মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৮
মাহা আয়মাত
বিকেল গড়িয়ে একটু আগেই সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বাড়ির ভেতর এখন বেশ কোলাহল। কারণ, সবার প্রতীক্ষার মুহূর্তটা ঘনিয়ে আসছে। মেহজা রুমে ঢুকে দেখে, রুমে আরভিদ নেই! হয়তো নিচে সবকিছু দেখাশোনা করছে। এতক্ষণ সে ছিল অর্তিহার কাছে। সারাদিনই অর্তিহার সাথেই থেকেছে। এক মুহূর্তের জন্যও তাকে একা ছাড়েনি। এখন শুধু একটু সময়ের জন্য এসেছে নিজে শাওয়ার নিয়ে রেডি হতে। যাওয়ার আগে মিশানকে অর্তিহার কাছে বসিয়ে দিয়ে কড়া ভাবে বলে এসেছে, এক মুহূর্তের জন্যও যেন অর্তিহাকে একা না ছেড়ে যায়, আদ্রিক কিংবা আরভিদ যেই আসুক না কেন!
মেহজা কাভার্ড থেকে আরভিদের একটি টি-শার্ট আর নিজের একটি প্লাজু বের করে। শাওয়ারের পর এগুলোই পরবে। কারণ ওয়াশরুমে শাড়ি পরতে বেশ কষ্ট হয়। তারপর ঝটপট ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। প্রায় এক ঘণ্টা পর শাওয়ার শেষ করে বেরিয়ে এল ওয়াশরুম থেকে। চুল ভালোভাবে মুছে মাথায় তোয়ালে পেচিয়ে মেকআপ করতে লাগল। মেকআপ শেষ করে মাথা থেকে তোয়ালে খুলছে, তখনই রুমে ঢুকল আরভিদ। চেহারায় রাগী রাগী ভাব!
মেহজা তখন ড্রেসিং টেবিল থেকে হেয়ার ড্রায়ারটা নিয়ে চুল শুকাতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই আরভিদ দ্রুত এগিয়ে এসে ড্রায়ারটা মেহজার হাত থেকে নিয়ে নেয়।
মেহজা অবাক হয়ে তাকায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— কী হয়েছে? হেয়ার ড্রায়ার নিয়েছেন কেন?
— চুল শুকাবি?
মেহজা ত্যারা উত্তর দেয়
— না, কাপড়!
— তা বল! কাপড় শুকাতে সমস্যা নেই!
মেহজা বিরক্ত কন্ঠে বলে,
— পাগল হয়েছেন নাকি? হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে অবশ্যই চুল শুকাবো!
— না, হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকানো লাগবে না! এতে হিটে চুল ড্যামেজ হয়ে যাবে।
— অবশ্যই লাগবে! আমার চুল ড্যামেজ হলে হবে! দিন, আমি শুকাবো!
আরভিদ গম্ভীর কন্ঠে বলে,
— একদমই না! আর চুল তোর হলেও যত্ন আমি করি। সো, তোর চুলে তোর চেয়ে বেশি অধিকার আমার!
মেহজা রেগে বলে,
— আশ্চর্য! আমি কি তাহলে রেডি হবো না?
আরভিদ অবলীলায় উত্তর দেয়,
— আমি মানা করেছি নাকি?
— চুল না শুকালে রেডি হবো কিভাবে?
— চুল শুকানোরই তো ব্যাপার? আমি শুকিয়ে দিচ্ছি, ওয়েট কর!
এই বলে আরভিদ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মেহজা বেডে বসে রাগে ফুঁসতে থাকে।
— সালা গন্ডার! দিচ্ছে না আমাকে রেডি হতে! সব মেহমান এসে আমাকে ফকিন্নি দেখে চলে যাবে!
ঠিক তখনই দরজা খুলে আবার ঢুকে আরভিদ। হাতে ছোট একটা ফ্যানের মতো কিছু একটা।
মেহজা ভ্রু কুঁচকে বলে,
— এটা কী?
আরভিদ হাতে থাকা জিনিসটা দেখিয়ে বলে,
— এটা একটা ছোট এসি টাইপ ফ্যান! এতে বরফ আর ঠান্ডা পানি দিলে একদম এসির মতো ঠান্ডা বাতাস দেয়। ওই বাতাসেই তোর চুল শুকিয়ে দেবো দুই মিনিটে! আর এতে চুলের কোনো ক্ষতিও হবে না!
মেহজা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায়। অর্থাৎ সে বিশ্বাস করছে না যে এটা দিয়ে চুল শুকানো যাবে। মেহজা গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আরভিদ তার পেছনে দাঁড়িয়ে ফ্যান দিয়ে চুল শুকাতে থাকে মেহজার। ঠান্ডা বাতাসে মেহজার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। পুরো মাথা ঠান্ডা হয়ে গেছে, দারুণ আরাম লাগছে।আরভিদ ধীরে ধীরে চুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে শুকাতে লাগল, মাঝে মাঝে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাথায়। সেই আরামের ছোঁয়ায় মেহজার চোখে প্রায় ঘুম এসে গেল।
প্রায় পাঁচ মিনিট পর আরভিদ বলে,
— এই নে, তোর চুল শুকিয়ে গেছে!
মেহজা চুলগুলো হাত দিয়ে ধরে দেখে সত্যিই চুলগুলো একদম শুকিয়ে গেছে। মেহজার ভালো লাগে আরভিদের এই কাজে। কিন্তু সেটা আরভিদকে বুঝতে দেয় না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে,
— হুম! এখন আপনি যান, দ্রুত শাওয়ার নিয়ে এসে রেডি হন! আমরা কয়েকটা কাপল ফটো তুলবো!
আরভিদ মুচকি হেসে বলে,
— আচ্ছা বউজান!
এই বলে আরভিদ শাওয়ার নিতে চলে যায়। আরভিদ বাথরুমে ঢুকতেই মেহজা দরজাটা লাগিয়ে দেয়। তারপর বিয়ের জন্য কেনা গোল্ডেন রঙের ওপর সাদা পাথরের ভারি শাড়িটা পরে নেয়। শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে নানা ভঙ্গিতে পোজ দিতে থাকে।
মেহজা আয়নায় নিজেকে দেখে ঢং করে হেসে বলে,
— ইশ মেহু! তুই এত সুন্দর কেন? তোর এত সুন্দর হওয়াটা কিন্তু ঠিক না!
এরপর বিছানা থেকে মোবাইলটা নিয়ে একের পর এক সেলফি তুলতে থাকে। ঠিক তখনই শাওয়ার থেকে বের হয় আরভিদ। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে সে মেহজার কাণ্ড দেখছে। মেহজার সেলফি তোলা শেষে সেলফিগুলো দেখে মুখ বাঁকায়। একটাও সুন্দর হয়নি! বিরক্ত হয়ে রেগে গিয়ে মোবাইলটা বিছানায় ছুড়ে মারে।
আরভিদ ভ্রু কুচকে বলে,
— কী হয়েছে? রেগে যাচ্ছিস কেন?
মেহজা দ্বিগুণ রাগ নিয়ে চোখমুখ কুচকে বলে,
— ৫০ টার উপরে ছবি তুললাম, একটাও সুন্দর হয়নি! সালার আমার কপালটাই খারাপ! কোনো মোবাইল বা ক্যামেরায়ই আমার ছবি ভালো আসে না!
আরভিদ কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে। মেহজা আবার আয়নার সামনে গিয়ে কয়েকটা পোজ দেয়। এবার নিজের রাগ ভেঙে হাসতে শুরু করে।
মেহজা খুশি হয়ে বলে,
— এই যে আয়নায় আমাকে দেখতে কী সুন্দর লাগছে। আমি তো নিজের ওপর নিজেই ফিদা হয়ে যাচ্ছি। ইশশ, যদি আয়নায় স্ক্রিনশট নেওয়া যেতো!
আরভিদ হেসে ফেলে। তারপর সে বিছানা থেকে পাঞ্জাবি টা তুলে পড়ে নেয়। তার ওপর ওয়েস্টকোট পরে। কোটটিতে গোল্ডেন রঙের জড়ির কাজ করা। সাথে সাদা পায়জামা, হাতে ঘড়ি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করে নেয়। নিত্যদিনের সুদর্শন আরভিদকে যেন আজকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে সাদা পাঞ্জাবিতে। আজকেও বহু মেয়ে ঘায়েল হবে এই সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত পুরুষটিকে দেখে। কিন্তু ঘায়েল না হয়ে উপায় আছে? যেখানে এই পুরুষের সৌন্দর্যই এমন চোখ ধাধানো। সেখানে মেয়েদের দোষ কি?
আরভিদ রেডি হয়ে বিছানা থেকে নিজের আইফোনটা তুলে নিয়ে মেহজার কোমর পেছন দিক থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আয়নায় তাকিয়ে বলে,
— চলেন মিসেস কারদার, এই গোল্ডেন মুহুর্তটাকে স্মৃতি রাখি?
মেহজা মুখ বাঁকিয়ে বলে,
— এইসব মোবাইল ক্যামেরার এখনো সেই যোগ্যতা হয়নি আমার সুন্দর চেহারাটা সুন্দর করে ক্যাপচার করার! তাই ফেস ঢেকে ছবি তুলবো। আর এমনিতেও ফেইসলেস ছবি এসথেটিক লাগে!
আরভিদ হেসে বলে,
— ঠিক আছে, তাহলে নেমে পড়ি?
— কোথায়?
— মিশন এসথেটিকে!
— আচ্ছা!
বলপই মেহজা সামনে এসে আরভিদকে জড়িয়ে ধরে, মুখ লুকায় তার বুকে। আরভিদ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা মিরর ছবি তোলে। এরপর ফেইসলেস আরো অনেক ছবি তোলে। ছবি তোলা শেষে মেহজা বলে,
— দেন ফোনটা দেন। ছবিগুলো দেখবো!
আরভিদ ফোনটা মেহজার হাতে দেয়। মেহজা ছবিগুলো দেখে খুশি হয়ে বলে,
— ছবিগুলো অনেক সুন্দর হয়েছে! অবশ্য সুন্দর হবেই তো! আপনি আগে তো ফটোগ্রাফি করতেন! ভুলেই গেছিলাম!
আরভিদ চুপ থাকে। মেহজা আবার বলে,
— শুনেছিলাম, ফটোগ্রাফির প্রতি আপনার অনেক শখ ছিলো! আচ্ছা, আপনি এটা ছেড়ে দিলেন কেন?
আরভিদ কিছু বলে না। চোখ ঘুরিয়ে তাকায় অন্য দিকে।
মেহজা অবাক হয়।
— চুপ করে আছেন কেন? বলেন? না বললে কিন্তু আমি রাগ করবো!
আরভিদ মেহজার দিকে তাকায়। নরম স্বরে, ভালোবাসা মেশানো চোখে তাকিয়ে বলে,
— ছোট শখ ছিলো। সময়ের সাথে ছেড়ে দিয়েছি!
— মিথ্যে বলবেন না! সবার থেকে শুনেছিলাম, ফটোগ্রাফির প্রতি আপনার কত নেশা ছিলো! এখন বলেন, কেন ছেড়েছেন?
আরভিদ ঠোঁট বেঁকে হালকা হেসে নরম গলায় বলে,
— বড় শখের জন্য ছোট শখটা ছেড়ে দিয়েছি।
মেহজা কৌতূহলী হয়ে বলে,
— বড় শখ?
— হুম। তুই হচ্ছিস আমার বড় শখ!
মেহজা কিছুই বুঝতে পারে না।
— কিছুই বুঝতে পারছি না! খুলে বলেন!
আরভিদ একটু থামে। চোখে হালকা স্মৃতি জমে ওঠে। যে কারণেই সে ফটোগ্রাফি ছেড়ে দিয়েছিলো।
পাঁচ বছর আগে
আরভিদ নিজের রুমের সোফায় বসে নিজের শখের ক্যামেরার লেন্সটা পরিষ্কার করছে। মনোযোগ দিয়ে কাপড়টা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লেন্সটা মুছছে। ঠিক তখনই দরজায় নক হয়।
আরভিদ অনুমতি দেয় ভেতরে আসার।
— আসো।
দরজা খুলে ভেতরে ঢোকেন আভীর কারদার। তিনি এসে বিছানায় বসেন, মুখোমুখি আরভিদের হয়ে। আরভিদ হাতের কাজ থামায় না, ক্যামেরা পরিষ্কার করতেই করতেই আভীর কারদারের দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
— কিছু বলবে, ড্যাড?
আভীর বলেন,
— হ্যাঁ, জরুরি কথা ছিলো।
— বলো।
— এটা ছাড়বে কবে?
আরভিদ লেন্স মুছা থামিয়ে আভীর কারদারের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— কোনটা?
আভীর কারদার চোখের ইশারায় ক্যামেরাটা দেখিয়ে বলেন,
— হাতে যেটা নিয়ে রেখেছো! তোমার এই ফটোগ্রাফির নেশা!
আরভিদ একটু থেমে শক্ত গলায় বলে,
— এটা কখনো ছাড়ছি না! ফটোগ্রাফি আমার শখ!
— শখ তোমার রাজনীতিও! কিন্তু দুই শখ একসাথে টিকবে না। ব্যালেন্স করতে পারবে না। যেকোনো একটাকে বেছে নিতে হয়, আরেকটা ছাড়তে হয়।
আরভিদ দৃঢ় কন্ঠে বলে,
— আমি ব্যালেন্স করছি, ড্যাড! তোমার বলতে হবে না।
আভীর কারদারও দৃঢ় কন্ঠে বলেন,
— এত ব্যালেন্স করার দরকার নেই। ফটোগ্রাফি ছেড়ে দাও! ফটোগ্রাফিতে যে সময়টা দিচ্ছো, সেটা রাজনীতিতে দাও। রাজনীতিবিদের শখ একটাই থাকতে পারে, সেটা রাজনীতি। নইলে রাজনীতিতে উন্নতি করা অসম্ভব!
আরভিদ চোখমুখ শক্ত করে বলে,
— আমি ফটোগ্রাফি ছাড়ছি না কোনোভাবেই! অন্য কিছু বলার থাকলে বলো, নয়তো যাও।
— তোমার জীবনে কোনটা বেশি শখের, মেহজা নাকি ফটোগ্রাফি?
আরভিদ হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। রাগে তার গলা ভারী হয়ে যায়।
— দুটোই আমার শখের, দুই জায়গায়!
— যদি কোনো এক সময় তোমাকে একটা বেছে নিতে হয়, কোনটা নেবে?
আরভিদ চুপ করে যায়। চোখে জ্বলজ্বল করে রাগ আর অস্থিরতা।
আভীর ভ্রু উঁচু করে তাকায়, হালকা ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গভরা হাসি।
— তখনও কি ফটোগ্রাফি চুজ করবে?
আরভিদ রেগে জোরে বলে উঠে,
— মেহু! মেহুর থেকে শখের আমার কিছুই নেই!
আভীর হাসেন। এই উত্তর টাই তিনি চাচ্ছিলেন।
— ঠিক আছে, যেহেতু মেহজার উপরে তোমার কোনো শখ নেই, তাহলে মেহজার জন্যই ফটোগ্রাফি ছেড়ে দাও।
আরভিদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— তুমি মেহুকে ব্যবহার করছো, ড্যাড?
আভীর স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
— ব্যবহার কোথায় করলাম? আমি তো তোমাদের ভবিষ্যতের কথাই বলছি!
আরভিদ শক্ত গলায় বলে,
— বলতে হবে না!
— আগে-পরে ফটোগ্রাফি ছাড়তেই হবে। দুদিন পরে যখন তুমি মন্ত্রী হবে, তখন ক্যামেরা নিয়ে এভাবে ঘোরা মানাবে না!
— আমি যেটা করবো, সেটাই মানাবে! কারণ আমি আরভিদ কারদার!
— তুমি মেহজাকে চাই বলেছো, আমি কিছু বলিনি। এক কথায় রাজি হয়ে গেছি। মাসরিফ আমাকে সরাসরি না করে দেওয়ার পরও নিজের অহং সাইডে রেখে তোমার জন্য দ্বিতীয়বার মাসরিফের সঙ্গে কথা বলে রাজি করিয়েছি! আর আজ তুমি আমাকে এইভাবে না করছো?
আরভিদ আগের মতোই শক্ত গলায় বলে,
— তোমার কি মনে হয়, তোমার বা মাসরিফ আঙ্কেলের আপত্তিতে আমার মেহুকে পাওয়া আটকাবে?
আভীর হেসে বলেন,
— অবশ্যই না! আমি জানি, তোমার কারও মতামতের দরকার নেই। কিন্তু যখন সব কিছু সুন্দরভাবে, সবার সম্মতিতে হচ্ছে, তখন ঝামেলা করার দরকার কী?
আরভিদ চুপ করে যায়। মুখে রাগ জমে ওঠে, কপালের রগ ফুলে ওঠে। চোখে জ্বলছে অভিমান আর যন্ত্রণার মিশেল।
আভীর কারদার আবার হেসে বলেন,
— ড্যাড তোমাকে একটা সিম্পল শর্ত দিয়েছি। আর তুমিই তো বলেছিলে, মেহজার উপরে তোমার কোনো শখ নেই! তাই শর্তটা মানা কঠিন কিছু না। বড় শখের জন্য ছোট শখ কুরবানি দিতে হয়, তাহলেই বড় শখের মূল্য বোঝা যায়।
বর্তমান
আরভিদের কথা থেমে যায়। তার চোখে এক অদ্ভুত কষ্টের ঝিলিক। প্রিয় জিনিস হারানোর সেই ব্যথা এখনো স্পষ্ট। মেহজা চুপচাপ তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখে পানি জমে উঠেছে। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। তাকে পাওয়ার জন্য আরভিদ ফটোগ্রাফি ছেড়ে দিয়েছিলো! যে ফটোগ্রাফি ছিলো তার নিঃশ্বাস, তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় অংশ, সেটা ছেড়ে দিয়েছে শুধু তাকে পাওয়ার জন্য? তাহলে সে আরভিদের কাছে এতটা মূল্যবান? ভাবতে ভাবতেই মেহজার চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। আরভিদ আলতো করে এগিয়ে এসে নিজের হাত দিয়ে সেই জল মুছে দেয় মেহজার গাল থেকে।
আরভিদ নরম স্বরে বলে,
— কাঁদছিস কেন, মেহু?
— আপনি আমাকে এতটা চান?
মেহজার কন্ঠে কাঁপুনি। আরভিদ বিনা দ্বিধায় বলে,
— অনেক!
মেহজা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
— কেন? আমার মধ্যে এমন কী আছে যে আপনি আমার জন্য এত কিছু করেন?
আরভিদ গভীর শ্বাস নিয়ে বলে,
— জানি না আমি। কিন্তু তুই ছাড়া আমার কিছুই ভালো লাগে না।
মেহজা একটু নিচু স্বরে বলে,
— তাই বলে আমার জন্য আপনার এত শখের ফটোগ্রাফি ছেড়ে দিবেন?
আরভিদ মৃদু হেসে বলে,
— আগে ফটোগ্রাফিই ছিল আমার শখ। কিন্তু তোকে দেখার পর বুঝেছি, এখন তুই-ই আমার সবচেয়ে মূল্যবান শখ।
বলেই আরভিদ মেহজার কোমর ধরে আলতো করে নিজের দিকে টেনে নেয়। ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে রাখে, তারপর নাক ছুঁইয়ে দেয় মেহজার নাকে। মেহজা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলে, দুহাত দিয়ে আরভিদের গলা জড়িয়ে ধরে।
নীরবতার মধ্যে মেহজার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে,
— কষ্ট লাগেনি ফটোগ্রাফি ছাড়তে?
আরভিদ চোখ বন্ধ রেখেই ধীর কন্ঠে বলে,
— সামান্য লেগেছিলো। কিন্তু তুই না থাকলে যতটা কষ্ট পেতাম, তার ধারে কাছেও না।
দুজনেই আবার চুপ হয়ে যায়। ওদের দুজনের মাঝে তখন শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ। অনুভব মিশে আছে প্রতিটি মুহূর্তে। হঠাৎই মেহজা এক অপ্রত্যাশিত কাজ করে বসে। কোনো কিছু না ভেবে সে আরভিদের ঠোঁটে চুমু খায়। আরভিদও থেমে না থেকে সাড়া দেয়। দুজনের ঠোঁট মিশে যায় একে-অপরের মধ্যে। সময় যেন থেমে যায়। প্রায় দুই মিনিট পর মেহজা আলাদা হতে চায়, কিন্তু আরভিদ ছাড়ে না। বরং আরও দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে নেয় তাকে। আরও কিছুক্ষণ পর অবশেষে সে মেহজাকে ছেড়ে দেয়। মেহজা চোখ খুলে তাকায়। মুখ লাল হয়ে গেছে, জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। লজ্জায় কাঁপছে ওর গাল। আরভিদের মুখে তৃপ্ত, শান্ত, খুশিতে ভরা হাসি।
আরভিদ মৃদু হেসে মেহজাকে কাছে টেনে কোমর জড়িয়ে বলে,
— কিসটা কি সত্যিই মজা ছিল, নাকি আমি অনেকদিন পর পেয়েছি বলে মজা লাগছে?
মেহজা হেসে ওর বুকে কিল মারে,
— নিলজ্জ একটা!
আরভিদ মজা করে বলে,
— কিস তুই করেছিস, আর অপবাদ আমি পাই!
মেহজা ভেংচি মেরে বলে,
— অসভ্য!
আরভিদ হেসে উত্তর দেয়,
— তোর প্রেমে!
মেহজা হেসে বলে,
— হয়েছে! এবার নিচে যান! কত কাজ পড়ে আছে, আর আপনি এখানে ঘুরছেন!
আরভিদ চোখ টিপে বলে,
— আরেকটু থাকি না?
মেহজা হেসে ধাক্কা দিয়ে বলে,
— না! জলদি যান!
সে ওকে ঠেলে রুম থেকে বের করে দিতে দিতে বলে,
— গিয়ে কাজ করেন!
আরভিদ হেসে বেরিয়ে যায়। মেহজা আয়নার সামনে এসে নিজের লিপস্টিক ঠিক করে। আয়নায় নিজের মুখ দেখে একবার হেসে নেয়। চোখে এখনো একটু লজ্জা লেপ্টে আছে। তারপর সেও রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
আদ্রিক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুলগুলো আচড়াচ্ছে। আচড়ানো শেষে চিরুনিটা টেবিলের উপর রেখে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসে। সাদা পাঞ্জাবির ওপর হালকা গোল্ডেন কাজ করা ওয়েস্টকোট, সঙ্গে সাদা পায়জামা। বাম হাতে সিলভার রঙের ঘড়ি, ডান হাতে চেইন ডিজাইনের ব্রেসলেট। আঙুলগুলোতেও ঝিকিমিকি করছে আংটিগুলো। বাম হাতে তিনটি, একটির রঙ সিলভার, এক কালো, আরেকটি আবার সিলভার-কালো মিশ্রণের। ডান হাতে দুটো, একটা সিলভার, আরেকটা কালো। এই আংটি, এই ব্রেসলেট সবই আদ্রিকের প্রতিদিনের সঙ্গী।
আয়নায় নিজেকে পার্ফেক্ট লাগছে দেখে ঠোঁটে এক চিলতে আত্মবিশ্বাসী হাসি টেনে সে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে।
অর্তিহার রুমের দরজার কাছে এসে দরজায় নক করার জন্য হাত বাড়াতেই পেছন থেকে মেহজার কণ্ঠ ভেসে এলো,
— কোথায় যাচ্ছেন?
আদ্রিক চোখ সরু করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, ঠোঁটে টেনে আনে বিষমিশ্রিত এক হাসি।
— কানা নাকি?
মেহজা কপাল কুঁচকে উত্তর দেয়,
— না কানা না! দেখছি আমি!
আদ্রিক ভ্রু তুলে বলে,
— তাহলে প্রশ্ন করছো কেন?
মেহজা এবার গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করে,
— অর্তির রুমে আপনার কি কাজ?
আদ্রিক আগের ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
— আরভিদ তোমার সাথে রুমে যে কাজ করে, সেটাই!
মেহজা চোখ বড় বড় করে তাকায়।
— মানে?
আদ্রিক মাথা নেড়ে হাসে।
— এই টুকু কথা বুঝতে পারো না? আবার আসছো আমার সাথে লাগতে?
মেহজা সামনে এগিয়ে এসে আঙুল উঁচিয়ে বলে,
— আমাকে একদম আন্ডারস্টিমেট করবেন না! আমি ক্রাইম প্যাট্রোল দেখে বড় হওয়া মেয়ে!
— অনেক ভয় পেয়েছি আমি! এখন যাও!
মেহজা দৃঢ় গলায় বলে উঠে,
— আপনি যান! অর্তির যেতে হবে না!
আদ্রিক ঠোঁটের কোণে অভ্যাসগত হাসিটা টেনে বলে,
— তাই? তা এই কথাটা কে বলেছে? বাড়ির কর্ত্রী মেহজা?
— যা ইচ্ছে ধরে নিতে পারেন!
আদ্রিক একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
— আচ্ছা কর্ত্রী, যাচ্ছি না অর্তির রুমে! হ্যাপি?
মেহজা চুপ করে থাকে। আদ্রিক মেহজাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগল। ঠিক তখনই মেহজা পেছন থেকে বলে উঠে,
— যেভাবে সেজেছেন দেখে মনে হচ্ছে আজকে আপনারই বিয়ে।
আদ্রিক ঠোঁটের কোণে অভ্যাসগত হাসি টেনে মেহজার দিকে তাকায়।
— কে বলতে পারে? হয়তো আজই আমার বিয়ে।
মেহজা সন্দেহভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
— কি বলতে চাচ্ছেন?
— বলতে চাচ্ছি, বয়স হচ্ছে, বিয়ে করতেই পারি! দরকার পড়লে আজকেই করতে পারি, কাউকে যদি দেখে ভালো লেগে যায়।
মেহজা ব্যঙ্গ করে বলে,
— আজ জানি কার কপাল পুড়বে!
— ভালোই তো, দুই কপাল পোড়া একই বাড়িতে থাকবে।
মেহজা কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
— আরেকটা কে?
— মাননীয় আইনমন্ত্রী!
মেহজা দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
— আপনার যদি এতো চুলকানি উঠে, বলেন আমাকে। চুলকানির মলম লাগিয়ে দিব!
আদ্রিক ঠোঁটের কোণে হাসি রেখেই হতাশার সুরে বলে,
— ইশশ! সালায় শনিবারে জন্ম নিয়ে জীবনটাও শনি বানিয়ে ফেলছে! নয়ত মলম বিক্রেতা এসে কপালে জোটে!
বলেই আদ্রিক নিচের দিকে হাঁটা ধরে। পেছন থেকে মেহজার চিৎকার ভেসে এলো,
— ইচ্ছে করছে গলাটা চেপে ধরি!
আদ্রিক কোনো পাত্তা না দিয়ে শুধু ঠোঁটের কোণে একরাশ গা জ্বালানো হাসি রেখে নিচে নেমে গেল।মেহজা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে অর্তিহার রুমে। রুমে ঢুকেই মেহজা হা করে তাকিয়ে থাকে।
সাদা রঙের গাউন পরে বধূ বেশে আয়নার বসে আছে অর্তিহা। গাউনজুড়ে গোল্ডেন রঙের সুতো আর ঝলমলে স্টোনে এমন কাজ করা যে একবার দেখলেই বোঝা যায়, পোশাকটা নিঃসন্দেহে ভারি আর রাজকীয়। গলায় ঝুলছে দুটি ভারী স্বর্ণের হার—তাতে ছোট ছোট ডায়মন্ড ঝিকমিক করছে। কানে স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের তৈরি দুল। কপাল ও মাথায় স্বর্ণ আর মুক্তার তৈরি টিকলি এবং ঝাপটা। তার ওপর ভেসে আছে গোল্ডেন পাড়ের সাদা পাতলা দোপাট্টা। মুখে নিখুঁত ব্রাইডাল মেকআপ। রূপে যেন আভিজাত্যের দীপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে। আর সেই রূপকে পরিপূর্ণ করে তুলেছে ঠোঁটের নিচের সেই ছোট্ট, গাঢ় তিলটা। যেন সব সৌন্দর্যের কেন্দ্রবিন্দু সেখানেই।
মেহজা মুগ্ধ কন্ঠে বলে,
— অর্তি! আমি পাগল হয়ে যাবো! এতো সুন্দর লাগছে কেন তোকে!
মিষ্টি পাশে দাঁড়িয়ে হেসে ফেলে,
— আজকে তো সাইহান ভাইয়া শেষ!
মেহজা চোখ টিপে বলে,
— বুঝেছো, গেটে বেশি করে টাকা নিবা! এতো সুন্দর বউ পাবে, কমে কিন্তু চলবে না!
হানিন হেসে বলে,
— ঠিক বলেছেন ভাবি!
তখনি দরজা ঠেলে ভেতরে আসে আস্মিতা, নাজনীন আর তাহিয়া কারদার। ব্যস্ততার ভিড়েও তাহিয়া কারদার মেয়েকে একবার বধূ বেশে দেখতে এসেছেন। অর্তিহাকে দেখেই তিনজনের মুখ থেকে একসাথে বেরিয়ে আসে,
— মাশাল্লাহ!
তাহিয়া কারদার এগিয়ে এসে মেয়ের কপালে চুমু খান।
— মাশাল্লাহ, আমার মেয়েটাকে বউ সাঝে কত সুন্দর লাগছে। আল্লাহ যেন ওর রূপের মতোই ভাগ্যটাও সুন্দর করে দেন।
সবাই একসাথে বলে ওঠে,
— আমিন।
মিশান খিলখিলিয়ে হেসে বলে,
— আমার না, আপুর সৌন্দর্য দেখে মাঝে মাঝে হিংসা হয়! বেশি না একটু! আমি যদি আপুর মতো এতো সুন্দর হতাম, সবাই আমাকেই দেখতো! আপু অনেক লাকি!
সবাই হাসে মিশানের কথায়। অর্তিহা চুপ করে তাকিয়ে থাকে মিশানের দিকে। মুখে একটুও অভিব্যক্তি নেই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কেমন একটা তিক্ত হাসি খেলে যায়। যে রূপ তার জন্য অভিশাপ, সেই রূপ নিয়েই কেউ নাকি হিংসা করে! ভাগ্যবতী বলে! অথচ এই সৌন্দর্যই তো তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে সুখ, খুশি, হাসি, স্বাধীনতা সবকিছু এমনকি মুক্তিও। এই রূপই তাকে আদ্রিকের বন্দিনী বানিয়েছে।
অর্তিহা মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে,
— আজ যদি আমার এতো সৌন্দর্য না থাকতো, আমি যদি সাধারণ সৌন্দর্যের মেয়ে হতাম, তাহলে কি আদ্রিক ভাইয়া আমাকে এভাবে চাইতো? না, চাইতো না! কারণ আমি উনার মোহ, ভালোবাসা না! ভালোবাসা হলে আমাকে এভাবে কষ্ট দিতেন না!
অর্তিহাকে অন্যমনষ্ক হয়ে থাকতে দেখে তাহিয়া কারদার অর্তিহার কাঁধে হাত রেখে ডাক দেন,
— অর্তি? কোথায় হারিয়ে গেছো?
মিশান দুষ্টুমি করে বলে,
— সাইহান জিজুর মাঝে!
সবাই হেসে ওঠে। আস্মিতা মিশানের কান মুচড়ে ধরে বলেন,
— এই পাজি মেয়ে! খুব পেকে গেছো তাই না?
মেহজা তালে মিলিয়ে বলে,
— আম্মু, চিপায় নিয়ে তিন-চারটা দাও।
মিশান চোখমুখ কুচকে বলে,
— তুমি যাও চিপায় জিজু কে নিয়ে। আমি আর আম্মু কেন যাবো!
মেহজা হালকা লজ্জা পেলেও সেটা কাউকে বুঝতে দেয় না। এমন ভান করে যেন কিছু শোনেনি। আস্মিতা মিশানের পিঠে হালকা চড় মেরে বলে,
— চুপ পাজি মেয়ে! বড় বোন হয়।
মিশান তাহিয়া কারদারের দিকে ইনোসেন্ট ফেস করে বলে,
— মামানি! আম্মু মারছে!
তাহিয়া হেসে বলেন,
— আহ, আস্মিতা! মারছো কেন বাচ্চা মেয়ে! ছেড়ে দাও, বিয়ে বাড়ি হাসি মজা তো করবেই!
মিশান গাল ফুলিয়ে বলে,
— এটাই তো আম্মু বুঝে না!
আস্মিতা চোখ পাকিয়ে বলেন,
— তুমি খুব বুঝো না!
মিশান হেসে বলে,
— আচ্ছা আচ্ছা, এখন আমাকে না বকে অর্তি আপুকে দেখো! কী সুন্দর লাগছে!
আস্মিতা হেসে বলেন,
— লাগবেই তো! আমাদের অর্তির সৌন্দর্যই এমন!
মিশান কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে,
— আচ্ছা মামানি, একটা প্রশ্ন করি?
তাহিয়া কারদার স্নেহভরে বলেন,
— বলো?
— অর্তি আপু কার মতো হয়েছে দেখতে?
তাহিয়া কারদার খানিকটা চমকে যান।
— কেন?
— অর্তি আপুর সাথে তোমাদের কারোর চেহারা মেলে না! এমনকি আপুকে পুরো বিদেশি লাগে! দেখে মনে হয়, বাহিরের দেশ থেকে এসেছে!
তাহিয়া কারদার হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। আস্মিতা তৎক্ষণাৎ ধমকে ওঠেন,
— মিশান! তোমাকে না বারণ করেছি বড়দের মতো কথা বলতে? বড়দের বিষয় নিয়ে এত কথা বলো কেন?
আস্মিতার হঠাৎ এমন রেগে যাওয়ায় মেহজা, মিষ্টি, হানিন আর অর্তিহা একটু হতবাক হয়ে যায়। এমন ছোট আর সামান্য প্রশ্নে এত রিয়েকশন কেন!
মিশান ভয়ে পেয়ে কাঁপা গলায় বলে,
— আম্মু বকছো কেন? আমি তো শুধু জানতে চেয়েছি, অর্তি আপু কার মতো হয়েছে। এতে রাগ করলে কেন?
আস্মিতা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাহিয়া কারদার চোখের ইশারায় থামিয়ে দেন। তারপর মিশানের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলেন,
— তোমার অর্তি আপু দেখতে তার নানুনের মতো হয়েছে। আমার মা-ও দেখতে পুরো বিদেশিনী ছিলেন। আর তোমার অর্তি আপু আমার গর্ভের সন্তান, কোনো বিদেশিনীর না।
তাহিয়া একটু থেমে আবার বলেন,
— চলো এখন নিচে যাই, অনেক কাজ বাকি। একটু পরেই বর পক্ষ এসে পড়বে। চলো, নাজনীন, আস্মিতা।
আস্মিতা মিশানকে বলেন,
— তুমি আসো আমার সাথে।
মিশানের ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হয় ভয়ে। কারণ না গেলে যদি আস্মিতা আবার রেগে যায়। ওরা চলে যেতেই মেহজা, মিষ্টি আর হানিন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকে।
প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট পর মিশান হাফাতে হাফাতে রুমে ঢুকে বলে,
— বর এসে গেছে! বর এসে গেছে, চল তোমরা! গেইট ধরতে হবে তো!
হানিন আর মিষ্টি উঠে দাঁড়ায়,
— হ্যাঁ, চলো। চলো।
মেহজাকে বসে থাকতে দেখে মিশান বলে,
— আপু, চলো?
মেহজা মিশানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— না, তোরা যা। আমি অর্তির কাছে থাকবো, ও একা থাকবে।
মিশান বায়না ধরে,
— অর্তি আপু তো আর ছোট না! চলো না! তোমাকে ছাড়া মজা হবে না গেইট ধরতে! প্লিজ প্লিজ!
মিষ্টি বলে,
— হ্যাঁ ভাবি, চলেন আমাদের সঙ্গে।
অর্তিহার মন অস্থির। সাইহান এসে গেছে, বিয়ের সময়ও প্রায় এসে পড়েছে। কিন্তু আদ্রিকের কোনো খোঁজ নেই! সারাদিন কেটে গেল, তবু তাকে একবারও দেখেনি অর্তিহা। মাথার ভেতর এক অজানা ভয় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছে না, শুধু বুকের ভেতর ভারী একটা চাপা কষ্ট জমে আছে। প্রেগ্ন্যাসি অবস্থায় এমন দুশ্চিন্তা কারোই সহ্য হওয়ার না। চোখের পানি ধরে রাখতে পারছে না অর্তিহা। ইচ্ছে করছে কোথাও হারিয়ে যেতে, এমন জায়গায় যেখানে কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। না আদ্রিক, না অন্য কেউ। কারণ সে আর নিজের এই ভয় আর কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পারছে না। বড্ড ক্লান্ত সে তার কষ্ট, কান্না, অনুভূতি লুকিয়ে রাখতে রাখতে।
অর্তিহা কিছুটা ভাঙ্গা গলায় বলে,
— তুই যা মেহু, আমি একা থাকলে সমস্যা নেই।
হানিন বলে,
— ভাবি, আপনি যান, আমি আছি অর্তির সঙ্গে।
মেহজা হেসে বলে,
— না, তোমরা যাও। দ্রুত গিয়ে গেইট ধরো! তারপর এসে আমার পাওনাটা দিতে ভুলবে না। আমি একটু পর সাইহান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করবো।
ওরা চলে গেলে অর্তিহা কিছুটা সন্দিহান দৃষ্টিতে মেহজার দিকে তাকিয়ে বলে,
— কিছু হয়েছে মেহু? তুই এমন করছিস কেন?
মেহজা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
— কই, কী হয়েছে? আমি কী করলাম?
অর্তিহা তাকায় মেহজার চোখের দিকে।
— তুই গেলি না কেন?
মেহজা মৃদু হেসে বলে,
— কারণ আমার তোকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না! একটু পরই তো বিয়ে করে চলে যাবি, তারপর তো দুদিন পর দেখা হবে। তাই এখন তোর একটু বেশি করে কাছে থাকতে চাচ্ছি।
অর্তিহা নরম স্বরে বলে,
— ওহ।
গেইটে শালিকাদের দুই লাখ টাকা দেওয়ার পর সাইহান ভেতরে প্রবেশ করে। সাদা, লাল ও গোল্ডেন রঙের মিশেলে শেরওয়ানি পড়েছে। দেখতে অসাধারণ লাগছে। সাথেই আছে শায়রা পড়নে সাদা রঙের সাড়াড়া। তাকেও কম সুন্দর লাগছে না। অনুষ্ঠানে পুরুষদের মনকাড়ার মন সুন্দর লাগছে। সবাই লিভিং রুমে বসেছে। বরযাত্রী সংখ্যা তেমন বেশি না, প্রায় ২৫–৩০ জন। এখন বিয়েটা ঘরোয়া হওয়ায় মানুষ কম। সাইহান সোফায় বসে আছে, পাশে শায়রা, লাম্মি, রুশা। পূশের সোফায় সায়র আর সাইহানের ফ্রেন্ডরা। সামনের সোফায় আভীর কারদার, সারফারাজ, আফির কারদার বসে আছেন। তিনজনই চুপচাপ, কারো সঙ্গে কারোর কথাবার্তা নেই। বাকি বরযাত্রীরা কথা আর হাসি মজা মেতে আছে।
তখনি সেখানে আদ্রিক এসে উপস্থিত হয়। শায়রা ফোনে ব্যস্ত ছিলো। ফ্লোরে পুরুষের ছায়াতে চোখ পড়েই মাথা উঠিয়ে তাকায়। এবং চোখ দুটো থেমে গেল আদ্রিকের উপর। চোখ বুলায় আদ্রিকের মাথা থেকে পা পর্যন্ত। শায়রার মুখে হাসি ফুটে উঠে। সাইহান কপাল কুঁচকে, একটু বিরক্ত হয়ে আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আদ্রিক তাঁর অভ্যাসগত হাসি টেনে বলে,
— হাই সাইহান? এসে গেছো বিয়ে করতে?
সাইহান শক্ত চোখে তাকিয়ে উত্তর দেয়,
— হ্যা বিয়ে করে বউ নিতে এসেছি আর নিয়েই যাবো!
আদ্রিক মাথা বেঁকিয়ে, বাধ্য ছেলের মতো বলে,
— আচ্ছা, জামাই আদরের জন্য প্রস্তুত থেকো।
সাইহান অবোধ্যকণ্ঠে প্রশ্ন করে,
— কি বলতে চাচ্ছো?
আদ্রিক হেসে বলে,
— বউ নিতে আসছো জামাই আদর পাবে না? ইনফ্যাক্ট শুধু জামাই আদর না আমার তরফ থেকেও আলাদা আদর আছে। আর আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি কখনো কোনো ছেলে তার হবু শ্বশুর বাড়ি থেকে এতো আদর পায়নি!
সাইহান তীক্ষ্ণ আর ক্ষোভভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে আদ্রিকের জান টা নিয়ে নিতে পারলে খুশি হত। শায়রা উঠে আদ্রিকের সামনে দাঁড়ায়। তার এবং আদ্রিকের মধ্যকার দুরত্ব বেশি না, আবার খুব কাছাকাছিও নয়। সাইহানের বিরক্তি বেড়ে যায়। শায়রাকে এতো কাছে দেখে আদ্রিকের মুখাবয়বের পরিবর্তন ঘটে না। আগের মতোই ঠোঁটের কোনে অভ্যাসগত হাসিটা রয়েছে।
শায়রা মুগ্ধ চোখে হেসে বলে,
— মেরে ফেলতে চাও নাকি? এতো সুন্দর কেন তুমি? আমার চোখ দুটো যে ফেরাতে পারি না!
আদ্রিক স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
— ফেরাতে না পারলে সমস্যা নেই উপড়ে ফেলবো লিটল বিচ!
শায়রা রাগে না। উল্টো হেসে ফেলে।
— দাও গালি! প্রতিবাদ করবো না! তোমার থেকে পাওয়া গালি, কষ্ট সব আমি মাথা পেতে নেবো!
আদ্রিক হেসে উঠে,
— তোর নষ্টামি টোনে কথা বলা বন্ধ হবে না!
শায়রা পাগলামি কন্ঠে বলে,
— এভাবে হেসো না আদ্রিক আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি তোমার হাসির মাঝে!
আদ্রিক চোখ সরু করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিষমিশ্রিত হাসি দিয়ে বলে,
— একটু পর মরেও যাবি!
— এতো তাড়াতাড়ি মরবো না! তোমাকে এখনো পাওয়া হয়নি আমার!
— আফসোস তোর স্বপ্ন পূরণ হবে না।
— স্বপ্ন তোমার পূরণ হয়নি! আমার টা ঠিকই হবে! ভাইয়া অর্তিহাকে পাবে আর আমি তোমাকে!
— আমি স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিয়েছে! কারণ স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় না! এখন আমার কেবল চাওয়া আছে! আর যেটা আমি চাই সেটা পাই এট এনি কস্ট, লিটল বিচ!
— আমি শায়রাও তোমাকে চাই! আর আজ পর্যন্ত যা চেয়েছিলে সবকিছুই হাসিল করেছি! তোমার ব্যাপারটাও বেতিক্রম হয়ে না বেবি!
— আচ্ছা! হলে জানাস আমাকে!
— শশশশ! বলে যাও আমাকে দেখতে কেমন লাগছে?
— যেটা বলে তোকে ডাকি সবসময়, সেটাই লাগছে!
শায়রা হেসে বলে,
— লিটল বিচ?
আদ্রিক কিছু না বলল, ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে শায়রার চোখে তাকিয়ে থাকে। শায়রাও হাসে। আজকের দিনটি তার জীবনের খুশির দিন। আজকে সে রাগ করবে না। কোনোভাবেই না। আদ্রিক ঘুরে চলে যায়। শায়রা আদ্রিকের যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে ফিরে এসে সাইহানের পাশে বসে।
সাইহান ধীর কণ্ঠে বলে,
— কেন যাস এই ছেলের কাছে? তোকে সবসময় অপমান করে! এর থেকে বেটার ছেলে তোকে এনে দিবো আমরা, যে তোকে মাথায় তুলে রাখবে!
শায়রা মাথা নেড়ে বলে,
— চলো বিয়ে করতে হবে না তোমার।
সাইহান অবাক হয়ে বলে,
— মানে?
— মানে অর্তিহাকে বিয়ে করার কোনো প্রয়োজন নেই! অর্তিহা তো তোমাকে চায় না! আমরা ওর থেকে আছে সুন্দর মেয়ে এনে দিবো যে তোমাকে চাইবে!
সাইহান বিরক্ত হয়ে বলে,
— যা ইচ্ছে কর! ওই ছেলের লাথি উষ্ঠা খা! আমার কি!
শায়রা চুপ করে বসে আছে। পাশে বসা বান্ধবী লাম্মি শায়রার কানে ফিসফিস করে বলে,
— এই ছেলেটা এত অ্যাট্র্যাকটিভ কেন?
শায়রা চোখ সরু করে তাকায়,
— কার কথা বলছিস?
লাম্মির পাশ থেকে রুশা হেসে বলে,
— অফকোর্স আদ্রিকের কথা বলছে। কি এটিটিউট ওর! ওর তাকানোটা জাস্ট কিলিং! ওর ব্যাপারটাই অন্যরকম! কিভাবে ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে কথায় মেরে ফেলে শত্রুকে! ড্যাম হট অ্যান্ড অ্যাট্র্যাকটিভ পার্সন!
লাম্মি তাল মিলিয়ে বলে,
— এমন শত্রু তো আমরাও ডিজার্ভ করি!
কথাটা শেষ না হতেই আচমকা লাম্মি চিৎকার করে ওঠে,
— আআআহ!
শায়রার তার উঁচু হিল লাম্মির পায়ের আঙুলের ওপর চেপে ধরে রেখেছে। সর্বশক্তি দিয়ে চাপ দিয়ে রেখেছে। শায়রা মুখে ঠান্ডা ভাব, কিন্তু চোখে হিংসার আগুন।
সবাই চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— কী হয়েছে, লাম্মি?
শায়রা দ্রুত হিলটা সরিয়ে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে মুচকি হেসে বলে,
— কিছু না, আমার হিলটা ভুলে ওর পায়ে লেগে গেছে!
লাম্মি আর রুশা দুজনেই বুঝে যায় শায়রা ইচ্ছা করেই ব্যথা দিয়েছে। লাম্মি ব্যথায় কুঁকড়ে গেলেও মুখে জোর করে হাসি টেনে বলে,
— সামান্য লেগেছে!
শায়রা গলার স্বর নিচু করে বলে,
— প্রথমবার ভুল করেছিস দেখে আস্তে লেগেছে। দ্বিতীয়বার এমন ভুল হলে তৃতীয়বারের জন্য বেঁচে থাকবি না।
লাম্মি রাগে ফেটে পড়ে। নিজের রাগকে সংযত করার চেষ্টা করতে থাকে। শায়রা পাত্তা দেয় না।
সব বরযাত্রী হাসি মজা করলেও সায়র চারপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে খুঁজছে। সে আসার পর থেকেই কাউকে খুঁজে চলেছে কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনটা দেখে সে উঠে দাঁড়ায়।
সাইহান সায়রকে দাড়াতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
— কোথায় যাচ্ছিস?
সায়র সংক্ষেপে বলে,
— একটু কথা বলে আসছি!
বলেই বাইরে চলে যায়।
মেহজা নিচে এসেছে অর্তিহার কাছে হানিন আর মিশানকে দিয়ে। সে লিভিং রুমে ঢুকতেই সাইহান হেসে বলে,
— আসসালামু আলাইকুম, ভাবি!
মেহজা হেসে উত্তর দেয়,
— ওয়ালাইকুম সালাম! আপনাকে তো বেশ সুন্দর লাগছে আজ, পুরো জামাই লুকে!
সাইহান মুচকি হেসে বলে,
— থ্যাংক ইউ, ভাবি!
তারপর গলার স্বর নিচু করে যোগ করে,
— ভাবি, আপনি অর্তিহাকে একা রেখে এলেন? এই সুযোগে যদি আদ্রিক ওকে কিডন্যাপ করে ফেলে?
মেহজা হেসে আশ্বস্ত করে,
— আরে না না, চিন্তা করবেন না! অর্তি একা না, আমি মিশান আর হানিনকে ওর সঙ্গে পাঠিয়েছি। আদ্রিক ভাইয়া কিছুই করতে পারবে না। আজকের দিনেই বিয়ে হবে, ইনশাআল্লাহ!
সাইহান কৃতজ্ঞ গলায় বলে,
— আবারও থ্যাংকস, ভাবি! আপনি জানেন না, আমার জন্য কত বড় উপকার করছেন!
মেহজা হেসে বলে,
— আরে, কোনো ব্যাপার না! আচ্ছা, আমি একটু ঐদিকটা দেখে আসি।
মেহজা চলে যেতেই শায়রা সাইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— এই, তুমি কি সিউর এই মেয়ে তোমার পক্ষেই আছে? নাকি কেবল ভান করছে তোমার পক্ষে থাকার?
সাইহান বলে,
— ভাবি পুরোপুরি আমার পক্ষেই আছে। আর আদ্রিকের পক্ষে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না, কারণ ভাবি আদ্রিককে সহ্যই করতে পারে না!
সাইহানের শেষ কথাটা শায়রার একদম ভালো লাগে না। রাগে গলা চড়িয়ে বলে,
— সহ্য করতে না পারলেই বা কী? আদ্রিক কাউকেই পাত্তা দেয় না! অসভ্য একটা মেয়ে!
সাইহান বিরক্ত হয়ে বলে,
— আদ্রিকের চামচি!
শায়রা দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দেয়,
— যেমন তুমি অর্তিহার চামচা!
সাইহান আর পাল্টা জবাব দেয় না। সাইহান বুঝতে পারে আর একটা কথা যদি বাড়ে, তাহলে হয়তো ঝগড়া মারামারিতে গড়াবে। তাই সে চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করে।
মেহজা সোজা কিচেনে এসে পড়ে। এসে দেখে তাহিয়া আর নাজনীন কারদার মেহমানদের জন্য নাস্তার সব আয়োজন বের করে দেওয়ার কাজে ব্যস্ত।
তাহিয়া কারদার ব্যস্ত কন্ঠে বলেন,
— নাজনীন, মিষ্টিগুলো কোথায়? এগুলো বের করে আনো!
নাজনীন বলেন,
— এই তো, ভাবি, আনছি!
মেহজা গিয়ে তাহিয়ার পাশে দাঁড়ায়, কিন্তু কিছু বলে না। তাহিয়া আড়চোখে একবার মেহজার দিকে দেখে আবার মেইডদের কাজে তাগিদ দিতে থাকে। মেহজা এখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, একদম বাচ্চাদের মতো।
নাজনীন কারদার মিষ্টি নিয়ে এসে বলেন,
— এই নাও, ভাবি, মিষ্টিগুলো!
তাহিয়া কারদার বলেন,
— এই মিষ্টিগুলো ঐ ট্রেতে নিয়ে রাখো।
মেইড বলে,
— জ্বি ম্যাম।
মেহজা এবার চলে যেতে নেয়। ভাবে, তাহিয়া তাকে দেখছেনই না, কোনো কথা বলছেন না। কিন্তু যেই ঘুরে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাহিয়া কারদার তাকে ডেকে বলেন,
— কোথায় যাচ্ছো?
মেহজা অস্বস্তিতে পড়ে বলে,
— হ্যা, মামানি?
তাহিয়া কারদার ভ্রু কুচকে বলেন,
— হঠাৎ আবার ডাক পরিবর্তন করে ফেললে? আগে তো শাউড়ী আম্মা বলে মুখে ফেনা তুলতে!
মেহজা চুপ করে থাকে, কি বলবে বুঝতে পারে না। তাহিয়া কারদার রেগে আছেন নাকি রাগ কমেছে, বুঝতে পারছে না। মেহজা চুপ থাকায় তাহিয়া আবার বলেন,
— চুপ করে আছো কেন?
— কিছু না, শাউড়ী আম্মা।
নাজনীন কারদার মেহজাকে প্রশ্ন করেন,
— আরভিদ কোথায়?
মেহজা মাথা নেড়ে উত্তর দেয়,
— জানি না তো। এখনো দেখিনি কোথায়।
তাহিয়া কারদার আর কিছু না বলে কাজে মনোযোগ দেয়। মেহজা চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছে।
তখন একজন মেইড এসে বলে,
— তাহিয়া ম্যাম, নাজনীন ম্যাম, আভীর স্যার আপনাদেরকে ডাকছেন।
তাহিয়া কারদার বলেন,
— আচ্ছা, যাও। বলো, একটু সময় লাগবে, এদিকের কাজটা শেষ করে যাচ্ছি।
মেইড মাথা নেড়ে চলে যায়। নাজনীন কারদার বলেন,
— মেহমানদের নাস্তা মেহজা সামলাবে। আমরা বরং দেখি, ভাইয়া কেন ডাকছে। হয়তো জরুরি কিছু।
তাহিয়া কারদার সরু চোখে মেহজার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
— পারবে ঠিকভাবে সামলাতে?
মেহজা দ্রুত বলে উঠে,
— হ্যা, পারবো! আপনি চিন্তা করবেন না, নিশ্চিন্তে যান।
তাহিয়া কারদার নাজনীনকে সঙ্গে নিয়ে কিচেন থেকে বের হবেন এমন সময় মেহজা ডাক দেয়,
— শাউড়ি আম্মা?
তাহিয়া থেমে ঘুরে তাকান। মেহজা হালকা হাসি দিয়ে বলেন,
— শাড়িটাতে আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে।
তাহিয়া কারদার নিজের পড়নের শাড়ির দিকে তাকান। গতকাল আরভিদ ও মেহজা থেকে গম্ভীর স্বরে বলেন,
তাহিয়া কারদার: আমি শুধু আমার ছেলের জন্য পড়েছি। আমার একমাত্র ছেলের খুশির জন্য সব করি। তার জন্যই তোমাকে কিছুটা ছাড় দিয়েছি। আমার আদরের ছেলের চোখে জল আমি সহ্য করতে পারি না।
বলেই তিনি সোজা কিচেন থেকে বের হন। নাজনীনও সাথে চলে যান। মেহজা অবাক হয়। আরভিদের চোখে জল? আরভিদ কখন কেঁদেছে? কিছুই বুঝতে না পেরে মেহজা কাজে মন দেন।
মেহজা মেইড নাসিমাকে ডেকে বলে,
— দ্রুত কাস্টার্ডটা বের করে আনেন।
তারপর বাকি সব নাস্তা ঠিকমত সাজিয়ে নেন।
মেহজা বলে,
— এখন সবাই ট্রেগুলো নিয়ে নিন।
মেইডরা একে একে ট্রে তোলা শুরু করে। মেহজা সবকিছু দেখে, সব ঠিক আছে কিনা নিশ্চিত হয়।
— চলুন সবাই!
মেহজা লিভিং রুমে আসে, পেছনে মেইডরাও।
মেহজা মেইডদের নির্দেশ দেয়,
— নাস্তা টেবিলে রাখেন।
মেইডরা টেবিলে রাখে।
মেহজা সব মেহমানদের হেসে বলে,
— সবাই নাস্তা খান।
সাইহান হেস বলে,
— এসবের কি প্রয়োজন ছিল, ভাবি?
মেহজা বলে,
— ছিল, ছিল! আমার একমাত্র ননদের একমাত্র হবু শ্বশুরবাড়ি বলে কথা!
শায়রা ভ্রু কুচকে বলে,
— শ্বশুর বাড়ি দুইমাত্র হয়?
মেহজা মাথা নেড়ে বলে,
— হয় তো! আমাদের এলাকার এক আঙ্কেল দুই বিয়ে করেছিলেন। তার শুধু দুইটা শ্বশুর বাড়ি ছিল। তো এখন দুইমাত্র শ্বশুর বাড়ি আছে।
সাইহান বোকা হয়ে হাসতে থাকে। শায়রা বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকায়। এতক্ষণে সায়র আসে, কল শেষ করে। মেহজা সায়রকে দেখে কিছু বলে না। সায়র মেহজার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেহজা এবার সাইহান কে বলে,
— আমি একটু আসছি। আপনারা নাস্তা নেন।
বলেই মেহজা হেঁটে গেলো কিচেনের দিকে। মেহজা যেতে দেখে সায়র পিছু পিছু যেতে লাগলো।
তখন শায়রা বলে উঠে,
— কোথায় যাচ্ছিস?
সায়র মেহজার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সংক্ষেপে বলে,
— এখানেই!
বলেই সায়র মেহজার পিছু যেতে লাগে। মেহজা হাঁটতে হাঁটতে কিচেনের সামনের দিকে আসতেই পেছন থেকে সায়রের গান শুনে থেমে যায়।
— বড়লোকের বেটি গো লম্বা লম্বা চুল, এমন মাথায় বেধে দিবো লাল গেন্দা ফুল!
মেহজা থেমে ঘুরে তাকায়। মেহজাকে দাড়াতে দেখে সায়রও দাড়ায়। মেহজা ভ্রু কুচকে তাকায় সায়রের দিকে। সায়র হেসে উঠে।
মেহজা সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
— কি? এটা কি ধরনের অসভ্যতা?
সায়র মুচকি হেসে বলে,
— অসভ্যতামি কোথায়? গান গাচ্ছিলাম আপনাকে ডেডিকেট করে। আর আপনি তো বড়লোকের বেটিই!
— আপনি কি আমার সাথে ফ্লাট করছেন?
— করলেই বা ক্ষতি কি?
মেহজা কটাক্ষ করে বলে,
— বিরাট ক্ষতি কারণ আমার পার্সোনাল বেডা আছে! আর সেই বেডা আপনার থেকে হাজার গুণে সুন্দর!
সায়র জোরে হেসে ফেলে। মেহজা বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর হাসি থামিয়ে আবার সুর মিলিয়ে গেয়ে উঠে,
— আপনে লাভার কো ধোকা দো ডার্লিং মুজে বি এক মোকা দো!
ঠিক তখনি পেছন থেকে আরভিদ সুর মিলিয়ে গেয়ে উঠে,
— darling সুযোগ দিলে ডার্লিং এবং সুযোগ আত্মসাৎ করা ব্যক্তি দুজনকেই হাত পা ভেঙে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করাবো!
সায়র চট করে ঘুরে তাকায়। আরভিদ কাঁচা চিবিয়ে খাবে এমন চেহারা নিয়ে সায়রের দিকে তাকিয়ে আছে। সায়র কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেল।আরভিদকে দেখে মেহজা মুচকি হেসে সায়রের দিকে তাকায়।
সায়র নিজের অস্বস্তি ঢাকতে হেসে বলে,
— আরভিদ ভাইয়া তুমি? এখানে?
আরভিদ দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
— আমার মিসেসের সাথে কি পরিমাণ ফ্লাটিং করছো সেটাই দেখতে এসেছি!
সায়র অবাক হয়ে বলে,
— মিসেস? ও বিবাহিত?
আরভিদ উত্তর দেয়,
— হ্যা! তিন কবুল বলে বিয়ে করেছি! সাথে রেজিস্ট্রিও করেছি!
সায়র মেহজার দিকে তাকায়।
মেহজা মেকি হেসে বলে,
— আরে না আমি শিঙ্গেল!
আরভিদ সায়রের থেকে চোখ সরিয়ে মেহজার দিকে ভ্রু কুঞ্চে তাকায়।
মেহজা আরভিদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
— আমি উনার দূর সম্পর্কের বউ! কাছের না কিন্তু! সেই হিসেবে আমি শিঙ্গেল!
আরভিদ চোখ সরু করে কড়া নজরে তাকায়। মেহজা পাত্তা দিল না।
সায়র মাথা নত করে বলে,
— সরি দুজনকেই! আসলে আমি বুঝতে পারিনি।
বলেই দ্রুত কেটে পড়ে সে সেখান থেকে। সায়র চলে গেলে মেহজা হাত দিয়ে কিছু সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বলে,
— কারোর জেলাসিতে ঝলে পুড়ার ধোয়া উড়ছে!
আরভিদ টান দিয়ে মেহজাকে বুকের দিকে টেনে জড়িয়ে নেয়। গভীর কণ্ঠে আরভিদ বলে,
— আমার জালেমার দিকে কারোর চোখ পড়লে আমার বুক পুড়বে! এটাই স্বাভাবিক!
মেহজা মুচকি হেসে বলে,
— তা কখন থেকে আপনার বুক পুড়ছিলো শুনি?
— যখন ও তোকে গান গেয়ে শোনাচ্ছিল!
— ওহ আচ্ছা তখন এসেছিলেন আপনি!
আরভিদ বাঁকা হেসে বলে,
— নাহ! তুই যখন ওকে বলছিলি তোর পার্সোনাল বেডা আছে আর সে ওর থেকেও বেশি সুন্দর তখন এসেছিলাম!
মেহজা মুখ বাঁকিয়ে বলে,
— ওটা আপনাকে বলিনি!
আরভিদ চোখ সরু করে বলে,
— তাহলে কার জন্য ছিলো?
মেহজা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দূরে একটা ছেলেকে দেখতেই হাত উঠিয়ে হাই ইশারা করে। তারপর আরভিদকে বলে,
— ঐ ছেলেটাকে বলছিলাম!
আরভিদ আড়চোখে সেই ছেলেটার দিকে একবার তাকায়। তারপর আবার মেহজার দিকে তাকিয়ে বলে,
— অকারণে কেন ওকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছিস?
মেহজা আরভিদের বুকে হাত রেখে প্রশ্ন করে,
— আপনি এতো টক্সিক আর পজেসিভ কেন?
আরভিদ শাড়ির ভাজে হাত ঢুকিয়ে মেহজার কোমরে চিমটি কাটে। মেহজা ব্যথায় আহ করে উঠে।
আরভিদ শক্ত কন্ঠে চোখে হিংসা নিয়ে বলে,
— কারণ আমার বউ তুই!
দুজনেই একে অপরের চোখের দিকে চোখ রাখে। হঠাৎ মেহজার খেয়াল হয়, তারা খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে।
মেহজা হেসে আরভিদকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বলে,
— জালেম একটা! ব্যথা পেয়েছি না?
— আমার স্পর্শে এই ব্যাথা সামান্য রেডলিপ!
মেহজা মুখ বাঁকিয়ে বলে,
— এই ব্যাথার শোধ আমি তুলবো জালেম কারদার!
সাইহান বসে আছে চুপচাপ। হঠাৎই তার ফোনে একটা মেসেজ আসে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে, মেহজার নাম্বার। মেসেজটা খুলতেই দেখে লেখা,
— সাইহান ভাইয়া, একটু অর্তির রুমে আসেন দ্রুত! সমস্যা হয়ে গেছে!
মেসেজটা পড়ে সাইহান থমকে যায়। তার মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। সমস্যা মানে কী? অর্তিহাকে পাওয়া যাচ্ছে না নাকি? তাহলে কি আদ্রিক ওকে কিডন্যাপ করে ফেলেছে? চিন্তিত মুখে সে উঠে দাঁড়ায়। ওকে উঠতে দেখে আভীর কারদার জিজ্ঞেস করেন,
মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৭
— কি হয়েছে সাইহান? কোনো সমস্যা?
সাইহান হালকা হাসি দিয়ে বলে,
— না আঙ্কেল, একটু ওয়াশরুমে যাচ্ছি।
সাইহান সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে করিডোরে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু এখন তার নতুন সমস্যা, অর্তিহার রুমটা কোনটা? মুহূর্তে মনে পড়ে যায়, শায়রা বলেছিলো, আরভিদের রুমের পরের রুমটাই অর্তিহার। তাই দেরি না করে সে সেইদিকে হাঁটা শুরু করে। তখনি, পেছন থেকে কেউ তার মুখে রুমাল চেপে ধরে। সাইহান কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব অন্ধকার হয়ে আসে। সে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে মাটিতে।
