মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২৭
সাদিয়া
অম্বর সাদা ফকফকে হতেই গ্রামের বিয়ে বাড়িটা কোলাহলে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সকাল হতে না হতেই রব রব আওয়াজে মনে হলো খুব বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। এত আওয়াজপূর্ণ বাড়িতে আর ঘুমিয়ে থাকার উপায় নেই। কান পাতাই যাচ্ছে না বাহির থেকে আসা গুঞ্জন কলরবে। সকাল হতে না হতেই শুরু করে দিয়েছে বিয়ের আমেজ।
সকাল তখন ৮ টা বেজে ৩৭ মিনিট। শীতের পুরোপুরি রেশ কাটেনি এখনো। হাল্কা মৃদু শীতল বাতাস গায়ে এখনো অনুভব হয়। কোনো দিন আবার সকাল থেকে গরমের মাত্রা উপলব্ধি করা যায়।
মায়রা ফ্রেশ হয়ে ধীর পায়ে মাঝরুমে আসে। বাড়িটা বেশ বড়সড়। গ্রামের আর সব বাড়ি তুলনায় হালিমা বেগম নিজের বাড়িটা বেশ সুন্দর পরিপাটি করে তৈরি করেছেন। হালিমা বেগমের সংসারও খুব বড় নয়। শ্বশুর শাশুড়ি নেই। তিন ছেলে এক ছেলের বউ, নাতনী আর স্বামী নিয়ে উনার সংসার। হালিমা বেগমের স্বামী করিমুল্লাহ সিদ্দিক ধানের বিরাট ব্যবসায় করেন। বড় ছেলে হিকমাত বাবার সাথেই পরিচালনা করে ধানের পরিমাপহীন ব্যবসায়। মেজো ছেলে হিমেল একজন আইনজীবী। আর ছোট ছেলে তো আড্ডায়, মাস্তিতে ডুবে থেকে ভার্সিটির গণ্ডি পের হয়নি এখনো। মাঝঘরে আসলে দেখা হলো হিকমাতের বউ রুবিনা ভাবির সাথে। তিনি তখন টেবিলে খাবার সাজাচ্ছেন। টেবিলে বাহারি খাবার দেখে কপাল কুঁচকে নিল মায়রা। একবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিল। রান্নাবান্না কি ফজরের পর থেকেই শুরু করে দিয়েছে নাকি? ধীর পায়েই সে এগিয়ে গেল। রুবিনা ভাবির পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ভাবি দিন আপনায় কিছু সাহায্য করি।”
রুবিনা তখন হাস্যোজ্জ্বল চোখে তাকাল তার দিকে। সে এক ধ্যানে মহিলাটার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন এই হাসিতে কোনো লুকোচুরি কিংবা ভণিতা নেই। একদম মনের গভীর থেকে ঠিকরে পড়ছে চেহারার জৌলুস। মানুষটা সবসময় এমন মুখ করে থাকে। যেন শ্রেষ্ঠ সুখী। জীবন কি এত আনন্দের উনার কাছে? এভাবে সবসময় এত নিখুঁত বাস্তব করে হাসে কি করে সে? মন থেকে কিভাবে এত তৃপ্তিময় আনন্দ হাসি হয়ে বের হয়? রুবিনা ভাবি তখন ঠোঁটে মিষ্টি হাসি তুলে নরম স্বরে বললেন,
“সেকি বলো মেয়ে? তুমি হলে আমাদের বাড়ির অতিথি। তাও প্রথমবার এলে খালা শাশুড়ির বাড়ি। তুমি কাজ করতে যাবে কেন? বরং এখানে বসো।”
“কোনো সমস্যা নেই ভাবি বলুন না কি করতে হবে।”
“তুমি কিন্তু আমার থেকে বয়সে ছোট হবে। সম্পর্কেও। তাই নাম ধরেই ডাকতে পারি তো?”
রুবিনার মিষ্টি হাসি মুগ্ধ হয়ে দেখল মায়রা। গায়ের রং এতটা ফর্শা ধবধবে নয়। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ কিন্তু চেহারায় মায়া উপছে পড়ছে। এত মিষ্টি দেখতে।
“আপনি চাইলে ভাবি আমাকে তুই করেও ডাকতে পারেন। আপনি তো আমার বড় বোনের মতোই।”
রুবিনা চকিতে তাকাল মায়রার দিকে। কাজ রেখে মলিন মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার চেহারায়। পরক্ষণে ম্লান হেসে মায়রার নরম গালে হাতের তালু স্পর্শ করে বলল,
“তুমি খুব ভালো মায়রা। খুব মিষ্টি দেখতে।”
“আপনার থেকেও কম আছি। আচ্ছা ভাবি একটা কথা বলি?”
“তোমার যত মন চায় তত বলো না। কোনো মানা নেই।”
রুবিনার এত মার্জিত হাসিমুখের ব্যবহার বারবার মুগ্ধ করছে মায়রা কে। আগ্রহ দমিয়ে রাখতে অক্ষম হয়ে মায়রা নিবিড় গলায় প্রশ্ন করল,
“ভাবি, আপনি সবসময় এত সুন্দর করে হাসেন কি করে? দেখে বুঝা যায় যেন অন্তর থেকে হাসছেন।”
রুবিনা কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। শূন্যে তাকিয়ে রইল কেবল স্থির ভঙ্গিতে। হাতের কাজ ছেড়ে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে কেমন করে। খাবার সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা কিংবা অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার কোনো তোরজোড় নেই। ঠোঁটে লেগে আছে এক টুকরো নিম্প্রভ হাসি। যেন কোনো ভাবনায় তলিয়ে গিয়েছে সে। মায়রার কৌতূহলে কপাল কুঁচকে এলো। রুবিনার গা স্পর্শ করে মৃদু আওয়াজে ডাকল “ভাবি” বলে। হঠাৎ রুবিনা চমকে উঠল। থতমত খেয়ে তাকাল তার দিকে। ক্ষণে ম্লান হাসি মুহূর্তে প্রাণবন্ত রূপ ধারণ করল। যেন গভীর থেকে ফুটে উঠল আনন্দের এক টুকরো হাসি। খাবারের প্লেট গুলি সুন্দর ভাবে সাজাতে সাজাতে আওয়াজ তুলল রুবিনা।
“ছয় বছর বয়সে মা ম’রছে। তার কয়েক মাস পরেই ঘরে সৎ মা এলো। প্রথম ভালো কাটলেও সৎ মায়ের ঘরে প্রথম সন্তান হতেই বোধহয় আমার কপাল পু’ড়ল। সাত বছর বয়স থেকে জীবনের দুঃখ কষ্ট সব সয়ে নিয়েছি। কত রাত না খেয়ে পান্তাভাত খেয়ে কাটিয়েছি জানি না। সারা দিন গরুর মতো কাজ করলেও দিন শেষে পেট ভরে খেতেও পারিনি। সংসারের সব কাজ একা করতাম। ঘরে ভালো রান্না হলেও আমার পাতে জুটতো গতকালের বাসি তরকারি। আমার মনে আছে পুরো একটা বছর আমি মাংসের একটা টুকরো পায়নি পাতে। আমার পেটে গোশতের একটু ঝোলও জুটত না। বাসি গান্দা হওয়ার পর সেটা আমার কপালে জুটত। সব মিলিয়ে নরক থেকে আমি এই বাড়িতে আসি ১৭ বছর বয়সে।
এত বড় বনেদি বাড়ি রাজপুত্রের মতো জামাই, শ্বশুর শাশুড়ি, দেবর সব মিলিয়ে মনে করেছিলাম আমার বোধহয় রাজকপাল হলো। তবে অভাগী যেদিকে চায় সেদিকে স্বর্গ ফুরায়। বিয়ের প্রথম ২/৩ বছর শ্বশুর শাশুড়িও আমায় খুব একটা ভালো পেত না। কষ্ট থাকলেও নরকের থেকে বেশ শান্তিতে থেকেছি। শুধুমাত্র তোমাদের ভাই আমাকে যা আদর যত্ন করত। সবসময় ভালোবাসত, সান্ত্বনা দিত। এরপর আস্তেআস্তে আল্লাহর রহমতে সব ঠিক হতে শুরু করল। আমার কোলে রুমি এলো। এখন শ্বশুর বলো শাশুড়ি বলো বা স্বামী সব দিক দিয়ে আল্লাহ আমায় ভরে দিয়েছেন। রাজ কপাল খুলেছে আমার। শ্বশুর শাশুড়ির ভালোবাসা পাচ্ছি, দেবরের সম্মান পাচ্ছি। স্বামীর থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখ পাচ্ছি। মেয়ের মুখে মা মা ডাক শুনছি। দিন শেষে প্রতিবেলায় তৃপ্তি করে খেতে পাচ্ছি। এখন দুএকদিন পরপর গোশত দিয়ে ভাত খেতে পারছি। বরং এক সময় ওই হাহাকারের বস্তুটির প্রতি এখন বেতৃপ্তিই লাগে। এত ভালোবাসা পেয়েও কি করে না হেসে পারি বলো? এখন আমার এই মুখের হাসিটা অন্তর চিড়ে আসে। তবুও মনে হয় আমি বোধহয় আমার ভেতরের আনন্দ টা ঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারি না।”
মায়রা নির্বাক নিস্তব্ধ। চোখ গুলি তার ছলছল করছে। একটা মানুষের এই আনন্দ হাসির পেছনের ইতিহাসটা বুঝি এতটাই নির্মম ছিল? যার জন্যে এখন এভাবে নিজের হাসি নির্বিঘ্নে ফুটাতে কুণ্ঠাবোধ করে না? এক মিনিটের জন্য মনে হয় না এই হাসি আড়াল হয় ঠোঁটের কোল থেকে। এতটা বিষ পান করার পর এন্টিবায়োটিকের প্রভাবে কিভাবে ঠিকরে হাসে। ইশশ গোশতের আশায় মেয়েটা না জানি কতটা চাঁপা কষ্টে কাটিয়েছে দিনদিন। তার মন টাই বা কেমন করেছিল? ভাবতেও হৃদয় কাঁপল মায়রার। আর এখন রাজ সুখী সে। মানুষের দিন ঘুরতে ঠিক কত দিন সময় লাগে?
“একটা পুরুষ মানুষ চাইলেই একটা নারীকে সুখের মোলায়েম চাদরে জড়িয়ে নিতে পারে। পুরুষ নারীকে যেভাবে বিষাক্ত রোদনের বারিধিতে ডুবাতে জানে। তেমনি জ্বলন্ত অঙ্গার কেও শীতল ধারায় মুছে বুকের গহীনে স্থান দিয়ে হীম করে দিতে পারে মায়রা। একটা মানুষের সুখের শেষ ঠিকানা একটা শক্ত পুরুষ অনায়াসে হতে পারে। ভালোবাসা একটা পুরুষকে মোমের মতো গলিয়ে দেয় মেয়ে। নারীর পবিত্র ভালোবাসায় পুরুষ অন্ধ হলে জীবন ঠিকরে এই হাসি আনন্দ ধরা দিবে।”
মায়রা একদম নিম্প্রভ দৃষ্টিতে ভাসমানে তাকিয়ে আছে। চোখ মুখ তার ঝিল্লি দিচ্ছে অজানা এক প্রত্যাশায়। গাঢ় মোহ গুলি গভীর ভাবনায় তলিয়ে যাচ্ছে। ঘোর লাগা চোখ গুলিতে স্পষ্ট ভাবে খেলা করছে ইহামের শক্ত কঠোর মুখশ্রী। তীক্ষ্ণ মুখাবয়বের মায়া মায়া চাউনিতে যেন ডুবে গিয়েছে মায়রা।
রুবিনা পাশ ফিরতেই কপাল কুঁচকে নিল মায়রাকে এভাবে আনমনে মগ্ন থাকতে দেখে। পরক্ষণে তার নজর যায় মেয়ের খোলা চুলের দিকে। টপটপ করে পরা পানি দেখেই আবারও মুচকি হেসে উঠল রুবিনা। মৃদু ধাক্কা দিয়ে টিপ্পনী কেটে বলল,
“কি গো মেয়ে আমাদের রুক্ষসুক্ষ দেবরটা কে কি পটিয়ে ফেলেছো নাকি? রাতে বুঝি খুব ভালোবাসা দিয়েছে?”
হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে স্তম্ভিত ফিরতে ফিরতে এমন কথা শুনে লজ্জায় নুয়ে যায় মায়রা। মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বলে “ভালোবাসা না ছাই। সারাক্ষণ শুধু ধমকে বেয়াদব মাথামোটা বলদ বলে বেড়ায়।”
“কি গো কি বিড়বিড় করছো।”
মাথা নুয়েই নীরব কন্ঠে জবাব দেয় মায়রা।
“কিছু না ভাবি। কিছু করতে হলে বলুন না আমায়।”
রুবিনা ঠোঁট টিপে হাসল। মুখ বাড়িয়ে দিয়ে ফিসফিস করে জানাল,
“ভিজে চুল দেখিয়ে মানুষকে স্বামী সোহাগি প্রমাণ করতে হবে না। চুল গুলি বেঁধে ফেলো। মুরব্বিরা দেখলে আবার ফিসফিস শুরু করবে। এটা শহর না বোন। এখানে ন্যূনতম কাজেও ফিসফাস সঙ্গি থাকে।”
মায়রা গাছাড়া ভাবে তাকিয়ে দেখল রুবিনা কে। টকটকে শ্যামলা বর্ণের মুখটায় হাসিটা বড্ড মানায়। মেয়ে হয়েও সে মুগ্ধ হয়েই তাকিয়ে দেখে এই হাসি। কোমর সমান ভিজে চুল গুলি হাতের পেঁচে জড়িয়ে নেয় খোঁপায়। তারপর ওড়না টানে মাথায়।
“দুই জা মিলে কি কথা বলছেন বলুন তো?”
ছাই রাঙ্গা শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে ইহাম টেবিলের দিকে এলো। তার মুখে এমন ধরনের কথা শুনে রুবিনা অবাক হয়েও চাইল। হাসি মুখেই জবাব দিল,
“দেখছিলাম আরকি আমার রসকষহীন দেবরটা ঠিক কতটা রসালো হলো।”
“ছিঃ ছিঃ ভাবি আপনার মাইন্ড কত বাজে। এসব চুলকানি মূলক কথা কি আপনি আমার বউ এর মাঝেও ছড়িয়ে দিচ্ছেন নাকি? এসব কিন্তু হবে না। মানব না আমি। আমার একটাই নাদান মাথামোটা বউ।”
“একদম বাড়াবাড়ি করবেন না।” চোখ রাঙ্গিয়ে গাল ফুলালো মায়রা। “সবসময় আপনার এসব মানব না আমি।”
ইহাম চেয়ার টেনে বসল। কলার ঠিক করতে করতে বলল,
“তুমি মানলেও আমার না মানলেও আমার। ভাবির থেকে দূরে থাকবে। উনি কিন্তু সুবিধার না। ভুলভাল কিছু মাথায় ঢুকিয়ে দিবে আচাক্কা।”
“বারে তোমরা করতে পারলে দোষ না আমি বললেই দোষ। কুকুরের দোষ থাকে না এখন লেজের দোষ?”
“বুঝেছি ভাবি। ভাই কে বলতে হবে। অনেকদিন মনে হয় আপনার গালে চটকা পড়ে না।”
“আমার রসকষহীন দেবরটা বুঝি আমার জা কে চটকা দেয়?”
“সেটা কি দেখতে পাচ্ছেন না আপনি? কাল রাতেই তো দিলাম। সামনেই আছে জিজ্ঞেস করুন।”
ভ্রু উঁচু করে চোখ বের করল মায়রা। এই লোকটা তো আসলেই অসভ্য। কথার ছিড়ি কি।
“আপনি একটা অসভ্য মানুষ।”
মায়রার দাঁত কিড়িমিড়ি করা দেখে রুবিনা শব্দ করে হেসে উঠল। লাঠি খুঁড়িয়ে তখন এগিয়ে এলেন কুলছুমা বেগম।
“কিরে তোরা কি নিয়া রং তামাশা করোছ?”
রুবিনা হাসি মুখে এগিয়ে গিয়ে উনাকে ধরল। চেয়ার টেনে দিয়ে বসাতে বসাতে বলল,
“নানি বাজিয়ে দেখছিলাম তোমার গম্ভীর নাতিটা কতটা রসালো হয়েছে।”
“দেখেছো তো নানু তোমার নাতবউ এর কথা? এখন বলো ভাই কে বিচার দেওয়া জায়েজ না?”
“বাদ দে সেসব আগে কো চাঁন্দের টুকরা বউটা কেমনে পাইলি?”
ইহাম কাঁচের গ্লাসটা তুলে ঢগঢগ করে পানি খেলো। টেবিলের উপর গ্লাসটা রাখতে রাখতে খুব নেশালো তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখল মায়রার মুখশ্রী। রঙ্গিম আভা মেয়েটার মুখের জৌলুশ দ্বিগুণ করে তুলছে। লাজুক চোখের দৃষ্টি তার উপর পড়তেই কেমন চটজলদি সরিয়ে নিয়েছে। মায়রার হাসপাস দেখে ঠোঁট টিপে হেসে উঠল ইহাম। মোহনিয়া মুখের দিক গাঢ় নজর রেখেই জবাব দিল,
“চাঁন্দের টুকরা বলছো? তাহলে সেই টুকরা আমার ভাগ্যেই ছিল। তাই তো না চাইতেও পেয়ে গিয়েছি।”
লজ্জায় অস্বস্তিতে ভেতর কেমন বিচলিত হচ্ছে মায়রার। ইহামের কথার জোয়ার খেলে গেল তার বুকের খুব গহীন জুড়ে। শুকনো ঢোক গিলে ধীর গতিতে মাথা উপরে তুলল। তখনি চোখাচোখি হলো দুজনের। কি সাংঘাতিক! লোকটা এভাবে শানিত নজরে তার দিকে তাকায় কেন? এমন দৃষ্টি দেখলেই তার ভেতর খাবলে ধরে অস্থিরতায়। মানুষটার ওই মোহভরা চাউনি ভার করে দিচ্ছিল তার অন্তঃস্পট। ব্যাকুলতার সহিত দ্রুত নিজের চোখ ফেরায় মায়রা। কি ভয়ংকর অস্থিরমাখা সেই চাউনি। যেন ঠিক তীরের মতো গিয়ে বিঁধে বুকের ভেতর। আবারও গলা শুকিয়ে আসছে তার। ঢোক গিলার জন্যে ছটফট করছে ভেতরটা। কাঁপা হাতে কোনো রকম মাথায় দেওয়া ঠিকঠাক ওড়নাটা আরেকটু টেনে ধরল। ঘায়েলি দৃশ্য টা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল ইহাম। ইশশ লাল চুড়িদার পরা মসৃণ ওড়না টানা মেয়েটা কে একদম বউ বউ লাগছে। ইচ্ছা হচ্ছে টুক করে জড়িয়ে নিতে। ওই অস্থির ভাবে নিশ্বাস নেওয়া কিংবা ছটফট করতে থাকা পরিস্থিতিটা বেশ আনন্দ দিল ইহাম কে। ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা মুচকি হাসিটা আরেক পরদ প্রস্তও হলো।
“দেখলে তো নানি তোমার নাতি চাঁন্দের টুকরার থেকে নজরই সরাচ্ছে না।”
টিপে হেসে উঠল রুবিনা। লজ্জায় আরো লাল হয়ে যাওয়ার মায়রার মুখ দেখে কুলছুমা বেগম বলে উঠলেন,
“চাঁন্দের লাহান মুখ থেইকা কার চোখ সরতে চায় ক তো ছ্যামড়ির মা।”
এক বিব্রতকর পরিস্থিতি পরিবেশটাকে নীরব করে দিল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে শিরিন বেগম আসতে আসতে জিজ্ঞাস করলেন,
“কিরে ইহাম কোথায় বের হবি বাপ? নাস্তা করে ফেলেছিস?”
মায়ের দিকে চোখ সরায় ইহাম। ক্ষণে গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়,
“তোমার ভাগিনা বউ কি এক বারও বলেছে আমাকে খাবারের কথা? সেই কখন থেকে বসে আছি।”
“এমা ছিঃ, ইহাম ভাই কথার ছলে ভুলে গিয়েছিলাম। কি নিবেন সেটা বললেনও তো না।”
পাশ থেকে শিরিন বেগম জবাব দিলেন,
“ইহাম খাবার তো তোর সামনেই আছে। ওকে দোষারোপ করছিস কেন?”
ইহাম প্লেটে হাত ধুতে ধুতে বলল,
“দিন দিন ভাবি যা আছে তাড়াতাড়ি দিন। বের হতে হবে আমার।”
রুবিনা দ্রুত হাত বাড়িয়ে আরেকটা প্লেটে আতব চালের ধবধবে সাদা ভাত বাড়ল। ধোয়া উঠা গরম ভাতের সাথে ঘী মাখা আলু ভর্তা, মাছের ভাজি। সেই সাথে শিম দিয়ে ছোট মাছের মাখা তরকারি, রুই মাছের ভুনা আর পাতলা মসুরডাল। ফজরের পর থেকেই রুবিনা দুই একজনের সাহায্যে তাড়াতাড়ি করে এই টুকই তৈরি করেছে। গরম ভাতের সাথে আলু ভর্তা মাখিয়ে ব্যস্ত হয়ে মুখে দিচ্ছে ইহাম।
“আস্তে খা বাবা। এত তাড়া কেন?”
“বের হতে হবে মা। কাজ আছে।”
“সেকি আজ গায়ে হলুদ। চলে যাবি নাকি?”
আলু ভর্তার সাথে মাছ পুরে মুখে দিতে দিতে উত্তর করল ইহাম,
“ছুটি কাটাতে আসিনি মা। কাজ আছে এখানে। ছোটখাটো একটা মিশনে এসেছি। বরিশালের এত বড় মিশন ফেলে শুধু শুধু চুনোপুঁটি ধরতে এখানে এলাম।”
কথাটা শেষ করেই ইহাম তাকাল মায়রার দিকে। আর কেউ কিছু না জানলেও সে তো জানে এই এক কথায় দুই কথার মানে গুঁজে দিয়েছে সে। মায়রা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে ইহামের দিকে। চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নত করল। কুলছুমা বেগম বলে উঠেন,
“নতুন নাতবউ আমার ভাইয়ের পাতে মাছের তরকারি টা দে।”
মায়রা নড়েচড়ে উঠল। রুবিনা হাত ঠেকিয়ে ইশারা দিতেই মায়রা মাছের ভুনার বাটিটা নিয়ে এগিয়ে যায় ইহামের দিকে। মাথাটা উঠিয়ে দেওয়ার আগে ক্ষীণ আওয়াজে জিজ্ঞাস করে,
“মাথা দিব?”
“সময় নেই। একটা ছোট পিস দাও।”
এত গুলি মানুষের মাঝেও ইহাম ঘাড় পাশ ফিরিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল,
“মাথাটা তুমি খেও। এমনিতেও তো নিজেরটার মাঝে গোবর ছাড়া কিছু নেই। তাই এটা খেয়ে একটু আপডেট করো।”
কটমট চোখে মায়রা তাকায় ইহামের দিকে। তা দেখে গূঢ় হাসে ছেলেটা। ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে,
“তাড়াতাড়ি করো মায়রা। লেইট হয়ে যাবে।”
মাছের একটা বড় পিস পাতে তুলে দিয়ে ফোঁসফোঁস করে সে একটু দূরে দাঁড়াল। ইহাম একপল তাকাল সেদিকে। এই মেয়েটাকে একটু ফুলিয়ে দিতে আজকাল বেশ মজা মজা লাগে তার কাছে। যেন সবচেয়ে মজাদার একটা কাজ। মাথামোটা মেয়েটাও ফোটকা মাছের মতো ফুলে যায়।
“আম্মাজান আম্মাজান” করতে করতে হাসিবুল্লাহ তখনি এগিয়ে এলো। ডান হাতে বেচারা ভিজে গামছা পেঁচিয়ে এসেছে। সবাই তার দিকে কেমন কপাল কুঁচকে বিস্ময়কর কৌতূহলী নজরে তাকিয়ে আছে। যেন ভিজে গামছায় পেঁচানো হাত আর করুণ মুখের মানেই বুঝতে চাইছে নিজ মনে। ছেলের ডাক শুনে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন হালিমা বেগম। আনমনে প্রশ্ন করলেন,
“কি হয়েছে? কি বলবি বল?”
হাসিবুল্লাহ খাবার টেবিলের দিকে তাকিয়ে সবার দিকে একবার নজর দিল। শুকনো ঢোক গিলে করুণ মুখাবয়বে আওয়াজ তুলল।
“তোমারে কই নাই তো আম্মা। তোমারে কি আমি আম্মাজান ডাকি?”
ঘরের সব গুলি মানুষ কেবল সূক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে রইল হাসিবুল্লাহর দিকে। তার কর্মকাণ্ড যেমন তাদের সকলের কৌতূহল বাড়িয়ে দিল। কেবল মাত্র ইহাম মাথা নিচু করে ঝটপট নিজের খাওয়া শেষ করছে। তাকে এখনি বের হতে হবে। ঠিক সময়ের মাঝেই গন্তব্য স্থানে পৌঁছাতে হবে। হালিমা বেগম কপাল কুঁচকে ছেলেকে পরখ করে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে দেখলেন খাবার টেবিলের মানুষগুলির দিকে। সকলের নজরে যেন এক প্রশ্ন নিজের মা কে আম্মাজান না ডাকলে কাকে ডেকেছে এটা? শিরিন বেগম কে? খাবার টেবিলের দিকেই তো তাকিয়ে আছে হাসিবুল্লাহ। সবার মাঝে যেন এই উদ্দীপনাই খেলে গেল একান্তে। অবাক চিন্তিত ভঙ্গিতে হালিমা বেগম শুধালেন,
“তো কারে ডাকোস আম্মাজান? তোর খালামনিরে?”
বিরক্ত নাকি ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে নিল হাসিবুল্লাহ তা বুঝা গেল না কারো। খিটখিট করে জবাব দিল সে,
“আরে দূর না। আমি তো ওই লাল জামা পরা নারী কে ডাকছি।”
বিস্তর বিস্ময়ে সবাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাদের মূলকেন্দ্র বিন্দু যেন হাসিবুল্লাহ। সকলে অতি আশ্চর্যের সহিত তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আকাশ থেকে টুপ করে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু একটা খসে পড়েছে এমন নজর সবার। ড্যাবড্যাব করে একে অন্যের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে বিস্মিত দৃষ্টি স্থির করল মায়রার উপর। এখানে একমাত্র মায়রার পরনে শুধু লাল জামা। সবাই বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে দেখল কেবল। হাসিবুল্লাহ মায়রা কে আম্মাজান ডাকছে? ছিঃ ওর কি মাথা খারাপ হলো? হাসিবুল্লাহ আবারও কাতর স্বরে ডেকে উঠল,
“আম্মাজান। আপনি আমার আম্মাজান।”
কিছুক্ষণ ঘরটায় প্রতিটা মানুষ অবাক হয়ে স্তব্ধ রইল। অতঃপর খ্যাঁক করে উঠলেন হালিমা বেগম।
“তোর কি মাথা খারাপ হইছে রে হাসিব? কি ভুলভাল বকতাছোস? শরীরে জ্বর উঠছে নাকি?”
“না আম্মা কিছুই হয় নাই আমার। আমি জ্ঞানেই আছে।”
রাগ লাল হয়ে হালিমা বেগম জানতে চাইলেন,
“তাহলে বদলের বাচ্চার মতো মায়রা কে আম্মাজান ডাকোস কেন? ও না তোর ভাবি হয়?”
“ভাবি তো মায়ের মতো হয় তাই না আম্মা? তাহলে আম্মাজান তো ডাকতেই পারি।”
“আরে গাধার বাচ্চা, তুই..” তখনি বিরক্তে ডুবা উনার চোখ গেল হাসিবুল্লাহর হাতের দিকে। আঁতকে উঠেন তিনি। দ্রুত এগিয়ে যান ছেলের নিকটে। “কিরে বাজান তোর হাতে কি হইছে?”
মায়রার কৌতূহল কমছেই না। এই ছেলে তাকে আম্মাজান ডাকছে কেন? কালকেই না হাত ধরে কেমন ফ্লাটিং করা শুরু করেছিল? তবে এক রাতে কি হলো? রুবিনাও কেমন হতভম্ব হয়ে আছে। চোয়াল হা হয়ে আছে তার। কি বলে এই ছেলে? ভাবি মায়ের মতো হয়? কই তার সাথে তো হাসিবুল্লাহ মশকরা করতে এক বিন্দু ছাড়ে না।
“উফফ আম্মা ধরো না। ব্যথা খুব।”
“হাত সরা দেখতে দে আমায়। হাতে ব্যথা পেলি কি করে? ফুলে গিয়েছে তো। কি হয়েছিল হাতে?”
হাসিবুল্লাহ চোরাচোখে নজর বুলালো। পরে আমতাআমতা করে বিরক্ত অভিমুখেই জবাব দিল,
“আরে রাতে হয়তো বেকায়দায় শুয়েছিলাম তাই একটু ব্যথা করছে। রগে টান লেগে ফুলেছে হবে।”
“সেকি কথা? শুয়ার কারণে এভাবে ফুলবে নাকি?”
শিরিন বেগম এগিয়ে গিয়ে বললেন এই কথা। পাশ থেকে কুলছুমা বেগম বলে উঠলেন,
“কোন আকামকুকাম করতে গেছিলি রে হাসিবুল্লাহ? হাতে ব্যথা পাইলি কেমনে হাছা কইরা কো। এমনি এমনি কি আর ফুলছে?”
“নানি ফুলে নাই বেশি। মজা নিও না তোমরা। আমি ঠিক আছি।”
রুবিনা নিজের আগ্রহ প্রকাশ করে বলেই ফেলল,
“হাসিবুল্লাহ আমাকে তো কোনো দিন এমন করে কথা বলো নি। বরং টিটকারি দিয়ে কথা বলো সবসময়। তাহলে মায়রা কে আম্মাজান ডাকো কোন হিসেবে ভাই?”
হাসিবুল্লাহ একটা চরম ফ্যাসাদে পড়ল। চোখে মুখে বিরক্তির ভাব উপছে পড়ছে। সবাই যেন তাকে গর্তে টেনে নেওয়ার প্রতিযোগিতা করছে। মাগার পরিস্থিতিটা কেউ বুঝারই চেষ্টা করছে না। কি উত্তর দিবে ভেবেই হাসপাস করে উঠল।
ইহাম মাছ ভোনা দিয়ে খাবার শেষ করেই উঠল। গামছায় হাত মুছতে মুছতে বলল,
“বের হচ্ছি মা।”
সবাই তার দিকেই ঘুরে তাকাল। মন খারাপ করে শিরিন বেগম প্রশ্ন করলেন,
“রাতের দিকে আসবি না বাবা?”
“কাজ শেষ হলে চলে আসার চেষ্টা করব। তোমরা আনন্দ করো।”
ইহাম যাওয়ার আগে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল মায়রার দিকে। শান্ত নরম চাউনিতে চোখের ভাষা দিয়েই যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে,
“যাচ্ছি।”
মেদিনীর বুকে তখন ঘোর আঁধার নেমে এসেছে। চারিদিকে অন্ধকার ছাপিয়ে গেলেও হালিমা বেগমের বনেদী বাড়িটার চারপাশে আলো টইটুম্বুর করছে। লোকে লোকারণ্য বাড়িটা। অসংখ্য ঝুড়ি বাতি স্ট্রিট লাইটের আলো বাড়ির আশপাশের অনেকটা জুড়ে আলোকিত হয়ে আছে। হালিমা বেগমের উঠান বিশাল বড়। ক্ষেতের ধান শুকানোর জন্যে সারাবছর উঠান টা তেলতেলে থাকে। এমনকি গ্রামের কারো বিয়ে কিংবা বড় কোনো অনুষ্ঠানে এই বাড়িতেই প্যান্ডেল সাজানো হয়। আকর্ষণীয় স্টেইজ, এত আলো, সাজসজ্জা সব কিছুতে শহুরে ছোঁয়া। আশেপাশের সব লোকজন বোধহয় এই বাড়িতেই অবস্থান করছে। গ্রামের এত বড় বনেদী বাড়ির বিয়ে বলে কথা।
একটু পরই অনুষ্ঠান শুরু হবে। ভিডিও ম্যান আনা হয়েছে মুহূর্ত গুলি সংরক্ষণ করার জন্যে। সবাই কে তাড়া দেওয়া হচ্ছে রেডি হয়ে স্টেইজে যাওয়ার জন্যে। এদিকে শিফু ঘাপটি মেরে বিছানার এক কোণায় বসে আছে। হাতে তার ফোন। মা অনেক বার বলে গিয়েছে শাড়ি পরতে কিন্তু তার এক কথা। কোনো শাড়ি টাড়ি পরতে পারবে না সে। হলুদ আর সাদার মিশ্রনে একটা গাউন এনেছে সেটাই পরবে।
“শিফু প্লিজ উঠো না। চলো শাড়ি পরি দুজনে।”
“না ভাবি। আমার ইচ্ছা নেই। তুমি পরো গিয়ে।”
“দেখো তুমি শাড়ি পরবে না আমি একা পরে কি করব বলো?”
“ভাবি আমি মেয়ে। আর তুমি বাড়ির বউ। তোমার না পরাটাই কেমন দেখাবে।”
“তুমি না পরলে আমিও পরব না। পরলে এক সাথেই পরব নয়তো না। এই চুড়িদারই থাকবে না হয়।”
“প্লিজ ভাবি জোর করো না। ভালো লাগছে না আমার।”
“নিজের ভালো না লাগার কারণ গুলি কি করে চেঁপে রাখতে পারো শিফু?”
করুণ চোখে শিফুয়া তাকায় মায়রার দিকে। ভাবির কথার মানে বুঝতে পেরেই ছটফট করে উঠে তার ভেতরটা। দ্রুত নিজের আবেগ লুকাতে চোখ নামায় কৌশলে। ভেতরের অস্থিরতা গুলিকে চাঁপা রেখেই জবাব দেয়,
“ভাবি আসলে এসব শাড়ি আমার পছন্দ না। প্লিজ তুমি পরো।”
“তুমি কিন্তু আমার কথার প্রসঙ্গ পালটাচ্ছো শিফু।”
ব্যাকুলতা লুকাতে ব্যস্ত হলো শিফুয়া। কি দরকার ভেতরের চাঁপা কষ্ট গুলি কে অন্যকে জানানো? তাতে তো আর পরিস্থিতি পাল্টে যাবে না। তার চেয়ে নিজের কষ্ট যাতনা সব নিজের কাছেই রাখা হোক।
“ভাবি প্রসঙ্গ পাল্টালে যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে তবে সেটা ভালো নয়কি? বাদ দাও না এসব কথা।”
“বাদ দিয়ে কি হবে শিফু? তুমি নিজেও তো কষ্টে আছো।”
এইটুক একটা মেয়ে তবুও পরিস্থিতির সম্পর্কে কতটা বাস্তবিক। সব কি ভাইয়ের গুন? ঠোঁটে কি সুন্দর একটু নগণ্য হাসি তুলে আনল সন্তপর্ণে। মায়রা ধ্যান দিয়ে দেখল সেই হাসিটুক। এই মেয়ে তো বড় হলে ভাই কেও ছাপিয়ে যাবে মনে হয়।
“কাছের মানুষ গুলিকে ভালো রাখতে তাদের কথা মেনে নিতে হয় ভাবি। এটা আমি ছোটবেলা থেকেই শিখেছি। পরিস্থিতি অনুকূল রাখতে কিংবা পরিবারকে হাসি মুখে দেখতে নিজের কষ্ট কিছু না। আর দেখছো না আমি কেমন স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছি। এসব নিয়ে এখন ভাবছি না মোটেও। দেখি না সামনের দিন গুলি কেমন কাটে। ভবিষ্যৎ ঠিক কোথায় উপনীত করে আমায়। আমি কিন্তু মুটেও কষ্টে নেই ভাবি।”
মায়রা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল শিফুর দিকে। ঠোঁটে ফুটল তার কিঞ্চিৎ তুচ্ছ হাসি। মেয়েটা কি অভিনয় করার চেষ্টা করছে। ঠোঁটের হাসিটা যে মিথ্যে তা ছলছল চোখ গুলি যেন সাক্ষী দিয়ে যাচ্ছে।
“তুমি কিন্তু ভাইয়া কেও কষ্ট দিচ্ছো শিফু।”
চট করে মায়রার দিকে তাকাল সে। করুণ মুখটা দেখেই তার তুহিনের কথা মনে ভাসল। ইশশ ভেতরটা আবার জ্বালা করছে। চোখ গুলি তপ্ত হয়ে আসছে। কেন যেন ভেতরের শাসন গুলি শুনতে চায় না তারা। কি যে অবাধ্য হয়েছে। নিজ মনের শক্ত শাসন বুঝি নরম মসৃণ আবেগ গুলি মানতে নারাজ। চোখ গুলি টলমল করছে তার। দ্রুত মায়রার দিক থেকে মুখ ঘুরালো সে। এখনি এখান থেকে যেতে হবে। নয়তো ভাবি তাকে আরো নানা প্রশ্নের জালে ফাঁসিয়ে দিতে পারে। কোনো দরকারই নেই ভেতরকে আর দূর্বল করার।
“ভাবি শাড়ি না পরবে? তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। বাহির থেকে মা ডাকছে রেডি হতে হবে তো।”
ফোনটা বিছানার উপর রেখেই শিফু এক প্রকার পালালো। মায়রা ধ্যান ধরে দেখল সবটা। ভেতরটা ফাঁপা হলো তার। বারবার মনে হলো এই সবের পিছনে কেবল আর শুধুমাত্র ইহামের সিদ্ধান্ত দায়ী।
রাত তখন ৯ টার উপরে। মেয়েরা সবাই শাড়ি পরেছে। ছেলেদের এক রকম পাঞ্জাবী দেওয়া হয়েছে হিমেলের পক্ষ থেকে। নতুন আইনজীবীর নতুন বিয়ে বলে কথা।
মায়রা কাচা হলুদ রং এর একটা শাড়ি পরেছে। গায়ে সাদা জর্জেট ব্লাউজ। স্ট্রেইজ থেকে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। সাউন্ড বক্সের তীব্র আওয়াজ কানে বাজচ্ছে। নিজের ফোনে ফটাফট কয়েকটা সেলফি তুলে মায়রা সেগুলি দেখল। পিক গুলি বেশ সুন্দর হয়েছে দেখে মুচকি হাসল। ফিরে যাওয়ার জন্যে পা ঘুরাতেই তার দৃষ্টি থমকালো এক জায়গায়। হাস্যোজ্জ্বল চেহারাটা মুহূর্তেই সন্দিগ্ধ কৌতূহলে বদলে নিতে সময় লাগল না এক দণ্ড। ভ্রুদ্বয়ের মাঝে খুব সরু কয়েকটা রেখা উদয় হলো মায়রার। সূক্ষ্ম চোখে কেবল কৌতূহলের লীলা ঘুরে বেড়াচ্ছে। চেহারা সুরতে নির্নিমেষ একটা উৎকণ্ঠা জায়গা করে নিয়েছে অনায়াসে। অস্থির চোখ গুলি কেবল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ভয়ংকর দৃশ্য টা। প্রবল ধেয়ে চলা এক ধাক্কায় শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল তার। কি সাংঘাতিক ঘটনা।
এটা ইহাম না? আধো আলোয় তো তাকেই দেখা যাচ্ছে। ওই তো লোকটা কেমন নির্লিপ্ত চাউনিতে শান্ত স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকেও মায়রা দেখতে পাচ্ছে লোকটার শান্ত দৃষ্টিতে কেমন হীম শীতলতা বয়ে চলছে। কিন্তু লোকটা কে এমন এলোমেলো উষ্কখুষ্ক দেখাচ্ছে যে? আচ্ছা শার্টে লেগে থাকা কালচে দাগ গুলি কিসের? আবার খানিক দূর থেকেও তো বুঝা যাচ্ছে ধূসর রাঙ্গা শার্টটায় কেমন লাল লাল ছোপ।
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২৬
মায়রার নিশ্বাস আটকে আসছে অজানা এক আতঙ্কে। এক বিস্তর শঙ্কা যেন গলা চেঁপে ধরেছে তার। নিশ্বাসটা পুরোপুরি ধক করে আটকে গেল লোকটার হাতের দিকে তাকিয়ে। ভয়াবহ কি একটা আঁচ করে তার কলিজা কেঁপে উঠল এক নিমিষে। লোকটার লাল টকটকে রাঙ্গা বা হাত দিয়ে চুইয়েচুইয়ে শোণিত ধারা গড়িয়ে পড়ছে জমিনে। কি মারাত্মক ভয়ংকর কাণ্ড! ও গুলি তো র’ক্ত।