যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৪

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৪
মম সাহা

বাহিরের আবহাওয়া বোধহয় থম মেরে আছে। একটা ফোঁটাও বাতাস নেই চারপাশে। বাতাস থাকলে তুহিন নিশ্চয় অনবরত এমন ঘামতো না। অস্থির হতো না। বুকটা উত্তেজনায় এমন কাঁপছেই বা কেনো? এতো ভয়ঙ্কর শব্দে! মনে হচ্ছে সভ্যতার ট্রয় নগরী আবার নতুন করে তার বুকে ভেঙেচুরে পড়ছে।
নীরবতাে জাল তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে রুম জুড়ে। চিত্রার কথা বলতে অপরাধবোধ হচ্ছে। কোথাও না কোথাও নিজেকে এই সম্পর্কের খু নী মনে হচ্ছে। হয়তো তার জন্যই এমন হলো।
“ভাইজান, তুমি দশটা কলের একটা কলও ধরার সময় পাওনি? এতটা ব্যস্ত ছিলে? যদি ধরতে তাহলে নিরু আপু আজ তোমারই থাকতো।”

তুহিন তখনও মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে। কী বলবে, কী বলা উচিত তা-ই হয়তো ভেবে পাচ্ছে না।
চিত্রারও বলার ছিলো অনেককিছু। কিন্তু ভাইজানের এই স্তব্ধতা দেখে আর বলা হলো না। মনে মনে মায়া হলো ভাইজানের জন্য। কারণ ভাইজান সেই কাঁধটা হারিয়ে ফেলেছে যেই কাঁধ ভাইজানকে তুমুল ঝড়েও জায়গা দিয়েছিলো এক ফোঁটা নিদ্রা যাপনের জন্য। ভাইজান সেই বাগান হারিয়ে ফেলেছে, যেই বাগানে সব-কটি খাঁটি প্রেমের গোলাপ ফুটতো তার নামেই।
চিত্রা যেমন নীরবে এসেছিলো তেমন নীরবেই চলে গেলো। খুব ধীরে, স্থিরে। শব্দ করলো একটুও। তুহিন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না বোনের সামনে। যেই ধাক্কাটা খেয়েছে সেটার পর প্রতিক্রিয়া না দেখানোটাই বোধকরি স্বাভাবিক।
চিত্রা বেরিয়ে যেতেই সে দরজা আটকে দিলো। ঘরের আলো জ্বালিয়ে ঘুম হয় না। আর….
থাক। আর নাহয় লোকে না-ই জানলো। যেই প্রেমকে দিনে-দিনে দূরে ঠেলেছিল সেই প্রেমের বিদায়ে এখন আর প্রকাশ্যে কান্না করা উচিত নয়। লোকে হাসবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জীবন স্রোতেও ভেসে যায় বসন্তরা প্রেম ছাড়াই। শহরের গলির কোণে যেই প্রেম মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে সেই প্রেমের গল্পরা দমবন্ধ হয়েই মারা যায় পথিমধ্যে। অহির প্রেমের গল্পটাও কি এমন ছিলো না? যেই প্রেমের গল্প তার বুকের ভেতর সদ্য উজ্জীবিত বসন্ত হয়ে এসেছিলো সেই প্রেমের বীজই তো তাকে করে দিয়েছিলো আবেগশূন্য। একটি ছল, একটি মিথ্যে তার জীবন থেকে সমস্ত আকাঙ্ক্ষা ধুয়েমুছে ছাফ করে দিয়েছিলো।
সেই বহু পুরোনো রেস্টুরেন্টটায় বসে আছে অহি। যেই রেস্টুরেন্টে তার সাথে দেখা হয়েছিলো প্রেমের। দমকা বাতাসে যেই প্রেম আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিলো তাকে। এরপর…
অহি ভাবুক ভঙ্গিতে রেস্টুরেন্টটার চারপাশে চোখ বুলায়। যদি সেই পুরোনো মুখটির দেখা পাওয়া যায়! মনের কোণে লুকিয়ে থাকা আশাদের পরিপূর্ণতা মেলে না। পুরোনো মুখটিকে পাওয়া যায় না এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বদ্ধ জায়গাটাই। হয়তো পৃথিবী চায় না আর তাদের দেখা হোক!

অবনী বেগম মেয়ের চঞ্চল এই চোখ জোড়ার এই ব্যর্থ অভিযান ঠিক খেয়াল করেন। গরম ধোঁয়া উঠা কফিটায় চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞেস করেন, “কাউকে খুঁজছো?”
অহির দৃষ্টি থেমে যায়। ধরা পড়ে গেছে ভেবে জিভ কাটে মনে মনে। এরপর কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে তাকায় মায়ের পানে। মাথা দুই পাশে নাড়িয়ে বলল,
“না তো! কাকে খুঁজবো?”
“সে তো তুমি বলতে পারো কাকে খুঁজছো! আমি তো জিজ্ঞেস করলাম কেবল।”
অহি চুপ করে যায়। মায়ের সামনে মিথ্যে বলে লাভ নেই। ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এরচেয়ে চুপ থাকাটাই উত্তম সিদ্ধান্ত।

কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে দু’জনই উঠে দাঁড়ালো। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়েই করল রিকশার খোঁজ। তখনই পথের উল্টো দিকের একটি দৃশ্যে চোখ থেমে গেলো অহির। একজন মহিলা এবং একজন পুরুষ কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক করে চলছে অনবরত। তাদের দিকে উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে আছে চলন্ত পথিকেরা। রাস্তাঘাটে এমন নাটকীয়তা অহির বড়োই বিতৃষ্ণা লাগে। তাই বিরক্তি নিয়েই সেদিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো অহি কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো একটি চেনা মুখ ছিলো সেখানে। মনে হতেই সে তৎক্ষণাৎ সেখানে তাকালো। পুরোপুরি ভাবে ধ্যান দিলো মুখটায়। হ্যাঁ, মহিলা মুখটিকে সে চেনে। এই মুখটিই তো আজ থেকে অনেক গুলো দিন আগে তাকে জীবনের সবচেয়ে কঠিন কথাগুলো বলেছিলো। বলেছিলো, অহির মনে সৃষ্টি হওয়া মানবের আসল পরিচয়ের কথা। নওশাদের স্ত্রী না উনি? হ্যাঁ, অহি ঠিক ধরেছে। সেই ভদ্রমহিলাই! কিন্তু এমন পথিমধ্যে কেনো সে অভদ্রের মতন তর্কবিতর্ক করছে! তাই এমন রাস্তায়?

অবনী বেগমকে দাঁড়াতে বলেই অহি রাস্তার অপর পাশে ছুটে গেলো। ততক্ষণে ভদ্রমহিলা উঠে পড়েছে একটি নামীদামী গাড়িতে। তার হাতের ফোনটা গড়াগড়ি খাচ্ছে রাস্তায়। অহি ডাকার আগেই গাড়িতে তীব্র গতিতে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। হতাশ হয়ে অহি অপরিচিত ভদ্রলোকের দিকে তাকালো। ভদ্রলোকের চোখে-মুখে তীব্র রাগ তখনও সুস্পষ্ট। অহির মনেও তুমুল আগ্রহ। পরস্ত্রী’র সাথে এমন আচরণ করেছেনই-বা কেন ভদ্রলোক তা জানার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল।
অহিকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটাই রাশভারি স্বরে বললেন, “নাটক তো শেষ। আপনি এখনো দাঁড়িয়ে কী দেখছেন?”
একটু ধমকের স্বরেই বলল। অহির এতে কিঞ্চিৎ রাগ হলেও সে পাত্তা দিলো না। মনের ভেতর জন্মানো আগ্রহ দমিয়ে না রেখেই বলল,

“এই ভদ্রমহিলার সাথে আপনি চেঁচামেচি করলেন কেন?”
অহির প্রশ্নে বোধহয় ভারী অবাক হলেন সামনের লোকটি। পথে নাটক হলে পথচারীরা বড়োজোর নাটক দেখে। কখনো এভাবে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে আসে না! অথচ এই মেয়েটা কি-না সেধে সেধে জিজ্ঞেস করছে!
ভদ্রলোক চটে গেলেন আরও, “অদ্ভুত! এতক্ষণ নাটক দেখে পোষেনি যে এখন আবার নাটকের কারণ জিজ্ঞেস করতে চলে এলেন!”
ভদ্রলোকের রাগী কণ্ঠে এবার অহিও কিঞ্চিৎ রাগলো। কেউ অন্যের রাগ তার উপর ঢাললে তার প্রচন্ড বিরক্ত লাগে। অহিও এবার কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলল, “আপনারা রাস্তায় নাটক করতে পারলে মানুষ জিজ্ঞেসও করতে পারবে। আর তাছাড়া এই ভদ্রমহিলাকে আমই বোধহয় চিনি। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করতে এলাম।”
এতক্ষণ লেগে থাকা লোকটা এবার কিছুটা অবাক হলেন, “আপনি রেণুকাকে চেনেন?”
অহি যদিও ভদ্রমহিলার নাম জানতো না। তবে বুঝতে পারলো রেণুকা বলতে লোকটা মহিলাকেই বুঝিয়েছেন তাই সে সম্মতি দিল,

“হ্যাঁ। উনার একটা মেয়ে আছে না? হুমু নাম?”
ভদ্রলোকের কুঁচকানো ভ্রু শিথিল হয়ে গেলো। অহি যে সত্যিই রেণুকাকে চেনে তা আর বলার অপেক্ষা রাখলো না।
তাই উনি জিজ্ঞেস করলেন,
“হ্যাঁ। কিন্তু সে তো বহু আগের কথা!”
এবার অহি চমকালো, “বহু আগের কথা মানে?”
“বহু আগের কথা মানে হলো, হুমু ওর আগের সংসারের মেয়ে। আপনি রেণুকাকে কীভাবে চেনেন? কবে থেকে? অনেক আগের পরিচিত কি?”
অহি যদিও কিছু বুঝতে পারল না। ‘আগের সংসারের মেয়ে’ কথাটা বার বার কানের কাছে পোঁকার মতন বিলবিল করছিলো। সে অস্ফুটস্বরে বলল,
“আপনার সাথে উনার বিয়ে হয়েছে?”

ভদ্রলোক অবলীলায় বলল, “হ্যাঁ। সে তো ওর স্বামী মারা যাওয়ার পরপরই!”
অহির পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরিয়ে গেলো। স্বামী মারা গিয়েছে মানে? তার মানে নওশাদ…
অহি আর ভাবতে পারলো না। তার দুনিয়া যেন অন্ধকার হয়ে এলো। লোকটা তার সাথে মিথ্যে বলেছে তাই তার অভিমান ছিলো কখনো আর মুখদর্শন করবে না ভেবেছিলো। কিন্তু তাই বলে কখনো সে ভাবেনি মানুষটার সাথে আর দেখা হবে না!
অহিকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোকই বললেন, ‘কী হয়েছে আপনার? আপনি কি আমাদের বিয়ের কথাটা জানতেন না?”
অহি সাথে সাথে মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ, জানতো না। তারপর বহু সাহস সঞ্চয় করে বলল, “নওশাদ তাহলে বেঁচে নেই?”
অহির প্রশ্নে ভদ্রলোক ভ্রু কুঁচকালো, “নওশাদ মরবে কেনো? আমি বলেছি রেণুকার স্বামী মারা গিয়েছে যখন।”
“নওশাদই তো উনার স্বামী।”

“আপনি কি সত্যিই রেণুকাকে চেনেন? নওশাদ ওর স্বামী হতে যাবে কেনো? নওশাদ রেণুকার দেবর ছিলো। হুমুর বাবা তো ছিলো হাসিব শেখ! নওশাদ তো হাসিব শেখের ভাই। হাসিব মারা যাওয়ার কয়েকদিন পরই রেণুকার সাথে আমার বিয়ে হয়।”
অহি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখেমুখে তীব্র অবিশ্বাস। দীর্ঘ এতগুলো বছর যাবত সে একটা ভুলের উপর দাঁড়িয়ে ছিলো ভাবতেই তার পায়ের নিচের জমিন যেন কেঁপে উঠল। একপাক্ষিক কথা শুনে সে যেই তীব্র ভুলটা করেছে তার জন্য নিজের মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করল। ততক্ষণে অবনী বেগমও চলে এসেছেন মেয়ের কাছে। মেয়েকে এমন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন কী হয়েছে অথচ অহি তখন কথা বলার অবস্থানে নেই। কেবল নিজের করা ভুলের জন্য অনুশোচনায় জ্বলে যাচ্ছিলো। নিজের আড়াইটা বছর নষ্ট করেছে ভেবেই নিজেকে চ ড় দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।

কফিশপে বন্ধুদের আড্ডা চলছে। গানে গানে মুখরিত কফিশপ। সবাই-ই আনন্দ নিয়ে সেদিকটায় তাকিয়ে আছে। নিরুও বেশ হাসি হাসি মুখে দেখছে গানের দলটাকে। কখনো কখনো নিজেও সুর মেলাচ্ছে। তুহিন এই চঞ্চল, হাসিখুশি নিরুটার দিকে তাকিয়ে রইলো। পারদে পারদে তার বিস্ময় ছুঁয়ে গেলো যেন আকাশ। লই কোন নিরু? প্রেম বিচ্ছেদে যেই নিরুর চোখের নিচ বিমর্ষ, ক্লান্ত হয়ে যায়নি সেই নিরুকে কি সে চিনতো?
বিয়ের পর ঝলমল করছে নিরু নিজের নাকের নাকফুলটার মতন। তুহিনকে ছেড়ে এতটাই সুখী হয়েছে সে?
তুহিন কথা বলল, “তুমি সুখে আছো, নিরু?”
নিরু তখনও গানের তালে তালে পা নাড়াচ্ছে। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“সুখে থাকারই তো কথা!”

তুহিন এবার নির্লজ্জের মতন একটি প্রশ্ন করে বসলো, “আমাকে ছেড়ে তোমার তো সুখী হওয়ার কথা নয়!”
প্রশ্নটি করে নিজেই দমে গেলো। ভীষণ স্বার্থপরের মতন প্রশ্ন হয়ে গিয়েছে বোধহয়। নিরুর সুখ দেখে তার এমন স্বার্থপরতা কি মানায়? কই, নিরু তো তাকে সুখী দেখে কখনো এমন প্রশ্ন করেনি!
নিরুর পা থেমে গেলো। হাসি হাসি মুখটা তখনও বিদ্যমান। বেশ জোরে একটা শ্বাস ফেলল। তুহিনের দিকে তাকিয়ে তার মনে মনে মায়াও হলো। বলল,
“কিছু কিছু মানুষ খুব অদ্ভুত হয় জানো? যারা বিশ্বাসঘাতকতা করতে জানে না, স্বার্থপর হতে জানে না, কাউকে এমন কিছু বলতে জানে না যেটা কষ্ট দেয়। কেনো জানো? কারণ তারা কখনো না কখনো কারো বিশ্বাসঘাতকতায় ভেঙে চুরমার হয়েছিল, কারো স্বার্থপরতায় পাগলের মতন কেঁদেছিলো, কারো কথার আঘাতে চির জীবন বুকের ভেতর ক্ষত নিয়ে ঘুরে ছিলো। তাই তারা জানে এসব জিনিসের যন্ত্রণা কতটা দুঃসহ। এবং জানে বলেই তারা অন্যকে সেই নরক যন্ত্রণা দিতে পারে না। হাজার দুঃখ পেলেও কঠিন স্বরে বলতে পারে না— তুমি বিষের চেয়েও বিষাক্ত। তারা চুপ করে থাকে। একদিন, দু’দিন, তিনদিন…. চুপ করে থাকতে থাকতে তাদের একসময় যখন মনে হয় আর সহ্য করা যাচ্ছে না তখন তারা সরে যায়। এবং এতটা দূরেই সরে যতটা দূর গেলে আর তাদের চাইলেও ফিরে পাওয়া সম্ভব না। আসলে একটা সম্পর্কে আমাদের ভুল কী হয় জানো? কাউকে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড ভেবে নেওয়াই।

ভেবে নিই যতই ঝামেলা হোক সে ফিরে আসবে, সে কাঁদবে, সম্পর্কটা আগলে রাখবে। কিন্তু আমরা এটাই ভুলে যাই, যে মানুষটা কিছু হারানোর ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকে সেই মানুষটা যখন সেই হারানোর ভয়টাকেই হারিয়ে ফেলে তখন আর তারা কোনো বাঁধনেই আটকে থাকে না। তারা হারানোর ভয়টাকে এতটা দূর্দান্ত ভাবেই জয় করে নেয় যে আর কোনো পিছুটান তাদের বাঁধা হয় না।
আর তারা কাঁদে না। আর বেহায়ার মতন বলে না, সব ঠিক করে নাও। কারণ তাদের ভেতর থেকে সেই আগ্রহটাই দ্বিতীয় পক্ষ শেষ করে দেয়। আমাদের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে, তুহিন।

তুমি আমার ভালোবাসাটাকে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড ভেবে নিয়েছিলে। সবসময় আমার ভুল হোক কিংবা না হোক, বেহায়ার মতন এসে সবটা ঠিক করে নিয়েছিলাম বলে তুমি ভেবেই নিয়ে ছিলে নিরু তোমায় ছাড়বে না। তুমি সে যা-ই করো না কেন। অথচ তুমি জানোই না, যারা বারে বারে সব জোরা লাগায় তারা যখন কোনো কিছু ছিন্ন করে তখন এমন ভাবেই ছিঁড়ে যেন আর জোরা না লাগে। তুমি আমাদের সম্পর্কে ছোটো ছোটো অনেক ক্ষতই করেছিলে। আমি সেখানে রঙ বেরঙের অনেক জোড়াতালি দিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম সব ঠিক হবে। কিন্তু হয়নি। প্রতিবার এতটা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে যে এবার আমি পুরোটাই ছিঁড়ে ফেলছি এমন ভাবে যেন আর জোরা দেওয়া না যায়। আমার আজ আর কিছু হারানোর ভয় নেই। আমি সেই ভয়কে জয় করে নিয়েছি। যেই ভয়ে এতদিন তোমায় আঁকড়ে ধরতাম শত অবজ্ঞার পরেও, আজ আমার সেই ভয় নেই। তুহিন, তুমি মুক্ত। তোমাকে হারানোর ভয়ে আর কেউ কাঁদবে না।”
তুহিন তাকিয়ে থাকলো নিরুর দিকে নির্নিমেষ। শান্ত স্বরে এত গুলো কঠিন কথা মেয়েটা অনায়াসে বলে দিলো। এতটাই অনায়াসে যে তার একবার চোখের পলকও পড়লো না। অথচ এদিকে, তুহিনের চোখ থেকে অজান্তেই অশ্রুরা গড়িয়ে পড়লো। আজ তা দেখে বিচলিত হলো না নিরু। বরং ঠাঁই বসে থেকে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলো। দম ছেড়ে আবার বলল,

“তুমি আমায় ভালোবাসছো না, সময় দিচ্ছো না, আগের মতন খবর রাখছো না…
সময় দাও, একটু কথা বলো, একটু যত্ন করো প্লিজ…
প্রথম কথাগুলো অভিযোগ, এরপরের গুলো ভিক্ষে চাওয়া।
যখন সম্পর্কে অভিমান, অভিযোগ ছাপিয়ে ভিক্ষেতে চলে আসে তখন এই সম্পর্কে আর টান থাকে না। থাকে কেবল এক পক্ষের অসীম মায়াটুকু। যে মায়ার জের ধরে একজন পা অব্দি ধরতে পারে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে, আর আরেকজন সেই পা ধরার পেছনের নীরব অসহায়ত্বটুকু বুঝতেই পারে না। এরপর এই সম্পর্কটা শেষ হয় ভিক্ষে চাওয়া মানুষটার হাতেই। ভিক্ষে চাইতে চাইতে একসময় যখন সে মানুষটা বলে দেয়—
“অনেক হলো, আর কত ? আর কত ভিক্ষে চাইবো! থাক না, ছেড়ে দিলাম ভিক্ষের দাবী।”
এরপরই না সবটা শেষ হয়ে যায়, জানো? ভিক্ষে করা মানুষটা এটা মেনে নেয় যে, ভিক্ষের দানে ভালোবাসা থাকে না।

আমি এটা মেনে নিতে পেরেছি। আর তাই তো সরে গিয়েছি। যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে থেকে আর কী লাভ, তুহিন? তাই চলেই গেলাম!”
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়ালো নিরু। তুহিনের কত কিছুই বলার ছিলো তবে বলা হলো না আর। কেবল বলল,
“তুমি সুখী হও। তোমার স্বামী যেন তোমাকে, তোমার মতন ভালোবাসে।”
নিরু এই শুভেচ্ছায় মাথা নাড়ালো। রেস্টুরেন্টের কাঁচের বাহিরে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলল,
“তোমার দোয়া কবুল হয়ে গেছে, তুহিন। এই দেখো বাহিরটায়, ঐ কালো শার্ট পরা লোকটা আমার স্বামী। এই রোদেও সে দাঁড়িয়ে আছে আমার অপেক্ষায়। যেখানে সে জানে আমি আমার প্রাক্তনের সাথে দেখা করতে আসছি সেখানে সে আমাকে যত্ন সহকারে নিয়ে এসেছে। এত যত্ন করে আমার! মাঝে মাঝে ভাবি জানো? কখনো কখনো আমাদের যারা ছেড়ে যায় তাদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কারণ তারা ছেড়ে না গেলে আমরা কি জানতাম, পৃথিবীতে আমাদেরকেও অবজ্ঞা করার পর কেউ কেউ ভালোবাসার জন্য থেকে যায়!”

তুহিন ঘোলাটে চোখে সত্যিই দেখলো একটা লোক কালো শার্ট পরনে। পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। নিরু যেতেই লোকটা হাতের ছাতাটা নিরুর মাথার উপর মেলে ধরল। ব্যস্ত হাতে রুমাল বের করে মুছিয়ে দিলো নিরুর মুখটা। নিরুরও তবে সত্যি সত্যি ভালোবাসার মানুষ হলো?
তুহিন হাসলো।
গানের আড্ডায় তখন সমস্বরে গান বাজছে,

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৩

“আমি আবার ক্লান্ত পথচারী
এই কাঁটার মুকুট লাগে ভারী,
গেছে জীবন দুদিকে দু’জনারই
মেনে নিলেও কি মেনে নিতে পারি?
ছুঁতে গিয়েও যেন হাতের নাগালে না পাই ..
এভাবে হেরে যাই, যেই ঘুরে তাকাই
কেমন যেন আলাদা আলাদা সব,
আলগা থেকে তাই, খসে পড়েছি প্রায়
কেমন যেন আলাদা আলাদা সব…..”

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৫