যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৪
মম সাহা
রাত্তিরের বুকে এক খণ্ড বেনামি বাতাস ছুঁয়ে দেয় দেহের কোমলতা। দূর-দূরান্তের বিল্ডিং গুলো থেকে ভেসে আছে আলোর ছটাক। সওদাগর বাড়ির হাসির রবও পাওয়া যায় কান পেতে শুনলে। চারপাশে এই বাহ্যিক শব্দের আনাগোনায় ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে দু’টো মানুষ। একদম নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ।
চিত্রার এই নিশ্চুপতা সয় না। বুকের ভিতর ভয়ের যেই দাবানল ফুটছে তা বুকের ভেতর আটকে রাখা বড়ো অসুবিধার হয়ে উঠেছে বিধায় সে বাহার ভাইয়ের উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“বললেন না যে, বন্দুক আপনার কাছে কেন? কী কাজ আপনার সেটা দিয়ে?”
বাহার ভাই চিত্রার দিকে তাকিয়ে ছিলেন এতক্ষন যাবত। চোখের মণি গুলো কেবল ঘুরছে কিন্তু পলক পড়ছে না মোটেও।
উত্তরের আশায় মানুষটার মুখের দিকে চিত্রা তাকিয়ে থাকে। ঘড়ির কাটায় মিনিট বোধহয় তুই পেরিয়ে যায় এই নীরবতায়। অতঃপর মানুষটা বলেন,
“কাজ কিছু একটা আছে বৈকি।”
“কী কাজ সেটা?”
“কী কাজ সেটা কাজ হলেই জানতে পারবে নিশ্চয়।”
চিত্রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ছুটে চলা বাতাসের সাথে সেই দীর্ঘশ্বাস মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কিছুটা ক্ষণ মৌন থেকে এরপর ক্লান্তিতে নুইয়ে আসা কণ্ঠে মেয়েটা বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“মনে আছে এমন একটা সন্ধ্যার সমাপ্তি ক্ষণ ছিলো। আমাকে রিকশা করে কাজি অফিস পাঠিয়ে ছিলেন আপনি। আমি তীব্র অপেক্ষায় বসে বসে প্রহর গুনছিলাম অথচ আপনি আসেননি। আমার অপেক্ষার গন্তব্য অনির্দিষ্ট রেখে আপনি আসেননি। আমি কেবল অপেক্ষা করে গেছি। ভেবেই গেছি আপনি আসবেন। আর যাই হোক আমার বাহার ভাই আমাকে ধোকা দিবেন না। অথচ আমি ভুল ছিলাম। আমার বাহার ভাই আমাকে দেওয়া কথা রাখেননি। সারাটা সন্ধ্যা আমি ঠাঁই বসেই ছিলাম। পথের ধূলো এলো, বেনামি কাক এলো, আমার খুলে রাখা জানালায় শরৎ এর মেঘ উড়ে এলো কিন্তু আপনি আসেননি। আমার অপরাধ কী ছিলো? কিছুই না। আপনি আসতে পারেননি সেটায় আপনার হয়তো কোনো বাধ্যবাধকতা ছিলো আমি জানি কিন্তু অপারগতাও তো কম ছিলো না। আপনি জানতেন আপনি আসতে পারবেন না, এটা আপনার কথাবার্তায় বুঝিয়ে ছিলেন কয়েক বার। তাহলে কেন আশা জাগিয়েছিলেন মনে? আড়াইটা বছর কম সময় ছিলো না। আপনি এলেন যা-ও, আবার নতুন করে আমার অভিমানের দেয়াল ভাঙলেন কিন্তু আবার কী করতে চাচ্ছেন আপনি? আবার, আবার আমাকে ঠকানোর পাঁয়তারা? আবার আমাকে অপেক্ষায় রেখে পালাবেন তাই না?”
চিত্রার চোখে আজ অশ্রু নেই কেবল আছে এক বুক হতাশা, যন্ত্রণা। বার বার কেন তারই প্রেম হারিয়ে যাবে? বার বার সে-ই কেন ভুগবে দহনে? এ কেমন তার প্রেম? এ কেমন তার প্রেমিক?
বাহার ভাই আরও দু’কদম এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন চিত্রার কাছটায়। একদম কাছাকাছি। দু’জনের শ্বাস-প্রশ্বাস দু’জনের দেহ ছুঁয়ে যাচ্ছে। অতঃপর হাত রাখলেন চিত্রার মাথায়। মায়ের কোলের অবুঝ শিশুটিকে যেমন আহ্লাদ করেন মা ঠিক তেমন করে বার কয়েক তিনিও চিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। নিবিড় স্বরে বললেন,
“শান্ত হও, রঙ্গনা।”
চিত্রার এবার সত্যি সত্যি কান্না পেলো। যতই কঠিন থাকার চেষ্টা করুক, যতই ভাবুক আর কাঁদবে না কিন্তু শেষমেশ তা আর হয় কোথায়? মানুষটা এমন করে আহ্লাদ করে দু’টো কথা বললেই যে সব অভিমান ভেঙে যায়। কেটে যায় সব রাগ। ভালোবাসার কাছে কঠিন হতে পারে না যে অভিযোগ। কী করবে সে?
বাহার ভাই হাতের তালু দিয়ে মুছে দিলেন চিত্রার সদ্য গাল গড়িয়ে যাওয়া অশ্রুদের। কী সুন্দর স্নেহময় স্বরে বললেন,
“এই মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় যাবো আমি? কিছু হতে না হতেই কেঁদে ভাসিয়ে দেয় মেয়েটা! এই মেয়ে, তুমি এত কাঁদো কেন হ্যাঁ? জানো না, অভিমান আর প্রেমে কাঁদতে নেই!”
চিত্রা এবার নিঃসংকোচে জড়িয়ে ধরে মানুষটাকে। এতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে যেন মিশে যাবে এখুনি মানুষটার শরীরের সাথে। কোনো ভাবেই যেন আর যেতে দিবে না।
মুচকি হেসে উষ্ণ আলিঙ্গনটাকে সাদরেই গ্রহণ করেন বাহার ভাই। মাথায় হাত বুলানো জারি রেখেই ফিসফিস করে বললেন,
“চিন্তা নেই, মেয়ে। পালাবো না তোমায় একা করে।”
“কিন্তু আমার বুকে যে বড়ো ভয় হচ্ছে। আপনি কিছু ভুল করবেন না তো?”
“ভুল করবো না ঠিক আমার জানা নেই। কেবল এতটুকু জানি, এবার যেখানেই যাবো তোমায় নিয়ে যাবো, রঙ্গনা। তোমায় ছাড়া আমার একেকটি যুগ যেন হাজার বছরের সমান। তুমি কেবল পাশে থেকো। থাকবে তো?”
চিত্রা ঘোরে ডুবে গেলো। কোঁকড়া চুলের মানুষটার বুকে মুখ গুঁজে অস্ফুট উত্তর দিলো,
“থাকবো। মরতে বললে একসাথে মরবো।”
“মরবো কেন, মেয়ে? আমাদের তো সংসার করা বাকি।”
চিত্রা বুকে মুখ গুঁজে রেখেই হাসলো। মাথা নাড়িয়ে কেবল সম্মতিটুকু দিলো।
অনুষ্ঠান বাড়িতে তখনও মোটামুটি সজাগ অনেকেই। আবার ঘুমিয়ে গিয়েছে কেউ কেউ। রান্নাঘরে খুটখাট যেন স্থায়ী ভাবেই চলছে। এই কেউ চা খাচ্ছে তো এই খাচ্ছে কফি। কেউ বা রাত বিরেতে বিরিয়ানিটা গরম করে নিয়ে টিভির সামনে বসছে। সবকিছুই নিয়ম ভেঙে মত্ত কেবল আনন্দে।
তুহিনের ঘরের আলোটুকু নেভানো। ল্যাপটপ স্ক্রিনের আলোটাই কেবল এসে পড়ছে মুখে। অন্ধকার ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকারও বলা যায় না। বাহিরের রঙ বেরঙের জ্বলতে থাকা ছোটো লাইট গুলোর আলোর এক অংশ এসে তার ঘরের ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
ঠিক তখনই দরজায় টোকার শব্দ হলে। কেউ একজন আসার অনুমতি চাচ্ছে। তুহিন মনযোগ স্থির রেখেই অনুমতি দিলো আসার।
এক মগ গরম কফি নিয়ে ছেলের ঘরে ঢুকলেন মুনিয়া বেগম। তুহিন সেদিকে তেমন খেয়ালও করেনি। একবার দেখেওনি কে এসেছে। তবুও খুব করে বুঝতে পারলো মা এসেছে। এবং মুখ না তুলেই বলল,
“ঘুমাওনি, আম্মু? তোমার প্রেশার বাড়বে যে!”
মুনিয়া বেগম এসে বসলেন ছেলের পাশে। কফির মগটা ছেলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“নে কফিটা। তুইও তো ঘুমাসনি! রাত যে অনেক হলো। ঘুমিয়ে পর।”
“অফিসের অনেকগুলো কাজ জমে গিয়েছে, আম্মু। এগুলো একটু একটু করে শেষ করি। এরপর নাহয় ঘুমাবো?”
মুনিয়া বেগম শান্ত চোখে পরখ করলেন নিজের ছেলেটাকে। নীল স্ক্রিনের আলোটুকুতে বুঝা গেলো তুহিনের চোখের নিচের কালো দাগ গুলো। শুকিয়ে যাওয়া মুখটির অসহায়ত্ব গুলো। কিছুটা রয়েসয়ে তিনি ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
“আমি ভাবছিলাম একটা বউ যদি ঘরে আনা যায় কেমন হয়?”
কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়েও থামলো তুহিন। মায়ের কথায় এক পলক তাকালো মায়ের দিকে। এরপর আবার কফির কাপটি তুলে নিলো মুখে। এক চুমুক কফি পান করল। কিছু হয়নি এমন ভাব করে বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল,
“চিত্রা, চাঁদনী আপা এখনো বিয়ে করেনি, আম্মু। বোনদের কথা তো আগে ভাবতে হবে তাই না?”
“তোর বড়ো আম্মু বলল চাঁদ দেশে আসতে চাচ্ছে না। পাহাড় ভ্রমণের উদ্দেশ্যে নাকি যেতে চায়। ওর বিয়ের কোনো পরিকল্পনাই নেই আর। এদিকে চিত্রার কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“কী করবে মানে? তোমাদের কি এখনো বুঝাতে হবে মেয়েটা কী চায়?”
মুনিয়া বেগম বেশ জোরে শ্বাস ফেললেন। চিন্তা দেখা দিলো মুখে। তুহিন কফির কাপটা কিনারায় রেখে মায়ের বাহুতে হাত রাখলো। আশ্বস্ত করে বলল,
“চিতাবাঘ বাহার ভাইকে ভালোবাসে, আম্মু। এতটুকু তুমি কিংবা তোমরা বুঝতে পারো তা আর বলার অবকাশ রাখে না। মেয়েটা তো কম কষ্ট পেলো না বাহার ভাইরা চলে যাওয়াতে? এবার যেহেতু ফিরে এসেছেন বিয়ের কাজটা ধরেই ফেলো।”
“কিন্তু এবার বাহারের পরিবারের কেউই তো ফিরেনি। আর শুনেছি ওদের বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দিবে না যেন দিয়েওছে। কী ভরসায় বিয়ের কথা বলবো? কী বলবো বল তো?”
“বিক্রি করেছেন হয়তো অন্য কোথাও জায়গা নিয়েছেন। বনফুলের কী অবস্থা হয়েছিল তা তো জানোই, আম্মু। হয়তো সেজন্য উনারা এখানটাতে থাকেন না।”
“সে তো জানি। কী জানি মেয়েটার কী অবস্থা!” আচমকা কথাটা বলেই থেমে গেলেন মুনিয়া বেগম। তুহিনের মুখে কেমন ছেয়ে আছে অন্ধকার। প্রসঙ্গ ঘুরাতেই তিনি বললেন,
“সে যাই হোক। আমি তোর বাবাকে বলে দেখি চিত্রা আর বাহারের বিয়ের কথা। ছেলেটা কিন্তু যথেষ্ট ভালো।”
“ভালো না ছাঁই।”
দরজায় দাঁড়িয়েই হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন নুরুল ইসলাম। চমকে গেলেন মুনিয়া বেগমসহ তুহিনও। কিছুটা অবাকও হলেন দু’জনে। তুহিন বিরক্ত ও অবাক উভয় অনুভূতি নিয়ে শুধালো,
“বাহার ভাইকে আপনি কোনো কালেই পছন্দ করতে না, আব্বু। এ আর নতুন কী!”
নুরুল ইসলাম এগিয়ে এলেন ক্রুদ্ধ হয়ে। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,
“এ ছেলের গত আড়াই বছরের হিস্টোরি জানলে মাথা ঘুরে উঠবে তোমাদের।”
বাবার এই অকারণ কথাগুলো বরাবরই তুহিনের অপছন্দ। তবুও মুখ কালো করে বলল,
যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৩
“কী হিস্টোরি? কী করেছেন, বাহার ভাই?”
নুরুল ইসলাম তাচ্ছিল্য করে বললেন, “জেল খেটেছে। জেল। বুঝতে পেরেছো?”
বাক্যটি যেন বজ্রপাতের ন্যায় শোনালো। চমকে উঠলো তুহিন। মুনিয়া বেগম তো প্রায় মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েই গেলেন। মনে হলো নুরুল ইসলাম ভীষণ বাজে একটা জোক্স মেরেছেন। কিংবা বলা যায় অনাকাঙ্খিত বো মা বি স্ফর ণ ঘটিয়েছেন।