মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৭
মাহা আয়মাত
রাত তখন আনুমানিক দুইটা। অর্তিহা ফ্লোরে বসে আছে, মাথা রেখেছে বিছানায়। তার চোখের জল থামছে না একটুও। রুমে ঢোকার পর থেকে সে কাঁদছে অবিরাম। কাঁদবেই বা না কেন? আজ সে হারিয়েছে তার ভালোবাসার মানুষটাকে। নিজের চোখের সামনে দেখেছে তার প্রাণটা নিভে যেতে। অর্তিহার চোখে বারবার ভেসে উঠছে মাওলিদের নির্মম মৃত্যু দৃশ্যটা। অথচ একবারের জন্যও সে তার ভালোবাসার মানুষটাকে ছুঁতে পারেনি। বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে কষ্টে।
এরই মাঝে একবার তাহিয়া কারদার এসে ডেকেছিল। কিন্তু অর্তিহা তখন রাগ, কষ্ট আর বিরক্তিতে কড়া স্বরে তাহিয়াকে চলে যেতে বলেছিল। একা থাকতে চেয়েছিল। কান্নার মাঝেই হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হয়। অর্তিহা বিছানা থেকে মাথা তুলে দরজার দিকে তাকাতেই দেখে, আদ্রিক দরজাটা বন্ধ করছে।
অর্তিহা দাঁড়িয়ে যায়। রাগ আর বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে,
— আপনি আমার রুমে ঢুকেছেন কিভাবে? আমি তো লক করে রেখেছিলাম!
আদ্রিকের ঠোঁটের কোণে হালকা এক বাঁকা হাসি। ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
— রুমে আমি আগেও বহুবার এসেছি! চাবি আছে আমার কাছে!
অর্তিহা পূর্বের তুলনায় গলার স্বর চওড়া করে বলে,
— কেন এসেছেন? বেরিয়ে যান!
আদ্রিক অর্তিহার কাছে এসে ডান হাত রাখে অর্তিহার কোমরে, বাম হাত পিঠে দিয়ে টেনে নেয় নিজের কাছে। তারপর অর্তিহার কান্নায় ফোলা চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— বর বউয়ের কাছে কেন আসে?
অর্তিহা হতবাক হয়ে বলে,
— মানে? আপনি কী বলছেন?
আদ্রিক অর্তিহার লাল হয়ে যাওয়া নাকের ডগায় নিজের নাক ছুঁইয়ে নরম গলায় বলে,
— আদর করতে এসেছি।
অর্তিহা ছটফট করে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আদ্রিক ছাড়ে না।
— ছটফট করছিস কেন?
অর্তিহা রেগে বলে,
— আপনার ছোঁয়ায় ঘৃণা হচ্ছে আমার! ছাড়েন!
আদ্রিক ঠোঁটে একফোঁটা হাসি টেনে বলে,
— এখনো ঠিকমতো ছুঁইনি, তাতেই ঘৃণা? তাহলে গভীরভাবে ছুঁইলে কী করবে?
অর্তিহা কাঁপা গলায় বলে,
— চলে যান, না হলে আমি চিৎকার করবো!
আদ্রিক শান্ত স্বরে উত্তর দেয়,
— রুমটা সাউন্ডপ্রুফ, অর্তিজান! তুই চিৎকার করলেও কেউ শুনবে না। আর শুনলেও আমি কেয়ার করি না। আমি যেটার জন্য এসেছি, সেটা না করে যাবো না, বেবিডল।
অর্তিহার গলা কাঁপছে, চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।
— আপনি আমার সঙ্গে এমন করছেন কেন? আমি কী করেছি? কিসের শাস্তি দিচ্ছেন? একটাবার বলেন কেন আপনি আমাকে এতো কষ্ট দিচ্ছেন?
এবার আদ্রিকের চোখের দৃষ্টি গভীর হয়ে ওঠে। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসিটা মিলিয়ে যায়। চোখে ফুটে ওঠে কষ্ট আর কঠোরতা।
— করেছিস তো! আমার ফিলিংসের মজা করেছিস!
অর্তিহা বিস্মিত হয়ে বলে,
— আপনার ফিলিংস? এসব কী বলছেন?
আদ্রিক কঠিন কণ্ঠে বলে,
— কিসব বলছি আমি? আমি তোর মধ্যে মত্ত ছিলাম, আর তুই সেই ফিলিংসকে জুতো মেরে আরেক ছেলের সাথে প্রেম রচয়িতা করেছিস! এটা কি তোর কাছে কম মনে হয়?
— আমি আপনাকে সবসময় ভাই ভেবেছি! ভাইয়া আর আপনার মধ্যে কখনো পার্থক্য করিনি!
আদ্রিক ঠান্ডা গলায় বলে,
— আমি তোর ভাই না! আর না তুই আমার বোন লাগতি! তোর আর আমার আগে একটাই সম্পর্ক ছিলো, সেটা হচ্ছে তুই আমার প্রেয়সী, আর এখন আমরা স্বামী-স্ত্রী!
অর্তিহা কেঁপে উঠে বলে,
— আপনার প্রতি তো এখন আরও বেশি ঘৃণা আসছে! আমি আপনাকে ভাই ভাবতাম, আর আপনি কিনা আমাকে অন্য নজরে দেখতেন!
আদ্রিক এক ভ্রু উঁচিয়ে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বলে,
— ঘৃণা বেড়েছে?
— হ্যা, বেড়েছে!
আদ্রিক ঠান্ডা হেসে বলে,
— এখন আরও বাড়বে!
বলেই আদ্রিক অর্তিহাকে কোলে তুলে নেয়। অর্তিহা ছটফট করতে থাকে, কিন্তু আদ্রিক তাকে বেডে শুইয়ে নিজে তার উপর উঠে পড়ে। সে অর্তিহার দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরে—গলা, বুক, মুখজুড়ে উন্মাদের মতো নাক ঘষে, পাগলের মতো চুমু দিতে থাকে। অর্তিহা কান্না করে, নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। আদ্রিক টেনে অর্তিহার গলায় থাকা কলেজের ক্রসবেল খুলে ফেলে, তারপর খুলে ফেলে তার ড্রেসটাও। অর্তিহা ছটফট করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যায়। ধীরে ধীরে তার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে, চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যায়। সকাল থেকে কিছু না খাওয়া, সারাদিনের কান্না আর মানসিক ধকল সব মিলে জ্ঞান হারায়।
ফজরের আজানের সময় আদ্রিক ক্লান্ত হয়ে অর্তিহার উপর থেকে সরে যায়। কম্বলটা টেনে অর্তিহার গায়ে জড়িয়ে পাশে শুয়ে পড়ে। শ্বাস নিতে থাকে জোরে জোরে। চোখ পড়ে অর্তিহার দিকে। নিশ্চল, ফ্যাকাশে ভাঙা চেহারা। তার মুখের মলিনতা দেখে আদ্রিকের বুকটা মোচড় দেয়। সে ঝুঁকে অর্তিহার মুখের দিকে তাকায়, চোখ দুটো নরম হয়ে আসে। চোখের কোনায় পানি জমে, কিন্তু গড়িয়ে পড়ার আগেই আঙুল দিয়ে মুছে ফেলে।
আদ্রিক ঢোক গিলে। কণ্ঠটা ভারী, ব্যথায় কাঁপা,
— আজ তোর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতাম, কিন্তু তুই সেই মানুষটা, যে আমাকে হার্ট করেছে। ভাবিনি আমার ফুলটা আমাকেই কাঁটা বিঁধাবে। তুই বুঝলি না অর্তি, তুই আমার কত আদরের, কত যত্নের! তোকে আমি নিজের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। তোকে দেখলেই মনে হতো, তুই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর জিনিস। আমি শুধু তোকে দেখতাম, শুধুই তোকে।
আদ্রিক থামে। অর্তিহার গালে হাত রেখে নরম স্বরে বলে,
— আমার স্বপ্ন ছিল তোর আমার একটা সংসার হবে, যেখানে থাকবো শুধু তুই আর আমি। তুই যদি অন্য কাউকে তোর হৃদয়ে জায়গা না দিয়ে আমাকে জায়গা দিতি তাহলে আমি আমার হৃদয় এনে তোর হাতে রাখতাম। কেন এমন করলি অর্তি? কেন এত কষ্ট দিলি?
আদ্রিকের কন্ঠস্বর কঠোর হয়ে উঠে,
— ওই থার্ড ক্লাস ছেলেটার পাল্লায় পড়ে এতদিন আমাকে বোকা বানালি? আমার চেয়ে আপন হয়ে গেছে সে? অথচ আমার জীবনে তুই-ই ছিলি সবচেয়ে আপন! মনে রাখিস, আজকের পর থেকে তুই আর আমাকে কাঁদাতে পারবি না। সে সুযোগ তুই হারিয়ে ফেলেছিস।
বলেই আদ্রিক উঠে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে দরজা খুলে ভেতর থেকে লক করে বাইরে চলে যায়।
পরের দিন অর্তিহা সারাদিন রুম থেকে বের হয় না। পরিবার সবাই তাকে ডেকেছে। কিন্তু অর্তিহা কাউকে দরজা খুলে দেয়নি, বেরও হয়নি। সে সারাদিন নিজের রুমেই কাটায়। রাত তখন গভীর। অর্তিহা ফ্লোরে বিধস্ত অবস্থায় বসে আছে। মাথা বেডে রাখা, চুলগুলো পাগলের মতো এলোমেলো। কাল থেকে কান্না করতে করতে চোখের নিচে কালো দাগ ফেলে দিয়েছে। কিন্তু এখন চোখ একদম শুকনো। মন যেন ঘোরে ভরা। একঘেয়েমিতে সে দূরের ফ্লোরের দিকে নির্দিষ্টভাবে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়, রুমের লাইট জ্বালিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে। গলায় দাগ হয়ে আছে, যেটা আদ্রিক গতরাতে দিয়েছে। দাগটা দেখে নিজের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা লাগে অর্তিহার।
অর্তিহা আচমকা নিজের শরীর থেকে কিছু মুছার চেষ্টা করতে থাকে অবুঝের মতো,
— ইশশ সারা শরীরে ঐ খুনিটার স্পর্শ লেগে লেগেছে! মুছতে হবে! মুছতে হবে! ভালোভাবে মুছতে হবে! খুনিটা আমাকে অপবিত্র করে দিয়েছে! ছিহ! মুছতে হবে! মুছচে না কেন? নোংরা স্পর্শগুলো যাচ্ছে না কেন?
হঠাৎ সে শান্ত হয়ে, বিরবির করে নিজেকেই বলতে থাকে,
— এইভাবে মুছবে না! জানাজার গোসলের মাধ্যমেই এই নোংরা স্পর্শ গুলো মুছে যাবে! আর জানাজার গোসলের জন্য তো মরতে হবে! এখন আমি মরতে হবে! আমি বেঁচে থেকে কি করবো? না নিজের ভালোবাসার মানুষকে বাঁচাতে পারলাম আর না নিজের সম্মান, সতীত্ব! আমার মাওলিদের খুনির স্পর্শ পরেছে আমার শরীরে! সেই দেহে প্রাণ থাকা সাঝে না! হুম এখন এই দেহে প্রাণ রাখা যাবে না!
বলেই অর্তিহা আশেপাশে কিছু খুঁজতে থাকে। সবকিছু ছড়িয়ে ফেলে। সাইড টেবিলের প্রথম দুটো ড্রয়ার খুলে দেখে পায় না। তৃতীয়টা খুলতেই আশানুরূপ জিনিসটা পায়। মুখে হাসি ফুটে উঠে। দ্রুত ড্রয়ার থেকে ছুড়িটা বের করে।
ছুড়িটা উপরে তুলে ভালোভাবে দেখে, তারপর বলতে থাকে,
— ছুড়ি দিয়েই তো মেরে ফেলেছে আমার মাওলিদকে? তখন নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছে! কষ্ট ও একা পাবে কেন? আমিও পাবো! আমিও ওর মতো কষ্টে ছটফট করে মরতে চাই!
বলেই বাম হাতটা উপরে তুলে ছুড়িটা হাতের উপর রাখে। যেই ছুড়িটা চালিয়ে দিতে যাবে হাতে তখনই একটা চেনা কন্ঠ শুনে থেমে যায়।
— মরে যা কিন্তু কাল সবাই তোর মৃত্যুর খবর পাওয়ার আগেই গত রাতের তোর আর আমার কাটানো মুহুর্তের ভিডিও দেখবে! কালকে রাতে আমাদের মধ্যে যা যা হয়েছে সবকিছু!
অর্তিহা আয়নায় তাকিয়ে দেখে দরজার সামনে আদ্রিক দাঁড়িয়ে আছে। বরাবরের মতোই স্বাভাবিক চেহারা। হাতে ট্রে আর তাতে খাবার। অর্তিহাকে এমন অবস্থায় দেখেও আদ্রিক কোনোভাবেই বিচলিত নয়।
অর্তিহার মাথার ওপর দিয়ে কথাগুলো যায়। সে কিছুই বুঝতে পারে না।
— ভিডিও মানে? আপনি কি বলছেন? ভিডিও কোথা থেকে আসবে?
আদ্রিক এগিয়ে এসে সাইড টেবিলে ট্রে রাখতে রাখতে বলে,
— আমার ফোনে আছে। যেটা গতরাতের সবটা কেপচার করেছে!
অর্তিহা একটুও ঘাবড়ায় না, অবাকও হয় না। কাল থেকে ওর সাথে যা হচ্ছে, তাতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। শান্ত গলায় সোজাসুজি প্রশ্ন করে,
— আপনি কেন করছেন এসব? আমাকে কষ্ট দিতে? আমি তো কষ্ট পেয়েছি! আমার সামনে আমার মাওলিদকে মেরে ফেলেছেন! আমার সাথে জোরজবরদস্তি করেছেন কাল রাতে! তাহলে আর ভিডিও করার কি দরকার ছিলো?
আদ্রিক উত্তর দেয় না। অর্তিহা উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে চোখ ভরে ওঠে পানি; ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠে,
— বাঁচার তো কোনো কারণ রাখেননি! এখন আমাকে মরতে দেন! এতো কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না!
অর্তিহার কথায় আদ্রিকের মুখাবয়ব অপরিবর্তিত। কঠিন কণ্ঠে সে বলে,
— তুই মরে গেলে আমি কাউকে বাঁচতে দিবো না! কেউ শান্তি তে বাচতে পারবে না। তুই আমাকে হার্ট করেছিস না? এখন তুই চলে গেলে তোর শাস্তি আমি চাচ্চু কে দেবো, মিমিকে দেবো, আরভিদকে দেবো! কারদার ম্যানরকে দেবো! চাচ্চু, মিমি, আরভিদ ও কারদার ম্যানরের সম্মান আমি ধুলোয় মিশিয়ে দেবো। বাড়ি থেকে যদি লাশ বের হয় তাহলে একটা না একাধিক হবে!
অর্তিহা কান্না থামিয়ে, জলভরা চোখে ক্লান্ত গলায় বলে,
— এমনও কেউ হয়? এতোটা হিংস্র, কঠোর?
— সবাই হয় না! শুধু আমি হই! আমার অবাধ্য হলে সব শেষ করে দিবো!
— আমাকে কবে শেষ করবেন পুরোপুরি?
আদ্রিক নিজের দুই হাত অর্তিহার দুই গালে রেখে শক্ত গলায় বলে,
— তোকে নিজের কাছে রাখবো! তোর শেষ নেই!
আদ্রিক থামে।
— কিন্তু তুই যদি নিজেকে শেষ করতে চাস তাহলে বাকিদের শেষ হওয়ার দায়ীও তোরই!
অর্তিহা অবুঝ বাচ্চার মতো প্রশ্ন করে,
— শান্তি দিবেন না? মরার মতো করে বাঁচিয়ে রাখবেন?
— তুই কিভাবে বাচতে চাস এটা তোর উপর ডিপেন্ড করে! তুই যেমন চাইবি তোকে আমি সেভাবেই রাখবো! অন্যকাউকে চাইলে কষ্ট আর আমসকে চাইলে সুখ!
— আজকে আমি দুর্বল তাই আপনি বেঁচে যাচ্ছেন! কিন্তু যেদিন আমি শক্তিশালী হবো সেদিন আমি নিজের হাতে আপনাকে মারবো!
আদ্রিক কিছুক্ষণ অর্তিহার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অর্তিহার চোখে ঘৃণা আর প্রতিশোধ জ্বলছে।
আদ্রিক শান্ত স্বরে বলে,
— হাত মুখ ধুয়ে আয়। খাবার নিয়ে এসেছি চুপচাপ খা!
অর্তিহা চোখ নামিয়ে বলে,
— বিষ ছাড়া কিছু মুখে নিবো না!
— ওকে! যাচ্ছি আমি ভিডিও টা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট করতে!
বলেই আদ্রিক যেতে চাইলে অর্তিহার হাত ধরে নেয়। ভেজা চোখে তাকিয়ে বলে,
— খাবো!
আদ্রিক টেবিল থেকে প্লেট নিয়ে অর্তিহার মুখের সামনে লোকমা ধরলে অর্তিহা বলে,
— আপনার ঐ অপবিত্র হাত দিয়ে খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না!
আদ্রিক স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
— এই অপবিত্র হাত দিয়েই তো ছুয়ে ফেলেছি এখন খাওয়ার ক্ষেত্রে অপবিত্রতা দেখে কি হবে?
অর্তিহা শক্ত গলায় বলে,
— হবে! কখনো দেখেছেন ধর্ষিতাকে ধর্ষকের হাত থেকে খাবার খেতে?
মুহুর্তেই আদ্রিকের চোখজোড়াতে হিমশীতলতা ভর করে।
— আমার স্পর্শ কে ধর্ষণ বলে আখ্যায়িত করবি না! নয়ত তোর বাদ বাকি আপনজনদের লাস পাবি! আমার ভয়ংকর রূপ তো দেখেছিস! কতটা নির্দয় নিষ্ঠুর সে রূপ! তাই আমার অবাধ্য হবি না নয়ত! বাকিটা আর বলার প্রয়োজন আছে?
অর্তিহার চোখজোড়াতে এতক্ষণ ভয় না থাকলেও আদ্রিকের চোখ দেখে অন্তর কিছুটা ভয় পায়। কথাগুলো শুনে ভয় আরও বাড়ে। আপন মানুষ হারানোর ভয়। একজন আপন মানুষ হারানোর কষ্টই সে সহ্য করতে পারছে না। সেখানে এতোগুলো আপন মানুষের কষ্ট কিভাবে সহ্য করবে? কিভাবে নিজে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে বাড়ির সবাইকে মৃত্যু যন্ত্রণা দিবে?
আদ্রিক নিজ হাতে অর্তিহাকে খাইয়ে দিতে থাকে। অর্তিহার ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও খাচ্ছে আদ্রিকের হাতে। কারণ অন্যথায় প্রিয়জনকে হারাতে হবে। খেতে খেতে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। খাওয়া শেষ হলে আদ্রিক উঠে ওয়াশরুমে হাত ধুয়ে ফিরে দেখে অর্তিহা ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। আদ্রিক এগিয়ে এসে পাশে বসে। অর্তিহা তাকায় না, তবু আদ্রিকের উপস্থিতি বোঝে।
আদ্রিক স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
— কালকে থেকে যেন আর কান্না করতে না দেখি ঐ ছেলের জন্য! তুই আমার! তোর চোখের জলও অন্য কারোর জন্য বের হবে না!
অর্তিহা আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
— তাহলে আজকে শেষ কান্না টা কেঁদে নেই?
আদ্রিক নিজের পকেট থেকে একটা সিরিজ বের করে অর্তিহার গলায় ইনজেকশনটা পুশ করতে করতে শক্ত গলায় বলে,
— নাহ!
অর্তিহা তাকিয়ে আছে আদ্রিকের দিকে। চোখ দুটো গোল হয়ে আছে, শরীর নিস্তেজ, ধোঁয়াশা চোখে তাকিয়ে থাকে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিজের মধ্যে নেই! ধীরে ধীরে তার চোখ ছোট হয়ে আসে, বন্ধ হয়ে ঢলে পড়তে থাকে। আদ্রিক দ্রুত হাত বাড়িয়ে তাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। অর্তিহা ঘুমিয়ে গেছে। দুদিন পেটে খাবার না পড়ায় শরীর ক্লান্ত, তার উপর আদ্রিক তাকে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করেছে। কারণ অর্তিহার রেস্ট দরকার শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। আদ্রিক কোলে তুলে বেডে শুইয়ে দেয় অর্তিহাকে।
আদ্রিক কিছুক্ষণ অর্তিহার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ দুটো না নরম, না কঠোর কিন্তু তাতে ব্যথা ছিল। এমনভাবে তার চোখে ব্যথা একটু আগে ছিল না!
আদ্রিক নরম স্বরে ক্লান্ত গলায় বলে,
— এই কষ্টটা তুই নিজেই চেয়েছিস! অন্য কারও সাথে সুখ দেখলে আমার থেকে নরক যন্ত্রণাই পাবি! এখনো তোকে আমি আমার পাওয়া যন্ত্রণার একাংশও দেইনি! এই শাস্তিটা দিচ্ছি যেন জীবনে দ্বিতীয়বার আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে জায়গা না দিস!
এরপর আদ্রিক উঠে দাঁড়ায়। ধীরে পা ফেলে অর্তিহার রুমের দরজাটা ভেতর থেকে লক করে নিজের রুমে চলে আসে। গিয়ে সোজা রুমের বাম পাশে রাখা গ্র্যান্ড পিয়ানোর দিকে এগিয়ে যায়। বড়, কালো চকচকে সেই পিয়ানোটা ঘরের কোণজুড়ে ছড়িয়ে আছে, যার ঢাকনা খোলা আর ভেতরের তারগুলো হালকা আলোয় ঝলমল করছে। টুলে বসে সে জোরে পিয়ানো বাজাতে শুরু করে। পিয়ানোর তালে তালে গেয়ে ওঠে,
— তুই কবে যে বুঝবি বল, পাগল মনের উথাল-পাথাল! তুই কবে যে বুঝবি বল, পাগল মনের উথাল-পাথাল! হলো বানজারা, বানজারা, হলো বানজারা!
ওর পিয়ানো বাজানো দেখেই বোঝা যায়, বুকের ভেতর কতটা অশান্তি জমেছে। আজই তার শেষ পিয়ানো বাজানো! কাল থেকে সে আর পিয়ানো বাজাবে না। কেনই বা বাজাবে? যার হাসিমাখা মুখ দেখার জন্য নিয়ম করে পিয়ানো বাজাতো, সে তো আর আসবে না তার বাজানো শুনতে!
হ্যাঁ, অর্তিহার কথাই বলা হচ্ছে। অর্তিহা আদ্রিকের পিয়ানোর সুর শুনলেই রুমে এসে বসে থাকতো, মুগ্ধ হয়ে শুনতো। আদ্রিকও তার অর্তিজানের জন্যই পিয়ানো বাজাতো। কিন্তু কাল থেকে তার বেবিডল আর আসবে না, খুশি হয়ে সেই সুরে হারিয়ে যেতে!
মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৬
প্রায় পনেরো মিনিট জোরে বাজানোর পর আদ্রিক থেমে যায়। আজই শেষ, নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্য বাজানো এই পিয়ানো। সে আবার বাজাবে, শুধু সেই দিন যেদিন তার অর্তি আবার মুগ্ধ চোখে শুনবে তার পিয়ানোর সুর।
