মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৬
সাদিয়া
“ক্যাপ্টেন, নিজের উপর আপনি এত নিয়ন্ত্রণ হারা হচ্ছেন কেন? দয়া করে একটু ধৈর্য ধরুন। শান্ত হোন। এতটা উত্তেজিত হবেন না আপনি।”
“আমার বউ ওখানে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে আর তুই আমাকে ধৈর্য ধরতে বলছিস শান্ত হতে বলছিস? ডাক্তার ওখানে বলছে ১২ ঘন্টার মাঝেও জ্ঞান ফিরবে কিনা নিশ্চয়তা দেয় নি আর তুই আমাকে উত্তেজিত হতে মানা করছিস? আমি উত্তেজিত হবো না তোর নানা উত্তেজিত হবে?”
চিৎকার করে কথাগুলি বলতে ইচ্ছা হলেও বলল না ইহাম। চুপচাপ শুনে নীরব রইল। তার ভেতরে অস্থিরতায় প্রবাহ করছে। শিরায় শিরায় ছুটে চলছে উত্তেজনা। কোনো ভাবেই ভেতরের দামামা কে থামিয়ে নিজেকে শান্ত স্থির করতে পারছে না। অস্থির ভঙ্গিতে ফোঁসফোঁস করে দম নিল। ভেতর থেকে নিশ্বাসের সাথে কেবল আগুনের গোলা বের হচ্ছে। তিড়তিড় করে হাত চালান করল প্যাকেটে। সিগারেটের প্যাকেট হাতে দেখেই দূর থেকে ইবরাহিম একনজরে তাকিয়ে রইল। কোথাও যেন দেখেছিল এক সাথে কয়েকটা সিগারেট টানতে। ইহাম তাই করল। প্যাকেট থেকে ২ টা সিগারেট বের করে তা মুখে পুরে দিলো। লাইটার দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে টান দিল তাতে। ফু দিয়ে নিশ্বাস ছাড়ার সাথে সাথে এক দলা ধোয়া কুণ্ডলী বের হয়ে এলো। নীরবে কোনো গভীর ভাবনায় তলিয়ে থেকেই ধোয়ার টানে ভেতর ভরাচ্ছে। ইবরাহিম কেবল স্তব্ধ হয়ে দেখছে ইহামের অস্থিরতা। ক্যাপ্টেন খুব বেশি স্মোক করে না। মাঝেমাঝে কয়েকবার খেতে দেখেছে। তাদেরকেও তো ক্যাপ্টেন সবসময় মানা করে সিগারেট টান না দিতে। আর সেই লোক কিনা এভাবে ধোয়া ফুঁকছে? তাও একসঙ্গে দুইটা? তার ভেতরে ঠিক কতটা প্রলয়ঙ্করী উথাল ঢেউ আঘাতের বিধ করছে ভাবা যায়?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইহাম আপন শোকে একের পর এক টান দিয়ে যাচ্ছে। সুখটানেও তার ভের স্বস্তি পাচ্ছে না। ওই মেয়েটার চোখের পাতা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে কি তার স্বস্তি শান্তি ও গায়েব হলো নাকি? ভেতরটা এতটা অশান্ত হয়ে উঠছে বারবার। মেয়েটা তার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না, কথা বলছে না, কথার উল্টোপিঠে কাজ করছে না এই বিষয়টা যে তাকে ঠিক কতটা পীড়া দিচ্ছে কতটা দুমড়েমুচড়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে তা কাকে বুঝাবে সে? দাঁতে দাঁত চেঁপেও ভেতরের আঘাত আনা বজ্রাঘাত গুলি প্রতিহত করতে পারছে না সে। ভেতরটা এতটা পুড়ছে যে ইচ্ছা হচ্ছে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করতে।
ইহামের এই উগ্র অস্থিরভাব দেখেও ইবরাহিম ভীত হয়ে আরেক পা এগিয়ে গেল। কিছু একটা নিয়ে বেশ চিন্তিত হলেও এই মুহূর্তে বিষয়টা জানানোরও একটা আবশ্যকতা আছে। যদিও সে জানে না এই উন্মাদনায় বিষয়টা শুনার পর ক্যাপ্টেন ঠিক কতটা উশৃঙ্খল হবেন। তবুও পরিস্থিতি বিবেচনায় তাকে জানাতে হচ্ছে। ইবরাহিম শ্লথ এগিয়ে এলো। ভয় পাচ্ছে সে। গলা কেঁশে বলল,
“ক্যাপ্টেন একটা কথা বলতে চাইছিলাম।”
বজ্রবেগে ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে ইহাম ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল। অসম্ভব লাল লাল ভিজে চোখ গুলি দেখে আঁতকে উঠল ইবরাহিম। ওই তীব্র চাউনি তার গা কাঁপিয়ে দিল। ওই হিংস্র নজরের তলে পড়ে বুক কেঁপে উঠল তার। ত্রস্ত হলেও সামনে নিল কেমন। ঢোক গিলে স্থির হয়েই মাথা নুয়ে নিল সে। বিক্ষিপ্ত গলায় চিবিয়ে বলে ইহাম,
“এই মুহূর্তে আমি কোনো কথা শুনতে চাই না ইবরাহিম। আমার চোখের সামনে থেকে যাও। লিভ ইট। নয়তো খারাপ কিছু করে ফেলব।”
ইহাম যে নিজেকে কোনো ভাবেই সামলে নিতে পারছে না আর না নিজেকে নিয়ন্ত্রণের আওতায় আছে সেই বিষয়টা ইবরাহিম নিজ দায়িত্বে বুঝে নিয়েছে। ইহাম পাশ কাটিয়ে দুই পা সামনে এগোয়। অন্তঃকরণের খরস্রোতা তাণ্ডবে দিশেহারা হচ্ছে। তর্জনী আর মধ্যমায় চেঁপে ধরা দুই সিগারেট আবারও ঠেকালো ঠোঁটে। কে না বলে আগুন খেলে ভেতরের অশান্তি কমে। বা’ল তার ভেতরের অশান্তি কেন কমছে না? আরো বিরক্ত হলো সে। আগের তুলনায় আরো জোর দিয়ে টান দিল তপ্ত ধোয়া।
ইবরাহিম হাঁসপাঁস করল। মিশন এখনো কমপ্লিট হয়নি বিষয়টা কি করে জানাবে সে? আর ক্যাপ্টেন এই মুহূর্তে যে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত সেই অবস্থায় ব্যাপারটা নিবে কি করে? কিন্তু এই মুহূর্তেই যদি না জানানো হয় তবে আরো ক্ষতি হবে। ক্যাপ্টেন নিশ্চয় কিছু আদেশ দিবেন হয়তো। তাই ইহামের বারণ করা সত্ত্বেও সে ওখানেই দাঁড়িয়ে। একবার পিছন ফিরে তাউসকেও দেখে নিল। হাদারাম ভীতুটা ওখানে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। নিশ্চয় তার এই অবস্থায় মজা নিচ্ছে। নিজে তো আসলোই না উল্টো তাকে নিয়ে বিদ্রূপ করে খারুসের বাচ্চাটা। ইবরাহিম মনে মনে তিক্ত কিছু গা’লি দিয়ে আবারও তাকায় ইহামের দিকে। খুব সাহস নিয়েই ক্ষীণ গলায় বলে উঠে,
“ক্যাপ্টেন আযহার পাটোয়ারি পালিয়েছে। ফেনীর ফোর্স তাকে ধরতে পারেনি।”
এতটুক বলেই চুপ করে ইবরাহিম। মাথা নুয়ে আড়চোখে তাকায় ইহামের প্রতিক্রিয়া দেখতে। মানুষটা যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। নড়াচড়া বাদে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখের ভঙ্গিমা দেখার সুযোগ নেই, কেবল পিঠপিছন দেখা যাচ্ছে। ইহামের এই নিস্তব্ধতা দেখে চোখ সরু হয়ে আসে ইবরাহিমের। মনে লঘু শঙ্কা উদয় হয়। ডিপার্টমেন্টে এই লোকের শীতল নিস্তব্ধতা নিয়ে বেশ নাম ডাক আছে। ক্যাপ্টেনের এই শিরশির করা শীতল নিস্তব্ধতা যেন ভয়ংকর কিছুর পূর্বাভাস। ইবরাহিম চোখের পলক ফেলার আগেই দেখতে পেল ইহাম ক্ষিপ্রে নিজের হাতের জ্বলন্ত সিগারেট গুলি কোথাও ছুড়ে ফেলল। সেই হাতটাই ক্ষিপ্ততায় মুচড়ে ধরল ক্রোধে। তারপর কিছু সময় ওভাবেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ইবরাহিমের কথার পিষ্টে কোনো জবাব না দিয়ে উল্টো আবার হসপিটালের ভেতরে প্রবেশে উদ্যত হলো মানুষটা।
ইহাম চলে যেতেই হনহন করে এলো তাউস। এবার হাসি মুখে নয় বরং শঙ্কিত চেহারায় জিজ্ঞাস করল,
“ক্যাপ্টেন কিছু বলল? এই নীরব দেখালো কেন? এর মানে কি?”
ইবরাহিম দাঁতে দাঁত কাটে। একটু আগেই তাউসের হাসি মুখটা মনে হতেই রাগ বাড়ল তার। চোয়াল শক্ত করেই তাউসের পা’ছায় ল্যাঙ মারল। কিটকিট করে জবাব দিল “তোর বা’ল।”
হন্তদন্ত করে মহিন সাহেব ও ফাতেমা বেগম এগিয়ে এলেন করিডোর পেড়িয়ে। কাল রাতেই ছেলেকে দিয়ে চিন্তিত উদ্বিগ্ন হয়ে গিয়েছেন এক হাসপাতালে। আজ আবার মেয়ের আশঙ্কাজনক অবস্থায় দিশেহারা বাপ মা দগ্ধ বক্ষ নিয়ে ছুটে এলেন আরেক হাসপাতালের দ্বারে। তাদের পিছনে বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে এলো তুহিনও। ডক্টর বলেছিলেন আজ হসপিটালে থাকতে। কিন্তু একমাত্র আদরের বোনের এই সংকটাপন্ন অবস্থায় কোনো কিছুই তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। হাসপাতালে এসে বেশ কয়েকদিন পর চাঁপা যন্ত্রণা কে সম্মুখে দেখে দ্বিগুণ বিষে ছেয়ে গেল অন্তঃকরণ। হৃদয়ের সূক্ষ্ম ব্যথাটা তরতাজা হয়ে ফেঁপে উঠছে। ভারি বুকের পীড়াটা গলায় তারকাটার মতো লাগছে। কিছু পল বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল তুহিন। কোনো রকম পাগলামি করল না। নিস্তেজ এক টুকরো ম্লান হাসি দিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সে।
ফাতেমা বেগম পাগলের মতো দিশেহারা হয়ে প্রথমে গেলেন শিরিন বেগমের কাছে। এদিক ওদিক করে আগে খুঁজলেন ইহাম কে। হয়তো মেয়ের খুঁজের জন্যে একমাত্র ভরসার জায়গা সে। ইহাম কে দেখতে না পেয়ে তিনি অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলেন শিরিন বেগম কে।
“বে বেয়ান আমার মায়রা? আমার আদরের মাইয়া কোথায় বেয়ান।”
মায়ের মনের উদ্বিগ্ন আর ভয় বুঝলেন শিরিন বেগম। উনার অবস্থা নাজেহাল দেখে তিনি শান্ত করার চেষ্টা করলেন। মাথায় শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“শান্ত হোন বেয়ান। একটু শান্ত হোন। মায়রা ভালো হয়ে যাবে আল্লাহর রহমতে। আপনি দিশেহারা হবেন না। একটু শান্ত হোন। এখনি ওকে কেবিনে দিবে। আপনি একটু শান্ত হোন।”
মায়ের সরল মমতার মন কোনো সান্ত্বনা না শুনে বিলাপ করতে লাগে। উনার কান্নার বেগ দেখে শিরিন বেগম ভীত গলায় বললেন,
“বেয়ান দয়া করে আপনি উত্তেজিত হবেন না। একটু শান্ত হোন। দেখুন আমার ছেলেটা একদম পাগল হয়ে গিয়েছে মায়রা মার জন্যে। পুরো উন্মাদের মতো করছে। এখন আমরাও যদি ওর সামনে ভেঙ্গে পড়ি তখন সমস্যা আরো বাড়বে। মায়রা আম্মার কিচ্ছু হবে না। আল্লাহকে ডাকুন শুধু।”
মহিন সাহেব এগিয়ে গেলেন ইসহাক চৌধুরীর নিকট। কাঁদোকাঁদো মুখ নিয়ে জিজ্ঞাস করলেন মেয়ের কথা। আহারে বেচারা মেয়ের চিন্তায় কাতর হয়ে আছে। গলাটাও কাঁপছে কান্নার দাপটে। ইশশ পারছে না বুঝি অন্যদের মতো চিৎকার করে নিজের ভেতরের যন্ত্রণাটা উগলে দিতে। বাবা নামক ব্যক্তিটাকে তো সবসময় পাষাণ হয়েই নিজেদের কষ্ট গুলি চেঁপে যেতে হয়। ইসহাক চৌধুরী বুঝি টের পেলেন মহিন সাহেবের ভেতরের দ্রিমদ্রিমে কষ্ট টা। তিনি সান্ত্বনা অর্থে ভরসা দিতে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন বুকের সাথে। তারপর আস্তেধীরে জানালেন ডাক্তারের সঠিক কথাটা। মেয়ের এই করুণ অবস্থার কথা শুনে কেঁপে উঠলেন যেন মহিন সাহেব। চোখ গুলি পানিতে টইটুম্বুর করে একদম নিস্তব্ধ হয়ে তিনি ধপ করে বসে পড়লেন বাহিরের রাখা চোয়ারের উপর। চাঁপা কান্নার কারণে উনার পাণ্ডুর ঠোঁট গুলি কাঁপছে। ওভাবেই পানি ভর্তি চোখ গুলি নিয়ে কতক্ষণ তিনি ভাবলেশহীন ভাবে কিছু দেখে যাচ্ছিলেন কেবল। অতঃপর শরীর ঝাঁকি দিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে উঠেন তিনি। বাবা নামক শক্ত ব্যক্তিটাকে তুহিন খুব কম দেখেছেন কাঁদতে কিংবা দূরস্থ হতে। সেই বাবা কে এভাবে কাঁদতে দেখে তুহিন এগিয়ে এলো। বাবা কে সামাল দিতে সে ব্যস্ত হলো।
দূর থেকে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে শিফু কেবল দেখে গেল তুহিন কে। মানুষটার চোখমুখ গুলি একটু চাঁপা দেখাচ্ছে। শুকনো মুখটা যেন স্পষ্টত বলে দিচ্ছে মনের অভিব্যক্তি। মলিন মুখের আড়ালে বিষাক্ত যন্ত্রণা গুলি ভেসে বেড়াচ্ছে। তখনি মায়রার কথা মনে হলো। মায়রা ভাবি তো ঠিকই বলেছিল। কথা গুলি তো তার সাথে সামঞ্জস্যই। হাসিখুশি চটপটে ওই তুহিন ভাই কি তার কারণে মিলিয়ে গিয়েছে? একমাত্র সে’ই কি নয় ওই ছেলেটার দুঃখের হেতু? বুক মুচড়ে উঠে শিফুর। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে দূর থেকে তুহিনের উপর। বুকটা ব্যথায় জমে উঠে তার। তবুও পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে তা গলে পড়ে না।
তুহিন ফোনে বন্ধুদের সাথে কথা বলছে গ্রুপ কলে। বারবার জিজ্ঞাস করছে তারা আসবে কিনা, কোনো প্রয়োজন কিনা, র’ক্ত টক্ত লাগলে যেন বলে এসব নিয়ে। খুব দুটানায় ভোগে শিফু আর না পেরে এগিয়ে এলো। শ্লথ পায়ে এসে তুহিনের পিছু দাঁড়িয়েছে মিনিট হবে। ভেতরে তখন শ্বাসরোধ অবস্থা। তবুও ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে সে। আরো একটু দাঁড়িয়ে থেকে ক্ষীণ গলায় ঠোঁট নাড়াল “তুহিন ভাই” বলে। চট করেই তুহিন ঘাড় বাঁকালো। পিছনে শিফুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেও খানিক স্তব্ধ হলো। তার ভাবনা গুলিও জমে এলো। তুহিনের থমকে যাওয়া নজর দেখে হাসপাস করল শিফুর ভেতরটা। অস্বস্তিতে মাথা নুয়ে হাতের নখ কুটল। শিফুকে বিব্রত অবস্থা তেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপালে এবার ঈষৎ সরু হলো। এই মেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছে? ভাবা যায়? তার উপর কি সহানুভূতি দেখাতে এসেছে? আচ্ছা শিফু যখন তার অবস্থার কথা শুনেছিল তখন কি ভেবেছিল সে? তার কি এক মুহূর্তের জন্যে মনে হয়েছিল তার কারণে সে আত্মহ’ত্যা করতে গিয়েছিল? নিজের ভাবনায় নিজেই তুচ্ছ হাসল তুহিন। আজ বাদে ৫ দিন পর তার ফ্লাইট মালেয়সিয়ায় আর সে কিনা এই কারণে নিজেকে শে’ষ করার চিন্তায় জড়াবে? এতই সহজ? নিজেকে প্রমাণ না করেই? ইহাম ভাই কে দেখাতে হবে না তার যোগ্যতা টা?
“কিছু বলবে শিফু?”
ফোন রেখে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল তুহিন। চোখের পাতা তুলে চায় শিফু। কি জবাব দিবে বুঝে না। ফ্যালফ্যাল করে কেবল তাকায়।
“কিছু বলতে চাইলে বলতে পারো শিফু। নিশ্চয় করুনা দেখাতে এসেছো?”
“না” তৎক্ষণাৎ তাকায় শিফু। তুহিনের ঠোঁটের উপর হাসিটা যে তাকে অবজ্ঞা করেই কথাটা বলেছে তা বেশ টের পায় শিফু। হৃদয়ে ভাটা পড়ে তার। তবুও ঠাই দাঁড়িয়ে। “আপনি কেমন আছেন তা জিজ্ঞেস করতে এলাম।”
“তাই নাকি?” সেই মেকি হাসিটা আরো প্রসারিত করল তুহিন। “আমি কেমন আছি তা জিজ্ঞেস করতে তুমি আমার কাছে এসেছো? আমি বাঁচি মরি তাতে তোমার কিছু যায় আসে?”
“এসব কেমন ধরনের কথা তুহিন ভাই।”
“কেন ভুল কিছু বললাম কি? আমি জানি তুমিও আমার প্রতি দূর্বল শিফু। তবুও কেন আমাকে কাছে টেনে নিচ্ছো না?”
এই পর্যায়ে শিফুর বলতে ইচ্ছা হলো সত্যিটাই। কিন্তু আবারও পিছুটান তাকে ঝাপটে ধরেছে। অগত্যা নিজেকে শক্ত করে নেওয়ার অভিপ্রায়ে বলে,
“এ কোন ধরনের ব্যবহার তুহিন ভাই? আপনি অসুস্থ ছিলেন। কেমন আছেন তা জিজ্ঞেস করতে এলাম। তাতে কি আমি আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে গেলাম? আপনি একটু ওভার থিংক করে ফেলছেন না?”
তুহিনের পায়ের রাগ মাথায় উঠে গেল মেয়ের এমন ভাবসাব দেখে। দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল,
“তো এসেছো কেন? মজা দেখতে যে তোমার বিরহে আমি কতটা পুড়ছি? পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে যখন মেনেই নিতে পারবে না তবে আসো কেন কাছে? মলম যেহেতু লাগাতেই পারবে না তবে ক্ষত দেখতে আসার মানে কি? ভাইয়ের মতো হয়েছো তাই না? এত পাষাণ এত কঠিন তুমি? মনে রেখো আমার থেকে ছাড় পাবে না তুমি শিফুটিফু।”
তুহিনের চোখ গুলি লাল হয়ে আছে। চোয়াল শক্ত। শাসানো দৃঢ় বাক্যগুলি মনের আবেগে টলমল করে উঠল। শক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও খুশিতে তার মনের গ্লানি গুলি যেন কূর্পরের মতো উবে যেতে শুরু করেছে। মনের শান্তিটা চেঁপে রেখে কিছু বলতে উদ্যত হওয়ার আগেই চোখ যায় ইহামের দিকে। বেপরোয়া ভাবে সে এগিয়ে যাচ্ছে বোধহয় বউ এর কাছেই। যাওয়ার মাঝে খুব ধারালো তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করেও গেল তুহিনের সাথে তার কথা বলার দৃশ্যটা।
ত্রস্ত পায়ে ইহাম এগিয়ে গেল কেবিনের দিকে। একটু আগেই মায়রা কে আইসিইউ এর কেবিনে শিফট করা হয়েছে। পা এগিয়ে নিতে পারছে না কোনো দৈব্যশক্তির বলে। যেন মাটি থেকে তার পা জোড়া কেউ টেনে ধরে রেখেছে। ভেতরের দুরুদুরু ধ্বনিটা কলকলিয়ে ভেজে যাচ্ছে অনবরত। রোধ্য শ্বাসে পা চালান করছে কেবিনের দরজার দিকে। সে’ই প্রথম মায়রার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে কেবিনে দেওয়ার পর। তার উদ্বিগ্নতা আর বেপরোয়া ভাব দেখে বাকিরা তাকে নিয়েই শঙ্কিত। এই ছেলে না জানি আবার স্টোকটোক করে বসে। তার অধৈর্য আর অস্থির ভাব অবাক করেছে মায়রার বাবা মা কেও। মহিন সাহেব মনেমনে মেয়ের জামাই নিয়ে তৃপ্তিও অনুভব করেছেন। মেয়েকে তিনি তাড়াহুড়ো করে অপাত্রে দেন নি। বরং মেয়েটা তর যোগ্য মানুষের কাছে পৌঁছেছে।
কাঁপাকাঁপা হাতে ইহাম কেবিনের দরজা খুলল। নজর নিক্ষেপ করতেই দেখতে পেল একদম বেডে রুক্ষমূর্তি হয়ে নিস্তেজ ভাবে পড়ে আছে মেয়েটা। শরীরে অসংখ্য তারের বেড়াজাল। ওই মুদে রাখা পাণ্ডুর মুখটার দিকে তাকাতেই বুকটা অকস্মাৎ ছ্যাঁত করে উঠে। কলিজা কামড়ে ধরা যন্ত্রণা হয় কোথাও। বুকের ভেতর প্রবল ভাবে ব্যথাতুর দ্রিমদ্রিম শব্দ হয়। নিজের জীবনের পরোয়া না করা শক্ত মানবটার হৃদয় জমিনেও ভূমিকম্প শুরু হয় মায়রার অবস্থায়। হৃদয়ের ঢিপঢিপ অনুভূতি নিয়েই সে কম্পিত পা ফেলে কেবিনে।
নিম্প্রভ তেজোহীন মেয়েটার পাশে আস্তে করে বসল ইহাম। কয়েক পল নিভৃতেই তাকিয়ে রইল মায়রার বাকহীন নিস্তেজ মুখশ্রী তে। ঝাপসা চোখের দৃষ্টি এবার মুখ থেকে এনে আবদ্ধ হলো সুই বিঁধানো হাতের উপর। আলতো করে হাতটা তুলে নিজের মুঠিতে ভরে নেয়। খানিক নুয়ে সুই বিধা হাতে একটু করে চুমু খায়। আবার নির্নিমেষ তাকায় মায়রার আদলে। দহনে বুক ভার হয়ে চোখ গুলি ভিজে এলেও গলার আওয়াজ শক্ত রেখে বিড়বিড় করে উঠে ইহাম।
“এ্যাই মায়রা, দেখেছো তুমি কত বেয়াদব হয়েছো? আমার একটা কথাও শুনো তুমি? আমি যাই বলতে যাই সেই কথার পিছে পিছু ঘুরতে হয় কেন তোমার? এই যে কি সুন্দর আমার কথা অবাধ্য করে শুয়ে আছো। আমি যে তোমাকে উঠতে বলছি সেই কথা তুমি শুনতে পাচ্ছো না?”
অবুঝের মতো ইহাম তাকিয়ে থাকে মায়রার দিকে। যেন মায়রা এখনি উঠে তার কথার জবাব দিবে। কিন্তু হায় মেয়েটা উঠে না। চোখ মুদে রাখে আপন চেতনায়। কিছুক্ষণ ওভাবে নীরব তাকিয়ে থেকে ইহাম মেজাজ হারায়। দাঁতে দাঁত কাটে।
“একটা বেয়াদব মেয়ে তুমি। অত্যন্ত লেভেলের বেয়াদব। ইচ্ছা হচ্ছে তোমার গালে ঠাটিয়ে একটা চর বসিয়ে দেই। আমার কথা কানে ঢুকছে না? শুনতে পাচ্ছো তুমি? তোমাকে উঠতে বলছি আমি। কথা বলো আমার সাথে। তাকাও এদিকে। তুমি কেন দেখতে পাচ্ছো না আমার ছটফটানি? আমার ভেতরের বুদবুদ লাভা চোখে পড়ছে না কেন তোমার? তাকাচ্ছো না কেন? দেখতে পাচ্ছো না কেন আমি তোমার কারণে কতটা উদগ্রীব হয়ে উঠেছি। নিজেকে উন্মাদ লাগছে তোমার বাকহারা ঠোঁট আর নিস্তেজ চোখ দেখে। প্লিজ জান আমার উঠো। তাকাও এদিক।”
ঝাপসা চোখের পাতা গড়িয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। ঠোঁট গুলি তিড়তিড় করে কাঁপে। অবোধের মতো তাকিয়ে থেকে কাতর গলায় বলে উঠে,
“তুমি তো দেখি মায়রা খুব পাষাণ হয়ে গিয়েছো। আমার থেকেও বেশি শক্ত হয়ে গিয়েছো বুঝি? আমার এত যাতনাও কি তোমার হৃদয় স্পর্শ করতে অক্ষম হচ্ছে? প্লিজ জান বেয়াদবি করলেও আমার চোখে তাকিয়ে মুখে মুখে কথা বলে বেয়াদবি করো। তোমার সাতগুণ বেয়াদবি আমি মাফ করে দিবো আমার মিসেস পিচ্চি চৌধুরী। তারপরেও উঠো। তোমার এই ধরনের বেয়াদবি আমার অন্তর নিতে পারছে না রে জান।”
এক পেশে ইহাম কথা বলে যায় কেবল। ওপর পাশে অজ্ঞান হয়ে বেডে লেগে থাকা ছোট্ট শরীরের মেয়েটা জবাব দেয় না। তার কথার পিঠে রাগ করে বিরক্ত গলায় বলে উঠে না “আপনি একটা কঠিন পাষাণ মানব।” হৃদয়টা ব্যথায় হাহাকার করে উঠে। অন্তরটা হু হু করে তীব্র যাতনার উপস্থিতি জানান দেয়। মায়রার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে ইহামের। ললাটে লঘু ভাঁজ পড়ে। দৃষ্টি হয়ে উঠে শাণিত তলোয়ারের ন্যায়। যেন নৃশংস কোনো কিছু তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে যাচ্ছে। হৃদয়ে জ্বলে উঠে দাউদাউ করা স্পৃহা। অদ্ভুত ভরাট কন্ঠে আবারও হিসহিস করে জানান দেয়,
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৫
“যত যা বেয়াদবি করার এখনি করে নাও। আমি ফিরে এসেও যেন না দেখি তোমার এই বেয়াদবি। আমি আসতে আসতে তুমি যেন দিব্বি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারো শুধু এতটুক চাই।”
তারপর একদম মায়রার দিকে ঝুঁকে বসল সে। আরেকটু ফিসফিস করে বলে উঠল “তোমার ওই ললিত ঠোঁট যেন আমায় নিয়ে কিছু কথা আওড়ায়। ওই মনোজ্ঞ মোহিত চোখ জোড়ার শীতল চাউনি যেন আমায় আবদ্ধ করে। আমায় আর উন্মাদ করার পরিকল্পনা চালিও না জান।” মুখটা বাড়িয়ে দিয়ে মায়রার ললাটস্থলে শব্দ করে চুম্বন বসিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে মেয়েটার শুষ্ক ঠোঁটজোড়াতেও খুব যত্ন করে আলতো ভাবে চুমু খায়।