মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৫১

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৫১
সাদিয়া

হেচকা টানে মায়রাকে আবারও নিজের কাছে নিয়ে এলে মেয়েটা চোখ মুখ তেঁতো করে নেয়। বেশ তিক্ত কন্ঠেই বলে, “আপনার এই হেয়ালি ভাব গুলি আমি মুটেও নিতে পারছি না। সত্যি নিতে পারছি না।”
মায়রার মুখাভঙ্গি দেখে ইহামও কেমন শক্ত হয়। মেয়েটা ছাড়বার জন্যে একটু মুচড়াতেই ইহাম নিজ ইচ্ছায় ছেড়ে দেয় তাকে। মায়রাও দূরে গিয়ে খানিকটা শ্বাস টানে। ভেতরটা খুব জ্বলছে। ইহামের এই ধরনের ব্যবহার বুঝি তাকে আরো পু’ড়াচ্ছে। একটা মাস। পুরো একটা মাস ওই পাষণ্ড লোকটা তার সাথে কথা বলেনি। এতদিন পরে এসে কোথায় নিজেদের মাঝে সব ঠিক করবে, নিজের ভুল স্বীকার করবে, আর তাকে যে ওভাবে বলল? কান্না গুলি গলায় এসে বিঁধে। এমন একটা লোককে কেন ভালোবাসতে গেল সে? ফুঁপিয়ে উঠে বক্ষস্থল।

বেশ কিছুটা সময় যায়। ইহাম বিছানায় বসে ফোন টিপছে। যেন কিছুই হয়নি খুব স্বাভাবিক। এদিকে মায়রা ভেতরে উত্তপ্ত আগুন নিয়ে বসে আছে পড়ার টেবিলে চুপচাপ।
“ওখানে গাল ফুলিয়ে বসে না থেকে আমার কাছে আসো।”
মায়রা তাকাল ঘাড় ফিরিয়ে। লোকটা তখনো বিছানায় বসে ফোন টিপছে দেখে মায়রা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে কেবল নিশ্চুপ রইল।
“এদিকে আসো মায়রা।”
“….
“কারো জন্যে সালামি নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু কেউ সালাম’ই করছে না দিবো কি করে বলো তো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মায়রা তবুও জবাব দেয় না। কোনো এক কারণে চোখ দুটি তার ছলছল করে উঠে। হয়তো পুরোনো কোনো আঘাত কিংবা অতি স্বাভাবিক ভাব।
ইহাম এগিয়ে যায়। মায়রা তখন চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে রেখেছে। কোলের উপর রাখা হাত দুটো কঁচলে যাচ্ছে অনবরত। ইহাম এসে ঠিক তার পায়ের কাছে ফ্লোরে বসল। মায়রা একটুও দৃষ্টি দিল না তার উপর। মেয়েটার কচলে যাওয়া হাত দুটি ধরে নরম গলায় শুধালো,
“অভিমানে কি পাহাড় জমেছে?”

জবাব না দিয়ে মায়রা মুখ ফিরিয়ে নেয়। ইহাম আরো কিছু বলবে তার আগে দরজার ওপাশে ফাতেমা বেগমের ডাক শুনা যায়। ইহামের মুখটা বেশ খানিকটা কালো হয়ে এলেও বিশেষ পাত্তা দিলো না সে। শুধু চোখের ইশারায় মায়রা কে বুঝিয়ে দিল দরজাটা খুলে দিতে। মেয়েটাও নাক টেনে নিজেকে সংযত করে দরজা খুলে দেয়।
ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে চলে এসেছেন তিনি। মেয়ে আর মেয়ের জামাই এর এমনিতেই মনোমালিন্য চলছে দেখে তিনি আর তাদের বিরক্ত করলেন না। দরজার সামনে থেকেই মায়রা কে বললেন, “যা জামাই কে নিয়ে ওগুলি গিয়ে গা।”
“মায়রা? আম্মু কে ভেতরে আসতে বলো।”

“না বাবা আমার কাজ আছে। তুমি মায়রা কে নিয়ে কিছু একটা মুখে দাও।”
“আমার খিদে নেই আম্মু। আসার সময় মা জোর করে খায়িয়ে দিয়েছে।”
“তবুও কিছু মুখে দাও বাবা।” মেয়ের হাতে ট্রে দিয়ে ক্ষীণ গলায় বলেন, “যা নিয়ে যা। দেখ, কি খায়।”
“উনি তো খাবে না বলছে।”
“তুই চুপ কর। নিয়ে যা। জামাই এর সাথে নিজেও একটু কিছু মুখে দিস সকাল থেকে কিছু খাসনি। নিয়ে যা।”
দরজার ওপাশে বলা ফাতেমা বেগমের কথা শুনল ইহাম। তাই আর না করল না। মায়ের কথাতে মায়রাও ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে ভেতরে ঢুকল। পড়ার টেবিলটায় রেখে বলল, “খেয়ে নিন।”
আর কিছু বলল না মায়রা। মুখটা শক্ত করে তাকিয়ে রইল অন্যদিকে। ইহাম হাতে বিরিয়ানির প্লেটটা না নিয়ে ভাত নিলো। পাতে চিংড়ী ভোনা আর মাফ ভাজাটা নিয়ে বিছানায় বসল। সবসময়ের মতো রসকষহীন গলায় ডাকলও।
“এদিকে আসো।”

মায়রা শুনেও না শুনার মতো গোয়ার হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটার চোখমুখ দেখে ইহাম আর ডাকল না। প্লেটটা বিছানায় রেখে নিজেই টেনে নিয়ে গেল মায়রা কে। মুখের সামনে লোকমা ধরে বলল, “হা করো।” মায়রার থমথমে মুখ। না আছে কোনো আনন্দ আর না আছে কোনো প্রাণ।
“হা করো মায়রা।”
“খিদে নেই” রুক্ষ গলাতেই জবাব দেয় মায়রা।
“হা করতে বলেছি।”
“বললাম তো খাবো না” বেশ বিরক্ত দেখালো মায়রা কে। ইহামের মেজাজ শক্ত হলেও দমল সে। কোমল গলায় বলল, “প্লিজ লক্ষ্মী টা হা করো।”
মায়রা কেমন করে জানি তাকালো ইহামের মুখের দিকে। ওই টান মায়া যুক্ত মুখের অধিকারি কঠিন মানুষটা হা করার সাথে সাথে নিজেও হা করে বসল আপনাআপনি।

“সকালে নাকি খাওনি।”
“….
“কিছুদিন আগের কথা ভুলে গেলে? এভাবে না খেয়ে থাকলে চলবে? বিছানায় পড়তে হবে তখন।”
“পড়লেই কি? আপনার ভাবতে হবে কেন? সেই তো ছেড়েই দিবেন?”
মেয়েটা যেন প্রশ্নাত্মক চাউনি তে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কথাটা শুনেও না শুনার ভান করে ইহাম খায়িয়ে দিতে দিতেই বলল, “খেয়ে উঠে মেহেদী দিবে। বিকেলে বের হবো।”
“কোথাও যাবো না আমি।”
“না করো না মায়রা।”
“না’ই করছি। যাবো না কোথাও।”
“প্লিজ জান আজকের দিনটা অন্তত নষ্ট করো না। রাগ অভিমান যা আছে সব মিটিও। প্লিজ সিনক্রিয়েট না করে যা বলছি করো। রাতের ফ্লাইটেই চট্টগ্রাম ফিরব।”

মায়রা মুখটা ফিরিয়ে নেয় অন্যদিকে। সত্যি তার কাছে সবকিছু এক বিরক্ত লাগছে। ফিরেই যখন যাবো তখন আসতে গেলো কেন? তাকে কি কেউ দাওয়াত দিয়ে এনেছে নাকি?
কোনো রকম বা হাতের এক পিঠে সিম্পল করে মেহেদী দিয়েছে মায়রা। আশ্চর্য আব্বুর আনা মেহেদী টা তো সে খুলেই নি তাহলে কে দিয়েছিল? তিক্ত সময়টুকুতে আর বেশি গুরুত্ব দিলো না সেসবে।
বেশ অনেকক্ষণ ধরে এভাবে এক ঘরে বসে থাকতে থাকতে মায়রা বিরক্ত হলো আরো বেশি। এদিকে ইহাম উঠে হুট করেই পাঞ্জাবী খুলে ফেলল। দৃশ্যটা দেখে লজ্জায় অস্থিমজ্জায় কাঁপন ধরে উঠল তার। ঠোঁট উল্টে মাথা নুয়ে কোনো রকম গেল দরজার কাছটায়। তখনি ইহাম ডেকে বলল,

“কোথায় যাচ্ছো মায়রা? এদিকে আসো।”
মায়রা উত্তর না দিয়েই মাথা নত করে পা টিপে পৌঁছালো দরজার কাছে। বদ্ধ দরজা খুলার আগেই ইহাম ঝড়ের বেগে গিয়ে খপ করে ধরল হাতটা।
ভারি কন্ঠে বলল, “আমি ঘুমাবো মায়রা। কাম।”
“আশ্চর্য আপনি ঘুমাবেন ঘুমান গিয়ে। না করেছে কে? আমার হাত ধরেছেন কেন?”
ইহাম উত্তর না দিয়ে পাজোকোলে তুলে নেয় মায়রা কে। বিছানায় নিয়ে শুয়িয়ে দিয়ে তাকে জড়িয়ে নিজেও শুয়ে পড়ে।

“আজব আপনি এমন করছেন কেন? ছাড়ুন আমায়।”
“হুশশ, একদম নড়ো না জান।”
মায়রা হঠাৎ করেই থমকে যায়। ভেতরটা মুচড়ে উঠে।
“একটা মাস ধরে শান্তিতে ঘুমাতে পারি নি মায়রা। একটু ঘুমাতে দাও লক্ষ্মীটা।”
মায়রা চুপটি করে থাকে। যেন কোথাও হারিয়ে গিয়েছে সে।
“দুইটায় ডাক দিবে। বের হবো।”
অতঃপর মায়রা কে ঝাপটে ধরেই সে মেয়েটার ঘাড়ে মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ করে। এদিকে মানুষটার গা থেকে ভেসে আসা সুমিষ্ট ঘ্রাণ আর উষ্ণ নিশ্বাস নিগূঢ় অস্থিরতা স্থাপন করে মায়রার মনঃস্পটে।

“ইদ মোবারক।”
শিফু যেন চাতক পাখির মতো এইটুক কথা শুনার আশাতেই বসে ছিল সকাল থেকে। তুহিন ভাই এর কথায় হৃদয়টা ধুকবুক করে উঠে। উচাটন মন নিয়ে জবাব দেয়, “ইদ মোবারক।”
“কেমন আছো শিফুটিফু?”
“আলহামদুলিল্লাহ আপনি?”
“এই তো…”
এরপর দুজনই নীরব থাকে কিছুসময়। ফোনের ওপাশ থেকে দুজনের কানের পর্দায় ভাজে মিহি নিশ্বাসের আওয়াজ।
অতঃপর তুহিন নিজেই ফিসফিস করে বলে, “কিছু বলবে না?”
শুকনো ঢোক গিলে শিফু। যদিও তার বলা উচিৎ নয় তবুও ক্ষীণ কন্ঠে শুধায়, “আপনি ওখানে গিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে গিয়েছেন তাই না তুহিন ভাই?”
“সব মিলিয়ে এটা বলাই যায়।”

কন্ঠে খানিক অভিমান ঢেলে মলিন স্বরে আবারও শুধায়, “বিদেশ গিয়ে অনেকটা বদলেছেন আপনি তুহিন ভাই।”
“স্মৃতি যদি জ্বালাতন করে তবে বদলে যাওয়াই ভালো। না বদলে গেলেও চেষ্টা করছি বদলানোর।”
শিফুর কোমল হৃদয়ে আঘাত করে তুহিন ভাই এর সোজা স্বাভাবিক কথা। হৃদয়ে অদৃশ্য ক্ষত সৃষ্টি হয় নিমিষে। ভারভার বুক নিয়ে পুরু কন্ঠে বলল শিফু, “বেহালায় যদি বদলানোর সুর ধরে তবে সেটা সংগীতে পরিণতই হয়।”
“এত কঠিন কথা কি করে বলো তুমি শিফু? কে শিখিয়ে দেয় এসব কথা?”
দুঃখ লুকানোর মলিন হাসি হাসে শিফু। জবাব দেয়, “শিখতে হয় কিংবা পরিস্থিতি শিখিয়ে দেয়।”

“আমায় মিস করো না?”
“করলেই?”
“কি হতো আমার নামে বাঁধা পড়লে?”
“কারণ বাঁধা ছিলো।”
“ওটা মানব সৃষ্ট। তুমি চাইলেই কিন্তু অনেক কিছু হতে পারত শিফু।”
“হয়তো পারত। হয়নি বলেই আপনি এখন মুক্ত আছেন এটাই কি আপনার স্বাধীনতা কিংবা রিলাক্স ভাব নয়?”
“তা ঠিক। কোনো সুঁতোয় তো আর বাঁধা পড়ে নেই। যা খুশি করতে পারি। কোনো প্রবলেম হয়না। জাস্ট ফান আর ইনজয়।”

“….
“তোমার দিন কেমন কাটে?”
“ভালো।”
“সামনের বছর তো পরীক্ষা না?”
“হুম।”
“মন দিয়ে পড়ো।”
“হু…”
“সেজেগুজে ছবি পাঠিও সালামি দিবো নে।”
“ছবি না পাঠালে কি সালামি দেওয়া যাবে না?”
“সালাম না করলে সালামি দিবো কেন? কাছে নেই তাই ছবিই সালাম হিসেবে গ্রহণ করলাম।”
“বিনিময় প্রথা না করলে কি কিছু পাওয়া যায় না তুহিন ভাই?”
“বিনিময় প্রথা সেই আদিমকাল থেকে চলে আসছে। বিনিময় প্রথা চালু না থাকলে শুধু শুধু কিছু দিয়ে লাভ কি?”
“সবকিছুতে লাভক্ষতির হিসেব করলে তো এই পৃথিবীর অনেক কাজই করা হতো না।”
“ওকে শিফুয়া চৌধুরী তোমার স্টাডি লাইফ ভালো হোক। ভাইয়ের আদরের বাধ্য বোন, রাখছি।”
শিফু জানে তুহিন ভাই তাকে খোঁচা মেরে কথা বলছে। মলিন কন্ঠে শুধায়, “আজো কি ব্যস্ত?”

“খুব। বের হবো।”
“এখন?”
“হু।”
“এই বদলানোর সুরে আপনার মনে কোথাও কি আমি আছি তুহিন ভাই?” বলতে খুব মন চাইল শিফুর। কিন্তু গলায় এসেই কথা গুলি আটকে গেল। কোনো ভাবেই বাক্যটা আর বের করতে পারল না সে। ওপাশ থেকে সেকেন্ড পাঁচ নীরবতা চলল। হঠাৎ অদ্ভুত গলায় বলল তুহিন,
“তোমায় মিস করি শিফুটিফু।”
ফোনটাও কেটে গেল। শিফু শ্বাস টেনে নিল জোরালো ভাবে। নিভে আসা প্রদীপ খানায় হঠাৎই আশার শিখা জ্বলে উঠল শেষাত্মক বাক্যে।

মোটামুটি গতিতে গাড়ি চলছে বাইপাস একটা রাস্তা ধরে। দুইপাশ থেকে ধেয়ে আসা বাতাস শরীরে কনকন হাওয়া দিচ্ছে। মায়রা কে নিয়ে বের হবে বলে ইহাম আগে থেকেই গাড়ি নিয়ে এসেছিল। গাধা মেয়েটাকে বলেছিল ২ টার দিকে ডাক দিতে। তার উমে মেয়েটা নিজেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। তাই বের হতেহতে বেশ দেরি হয়ে গেল।
শহর থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে তারা। একটা লেকের পাড় দেখে ইহাম গাড়ি থামায়। খুব একটা মানুষ নেই বললেই চলে। যারা ছিল তারাও এখন আবার চলে যাচ্ছে। আকাশটাও কেমন আবছা হয়ে আছে। মায়রার হাত ধরে রাস্তা পার করে খালি একটা জায়গায় ঘাসের উপর বসল দুজন।
চুপচাপ নিরিবিলি পরিস্থিতি আর হীম বাতায়ন শরীরে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় প্রশান্তি। মায়রা ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় চুপ করে বসে থাকা ইহামের দিকে। নিজেও খানিক চুপ থেকে বলে উঠে, “আমার কথা আছে আপনার সাথে।” ইহাম স্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়েই ক্রুর হাসে। যেন মায়রার কথার অপেক্ষা তেই আছে সে। মনে মনে আওড়ায়, “আমারও কথা আছে তাই তো এখানে নিয়ে এসেছি।”

“আমি আপনাকে কিছু বলছি শুনতে পাচ্ছেন?”
মায়রা বেশ রাগান্বিত হয়েই বলল কথাটা। ইহাম ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো। স্বল্প কন্ঠে বলল, “আমারও কথা আছে তোমার সাথে।”
“না। আপনি প্রথম থেকেই বলে এসেছেন সবসময়। আজ আমি বলব আপনি শুনবেন।”
জবাব দেয়না ইহাম। সূক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে দেখে কেবল মায়রার মুখাভঙ্গি।
“আপনার সাথে আমার একমাস ধরে কোনো রকম যোগাযোগ হয়না অথচ আপনি কত স্বাভাবিক হয়ে আছেন। শেষবার কি বলেছিলেন তা নিশ্চয়ই মনে আছে।”
“বলো শুনছি।”

“আপনার সাথে শুরু থেকেই আমার কোনো দিক থেকে যায় না। আমরা টোটালি দুজন দুই মেরুর প্রাণী। আমাদের দেখা কিংবা পরিচয় হওয়ার পর থেকেই যতটা না ভালো মুহূর্ত আছে তার থেকেও বেশি খারাপ অভিজ্ঞতা, ঝগড়া আর তিক্ততা আছে। যেন সম্পর্কটা দুজনের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। না আছে কোনো সম্মান, ভরসা, বন্ধুত্ব পূর্ণ আচরণ আর না সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মতো আছে ভালোবাসা। মানছি আপনি দায়িত্বশীল। সম্পর্কের মানে আপনার কাছে বোধহয় দায়িত্বশীল হলেও আমার কাছে ভালোবাসার। যেটা আপনার মাঝে নেই। আপনি তো আমায় মানুষ বলেও মনে করেন না।

আপনার যখন রাগ হবে তখন কুকুরের মতো কেবল আমার সাথেই ব্যবহার করবেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে বলে যে সবার মতো স্বামী সংসার টিকাতে সব মেনে নিবো তা নয়। আমার কাছে আমার আর আমার অনুভূতির দাম আছে। কখনো কখনো কিছু বিষয় হয়তো মেনেও নেওয়া যায় যদি সম্পর্কটায় ভালোবাসা থাকে। কিন্তু আমাদের সম্পর্কের মাঝে এটা নেই। আমার কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে। যখন যেভাবে পারবেন হেয় করে কথা বলবেন আঘাত করবেন, না হওয়া সংসারে ভাতের খোঁটা দিবেন। আমি তো আর আপনার বাসার কুকুর নই যে সব সহ্য করেও পড়ে থাকতে হবে। এভাবে আমি পারব না নিজের দাম বিকিয়ে, হৃদয়ের অনুভূতি কে পায়ে পিষে আপনার কাছে থাকতে। আপনি তো বলেছেনই আমায় ছেড়ে দিবেন। টক্সিক সম্পর্ক বাড়তে দেওয়ার চেয়ে এটাই ভালো।”
একনাগাড়ে কথা গুলি বলে দম নিল মায়রা। নিশ্বাস আটকে রেখে বলা কথাগুলি বুকের খুব গভীরে আঘাত করলেও বাহিরের আবরণ শক্ত কঠোর।

“কোনটা মায়রা?”
সরুচোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করে ইহাম। এতেই ফুঁসে উঠ মায়রা। অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ক্ষোভান্বিত কন্ঠে বলে, “আপনি তো দেখি খুব মুডে আছেন তবে আমিও কিন্তু সিরিয়াস।”
রেগে মায়রা উঠতে চাইল। ইহাম হাত ধরে তাকে বসিয়ে দিয়ে বলল, “কথা শেষ হয়নি বসো।”
“আপনার এই খামখেয়ালি আমার একটুও সহ্য হচ্ছে না।”
“আমাদের বিয়ের কতদিন হলো বলতে পারবে? কিংবা সংসার জীবনের কয়টা দিন আমরা এক সাথে ছিলাম?”
জবাব দেয় না মায়রা। নিজ থেকেই বলে,
“একটা সম্পর্ক সুন্দর করতে গুছিয়ে নিতে সময় লাগে। মানছি তোমায় আমি সেই পর্যাপ্ত সময়টা দিতে পারিনি। তাই আমাদের বোঝাপড়া টায় অনেকটা ফারাক হয়ে গেছে।”
জবাবে কিছুই বলে না মায়রা।

“বিয়ের পরে মুখেমুখে বললেই ভালোবাসা হয় না। তখন ভালোবাসাটা বুঝা যায় কাজে আর দায়িত্বে। একটা মানুষের মুখে বলা কথাটাই কি জরুরী? চোখের ভাষা কাজে কিছুই কি বুঝা যায় না?” মাথা নুয়ে তুচ্ছ ভাবে হাসে ইহাম। “শালা ছোটবেলা থেকে কেন যে সব কিছু বলার অভ্যাস টা করলাম না তাহলে আজ বউ এভাবে চলে যাওয়ার কথা বলত না।”
বুকে ধক করে লাগল মায়রার। কথাটায় নয় লোকটার অদ্ভুত কন্ঠে। নিশ্বাস আটকে সে তাকালো ইহামের দিকে। ওই কন্ঠে কি ছিল?
“তুমি বললে আমি তোমায় মূল্য দেই না। অথচ আমি যদি সেটা বলতে পারতাম তবে দুনিয়া বুঝত তুমি আমার কাছে ঠিক কি।”
ঢোক গিলল ইহাম। দৃষ্টি এখনো অদূরে সেই স্বচ্ছ পানির দিকে।
“এই পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে স্বল্প ভাষী। যারা নিজেদের অনুভূতি ভালোলাগা খারাপ লাগা গুলি বাকি সবার মতো বলতে পারে না। প্রকাশ করতে পারে না। তারা শব্দের চেয়েও বেশি কিছু প্রকাশ করতে জানে নীরবতায়। তাই বলে এই না যে তারা মানুষ নয় কিংবা তার অনুভূতি নেই। বরং এসব মানুষদের অনুভূতি হয় গভীর উচ্চারণের চেয়েও প্রবল।”

ঘাড় ফিরিয়ে ইহাম মায়রার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয় দুজনের। মেয়েটা তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ শান্ত আকাশে ভাজ পড়ার মতো করে ইহাম বলে উঠল, “আমার অনুভূতি শব্দে নয়, হৃদয়ে বাজে মায়রা।”
আচমকা ধেয়ে আসা ধোয়ার কুণ্ডলীর মতো কিছু একটা তার নিশ্বাস রোধ করে দেয়। মনের বেগতিক অবস্থার আভাস পেয়ে হুট করে মায়রা উঠে দাঁড়ায়। এক পা বাড়াতেই ইহাম উঠে তার পথ আগলে দাঁড়ায়।
“কথা শেষ হয়নি মায়রা চলে যাচ্ছো কেন?”
“আপনি হয়তো ঠিক বুঝতে পারেননি আমি কি বলতে চেয়েছি। এসব কথা ভালো লাগছে না আমার।”
“আমি প্রসঙ্গেই আছি মায়রা বরং তুমি ছিটকে পড়ছো।”
চুপ করে যায় মায়রা। কারণ সে নিজেও জানে ইহাম লাইন চ্যুত হয়নি। সে নিজেই অভিযোগ তুলেছে ভালো না বাসার। কিন্তু মানুষটাকে তো মুখ ফুটে বলতেও পারছে না এসব কথায় তার জ্বালা হচ্ছে ভেতরে। এতদিনে শক্তভাবে গড়ে তুলা ভীতটা দূর্বল নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে।

মায়রার দুই বাহু আঁকড়ে ধরে ইহাম। লঘু কন্ঠে বলে, “আমি তো মানুষ মায়রা। আমার কি কোনো চাওয়াপাওয়া থাকতে নেই? আমি কি তোমার কাছ থেকে নিজে কিছু চাইতে পারি না? আমার না বলা কথা, চোখের ভাষা, মনের অব্যক্ত অনুভূতি কাছের মানুষটা নিজ দায়িত্বে বুঝে নিক সেটা চাইতে পারি না? মানছি তুমি আমার মেন্টালিটির না কিন্তু অবুঝ তো নও। কবে বুঝেছিলে আমায়? আমি মুখ ফুটে কিছু না বললে ভেতরের লুকানো অনুভূতির আড়ালে কেবল বাহিরের শক্ত আবরণ টাই দেখে গিয়েছো। একেবারে নির্বোধের মতো। কখনো ভেতর দেখার প্রয়াস টুকুও করোনি তুমি।”
“এটা আপনি বলছেন? অথচ আমার দিকটা আপনি বিবেচনা করেছেন?”
“করিনি বলছো?”
মুখ ফিরিয়ে নেয় মায়রা।

“প্রথমপ্রথম না করলেও এরপর তোমায় বুঝার চেষ্টা করিনি বলছো? সবসময় চাইতে আমি মুখ ফুটে বলি তোমায় ভালোবাসার কথা। কিন্তু আমার প্রকাশতার ভাষাটাই নেই। সময় চাইতে নিজের কাজের জন্যে দিতে পারি না। এছাড়া কি মায়রা? সম্মান? তোমায় আমি কি অসম্মান করি বলো তো? বেয়াদব মাথামোটা গবেট এগুলিই তো? আসলেই মায়রা তুমি মনে করো আমি ওসব তোমায় অসম্মান করে বলি? সোনা ময়না টিয়ার বদলে ওগুলি আমার আদুরে সম্বোধন হোক সেটা রাগে কিংবা অন্য সময়ে। আর কি মায়রা?”

“আপনার রাগ ভয়ংকর ইহাম। যেটা আমি মেনে নিতে পারি না। আর পারব না। না আছে আপনার মাঝে কোনো অনুতপ্ত আর না অনুশোচনা। আপনি এখনো বুঝতেই পারছেন না আমার সাথে আপনি ঠিক কি ব্যবহার করেছেন। আপনার কথায় এখনো মনে হচ্ছে এরপরও আপনার ভয়ংকর রাগ চাপলে আপনি আবারও আমায় আঘাত করে কথা বলবেন এরপর এসে স্বাভাবিক ভাবে দুইটা কথা বললেই আমি সব ভুলে যাবো। এভাবেই চলবে তো? এভাবেই থাকতে হবে? সরি টু সে এত যাতনায় আমি নিজেকে সামলে নিতে পারব না।”

মায়রা কিছুদিন চলে হেটে চলে যেতেই পিছন থেকে ইহাম চেঁচিয়ে উঠে, “তোমার কি আমাকে রোবট মনে হয় মায়রা? আমার ভেতর কি শুধু রাগই আছে? দুঃখ কষ্ট অনুতাপ কিছুই নেই? হ্যাঁ আমি নিজেই ফিল করেছি তোমায় ওভাবে বলে। নিজের রাগটাকেই কন্ট্রোল করতে পারি না আমি। তাই বলে কি অনুতাপ হয়না বুকে? একটা মাসের প্রতিটা দিন প্রতি রাত তোমায় মিস করেছি। তোমার যন্ত্রণায় ছটফট করেছি মায়রা। মুখে না বললে তো তোমরা আবার কিছু বিশ্বাস করো না। আমি জানি আমার রাগ আর স্বল্প কথার স্বভাব আমার কাল হবে। এটাই হলো। এত নিষ্ঠুর হইও না মায়রা। আমার ভেতরের অপ্রকাশিত অব্যক্ত অনুভূতি এটা মেনে নিতে পারবে না রে। মায়রা। মায়রা।”

শেষের চিৎকারে মায়রার পা থেমে গেল। নিদারুণ কষ্টে নিশ্বাসটা একেবারে আটকে এলো। ইহামের ভেজা কন্ঠে মায়রা টপটপ করে কেঁদে দেয়। তবুও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু না হয় তিনিও বুঝুক অবহেলা কঠোরতার কষ্টটুক।
ইহাম ছুটে আসে মায়রার কাছে। দুই বাহুতে হাত ধরে বলে, “কি চাইছো টা কি মায়রা? কেন এমন করছো? আমি উন্মাদ হয়ে যাই এটাই চাইছো?”
“আমি কাউকে কিছুই হতে বলিনি।”
“তবে এত পাষাণ হচ্ছো কেন?”
“এসব তো আপনারই শেখানো।”
ইহামের মুখ কালো হয়ে যায়। যেন মুখাভঙ্গি তে বুঝা যায় ভেতরে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্যটুক। আহত স্বরে বলে,
“ভুল হয়েছে আমার।”
“ভুল? কথায় কথায় আঘাত করেন অপমান করেন আপনি ওসব ভুল? আমার ফিলিংসের মূল্য দেন না আপনি। আপনি বলেছেন আমি বসে বসে অন্ন ধ্বংস করি ইহাম।”

কেঁদে উঠে মায়রা। বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব হয় ইহামের। হৃদপিন্ডটা কা’মড়ে ধরে কোনো কিছু। আচমকা মায়রার হাতটেনে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। শক্ত বাহুডোরে আগলে নিয়ে বলে উঠে,
“আমি ভুল করেছি মায়রা। আমি আমার অপরাধ স্বীকার করে নিচ্ছি। তোমার সাথে ওভাবে রেগে কথা বলে আমি প্রতিনিয়ত দগ্ধ হয়েছি জান। আমার ভেতর পুড়েছে তোমার সাথে একটিবার কথা বলতে। প্রতিটি ক্ষণ চেয়ে এসেছি তুমি নিজ থেকে কল করো আমায়। শুধু একটাবার। কিন্তু করোনি। এই একমাসে তোমার গুটিয়ে যাওয়া আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া আমায় বুঝিয়েছি তোমার কষ্টটুক। সরি জান আমি মাফ চাইছি তোমায়। রাগ আছে তাই বলে ইগো নিয়ে বসে থেকে নিজে নিজে উন্মাদ হতে পারব না। প্লিজ জান মাফ করে দাও। তবুও আর মুখ ফিরিয়ে রেখো না আমার দিক থেকে।”

মায়রা ফুঁপায়। বুকে নাক মুছে। এরমাঝে কালো আকাশ থেকে ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ে। ওভাবেই দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে প্রায় আধভেজা হওয়ার পথে।
“আপনি আবার রেগে গেলে আমায় কষ্ট দিবেন। যা খুশি তাই বলবেন। আপনায় মাফ করা যায় না ক্যাপ্টেন সাহেব।”
ইহাম মায়রা কে বুক থেকে তুলে। দ্রুত বেগে মায়রার গালের দুইপাশে হাত দিয়ে বলে উঠে, “আমি কথা দিচ্ছি তোকে আর কষ্ট দিবো না। তবুও আমায় পাগল করার জন্যে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিস না জান।”
মায়রা নাক টেনে ইহামের বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। কয়েকটা কিল দিয়ে আধো কন্ঠে বলে, “আর কখনো যদি আমায় কষ্ট দিয়ে কথা বলেন সত্যি বলছি আমি কখনো আপনায় আর মাফ করবো না। বউ কে ভালোবাসা দিয়ে রাখতে না পারলে রাখার দরকারই নেই।

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৫০

ইহাম আবারও মায়রার হাত টেনে এনে ঝাপটে ধরে তাকে। অদ্ভুত প্রশান্তিতে চোখ বন্ধ করে থুতনি রাখে মায়রার কাঁধে। হিসহিস করে বলে, “আদর করব। খুব আদরে রাখব কথা দিলাম। বউ একটু জড়িয়ে ধরো প্লিজ। বুকের ছাতিটা বউ বউ করে বড্ড দাপাদাপি করছে।”
ততক্ষণে আকাশ কাঁপিয়ে গর্জন দেওয়ার সাথে সাথে ধরণীর বুকে ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নামে। এ যেন সকল দুঃখ কষ্ট অপেক্ষা কিংবা মনোমালিন্য নীরদ রূপে আকাশ থেকে ঝড়ে পড়ছে ভূতল ছুঁয়ে।

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৫২