মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২২
সাদিয়া
রাস্তায় ইহাম আর মায়রার খুব বেশি একটা কথা হয়নি। ইহাম নিজ থেকেও কথা বলতে যায়নি। মায়রা শুধু ওই রুক্ষতা দেখেছে আর নীরবে ফোঁসফোঁস করেছে শুধু। তাদের বাসা থেকে ইহামের বাসায় আসতে ১ ঘন্টার কম সময় লাগে। তবুও বাসায় পৌঁছাতে গিয়ে দেড় ঘন্টা সময় লাগিয়ে দুপুর দুইটা ১৩ মিনিটে এসে উপস্থিত হয়েছে।
ইহামের পিছুপিছু গুটিশুটি পায়ে নিভৃতে মায়রা ভেতরে প্রবেশ করল। শিরিন বেগম ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন। অনেক দিন পর ছেলেকে কাছে পেয়েও নির্বিঘ্নে তাকে পাশ কাটিয়ে জড়িয়ে ধরলেন মায়রা কে। বিষয়টায় ইহাম ঘাড় বাঁকিয়ে কপাল কুঁচকে তাকাল মায়রার দিকে। তার ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন বুঝিয়ে দিতে চাইছে,
“ব্যাপারটা কি হলো? বাড়িতে পার্মানেন্ট ভাবে আসার আগেই কি সবাই কে বশ করে নিচ্ছো?”
কি বুঝল মায়রা সে নিজেই জানে কেবল। তবে ইহামের এই মুখশ্রী দেখে হাসি পাচ্ছে তার। শাশুড়ি কে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট টিপে হেসে উঠল। বউ শাশুড়ির এমন আহ্লাদ কিছুক্ষণ ভ্রুকুটি করে দেখে ইহাম চলে গেল ড্রয়িংরুমে। পারিবারিক এই বিষয় গুলিতে তার খুব বেশি পাত্তা দেওয়া আগেও তেমন ছিল না। আর এখনো নেই। বরং শার্টের উপরের দুইটা বোতাম খুলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে নিশ্বাস ছাড়ল।
“আসো মা ভেতরে আসো।” টানতে টানতে নিয়ে এলেন মায়রা কে। “আমাদের কথা মনে পড়ে না কি? ছেলে বাড়িতে থাকে না তাই বলে কি বুড়াবুড়ি কে একটু দেখে যেতে পারো না? তুহিন কে নিয়েও তো কদিন পর পর আসতে পারো। কিছুদিন পর তো একেবারেই চলে আসবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
লজ্জায় লাল হলো মায়রার মুখ। কিছু একটা ভেবে আড়চোখে তাকাল ইহামের দিকে। পিত কালারের শার্টের ভেতর থেকে সাদা উন্মুক্ত বুকের কিছু অংশ নজরে আসতেই স্তব্ধ হয়ে যায় সে। ভেতর ঘর ঢিপ ঢিপ করে আলোড়ন তৈরি করে। গলা শুকিয়েও আসে। শিরিন বেগম ঠেলে তাকে ইহামের পাশেই সোফায় বসিয়ে দিলেন। মায়রা মাথা নিচু করেই দুই হাত জড়ো করে আনে নিজের খুব কাছে।
শীতের শেষ সময় যাচ্ছে। সকালে আর রাতে বেশ ঠান্ডাই লাগে। কিন্তু দুপুরেই গরম টা লাগে। এই যেমন এখন লাগছে। তার পাশের লোকটা ভিজে গিয়েছে। ফর্শা বুকে বিন্দুবিন্দু ঘাম বেশ আকর্ষণীয় লাগছে। আড়চোখে দৃশ্যটা আবার দেখে নিজে নিজেই অস্থির হলো মায়রা। শিরিন বেগম রান্না ঘরে গিয়েছেন। ফাঁকা ড্রয়িংরুম দেখে ইহাম নিজেকে ঝুঁকিয়ে দিল মায়রার দিকে। নরম কোমল গলায় বলল,
“হঠাৎ অকারণে টেম্পারেচার বাড়াচ্ছো কেন মায়রা? এতটাও গরম আসেনি এখনো। তবে এই উষ্ণতা অস্থিরতা কিসের মেয়ে? এই প্রথম স্বামীর সাথে স্বামীর বাড়ি এসেছো তাই?”
ফোলা গাল আরো গরম হয়ে এলো মায়রার। চোখ বড় করে বিমূঢ় হয়ে তাকাল ইহামের দিকে। কিছু বলার ভাষা পাচ্ছে না সে। এই লোকটা হুটহাট তাকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে কি?
ট্রে হাতে শিরিন বেগম এগিয়ে এলেন। ইহামও দ্রুত স্বাভাবিক ভাবে বসল। মায়রা নুয়ে আসা মাথা আর সোজা করল না। দুই গ্লাস লাচ্চি আর বিভিন্ন রকম মিষ্টি ভর্তি প্লেট। মায়রা কে উপেক্ষা করেই ইহাম নিজের ভাগের গ্লাসটা টেনে নিল হাতে। মায়রা কে একটিবার না সেঁধেও ঢগঢগ করে সবটুক লাচ্চি খেয়ে আরামের ঢেকুর তুলল। পরপর বলল,
“লাচ্চি টা খেয়ে দেখো মায়রা। মার হাতে বানানো স্পেশাল লাচ্চি। সব রেস্টুরেন্ট খুঁজেও এমন সুস্বাদু লাচ্চি পাবে না তুমি। খাও খাও তাড়াতাড়ি খাও।”
শিরিন বেগম হেসে গ্লাসটা এগিয়ে দিলেন মায়রার দিকে। জড়তা মেশানো মিষ্টি হেসে মায়রা হাতে তুলে নিল সেটা। এক চুমুক খেতেই পরাণ জুড়ালো তার। আসলেই ভীষন মজার। সে প্রায় অর্ধেকটা শেষ করেছে। মন চাইছে পুরোটা খেয়ে ফেলতে তবুও চক্ষুলজ্জায় তা না করেই রেখে দিল সেটা। পাশে এখনো ইহাম বসা।
“নাও আম্মা একটু মিষ্টি খাও।” মিষ্টি আর সন্দেশের প্লেটটা এগিয়ে দিলেন তিনি মায়রার দিকে। “এখন ভাত খাবে তাই বেশি কিছু করিনি। বিকেলে যা খাবে তাই বানিয়ে দিবো।”
পাশ থেকে ইহাম বলে উঠল,
“মা ওকে অতিথির মতো এত আপ্যায়ন করছো কেন? দুদিন পর একেবারে এ বাড়ির সদস্য হয়ে যাবে সে। এটা ওর বাড়িই হবে তখন। তাহলে এখন অতিথির মতো ট্রিট করছো কেন?”
“তুই চুপ কর। সবসময় বেশি বেশি করা। নাও মা তুমি একটু কিছু খাও। হাত মুখ ধুয়ে নাও পরে ভাত দিচ্ছি।”
“না আন্টি।” মায়রা কঠিন চোখের দৃষ্টি দিয়ে তাকাল ইহামের দিকে। পরক্ষণে তাকাল শিরিন বেগমের দিকে। “আমি এখন কিছু খাবো না। গাড়ি দিয়ে এসেছি তো মাথা ঘুরাচ্ছে। এখন কিছু খেলে আরো খারাপ লাগবে আন্টি।”
“মা ডাকবে। কিসের আন্টি? মা ডাকবে মা।”
“তুই থাম তো ইহাম। ও তো মা বলেই মাঝেমাঝে আরকি একটু বদলে যায়। অভ্যাস নেই তো। তাই না মা?”
মায়রা মুচকি হাসল। আবারও কটমট করে তাকালো ইহামের দিকে। তাতে অবশ্য লোকটার যায় আসে না। সে চমৎকার ভাবেই হাসল তার দিকে তাকিয়ে। সেই হাসি আরো রাগালো তাকে। এই লোকটার সব বিষয়ে এত সারাসরি কথা আর ভালো লাগছে না।
“মা শিফু কোথায়?”
“ওর রুমেই আছে। এখন তো ঘর থেকে বেশি বেরই হয় না।”
“মায়রা তুমি মার সাথে গল্প করো আমি ফ্রেশ হয়ে শিফু কে নিয়ে আসছি।”
মনমরা হয়ে শিফু জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। বাহির থেকে ওদের শব্দ আসলেও সে বের হওয়ার আগ্রহ পাচ্ছে না। তাই নীরবে একা রুমেই শূন্যে তাকিয়ে কোনো কিছুর চিন্তায় মন্ত হয়ে উঠেছে।
“শিফু।”
আচমকা ডাকে শিফু চকিতে তাকায়। ভাইকে দেখেই ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসে। বাবা মার চেয়েও ভাইকে সে যমের মতো ভয় করে। শুকনো মুখটা নিয়ে হাসার চেষ্টা করলেও পারল না।
“আসো ভাইয়া। কখন এসেছো? আসলে আমার ভালো লাগছিল না তাই বের হইনি।”
হাসিখুশি ছটফটে মেয়েটাকে এই রূপে দেখে ইহামের বুকটা মুচড়ে উঠল। চোখের নিচের কালি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চিন্তায় মনমরা থেকে মুখে কয়েকটা ব্রণও হয়েছে। মুখটা শুকিয়ে পাণ্ডুর হয়েছে তার। শিফু ভয় ভয় নিয়ে এগিয়ে এলো তার দিকে। ভেতরে একটাই দুশ্চিন্তা ভাইয়া না তুহিন ভাই কে নিয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে। মাথা নিচু করে শঙ্কিত রূপে ঠাই মেরে আছে শিফু। ইহাম আরেক পা এগিয়ে গিয়ে বোন কে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। আকস্মিক এমন কান্ডে শিফু বেশ বিস্মিত হলো। তার ভাইয়া তার সাথে এতটা সহজ নয়। সবসময় কঠিন ভাবে শুধু শাসনই করে যায়। তবে আজ কেন তার উল্টো? ভাই কে নরম হতে দেখে আরো গলে গেল শিফু। এত দিনের চিন্তা বিষণ্ণতা সবকিছু ভাই কে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ঝেড়ে ফেলল। বেশ কিছুক্ষণ কান্না করে দম নিল শিফু। এবার ইহাম তার চোখের পানি মুছে এগিয়ে নিয়ে গেল বিছানার দিকে। চুপটি করে বসিয়ে দিয়ে শিফুকে সহজ হতেও সময় দিল।
“দেখ শিফু তুই আমার আদরের ছোট বোন। ভাইয়া এখন তোকে কিছু কথা বলব একটু মনোযোগ দিয়ে শুনিস?”
শিফু নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলেই মাথায় সায় জানাল। ইহাম আরেকটু সময় নিয়ে শান্ত গলায় শুধালো,
“পছন্দ করিস তুহিন কে?”
আত্মা চিপে আসে শিফুর। বিদ্যুৎ গতিতে চমকে তাকিয়ে থাকে ভাইয়ের মুখের দিকে। এমন কঠিন একটা প্রশ্ন করার পরেও ভাইকে শান্ত ভঙ্গিতে দেখে ঠোঁট কেঁপে উঠে তার। ইহাম কেমন করে জানি হাসল। শিফুয়ার উত্তর শুনার অপেক্ষা না করে নিজ থেকেই বলতে আরম্ভ করল,
“শিফু তুই এখনো ছোট। দুনিয়াটা এখনো তোর আওতায় ছোট। চোখে তোর রঙ্গিন চশমাও। কারণ তোর সময়টাই আবেগের। আর জীবনের এই সময়টাই মানুষ বেশিরভাগ ভুল করে থাকে। ওই যে শুধুমাত্র আবেগের বশে রঙ্গিন চশমার তাড়নায়। এই সময়ে তুই যা দেখবি যেদিকে তাকাবি সব রঙ্গিন। কিন্তু সত্যি এটাই যে চশমা টা খুলে ফেললেই সব কিছু সাদা কালো ধোঁয়াশা। এই সময়টা তুই সঠিক ভাবে কাটাতে পারলেই সত্যিকার অর্থে জীবনের রঙ্গিন স্বাদ নিতে পারবি তুই। দেখ শিফু তুই হয়তো তুহিন কে পছন্দ করিস। তবে এটা কিন্তু ভালোবাসা নয়। এটা সম্পূর্ণ তোর আবেগ আর মোহ। এটা কিন্তু কেটে যাবে। তোর রঙ্গিন চশমাটা খুলে ফেললেই বুঝতে পারবি সেটা।”
শিফু কিছু বলছে না। মাথা নিচু করে বসে থাকলেও ভাইয়ের প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে সে। প্রত্যেকটা কথার মানেও বুঝার চেষ্টা করছে।
“জানি না তুই কি ভাবছিস। তোর মনে চলছে কি শুধু বলব আমরা তোর খারাপ চাই না। তুই তোর নিজের জন্যে সঠিক টা বেছে নেওয়ার মতো এখনো বড় হোসনি। সেই বয়স তোর হয়নি। তুহিন কে তুই পছন্দ করতেই পারিস তাই বলে নিজের এই হাল করবি? ও কিছুদিন পরই বিদেশ চলে যাবে। কিন্তু তুই কি করছিস? জীবনের পড়ালেখার এত গুরুত্বপূর্ণ সময়টা হেলা করে নষ্ট করছিস না? শরীরটা খারাপ করছিস না? ও ওর মতো করে এগিয়ে যাচ্ছে তুইও তোর মতো করে এগিয়ে যা। ঠিক ভাবে পড়াশোনা কর। ভালো ভার্সিটি চান্স পা। এরপর তুহিন দেশ আসলে তোরা দুজন যেটা ঠিক করবি সেটাই হবে। একটু বুঝার চেষ্টা কর, এখন যদি তোদের কোনো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। এরপর তোরা দুজন আলাদা দুই দেশে থাকবি। বিদেশী কালচারে গিয়ে যদি তুহিনের মত পরিবর্তন হয়?
কিংবা ম্যাচিউয়ড হবার পর তুই যদি মনে করিস তুহিন কে তুই চাস না কিংবা অন্য কাউকে ভালো লাগল তখন? ভার্সিটিতে উঠার পর একটা মেয়ের অনেক মানুষের সাথেই কথা হয় উঠাবসা হয়। তখন কাউকে ভালো লাগতেই পারে। তখন কি করবি? দেখ শিফু আমরা তোদের দুজনকেই আপন ভাবি। তোদের দুজনেরই ভালো চাই। সে থেকেই এটাই চাইছি তুহিন দেশে আসার পর আর তুই আরেকটু বড় হবার পর তোরা যেটা ভালো মনে করবি সেটাই হবে।”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল শিফু। নিজ থেকেই শক্ত ভাবে ঝাপটে ধরল তার কঠিন ভাইটাকে।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই ড্রয়িংরুমে এক সাথে বসেছে। ইসহাক চৌধুরী বাসায় নেই। কি কাজে সকালে বের হয়েছেন এখনো আসেন নি। ইহাম ততক্ষণে জানিয়ে দিয়েছে তুহিন আর শিফুর বিষয়টা। বিষণ্ণতা কাটিয়ে জীবন সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক করেছে শিফু। ভাগ্যে যা আছে ভবিষ্যৎ সেটাই দিবে। শিরিন বেগম মলিন কন্ঠে বললেন,
“বাবা বিষয়টা আরেকটু ভালো করে চিন্তা করলে হতো না? ছেলেটা ভালো ভদ্র। নিজেদের মাঝে কাজটা ভালো হতো। আরেকটু ভেবে দেখ না।”
“যা ভাবার ভেবে নিয়েছি আমি। এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলো না মা।”
“একটু চিন্তা করে দেখ বিষয়টা। তুই যেই যুক্তি দেখাচ্ছিস কাবিনের পর বিদেশ গিয়ে এমনটা তো নাও হতে পারে।”
“মা প্লিজ যেটা বুঝো না সেটা নিয়ে কথা বলো না। যা করছি ওদের ভালোর জন্যেই করছি।”
“কিসের ভালো বলতো? ছেলেটা শিফুকে ভালোবাসে।”
হুট করে জ্বলে উঠল যেন ইহাম। শান্ত রূপটা পাল্টে হুংকার ছেড়ে বলল,
“ভালোবাসা মাই ফুট। এত ভালোবাসা ভালোবাসা করো কেন সবাই? তোমাদের কত বার বলতে হয় ভালোবাসা বলে কিছু হয় না। সবটাই প্রয়োজনের তাগিদ, ভালো লাগা কিংবা মায়া। প্লিজ মা অযৌক্তিক কথাবার্তা বলো না।”
মায়রা নির্বাক নিস্তব্ধ। মাথাটা ঘুরে গেল তার ইহামের কথায়। কি বলল লোকটা? ভালোবাসা বলতে কিছু হয় না? তার ধারণায় কি ভালোবাসা মাত্র দুই শব্দ? মাই ফুট? কি হলো মায়রার কে জানে? হয়তো নিজের দিকটা বিবেচনা করে বিমূঢ় ভাবে শুধু চেয়ে না থেকে বলে উঠল,
“ভালোবাসা কি শুধুমাত্র আপনার কাছে মাই ফুট?”
ইহাম কড়া নজরে তাকাল মায়রার দিকে। মুখের উপর প্রশ্ন করারটা বুঝি তার একটুও ভালো লাগেনি তা বুঝাই যাচ্ছে। তবুও মায়রা মিয়ে গেল না। বরং ভেতরের জেদ নিয়েই কঠোর গলায় আবার প্রশ্ন করল,
“আপনার কাছে ভালোবাসা মাই ফুট হতেই পারে তবে সবার কাছে নয়। ভাইয়া শিফু কে ভালোবাসে। কাবিন হয়ে গেলে আপনি যেটা ভাবছেন সেটা হবার সম্ভবনাও কম থাকবে। ভাইয়া এমনটা করবেও না। তাদের মাঝে অন্তত এই বিষয়টা থাকবে যে তারা বিবাহিত। একে অপেরের মাঝে আবদ্ধ। এই চিন্তাটা আপনার যুক্তির সাথে গুলাবে না। তাহলে শুধুশুধু আপনার সিদ্ধান্ত টা ওদের উপর চাঁপিয়ে দিচ্ছেন কেন?”
ব্যস! দপ করে ইহামের রাগের বাতি জ্বলে উঠল। কটমট করে তাকালো মায়রার দিকে। মা আর শিফুর দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। নিঃশব্দে মায়রার হাত চেঁপে ধরে হনহন করে টেনে নিয়ে গেল নিজের ঘরের দিকে। পিছন থেকে শিরিন বেগমের শত ডাক অপেক্ষা করেই টেনে ঘরে আসল। দরজাটা লাগিয়েই ক্ষিপ্ত এগিয়ে গেল মায়রার দিকে।
“এই অভদ্র বেয়াদব মেয়ে। নিজের ব্যবহার কবে বদলাবে? মুখের উপর কথা বলা চরম বেয়াদবি এটা শিখোনি? পরিবার থেকে শেখায়নি কিছু? অভদ্র মেয়ে। কি ভেবেছো একদিন একটু নরম গলায় কথা বলেছি বলে কি লাই পেয়ে গেছো? যা খুশি করবে? তোমার বাজে বিহেভিয়ার মেনে নিব আমি?”
ইহামের ক্ষিপ্ত হিংস্র রূপ দেখে থমকায় মেয়েটা। কথার ধরন চোখের পানি এনে দিলেও অবলার মতো দমে গেল না। বরং কাঁপা ঠোঁট গুলি নিয়ে মৃদু আওয়াজে প্রশ্ন করল,
“আপনি কি একটা দুমুখি সাপ ইহাম? ভালো মানুষের আড়ালে এই রূপটা লুকিয়ে রাখেন নিজের মাঝে?”
ক্রোধে দাঁত পিষল ছেলেটা। মাথায় আগুন টগবগ করে ফুটছে। দাঁত কেটে শক্ত ভাবে চেঁপে ধরল মায়রার বাহু। চিবিয়ে বলল,
“বেশি বেয়াদবি করো না মায়রা। মুখের ভাষা সংযত করো।”
মায়রাও রাগে পিষ্ট হলো। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
“একদম ছুঁবেন না আমাকে। ছাড়ুন। কি ভেবেছেন সবাই কে আপনি আপনার মতো করে চালনা করবেন? সবাই আপনার কথা শুনতে বাধ্য?”
“মায়রা যেটা বুঝতে পারছো না সেটা নিয়ে ফটফট করো না। মুখের উপর আর কোনো দিন যদি কথা বলতে দেখি তবে গাল ফাটিয়ে দিব কিন্তু বেয়াদব মেয়ে।”
বুকে চ্যালাকাঠের আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে ইহাম নিজের হিংস্র রাগী রূপ প্রদর্শন করেই আবারও চলে গেল। জ্বলন্ত বুক নিয়ে মায়রা ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। কোনো কিছু বুঝতে পারছে না সে। মাথাটা ফাঁকাফাঁকা লাগছে। ইহাম মানুষটাকে এখন পর্যন্ত সঠিক ভাবে চিন্তে পারছে না সে। এই মানুষটার চিন্তা ভাবনা, আচারণ, ব্যবহার এমনকি তাকে নিয়ে তার ধারনা সব কিছু অস্পষ্ট। কি চায়কি মানুষটা? ভালোবাসার কোনো মূল্যই যদি মানুষটার কাছে না থাকে তবে তার কাছে নিজের জায়গাটা কি? কি ভাবে তাকে নিয়ে সে? সব কিছু ভেতর ফাঁপিয়ে তুলছে তাকে। ইহাম যেন তাকে ধোঁয়াশার কূপে ফেলে দিয়েছে।
উষ্ণ দুপুর পেড়িয়েছে সেই কখন। প্রাতঃসন্ধ্যা চলছে। দূরে তাকালেই কুয়াশার আস্তরণ দেখা যায়। বিকেল থেকেই মায়রা শিফুর সাথে টুকটাক গল্প করছে। মেয়েটাকে দেখে বুঝায় যাচ্ছে ভাইয়ের বুঝ তাকে বেশ প্রভাবিত করেছে। খানিক হাসিখুশি ভাবেই কথা বলছে। কিন্তু তার ভেতরে যে আগুন? সেই জ্বলন কমবে কি করে? ইহামের জ্বালানো অনল নেভানো কি উপায়ে? কি করে এই ধোঁয়াশা কাটাবে? তার বয়স কম হতে পারে তবে পারিপার্শ্বিক কিছু বিষয় পারিবারিক কিছু পিছুটান সব নিয়ে তার ধারনা কিংবা বুদ্ধি স্বল্প হলেও আছে।
স্বামী স্ত্রীর পবিত্র বন্ধনটা চাইলেও সহজে ছিন্ন করার যায় না। আর মেয়েদের সমাজে তো সেটা আরো কঠিন। বারবার সেদিনের ইহামের বলা কথা গুলি মনে পড়ে। মন কোমল কন্ঠে যে বলেছি, ‘স্বামী স্ত্রীর বন্ধন আটুট’ সেটা? ওই একটা কথায় তো সে মনে গেঁথে নিয়ে সম্পর্কটা এগিয়ে নেওয়ার প্রবণতা দেখিয়েছে। তাকে ভালোবাসে না হয়তো তাকে ভালো লাগে ইহামের সেটা শুনেও তো সম্পর্কটা মজবুত করতে টেনে নিয়েছে নিজের দিকে। তবে কেন এখন এই রকম ব্যবহার? কি চায় সে? কোনটা মেনে নিবে? ভেতরটা জ্বলে পুড়ে খাখ হয়ে যাচ্ছে। চোখ গুলিতে তপ্ত পানি এসে ভিড় জমিয়েছে।
শিফু আনমনে বলল,
“আযান দিয়েছে ভাবি। চলো নিচে যাই।”
শিফুর কথায় স্তম্ভিত ফিরিয়ে মায়রা অন্যপাশে ফিরল দ্রুত গতিতে। চোখের পানিটুক মুছে সেও পা বাড়াল।
দুপুরে খাবার পর সেই যে মায়রার সাথে রাগারাগি করে বের হয়েছিল ইহাম আর ফেরেনি। ইসহাক চৌধুরী বিকেলেই ফিরেছেন। এখন নিজের রুমে আছেন। মায়রা আসাতে খুব খুশিই হয়েছেন তিনি। শিরিন বেগম তখন নাস্তা তৈরি করছেন। ফুটন্ত তেলে আলুর পকোরা ভেজে নিচ্ছেন। ইহামের নাকি খুব পছন্দের। শিফু নিজের ঘরে আছে। মায়রা শাশুড়ির সাথে রান্নাঘরেই দাঁড়িয়ে আছে। সাহায্য করতে চাইলেও দেন নি তিনি।
গরমগরম পকোরা দুধ চা চানাচুর আর নুডলসের বাটি নিয়ে মায়রা শিফুর রুমে যায়। খেতেখেতে গল্পও করে। মায়রা আসলে বুঝতে চাইছে শিফু তুহিন কে নিয়ে কি ভাবে। বিকেলে একবার তুহিনের কথা বলায় শান্ত ভাবে শিফু জবাব দিয়েছিল,
“প্লিজ ভাবি আমি অনেক কষ্টে ঠিক করেছি ওই বিষণ্ণতা থেকে বের হবো বলে। তুমি প্লিজ এখন এসব নিয়ে কথা বলো না। আমার সময় চাই। ভাগ্য যা দিবে ভবিষ্যতে মেনে নিব তা।”
মায়রা ঢোক গিলল। তুহিন ভাইয়া কে নিয়ে সরাসরি কিছু বলতেও পারছে না শিফুর বারণে। তবুও ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কিছু জিজ্ঞাস করবে তার আগে দ্রুত ইহাম এগিয়ে এলো শিফুর রুমে। দুজনকে একবার দেখে নিয়ে শান্ত গলায় মায়রার উদ্দেশ্যে বলল,
“মায়রা একটু রুমে আসো। প্রয়োজন আছে।”
আবারও চলে গেল মানুষটা। মায়রা শিফুর মুচকি হাসির পিছে লজ্জাই পেল একটু। সাথে তৈরি হলো সূক্ষ্ম রাগ। তখনের ব্যবহার তাকে বানালো জেদি। একনাগাড়ে নিজ মন কে শুধালো “তাকে কি প্রয়োজন? এভাবে কেন ডাকবে সে? ডাকলেই যেতে হবে নাকি?” মায়রা নিজেকে শক্ত করল। ঠিক করে নিল যাবে না।
“ভাবি যাও দেখে আসো ভাইয়া হয়তো দরকারে ডাকছে।”
মায়রা একটু হাসার চেষ্টা করল। পরক্ষণে উঠে ত্যাড়ামি করেই পা বাড়ালো ড্রয়িংরুমের দিকে। শিরিন বেগম একা একা বসে সিরিয়াল দেখছেন। মায়রাও নীরবে গিয়ে পাশে বসল। টিভিতে তখন স্টারজলসার সিরিয়াল চলে। যেটা দেখেই মায়রা চোখ মুখ শিটকে আনে। স্টারজলসা জি বাংলা এসব কি মানুষ দেখে? কোথা থেকে কোথায় চলে যায় তার কোনো আগমাথা নেই। আগে অবশ্যই কিছুটা হলেও ভালো সিরিয়াল দিতো এখন যাচ্ছেতাই। স্টারজলসার ‘বোঝেনা সে বোঝেনা’ নাটকটাই ভালো ছিল তার কাছে। প্রতিদিন নিয়ম করে টিভির সামনে বসত তখন। অনেক বছর হয় সে তা ছেড়েছে।
তাকে বসতে দেখে শিরিন বেগম মনোযোগ সরালেন। তাকিয়ে হাসলেন। মায়রাও হেসে বলল,
“মা আপনি এসব কেন দেখেন? স্টারজলসা জি বাংলার থেকে আমাদের বাংলাদেশের অনেক সুন্দর সুন্দর নাটক আছে। যা দেখতেও সাবলীল আর হাসিরও। বাস্তবিক বিষয়ও খুঁজে পাওয়া যায়। আপনি আর এসব দেখবেন না।”
মায়রার মুখ দেখে হেসে উঠেন শিরিন বেগম। সেভাবেই জবাব দেন,
“দুই একটা সিরিয়াল দেখি আম্মা। তাও মাঝেমাঝে। এখন থেকে আর দেখব না।”
মুচকি হাসল মায়রা। শিরিন বেগম রিমোট দিয়ে চ্যানেল পাল্টে দিলেন। তখনই গজগজ করতে করতে ইহাম এগিয়ে এলো। গম্ভীর শীতল কন্ঠে বলল,
“মায়রা তোমাকে ঘরে আসতে বলেছিলাম। ডেকেছি যেহেতু নিশ্চয় দরকার ছিল। একটু দেখে যাও। পরে আবার এসো।”
মায়রা কি বলবে বুঝল না। হতবাকের মতো তাকিয়ে রইল ইহামের দিকে। পরক্ষণে শাশুড়ির দিকে তাকাতেই লজ্জায় মাথা নুয়ে আনল। ভদ্র মহিলা মিষ্টি করে হাসলেন। “যাও দেখো গিয়ে আম্মা।” মায়রা কোনো জবাব দিতে পারল না। শুধু বিরক্ত লাগছে তার। চক্ষুলজ্জা বলেও হয়তো মানুষটার কিছু নেই। নিজের মা কি ভাবল সেই চিন্তা আছে তার? আর কিসের এত দরকার? সে কি পাকাপোক্ত ভাবে এই বাড়ির গিন্নি নাকি যে প্রয়োজনের তাগিদ টা আসবে। তবে বারবার এত তলব কিসের? তখনের ব্যবহারের কথা মনে হতেই আরো বিরক্ত হলো সে। শাশুড়ির সামনে কোনো ত্যাড়া জবাবও দিতে পারছে না।
“কি হলো মায়রা আসো। এখনি এসো কিন্তু। আমার যেন আবার ডাকতে না হয়।”
ইহাম চলে যেতেই। শিরিন বেগম উঠলেন। “যাও মা দেখো ছেলেটা কি বলে। আমি তোমার শ্বশুরের কাছে যাই।”
শিরিন বেগম উঠতেই রাগ ফুটে উঠল তার মুখে। গটগট আওয়াজ তুলে চলল ইহামের ব্যক্তিগত ঘরটায়।
“ষাঁড়ের মতো ডাকছেন কেন? কি প্রয়োজন আমাকে দিয়ে আপনার?”
ইহাম জবাব দিল না। দুইটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“একটা তোমার। আরেকটা শিফুর।”
আড়চোখে মায়রা একবার দেখল প্যাকেট গুলি। কিন্তু ধরলও না জবাবও দিল না। আগের মতোই অন্যপাশে মুখ করে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ওমন করে থাকতে দেখে ফোঁস করে দম ছাড়ল ইহাম। এগিয়ে গেল তার কাছে। মুখটা বাড়িয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে,
“তখনের জন্যে রেগে আছো?”
জবাব দিল না মায়রা। বরং ওই কথা কিংবা গলার স্বর যেন ভেতরের যন্ত্রণার আগুন জ্বালিয়ে দিল আরো বেশি করে। ইহাম এবার তার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। চিবুকে হাত দিয়ে মুখে উপরে তুলে বলল,
“মুখ ফুলিয়ে রেখো না মাথা মোটা মেয়ে। ভালো দেখায় না।”
রাগে যন্ত্রণায় ফুলে উঠল মায়রা। কি পেয়েছে এই লোকটা? ভালোবাসবে না, আবার যখন যা মন চায় তেমন ব্যবহার করবে? মন চাইলে সোহাগ দেখিয়ে কথা বলল তো আবার আবার হিংস্র রাগটাও দেখিয়ে দিবে? গাল ফুলিয়ে মায়রা হাতটা সরিয়ে দিল ইহামের। আবারও মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। তাকে এভাবে ফুঁসতে দেখে খানিক হাসিই পেল ইহামের। মেয়েটার বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে দেওয়ার স্বভাব আছে। ভেতরের জেদটা কেমন ফুঁসিয়ে তুলছে তাকে। এক গালে হেসে ইহাম তার ####বাহু চেঁপে ধরে টেনে বিছানায় আনল। জোর করে বসাতে চাইল মায়রা তা হতে দিল না। বরং হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
“ছাড়ুন আমাকে একদম ধরবেন না। হাত সরান।”
“ঠিক আছে ধরব না। বসো চুপচাপ।”
“আপনি যখন যা বলবেন তাই শুনতে হবে?”
“আচ্ছা এখন শুনো। চুপচাপ বসো। নয়তো কিন্তু আবার ধরে বসাবো?”
মায়রা মুখ ফুলিয়ে নিভৃতে বসল। ভেতরের দাউদাউ আগুন তাকে আরো ক্ষিপ্ত বানিয়ে তুলছে যেন। আড়চোখে তাকালো ইহামের দিকে। মানুষটা শপিং ব্যাগ থেকে কয়েকটা ড্রেস বের করে দিল। লেমন কালারের ড্রেস বেশ চকচক করছে। ব্রাইট কালার তার বেশ ভালো লাগে। রঙ টা জ্বলজ্বল করতে দেখেও চোখ সরিয়ে নিল সে।
“দেখো তো ড্রেসগুলি পছন্দ হয়েছে কিনা।”
“ঘুষ দিচ্ছেন আমায়? ভেবেছেন তাহলেই সবটা ঠিক হয়ে যাবে? নিজে ভুল করে এখন আবার ঘুষ দিচ্ছেন?”
মাথা নুয়িয়ে হাসল ইহাম। ওই হাসিটা মায়রা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখল। চোখাচোখি হবার আগেই চোখ সরিয়ে নিল সে।
“বউকে কিছু দেওয়া যদি ঘুষ মনে হয় তবে সেটাই করছি। প্রশাসনের লোক হয়েও তবে আমি এই ঘুষ কে সমর্থন জানাচ্ছি আমার পিচ্চি মিসেস।”
মায়রা জবাব দিল না। ইহাম কে নিয়ে দুটানায় দোদুল্যমান হলো মন। একেক সময় একেক আচারণের সাথে মায়রা নিজেকে সামলে নিতে পারছে না। বরং এই দুটানা আরো বেশি তাকে অস্থির করে দিচ্ছে। আরো কষ্ট পাচ্ছে সে। ঠোঁট ফেটে এবার কান্নাই চলে এলো তার। চেয়েও আর আটকাতে পারছে না। ইহাম উঠে গিয়ে ঘরে থাকা সেন্টার টেবিল থেকে আগে থেকে আনা একটা প্লেট নিয়ে এলো। সন্তপর্ণে ফুচকা গুলি সার্ভ করতে করতে আবারও তাকাল মায়রার দিকে। সবগুলি ফুচকা সাজিয়ে সেটা পাশে রেখে আরেকটু এগিয়ে গেল মায়রার কাছে। সঙ্গেসঙ্গে মায়রা অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ইহাম হেসে আবারো তার থুঁতনিতে আঙ্গুল ঠেকিয়ে নিজের দিকে মুখ ফেরায়। আধোআধো গলায় জানায়,
“তখনের বিষয়টা একটু বেশি হয়ে গিয়েছে না? প্লিজ আর কেঁদো না। মুখের উপর কথা বলা আমি ঠিক নিতে পারি না মায়রা। আমার রাগ হয় অনেক। প্লিজ কান্না থামাও।”
মায়রা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। একনজরে মানুষটাকে দেখছে। এই লোকটার এত ইগো? একটা বার কি নিজের ভুলের জন্যে সরি বলা যায় না? কেঁদে কেঁদেই সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। থুঁতনি থেকে হাত সরিয়ে ইহাম পাশ থেকে একটা ফুচকা তুলে নিল। সেটা তার মুখের সামনে ধরে বলল,
“মায়রা আমাদের সম্পর্কটা আমার মাঝে ঠিক কি এফেক্ট করেছে সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। শুধু এতটুক জানি দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক সেটা আমাদের মাঝে বিদ্যমান। চাইলেই এই পবিত্র বন্ধনটা ছিন্ন করার অবকাশ নেই। আমি শুধু জানি আমি তোমায় ছাড়তে পারব না। তোমায় আমার প্রয়োজন। তোমার সব দিকটা আমি মেনে নেই। একটু রাগারাগি করে ফেললেও মানিয়ে নিও?”
“আমি কি শুধুই আপনার প্রয়োজন? তাই আপনি আমায় ছাড়বেন না এই তো?”
“আগে তোমায় আমি তেমন পাত্তা না দিলেও কিংবা খুব বেশি কিছু মনে না করলেও ইদানীং তুমি আমার মাঝে ইফেক্ট করো। আমার মাঝেও তুমি প্রভাবিত হও। কাল রাতের পর সেটা আরো তীব্র হয়েছে মায়রা। আমার গভীরে স্থান নিয়েছো তুমি। তাহলে কেন আর কিভাবে ছাড়ব বলো? একটু রগচটা আর রেগে কথা বলি বলে এসব বলছো?”
ইহাম উত্তরের আশা না করে ফুচকা টা খাওয়ার ইশারা দিল। মায়রা করুন মুখে ছলছল নয়নে কেবল মাথা দিয়ে ইশারায় না করল। ইহাম ম্লান হেসে গালের দুই পাশ ধরে মুখে ঢুকিয়ে দিল তা। অতঃপর হাতে বৃদ্ধাঙ্গুলিতে লেগে থাকা তেঁতুলের রসটা নিজের ঠোঁট দিয়ে চেকে নিল। সবটা দৃশ্যই দেখল মায়রা। মুখের ফুচকাটা চিবিয়ে শান্ত ভাবে প্রশ্ন করল,
“আপনি আমায় ভালোবাসেন না তাই না?”
ইহাম সঙ্গেসঙ্গে জবাব দিল না। বরঞ্চ আরেকটা ফুচকার মাঝে তেঁতুলের টক ঠেলে নিঃশব্দে মায়রার মুখের সামনে ধরল। মায়োরা ভিজে বিড়ালের মতো ওই মায়াবী মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রইল লোকটার। বোকার মতোই মাথা নাড়িয়ে অসম্মত জানাল। তবুও শুনল না সে। গাঢ় ভাবে ইশারায় মুখ খুলার জন্যে বলতেই মায়রা মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাধ্য হয়ে তাই করল। পরক্ষণে শীতল আওয়াজ তুলল কন্ঠে।
“আচ্ছা মায়রা ভালোবাসা কি? তোমার কাছে ভালোবাসার বর্ণনা কি? আমার মাঝে ভালোবাসার ব্যাখ্যা বিস্তার করে না। আমার জীবনে কখনো ভালোবাসা প্রেম আসে নি। তাই সেই অর্থে ভালোবাসা কি তা আমি জানিও না। কালকেই বলেছি তোমাকে আমি ভালোবাসি না। তবে পছন্দ করি। এই পছন্দ কি ভালোবাসার সূত্রপাত বলো? আমার জীবনে আমার পরিবারের বাহিরে তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যাকে আমি অনুভব করতে পারি। যে আমার খুব গভীরে সেটা ভালোবাসা কি না জানি না।
তোমার প্রতি আমার অনুভূতি টা আসলে ঠিক কি নামের আমি সেটা এখনো ঠাউর করতে পারিনি। বিয়ের পরপরের হিসাবটা বাদ দাও। আমি ছোট বেলা থেকেই ভেতরের অনুভূতি টা সবাই কে সহজ ভাবে প্রকাশ করতে পারি না। চাইও না আসলে। একটু চাঁপা স্বভাবটাই আমার কাছে বেশ স্বস্তির।
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২১
তোমার প্রতি আমি ভালো লাগার অনুভূতি টাই কি প্রকাশ করতে পারছি বলো? তাই বলে এই নয় যে তোমাকে আমি চাই না। আমি আমার স্বভাবের বিরুদ্ধে না গিয়ে তোমার সাথে একটু কঠোর ভাবে কথা বললে কিংবা রাগারাগি করলে যে তোমাকে আমি পছন্দ করি না, দেখতে পারি না কিংবা ভালোবাসি না সেটা ভাবা বোকামি নয়কি? মায়রা আমাকে আগে একটু সময় দাও একজেক্টলি ভালোবাসা কি সেটা উপলব্ধি করার।”