যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৩৯
মম সাহা
অবনী বেগম সবটা কাজ শেষ করে মাত্রই ঘরে এসেছেন। ঘামে কিছুটা পিঠ ভিজে গিয়েছে। বাড়ির কাজ তিন জা হাতে হাতে করেন। তবে রাতের কাজটা বেশিরভাগ সময় অবনী বেগম ইচ্ছেকৃত নিজের দিকে টেনে নেয়।
কেন টেন নেয়? কারণটা কেউ না জানলেও অবনী বেগম জানেন। আমজাদ সওদাগরের সাথে তার সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রীর নৈকট্যটা নেই। ঘরে এসে এক বিছানায় দু’জন দু’দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে থাকেন। একটা ঘর, একই বিছানা, একটি এত বছরের সংসার অথচ দু’জনের দূরত্ব যোজন-যোজন দূরের। খারাপ লাগতো এই জিনিসগুলো তার। তাই এরপর থেকে তিনি ঠিক করলেন যতটা দূরে থাকবেন ততটাই মানসিক স্বস্তি।
অন্তত এটা ভেবে খারাপ লাগবে না যে, আমজাদ সওদাগর তার উপস্থিতিতে বিরক্ত হচ্ছেন। সত্যি বলতে কারো বিরক্তের কারণ হতে তিনি চান না।
ঘরের আলো জালানো। বারান্দার জানালাটা খোলা। হয়তো আমজাদ সওদাগর বারান্দায়। অবনী বেগম একটু আরাম করে বসলেন বিছানায়। সচারাচর এমন আরাম করে বসা হয় না বিছানায়। মনে হয় পরের ঘর, পরের বিছানা। এত বছর বাস করেও সবটা পরেরই রয়ে গেলো।
হুট করে দমকা বাতাস নিজের পিঠে অনুভব করতেই অবনী বেগম চমকে উঠলেন। বাতাসের সাথে পাওয়া গেলো একটি মৃদু যান্ত্রিক শব্দ। প্রথম অবস্থাতে তিনি ফিরে তাকাতে চাইলেও পরে আর ফিরলেন না। হাসলেন কেবল।
আমজাদ সওদাগর ততক্ষণে স্ত্রীর সামনের টেবিলের সাথে থাকা চেয়ারটায় বসলেন। মাঝে মাঝেই তিনি রাত জেগে বই পড়েন। আজও হয়তো পড়বেন। এ বাড়ির মানুষগুলো একটু শৌখিন ধাঁচেরই বলা চলে। প্রায় সব ক’টা মানুষ হয় গান করে, নয়তো বাগান করে, নয়তো বই পড়েন। আমজাদ সওদাগরের মতন সবকিছু মন্থর গতিতে গ্রহণ করা মানুষও সেই শৌখিনতার দলেই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
গায়ের ঘামটা শুকিয়ে এসেছে প্রায়। হাত-পা ঝাড়া দিয়ে অবনী বেগম ঘুমের প্রস্তুতির জন্য নড়তেই আমজাদ সওদাগর নিজের সামনের বন্ধ বইটার দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বললেন,
“হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় পাল্টে নিলে ঘুমটা বোধহয় ভালো হতো, অবনী।”
স্বামীর কথায় অবনীর ঠোঁটের একপেশে হাসিটা আরেকটু দীর্ঘ হলো বোধহয়। একদম হেলায় উত্তর দিলেন,
“আজ বহু বছর ধরে এমন করেই তো ঘুমোচ্ছি, আমজাদ! কখনো অসুবিধে হয়নি আমার। আজ নতুন করে কি খেয়াল হলো তোমার?”
আমজাদ সওদাগর স্ত্রীর মুখটির দিকে তাকালেন। তাকিয়ে রইলেন কিছুটা ক্ষণ। হয়তো কিছু বলতে চান কিন্তু অজুহাত কিংবা সংশয়ের চাদর গুটিয়ে ফেলছে তাকে।
ততক্ষণে অবনী বেগম শুয়ে পড়েছেন।
“তুমি আজকাল আমার কথাগুলো সহজ ভাবে নিতে পারছ না, অবনী।”
অবনী বেগমের বড্ড হাসি পেলো এমন কথাখানা শুনে। বিয়ের এত বছর পর এসে আমজাদ সওদাগরের কথা বলার ইচ্ছে হলো। কিন্তু বিপরীত পক্ষের ইচ্ছেকে ততদিনে যে তিনি গলাটিপে মেরে ফেলেছেন সে খেয়াল কি আছে ভদ্রলোকের?
নেই বোধহয়। মূলত যারা অপরকে ক্ষত-বিক্ষত করতে জানে তারা কখনোই বুঝে না সেই ক্ষতটার গভীরতা কত। বুঝে না বলেই তো ক্ষতের জ্বালা-ই কেবল বাড়িয়ে যায়।
“তোমার কথা কখনো কি সহজ ছিলো?”
“ছিলো না?”
“ছিলো বলে তো মনে পড়ছে না, আমজাদ।”
“আমি কি এতই জটিল কথা বলেছি তোমাকে, অবনী?”
“সেসব প্রশ্ন থাকুক, আমজাদ। জীবন কেটে গেলো অনেক বছর তো হলো প্রায়! যদি এই কথাগুলো প্রথম প্রথম সংসার শুরু হওয়ার সময়কার হতো তাহলে না-হয় মানা যেতো। কারণ তখন সরল-জটিলের হিসেবনিকেশ করলে হয়তো আজকের দিনটি অন্যরকম হতে পারতো। কিন্তু আজকে এসব হিসেব নেহাৎই যে সময় অপচয় এবং অতিরঞ্জিত বিষয়। সবটাই যে শেষ!”
অবনী বেগমের কথা থামতেই শরৎ এর বাতাসের মতন ঘর জুড়ে ঝুপ করে নেমে এলো এক রাশ নীরবতা। যেই নীরবতায় রয়েছে উপস্থিত দু’জনের অনেক অনেক কথা বলার ইচ্ছে, অনেক কিছু জানানোর সাধ। কিন্তু সময় আজ তাদের বিপরীতে।
আমজাদ তাকিয়ে রইলেন নিজের স্ত্রী’র পানে। মানুষটা চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন। কথার যুদ্ধের ইতি টেনে দিয়েছে নিশ্চুপেই।
বুক চিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বের হলো আমজাদের। চেয়ারটা আলগোছে ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন। ধীর, শব্দহীন পায়ে গিয়ে সুইচবোর্ডের সামনে গিয়ে পুরো ঘরের আলো জ্বালালেন। টেবিল ল্যাম্পের আলোটা সরাসরি গিয়ে এবার প্রতিফলিত হলো অবনী বেগমের মুখে। কেমন ক্লান্ত মুখটা! বন্ধ চোখের পাতাও কাঁপছে। আমজাদ সওদাগরের ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করতে— সত্যিই কি সবটা শেষ? আর কোনো উপায় কি একেবারেই নেই?
কিন্তু প্রশ্নগুলো তার আর করা হয়ে উঠল না। কোন অধিকারেই বা করবে। এই সংসারে এই নারীটিকে ভালোবাসার মতন স্পর্ধা আদতেও তিনি কখনোই করেননি যে। কেবল থেকেছেন দূরে দূরে। ঘরে থেকেও পরের মতন অনুভূতি দিয়েছেন। আজ কেবল এত বছরের মায়া ও অভ্যাসের জোরে এমন প্রশ্ন করা সাজে তার? সাজে না।
এ যে তার যৌবনের টগবগে আবেগের কাল নেই আর। যৌবেন ফুরিয়েছে, আবেগ ফুরিয়েছে, সম্পর্কও এবার ফুরিয়ে যাওয়ার পালা। পড়ে আছে কেবল জীবনের শেষবেলাটুকু। তিনি নাহয় সেটুকু কাটিয়ে দিবেন যথারীতি খাটের ডানপাশটায় শুয়ে নির্ঘুম রাত। যেমন করে অবনী বেগমের অজান্তেই এতকাল কাটিয়েছেন!
আজ বড়ো পুরোনো কথা মনে পড়ছে। তার আর অবনী বেগমের বয়সের ছিলো বিস্তর পার্থক্য। অবনী বেগম ছোটো বাচ্চাটিই বলা চলে তার কাছে তখন। ঘুমিয়ে গেলে খাটের একপাশে আর থাকতো না। উল্টে গিয়ে পড়তো আমজাদ সওদাগরের বুকের মধ্যিখানে। আমজাদ সওদাগর চেয়েও কি সেদিন সরাতে পেরেছিলেন অবনী বেগমকে? অদৃশ্য এক স্নেহে সারারাতই হাত বুলিয়ে গিয়েছে অবনী বেগমের মাথায়। কিন্তু ভালোবাসতে? পেয়েছেন কি?
না, পারেননি। আজও তিনি অকপটে স্বীকারোক্তি দিবেন এটি। কারণ ভালোবাসা যে বড়োই ঘাড়ত্যাড়া জাত! একবার কাউকে ভালোবেসে ফেলল যত যা-ই হোক সেদিক থেকে আর মন ফেরানো যায় না। কেবল ভালোবাসাটুকুর অভাবেই তো তাদের সেই সংসারের সময় ফুরিয়ে এলো।
আচ্ছা, কী এমন হতো যদি অবনী কেবল মায়া আর অভ্যস্ততায় কাটিয়ে দিতো তার সাথে বাকি জীবনটা? খুব কি ক্ষতি হতো অবনীর?
মনে মনে প্রশ্ন করেই আবার মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানায় আমজাদ। কীসব ভাবছে সে? অবনীর বয়স কত? চল্লিশেরও ঘরে যায়নি এখনো মেয়েটা। ওর তো আরও লম্বা জীবন পড়ে আছে। জীবনের প্রথম ভাগ তো কাটিয়ে দিলো ভালোবাসা না পেয়েই। মধ্যম ভাগ থেকে যদি মেয়েটা নতুন কারো একটা ভালোবাসা পায় তবে ক্ষতি কী?
সংসারে সুখী হওয়ার অধিকার যে সবারই আছে! কেবল শেষমেশ সুখ তাকেই ধরা দিলো না।
তার আজ বড়ো নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। সুখ কি আদৌ ধরা দেয়নি? নাকি সুখ এসেছিলো?
তার নাম হয়তো অবনীই ছিলো অথচ তিনি তা চিনতেই পারলেন না?
কী জানি! সবকিছু এক জীবনে আবার জানাও সম্ভব নয়।
অবনীর পায়ের কাছের চাদরটা নিয়ে ঢেকে দিলো তার শরীরটা। ঠান্ডা লাগলে সহজে মেয়েটার যে ঠান্ডা ছাড়ে না সে কথাও কি আমজাদ সওদাগর জানেন না? অবশ্যই জানেন। কেবল অবনী বেগম জানলেন না,
তারও জানার বাহিরে কতকিছু আছে। কত না বলা স্নেহ, মায়া, অভ্যাস, নির্ঘুম রাত জমা হয়ে গিয়েছে।
পৃথিবীতে সময় সবচেয়ে দ্রুত বেগে যাওয়া বস্তু। সময়ের চেয়ে দ্রুত আর কিছুই চলতে পারে না বোধকরি।
চাঁদনীদের দেশে ফেরার পর কেটেছে বেশ অনেকটা। দুইমাস শেষ হবে প্রায়। অক্টোবর পেরিয়ে নভেম্বর শুরু হলো। সকাল হলেই কুয়াশায় ঢেকে যায় আকাশটা। ঠান্ডায় কাঁথার ভেতর ঘুমটা জেঁকে বসে বেশ।
অথচ সেই কুয়াশা মাখা ভোরটাতেই চিত্রার ঘুম ছুটে গিয়েছে। চারপাশটায় ভোরে যেই শীত শীত ভাবটা হয় তা বেশ লাগে তার। অন্যদিন হলে ঘুমিয়ে যেতো আবার কিন্তু আজ আর সেটা করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ফুরফুরে মনে উঠে বসলো। ওড়নাটা গায়ে চাদরের মতন প্যাঁচিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো বারান্দায়। চারপাশ তখন ধোঁয়াশা। জোরে বার কয়েক শ্বাস টেনে নিলো।
তখনই তার কানে ভেসে এলো গুনগুন শব্দ। কণ্ঠ পরিচিত।
চিত্রা নিচে তাকাতেই দেখলো বাহার ভাই তাকিয়ে আছে। হাসি তার মুখে। হাতের ইশারা চিত্রাকে ডাকছেন। চোখ দেখে বুঝা যাচ্ছে না লোকটা ঘুমিয়েছেন কি-না রাতে! ঘুমের লেশমাত্র নেই চোখে।
চিত্রা হাতে ইশারা করে জিজ্ঞেস করল- এখানে কী?
একই ভাবে মানুষটা ইশারা করল- চা খেতে যাবো। আসো।
চিত্রা সম্মতি দিয়েই ধীর গতিতে ঘর থেকে বের হলো। যেন কেউ না দেখে।
রাস্তায়ও নামলো একদম ধীরে। হয়তো ভোর ছয়টা বাজবে আনুমানিক।
ওকে দেখেই বাহার ভাই প্রশ্ন করলেন, “আজ এত সকালে উঠলে যে?”
চিত্রা তারও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল, “আবহাওয়াটা সুন্দর যে তাই! আপনি কখন উঠেছেন?”
“সকালে উঠা ভালো। স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।”
“তাই বলে রাত জেগে থাকবেন? রাত জাগা মোটেও উপকারী নয়।”
বাহার ভাই মেয়েটার চতুরতায় হাসলেন।
“রাত জেগেছি কে বলল?”
“আজও যদি সব বলতে হয় তবে আর ভালোবাসলাম কই?”
লোকটা লাজুক হাসলো কথা শুনে। মাথা নাড়ালো মৃদু। হাঁটতে আরম্ভ করতেই পেছন থেকে ডাক এলো মেয়েলি কণ্ঠে,
“তোমরা হাঁটতে যাচ্ছো বুঝি? আমিও যাবো কি?”
চিত্রার হাসি হাসি মুখটা নিমিষেই অন্ধকার হয়ে গেলো। কণ্ঠটি তার চেনা যে!
সে রাগে সরে যেতে নিলো। কারণ জানে বাহার ভাই আসতেই বলবেন।
কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বাহার ভাই বারণ করলেন টুইংকেলকে। বললেন,
“আবহাওয়া চেঞ্জ হচ্ছে তো! শরীর মানাতে পারবে না আপনার হয়তো!”
টুইংকেল তবুও জোর করল,
“কিছু হবে না। এই দেশটা আর দেখা হবে কি? তাই একটু শরীর খারাপ করুক, তবুও দেশটা দেখে যাই প্রতিটা বেলায় কেমন রূপ থাকে তার!”
যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৩৮
বাহার ভাই চিত্রার দিকে তাকালেন। বিড়বিড় করে বললেন,
“চলুক ও? ওর যে সীমিত সময়। রাগ করো না।”
চিত্রা তাকিয়ে রইল। মানুষটা কার পক্ষের হয়ে বলছেন? কেনই বা বলছেন?
টুইংকেলের সীমিত সময় ও কি জানে না? সীমিত সময়ের জন্যই তো এসেছিলো ও! তাহলে লোকটা এমন অসহায় কণ্ঠে বলল কেন? তবে কী…
বাহার ভাইয়ের মায়া জন্মালো অন্য কোথাও?