে গিয়েও ইহাম দম নিল। নিশ্বাস ছাড়ল শব্দ তুলে। মনস্তাত্ত্বিক বিষয় গুলি আজকাল তাকে আরো রগচটা খিটখিটে বানিয়ে দিচ্ছে। যেটা একদম সমীচীন নয়। সবটা বুঝেও যেন লাগামহীন চলছে তা। অতঃপর শান্ত স্বরেই বলল,

“ভয় পাও না আমায়?”
ওই শীতল স্থবির কন্ঠ শিউড়ে তুলল মায়রা কে। চোখের পাতা গুলিও বুঝি কেঁপে উঠল। ঢোক গিলে সাহস সঞ্চয় করেই কেবল উত্তর দিল,
“ভয় পেতে যাবো কোন? বাঘ বা ভাল্লুক তো নন যে খেয়ে ফেলবেন।”
“প্রশ্ন যদি উঠে তোমাকে খাওয়ার তবে আমি বাঘ বা ভাল্লুকের চেয়েও ভয়ংকর আর হিংস্র। তখন সামলে নিতে পারবে তো মাথা মোটা?”

পুরো তাজ্জব বনে গিয়েছে মায়রা। থমকে গিয়েছে তার বাকশক্তি। কানের পাশ দিয়ে যেন বোতলার ভো ভো শব্দ আসছে। চারপাশ সব স্থির নিস্তেজ নিষ্প্রাণ। শুধু বুকের গহীন থেকে দিকদিক শব্দ আসছে কেবল। কি বলল এই লোকটা? এসব কোন ধরনের বেহায়াগিরি কথা? নিলজ্জ ছিঃ মার্কা কথা বলতে লোকটার কি বাঁধল না একটুও? কান দিয়ে যেন তার ধোয়া বের হচ্ছে। চোখ গুলিও রসগোল্লা হয়ে গিয়েছে। ওপাশ থেকে হীম শীতল গলা আসল।
“ওই গবেট? কথা বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে নাকি?”
মায়রা কোনো জবাব দিতে পারল না। গলা দিয়ে তার রা বের হচ্ছে না। ভেতরে এত বিক্ষোভ শুরু হয়েছে কেন? ওই সব কথায়? লোকটা বেহায়া পূর্ন কিভাবে হয়?

“এত বে বেহায়া মার্কা কথা বলছেন কোন অসভ্য পুরুষ?”
“অসভ্যতা কাকে বলে তুমি জানো মায়রা?”
মানুষটার ওমন শান্ত শীতল অপ্রত্যাশিত কথা কেমন অস্থির করে তুলছে তাকে। পরপর চোখের পাতা ঝাপটাল। আবার নাম্বার চেক দিয়ে নিল সে। এটা ওই কঠিন পাষাণ মানুষটাই তো? এভাবে কথা বলছে কেন তবে?
“কি কি বলছেন আপনি?”
“আই আক্সড ইউ হোয়াট ইজ আ অসভ্যতা।”
মায়রা অনুভব করছে তার গলা শুকিয়ে আসছে। ভেতরটা আরো বেশি অস্থির লাগছে।গলা দিয়ে কথা আটকে আসলো।
“পৃথিবীর কোনো শুদ্ধ পুরুষই বউয়ের কাছে সভ্য হতে পারে না। এটা আদিম যুগ থেকে পৃথিবীর অন্ত পর্যন্তই হয়ে আসবে। মাই ডেয়ার মাথা মোটা ওয়াইফ।”
“আ আপনি..”

“হ্যাঁ আমি মায়রা। এতদিন বিশুদ্ধ সভ্য পুরুষ ছিলাম। তবে আর, আর পারছি না বুঝলে। এবার আমার খুব অসভ্য হতে মন চায়ছে। এই পৃথিবীতে প্রতিটি পুরুষ একমাত্র তার বউয়ের কাছে অসভ্য আর নিলজ্জ হয়। তাই ভাবছি এবার সভ্যতা কে বিসর্জন দিতে হবে তোমার কাছে। মনটা আমার হাকুবাকু করছে একটু অসভ্যতা করতে। তুমি তৈরি তো আমার বেয়াদব বউ?”
মানুষের পরিবর্তন এত ভয়ংকর হয়? এখন তো মনে হচ্ছে আগের রুক্ষ শুষ্ক পুরুষটাই ভালো ছিল। এই স্বভাব ছাড়া বেহায়া মানুষটা কে ঠিক হজম করতে পারছে না সে। শুকনো ঢোক গিলল মায়রা। কি বলবে তাই খুঁজার চেষ্টা করল।
“এই বেহায়া মার্কা কথা কি করে বলছেন আপনি? লজ্জা লাগছে না আপনার?”
“ওমা লজ্জা নারীর ভুশন। ওটা ছেলেদের আশেপাশেও থাকে না। আর যদি হয় স্বামী তবে তার ছিটেফোঁটা ১০০ মাইলের ধারেকাছেও পাবে না ডেয়ার।”

“এই আপনি অন্য কারো নাম্বার মনে করে আমায় কল দিয়েছেন তাই না? নয়তো আপনার মতো রসকষহীন মানুষ এত বেহায়াপূর্ণ কথা কিভাবে বলে?”
“মুটেও নয়। ছাড় দিতে দিতে স্বামীকে তুমি কুস্বামী বানিয়ে ফেলছো দেখছি। না জানি কি ভাবো আমায়। এবার আর ছাড়া যায় না। খপ করে বিড়ালের বাচ্চার মতো ঘাড়ে ধরব আর বিড়াল মারব। বুঝলে?”
মায়রা হতবাকের মতো তাকিয়ে রইল। বুঝল না ইহাম কোনো নেশাটেশা করেছে কি না। আজ কথার ধাত এমন কেন? কি বলবে কি প্রশ্ন করবে তার হদিস পেল না বোকা মেয়েটা। কেবল স্তব্ধ কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ওপাশ থেকে সরল আওয়াজ ভাসল,
“কোথায় গিয়েছো?”
মেয়েটা মনে হয় আপন মনে কিছু ভাবছে। তাই কথাটা শুনলেও সঙ্গেসঙ্গে জবাব দিতে পারল না। সন্দিগ্ধ চিন্তায় দোদুল্যমান তার হৃদয়।

“ননসেন্স তোমায় জিজ্ঞেস করলাম কোথায় গিয়েছো?”
“আপনায় কেন বলতে যাবো আমি? আমায় এত প্রশ্ন করবেন না আপনি।”
“এখন থেকে বলতে হবে।”
“কে হন? এত কৈফিয়ত দেওয়ার মতো কেউ নন আপনি।”
“বুঝলাম এবার ঘাওড়া মাছ কে ছাই দিয়ে বেশ শক্ত করেই ধরতে হবে। তার বিনাশ হবে আমার হাতেই।”
“দেখুন আপনার বেফাঁস কথা আমার ভালো লাগছে না ফোন রাখুন অসভ্য পুরুষ।”
“আমায় একটু সময় দাও মায়রা অসভ্যতা কি সেটা তোমায় অস্থিমজ্জায় হাতে কলমে শিখিয়ে দিবো আমি। শুধু একটু ছুটির অপেক্ষা।”
মায়রা আর সইতে পারল না। গট করে কল কাটল। কি সাংঘাতিক ব্যাপার। পরিবর্তন ভয়ংকর কেন? এই যে এখন তার বুক দুরুদুরু করছে। নিশ্বাস আটকে আসছে। ওই চাঁপা কষ্টের চেয়ে আরও দ্বিগুণ বেশি তার পীড়া হচ্ছে বুকের ভেতর।

সকাল সকাল মায়রার ফুপু ভাতিজির জন্যে গরম গরম খিচুড়ি, বেগুন ভাজি, আর কষা খাসির গোশত রান্না করেছে। বেলা তখন ১১ টার উপরে। মায়রা ওয়াশরুম থেকে আসার সাথেসাথে তার ফুপি আনতারা বেগম হাত টেনে ধরেন তার। বিছানায় বসিয়ে বলেন,
“আমার আম্মা আগে এইটুক খাইয়া নে। বল ফুপির রান্না কেমন হইছে।”
“ফুপি টাওয়ালটা তো রাখতে দাও।”
“ওটা আমার কাছে দে। আমি মেলে দিব। তুই আগে খেতে বোস। দেখ তোর পছন্দের খাবার।”
মায়রা খুশিতে গদগদ। বিছানার উপরেই মিথিলা আর সে খেতে বসেছে। মায়রার খাওয়ার তৃপ্তি ভাব দেখে তিনি আহ্লাদী গলায় বললেন,
“আম্মা জলপাই এর আচার আর বোম্বে মরিচের আচার আছে। আনব?”
মায়রার ইঙ্গিত পেয়ে তিনি দ্রুত বড়বড় কাঁচের দুই বোয়াম এনে রাখলেন মেয়েদের সামনে। অতএব মায়রার গা বুলাতে বুলাতে বললেন,

“আম্মা রে তোর পছন্দের ইলিশ মাছ রান্না করছি। তুই খা আমি রান্নাঘরে গেলাম। কিছু লাগলে মিথিলা কে বলবি।”
“তুমি যাও তো আম্মা রান্নাঘরে। আমরা ছোটটা যে আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে। তুমি চিন্তা করো না যাও।”
খাওয়ার ফাঁকে মায়রা ধীর কন্ঠে সব বলে দিল মিথিলা কে। সব শুনে সে কড়া গলাতেই জবাব দিল,
“এই বোকা মেয়ে আমি তোকে এত বারবারি করতে বলেছিলাম? তোকে এত তাড়াতাড়ি গলে যেতে বারণ করেছিলাম কিন্তু জোরটাও তো খাটাতে বলেছিলাম। সেটা তো করিসনি। তোর কথাতে কিন্তু মনে হয়েছে একটুও বেশিই করে ফেলেছিস। শুধু মুখ ফিরিয়ে নিলেই হয় না। কখনো কখনো একটু নরম হলেও পুরুষ মানুষ বরফের মতো গলে যায়। তুই তো উনার সাথে যেচে কখনো ভালো করে কথাও বলিসনি। সবসময় ঘাড়ত্যাড়ামি আর একটু বেয়াদবও করেছিস। তবে? এত ছোটও তো তুই নস। যে আমার অক্ষরে অক্ষরে কথা মানবি নিজের একটু বিবেক মাথা না খাটিয়ে।”

“তুমিই তো বলেছো তাদের ছেড়ে দেওয়ার কথা বললে একদম কাবু হয়ে যায়। কিছুদিন পাত্তা না দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
মিথিলা কপাল চাপড়ে বলল,
“হায় আল্লাহ। তোকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতে বললাম কখন?”
“ওই যে বলেছিলে রিফাত ভাইয়া কে ব্রেকআপ এর কথা বললেই উনি সব কিছুতে কাবু হয়ে যায়?”
“তার মানে তুই সেই কথা গুলি নিজের মনে করে গেঁথে নিয়েছিস? ওরে গু খাওয়া মাইয়া, রিফাত আর ইহাম কি এক? ও আমার বয়ফ্রেন্ড আর ইহাম ভাই তোর হাজবেন্ট। রিফাতকে চাইলেই আমি ছেড়ে দিতে পারব কিন্তু তুই পারবি? সব এত সহজ? আমি তোকে এভাবে বলেছি? বা ছাড়বার কথাই কি বলেছিলাম? আমি তোকে বলেছিলাম কিছুদিন একটু কথা না শুনতে পাত্তা না দিতে। তাই বলে এতদিন আর এত কিছু?”
মায়রা কেঁদে ফেলল। নাক টেনে বলল,
“তো আমি কি এত কিছু জানি? এর আগে আমি কোনো রিলেশন এ গিয়েছি? তুমি যা বলেছো তাই যে মেনে উনার সাথে এমন করেছি সেটাও কিন্তু নয় আপু। উনি আমার সাথে এমন ভালো ব্যবহারই করেনি যে আমি গলে যাবো। উল্টে গবেট বেয়াদব মাথা মোটা যা তা বলে। তখন রাগ কার না হয়? উনি কি একটু ভালো করে কথা বলতে পারেনা?”

“দেখ মায়রা সব পুরুষ এক না। সবার মেন্টালিটিও এক নয়। তুই তোর মেন্টালিটি নিয়ে থাকিস আর উনি উনার টা। এই কারণেই হয়তো তোদের সম্পর্কটা এক জায়গায় থেমে আছে। সম্পর্ক ঠিক রাখতে অনেক সময় অনেক পদক্ষেপ নিতে হয়। কিন্তু তা বলে এই নয় যে সেই একই রেশ ধরে দিনের পর দিন চলতে হবে। এবার অন্তত সম্পর্কটা একটু উন্নতি কর। এখন তো মনে হচ্ছে সেদিন আমি ওই কথা গুলি না বললেই ভালো করতাম। আমার ওই কথা গুলিই মনে হয় তোকে আরো বেশি ক্ষেপিয়ে দিয়েছে।”
“তুমি বারবার একই কথা বলছো আপু। আমি একা কিভাবে সম্পর্কটা ঠিক করব? এখন সব দোষ আমার হয়ে গেল? আর ওই রুক্ষ লোকটা? রস নাই কষ নাই তার?”

“দেখ মায়রা একটু বুঝবান হয়ে চিন্তা কর। তুই মনে করছিস উনার দোষ কারণ তুই উনাকে যেভাবে চাস উনি সেরকম নয়। এমনতো হতে পারে উনার ক্ষেত্রেও একই থিওরি কাজ করছে। তাই সম্পর্কটা টা একদম উন্নতির দিকেও ধাবিত হচ্ছে না। যাই হোক অনেক হয়েছে। আমার যতটুক মনে হয় উনি হয়তো সেদিকে একটু এগুচ্ছে। এবার তোর দায়িত্ব উনাকে একটু হ্যাল্প করা। তোকেও এক পা বাড়াতে হবে।”
মায়রা মাথা নিচু করে সবটা শুনল। মনে মনে কি ভাবল তা মিথিলা ধরতে পারল না। সে আবার ভালো করে মায়রা কে দেখে নরম সুরে বলল,
“অনেক করেছিস, পাত্তাও দিস নি বা অন্য কিছু। এবার একটু শিথিল হো প্লিজ। এটা বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডের রিলেশনশিপ নয়। স্বামীস্ত্রীর একটা বন্ধন। এটা চাইলেই এত সহজে ভাঙ্গা যায় বল? আর রিফাতের কথা যে বলছিস সেটা এখন আর নেই। তিন দিন হয় ওর সাথে ব্রেকআপ হয়েছে।”
মায়রা চরম পর্যায়ে হা করে তাকাল মিথিলার দিকে। তার মুখ তখন স্বাভাবিক। যেন খুব বেশি ক্ষতি হয়নি তার।
“কিরে তোদের খাওয়া শেষ হয় না?”

আনতারা বেগম হন্তদন্ত হয়ে রুমে আসছেন। মিথিলা ফিসফিস করে বলল,
“আম্মু কিন্তু এসব জানে না যদি এই বিষয়ে কিছু বলিস তবে তোর পিঠে ইট গাঁথব।”
রাতের হিমেল বাতাস গায়ে কাটা দিচ্ছে। শরীরের সব লোমকূপ দণ্ডায়মান। তবুও মায়রা খুব করে কিছু চিন্তায় মশগুল। মিথিলা আপুর কথাও বেশ ভাবাচ্ছে তার ছোট্ট কোমল হৃদয়। সেই ভাবনা আরো জোরালো হচ্ছে ক্রমেক্রমে। গায়ে হীম বাতায়নে শীতল হবার সাথে সাথে অনেক নতুন অনুভূতিও ডালাপালা ছেড়ে প্রকান্ড আকার ধারণ করছে। মায়রা আনমনে থেকেই নিজের ফোন বের করল। শান্ত শীতল মনটা নিয়ে কল দেবার পরিকল্পনাও করল। লোকটার সাথে ধীরস্থিরে একটু কথা বলার উদ্দেশ্য তার।

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৭

একটু নরম গলায় কথা বলে না হয় দেখুক। লজ্জা সংশয় নিয়েই ধীর করল মন। আগে ফেসবুকে ঢুকে চেক করতে নিল মানুষটা লাইনে আছে কিনা। কারণ চাইলেও বা অফলাইনে থাকলেও ফোন করতে পারবে না। নিজের ফোনে টাকা বা মিনিট কোনোটাই নেই। অগত্যা ফেসবুকে ঢুকতেই অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ছবি পড়ল তার চোখের সামনে। জ্বলজ্বল করা দুটি মানব মানবীর অবয়ব তার চোখ গুলিকে জ্বালিয়ে দিল। অপ্রত্যাশিত দৃশ্যটা বুকটা দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে। হৃদয়ের বেসামাল উচাটন নিশ্বাস অবরোধ করছে। চিকচিক করা পানি ভর্তি চোখ গুলি দিয়ে ঝাপসা হয়ে আসছে ফোনের স্কিনের দুটি মানুষের দিকে। এই কি সেই? সেই পছন্দের নারী? বুকটা প্রচণ্ড ভার লাগল মায়রার। দমটা গলায় আটকে গেল বুঝি। টপটপ করে অনাদরে কয়েক ফোঁটা নোনা দানাও গড়িয়ে পড়ল কপোল বেয়ে।

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৯