মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৫০

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৫০
সাদিয়া

ইদের মিষ্টি সুভাস আর নানান খাবারের লোভনীয় সুঘ্রাণে মৌ মৌ করছিল চারপাশ। এই আনন্দমুখর সময়েও স্তব্ধ মায়রা। তার চোখের পাতায় থমকে আছে বিস্ময়, মুখের রেখায় জড়ানো নির্বাকতা। বিমূঢ় অবস্থায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে হাতের লেখাটা। কে লিখবে এভাবে? আম্মু? সম্ভব নয়। তবে? বাসায় তুহিন ভাইয়া থাকলেও বলা যেত দুষ্টামি করে লিখেছে। সেও তো নেই। তবে লিখবে টা কে?
প্রশ্নাত্মক চাউনিতে মায়রা দ্রুত মায়ের কাছে যায়। গিয়ে দেখতে পায় তার মা সবেমাত্র দুধ জ্বাল করছে। সে তো অবাক। ফাতেমা বেগম প্রতি দিনে ফজরের নামাজ পড়ে আর ঘুমাতে যান না। সোজা রান্নাঘরে গিয়ে সকাল আটটার মাঝে সমস্ত আয়োজন শেষ করেন।

“এখনো রান্না হয়নি আম্মু?”
পিছন ফিরে তাকান ফাতেমা বেগম। দুধে এলাচ আর চিনি দিতে দিতে শুধান, “উঠে গেছিস নবাবজাদী? যখন ঘুম ভাঙ্গার দরকার হয় তখন তো কাদাকাদা হয়ে থাকিস।”
“আমি গরম গরম সেমাই খেতে পারি না বলে তুমি না ভোররাতেই পায়েস আর সেমাই রান্না করে রাখো। আজ এত দেরি করলে পোলাও গোশত সব রান্না করবে না?”
“বিরিয়ানি, তোর পছন্দের চিংড়ি ভোনা, সরষে ইলিশ, রুই মাছ আর গরুর গোশত রান্না হয়েছে। দুপুরে আরো কিছু করতে হবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চোখ বড়বড় করে মায়রা প্রশ্ন করে, “এসব কিছু তো নাস্তার পরে রান্না করো এবার ভিন্ন কেন? আর এবার আমরা মানুষ কম। তবে এত আয়োজন কিসের?”
“তোর আব্বুর মেহমান আসবে। এখন যা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে পায়েস খা।”
সেসবে পাত্তা না দিয়ে মায়রা আমতাআমতা করে প্রশ্ন করে, “আমার রুমে কেউ ঢুকেছিল মা?”
ফাতেমা বেগম ভ্রু সংকোচিত করে তাকান। আশ্চর্য কন্ঠে তিনি নিজেও প্রশ্ন করেন, “কে ঢুকবে?”
মায়রা কি বলবে বুঝতে পারে না। তবুও থেমে থেমে বলল, “আম্মু তুমি কি আমার হাতে মেহেদী…” আর কিছু বলতে পারে না সে। কথা লেগে আসে। হাত দুটি জড়তায় কচলাকচলি করছে। ওমনি ফাতেমা বেগম প্রশ্ন করেন, “কিরে মায়রা? তুই হাতে মেহেদী দিসনি? অন্যসময় তো দুই হাতভর্তি মেহেদী দিয়ে বসে থাকিস এবার দিলি না কেন? বিয়ের পর এটাই তোর প্রথম ইদ।”
জবাব দেয় না মায়রা। মনমরা মুখটার প্রতি রেখায় জমে থাকে নিঃশব্দ বিষণ্ণতা। এক অদৃশ্য কষ্টে হৃদয় জ্বলে পুড়ে খাখ। মাথা নুয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বিড়বিড় করে, “বিয়ে নামক বন্ধন জীবনে এই প্রথম আমায় বিষাদ মুড়ানো ইদ উপহার দিলো।”

“কি রে কি বিড়বিড় করছিস?”
“না কিছু না।”
“কিছু না হলেই ভালো যা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তুহিন কল দিতে বলেছে তোকে।”
ভাই এর কথা মনে পড়ে মনটা আরো খারাপ হলো। হৃদয়ে টান অনুভব করল। এই প্রথম তার ভাই কে ছাড়া ইদ কাটাতে হচ্ছে। এবারের ইদ যেন তার প্রাপ্তির খাতা শূন্য করেছে।

“আমার আম্মা মায়রা?”
“জ্বি বাবা?”
“একি ফোন নিয়ে বসে আছো কেন? এখনো গোসল করোনি?”
মায়রা জানলার পাশে বিষণ্ণ মুখে বসে আছে ফোন নিয়ে। দেখা জিনিসও বারবার চেক করছে। হৃদয়টা পুড়ছে গূঢ় নিঃসাড় যন্ত্রণায়। একটা বার, একটাবারও কি কল করা যেত না? এত নিষ্ঠুর এত পাষণ্ড কি করে হতে পারে কোনো মানুষ? চাঁপা কষ্টে চোখ দুটি ছলছল করে উঠলেও বাবার সামনে তা নির্গত হতে দেয় না।
“কি হলো মা চুপ করে আছো কেন?”
ম্লান হেসে বলে, “করব আব্বু।”
“করব না মা। এখনি যাও গোসলে। আমি মাঠ থেকে এসে যেন দেখি তুমি তৈরি।”
“ঠিক আছে আব্বু” মাথা নিচু করে ক্ষীণ গলায় জবাব দেয়।

মহিন সাহেব এগিয়ে আসেন মেয়ের কাছে। কিছুসময় চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন। এটাই কি মেয়ের সাথে উনার কাটনো শেষ ইদ? সময়ক্রমে তুলে দেয়নি বলে নয়তো মেয়েটা আজ অন্যের বাড়িতে থাকত। আচ্ছা তুলে নেওয়ার পর ওরা কি কখনো তাদের সাথে ইদ কাটাতে দিবে আদরের মেয়েটাকে? এত আদর করে বড় করা মেয়েটা বিয়ের পর আর ইদ কাটাতে পারে নিজের বাবা মার সাথে। দুনিয়ার কি নিষ্ঠুর নিয়ম। যে মেয়ের মুখ না দেখে উনার ইদের সকাল শুরু হয়না পরের বার থেকে উনার সেই আদরের মেয়ে থাকবে অন্যের বাড়িতে। বুকটা হাহাকার করে উঠে মহিন সাহেবের। বুকের মুচড়ানিতে চোখ দুটি করে উঠে চিকচিক। সেটাকে কঠিন হৃদয়ে চাঁপা দিয়ে তিনি হেসে বলেন,

“আমি মাঠ থেকে এসে যেন দেখি তুমি রেডি হয়ে গিয়েছো। তাড়াতাড়ি করবে কিন্তু। আর এবার জামাই এর দেওয়া কাপড়টা পরে ইদ শুরু করবে কেমন?”
মায়রা জবাব দেয় না। নিঃশব্দে তাকায় বাবার দিকে। মহিন সাহেব মেয়ের কপালে আদুরে পরশ ঝাঁপিয়ে ঘর থেকে বের হন। বুকের বা পাশ টা বড্ড চিনচিন করছে উনার। এই প্রথম ছেলেটাকে ছাড়া ইদের মাঠে যেতে হচ্ছে। প্রতিবার ছেলে নামাজে যাওয়ার আগে ব্রেন্ডের আতর মাখিয়ে দেয় উনার শরীরে। অথচ এবার ইদে ছেলে উনার থেকে হাজার মাইল দূরে। একা একা মাঠে যেতে উনার সে কি যে কষ্ট হচ্ছিল বুকের ভেতর!

গোসল করে এসে মায়রা বিছানায় সব নতুন কাপড় জোতা এনে টাল দিয়ে ফেলে রেখেছে। তার একটুও ইচ্ছা হচ্ছে না ইদের জামা পরতে। শুধু আব্বু মন খারাপ করবে বলে না পরেও পারছে না। এবার মনে কোনো আনন্দ উল্লাস কিচ্ছু পাচ্ছে না। আশ্চর্য হুট করে সে কি বড় হয়ে গেল? শুনেছে বড় হয়ে গেলে নাকি ইদের আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ প্রতিবছর আব্বু ভাইয়া মাঠ থেকে আসার আগে নতুন জামা পরে সেজেগুজে সালামি আদার করার সে কি তাড়া আর উচ্ছ্বাস! কোথায় গেল সেসব? নাকি ওই কঠিন পাষাণ মানবটার দেওয়া যন্ত্রণায় সেসব চাঁপা পড়েছে?
আব্বু আম্মু বারবার করে ইহামের দেওয়া কাপড়টা পরতে বললেও মায়রা সেটা পরেনি। কেন পরবে? শুধু দায়িত্ব দেখাতে টাকা পাঠিয়েছে। একটাবার তো কল দিয়ে খুঁজটাও নেয়নি তবে সে কেন উনার দেওয়া কাপড়টাই পরতে যাবে?

পরেনি মায়রা। বাবার দেওয়া পার্পল কালারের একটা জরজেট গাউন গায়ে দিয়েছে। মুখে শুধু টোনার দেওয়ার পর একটু ক্রিম লাগিয়েছে। এছাড়া আর কোনো প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আব্বু নামাজ থেকে এসেই তাকে নিয়ে খেতে বসেছিল। কিন্তু দুই লোকমা বিরিয়ানি খেয়ে আর কিছুই ভালো লাগছিল না। একটা মাস রোজার কারণে নাকি ফাঁপা কষ্ট টা পেট ফুলিয়ে রেখেছিল বুঝেনি সে।
বিষাদ ভাবটা মায়রার মুখের আশপাশে খেলা করছে। উদাস নজরে তাকিয়ে আছে হাতে গোটাগোটা অক্ষরে “ফাহাদ ইহাম চৌধুরী” লেখাটার দিকে।

কানে মৃদু একটা আওয়াজ হলেও মায়রা চোখ তুলে তাকাল না। বিভোর নয়নে তাকিয়ে রইল কেবল হাতের তালুর দিকে। চোখে অপার্থিব ঘোর নিয়ে তাকিয়ে আছে লেখাটার দিকে। নিঃশব্দ এক টানে নিজেকে হারিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিলো সেই লেখাটার উপর। পুনরায় দরজায় আরেকটু জোরে শব্দ হতেই নিষ্পলক চোখে ঘাড় উঁচু করে তাকাল।
সময়টা যেন সেখানেই থমকে গেছে। এক অবিশ্বাস্য নয়নে মায়রা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কেবল। মস্তিষ্ক কিংকর্তব্যবিমূঢ়। চোখে মুখে নিঃসাড় বিষণ্ণতা। বিস্ময়ে এক ঝাপটা যেন হাওয়ার মতো বয়ে গেল সারা অঙ্গে। বুকের ভেতরটা হঠাৎ ধক করে কেঁপে উঠল। যেন জমে থাকা আবেগগুলো হঠাৎ বুনো ফুলের মতো বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। অসাড় হাত পা গুলিও মৃদু কাঁপছে। কাঁপাকাঁপা চোখের পাতা গুলি আস্তেধীরে বন্ধ করে আবার মেলে তাকালো। না, যা দেখছে যতটুক দেখছে নেত্রপল্লবে তার সবটুকুই বাস্তব। মুহূর্তে গহীন কোণে উলটপালট ঝড় বইতে শুরু করল। বহুদিনের জমানো ব্যথাটা আবারও চিনচিন করে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছুটে গেল।

ব্যথাতুর চোখের পাতায় কুয়াশার মতো ভেসে উঠছে সেই চেনা কঠোর আর শীতল মুখশ্রী। সিনা টানটান করে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। মায়রা এখনো যেন বিশ্বাস করতে চাইছে না ঝাপসা চোখের দৃষ্টিকে। ওই তো কঠিন পাষাণ মানবটা কেমন বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যার আদল থেকে জ্যোতির মতো ঝড়ছে আভিজাত্য মেশানো এক নিরব গাম্ভীর্য।
ইহাম নিষ্প্রভ তাকিয়ে দেখে যায় চোখের সামনে দাঁড়ানো এক হুরপরী কে। উত্তপ্ত বুকটা মুহূর্তে বরফের মতো শান্ত শীতল হয়ে উঠল। যেন কতদিনের জ্বালাময় তৃষ্ণা চোখের এক পলকেই নিভে বারি হলো।
কাল রাতের ঘটনা,

পুরো একটা মাসে ইহাম নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করেছে। নিদারুণ এক যন্ত্রণা দ্বন্দ্ব তাকে তিলেতিলে করেছে ঘায়েল। অফিস ফিরে এসে যখন মায়রা কে দুইবার কল দিলো আর মেয়েটা ধরল না। তখনি সে বুঝে গিয়েছিল ওই মেয়ে ছাড়া তার আর নিশ্বাস নেওয়া হবে না। আর না, ওই বেয়াদব মেয়েটার কাছে না গেলে চোখের সামনে না দেখলে বুকের জ্বালা কমবে না। এবং কি অক্সিজেনের অভাবে কাতরাতে কাতরাতেই প্রাণ যাবে বোধহয়।
যেহেতু সে কোনো মিশন বা ঘাঁটিতে নেই তাই CO এর কাছ থেকে রাতেই Pass Leave বা Overnight Family Visit এর অনুমতি নিয়ে নেয়। এটা মূলত পূর্ণ ছুটি নয় ডিউটির মধ্যে একটা সাময়িক অবকাশ মাত্র। শুধুমাত্র ইদের দিনটুক হাতে নিয়ে এসেছে। কাল আবার অফিস জয়েন্ট করবে সে।

তাই ভোর দিকেই ব্যক্তিগত খরচে হেলিকপ্টার দিয়ে সবার আগে এসেছে এই বাড়িতেই। মায়রা তখন ঘুমে মগ্ন। আর সে চুপচাপ নিশ্চল পায়ে এসে বিছানার কাছটায় হাটু ভাঁজ করে ফ্লোরে বসে। ঘুমন্ত মায়রার দিকে তৃষ্ণার্ত দুটি চোখ মেলে নিভৃতে কত সময় দেখে যায় তার কোনো হিসেব নেই। মায়রার শুভ্র হাত দুটি দেখে নিজ হাতেই নামটা লিখে দেয়। মেয়েদের এসব বিষয়ে সে খুবই কাঁচা।
ফাতেমা বেগম রাতেই মাংস ঢিফ ফ্রিজ থেকে নরমালে রেখেছিলেন। মেয়ের জামাই কে দেখে সঙ্গেসঙ্গে তিনি বিরিয়ানি চাপিয়ে দেন চুলায়। ইহাম মায়রার রুমে থাকতে থাকতেই তিনি রান্না শেষ করেন। যাওয়ার আগে জোর করে বিরিয়ানি খায়িয়ে পরে ছাড়েন। বারবার বলেছিলেন মায়রা কে ডাকতে তখন ইহামই বারণ করেছিল। মাঠ করে এসে সারপ্রাইজ দিবে বলে।

হাল্কা করে কেশে ইহাম গলা পরিষ্কার করল। মায়ামায়া আধোআধো নজরে ইহাম মায়রার চোখের দিকে তাকিয়েই ঘরে ঢুকল। উল্টো ঘুরে দরজাটা বন্ধ করতেই এতক্ষণ আটকে রাখা নিশ্বাসটা মায়রা বহুকষ্টে মৃদু আওয়াজ করে ছাড়ল। বুকের ভেতর তীব্র আলোড়নে নিশ্বাস জড় হয়ে এলো। হাতপা গুলি কাঁপছে। এক নিঃসাড় অবশ ভাব শরীরের হাড়মজ্জায় ছড়িয়ে গেল।
মন্থরবেগে পা ফেলে ফেলে ইহাম এগিয়ে এলো তার কাছে। তার প্রতিটি পায়ের কদম যেন পূর্বের তুলনায় আরো বেশি করে নিশ্বাস রোধ করে দিচ্ছিল মায়রার। মেয়েটার চোখে চোখ রেখেই ইহাম এগিয়ে এসে তার খুব কাছে দাঁড়ায়। কিছুসময় দুজন নিভৃতে কেমন চোখের চাউনিতেই নিজেদের মনের সকল কথা নিগূঢ় অভিযোগ গুলি জানাতে থাকে একেএকে।

ইহাম নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে মায়রার বাম গাল স্পর্শ করে। বৃদ্ধা আঙ্গুলটা কানের পাশে গালের উপর রেখে বাকি গুলি মেয়ের উন্মুখ চুলে গলিয়ে দিয়েছে। মায়রার মাথাটা খানিক এগিয়ে এনে ইহাম টুক করে প্রথমে মেয়েটার কপালে চুমু খায়। খুব সময় নিয়ে।
ললাটে ভিজে ওষ্ঠের পরশ আর ইহামের গা থেকে ভেসে আসা ওই মাতাল করা সুভাস মায়রার ভেতর উলটপালট করে দেয়। বিক্ষিপ্ত আন্দোলনে নামে হৃদয়।
মায়রার চোখের দিকে গাঢ় মোহের দৃষ্টি ফেলে ইহাম বিড়বিড় করে বলে, “ইদ মোবারক আমার বেয়াদব জান।”
কিছুসময় ইহাম প্রগাঢ় দৃষ্টিতে পরখ করতে থাকে গোটা মায়রা কে। এক অদৃশ্য অস্থিরতা মায়রার ভেতর কে অস্থির করে তুলে। ইচ্ছা হয় ঝাপটে ধরতে লোকটাকে। উনার সুবাসিত উমে নিজেকে গলিয়ে দিতে। কিন্তু সে পারছে না। তার কম্পিত অসাড় নিস্তেজ শরীর নাকি মনের বাঁধা তাকে আটকে দিচ্ছে সে বুঝতে অক্ষম।

মুখ বাড়িয়ে ইহাম সেই আগের নিয়মে মায়রার ঠোঁটের এক কোণায় ছোট্ট অথচ শব্দ করে চুমু খায়। লজ্জা অস্বস্তিতে মায়রা নুয়ে এতটুক হয়ে গেল। নিঃসাড় জড়তা আর অতিরিক্ত অস্থিরতা ভেতরে জলোচ্ছ্বাস তৈরি করেছে।
মায়রা দুইপা এগিয়ে গিয়ে নিজের জায়গা পরিবর্তন করল। যেন মানুষটার থেকে লুকানোর অভিপ্রায়। ইহাম বুঝল সেটা। পুনরায় নিজে গিয়ে মায়রার পাশে দাঁড়াতেই মাথাটা একেবারে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল মেয়েটা। ইহাম শক্ত মুখে নজরকারা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মায়রার মাথা তুলে।

“বেশিকিছু তো করিনি তবে লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে যাচ্ছো কেন মায়রা?”
তপ্ত হয় মায়রার ভেতরটা। দেখো লোকটা কিভাবে কথা বলছে যেন সব স্বাভাবিক। অথচ পুরো একটা মাস মুখের কথাটুক বলেনি। আর এখন কতটা নরমাল বিহেভিয়ার করছে। একটুপর বলতেও পারে “ওসব ভুলে যাও। ইট’স নরমাল।” মায়রার অভিমানে বুক ভার হয়। লোকটাকে এড়াতে সে এক পা এগিয়ে দিতেই ইহাম খপ করে তার হাত ধরে। নিদারুণ অস্থিরতায় ভেতরটা আনচান করে উঠে মায়রার। লম্বা শ্বাস টেনে দাঁত খিঁচে নিবারণ করার চেষ্টা চালায় অন্তঃকরণের দাপাদাপি।

“কি হলো মোবারক বাত জানাবেন না মিসেস চৌধুরী?”
বুকের গহীনে কেউ তীব্র বিষাক্ত ফলা নিক্ষেপ করেছে এমন যন্ত্রণা হলো মায়রার। ভেতরের সকল অস্বস্তি যেন গলার কাছটায় দলা পাকিয়ে এলো। ঠিক যেমন প্রথমপ্রথম হতো তার চেয়েও বেশি লাগছে। এই একটা মাসে যেন লোকটার থেকে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে সে। অথচ বদমাশ লোকটা কে দেখো যেন সব ঠিক স্বাভাবিক।
ইহাম এক পা বাড়িয়ে মায়রার মুখোমুখি হলো। বা হাতটা উল্টেপাল্টে সেই আগের মতো সফেদ মেহেদীর রঙ বিহীন হাতখানা দেখে চোখ সরু করে। অতঃপর নিজের লেখা নামটার দিকে তাকিয়ে নেশালো গলায় শুধায়, “মেহেদী দাও নি অথচ আমার নাম লিখে বসে আছো।”

ইহামের চোখ দুটিতে কেমন রসিকতা খেলে গেলো। মায়রার খুব মন চাইল “ওটা আমি লিখিনি” বলতে। কিন্তু গলা দিয়ে বের হলো না। হাতটা মুচড়াতে মুচড়াতে কেবল বলল, “ছাড়ুন।” মুহূর্তে ইহাম হেচকা টানে নিজেদের সকল দূরত্বটুক দূর করে একেবারে মেয়েটাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। কোমরের পাশে শক্ত হাত গলিয়ে মায়রার পেলব শরীরখানা নিজের সাথে লাগিয়ে রেখে হিসহিস করে জবাব দিল, “ছেড়ে দেওয়ার জন্যে চট্টগ্রাম থেকে এসেছি নাকি? সব হিসাব পাই টু পাই করে নিয়ে তবেই না তুমি ফাহাদ ইহাম চৌধুরীর থেকে নিস্তার পাবে।”
ভেতরটার মাত্রাতিরিক্ত অস্থিরতা হাঁসফাঁস করে তুলে। চোখ তুলে তাকাতে পারে না মায়রা। ইহাম নিজের মুখটা ওর মুখের খুব কাছে এনে দৃষ্টি নত করে দেখে যায় লাজে টুকটুক হয়ে যাওয়া তার রাঙ্গাপরীকে। ভেতরে ছলকে উঠে নীরব বাসনা। ফিসফিস করে জানায়, “আগেই লজ্জায় চেরি হয়ে যেওনা ডিয়ার। সময় আরো বাকি আছে। নিজের লাল ফেস কন্ট্রোল করো নয়তো আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারব না মেরি জান।” লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা হয় মায়রার। বেহায়া পুরুষটাকে দেখো কত নিলজ্জগিরি দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই কতদিনে তার সাথে উনার মাখোমাখো ভাব ছিল। কিন্তু সে সবকিছু হিসাব নিকাশ করে মনে রেখেছে। বিরক্ত মায়রা সরে আসতে চাইলে ইহাম আরো চেঁপে ধরে তাকে নিজের সাথে।

“হিসাব পরে হবে আগে নিজের হাত রাঙ্গাও। বিয়ে করেছি কি ইদের দিন সারাবছরের মতো বউয়ের সাদা হাত দেখব বলে?”
মায়রা দৃষ্টি নত করে জানায়, “আমি মেহেদী দিবো না।”
“তুমি না দিলে দেওয়ার ব্যবস্থা করব আমি।” একই ভঙ্গিতে বলল ইহাম।
“ছাড়ুন আমায়।”
“ছাড়ব তো আমি নিশ্চয় তবে আগে আমার পাওয়া গুলি উশুল করে।”
কোনো জবাব দেয় না মায়রা। গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে চেয়ে থাকে। ঢং দেখাচ্ছে এসে। একমাস কোথায় ছিল? একটাবার খবর নেয়নি। আর এখন রং এর আধিখ্যেতা দেখাতে আসছে। কিছুতেই মেহেদী দিবে না সে।
“লুক এট মি মায়রা।” চিরাগত সেই গম্ভীর মোটা কন্ঠ।

তাকায় না মায়রা। ইহাম আবার বলে, “আমার দিকে তাকাও।” মায়রাকে ত্যাড়ামি করতে দেখে একহাত দিয়ে মেয়েটার কোমর এখনো পেঁচিয়ে রেখে অন্য হাত মায়রার থুতনি স্পর্শ করে নিজের দিকে ফিরায়।
“তাকাতে বলছি তো আমার দিকে। কানেও কি কম শুনতে পাও নাকি?”
“আর যাই হোক আপনার কথা শুনতে চাইছি না। ছাড়ুন আমায়।”
“ছাড়ব। আগে বলো তুমি মেহেদী দিবে।”
“….
“কি হলো জবাব দাও।”
“ছাড়ুন আমায়।”
কোমরে আরেকটু চাঁপ দিয়েই মায়রা কে নিজের সাথে আরো এঁটে নিল সে। হিসহিস করে বলল, “আন্সার মি। নয়তো আর ছাড়ছিও না। এভাবেই রাখব সারাদিন।”
“বেহায়া, অসভ্য নিলজ্জ লোক” শব্দগুলি মায়রার মনে উদয় হলো। বিরক্তিতে বলল, “আমি মেহেদী দিতে পারি না। ছাড়ুন।”

“ওকে ফাইন” মায়রা কে ছেড়ে দিয়ে শুভ্র পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বলল, “যে দিতে পারবে তাকেই আনছি।”
এরপরই কারো নাম্বার খুঁজতে লাগল ইহাম। আড়চোখে বিরক্তিতে তাকিয়ে মায়রা ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করল, “কাকে আনবেন?”
ফোনের দিকে তাকিয়েই ইহাম জবাব দিল, “আর্টিস্ট কে। যে তোমায় মেহেদী দিয়ে দিতে পারবে।”
মায়রা চেঁচিয়ে বলে উঠল, “মানে?”
“ইদেও মেহেদী ছাড়া থাকবে নাকি?”
“না আমি মেহেদী দিবো না। কাউকে আসতে বলবেন না।”
“দিবে। আমি চায় তুমি দিবে মানে দিবে।”
“জোর খাটাচ্ছেন নাকি আমার উপর?”

এই পর্যায়ে ইহাম একটু নরম হলো। কোমল গলায় বলল, “আমি তোমার হাত মেহেদী রাঙ্গা দেখতে চাইছি। দ্যাট’স ইট।” ইহামের কথায় মায়রা চুপ হয়ে যায়। থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আড়চোখে দেখে গেল পাষাণ মানুষটাকে। এই মুহূর্তে ভেতরটা এত হাকুবাকু করছে করছে কেন? স্পন্দন টাও যেন বেগতিক হারে বেড়েছে। এসবই কি লোকটাকে কেবল সামনে দেখে হচ্ছে নাকি?
“দূর, কোথায় গেল ইমরানের নাম্বারটা? ওর বোনই তো আর্টিস্ট। ধূর বাল, নাম্বারটা কোন চিঁপায় গিয়ে লুকিয়েছে।”
ইহামের কথায় তব্ধা খেয়ে গেল মায়রা। চোখ দুটি আশ্চর্যে বড়বড় করে তাকিয়ে রইল। মুখের এ কি ভাষা এই লোকের? এই ধরনের কথাও বলে নাকি উনি?

ইমরানের বোন কে কল দিয়ে জানা গেল তারা গ্রামের বাড়ি বরিশাল গিয়েছে ইদ কাটাতে। এটা শুনে ইহাম আরেক আর্টিস্টের নাম্বার চাইল। তা দেখে মায়রা বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনার এসব ঢং বন্ধ করুন তো। আমি নিজেই মেহেদী দিতে পারব। আমার কোনো আর্টিস্ট ফার্টিস্ট লাগবে না।”
ভ্রু কুঁচকে ইহাম বলে, “তো এতক্ষণ কি মজা নিলে আমার সাথে?”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪৯

তিক্ত মুখে মায়রাও জবাব দেয়, “মজা না ছাই।”
চলে যাওয়ার জন্যে মায়রা পা বাড়াতেই ইহাম হাত টেনে ধরে। মায়রাও সরু চোখে তাকায় আচমকা। ইহাম নেশানেশা চোখে বক্র কন্ঠে শুধায়, “এর জন্যে আপনায় ঠিক কি শাস্তি দেওয়া যায় মিসেস চৌধুরী?”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৫১