মোহশৃঙ্খল পর্ব ৭

মোহশৃঙ্খল পর্ব ৭
মাহা আয়মাত

চারদিকে সূর্য ডুবে গেছে, আকাশ ঢেকে গেছে অন্ধকারে। দিনের আলো মিলিয়ে যাওয়া সেই সময়টায় আরভিদ মাত্রই বাইরে থেকে বাসায় ফিরেছে। রুমে ঢুকেই সে খেয়াল করে, ঘরটা ফাঁকা—মেহজা নেই কোথাও। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আরভিদ কাভার্ড থেকে বাসার কাপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। প্রায় পাঁচ মিনিট পর সে বের হয়, পড়নে টি-শার্ট আর টাউজার।
তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চিরুনি দিয়ে চুলটা একটু ঠিক নেয়, তারপর এসে বেডে বসে পড়ে। সে অপেক্ষা করতে থাকে মেহজার জন্য। মিনিট পাঁচেক পার হয়ে গেলেও মেহজার দেখা নেই। ধীরে ধীরে বিরক্তি জমতে থাকে আরভিদের চোখেমুখে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে রুম থেকে বের হয়।
বাইরে একজন মেইডকে দেখে বলে,

— মেহজাকে বলো, যেন রুমে এসে দেখা করে।
বলেই আবার রুমে ফিরে আসে। আবারও অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও মেহজার কোনো খোঁজ নেই। বিরক্তি এবার রূপ নেয় রাগে। সে উঠে দাঁড়াতেই যাচ্ছে, ঠিক তখনই রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে মেহজা।
হাতে চিপসের প্যাকেট, চিপস খেতে খেতেই রুমে ঢোকে সে। সামনে এসে দাঁড়িয়ে বাকা করে তাকিয়ে বলে,
— কী হয়েছে? এসেই এত খোঁজখবর নিচ্ছেন কেন? বাইরে আবার কোনো ঝামেলা বাধিয়ে আসেননি তো? যে আমার আচলের নিচে এসে লুকাতে চাইছেন?
আরভিদ হঠাৎ করে হাত বাড়িয়ে মেহজাকে টান দিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে নেয়। আচমকা টান পড়ায় মেহজার হাত থেকে চিপসের প্যাকেটটা ছিটকে পড়ে যায়। সে চোখ বড় বড় করে ভীত হয়ে আরভিদের টিশার্ট আঁকড়ে ধরে। মুহূর্তেই কী হয়েছে বুঝে ফেলে, এবং রেগে যায়। কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই আরভিদ তার গলায় মুখ ডুবিয়ে নাক ঘষতে শুরু করে।
মেহজা থামে না, বিরক্ত হয়ে আরভিদকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— এই সরেন তো, পটলা বেডা! দিলেন তো ভালো মুডটা পুরাই খারাপ কইরা! আমার প্রিয় চিপসটার আত্মার মাগফেরাত কইরা ফেলছেন!
কিন্তু আরভিদ সরে না, বরং আরও কাছে টেনে নেয় মেহজাকে।
— তোর কি আমার সাথে একটু মিষ্টি করে কথা বলা যায় না?
মেহজা এবার দু’হাত দিয়ে আরভিদের গাল দুটো টেনে বিকৃত করে জবাব দেয়,
— শত্রু পক্ষের সাথে আবার কিসের মিষ্টি কথা! আমার তো এক কথা, শত্রুর সাথে কোনো কথাই না, শুধু মারামারি!
আরভিদ নিজের গাল ছাড়িয়ে নিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— তোর আর আমার মধ্যে আবার কিসের শত্রুতা?
মেহজা ভ্রু কুঁচকে বলে,
— নিজে বাশ মাইরা এখন আবার ভুইলা গেছেন? অবশ্য, এইটাই স্বাভাবিক!
আরভিদ বিরক্ত স্বরে বলে,

— মেহু, তুই কবে একটু ভালো হবি?
মেহজা গম্ভীর ভাব নিয়ে উত্তর দেয়,
— এমনিতেই তো অনেক ভালো আছি, এর চেয়ে ভালো হলে দুনিয়ায় আর টিকতে পারবো না!
আরভিদ হেসে ফেলে। সে মেহজার ডান গালে হালকা করে চুমু খেয়ে বলে,
— আচ্ছা, আর ভালো হতে হবে না। এখন চল, দুজন দুজনকে একটু আদর করি?
মেহজা সন্দেহভরা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— কুড়কুড়ানি উঠে গেছে নাকি?
আরভিদ আঙুল দিয়ে মেহজার ঘাড়ের দিকটা স্লাইড করতে করতে বলে,
— হুম, অনেক বেশি!

মেহজা চট করে নড়ে বসে, আরভিদের হাত সরিয়ে দিয়ে রাগি চোখে বলে,
— একদম ফালতু গিরি করবেন না! নয়তো আপনাকে মরন চুলকানির মলম লাগায় দিমু!
বলেই উঠে দাঁড়াতে যায় মেহজা। কিন্তু হঠাৎই আরভিদ তাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় ফেলে দেয়, আর নিজেই মেহজার ওপর উঠে পড়ে। নেশাগ্রস্ত চোখে মেহজার দিকে তাকিয়ে নেশালো কণ্ঠে বলে,
— মলম লাগবে, তবে তোর রোমান্স ব্র্যান্ডের মলম!
মেহজা আরভিদের কাণ্ডে চোখ বড় করে ফেলে, বিছানায় মাথা ফেলে দেয়,
— চেপ্টা হয়ে গেছি রে! জলহস্তী বেডার নিচে পড়ে!
আরভিদ হালকা ভর দিয়ে নিজের ওজনটা কিছুটা সরিয়ে নেয়,

— এখন হয়েছে?
মেহজা চোখ-মুখ কুঁচকে গলা তুলে বলে,
— কী হইছে? উঠেন আমার উপর থেকে!
— উঠবো না!
— আমার মতো একটা অবলা মেয়েকে রুমে একা পেয়ে তবলা বাজাতে লজ্জা করে না আপনার?
আরভিদ সন্দেহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— অবলা কে?
মেহজা একটু নরম হয়ে আসে, ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে,
— আমিই তো!
আরভিদ মেহজাকে ভালো করে দেখে নিয়ে মাথা নেড়ে বলে,
— তুই অবলা হলে, জল্লাদ কাকে বলে?
মেহজা অবাক হয়ে বলে,
— আপনি আমাকে ইনডিরেক্টলি জল্লাদ বললেন?
আরভিদ হেসে বলে,
— ইনডিরেক্টলি না, ডিরেক্টলি বলছি। জল্লাদ বউ!
মেহজা বিরক্ত হয়ে দুই হাত দিয়ে আরভিদকে ঠেলে বলে,

— উঠেন আমার উপর থেকে! না হলে আজকেই আপনার সানডে-মানডে ক্লোজ করে দেবো!
আরভিদ তার ঠোঁটে আলতো করে আঙুল বুলিয়ে দিয়ে ধীরে বলে,
— উঠবো না বরং এখন আমি তোকে…
মেহজা ভ্রু কুঁচকে, চোখ ছোট করে বলে,
— এখন আপনি আমাকে কী?
আরভিদ কন্ঠস্বর ধীর করে ফিসফিসিয়ে বলে,
— আনবক্সিং করবো!
মেহজা চোখ কুঁচকে কড়া স্বরে বলে,
— যেই হাত দিয়ে আনবক্সিং করতে যাবেন, সেই হাত দুটো এমন জায়গায় ঢুকিয়ে দেবো, ডট ডট ডট! এখন বাকি টা বুঝে নেন!
আরভিদ মুখ থমথমে করে বলে,

— তুই যে জোরের মানুষ, তোকে আদর করে বুঝালেও হয় না!
বলেই আরভিদ মেহজার গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়। মেহজা কিছুটা অস্বস্তিতে নড়াচড়া করতে থাকে।গলায় কিস করতে করতে নিচের দিকে নামতে চায় আরভিদ। তখনই মেহজা তার মাথাটা ধরে উপরের দিকে তোলে। চোখে চোখ পড়ে দু’জনের। আরভিদের মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠে।
মেহজা ঠোঁট কামড়ে মৃদু স্বরে বলে,
— আমার পিরিয়ড হয়েছে।
আরভিদ ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলে,
— শাবাশ! আমার এত রক্ত চুষেছিস, এখন তো কোথাও না কোথাও থেকে বের হবেই, তাই না?
মেহজা তার বুকের ওপর কিল মেরে বলে,
— এই পটলা বেডা! আমি কখন আপনার রক্ত চুষেছি? বরং আপনিই তো শুরু থেকে আমাকে খেয়ে ফেলার ফন্দি আঁটছেন!
আরভিদ হেসে ফেলে,

— আজ সেই ফন্দিই সাকসেস হবে, রেডলিপ!
মেহজা বিরক্ত গলায় বলে,
— সাকসেস কিভাবে হবে? বললাম না, পিরিয়ড হয়েছে!
আরভিদ চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলে,
— তোকে আমি বিশ্বাস করি না।
মেহজা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
— ঠিক আছে, আপনি যা ইচ্ছা করেন। পরে যদি আমাদের বেবি প্রতিবন্ধী হয়, তখন কিন্তু দোষ আপনারই!
আরভিদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

— বেবি প্রতিবন্ধী হবে মানে?
— শুনেছি, পিরিয়ডের সময় যদি ঐসব করা হয়, তাহলে ৮৫% বাচ্চা প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরভিদ মেহজার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখে এক ধরনের বিস্ময়, মুখে থমথমে ভাব।
— তোর এইটুকু বয়সে এসব ব্যাপারে এতোকিছু জানিস?
মেহজা ভেংচি মেরে বলে,
— এইটুকু বয়সে আপনি তো আমার সঙ্গে কম কিছু করছেন না!
আরভিদ চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলে,
— কিন্তু তুই তো আগেই পুরো পেকে গেছিস!
মেহজা বিরক্ত গলায় বলে,
— উফফ, আপনি কিন্তু মেইন টপিক থেকে সরে যাচ্ছেন!
— আমি এতো তাড়াতাড়ি বেবি নিচ্ছি না।
কথাটা বলেই আরভিদ আবার গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়। মেহজা দ্রুত বলে ওঠে,

— যদি একটু এদিক-সেদিক হয়ে যায়, আর আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে যাই, তখন?
আরভিদ মুখটা তোলে, মেহজার দিকে তাকায়। চোখ-মুখ কুচকে ওঠে। বিরক্তির সঙ্গে হালকা রাগ মিশিয়ে বলে,
— তোর কি আমার রোমান্টিক মুডের চল্লিশা না করালে হয় না?
মেহজা ঠোঁট বেঁকিয়ে উত্তর দেয়,
— আমার শরীরে শুধু একটুখানি ওড়নাই না থাকলেই তো আপনার কুড়কুড়ানি শুরু হয়ে যায়!
আরভিদ ভ্রু কুঁচকে বলে,
— অতটাও হট না তুই।
মেহজা মেকি হাসি দিয়ে বলে,
— হুম, কিন্তু আপনার তো কুকুরকেও দেখলে কুড়কুড়ানি ওঠে, সেখানে আমি তো একটা জ্যান্ত মেয়ে মানুষ।
আরভিদ বিরক্ত স্বরে বলে,
— এখন তুই আসলে কী চাস?
মেহজা চোখ সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে হালকা স্বরে বলে,
— আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না।

আরভিদ কথাটা শুনেই ধপ করে উঠে বসে, মেহজার উপর থেকে। মেহজাও ধীরে ধীরে উঠে বসে আরভিদের দিকে তাকায়। আরভিদের চোখে-মুখে স্পষ্ট রাগ আর বিরক্তির ছাপ। মেহজা তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে যায়। বেশিক্ষণ আরভিদের সামনে থাকলে সে বুঝে যাবে, মেহজা মিথ্যে বলেছে—তার পিরিয়ড হয়নি। একবার বুঝতে পারলে আরভিদ তার বারোটা বাজিয়ে ফেলবে, এতে মেহজার কোনো সন্দেহ নেই।
আরভিদ মেহজার বেরিয়ে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর নিজের বিরক্তি নিয়ে উঠে, রুম থেকে বেরিয়ে ছাদের দিকে চলে যায়। ছাদে গিয়ে দেখে, এক কোণে আদ্রিক দাঁড়িয়ে আছে—সিগারেট টানছে। আদ্রিকের ছাদে থাকা একদম স্বাভাবিক। কারণ রাতের এই সময়টায় তারা প্রায়ই একসাথে ছাদে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়, সিগারেট টানে। আরভিদ ধীর পায়ে গিয়ে তার পাশে দাঁড়ায়।

— একটা সিগারেট দে তো?
আদ্রিক বাম হাতে সিগারেট ধরে রেখেছে, ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করে আরভিদের দিকে বাড়িয়ে দেয়। আরভিদ ঠোঁটে সিগারেট চেপে ধরে, তারপর লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে সেটা ফেরত দেয়।
আদ্রিক লাইটার আর প্যাকেট পকেটে রাখতে রাখতে আরভিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
— রেগে আছিস নাকি?
আরভিদ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তেই উত্তর দেয়,
— কই, আমি রেগে আছি?
আদ্রিক হেসে ফেলে।
— মেহজা রুম থেকে বের করে দিয়েছে?
আরভিদ চোখ কুঁচকে, বিরক্ত মুখে তাকায়,
— মেহু আমাকে রুম থেকে বের করবে? এটা আদৌ সম্ভব?
আদ্রিক সোজা হয়ে দাঁড়ায়, মজা করে বলে,
— তোর বউয়ের দ্বারা অসম্ভব কিছু না, ভাই।
— অসম্ভবই!
— ড্রপ ইট।

তারা দু’জনেই চুপচাপ সিগারেট টানতে থাকে। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে তারা নিচে নেমে আসে। রাতের খাবার শেষ হলে আরভিদ আবার মেহজার রুমে আসে। মেহজা একদম চুপচাপ, চেঞ্জ করে এসে শুয়ে পড়ে। আরভিদও শুয়ে শুয়ে ফোন টিপতে থাকে। একসময় ফোন হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।
রাত পেরিয়ে ভোরের আলো জানিয়ে দেয় নতুন দিনের সূচনা হয়েছে। মেহজা ধীরে ধীরে চোখ মেলে, তারপর উঠে হাই দিয়ে জানালার দিকে তাকায়। বুঝতে পারে সকাল হয়ে গেছে। রুমের চারপাশে তাকিয়ে দেখে আরভিদ নেই। ভাবে, হয়তো পার্লামেন্টে চলে গেছে।
সে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়, তারপর বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। একটু বাইরে হাওয়া লাগানো দরকার। নিচে বাগানের দিকে চোখ যেতেই দেখে—আরভিদ খালি গায়ে, শুধু ট্রাউজার পরে ডাম্বেল তুলছে। ঘামে ভিজে শরীর চকচক করছে। তার গা বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে, পেশিগুলো উঁচু হয়ে আছে—একেবারে জিম করা, গড়ে তোলা শরীর। দেখতে মারাত্মক লাগছে।
মেহজা মুখ বাঁকায়।

— দেখো কেমন জিম করে শরীর বানাচ্ছে! সামনে নির্বাচন, না! এই বডি দেখিয়েই তো মেয়েদের ভোট কাড়বে। লুচ্চা পটলা কোথাকার!
আরভিদকে গালাগালি করতে করতেই হঠাৎ চোখ পড়ে বাগানের বাঁদিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে কৌশলী। তার চোখ সম্পূর্ণভাবে নিবদ্ধ আরভিদের প্রশস্ত, ঘামে ভেজা শরীরের দিকে। এটা দেখে মেহজার মাথায় আগুন ধরে যায়। সে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়, সোজা বাগানের দিকে পা বাড়ায়। গিয়েই কৌশলীর পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কৌশলী বুঝতেই পারে না। সে মন-চোখ আরভিদের প্রশস্ত দেহেই আটকে আছে।
কৌশলী নিজেই নিজে বলে,

— উফফ… কি হট লাগছে আমার ভিলেনটাকে!
— হুম… একদম দিপজল চাচার মতো না?
কৌশালী চমকে পেছনে ঘুরে তাকায়। চোখ কুঁচকে বলে,
— দিপজল চাচার মতো মানে?
— তুমি নিজেই তো বললে ভিলেনের মতো লাগছে! আর বাংলাদেশে ভিলেন বললেই তো মাথায় আসে দিপজল চাচা!
কৌশলী জ্বলে উঠে,
— ছিহ্! আমার আরভু বেবির সাথে দিপজল না ফিপজলের তুলনা দিচ্ছো তুমি?
তারপর আরভিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
— ওর হটনেস দেখেছো? একদম হলিউডি ভিলেন!
মেহজা রেগে বলে,

— সারাদিন তোর আরভু বেবি, আরভু বেবি ডাক শুনলে তো মনে হয়, তুই-ই উনার লীগালি মা!
কৌশালী যেন আকাশ থেকে পড়ে এই কথা শুনে। সে চোখ বড় করে অবাক কন্ঠে বলে,
— কিহ্! কি বললে তুমি?
মেহজা ভ্রু কুঁচকে হালকা ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলে,
— আচ্ছা? এমন তো না যে মামানি আট মাসের সময় তোর আরভু বেবিকে নিজের পেটে বের করে তোর পেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো, তারপর বাকি এক মাস তুই পেটে রেখে সিজার করে জন্ম দিয়েছিস?
কৌশলী চেঁচিয়ে বলে,
— এই এই! চুপ করো! একটা থাপ্পড়…
— কৌশলী!

আচমকা রাগে গর্জে ওঠে আরভিদের কণ্ঠ। আরভিদের কণ্ঠ শোনার সঙ্গে সঙ্গে কৌশলী ঘুরে তাকাল, আর মেহজাও সামনের দিকে তাকায়। আরভিদ দাঁড়িয়ে আছে, রাগে তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সে ডাম্বেল তুলছিলো, তখনই দূর থেকে দেখলো মেহজা আর কৌশলী কথা বলছে। অবশ্য তাদের দেখে লাগছিলো না তারা কথা বলছে, বরং ঝগড়া করছে বলে মনে হচ্ছিলো। আরভিদ ডাম্বেল রেখে সোজা ওদের দিকে এগিয়ে এলো এবং কৌশালীর ‘থাপ্পড়‘ বলাটা তার কানে যেতেই রাগে তার মাথায় আগুন ধরে যায়।
কৌশলী কাঁপা গলায় বলে,

— কি… কী… হয়েছে?
আরভিদ রেগে গর্জে উঠে,
— তোমার সাহস হয় কি করে আমার বউকে থাপ্পড় মারবে বলার? আর যদি এমন কিছু শুনি, কি করবো এখন নাই বললাম তখন করে দেখাবো!
কৌশলী ভয়ে ঢোক গিলে বলে,
— এই মেয়েটাই তো আমা…
আরভিদ চোখ রাঙিয়ে থামিয়ে দেয়,
— ভাবি বলবে! সম্পর্কের জায়গাটা বুঝে কথা বলো!
কৌশলী কান্নার ভান ধরে ন্যাকা ন্যাকা গলায় ফুঁপিয়ে ওঠে। কিন্তু আরভিদ পাত্তা দেয় না। মেহজা মনে মনে হাসে। সুযোগ বুঝে কৌশলীকে ভেংচি মেরে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়, কিন্তু হঠাৎই পা মুচকে যায়।
— আহ!
করে বসে পড়ে। আরভিদ সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে, মেহজাকে জড়িয়ে ধরে।
আরভিদ বিচলিত কণ্ঠে বলে,

— কি হয়েছে মেহু?
মেহজা ব্যথায় দাঁত চেপে বলে,
— হাতির ঘরে মশা হয়েছে, পটলা!
আরভিদ রাগ চেপে বলে,
— কোথায় ব্যথা পেয়েছিস?
— মাথায়।
আরভিদ গম্ভীর মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেহজা ঢোক গিলে বলে,
— একে তো ব্যথা পেয়েছি, তার উপর আবার আপনার আজাইরা প্রশ্ন!
কৌশলী পাশে দাঁড়িয়ে আগুনে ঘি ঢালার জন্য বলে,
— দেখো! তুমি সাহায্য করছো আর ও তোমার উপরই রাগ দেখাচ্ছে! কৃতজ্ঞতা জিনিসটার নামও জানে না!
আরভিদ চোখ পাকিয়ে বলে,
— আমাদের ব্যাপারে নাক গলাতে এসো না! আমার বউ আমার সাথে কিভাবে কথা বলবে, সেটা তোমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে না!
বলেই আরভিদ মেহজাকে পাজে কোল তুলে নেয়।
মেহজা চমকে বলে,

— আরেহ বেডা! কী করছেন? কোলে তুলে নিচ্ছেন কেন?
— পায়ে ব্যথা নিয়ে হাঁটতে পারবি না।
মেহজা কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়—কৌশলীর জ্বলে যাওয়া মুখটা দেখে মনটা জুড়িয়ে যায়।
সে দুষ্টুমি করে আরভিদের গলা জড়িয়ে বলে,
— উফফ, সবাই দেখবে! তখন তো আমি লজ্জায় মরে যাবো!
আরভিদ একটু থেমে তাকায়। লজ্জা? আর মেহজা? এই জীবনে এমন কিছু সে দেখেনি। তখনি সে কৌশালী হিংসাত্মক চেহারা দেখে বুঝে যায়—সব নাটক কৌশলীকে জ্বালানোর জন্য!
সে ঠান্ডা গলায় বলে,

— লজ্জা পেলে আমি ভাঙিয়ে দেবো!
মেহজা মনে মনে বলে,
— লুচ্চা পটলা!
তবে বাইরে হেসে আরভিদের বুকে মুখ লুকিয়ে বলে,
— ইশশ, আপনি শুধু আমাকেই লজ্জা দেন!
আরভিদ হেসে মেহজাকে নিয়ে ভেতরের দিকে হাঁটা দেয়। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কৌশলী হিংসা আর রাগে দাঁতে দাঁত চেপে ফুঁসতে থাকে। বাড়ির ভেতরে ঢুকেই মেহজা আরভিদের কোল থেকে ছটফট করে নেমে পড়ে।
আরভিদ অবাক হয়ে বলে,
— কি হলো? নেমে গেলি কেন?
মেহজা গিয়ে সোফায় বসতে বসতে উত্তর দেয়,
— আপনার কোলের ওঠে চলাফেরা করার থেকে আমি আতুর লুলা হয়ে এক জায়গায় পড়ে থাকবো, তাও ভালো আমার জন্য!
আরভিদ হেসে মেহজার পাশে বসে বলে,

— দরকার পড়লে তোর হাত-পা ভেঙে দিয়ে আতুর লুলাই বানিয়ে ফেলবো, যাতে সারাজীবন আমার কোলেই থাকিস!
মেহজা নাক ছিটকে বলে,
— এভাবে হাফ ন্যাংটো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন?
আরভিদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
— ভাগ্য ভালো, এখনো ফুল ন্যাংটো হইনি!
মেহজা চোখ-মুখ কুচকে বলে,
— ছিহ্!
আরভিদ মুচকি হেসে বলে,
— মুখের ভাষা কিহ্!
— নিলজ্জ বেডা মানুষ!
আরভিদ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
— আর তোর তো অনেক লাজ-শরম আছে, না?
তখনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে অর্তিহা। আরভিদ সোফা থেকে নিজের টি-শার্টটা গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে অর্তিহাকে দেখে ডাকে। অর্তিহা কাছে এলে আরভিদ পাশে বসায়।

— তোকে জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি! কোচিংয়ে ভালো পড়াচ্ছে তো?
অর্তিহা ধীর কণ্ঠে উত্তর দেয়,
— হ্যাঁ।
— আজ কোচিং আছে?
— আছে।
— ঠিক আছে, ভাইয়া ড্রপ করে দেবে। এখন চল, ব্রেকফাস্ট করি!
তারা তিনজন ডাইনিং রুমের দিকে যায়। সেখানে পরিবারের সবাই ইতোমধ্যে উপস্থিত, শুধু এই তিনজন বাদে। আরভিদ গিয়ে চেয়ার টেনে বসে। মেহজাও আরভিদের পাশের চেয়ারে বসতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ করে কৌশালী কোথা থেকে এসে সেই চেয়ারে বসে পড়ে। কৌশালীর এমন ঝড়ের গতিতে আসা সবাইকে, এমনকি আরভিদকেও, কিছুটা অপ্রস্তুত করে দেয়।
মেহজা কৌশালীর দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় যেন চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। এরপর আরভিদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, আরভিদ মেহজার চাহনি দেখে মনে মনে কিছুটা ভয় পেলেও সেটা গোপন রাখে। সাথে ভিতরে ভিতরে কৌশালীর উপর প্রচণ্ড বিরক্তিও জমে ওঠে।
নাজনীন কারদার বিস্ময়ভরে রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলেন,

— এটা আবার কেমন ব্যবহার কৌশালী? কেউ এমন করে এসে অন্য কারো জায়গা দখল করে বসে?
কৌশালী মেকি হাসি দিয়ে বলে,
— আসলে আন্টি, চেয়ারটা ফাঁকা দেখে বসে পড়েছি, খেয়াল করিনি মেহজা বসতে যাচ্ছিল। সরি মেহজা, তুমি অন্যটায় বসে যাও?
মেহজা হেসে নাজনীনকে বলে,
— আরে সমস্যা নেই, ছোট মামানি! চেয়ারই কেড়ে নিতে পেরেছে, জামাই তো আর নিতে পারবে না!
এই বলে সে গিয়ে বসে পড়ে অর্তিহার পাশের চেয়ারে, ঠিক আরভিদের সামনাসামনি।
তাহিয়া কারদার হেসে বলেন,
— তা আজ এতো সকাল সকাল উঠলে যে, আম্মু?
কৌশালী মুখ খুলে কিছু বলবে, তার আগেই মেহজা বলে,
— বাগানের সিনারি দেখার লোভে উঠেছে সকাল সকাল!
নাজনীন কারদার ভ্রু কুঁচকে বলেন,
— বাগানে আবার কী এমন সিনারি?
মেহজা হেসে বলে,
— এই ধরনের সিনারি পারিবারিক মহলে বলার বিষয় না, ছোট মামানি।
নাজনীন চুপ হয়ে যান। বাড়ির গুরুজনদের মধ্যে একটা অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে। সকলে খেতে খাওয়া শুরু করে। মেহজা খেতে খেতে কৌশালী আর আরভিদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কৌশালী এটা-সেটা চাইছে আর আরভিদ নিঃশব্দে সেগুলো সার্ভ করে দিচ্ছে—যা মেহজার একদম সহ্য হচ্ছে না।
সে স্পুনে খাবার মুখে তুলতে তুলতে হঠাৎ গুনগুন করে গেয়ে ওঠে,

Balam mere cheater ho gaye.
Baaz se tetar hogaye
Desi sanda ki nazron ke attention seeker hogaye. aye
Balam mere cheater ho gaye.

সবাই কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ। তারা মেহজার দিকে তাকায়, তারপর তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকায় আরভিদের দিকে। মুহূর্তেই পরিস্থিতি পরিষ্কার হয়ে যায় সবার কাছে। কৌশালী রাগে ফুঁসে ওঠে কারণ সে ভালোই বুঝতে পেরেছে যে দেশি সান্ডা কথাটা তাকেই বলেছে। আরভিদের মেহজার চাহনি আর গানে কাশি উঠে যায়। সবাই উঠে পড়ে কাশি থামাতে সাহায্য করতে, কিন্তু মেহজা স্থির। কৌশালী গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দেয়, কিন্তু আরভিদ তা নেয় না।
বরং অর্তিহা যখন গ্লাস বাড়ায়, তখন সেটা নিয়ে খেয়ে ফেলে। কৌশালীর মুখটা থমকে যায়, অপমানিত বোধ করে সে গ্লাসটি নামিয়ে নেয়।
আদ্রিক মুচকি হেসে বলে,
— ওয়াও মেহজা! তুমি তো একদম প্লে-ব্যাক সিঙ্গার! এক গানেই বরকে আজরাইলের দরজায় পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলে!
মেহজা হেসে বলে,

— পরের বার দরজায় না, সরাসরি ভিতরে পাঠিয়ে দেবো!
আরভিদের আবার কাশি উঠে যায়, কিন্তু দ্রুত তা থেমে যায়। সবাই ধীরে ধীরে ব্রেকফাস্ট শেষ করে। মেহজা চুপচাপ উঠে রুমে চলে আসে এবং বিছানায় বসেই রাগে ফুঁসতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আরভিদ রুমে ঢুকে তার পাশে এসে দাঁড়ায়।
— রেগে আছিস?
মেহজা দাঁত চেপে বলে,
— নাহ্, মুখ দিয়ে আগুন বের করার শখ হয়েছে!
আরভিদ মজা করে বলে,
— তাহলে কোনো সার্কাসে জয়েন কর। শখও পূরণ হবে, আবার অনেক টাকাও পাবি!
মেহজা এবার দাঁড়িয়ে পড়ে, চোখে আগুন জ্বালিয়ে বলে,
— মেজাজ খারাপ করবেন না!
আরভিদ নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,
— এমন কেন করছিস? তুই কি কৌশালীকে নিয়ে জেলাস হচ্ছিস?
মেহজা ভ্রু উঁচিয়ে বলে,

— এই মেহজা কোনো দেশি সান্ডা আর পটলার থার্ড ক্লাস রোমান্স দেখে জেলাস হবে? হুঁহ্!
আরভিদ শান্তভাবে বলে,
— তাহলে নরমাল বিহেভ কর!
মেহজা রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— নরমাল বিহেভ কর! হুহ্! লুচ্চা দুই নাম্বার বেডা কোথাকার! জোর করে বিয়ে করেছে আমাকে, আর টাংকি মারছে উনার খালাতো বোনের সাথে!
আরভিদ বিরক্ত হয়ে বলে,
— টাংকি তো তোর সাথেই মারার চেষ্টা করছি, কিন্তু তুইই তো পাত্তা দিচ্ছিস না! আর কৌশালীর সাথে আমার কিছুই নেই। শুধু শুধু সন্দেহ করছিস!

— জানি আমি সবকিছু! আমি কি গাধা নাকি?
বলেই রাগে ফুঁসতে থাকে। মুখ তার থমথমে। আরভিদ এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে তাকায়। সময় হয়ে যাচ্ছে তার, দেরি আর করা যাবে না। এখন মেহজাকে বোঝালেও কিছু বোঝার নয়— সে যে এক জেদি মেয়ে! তাই আর তর্ক না বাড়িয়ে কাভার্ড থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে কাপড় পাল্টাতে। কিছুক্ষণ পরই বেরিয়ে আসে। সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামার সাথে কাঁধে কালো শাল।

সে আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল আচড়াতে থাকে এবং চোখে পড়ে আয়নার প্রতিবিম্বে মেহজার রাগে ফুঁসতে থাকা মুখটা। রাগে ফুলে থাকা সেই মুখেও একধরনের স্নিগ্ধতা লুকিয়ে আছে, যা বরাবরই আরভিদের প্রিয়।মেহজা একবার সেদিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আরভিদের চোখে-মুখে এক চিলতে মুচকি হাসি।
চিরুনিটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে সে মেহজার কাছে গিয়ে শান্ত গলায় বলে,

— যাচ্ছি আমি।
মেহজা চোখ কুচকে রাগী কণ্ঠে উত্তর দেয়,
— আটকেছে কে আপনাকে?
আরভিদ একরাশ হতাশা নিয়ে বলে,
— সেটাই তো আমার সবচেয়ে কষ্টের বিষয়… আমার বউ আমাকে বায়না করে একটুও আটকায় না।
মেহজার খোঁচা মেরে বলে,
— আমি কেন আটকাবো? আটকাবে তো আপনার প্রাণপ্রিয় কৌশালী! যান না গিয়ে, ওর কাছে বায়না করুন!
আরভিদ হালকা হাসে, তারপর নরম কণ্ঠে বলে,
— বায়না আমি তোর কাছেই করবো… কিন্তু আজ না। আজকে একটা জরুরি কাজ আছে।
বলেই আরভিদ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আরভিদ নিচে লিভিং রুমে এসে দেখে, আদ্রিক সোফায় হেলান দিয়ে বসে মোবাইলে দেখছে। পড়নে কালো শার্ট আর সাদা প্যান্ট।
আরভিদ সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

— কোথাও যাচ্ছিস?
আদ্রিক ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ধীরে তাকায় ওর দিকে।
— হ্যাঁ, একটা দরকারি কাজে যাচ্ছি।
আরভিদ কপাল কুঁচকে বলে,
— তাহলে বসে আছিস কেন?
— অর্তির জন্য অপেক্ষা করছি। ওকে কোচিংয়ে ড্রপ করে তারপর যাবো।
— আমি অর্তিকে ড্রপ করে দিবো। তুই চলে যা।
— আচ্ছা।
বলেই আদ্রিক বেরিয়ে যায়। আরভিদ অপেক্ষা করতে থাকে অর্তিহার জন্য, তবে বেশিক্ষণ না—অর্তিহা নিচে নেমে আসে। আজ তার পড়নে নীল চুড়িদার, গায়ের ফর্সা রঙের সাথে যেন রঙটা মিশে এক অদ্ভুত মোহময়তা তৈরি করেছে।
আরভিদ একটু চুপ থেকে বলে,

— চল।
এরপর আরভিদ ও অর্তিহা বাসা থেকে বের হয়। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছিলো। দু’জন গাড়িতে বসলে, গাড়ি চলা শুরু করে। তবে কিছুদূর যেতেই গাড়ি হঠাৎ থেমে যায়।
আরভিদ জিজ্ঞেস করে,
— কী হলো?
ড্রাইভার কিছুটা হতবাক গলায় বলে,
— জানি না স্যার। একটু দেখে নিচ্ছি।
সে নেমে যায়। অর্তিহা ও আরভিদ গাড়ির ভেতরে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার ফিরে এসে বলে,
— স্যার, গাড়ির টায়ার পাঞ্চার হয়ে গেছে।
আরভিদের মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে।

— কী বলছো? আগে দেখে রাখা যায় না?
— স্যার, বের করার আগে সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। হঠাৎ এমন হলো…
আরভিদ রাগ ও বিরক্ত মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
— কথা বাড়িও না। তাড়াতাড়ি টায়ার চেঞ্জ করো।
— সময় লাগবে স্যার, অন্তত ১০ মিনিট।
আরভিদ বিরক্ত মুখে জানালার বাইরে তাকায়। ঠিক তখনই রাস্তা ধরে এগিয়ে আসে আদ্রিকের গাড়ি। জানালার কাচ নামিয়ে সে বলে,

— কী হলো?
— গাড়ির টায়ার পাঞ্চার। তুই এখনো যাসনি?
— গাড়ির চাবি বাসায় রেখে এসেছিলাম, সেটা আনতে গিয়ে দেরি হলো।
আরভিদ এবার অর্তিহার দিকে তাকিয়ে বলে,
— তুই বরং আজ আদ্রিকের সাথেই যা। ভাইয়ার সাথে আরেকদিন যাবি। এখন আমার সাথে গেলে লেইট হয়ে যাবি।
এরপর আদ্রিককে বলে,
— ওকে কোচিংয়ে ড্রপ করে দিস।
আদ্রিক ফ্রন্ট সিটের দরজা খুলে দেয়। অর্তিহা একবার তার দিকে তাকায়, একদম স্বাভাবিক, শান্ত। তারপর চুপচাপ গাড়ি থেকে নামে, গিয়ে বসে আদ্রিকের গাড়িতে। গাড়ি চলতে শুরু করে।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অর্তিহা ধীরে বলে,

— ভাইয়ার গাড়ির টায়ার আপনি-ই পাঞ্চার করেছেন, তাই না?
আদ্রিক হেসে তাকায়। ঠোঁটের কোণে একরকম দুর্বোধ্য মুচকি হাসি।
— হুম। বউ হওয়ার আগেই তোকে অন্য কারও দায়িত্বে দিইনি, এখন তুই আমার বউ—তোর দায়িত্ব আমার। সেটার ভাগ আমি কাউকে দেবো না।
অর্তিহা কিছু না বলে চুপ করে থাকে। গাড়ি এসে থামে কোচিং সেন্টারের সামনের রাস্তায়। আদ্রিক নেমে গিয়ে অর্তিহার দরজাটা খুলে দেয়।
অর্তিহা ধীরে নামে। নরম গলায় বলে,
— যাচ্ছি।
— ওকে। আমি এখানেই থাকছি, তোর জন্য অপেক্ষা করবো।

অর্তিহা আর কিছু না বলে গলির দিকে হাঁটতে থাকে।
আদ্রিক তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ না অর্তিহা ভেতরে ঢুকে যায়। সেদিক থেকে চোখ সরাতেই চোখে পড়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি কালো গাড়ির দিকে। সামনে বড় করে লেখা— Toyota Land Cruiser Prado। আদ্রিকের চোখে প্রশ্ন ভেসে ওঠে, ভ্রু খানিকটা কুঁচকে যায়।
এদিকে অর্তিহা কোচিং সেন্টারে ঢুকেই অবাক হয়। পুরো ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা, আর সব ছাত্র-ছাত্রীরা দাঁড়িয়ে আছে নিজ নিজ জায়গায়। আর তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক সুদর্শন পুরুষ — যার উপস্থিতিতেই যেন জায়গাটি আলাদা এক আবহ তৈরি করেছে।

শ্যামলা গাত্রবর্ণ, সুঠাম ও প্রশস্ত দেহের গঠন, উচ্চতা আনুমানিক ৬ ফুট। তাঁর হেয়ারস্টাইল ছিল টেক্সচার্ড কুইফ, যা তাঁকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। পরনে ছিল কালো টি-শার্ট, তার ওপর কালো জ্যাকেট, আর সাথে মানানসই কালো প্যান্ট — একেবারে নিখুঁতভাবে পরিপাটি। তাঁর চেহারায় ছিল একধরনের দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস, যা মুহূর্তেই মন কাড়ে।
অর্তিহাকে দেখে ওর ফ্রেন্ডরা—হানিন আর মিষ্টি—ডেকে ওঠে। সবার চোখ তখন অর্তিহার দিকে, এমনকি ওই সুদর্শন অপরিচিত পুরুষেরও। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে অর্তিহার দিকে।
অর্তিহা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
পুরুষটি সামনে এসে দাঁড়ায়। গলায় ধীর অথচ দৃঢ় সুরে প্রশ্ন করে,

— আপনার নাম?
অর্তিহা চোখ সরিয়ে নরম গলায় বলে,
— আপনাকে বলার প্রয়োজনটা?
পুরুষটি গম্ভীর গলায় বলে,
— কারণ আইনের লোক আপনাকে জিজ্ঞেস করছে।
অর্তিহা চমকে যায়।
— আপনি… আইনের লোক?
ঠিক তখনই হানিন আর মিষ্টি এগিয়ে এসে অর্তিহার পাশে দাঁড়ায়। মিষ্টি একবার সামনে থাকা সেই সুদর্শন পুরুষটির দিকে তাকায়। পুরুষটির দৃষ্টি তখনও অর্তিহার দিকেই নিবদ্ধ।
মিষ্টি ধীরে অর্তিহার দিকে ফিরে বলে,
— অর্তি, উনি হচ্ছেন এসপি মেহরাব মাহমুদ কাজি!
জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছেন!
অর্তিহা অবাক হয়ে মিষ্টির দিকে তাকায়,

— কিসের জিজ্ঞাসাবাদ?
মেহরাব গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
— এই কোচিংয়ের উচ্চতর গণিতের শিক্ষক তাহমিদ নিখোঁজ। এটা নিয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছি। এখন, আশা করি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করা যাবে?
অর্তিহা হালকা স্বরে উত্তর দেয়,
— জি, জিজ্ঞেস করুন। কী জানতে চান?
— প্রথমেই, আপনার নামটা জানতে চাই।
অর্তিহা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই হঠাৎ পেছন থেকে কণ্ঠ ভেসে আসে,
— অর্তিহা কারদার!
মেহরাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অর্তিহার পেছনে তাকায়। অর্তিহাও বিস্মিত হয়ে ঘুরে দেখে— আদ্রিক দাঁড়িয়ে আছে! ধীর পায়ে সে সামনে এগিয়ে এসে মেহরাবের সামনে দাঁড়ায়।
মেহরাব ভ্রু কুচকে বলে,

— আপনি…?
আদ্রিক ঠান্ডা স্বরে উত্তর দেয়,
— আদ্রিক কারদার। নাম তো শুনেননি বলবেন না?
মেহরাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— শুনেছি, বহুবার। মনেও আছে।
আদ্রিক মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে,
— আর কিছু জানতে চান?
মেহরাব একবার অর্তিহার দিকে তাকিয়ে, আবার আদ্রিকের দিকে ফিরে বলে,
— জি, জানতে চাই অর্তিহা কারদারের কাছ থেকেই।
সে আবার অর্তিহার দিকে ফিরে প্রশ্ন করে,
— আপনি কবে ভর্তি হয়েছেন এই কোচিংয়ে?
— পাঁচ দিন আগে।
— শেষবার কবে তাহমিদ কে দেখেছেন?
— পাঁচ দিন আগেই।
— তারপর আর দেখেননি?
— না, আসলে আমি মাঝে দুই দিন কোচিংয়ে আসিনি।
মেহরাব ভ্রু কুচকে কড়া স্বরে বলে,
— কেন?
আদ্রিক উত্তর দেয়,
— অসুস্থ ছিলো।

মেহরাব একবার আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে আবার অর্তিহার দিকে তাকায়।
— তাহমিদকে মানুষ হিসেবে কেমন মনে হয়েছে আপনার? ভালো না…
আদ্রিক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে,
— চিপ!
মেহরাব আর অর্তিহা দু’জনেই আদ্রিকের দিকে তাকায়। মেহরাব ভ্রু কুঁচকে, অর্তিহা বিস্ময়ে।
আদ্রিক হেসে বলে,
— চিপ প্রশ্ন করছেন! একজন মানুষকে প্রথম দেখায় কীভাবে বোঝা যায় সে ভালো না খারাপ?
মেহরাব গলা কঠিন করে বলে,
— ক্যাপ্টেন এখানে আমি এসপি। তাই কোন প্রশ্নটা চিপ আর কোনটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা আমিই ঠিক করব। আমার কাজে হস্তক্ষেপ করবেন না।
আদ্রিক হাসে, কিন্তু আর কিছু বলে না।
মেহরাব এবার আবার অর্তিহার দিকে ফিরে প্রশ্ন করে,
— যেদিন আপনি তাহমিদ স্যারকে শেষবার দেখেছেন, সেদিন কি এমন কিছু বা কাউকে দেখেছেন, যা আপনার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছিলো?
অর্তিহা মাথা নেড়ে ‘না’ বোঝায়।
তখন আদ্রিক ঠোঁটের কোণে সেই পরিচিত মুচকি হাসি নিয়ে বলে,

— জিজ্ঞাসাবাদ শেষ? নাকি আরও কিছু জানার আছে, এসপি মেহরাব মাহমুদ কাজি?
মেহরাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— জি। শেষ।
আদ্রিক এবার অর্তিহার দিকে তাকিয়ে কোমল স্বরে বলে,
— চল?
অর্তিহা মাথা নাড়ে। আদ্রিক তাকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। পেছনে মেহরাব দাঁড়িয়ে, অর্তিহা আর আদ্রিকের চলে যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে থাকে। তার চোখ দুটি শান্ত, গভীর। কোচিং থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই হঠাৎ অর্তিহার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। সে পড়ে যেতে যেতে গাড়ির দরজা ধরে ফেলে, আর আদ্রিক দ্রুত তাকে ধরে ফেলে—ফলে সে মাটিতে পড়ে না।
আদ্রিক উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— কী হয়েছে?
অর্তিহা একটু সামলে নিয়ে আদ্রিকের দিকে একবার তাকায়, তারপর বলে,
— কিছু না, ঠিক আছি।
— সত্যিই ঠিক আছিস? কালকে মেইডের কাছে শুনেছি, তুই নাকি মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলি?
— তেমন কিছু না, আমি ঠিক আছি।
আদ্রিক কিছুক্ষণ নীরবে অর্তিহার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে ভেসে ওঠে এক নিঃশব্দ চিন্তা।
একটু থেমে সে প্রশ্ন করে,
— এই মাসে পিরিয়ড মিস হয়েছে?
অর্তিহা একটু অবাক হয়ে তাকায়,
— কেন?
— আনসার দে।
— হ্যাঁ।
— কয় মাস?
— তিন মাস।
— আচ্ছা, চল।

আদ্রিক অর্তিহাকে আস্তে করে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও উঠে পড়ে। গাড়ি স্টার্ট দেয় সে। অর্তিহা কিছুই বুঝে উঠতে পারে না আদ্রিক হঠাৎ এভাবে এমন প্রশ্ন করলো কেন। তবে আর কিছু না বলে, সে জানালার কাচের বাইরে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ আদ্রিক গাড়ি সাইড করে থামায় এবং নেমে যায়। অর্তিহা কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকায়। আদ্রিক ঢুকে পড়ে একটি ফার্মেসিতে। কয়েক মিনিটের মধ্যে সে ফিরে আসে, হাতে একটা প্যাকেট। গাড়িতে উঠে দরজাটা লাগিয়ে সে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দেয় অর্তিহার দিকে।
অর্তিহা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

— এটা কী?
আদ্রিক শান্ত গলায় বলে,
— প্রেগন্যান্সি কিট।
কথাটা শুনেই অর্তিহা থমকে যায়। যেন তার হৃদয় থেমে যায়। ভেতরে একটা ভয় চেপে বসে—তবে কি সে সত্যিই প্রেগন্যান্ট? তাই কি তিন মাস ধরে পিরিয়ড হয়নি? অথচ সে এ নিয়ে তেমন কিছু ভাবেনি, কারণ ভাবার মতো সময় বা মানসিকতাও ছিল না। কিন্তু এখন? সত্যি যদি হয়…? বাসার সবাই কীভাবে নেবে?
এসব চিন্তা যখন মাথায় ঘুরছে, গাড়ি এসে থামে কারদার ম্যানরে। হঠাৎ অর্তিহার হুশ ফিরে আসে। সে গাড়ির দরজা খুলে নামতে যায়, ঠিক তখনই আদ্রিক তার হাত ধরে আটকে দেয়।
অর্তিহা তাকায় তার দিকে। আদ্রিক স্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে বলে,

— এখনই চেক করবি!
অর্তিহা আদ্রিকের দিকে একবার তাকায়, কিছু না বলেই গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায়। মুখে কোনো শব্দ নেই, চোখে এক ধরনের শূন্যতা। নিজের রুমের একটু সামনেই দেখা হয়ে যায় মেহজার। হঠাৎ অর্তিহাকে এই অবস্থায় দেখে মেহজা অবাক হয়ে যায়। অর্তিহার চেহারায় আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট, যেন কিছু একটা তাকে নাড়া দিয়েছে। তার ভেতরের অস্থিরতা লুকানোর চেষ্টা করলেও মেহজার চোখে ধরা পড়ে যায়।

— কিছু হয়েছে অর্তি? তোকে এমন লাগছে?
— কি? না… কিছু হয়নি। আমি তো… একটু পরে তোর সাথে কথা বলছি।
এই বলে মেহজাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অর্তিহা দ্রুত নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। মেহজা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর চিন্তিত মুখে হেঁটে নিচে নামতে যায় মেহজা। সিঁড়ির কাছে এসেই আদ্রিককে দেখে—সে উপরে উঠছে। চোখে সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। আদ্রিক তার দিকে তাকিয়ে মেহজার দৃষ্টিতে থাকা প্রশ্নটা বুঝে ফেলে।

— কিছু বলবে?
— অর্তি কি আপনার সাথেই এসেছে?
— হ্যাঁ।
মেহজা ভ্রু কুচকে বলে,
— এত তাড়াতাড়ি ওর কোচিং শেষ হয়ে গেছে?
আদ্রিক স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দেয়,
— আজ টিচার আসেনি। তাই চলে এসেছে। আর কিছু?
— না।

আদ্রিক চলে যায়। মেহজা সিঁড়ি ঘেঁষে একটু উঁকি দিয়ে দেখে আদ্রিক কোন রুমে যাচ্ছে—অর্তিহার, নাকি নিজের। কিন্তু আদ্রিক নিজের রুমেই ঢোকে। এটা দেখে মেহজা নেমে যায় নিচে। মেহজা চলে যেতেই আদ্রিক আবার নিজের রুমের দরজা খুলে বের হয়। নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়ায় অর্তিহার রুমের সামনে। তারপর ধীরে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢোকে। রুমে ঢুকতেই সে দেখে অর্তিহা দাঁড়িয়ে আছে ওয়াশরুমের সামনে। তার হাতে একটি প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট। অর্তিহা কাঁপছে।

আদ্রিক কাছে যেতেই সে ধীরে মাথা তোলে, চোখে জল আর ভয়। আদ্রিক প্রশ্নবোধক চাহনি দেয়। অর্তিহা কাঁপা হাতে আদ্রিকের দিকে কিটটা বাড়িয়ে দেয়। আদ্রিক সেটা নিয়ে তাকায়… স্পষ্ট দুটি দাগ। এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে যায় সে। চোখজোড়া স্থির হয়ে পড়ে কিটটার দিকে। তারপর হঠাৎ ঠোঁটের কোণে এক শান্ত, স্নিগ্ধ হাসি খেলে যায়।
আদ্রিক অর্তিহার গলে হাত রেখে নরম, মোলায়েম কন্ঠে বলে,
— থ্যাংকস, অর্তিজান। আমার রোজ। আমাকে এমন একটা সুন্দর, অনন্য অনুভূতি দেওয়ার জন্য।
অর্তিহার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সে আদ্রিকের হাতটা নিজের গাল থেকে সরিয়ে দেয়।
— কাঁদছিস কেন?
— আমার বুঝি খুশি হওয়া উচিত? কিন্তু আমি খুশি হতে পারছি না! কারণ আমি চাই না আপনার সন্তানের মা হতে। আপনার মতো ঘৃণ্য একজন মানুষের গর্ভে সন্তান ধারণ করতে চাই না আমি, আদ্রিক ভাইয়া।
আদ্রিক চোখে চোখ রেখে সেই পরিচিত ঠান্ডা হাসিটা ঝুলিয়ে বলে,
— “তোর গর্ভে আমার সন্তান ধারণ করতে হবে।

আর আমার সন্তানের মা একমাত্র তুইই হবি। এটা কোনো অপশন না—এটা মোহশৃঙ্খল। যার কোনো মুক্তি নেই, রোজ।”
অর্তিহা অসহায়ভাবে কেঁদে ওঠে।
— কেন আপনি আমাকে এমন কষ্ট আর অভিশপ্ত জীবন দিলেন?
আদ্রিক হেসে বলে,
— আমি তো তোর কাছে ভালোবাসার স্বর্গ খুলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুই নিজেই নরক বেছে নিয়েছিস!
— আপনি কি আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন? অথচ আমি তো কোনো অপরাধই করিনি!
— তুই অপরাধ করিসনি? অন্য কাউকে ভালোবাসাটা অপরাধ নয়? জানিস সেদিন আমার কতটা কষ্ট হয়েছিল?
— আর কত শোধ তুলবেন? আর কত কষ্ট দিবেন আমাকে? কিছুদিন পর সবাই যখন জানবে আমি প্রেগন্যান্ট, তখন আমি কীভাবে বাড়ির মানুষদের মুখোমুখি হবো?
আদ্রিক ঠান্ডা স্বরে বলে,

— আমি তো আছি।
অর্তিহা কান্নারত অবস্থায় আদ্রিকের চোখে চোখ রেখে বলে,
— আপনার থাকাটাই তো আমার অস্বস্তির কারণ!
আদ্রিক ঠান্ডা চাহনি তে বলে,
— অস্বস্তির মাঝেই স্বস্তি খুঁজে নে। না হলে তোর জন্যই জীবনটা অসহনীয় হবে!
এই কথা বলে আদ্রিক দরজার লকটা ভেতর থেকে ঘুরিয়ে বেরিয়ে যায়। অর্তিহা ভেঙে পড়ে কান্নায়। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ে।
— কেন এমন হলো? এই সন্তান আমাকে এমন এক পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যেখানে আপনার নাম ছাড়া সম্মান রক্ষা করা সম্ভব না। কিন্তু আমি চাই না আপনার নাম, আদ্রিক ভাইয়া! আমি ঘৃণা করি আপনাকে! আমি কী করবো এখন? যখন সবাই সবকিছু জানবে, তখন কীভাবে ওদের চোখে চোখ রাখবো? আমি তো ওদের বিশ্বাসকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছি! আর এই সব কিছুর জন্য দায়ী আপনি!
আমি আপনাকে ঘৃণা করি, আদ্রিক ভাইয়া।
এখন, আগামীতেও ঘৃণা করবো। আপনি আমার সুন্দর জীবনটাকে অভিশাপে পরিণত করেছেন!

রেজা মঞ্জিল—বহিরঙ্গে যেমন রাজকীয়, তেমনি অন্তরঙ্গেও সমান শোভাময়। বিশাল বাড়ির প্রতিটি কোণ যেন নান্দনিকতার প্রতিচ্ছবি। দামি আধুনিক আসবাবপত্রে সুসজ্জিত, অন্দরমহলে শোভা ও সৌন্দর্যের কোনো কমতি নেই। রেজা মঞ্জিলের অভ্যন্তরের এক সুবিশাল, সুশোভিত কক্ষের বিছানায় বসে ফোনে কথা বলছেন তথ্যমন্ত্রী সারফারাজ ইমতিয়াজ রেজা।
— হ্যাঁ, আমি দেখে নিয়েছি। চ্যানেল টুয়েন্টি ফোর যা বলেছে, সেটা আইন না ভেঙে আইনরেখার কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে।

— ….
— “না, বন্ধ নয়। ওদের সঙ্গে বসো, বোঝাও—মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু বাস্তবতাও মাথায় রাখতে হয়।“
— ….
— “নতুন নীতিমালার ড্রাফট আমি কাল দুপুরে দেখব। আগে ভাষাটা ঠিক করো—নিয়ন্ত্রণ নয়, লিখো দায়িত্বশীলতা।“
— ….
— আচ্ছা, রাখছি।
ফোনটা কেটে দেন। ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। অনুমতি দিতেই ভেতরে প্রবেশ করে সাইহান। ছেলেকে দেখে একটু অবাক হয়ে বলেন,

— আজ এত তাড়াতাড়ি চলে এলে?
সাইহান সংক্ষেপে উত্তর দেয়,
— সার্জারি কম ছিলো।
একটু থেমে আবার বলে,
— তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।
সারফারাজ গম্ভীর গলায় বলেন,
— ঠিক আছে, বসো।
কিন্তু সাইহান বসে না। দাঁড়িয়ে থেকেই শান্ত স্বরে বলে,
— আমি বিয়ে করতে চাই।
সারফারাজের মুখে কোনো পরিবর্তন আসে না। ঠান্ডা মাথায় বলেন,
— ভালো কথা। কাল থেকেই পাত্রী দেখা শুরু করবো। বলো, তোমার কেমন মেয়ে পছন্দ?
সাইহানের গভীর ও দৃঢ় কন্ঠে বলে,
— তুমি জানো আমি কাকে পছন্দ করি।
সারফারাজ কঠিন মুখ করে বলেন,
— শত্রুর মেয়েকে পছন্দ করেছো? সেই মেয়ে কখনোই এই বাড়ির বউ হতে পারবে না!
সাইহান দ্বিগুণ দৃঢ় কন্ঠে বলে,

— ও আমার ভালোবাসা! শত্রু না!
সারফারাজ রাগে গর্জে ওঠেন,
— কারদার বাড়ির মেয়ে ছাড়া অন্য কেউ হলে বলো!
— অর্তিহা ছাড়া অন্য কাউকে আমি বিয়ে করবো না!
সারফারাজ রাগি কন্ঠে বলেন,
— তাহলে বিয়ে করো না! বিয়ে না করলে কেউ মরে যায় না!
সাইহান এবার রেগে বলে,
— আমি বিয়ে করবো, আর অর্তিহাকেই করবো! আর তুমি নিজে চাইবে ওকে ওর বাবা-মায়ের কাছ থেকে!
সারফারাজ রাগে ফেটে পড়েন,

— কোনোদিনও না! আমি কোনোদিনও কারদার পরিবারের মেয়ের হাত চাইবো না আমার ছেলের জন্য!
ঠিক তখনই দরজা ঠেলে ছুটে আসেন অঞ্জনা রহমান। স্বামী ও ছেলের চিৎকার শুনেই ছুটে এসেছেন। এসে বলেন,
— কী হয়েছে সাইহান? এভাবে বাবার সঙ্গে কথা বলছো কেন?
সাইহান চুপ থাকে। চোখে-মুখে তার রাগ জ্বলজ্বল করছে।
সারফারাজ রেগে বলেন,
— শত্রুর মেয়ের জন্য আমার সঙ্গে বেয়াদবি করছে!
সাইহান দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— আমি বেয়াদবি করিনি! আমি শুধু বলেছি, তুমি গিয়ে অর্তিহাকে চাইবে আমার জন্য!
সারফারাজ রাগি চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— বললাম না! কোনোদিনও চাইবো না!
সাইহান হঠাৎ গর্জে ওঠে,

— তাহলে নিজের ছেলের লাশ দেখো!
অঞ্জনা রহমান বিস্ময়ে আর ভয়ে জিজ্ঞেস করেন,
— এসব কী বলছো সাইহান? একটা মেয়ের জন্য তুমি তোমার বাবা-মাকে এমন কথা বলছো?
সাইহান কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দেয়,
— “একটা মেয়ে না মা! ও আমার ভালোবাসা। অর্তিহা আমার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র ভালোবাসা। আর যদি ও আমার না হয়—আমি নিজেকে শেষ করে দেবো!“
সারফারাজ স্তব্ধ হয়ে যায়। ছেলের আত্মঘাতী কথায় কিছুটা নরম হলেও মুখে রাগের রেখা রয়েই যায়।
— তুমি কী মনে করো, আমি গিয়ে চাইলে ওরা দিবে? আভীর কারদার তার আদরের একমাত্র মেয়েকে শত্রুর ঘরে পাঠাবে?

এই কথা শুনে সাইহান চুপ হয়ে যায়। ভাবনায় পড়ে—বাবা কি একদম ভুল বলেছে? সত্যিই তো, আভীর কারদার এমনটা করবে না। কিন্তু অর্তিহাকে অন্য কারো জীবনে কল্পনাও করতে পারে না সে। চুপচাপ বেড়িরে যায় সে রুম থেকে। সারফারাজ একবার তাকান, আবার চোখ ফিরিয়ে নেন। অঞ্জনা রহমান এক দৃষ্টিতে স্বামীকে দেখেন, তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে যান।

মোহশৃঙ্খল পর্ব ৬

সে দীর্ঘশ্বাস কোনো ঝগড়ার জন্য নয়—ছেলের জন্য, তার অবুঝ ভালোবাসার জন্য। জানেন, এই ভালোবাসার পরিণতি নেই। কারণ যে দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে দুই পরিবারের মাঝে, তা ভাঙবার নয়। বহু পুরনো শত্রুতা দুই পরিবারকেই আগলে রেখেছে।
সারফারাজ জানেন স্ত্রীর দীর্ঘশ্বাসের মানে। কিন্তু তাতেও বদলায় না তাঁর মন। শত্রুতা তাঁর কাছে ভালোবাসার চেয়ে বড়।

মোহশৃঙ্খল পর্ব ৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here