মোহশৃঙ্খল পর্ব ৯
মাহা আয়মাত
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল আরভিদ, অপর প্রান্তে এডিশনাল আইজিপি। কলটা শেষ করে সে গম্ভীর মুখে রুমে ফিরে আসে। রুমে ঢুকেই দেখে, মেহজা ফোনে গেম খেলছে। কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে অর্তিহার রুমের দিকে যেতে উদ্যত হয়। ঠিক তখনই কৌশালীর চিৎকারে পা থেমে যায় তার। অর্তিহার রুমে না ঢুকে পা বাড়ায় কৌশালীর রুমের দিকে।
দরজার কাছে পৌঁছতেই কৌশালী দরজা খুলে বেরিয়ে এসে হঠাৎ আরভিদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। হকচকিয়ে যায় আরভিদ। মুহূর্তেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কৌশালীকে এক থাপ্পড় দিয়ে বলে,
— দূরে থাকো আমার থেকে! এমনি আমার বউয়ের আমার ওপর সন্দেহ আছে!
থাপ্পড়ে হতভম্ব হয়ে যায় কৌশালী। আরভিদ ভয়ে আশপাশে তাকাতেই দেখে মেহজা দাঁড়িয়ে আছে, চোখে রাগ আর দাঁত কিড়মিড় করছে। পাশে অর্তিহাও দাঁড়িয়ে আছে। সেও কৌশালীর চিৎকার শুনোই এসেছে।
আরভিদ ঢোক গিলে মনে মনে বলে,
— কেমন পেত্নীর মতো দাঁত কিড়মিড় করছে! এই দাঁত না আবার আমার ঘাড়ে বসায়!
তারপর কৌশালীর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত নিয়ে মনে মনে বলে,
— আর এই আপদটাও শান্তি দিলো না! সারাদিন পিছনে ঘুরে! নিজের বউ পাত্তা দেয় না, আর এ কার না কার ভবিষ্যৎ বউ হয়ে পড়ে আছে আমার পিছে!
কৌশালী চোখে পানি নিয়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— আমাকে মারলে কেন?
আরভিদ বিরক্ত নিয়ে বলে,
— আমার কাছে আসায় অটোমেটিক হাত চলে গেছে!
কৌশালী অবাক হশে বলে,
— আজকে প্রথম শুনলাম কেউ কাছে আসলে অটোমেটিক থাপ্পড় পড়ে!
— সবার হয় না, আমার হয়! তাও আমার বউ ছাড়া অন্য কেউ আমাকে ছুঁতে এলে।
অর্তিহা কৌশালীর দিকে একটু এগিয়ে এসে বলে,
— চিৎকার করছিলে কেন?
— রুমে টিকটিকি ছিলো তাই!
আরভিদ রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— টিকটিকি দেখে কেউ এভাবে চিৎকার করে? আগে বলতে আরও দুটো থাপ্পড় দিতাম!
মেহজা তীক্ষ্ণ চোখে ঠাণ্ডা গলায় বলে,
— বকছেন কেন? জরিয়ে ধরেন, ভয়টা দূর হয়ে যাবে!
বলেই চলে যায় সে।
আরভিদ মেহজার যাওয়ার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,
— না জানি রুমে আমার জন্য আজকে কোন তুফান অপেক্ষা করছে!
কৌশালী বিস্ময় নিয়ে বলে,
— তুমি মেহজাকে ভয় পাও?
আরভিদ কৌশালীর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত নিয়ে বলে,
— অবশ্যই! বউকে না ভয় পেয়ে কোন জামাই ভালো থাকতে পারে?
কৌশালী অবাক হয়ে বলে,
— কিন্তু তুমি একজন মন্ত্রী!
আরভিদ বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— তো? আমি মন্ত্রী হলেও, সাথে জামাইও। আর জামাইদের ধর্মই বউকে ভয় পাওয়া!
অর্তিহা আরভিদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
— মেহু কি রাগ করেছে?
আরভিদ অর্তিহাকে বলে,
— ওর দাঁত কিড়মিড় দেখলি না? দাঁতই ঘোষণা করে দিয়েছে আজকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে!
আরভিদ চলে যেতেই অর্তিহা কৌশলীর কাছে এসে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে,
— খুব বেশি ব্যথা লেগেছে? বরফ এনে দেব?
কৌশলী বিরক্ত ও রাগ নিয়ে বলে,
— এত জোরেও লাগেনি। আমি ঠিক আছি।
এই বলে কৌশলী নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। অর্তিহা চুপচাপ নিজের রুমে ফিরে যায়। আরভিদ রুমে ঢুকে দেখে মেহজা বিছানায় বসে রাগে ফুঁসছে। সে ধীরে ধীরে কাছে যেতে যেতে গুনগুন করে গাইতে থাকে,
— Zara sa dil mein de jaga tu…
সে মেহজার পাশে বসে। মেহজা সঙ্গে সঙ্গে দূরে সরে গিয়ে ফাঁকা জায়গা তৈরি করে দেয়। আরভিদ আবার সেই দূরত্ব মিটিয়ে গায়,
— Zara sa apna le bana…
মেহজা রাগে চোখে আগুন নিয়ে তাকায়। আরভিদ গান থামিয়ে মুখটা বেচারার মতো করে ফেলে।
— রাগ করেছিস জান?
মেহজা মুখ ফিরিয়ে বলে,
— নাহ!
— বিশ্বাস কর, মেহু, ও আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারেনি, তার আগেই আমি…
মেহজা চোখ গরম করে তাকিশে বলে,
— আমাকে বলছেন কেন? আমি কে? কেউ না!
আরভিদ হাত বাড়িয়ে মেহজাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে,
— তোকেই তো বলবো! আর কে বলেছে তুই কেউ না? তুই আমার জান, আমার একমাত্র বউ!
মেহজা চোখ গরম করে আঙুল তুলে ইশারা করে বলে,
— উঁহু! দূরে থাকেন। একদম দূরে। আর আমাকে বউ বললে মেরে ফেলমু, পটলা বেডা!
আরভিদ আদরে স্বরে বলে,
— দূরে থাকলে তোর রাগ ভাঙাবো কিভাবে?
— রাগ ভাঙাতে হবে না!
এই বলে সে উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে উদ্যত হলে, আরভিদ তার হাত ধরে আটকে ফেলে। আরভিদ দাড়িয়ে মেহজাকে কাছে টেনে নরম স্বরে বলে,
— আগে তোর রাগ ভাঙাবো, তারপর যেতে দিবো!
মেহজা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,
— ছাড়েন! ভালোয় ভালোয় ছাড়েন আমাকে।
— আগে বল, কী করলে তোর রাগ ভাঙবে?
— আপাতত আপনি আমার থেকে দশ হাত দূরে থাকেন।
আরভিদ এবার মেহজাকে টেনে আরো কাছে এনে বলে,
— সব দোষ আমার হুম? তুই তো কৌশলীকে ইচ্ছে মতো ধুয়ে দিতে পারিস, আমার পাশে ঘেঁষার জন্য!
মেহজা ঠান্ডা কণ্ঠে বলে,
— আমি কেন আপনার পাশে কে ঘেঁষলো তা নিয়ে ঝগড়া করবো?
আরভিদ আদরে স্বরে বলে,
— কারণ আমি তোর বিয়ে করা বর!
মেহজা চোখ রাঙিয়ে বলে,
— হুহ!
এই বলে সে আরভিদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আরভিদ নিজেকে সামলে তার পিছু নেয়। সিঁড়ির কাছে এসে মেহজা নামতে শুরু করলে আরভিদ তার শাড়ির আঁচল ধরে টান দেয়। মেহজা তড়াক করে ঘুরে তাকায়—চোখে রাগে জ্বলে। অথচ আরভিদ কোনো পাত্তা না দিয়ে আঁচল ধরে রাখে।মেহজা আঁচল ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে নিচে নামে। আরভিদ পিছু পিছু আঁচল ধরে নেমে আসে।
হঠাৎ আরভিদের চোখ পড়ে—লিভিং রুমে বসে আছেন আভীর, আফির, নাজনীন, কারদাররা। এটা দেখে সে দ্রুত মেহজার আঁচল ছেড়ে দেয়। তার এই আচরণে মেহজার মনে অভিমান জমে। সে পেছন ফিরে একবার আরভিদের দিকে তাকায়—তার চোখে ব্যথা, কিন্তু সে কিছু বোঝায় না। আরভিদ মেহজাকে দেখেই আফির কারদার বসতে বলেন। আরভিদ একবার মেহজার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে সোফায় বসে পড়ে। ঠিক তখনই ডোরবেল বেজে ওঠে।
মেইড দরজা খুলতে এগিয়ে গেলে মেহজা বলে,
— আমি খুলছি।
দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে সে দরজা খুলে ফেলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। কারণ, যাদের সে দেখছে, তাদের এখানে দেখা তার একেবারেই কল্পনার বাইরে ছিল।
দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে সারফারাজ ও পুরো রেজা পরিবার— অঞ্জনা, সাইহান আর শায়রা। পেছনে বেশ কিছু মেইড, প্রত্যেকের হাতে সাজানো উপহারের থালা। এমন দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে যায় মেহজা। কারদার পরিবারের সদস্যরাও কৌতুহলী চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
সারফারাজ গম্ভীর স্বরে বলেন,
— ভেতরে আসতে দিবে না নাকি?
মেহজা সরে দাঁড়ায়। সবাই একে একে ভেতরে প্রবেশ করে। কারদার পরিবারের কারো মুখে কোনো কথা নেই, সবাই বিস্মিত। সারফারাজ সামনে এগিয়ে এসে আভীর কারদারের মুখোমুখি দাঁড়ান। আভীরের মুখে তীব্র রাগের ছাপ।
সারফারাজ গম্ভীর স্বরে বলেন,
— আমি এখানে শত্রুতা বাড়াতে আসিনি। বরং সেই শত্রুতা মিটিয়ে নতুন আত্মীয়তা গড়তে এসেছি।
আবীর কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন,
— নতুন আত্মীয়তা?
সারফারাজ বলেন,
— হ্যাঁ। কারদার বাড়ির মেয়েকে রেজা পরিবারের বড় বউ করতে চাই।
ঠিক তখনই সেখানে আসে তাহিয়া কারদার। লিভিং রুমে দাঁড়িয়ে থাকা রেজা পরিবারকে দেখে থমকে যায় সে। বিস্ময়ে ফেটে পড়ে,
— ভাইয়া?
সারফারাজ তাকান বোনের দিকে। সেই ছোটবোন, যাকে তিনি ৩৫ বছর ধরে জীবিত থাকা সত্ত্বেও রাগে অভিমানে মৃত ভেবে এসেছেন। আজ চোখের সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু আজকে তিনি আর বোনের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন না।
তাহিয়া কাঁদতে কাঁদতে ভাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে,
— ভাইয়া! তুমি এসেছো? আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না!
সারফারাজ মাথা নেড়ে আদর করে তাহিয়ার মাথায় হাত রাখেন।
সাইহান এগিয়ে এসে তাহিয়া কারদারের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
— হুম, ফুপি, আজ তোমার কাছে বাবা এসেছে কিছু চাইতে। তুমি কি বাবার সেই চাওয়াকে ফিরিয়ে দেবে?
তাহিয়া কারদার সারফারাজের বুক থেকে মাথা তুলে কান্নাভেজা কন্ঠে বলেন,
— কোনোদিনও না! ভাইয়া যদি আমার জানটাও চায়, আমি তাও দিয়ে দেবো!
সারফারাজ গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,
— তোর জান না, তোর জান সমতুল্য মেয়েকে চাইতে এসেছি আমার সাইহানের জন্য।
এই কথা শুনে তাহিয়া হতবাক হয়ে সারফারাজের দিকে তাকান তারপর আভীর কারদারের দিকে। আভীরের চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে কথাটা শুনে তার রাগ আরো বেড়ে গেছে।
আফির রাগে গর্জে উঠে বলেন,
— রেজা মঞ্জিলে কারদার ম্যানরেরছেঁড়া জুতোও পাঠাবো না! সেখানে মেয়ে তো দূরের কথা!
সারফারাজ রাগ নিয়ন্ত্রণ করে আভীরকে বলেন,
— আমি তোর সাথে একটু আলাদা করে কথা বলতে চাই।
আফির রেগে বলে ওঠেন,
— কী আলাদা কথা?! কোনো কথা নেই!
আভীর কারদার আফিরকে থামিয়ে বলেন,
— আমার রুমে চল।
দুজনই সিড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। নিচে গম্ভীর পরিবেশ। আরভিদ মুখ শক্ত করে সবকিছু দেখছে। কিন্তু একটা শব্দও করছে না।
সাইহান সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে তাহিয়া কারদারের হাত ধরে কোমল কণ্ঠে বলে,
— ফুপি, তুমি তোমার মেয়েটাকে আমাকে দেবে? বিশ্বাস করো, আমি অর্তিহাকে অনেক যত্নে রাখবো। কোনোদিন ফুলের টোকাও দেবো না! আমি অর্তিহাকে এতটা ভালোবাসি, যতটা ভালো কখনো নিজেকেও বাসিনি। প্লিজ, ফুপি, আমাকে ফিরিয়ে দিও না।
বলতে বলতে সাইহানের চোখে পানি চলে আসে। তাহিয়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলবেন, ঠিক তখনই অঞ্জনা এগিয়ে এসে বলেন,
— দয়া করে ফিরিয়ে দিয়ো না ওকে, তাহিয়া। আমার ছেলেটা সত্যিই মন থেকে ভালোবাসে অর্তিহা।
সাইহান তখনো তাকিয়ে থাকে তাহিয়ার দিকে, এক চিলতে আশার অপেক্ষায়। তাহিয়া হেসে স্নেহভরে সাইহানের গালে হাত রেখে বলেন,
— প্রথমবার আমার ভাতিজা ফুপির কাছে কিছু চেয়েছে। আমি কিভাবে ফিরিয়ে দিই? আমি রাজি। তোমার ভালোবাসাকে তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি।
তাহিয়ার মুখের কথা শেষ হতেই হাসি ফুটে ওঠে সাইহান, শায়রা আর অঞ্জনার মুখে। নাজনীন কারদার যেন হতবাক, তাহিয়ার কথায় তার মুখ শুকিয়ে যায়। আরভিদ তখনো চুপ।
আভীর আর সারফারাজ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সারফারাজ কিছু কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলেন,
— এটা গাজীপুরের সেই প্রপার্টির কাগজপত্র। এই জায়গা নিয়েই তো সবকিছু শুরু হয়েছিল। আজ এটা তোমার নামে করে দিলাম।
আবীর কারদারের চোখে ঝিলিক খেলে যায়। ঠোঁটের কোণে একটি ক্ষীণ হাসি।
— দেখেছিস! শেষ পর্যন্ত এটা কারদার বাড়ির অধীনেই এল। কারণ এর যোগ্য মালিক আমরাই!
সারফারাজ গম্ভীরভাবে বলেন,
— এখন আমি চাই, তোর মেয়েকে আমার ছেলের বউ বানাতে।
আভীর ভ্রু কুচকে বলেন,
— তোর কি মনে হয়, এই জায়গার বিনিময়ে আমি আমার কলিজার টুকরাকে দিয়ে দেবো?
সারফারাজ মুচকি হেসে বলেন,
— এই জায়গাটা কিন্তু কম কিছু না, তোর জন্য! ভাবিস।
আভীর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেন,
— ঠিক আছে। আমি রাজি।
আভীর ও সারফারাজ নিচে, লিভিং রুমে চলে আসেন। সবাই তাদের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আভীর সবার উদ্দেশ্যে বলেন,
— অর্তিহা আর সাইহানের বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই ।
আভীরের কথায় রেজা পরিবারের মানুষ আরেক দফা খুশি হয় তবে কারদার পরিবারের মধ্যে তাহিয়া ছাড়া কেউই খুশি নয়। আরভিদের মুখ দেখে বোঝা যায় না—সে খুশি, না কি বিরক্ত। মুখাবয়বে এক অদ্ভুত নিরাবেগতা।
মেহজা বলে উঠে,
— মামা, একবার অর্তির মতামত নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো।
নাজনীনও মাথা নেড়ে সমর্থন করে বলেন,
— হ্যাঁ ভাইয়া, মেহজা একদম ঠিক বলছে।
আভীর গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,
— আমার মেয়ে কখনো আমার কথার বাইরে যাবে না।
— তারপরও মামা, একবার অর্তির….
আভীর এবার রেগে মেহজার দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলেন,
— বললাম তো!
মেহজা চুপ করে মাথা নিচু করে ফেলে। আরভিদ ধীরে ধীরে চোখ তুলে মেহজার দিকে তাকায়, তারপর সোজা আভীরের দিকে চেয়ে কঠিন গলায় বলে ওঠে,
— ড্যাড, আমার বউয়ের সাথে এভাবে উচ্চস্বরে কথা বলবে না! সেই অধিকার আমি কাউকে দিইনি। পরবর্তীতে যেন এই ভুল আর না হয়!
এক মুহূর্তেই আভীর কারদারের মুখ থমথমে হয়ে ওঠে।
ঘরভর্তি লোকের সামনে ছেলের মুখে এমন স্পষ্ট জবাব শুনে সবার সামনে তিনি অপমানিত বোধ করেন। সারফারাজ হালকা হাসে। ঘর জুড়ে এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। মেহজা চোখে তুলে একবার আরভিদের দিকে তাকায়।
তাহিয়া এবার হেসে পরিস্থিতি ঠিক করার জন্য বলন,
— আচ্ছা , এবার বিয়ের ডেট ফিক্সড করা যাক?
সবাই সম্মতি দেয়। অঞ্জনা মেইডকে সব ডালাগুলো নামাতে বলেন। সবাই সোফায় বসে, শুধু আরভিদ আর মেহজা দাঁড়িয়ে। আভীর, সারফারাজ সহ সবাই আরভিদকে ডাক দেন—তাদের সঙ্গে বসে বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে। আরভিদ সামনে এগিয়ে এসে মেহজার হাত ধরে তাকে সোফায় নিজের পাশে বসায়। মেহজা একবার আরভিদের দিকে তাকায়, কিন্তু আরভিদের মুখে এখনও একরকম কঠিন ভাব বিরাজমান। এরপর সবাই মিলে শুরু করে বিয়ের বিষয়ক আলোচনা।
সবার কথা বলার মাঝখানে শায়রা হঠাৎ বলে উঠে,
— তা অর্তিহা কোথায়? ওকে নিয়ে আসেন?
অঞ্জনা সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলেন,
— ঠিক বলেছো! দেখি আমাদের অর্তি পাখিটাকে, যার মধ্যে আমার ছেলের প্রাণ আটকে আছে।
সাইহান লাজুকভাবে হেসে ফেলে। তাহিয়া মেহজাকে বলেন অর্তিহাকে নিয়ে আসতে। মেহজা আরভিদের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে। ওপরে উঠতেই কৌশলীর সঙ্গে দেখা হয়। কৌশলী মেহজাকে দেখে কিছু না বলেই নিচে চলে আসে। নিচে পৌঁছে রেজা পরিবারকে দেখে বিস্ময়ভরা চোখে বলে,
— আমি কি কোনো স্বপ্ন দেখছি? রেজা পরিবার! তাও আবার কারদার ম্যানশনে?
তাহিয়া হেসে বলেন,
— স্বপ্ন না কৌশলী, একদম সত্যি!
কৌশলী এগিয়ে গিয়ে শায়রার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
— হোয়াট এ সারপ্রাইজ! তোমাদের ঝামেলা সব মিটে গেছে?
সাইহান হাসিমুখে উত্তর দেয়,
— হ্যাঁ।
কৌশলী খুশি হয়ে বলে,
— দ্যাটস গ্রেট! মমকে বললে সে তো সঙ্গে সঙ্গে দেশে চলে আসবে! এতদিন এই দুই পরিবারের ঝামেলার জন্যই সে আসতে চাইছিল না!
এদিকে, অর্তিহা নিজের ঘরে বিছানায় বসে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। আজ মেহরাবের আসা তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সে বুঝতে পারছে না কেন মেহরাব তাকে সন্দেহ করছে তাহমিদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায়। ভাবতে ভাবতে তার দৃষ্টি পড়ে নিজের পেটের দিকে। মেহরাবের বিষয়টা যেন মুছে গিয়ে নতুন চিন্তার জন্ম দেয়।
সে ধীরে ধীরে পেটে হাত রাখে। সন্তানকে নিয়ে আবারও এক নতুন উদ্বেগ তার মনজুড়ে বসে। সে ভাবছে, আদ্রিকের নাম কি সে প্রকাশ্যে গ্রহণ করবে? অথচ আদ্রিকই সেই মানুষ, যে তার ভালোবাসার মানুষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তবুও এই পরিস্থিতিতে আদ্রিককে গ্রহণ করা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। না হলে সমাজের সামনে সে মুখ দেখাবে কীভাবে?
তারউপর আবার পরিবারের সবাই যদি জেনে যায়, সে আর আদ্রিক তো এক বছর আগেই গোপনে বিয়ে করেছে! তখন কী বলবে সবাই? যদি সন্তান প্রসঙ্গে সত্যি প্রকাশ পেয়ে যায়? সবাই কি তাকে ঘৃণা করবে?
অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে তার মাথায়। সে মাথা চেপে ধরে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। এই চিন্তাভাবনায় সে গত দুইদিন ধরেই অসুস্থ হয়ে আছে।
হঠাৎ দরজায় নক হয়। অর্তিহা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে আয়নায় নিজেকে ঠিকঠাক করে দরজা খুলে দেয়। মেহজা রুমে ঢুকে পড়ে।
মেহজা জিজ্ঞেস করে,
— কী করছিস?
অর্তিহা ছোট করে উত্তর দেয়,
— পড়ছিলাম।
— তোকে নিচে সবাই ডাকছে।
— কেন?
— সারফারাজ আঙ্কেল এসেছেন।
অর্তিহা অবাক হয়ে বলে,
— মামা এসেছেন?
— হুম, সাথে পুরো পরিবার।
— ওরা? মানে… কিছু হয়েছে?
— না, কিছুই না। তারা তোর আর সাইহানের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে!
অর্তিহার মাথায় যেন বাজ পড়ে। হঠাৎই সবকিছু ভেঙে পড়ে মনে হয়। সে কাঁপা গলায় বলে,
— নিশ্চয়ই নিচে ঝামেলা হচ্ছে?
মেহজা মাথা নাড়িয়ে চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
— না, বরং মামা রাজি হয়ে গেছেন। এখন তারা বিয়ের তারিখ ঠিক করছে।
অর্তিহা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। বিশ্বাসই হচ্ছিল না, তার বাবা রাজি হয়ে গেছেন! মেহজা তার হাতদুটি মুঠো করে ধরে বলে,
— শোন অর্তি, যদি তোর বিয়েতে কোনো আপত্তি থাকে, তুই না বলে দিবি। বিয়ে একটা বড় সিদ্ধান্ত। শুধু সবাই চাইছে বলে নিজের জীবনটা ভুল পথে দিবি না। কেউ যদি না-ও থাকে, আমি আছি!
অর্তিহা অসহায় চোখে মেহজার দিকে তাকায়। কী করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সে কখনোই বাবার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যায়নি। কিন্তু সে যে বিবাহিত, আদ্রিকের স্ত্রী! এবং এখন…এখন আবার তার গর্ভে আদ্রিকের সন্তান!
মেহজা আবার বলে,
— চল, সবাই নিচে অপেক্ষা করছে।
অর্তিহা স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। আবারও ডাকে,
— অর্তি, চল?
অর্তিহা এবার মাথা নেড়ে মেহজার সাথে নিচে আসে। লিভিং রুমে ঢুকতেই অঞ্জনা হেসে বলে ওঠেন,
— এইতো! আসছে আমার বাড়ির হবু বড় বউ!
সবাই তাকায় অর্তিহা আর মেহজার দিকে। সাইহান তাকিয়ে থাকে অর্তিহার দিকে, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। তার চোখে একরকম বিজয়ের আনন্দ, যেন নিজের ভালোবাসাকে সে পেতে চলেছে। শায়রার চোখ পড়ে অর্তিহার উপর। মনে পড়ে যায় গত রাতের আদ্রিকের সেই অপমানসূচক কথাগুলো। ভিতরে ভিতরে ক্ষোভে ফেটে পড়ে সে। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ চেপে রাখে। তার চোখে স্পষ্ট প্রতিশোধের আগুন।
আভীর অর্তিহাকে ডেকে নিজের পাশে বসায়। মেহজা আর আরভিদের সঙ্গে না বসে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। সাইহানের দৃষ্টি এখনও অর্তিহার দিকেই। অর্তিহার ভিতরে ভিতরে এক অজানা ভয় জন্ম নেয়। সাইহানের এই নিরব চাহনিতে তার ভালো লেগছে না। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভয়— যদি আদ্রিক সবকিছু জানতে পারে, তাহলে যে একপ্রকার তুফান বইবে!
সে ঘেমে উঠতে থাকে। এই দমবন্ধ পরিস্থিতির মাঝেই দুই পরিবার বিয়ের তারিখ নিয়ে আলোচনা করতে থাকে।
সারফারাজ প্রশ্ন করেন,
— সামনের শুক্রবারে বিয়েটা হলে তোমাদের কোনো আপত্তি আছে?
আভীর বলেন,
— না, আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
সাইহান হঠাৎ বলে উঠে,
— সামনের শুক্রবার মানে তো এখনও ছয়দিন বাকি!
সারফারাজ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন,
— তুমি কি আরো আগে চাচ্ছো?
সাইহান একবার অর্তিহার দিকে তাকালো, তারপর দৃঢ়স্বরে বললো,
— হ্যাঁ, আমি আর অপেক্ষা করতে চাই না। যত দ্রুত সম্ভব ওকে আমার করে নিতে চাই।
অর্তিহা মাথা নিচু করে বসে ছিল। ভিতরে ভিতরে তার হৃদয় কাঁপছিলো ভয়ে। আরভিদ পুরো আলোচনা জুড়েই চুপচাপ, নীরব।
সারফারাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
— ঠিক আছে, তাহলে তিন দিন পর অর্থাৎ মঙ্গলবারে। এর আগে সম্ভব না। বিয়ে বলে কথা, প্রস্তুতির দরকার হয়।
আভীর সম্মতি জানালেন। তারপর সবাই মিষ্টি মুখ করতে থাকে। আভীর একটি মিষ্টির টুকরা অর্তিহার সামনে এগিয়ে ধরেন। অর্তিহা একবার আভীর কারদারের দিকে তাকিয়ে, ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও অল্প করে কামড় দিলো মিষ্টিতে। রেজা পরিবার আরো কিছুক্ষণ বিয়ের আয়োজন নিয়ে কথা বললো। তারপর বিদায়ের সময় এলো। সবাই উঠে দাঁড়ালো। সাইহান একে একে সবাইকে বিদায় জানিয়ে, শেষমেশ এসে অর্তিহার সামনে দাঁড়ালো।অর্তিহা আস্তে করে মাথা তুলে তাকালো সাইহানের চোখে। তারপর আবার চোখ নামিয়ে নেয়।
সাইহান কোমল কণ্ঠে বলে,
— জানি, সবকিছু তোমার জন্য হঠাৎ করে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একবার আমার হয়ে দেখো। ভালোবাসা আর যত্নে তোমাকে মুড়িয়ে রাখবো। তোমার ছুঁয়ে আসা সব কষ্ট আমি নিজের মধ্যে চেপে রাখবো, শুধু তোমাকে ভালো রাখার জন্য।
একটু থেমে আবার বললো,
— যাচ্ছি এখন। পরেরবার যখন আসবো, তখন বর সাজে তোমাকে বউ করে নিয়ে যেতে আসবো। প্রস্তুত থেকো।
সাইহান কিছু সময় অপেক্ষা করলো, যদি অর্তিহা কিছু বলে। কিন্তু অর্তিহা না মাথা তোলে, না কিছু বলে। সাইহান এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর চলে যায়। সবাই চলে গেলে, অর্তিহা নীরবে সিঁড়ি বেয়ে উপরের ঘরে উঠে গেলো। তার আচরণে সবাই ভেবেছিল, হয়তো সে লজ্জা পেয়েছে। কিন্তু ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে সে হু হু করে কেঁদে উঠলো। বুক ফেটে কান্না আসে। সে বুঝতে পারছিল না কী করবে, কোথায় যাবে, কাকে বলবে। মনে হচ্ছিল, সে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ। সাথে আদ্রিকের ভয়ও হচ্ছে।
দুবাইয়ের আকাশে তখন সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে। ঘড়িতে ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। ইমিরেটস এয়ারলাইন্সের ক্রু অপারেশন সেন্টারের ভেতর বসে আছে আদ্রিক। পরনে তার পাইলটের ইউনিফর্ম— সাদা শার্টের উপর ডার্ক নেভি ব্লেজার, কাঁধে সোনালি স্ট্রাইপ, মাথায় পাইলট ক্যাপ, আর পায়ে কালো বুট জুতা। বাম বুকের ওপর একটি কালো ব্যাজে সাদা অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে— ক্যাপ্টেন আদ্রিক কারদার।
টেবিলের উপর রাখা আছে ফ্লাইট ফাইল, ট্যাবলেট, এবং চার্টস— সব কিছু সুচারুভাবে সাজানো। সামনে চেয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে থাকে আদ্রিক। এরপর এক গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সহ-পাইলট তখন চেকলিস্ট শেষ করে হালকা হাসি নিয়ে বলে,
— এভরিথিং’স গ্রিন, ক্যাপটেন। উই’আর অল সেট টু বোর্ড।
আদ্রিক মাথা হেলে সম্মতি জানায়। শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
— লেট্স গো দেন।
সে নিজের হ্যান্ডব্যাগটা কাঁধে তুলে নেয়। বিমানে ওঠার ধাতব সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে থাকে। তার বুটজুতার ধাপে ধাপে ধাতব শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বিমানের ফাঁকা গায়ে। হঠাৎ, বিমানের দরজার ঠিক সামনে— তার পকেটে থাকা মোবাইলটা কেঁপে ওঠে। থেমে গিয়ে সে ফোনটা বের করে দেখে, পরিচিত বাংলাদেশি নম্বর থেকে কল এসেছে।
কলটি রিসিভ করে সে কিছুক্ষণ চুপচাপ শুনে যায়। ফোনের ওপাশের কথাগুলো যেন মুহূর্তেই বদলে দেয় আদ্রিকের অভিব্যক্তি। তার শান্ত মুখশ্রীর নিচে ছায়া ফেলে এক কঠোর শীতলতা। চোখজোড়া হয়ে ওঠে হিমশীতল, ভয়ঙ্কর ।
কথা শেষ হতেই কিছু না বলেই কলটা কেটে, আদ্রিক ফোনটা পকেটে রেখে ওয়াকি-টকিতে যোগাযোগ করে কন্ট্রোল রুমে। কন্ঠস্বর কড়া অথচ সংযত,
— দিস ইজ ক্যাপ্টেন অ্যাদ্রিক কারদার। আই ওউন্ট বি অপারেটিং টুডেজ ফ্লাইট। সো অ্যাসাইন অল্টারনেট কমান্ড। আই হ্যাভ এন ইমার্জেন্সি… টু ঢাকা।
কল কেটে সে বিমানের সিঁড়ি থেকে আবার নিচে নেমে আসে। দ্রুত পা ফেলে সোজা যায় এয়ারপোর্টের রিসেপশনে। সেখানে গিয়ে শান্ত কিন্তু দৃঢ়, কণ্ঠে হালকা তাড়া নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— কুড ইউ টেল মি হাউ মেনি ফ্লাইটস আর স্কেজুল্ড টু বাংলাদেশ টুডে?
রিসেপশনিস্ট এক ঝলক তার চেহারার দিকে তাকিয়ে বলে,
— লেট মি চেক দ্যাট ফর ইউ, ক্যাপ্টেন… দেয়ার’জ আ ফ্লাইট টু ঢাকা ডিপার্টিং ইন এবাউট থার্টি মিনিটস.
— “ফাইন। বুক মি আ সিট — বিজনেস ক্লাস.”
রিসেপশনিস্ট মাথা নেড়ে শান্তভাবে বলে,
— সার্টেনলি, ক্যাপ্টেন। আই’ল নিড ইয়োর পাসপোর্ট অ্যান্ড পাইলট আইডি, প্লিজ.
আদ্রিক কোনো কথা না বলে পাসপোর্ট আর পাইলট আইডি বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
— মেইক ইট কুইক!
রিসেপশনিস্ট সব ফর্মালিটিজ দ্রুত শেষ করে দিল। তারপর পাসপোর্ট আর বোর্ডিং পাস এগিয়ে দিল আদ্রিকের দিকে।
সেগুলো হাতে নিয়ে আদ্রিক হালকা হেসে নিজের মতো করে বিড়বিড় করে বলে,
— লিটলহার্ট আমি আসছি! বি রেডি রোজ!
আরভিদ রুমে ঢুকেই ড্রেস চেঞ্জ করে বেডে গা এলিয়ে দিলো। ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিলেও, কানে কোনো চেনা শব্দ আসছে না—মেহজার আসার শব্দ। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন সে আসে না, তখন একরকম অস্থিরতায় রুম ছেড়ে বের হয় আরভিদ।
নিচে নেমে লিভিং রুম, ডাইনিং, কিচেন—সব জায়গায় খুঁজে দেখে। কোথাও মেহজার দেখা নেই। অগত্যা আবার উপরে ফিরে আসে সে, তারপর একটা মেইডকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— মেহু ম্যামকে দেখেছো?
মেইড ভদ্রভাবে উত্তর দেয়,
— জ্বি স্যার, ম্যাম তো গেস্ট রুমে।
আরভিদ অবাক হয়ে বলে,
— গেস্ট রুমে? সেখানে কী করছে?
মেইড কিছুটা সংকোচ নিয়ে বলে,
— ম্যাম বলেছেন, উনি আজ থেকে গেস্ট রুমেই থাকবেন।
এই কথাটুকুই যথেষ্ট ছিলো বুঝে নেওয়ার জন্য—মেহজা এখনো কৌশলীর ব্যাপারটা নিয়ে রেগে আছে। তবুও আরভিদ নিচে যায় না, গেস্ট রুমের দিকে এক পা-ও বাড়ায় না। ফিরে আসে নিজের রুমে, বিছানায় শুয়ে পড়ে। কিন্তু একদম ভালো লাগছে না! বুকের ভেতরটা যেন শূন্য লাগছে। মেহজাকে ছাড়া ঘুম আসছে না। বিয়ের পর থেকে মেহজা তার বুকেই মাথা রেখে ঘুমাতো। সেটা আরভিদের জোরেই হতো।
মেহজার নরম শ্বাস, ওম— এসব তার অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে। যার কারণেই এখন মেহজার অনুপস্থিতিতে সে ঘুমাতে পারছে না। প্রায় বিশ মিনিট এপাশ-ওপাশ করেও আরভিদ চোখের পাতা এক করতে পারলো না। হঠাৎ উঠে পড়লো। কাভার্ড খুলে গেস্ট রুমের চাবিটা বের করে নিয়ে নেমে এলো নিচে। ধীরে ধীরে দরজার কাছে গিয়ে চাবি ঘুরিয়ে ভেতরে ঢোকে।
মেহজা বেডে ঘুমিয়ে আছে। মুখে শিশুসুলভ নিষ্পাপ ভাব। সে চেহারায় জমে আছে শত মায়া, আর তাতেই আরভিদের সব দুর্বলতা। আরভিদ মুচকি হেসে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে তাকে কোলের মাঝে তুলে নেয়। ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘুম ভেঙে যায় মেহজার।
— আপনি? আপনি ভেতরে এলেন কিভাবে?
— চাবি দিয়ে।
— নামান! আমি ঘুমাবো না আপনার সাথে। আমি এই রুমেই থাকবো!
আরভিদ কোনো কথা না বলে মেহজাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে।
মেহজা আরভিদের কোলে ছটফট করতে করতে বলে,
— থাকবো না আমি আপনার সাথে!
আরভিদ সামনে তাকিয়ে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,
— আমিও তোকে আনতে যেতাম না… কিন্তু একটা জিনিস ফিল করার পরই আনছি।
মেহজা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
— কি?
আরভিদ মুচকি হেসে মেহজার দিকে তাকিয়ে বলে,
— শূন্য বিছানার চেয়ে দুষ্ট বউ অনেক ভালো!
আরভিদ মেহজাকে নিয়ে রুমে ঢুকে বেডে শুইয়ে দেয়। দরজা বন্ধ করতে যাবে, তখনই মেহজা উঠে বসে মুখ ফুলিয়ে বলে,
— ঠিক আছে আমার একটা শর্ত আছে!
— বল?
— ৩৬৫ দিন আমার কথা শুনতে হবে!
আরভিদ হেঁসে কাছে এসে বলে,
— ঠিক আছে। আর তোকে ৩৬৫ রাতই আমার কথা শুনতে হবে!
মেহজা রাগে ফুসে উঠে বলে,
— একদম পিরিত দেখাবেন না! তখন যে সবাইকে দেখে শাড়ির আচল ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেটা কি ভুলে গেছেন?
আরভিদ বেডে বসে মেহজার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,
— বাড়ির সবার সামনে যদি আমি এমন আচল ধরে ঘুরতাম, তখন খুব এমব্যারাসিং লাগতো না?
মেহজা রাগে ভেংচি মেরে বলে,
— রুমে উনি ইমরান হাশমি, আর বাইরে গিয়ে হয়ে যান নানা পাটেকর!
আরভিদ মেহজার দিকে ঝুঁকে এসে চোখ ছোট করে বলে,
— এখন তুই কী চাস? পুরো দুনিয়ার মানুষকে ডেকে এনে, তাদের সামনে রোমান্স করি?
মেহজা মুখ ঘুরিয়ে বলে,
— জ্বি না! আমি কিছুই চাই না! আপনি সরেন, আমার কাছে থেকে!
আরভিদ এবার মেহজার শাড়ির আঁচল টেনে নিজের টি-শার্টে শক্ত করে গিঁট দেয়।
মেহজা চমকে বলে,
— কি করছেন কি আপনি?
— শাড়ির আঁচল ছেড়ে দেওয়াতেই তো রাগ! এবার নিজেকে আঁচলে বেঁধে দিলাম। যেখানে যাবি, তোকে আমায় বয়ে নিয়ে যেতে হবে!
— হয়েছে! এত ভালোবাসা দেখাতে হবে না!
আরভিদ হেসে মেহজাকে বেডে শুইয়ে নিজে তার উপর ভর দেয়।
— কেন? আমার ভালোবাসা তোর লাগবে না?
মেহজা ফটাফট বলে দেয়,
— না!
আরভিদ থমথমে গলায় বলে,
— ঠিক আছে।
তারপর ঠোঁটে ফট করে চুমু খেয়ে বলে,
— তাও আমি দিবো, জামেলা!
মেহজার ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে ওঠে।
আরভিদ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলে,
— তোর হাসিটা অনেক সুন্দর।
— হুহ্! পাম দিবেন না! আমি এতোটাও সুন্দর না!
আরভিদ মেহুর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
— “আমি জানি না তুই নিজেকে কতটা সুন্দর ভাবিস, আর তোর থেকেও সুন্দর কেউ আছে কিনা। কারণ, আমি তো তোকে ছাড়া কখনো কারও দিকে তাকাইনি! আমার চোখে সবচেয়ে সুন্দর আর প্রশান্তিকর দৃশ্য হচ্ছিস তুই, মেহু। তোর চেহারায় একটা মায়া আছে, যেটায় আমি বড্ড দুর্বল। আমার প্রেম, ভালোলাগা, অপেক্ষা— সবকিছুই তোকে ঘিরে। তোকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে আমার সমস্ত অনুভব। তোকেই দেখেছি, তোকেই মনে রেখেছি, আমি আমার জীবনটা তোকে ঘিরেই বুনেছি… শুধু তোর জন্যেই।”
মেহজা একদৃষ্টিতে আরভিদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে যেন ডুবে যায় সেই দৃষ্টিতে। ডুববেই না বা কেন? আরভিদের চোখে-মুখে আর কণ্ঠে এতটা নিখাদ আকুলতা—তার প্রতিটা শব্দ যেন হৃদয়ে গেঁথে বসে।
মেহজা কাঁপা কন্ঠে বলে,
মোহশৃঙ্খল পর্ব ৮
— “আমি বহু মানুষকে দেখেছি—বিশ্বাস ভেঙে ফেলে দিতে, অজুহাতে ছেড়ে দিতে। তাই ভয় পেতাম—বিয়েতে, কারো মাঝে আটকে পড়ায়, বিশ্বাসে। অবশ্য এখনো পাই, ভীষণ!”
একটু থেমে আবার বলে,
— কিন্তু আপনি সবসময় এমন থাকবেন তো? কখনো ছেড়ে যাবেন না তো?
আরভিদ মেহজার গালে হাত রেখে বলে,
— তুই হচ্ছিস আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসের কারণ। তোকে ছেড়ে আমি বাঁচবো কী করে? তোকে ছাড়া আমি যে শ্বাস নিতে পারি না, রেডলিপ!
