মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩০

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩০
সাদিয়া

দরজায় টোকা পড়তেই খানিক হকচকিয়ে উঠে দুজনে। মায়রা আর ইহাম নিজেদের থেকে অল্প দূরে সরে। কিঞ্চিৎ বিব্রত বোধ করে মায়রা আড়চোখে তাকিয়ে দেখে ইহাম কে। তারমধ্যে বাহির থেকে আবার শব্দ আসতেই চটজলদি করে মায়রা উঠে দাঁড়ায়। উন্মুক্ত বাঁধনছাড়া চুল গুলিকে দুই হাত দিয়ে পরিপাটি করে দরজা খুলল। ওপাশে শিরিন বেগম কে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেমন চমকালো মায়রা। স্নেহময়ী কোমল হৃদয়ের ভদ্র মহিলাটা কি রেগে আছেন? মুখের হাবভাব এমন গম্ভীর বিষাদ কেন?

মায়রা কে পাশ কাটিয়ে কঠিন মুখে ভেতরে প্রবেশ করলেন শিরিন বেগম। ইহামের নজর তখন দরজার দিকেই ছিল। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মা কে পর্যবেক্ষণ করল। না বিছানা থেকে উঠল আর না কিছু বলল। মায়ের কাঠিন্য মুখ দেখে বেশ বুঝতে পারল তিনি যে রেগে আছেন। সবটা উপলব্ধি করেও তৎক্ষণাৎ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না সে। বরং শান্ত ভঙ্গিতে বসে থেকে মায়ের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে রইল। তার এই নির্লিপ্ত সংস্রবহীন ক্রিয়ায় নীরবে ফুঁসে উঠল মায়রা। শাশুড়ির নিরস মুখ দেখে তার নিজেরই খারাপ লাগছে। অথচ আপন ছেলেকে দেখো কিভাবে চুপচাপ তাকিয়ে রয়েছে। কেন এত কঠিন পাষাণ এই লোকটা? উঠে মার সাথে একটু ভালোমন্দ কথা বললে কি হবে? রেগে আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে হবে কি? মায়রা কটমট করে ইহামের দিকে তাকিয়ে নীরব রাগ ঝাড়ল। রাগ আর বিরক্ত মিলেমিশে একাকার হয়ে বিরূপ প্রভাব পড়ছে তারউপর। অগ্নিদৃষ্টিতে কেমন তাকিয়ে রইল ইহামের দিকে।

“মায়রা মা কাউকে বলো এই ব্যথার ঔষধটা খেয়ে নিতে। তার শরীরে ব্যথা না ফুটলেও তাকে এভাবে দেখেও আমাদের মন শান্ত হবে না। তাই বলো এটা যেন খেয়ে নেয় সে।”
কটমট চোখে মায়রা ইহামের দিকে তাকায়। শাশুড়ির কথায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তিনি ছেলের উপর অভিমান করে আছেন। অথচ ছেলেকে দেখো কিরকম শান্ত ভাবে বসে আছে। যেন এসব তার গায়ের লাগছে না। শিরিন বেগম আড়চোখে ছেলের দিকে তাকান। চোখ মুখ আরো শক্ত করে মায়রার হাতে ঔষধ গুলি ধরিয়ে দিয়ে গমগম কন্ঠে জানান,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“মনে করে বলো যেন খেয়ে নেয়। শরীর কে তো শরীর মনে করে না যেন পাথর হয়ে গিয়েছে। আমরা তো বাবা আর পাথর না তাই আমাদের মনে দয়া মায়া বলতে কিছু আছে।”
হনহন করে শিরিন বেগম হাটা ধরলেন। অথচ আপন ছেলে নির্বিকার। দরজার কাছে আসতেই আচানক ছেলে মা কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। শিরিন বেগম জানেন এটা ছেলের কাজ। তাই তিনি রাগ দেখিয়ে বলেন “ছাড় আমায়। মায়রা কাউকে বলো আমায় যেন ছেড়ে দেয় ভালোয় ভালোয়।” মায়রা হতবাক হয়ে একবার ইহামের দিকে তো আবার ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনে শূন্য বিছানায় নজর দেয়। এই লোকটা মাত্র বিছানায় বসে ছিল। তাহলে চোখের পলকে আবার দরজার কাছে গেল কিভাবে? বিস্ময়ে চোয়াল হা হয়ে থাকে তার।

“ঘরে এসে বসো মা।”
“খবরদার আমি কারো মা না। কেউ যেন আমায় মা বলে না ডাকে।”
“ঠিক আছে খালাআম্মা ওখানে গিয়ে বসুন।”
ছেলের কথা শুনে শিরিন বেগম বাক হারা হয়ে হতবিহ্বলের ন্যায় ছেলে আর মায়রার দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এই ছেলে বলে কি? মা ডাকতে বারণ করেছে বলে খালাআম্মা ডেকে বসবে?
ততক্ষণে অভিমানে মুখ ভোতা করে রাখা নিজের মা কে বিছানার কাছে টেনে নিয়ে গেল। জোর করে বসাতে চাইলে উনি রাগান্বিত ভাবে তাকালেন ছেলের পানে। কড়া গলায় বললেন,

“সর তুই আমার থেকে। যে ছেলেকে মা ডাকতে নিষেধ করেছি বলে খালাআম্মা ডাকতে সময় নেয় না এমন ছেলের দরকার নেই আমার। মায়রা তোমার স্বামী কে বলো আমাকে ছেড়ে দিতে নয়তো খারাপ হবে কিন্তু।”
“তুমি যদি আমার কেউ না হও তাহলে মায়রার স্বামী কি কলাগাছ ফেটে হয়েছে নাকি?”
শিরিন বেগম আহাম্মকের মতো ছেলের পানে তাকালেন। সুযোগ বুঝে ইহাম মাকে ঝাপটে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়েছে। তখনের মতো নিজে ফ্লোরে হাটু মুড়ে বসে মায়ের কোলে দুই হাত চেঁপে ধরল। ইহাম নিজের মায়ের দিক তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরালো বিস্ময়ে তাদের দিকেই তাকিয়ে থাকা মায়রার উপর। মানুষটার দৃষ্টি নজরে পড়তেই স্তম্ভিত ফিরল মায়রার। সে কিছু একটা ভেবে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই পিছন থেকে গম্ভীর কন্ঠ শুনা গেল।

“কোথায় যাচ্ছো মায়রা? এদিকে এসে বসো।”
তাকে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কঠিন গলায় আবারও বলে উঠল ইহাম,
“কি হলো বসতে বললাম না?”
একবার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আর কথা বাড়াল না মায়রা। চুপচাপ করে গিয়ে শাশুড়ির পাশে বসল। শিরিন বেগম থমথমে মুখ নিয়ে আবারও নড়ে উঠলে ইহাম বলল,
“কি হয়েছে মা? মশা কামড়াচ্ছে? এমন করছো কেন?”
“তুই ছাড় আমায় ইহাম। খবরদার কোনো কিছু বুঝাতে আসবি না আমায়।”
“তোমায় আবার আমি বুঝাব? বুঝালেও বুঝো তুমি? কিছুদিন ভালো যায় তো আবার সেই আগের রোগে ধরে। আর কত বলো তো মা।”

“দেখ আমি এত কথা বাড়াতে চাই না। তোর এই কাজ আমার ভালো লাগে না শুধু এটা জানি।”
“স্বার্থপর হচ্ছো?”
নরম দৃষ্টিতে তাকায় শিরিন বেগম। তিনি ভালো করেই জানেন ছেলে এখন কি কি বলবে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রাগটা কেমন পানি হয়ে আসল। দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলেন তিনি।
“বললে না তো স্বার্থপরের মতো কথা বলছো না?”
আর তাকালেন না শিরিন বেগম ছেলের মুখের দিকে। সাহস পেলেন না নিজেকে নরম করে দিতে। ছেলে বারবার তাকে এভাবেই মানিয়ে নেয়। তাই শক্ত হওয়ার চেষ্টা করে জবাব দিলেন,

“মায়েরা সব পারে। স্বার্থপর হতেও জানে।”
“তবে দেশের আর বাদবাকি মা গুলি? তারা কি করবে নিজেদের সন্তানের জন্যে?”
শুকনো ঢোক গিললেন শিরিন বেগম। মায়রা কেবল অপলক ভাবে অবলোকনের বিমূঢ় হলো। ড্যাবড্যাব করে দেখল শিরিন বেগমের গলা কাঁপছে। চোখের পাতা নড়বড় করছে। অপরদিকে মায়ের দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইহাম। যেন ধৈর্যের সাথে মা কে বুঝাতে তৎপর সে।
“আমি জানি মা তুমি অনেক সাহসী। স্কুলে থাকতে স্কাউটে নাম ছিল তোমার। আমাদের দেশের জন্যে কাজ করা নিয়ে তোমার তেমন কোনো আপত্তিও নেই। শুধু মাঝেমাঝে অতিরিক্ত চিন্তা থেকে বেঁকে বসো আরকি।”
“আমাকে বুঝাতে আসিস না ইহাম। আমি বেশ ভালো করেই জানি আওবাও নিয়ে তুই আমাকে খুব মানিয়ে ফেলবি। কিন্তু এভাবে আর হয় না।”

“কেন হয়না? কিসের এত পিছুটান তোমাদের?”
“তুই। তোর জীবন।”
“চাকরিটা না করলেও কি মৃত্যু থেকে বাঁচতে পারব নাকি আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে?”
“সর বাবা আমার কাজ আছে।”
“মিথ্যে বলছো। তুমি আমার থেকে পালাতে চাইছো।”
উত্তর দিতে পারলেন না শিরিন বেগম। দৃষ্টি অন্যিকে ঘুরিয়ে নিয়েছেন মুহূর্তে।

“দেশের জন্যে কাজ করতে পারা আমার ভাগ্যের ব্যাপার মা। তুমি যেমন তোমার সন্তান নিয়ে চিন্তিত। বাকি মা গুলিও নিজেদের সন্তান নিয়ে প্রিয়জন নিয়ে চিন্তায় থাকে। তাদের নিরাপত্তা কাউকে না কাউকে তো দিতে হবে? সেই দলে আমি থাকলেই বা ক্ষতি কি? নিজের সন্তানের দিকটা চিন্তা করলে বাকিদের সন্তানের চিন্তা করলে না কেন? তুমি তো এমন না মা। আমাদের সবার কথা কত ভাবো। পরিবারটাকে কিভাবে দুই হাতে আগলে রাখো। সেভাবে দেশটাকেও তো আগলে রাখতে হবে মা। আমি আমার কাজে এক তিল পরিমাণ আফসোস করি না। পিছুটান নেই তা অস্বীকার করি না। আমাদের সবার পরিবার আছে।

আমরা নিজেদের পরিবারকে ভালোবাসি সেই সাথে দেশে বাস করা বাকি পরিবার গুলিও আমাদের। তাদের নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব মা। প্রতিটা মিশন সাকসেসফুল হওয়ার পরের আনন্দ আর তৃপ্তির বিষয়টা তোমরা সাধারণ মানুষ টের পাবে না। প্রতিটা কাজ সম্পূর্ণ করার পর মনে হয় পরিবার কে আরেকটা বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছি। তোমাদের মতো মা যারা নিজেদের পরিবার সন্তান নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে তাদের আশ্বাস দেওয়া কি আমার উচিৎ না মা? যেখানে আমি আমার হৃদয়ের গভীর থেকে আমার দায়িত্বটাকে ভালোবাসি সেখানে তোমাদের এসব মানায় না। আমি চাইব দেশের আদর্শ একটা মা একটা পরিবার হয়ে সবসময় তোমরা আমার কাজকে সম্মানের সাথে মেনে নিয়ে গর্ববোধ করবে। একজন সৈনিকের পরিবার থেকে এই ধরনের কথা আশা করা যায় না মা। তোমাকে আর কতবার বুঝাবো বলো তো?”

শিরিন বেগম নিরুত্তর থাকেন। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে উনার। ছেলে যে এই কাজ টাকে কতটা ভালোবাসে তিনি তা খুব জানেন। তিনি বিরোধীও করেন না তেমন তবে মাঝেমাঝে ছেলের জীবনের আশংকা উনাকে ভঙ্গুর করে তুলেন।
“মা তুমি যদি এভাবে কান্না করো তাহলে আমার অনুপস্থিতিতে এই বদলটাকে কে সামলাবে? দেখো গাধার মতো কিভাবে কাঁদছে।”
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মায়রার কান্না আরো বাড়ল। সেই সাথে শাশুড়ির চোখের পানিও পড়ছে অনর্গল। ইহাম তাকিয়ে দেখল তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দুইটা নারীকে। যারা তার জীবনের আশংকায় ছটফট করছে।
“প্লিজ মা কান্না থামাও। এসব কান্না কাটি একদম ভালো লাগে না আমার।”
শিরিন বেগম ছেলেকে কিছু বললেন না। তাকালেনও না সেদিকে। পাশ ফিরে মায়রার দিকে নজর রেখে চোখের পানি মুছে দিলেন।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললেন,

“কান্নাকাটি করে লাভ নেই মেয়ে। এক বীরের স্ত্রী হয়েছো তুমি। এসব মানায় না। যত কাঁদবে তত বুঝিয়ে নিবে এই ছেলে। কোনো ফায়দা হবে না। তার ভেতরে দেশ কে নিয়ে সিদ্ধান্ত কিংবা ভালোবাসা কোনটাই বদলাবে না। বীরের স্ত্রী হয়েছো যখন অনেক কিছু ত্যাগ দিতেই হবে। কেঁদো না আর। এই হতচ্ছাড়াটা কে পাঞ্জাবী দিয়ে তৈরি হয়ে অনুষ্ঠানে আসতে বলো।”

মায়রার ভিজে গাল টা কে আবার মুছে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ছেলেকে এক প্রকার পা দিয়ে বেঁধা মেরেই হনহন করে ছুটে গেলেন তিনি। শাশুড়ি কথার গভীরতায় মায়রা আরো ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। ইহাম ম্লান হেসে ফোঁস করে দম ছাড়ে। আবার তাকায় মেয়েটার দিকে। এত কাঁদতে পারে কিভাবে এই মেয়ে? একটু আগেই না কতক্ষণ ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না করল। এখন আবার শুরু করেছে ডীপ মেশিন।
নীচ থেকে উঠে ইহাম বিছানায় বসল। দুই হাত দিয়ে মায়রা কে আগলে ধরতে চাইলে মেয়েটা আবার ত্যাড়ামি করে হাত সরিয়ে নিল। নাক টেনে বলল,
“আমি কেন ত্যাগ করব? কিছু ত্যাগ করতে পারব না আমি। কোনো বীরের বউও হতে পারব না। এত উদারতা নেই আমার মাঝে। চলে গেলে তো আর ত্যাগ ট্যাগ করতে হবে না।”
মুহূর্তে বিদ্যুৎ বেগে নিজের সাথে শক্তভাবে ঝাপটে ধরল ইহাম। দাঁত চেঁপে বলল,
“বলেছি না একদম জানে মে’রে ফেলব? এই কথাটা যেন আর না শুনি মুখে। কত ত্যাড়ামি করবে বেয়াদব মেয়ে?”

চারিদিকে যখন আনন্দ হৈহল্লোর আওয়াজ বাড়িটা কে মাতিয়ে তুলেছে শিফু তখন প্যান্ডেল থেকে অনেকটা দূরে নীরবে ফুঁপাচ্ছে। মেয়েটা কষ্ট গুলিকে চেঁপে রাখতে গিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু মন থেকে তো চাইছে আপ্রাণ ভাবে চেষ্টা করছে নিষিদ্ধ আবেগের চেয়ে পরিবারকে মূল দিতে। কিন্তু বারবার কেন নিজের অগাধ দৃঢ় মনোবাসনা থেকে পিছলে যাচ্ছে সে? এই কারণেই কষ্টটাকে কি আরো বেশি ভাবে অনুধাবন করতে হচ্ছে তাকে? উফ ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে একদম। আর সহ্য করা যায় না। মাঝেমাঝে তো মনে হয় এই কষ্টের চেয়ে মরণ ভালো হবে।

“কিরে তুই এখানে কি করছিস?”
হঠাৎ মোটা পুরুষালি কন্ঠে কেঁপে উঠে শিফু। বুক ধড়পড় করে উঠে তার। দ্রুত চোখ মুছে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা চালায় সে। হাত চার এর দূর থেকে আবারও ভেসে আসে।
“শিফু তুই কি কাঁদছিস?”
নাক টেনে চোখের পানিটা যত্ন করে মুছে নেয় শিফু। হাসার বৃথা চেষ্টা করে জানায়,
“আরে না হাসিব ভাই। এদিকে এসেছিলাম একটা ফোন কল এটেন্ড করতে। তখনি কোথা থেকে একটা পোকা এসে পড়েছে হয়তো চোখে।”
“সেকি রে আয় এদিকে আয়তো দেখি।”
হাসিব এগিয়ে গেল শিফুর কাছে। ছেলেটার হাতে তখনো ভিজে গামছা বাঁধা। খানিক ফুলেও আছে হয়তো।
“তেমন কিছু হয়নি ভাই। পোকা বের করেছি। কিন্তু সেই জ্বালা টা এখনো রয়ে গিয়েছে। তুমি চিন্তা করো না। তোমার হাতের ব্যথা কমেনি এখনো?”
শিফুর হাসিহাসি মুখের প্রশ্নটা শুনে হাসিবুল্লাহ কেমন চুপসে যায়। উষ্কখুষ্ক ভঙ্গিতে ইতস্ততার সাথে জবাব দেয়।
“এই সামান্য আছে আরকি।”

“সত্যি করে বলো তো” একটু থেমে শিফু চোখের কোণায় আঙ্গুল ঠেঁসে পানিটুক মুছে আনে যত্ন করে। “হাতে কিভাবে ব্যথা পেয়েছিলে? শুধু ঘুমানোর কারণে নাকি অন্য কিছু।”
সূক্ষ্ম চোখে হাসিবুল্লাহ পরখ করে শিফুকে। মেজাজ তার কটকটে। অসন্তোষ নজরে তাকিয়ে দেখল শিফুকে। একদম ভাইটার মতো চালাক আর ধূর্ত হয়েছে এই মেয়েটা। বড় হলে না জানি কেমন হয়। গড়গড় করে মনে হলো কাল রাতের অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের কথাটা। হুট করে দরজা ঠেলে আসা বিশাল দেহী মানুষটা কেবল অভিজ্ঞ হাতে তাকে মুষড়ে ধরেছিল নিষিদ্ধ কিছু ছোঁয়ার অপরাধে। সাময়িক বাহিনীতে দক্ষ পটু শক্তিশালী হাতটা তার কাছে বিষাক্ত লেগেছিল। আহ সেকি যন্ত্রণা! মনে হলেই শরীর কাঁপিয়ে হাতের ব্যথা বাড়ে। ধড়ফড়িয়ে উঠে হাসিবুল্লাহ। তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় শিফুর দিকে। মেয়েটা যে কিছু একটা আঁচ করতে পারছে সেটা সে ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। চালাক কিনা!

“তুই বলতে চাইছিস টা কি রে শিফু?”
“তুমি যত যাই বলো আমার মনে হচ্ছে তুমি কালকে রাতে ভয়ংকর কোনো বাঘের থাবায় পড়েছো। সেটা আর কেউ বুঝতে না পারলেও আমি কিন্তু পারছি।”
“চুপ কর। তুই বেশি বুঝিস না? তোদের মেয়েদের এই এক সমস্যা। সবসময় এক লাইন বেশি বুঝিস তোরা। ওদিকে চল সবাই অনেক মজা করছে। প্যান্ডেলে আয়।”

বাসন্তী কালার পাঞ্জাবীর হাতাটা গুটাতে গুটাতে ইহাম বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বের হচ্ছিল। তার এমন আকর্ষণীয় রূপ দেখে থমকে গিয়েছে মায়রা। কেমন অভিভূত নয়নে ওই ভয়ংকর সৌন্দর্য দেখে চলছে এক বলিষ্ঠ মানবের। আভিজাত্যের লেপন যার আদলে, মিহি গৌরবের জৌলুশ যার আশপাশ থেকে কিরন দিচ্ছে। সেই ফর্শা গায়ে রং টা যেমন মিশে গিয়েছে। বা হাতে পেঁচানো মোটা ব্যান্ডেজ টাও যেন বড্ড লোভনীয় আকর্ষণীয় ভাবে ফুটে উঠছে। মায়রা এক নজরে বিস্ময় মোহের সাথে জড়িয়ে নিয়েছে ওই লোকটার সৌন্দর্যের দৃশ্যটুক। আচ্ছা ছেলেরাও কি আগুন সুন্দর হয়? কিন্তু তার যে মনে হচ্ছে ওই লোকটাকে যেন স্বয়ং আগুন লাগছে। কাছে গেলে এই বুঝি ঝলসে দেয়।
মাঝারি আকারের চুল গুলিতে হাত বুলাতে বুলাতে ইহাম মায়রার কাছে এগিয়ে এলো। এই ঝলসানো আগুন কে সামনে আসতে দেখেই নিশ্বাস থমকে গেল বুক পিঞ্জিরায়। সবটাই তীক্ষ্ণ নজরে দেখে মুচকি করে হাসল ইহাম। মায়রার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ গলায় বলল,

“কি ম্যাডাম কি দেখছেন এভাবে তাকিয়ে?”
ঘোর লাগা কন্ঠে আরো ছটফটিয়ে উঠল মায়রা। মধুমেয় এক অস্থিরতায় ব্যাকুল চিত্ত ফুটে উঠল তার মাঝে। হাসপাস করা ভেতরটা নিয়ে মুহূর্তে চোখ নামিয়ে দৃষ্টি নত করল সে।
“কি হলো বললে না তো কি দেখিছিলে।”
কেমন মোহাচ্ছন্ন ভাবেই মায়রা জবাব দিয়ে বসল।
“আপনায়।”
“বেয়াদবের মতো নিজের স্বামীকেই চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলে?”
সচকিতে মায়রা চট করে তাকাল। চোখে মুখে তার প্রশ্নাত্মক ইঙ্গিত। ভ্রুদ্বয়ের মাঝ বরাবর সরু রেখা এঁকেছে সুনিপুণ রূপে। এই লোকটা সবসময় এমন। কোমলতা যেন পুষায় না উনার বিস্ময়ের সহিত প্রশ্ন করল।

“আশ্চর্য তাকিয়েছি বলে কি চোখ দিয়ে গিলে ফেলা হলো?”
“নয়তো কি মাথামোট?”
“আপনার মতো ভুজুংভাজুং চিন্তা ভাবনা তো আর সবার নেই। তাই আপনার মতো ভাবতেও পারে না। সামান্য তাকিয়েছি বলে কি নিজেকে যা খুশি ভেবে নিবেন নাকি?”
“তোমার জামাই তো তেমনি। দেখতে হবে না কে সে।”
পাঞ্জাবীর কলার টা ভাব নিয়ে টেনে ধরতেই বিরক্তে মায়রা মুখ ভেংচালো।

“ঢং।”
“ঢং দেখবে বউ। রাতে জোড়ালো ঢং দেখাবো তোমায় আমার মিসেস পিচ্চি চৌধুরী।”
“আপনার ঢং আপনি দেখতে থাকুন। আমার কোনো ইচ্ছা নেই।”
মায়রা চলে যেতে নিলেই ইহাম সন্তপর্ণে তার বাহু টেনে ধরল নিজের সাথে। আশপাশ তাকিয়ে ঘাড়টা খানিক মায়রার দিকে ঝুঁকিয়ে হিসহিস আওয়াজের বলল,
“আমার ভয়ংকর হামলার জন্যে তো তোমাকে লাগবে মাথামোটা। নিজের ঢং নিজে একা দেখব কি করে? ঢং দেখানোর জন্যে হলেও তো কাউকে দরকার বলো। আর আমার সেই কেউটা তুমি মিসেস পিচ্চি চৌধুরী।”
ইহাম ঠোঁট কামড়ে হাসতে হাসতে চলে গেল স্টেইজের দিকে। আর মায়রা তখনো হতবিহ্বলের মতো বিমূঢ় ভাবে তাকিয়ে আছে সেই দিকে। এই লোকটা তো দিনদিন বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে।

অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত তখন ঘড়ির কাটা বারোটার ঘরে। উঠানের এক পাশে বাবুর্চি দিয়ে বড় ডেকচি তে বিরিয়ানি রান্না করা হয়েছে। করিমুল্লাহ সিদ্দিক গ্রামের বিত্তবান লোক। তিনি গ্রামের হিসেব টা জানেন। তাই এত রাতেও বড় বড় ৩ ডেকচি বিরিয়ানি রান্না করিয়েছেন বাবুর্চি দিয়ে। কারো যেন কমতি না হয় সেদিকেই নজর উনার। কাল বিয়ে বরযাত্রী উনি কম নিতে চান। কম কম করেও ৫০ জন হয়ে গিয়েছে। না জানি আবার আর কত জন বাড়ে। কাল ভোর রাতেই দুইটা গরু ফালাবেন। উপহার কিংবা উপটৌকনের আশা তিনি করেন না। গ্রামের প্রতিটা ঘরে দাওয়াত দিয়ে এসেছেন তিনি। আদরের সুযোগ্য ছেলের বিয়ে বলে কথা। তিনি নিজের বড় দুই ছেলের উপর খুবই সন্তুষ্ট। কিন্তু ছোট ছেলেটাই হয়ছে কেবল লাগামছাড়া উশৃঙ্খল।

সবার হাতে হাতে বিরিয়ানির প্যাকেট দেওয়া হয়ছে। আশেপাশের লোকজনও কমে গিয়েছে। বাড়িতে কেবল নিজেদের লোকজন আর আত্মীয়স্বজন। প্যান্ডেলের ভেতরে তখন খাবারদাবার চলে। বেচারা হাসিবুল্লাহর মুখের ভাব করুন। তার ডান হাতটা নির্দয়ের মতো মচকে দিয়েছে একটা পাষাণ নির্দয় মানুষ। ইশশ সামান্য একটু ভুলে তার হাতটা মচকে দিতে ওই লোকটার একটুও কষ্ট হয়নি?
হাসিবুল্লাহ একেএকে সবার মুখের দিকে তাকায়। আশেপাশে তার মা নেই। তিনি থাকলে এতক্ষণে তার খাওয়া অর্ধেক শেষ হয়ে যেত। ডান হাতের কারণে শান্তিতে খেতেও পারছে না। উপায়ন্তর না পেয়ে সে আরো সামনে এগিয়ে গেল। মায়রা আর শিফু তখন এক সাথে বসে খাবার খাচ্ছিল। হাসিবুল্লাহ সরু চোখে মায়রা আর শিফুকে দেখল। এরপর রাশভারী কন্ঠে বলল,

“শিফু বোন আমার আমাকে একটু খায়িয়ে দে।”
শিফু মুখে গোশত দিয়ে বিরিয়ানি পুরতে পুরতে তাকায় সেদিকে। কোনো রকম চিবিয়ে জবাব দেয়,
“দেখছো না ভাই আমি খাচ্ছি? তুমি খালামনির কাছে যাও।”
“আম্মা এদিকটায় নেই। তুই খেয়ে আমাকে চামচ দিয়ে খায়িয়ে দে।”
“পারব না হাসিব ভাই। আমি খালামনি কে ডেকে আনছি খেয়ে।”
খিদেয় পেট চু চু করছে তার। বিরক্ত রাগে মুখ বিকৃত করে নিয়েছে সে। চোখা চোখে একবার নির্বিকার মায়রার দিকে তাকায়। ক্রোধে গজগজ করতে করতে বলে,
“এই সব কিছু হয়ছে আপনার জন্যে। এখন আপনি আমারে আগে খায়িয়ে দিন ভাবি।”
হাসিবুল্লাহর কথায় কুঁচকে তাকায় মায়রা। সন্দিহান চোখ দুটি বিরক্ত হাসিবুল্লাহকে দেখতে থাকে। তার এই হাতের জন্যে সে দায়ী? কি করে? সে কি গিয়ে বলেছিল যে, ‘বদমাইশ খাচ্চোর এভাবে না ওভাবে শু। তাহলে তোর হাতটা দেখবি সুন্দর করে মুচকে গেছে।’ বিরক্ত হলো মায়রা। অসন্তোষ গলায় শুধালো,
“আমি কেন খায়িয়ে দিব ভাইয়া? আর আমার কারণে হয়েছে মানেটা কি? কি বলতে চাইছেন আপনি? আমি আপনার হাত এমন করেছি?”

“আপনার কারনেই তো কাল রাতে..”
“কিরে হাসিব?” গম্ভীর কন্ঠটা শুনে সবাই সেদিকে তাকায়। সাদা পায়জামা আর বাসন্তী পাঞ্জাবী পড়া অত্যন্ত সুদর্শন যুবক টা তখন হাত ভাঁজ করে এদিকেই তাকিয়ে আছে। শরীর বাঁকিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে তাকে দেখে মায়রা শিফু হাসিবুল্লাহ তিনজনই তাকিয়ে আছে কিছু শুনার অপেক্ষায়। এদিকে বেচারা হাসিবুল্লাহ যেন পড়েছে দুই কাছের চিঁপায়। এখন এদিকেও ব্যথা ওদিকেও কষ্ট। ইহামের দিকে তাকিয়ে রইল অসহায় দৃষ্টিতে। আবার না কি করে বসে। ইহাম কে এগিয়ে আসতে দেখে হাসিবুল্লাহ ঢোক গিলল। হাতের ভাঁজ খুলতে খুলতে তার দিকেই এগিয়ে এসে বলল ইহাম,

“তুই ওকে খায়িয়ে দিতে বলিস কেন?”
গলাটা শুকিয়ে আসছে হাসিবুল্লাহর। হাতের ব্যথাটাও যেন মুহূর্তে বেড়ে গেল অদ্ভুত ভাবে। এই নীরব ব্যথা বুঝি তাকে আরো কিছুটা সতর্ক করল। ইহামের তীক্ষ্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে বৃথা হাসার চেষ্টা করে বলল,
“ভাবি তো আমার আম্মাজান তাই বলেছি আরকি খায়িয়ে দিতে।”
“এই বলদ” হাসিবুল্লাহর কাঁধে শক্তভাবে হাত রাখে ইহাম। “দেখিস না আমার হাত কাটা তোর আম্মাজান এখন আমাকে খায়িয়ে দিবে। তুই নিজের খাবারটা নিজে শেষ করতে পারবি না বল?”
মেকি হাসিটা আরে প্রসারিত করার চেষ্টা করে হাসিবুল্লাহ। কাঁধের উপর শক্ত হাতের চাপড় ব্যথা তুলে দিল মুহূর্তে। খানিক নিচের দিকে নুয়ে শরীর মুচড়াচ্ছে সে। চাইছে ইহামের কঠিন থাবাটার থেকে বাঁচতে। যেন নিজে থেকে হাত দিয়ে ওই থাবাটা সারাতে না হয়। ক্যাবলাকান্তের মতো হেসে জবাব দিল,

“হো ভাই। তোমার তো বাম হাত কাটছে তুমি তো খেতে পারবে না নিজে নিজে। আমার ডান হাত মচকে গিয়েছে তাতে কিছু না। বাম হাত তো ঠিকি ভালো আছে। আমি বাম হাত দিয়ে খেতে পারব। কুনু সমস্যা নাই ভাই। আম্মাজান রে বলো তোমারে খায়িয়ে দিতে। আমি বরং যাই। ওইদিকে হয়তো আমার বন্ধু ডাকছে।”
আরেকটু নড়ে উঠল হাসিবুল্লাহ। অবস্থা সুবিধার না। ইহাম এখনো তার কাঁধ চেঁপে আছে। বেগতিক অবস্থা দেখে হাসিবুল্লাহ হাটু ভাঁজ করে খানিকটা নুয়ে পড়ল নিচের দিকে। ইহামের হাতটা ছেড়ে দিতেই এক প্রকার ফুচকি দৌড়ে স্তান ত্যাগ করল ছেলেটা। তার এহেন কান্ডে মুচকি করে হেসে উঠেছে শিফু। ভাইকে ভাবির কাছে যেতে দেখে উঠে দাঁড়াল। নিঃশব্দে জায়গা ত্যাগ করে নিতেই চেয়ার টেনে মায়রার পাশে বসল ইহাম।
“পেটুকের মতো একা খাবে নাকি বেয়াদব মেয়ে? হাত কাটা দেখতে পাচ্ছো না? বলে দিতে হবে খায়িয়ে দেওয়ার জন্যে?”

“আপনার তো বাম হাত কেটেছে। তো ডান হাতে খান নিয়ে।”
“কত নির্দয় তুমি মায়রা। বেয়াদবের মতো তর্ক করছো অথচ স্বামীর মুখে খাবার তুলে দিতে পারছো না।”
“আশ্চর্য আপনি আমাকে সবসময় বেয়াদব বেয়াদব করেন কেন বলুন তো?”
“তুমি তো বেয়াদবই। দেখতে পাচ্ছো একটা অসুস্থ লোক বসে আছে। খিদে পেয়েছে অথচ তুমি খায়িয়ে দিতে কৃপণতা করছো। বলি এগুলি কি কিনে এনেছো নাকি?”
“অসুস্থ? কে? আপনি? আপনার গণ্ডারের মতো মোটা চামড়ায় লাগে অসুস্থ অসুবিধা? টের পান কিছু? আমার তো মনে হয় না।”
“বেয়াদব মেয়ে সবসময় মুখে মুখে তর্ক।”
“নরমাল কথা বললেও তো আপনি বেয়াদব বেয়াদব করেন। যাবো কোথায় আমি?”
“চাঁন্দের দেশে। অপেক্ষা করো তোমাকে রাতেই চাঁন্দের দেশে নিয়ে যাচ্ছি আমি। ভয়ংকর যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হোও পিচ্চি মিসেস চৌধুরী।”

ইহাম ধপ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল। সুচালো চোখে মায়রার দিকে তাকিয়ে ওর হাতে থাকা এঁটো খাবারের প্লেটটাই এক প্রকার টেনে নিয়ে হনহন করে সেখান থেকে চলে গেল ইহাম। তাজ্জব বনে মায়রা হা হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। গেল তো গেলই খাবারের প্লেট টা নেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল? বাড়িতে কি খাবারের কমতি পড়েছে যে তার আধ খাওয়া প্লেটটা নিয়েই ছুটতে হলো। ছোঁচা লোক!

কিছুক্ষণ ইহামকে বিড়বিড় করতে করতে মায়রা আরেক প্লেট বিরিয়ানি নিয়ে বসেছে। গরুর গোশতের বিরিয়ানি টা বেশ খেতে হয়েছে। ঘ্রাণ টা শুকলেই যেন জিহ্বে পানি এসে পেটের খিদে বাড়ে। বিরিয়ানি তে গোশতের পরিমাণও যথেষ্ট। লোকমায় লোকমায় ছোটছোট গোশত কামড়ে লাগলে অমৃত মনে হয়। সাথে ঠান্ডাঠান্ডা কোক পেয়ে মায়রা মহা খুশি। ঢোকে ঢোকে কোক খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে। লজ্জাশরম পাশে রেখে খানিক বড় করে এক লোকমা গোশত সহ বিরিয়ানি মুখে দিয়ে শশায় কামড় দেয়। চোখ বন্ধ করে তৃপ্তির সাথে চিবুতে থাকে। হন্তদন্ত হয়ে শিফু এগিয়ে আসে তখনি। লম্বা শ্বাস টেনে বলে,

“ভাবি এই নাও তোমার ফোন। আন্টি সেই কখন থেকে তোমায় কল দিচ্ছে।”
চট করে মায়রা তাকাল। শিফুর নিশ্বাস নেওয়ার গতি দেখে কপাল কুঁচকালো সে। আম্মু হঠাৎ এত বার করে কল দিবেই বা কোন? ভাবনার মাঝে মুখের খাবার টুক গিলতে গিলতে হাত বাড়িয়ে দিল ফোন নেওয়ার জন্যে।
“আম্মু কি অনেকক্ষণ ধরে কল দিচ্ছে?”
“হ্যাঁ ভাবি।”
ফোন নিয়ে লক খুলবে তার আগেই আবারও কল এলো ফাতেমা বেগমের নাম্বার থেকে।
“হ্যাঁলো আম্মু।”
“মায়রা মা রে..”
ফোনের ওপাশ থেকে ডুকরে কান্নার আওয়াজ শুনে থমকে গেল মায়রা। খাবারটা যেন লাগল গলায় ঠেকে গিয়েছে। চিন্তিত বিস্ময় চোখ গুলি স্থির। বুকের ভেতর তখন ভারী একটা কিছু আঘাত করছে। কি হয়েছে ওখানে? সব ঠিকঠাক? আম্মু এভাবে কান্না করছে কেন? অনেক কষ্টে ঢোক গিলল মায়রা। লঘু স্বরে জিজ্ঞাস করল,

“কি হয়েছে আম্মু? কান্না করছো কেন তুমি?”
“মা রে আমার তুহিন…”
ওপাশে যে ভয়াবহ কিছু হয়েছে তা আন্দাজ করতে পারছে মায়রা। বুকের ভেতরটা তখন ধুকধুক করছে। ফাতেমা বেগম কান্নার কারণে ঠিক ভাবে কথা পর্যন্ত বলতে পারছেন না। কি এমন হয়েছে ভাইয়ার? মা এভাবে কান্না করছে কেন? তীব্র শঙ্কায় হাত পা মৃদু কাঁপছে তার। খাবার পাশে রেখেই উৎকণ্ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ল মায়রা। উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,

“ভাইয়ার কি হয়েছে আম্মু?”
শিফুয়া চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই থমকে গেল এমন একটা কথা শুনে। তার কিশোরী বুকে প্রবল বেগে আঘাত আনল জলোচ্ছ্বাস। গাঢ় ভয় তার হৃদয় কামড়ে ধরল। তড়িতে সে পিছু ফিরল। কি শুনল এটা? কম্পিত পা টেনে আরেকটু এগিয়ে যায় মায়রার সন্নিকটে। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। কানে ঝংকার তুলে বেজে যাচ্ছে তুহিনের কিছু একটা হয়েছে। নিশ্বাসটা কেমন আটকে আসছে তার। কি হয়েছে ওই লোকটার?

“কি হলো আম্মু বলছো না কেন কি হয়েছে ভাইয়ার?”
“মায়রা, আমার তুহিন..”
“আম্মু প্লিজ বলো কি হয়েছে? আমার হাত পা কাঁপছে আম্মু।”
“জানি না। জানি না আমার ছেলের কি হয়েছে। ১১ টার দিকে খাবার জন্যে ডাকতে গিয়ে দেখি দরজা বন্ধ। এত ডেকেও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে তোর বাবা। ব্যালকুনিতে গিয়ে দেখি আমার ছেলেটা নিস্তেজের মতো পড়ে আছে। হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। এখনো কথা বলছে না আমার কলিজার টুকরাটা। আমার খুব ভয় হচ্ছে রে মা।”
মায়ের কান্নায় থমকে গিয়েছে মায়রা। চোখের পাতা তার অনড়। কেমন বিহ্বল চাউনি। শরীরের ভার ধরে রাখতে না পেরে এক পা পিছিয়ে গিয়েই কেমন ধপ করে চেয়ারটায় বসে গিয়েছে। এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকা আঁখি গড়িয়ে টপটপ করে ঝর্ণা বইল। ভাইয়ের জন্যে আতঙ্কে তার ভেতরটা ফাঁকা লাগছে। শূন্যে মস্তিষ্কে কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে একটা কথা। ‘ কি হয়েছে তার ভাইয়ের? ‘

ব্যাকুল উদ্বিগ্নে শিফুর বুকের হাড় ভেঙ্গে গুঁড়ো হচ্ছে। নিশ্বাসের পাল্লা কেমন থেমে থেমে নড়ছে। কানের পাশ দিয়ে বিরহের শীতল সুর তাকে বরফের মতো জমিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার ভেতর গহীনে। উদ্রেকে বুকের ছাতি কাঁপছে। তার কোমল হৃদয়ের দাবানলের জ্বলন ধরেছে যেন। কেমন ঘোরের মাঝে এগিয়ে গেল শিফু। ক্রন্দনরত মায়রার পায়ের কাছটায় ধীরে বসল নিভৃতে। উদ্রেক উৎকণ্ঠায় গলা কাঁপছে শিফুর। চেয়েও পারছে না ক্ষীণ আওয়াজ তুলতে। বারবার ভেসে উঠছে তুহিনের আধুত হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা। সে নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে আছে মায়রার দিকে। মেয়েটা কেমন পাথরের মতো বসে থেকে কাঁদছে। শিফু বুঝতে পারছে না তার ভেতরের অনুভূতির ঘনঘটা। সব কিছু কেমন যেন তার কাছে ভোতা লাগছে।

“ক কি হয়েছে ভা ভাবি?”
নির্জীব মায়রা মন্থরগতি তে চোখ ঘুরিয়ে তাকায় শিফুর পানে। মেয়েটার ঝলমল চোখ জোড়া দেখেই কান্নারত অবস্থাতেই তুচ্ছ হেসে উঠল মায়রা। ঠোঁটের কার্নিশে নগণ্য হাসিটা রেখেই বলে উঠল,
“শান্তি হয়েছে না শিফু? তোমাদের শান্তি হয়েছে আমার ভাই, হাসপাতালে। এবার তোমরা সবাই খুশি তো?”
ভাঁজ করা হাটুটা নড়ে উঠতেই শিফু মাটিতে লেপ্টে বসে পড়ল। শরীরটা তার অবশ লাগতে শুরু করেছে। কানে লাভার মতো টগবগ করছে তুহিন হাসপাতালে আছে সেই কথাটা। নিষ্প্রভ চোখ গুলি ছুঁয়ে কয়েক ফোটা পানি পড়তেই তেঁতে উঠল মায়রা। এদিকটায় এখন মানুষ নেই। নিজেকে সংযত করতে না পেরে ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠল,
“এখন কাঁদছো কেন শিফু? মজা পেয়েছো না? কষ্ট দিতে তো ভাইয়া কে কম দাও না। তাহলে এখন কাঁদছো কেন? একদম কান্না করে অভিনয় করবে না বলে দিলাম।”

শিফু স্তব্ধ। মায়রার বিদ্বেষী কথা তার কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না মনে হয়। বুকের ভেতরটা তার হাহাকারে লিপ্ত। মনের গহীনে থাকা মানুষটা বুঝি নিস্তেজ হয়ে হসপিটালে ভর্তি? কি হয়েছে তার? বড় ধরনের কোনো কিছু? তার কি খুব কষ্ট হচ্ছে। এই ভেতরের জ্বালার থেকেও বেশি? নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকা লোকটা কি জানে এত দূরে থাকা একটা হৃদয় দহনে পু’ড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে তার অবস্থায়?
“তোমরা, তুমি আর তোমার ভাই এসবের জন্যে দায়ী। তোমরা আমার ভাইটাকে কষ্ট দিতে দিতে জখম করে দিয়েছো। এসবের জন্য তোমরা দায়ী শিফু।”
অপরিচিত এক জায়গায় তাও বিয়ে বাড়ি। আশেপাশে মানুষজনের অভাব হবে না। এই পরিবেশে তার এভাবে রেগে যাওয়াও ঠিক নয়। নিজেকে সংযত করতে চেয়েও ব্যর্থ হচ্ছে সে। ভাইয়ের জন্যে ভেতরটা জ্বলছে। কেমন আছে এখন তার ভাই?

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২৯

পরক্ষণে হৃদয়টা জ্বলে উঠল অন্য এক কারণে। নিজেকে ধাতস্থ করে কঠোর বানাল। চোখের নির্মল পানিটা মুছে মন কে দৃঢ় করল। আজ সে কথা বলবেই বিষয়টা নিয়ে। নির্বোধের মতো নেওয়া একটা সিদ্ধান্তের উপর জেদ ধরে বসে থাকা মানুষটার জন্যে এমন অধঃপতন হতে পারে না। চোখের পানিটা মুছতে মুছতে পা বাড়াল গন্তব্যে। আজ যাই হোক দমে যাবে না সে। সীমা পার হতে হলেও নিজেকে সে হিসেবে প্রস্তুত করে নিল মায়রা।

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩১