যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৪০
মম সাহা
কুয়াশায় ভেসে যাওয়া মান-অভিমানের গল্পটা বুদ্ধিমতী টুইংকেল হয়তো ধরতে পারলো। তাই মুহূর্তেই নিজের মন পরিবর্তন করে, চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
“এই না, আমি যাবো না গো। বাবাকে তো কাল কলই করা হয়নি! ভুলেই গিয়েছি। এখন কল করে আসি। যদিও মাঝ রাত থাকবে তা-ও মানুষটা নিশ্চয় চিন্তা করছেন।”
চিত্রা সেই আগের বোকাটি নেই। তাই পরিস্থিতিকে হাতের মুঠোয় আনতে বলল,
“পরে কল দিও। এখন নিশ্চয় ঘুমুচ্ছেন আঙ্কেল। আসো আমাদের সাথে। একটু হাঁটাহাঁটি করো।”
বাহার ভাই একটা টু শব্দ করলেন না। বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রইলেন।
কিন্তু টুইংকেল আর একেবারেই যেতে রাজি হলো না। কলের অজুহাতে আবারও চলে গেলো বাড়ির ভেতরটায়। রাস্তায় তখন রইল বাকি দু’জন। বাহার ভাই ও চিত্রা। আর বৈদ্যুতিক তারের উপর বসে ঝিমুতে থাকা কালো মিশমিশে কাকটি।
বাহার ভাই সেদিকে বিশেষ নজর না দিয়ে বললেন,
“চলো, হাঁটি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চিত্রার ভেতর অপরাধবোধ কাজ করলো। টুইংকেল মেয়েটা আসার পর তার সাথে ভালো ভাবে মিশতে চেয়েছে প্রতিবার কিন্তু সে নিজের মনের অভিমানের জন্য বার বার না চাইতেও আপত্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলেছে। কখনো বা মেয়েটার পাশ কেটে চলে গিয়েছে। কিন্তু সে-ও বা কী করবে?
মাঝে সাঝে অনুভূতির কাছে একটা নিরূপায় লাগে নিজেদের!
চিত্রার সমস্ত হতাশা গিয়ে পড়ল বাহার ভাইয়ের উপর। উদাস, বিষাদগ্রস্ত স্বরে বলল,
“এসব আর ভালো লাগছে না। হয় স্থায়ী করুন সম্পর্ক নয়তো ছেড়ে দিন।”
বাহার ভাইয়ের ভাবান্তর দেখা গেলো না মুখে। কেবল ধীর স্বরে বলল, “ছেড়ে দেওয়ার হলে এত অপেক্ষার গল্পে কি রাত ফুরাতো?”
“এসব কাব্যিক কথায় আর কত কাল? বাস্তবতা আমার চেয়ে আপনিই তো ভালো বুঝেন, তাই না? সম্পর্কের হয় নাম দিবেন কোনো নয়তো পথ দেখিয়ে দিবেন বিচ্ছেদের।”
বাহার ভাই হাসলেন। পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালালেন। স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ ভোরের বাতাসটি নিকোটিনের কড়া গন্ধে ভারি হয়ে উঠে। চিত্রার রাগ বাড়ে তার সাথে পাল্লা দিয়ে।
“সারাজীবন তাহলে এ-ই করেই কাটিয়ে দিন।”
“আমি অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, তোমার বিশ্বাসের প্রাচীরে কীভাবে এমন ফাটল ধরল?”
চিত্রার রাগে-দুঃখে কান্না পায়৷ সে তো বাহার ভাইকে অবিশ্বাস করতে চায় না। তবুও অধিকারবোধ কখনো কখনো মানুষকে স্বার্থপর করে দেয় হয়তো।
চিত্রা কথা বাড়ালো না আর। ফুরফুরে মেজাজ মাটিতে মিশিয়ে চলে গেলো বাড়ির ভেতর। বাহার ভাই দাঁড়িয়ে রইলেন। অনেকক্ষণ। এক ধারেই। মূর্তির মতন। বোঝা গেলো ঠিক, ঝড় বয়ে যাচ্ছে মানুষটার চারপাশে।
দীর্ঘ এক শ্বাস ফেললেন মানুষটা। ক্লান্ত স্বরে বললেন,
“আর কতকাল দুঃখ পেলে আমার দুঃখের আয়ু ফুরাবে? আর কতকাল অপেক্ষার পর সুদিন আসবে?”
কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তরে চারপাশে বয়ে যায় কেবল নীরবতা।
চিত্রাদের ড্রয়িং রুমে মানুষ নেই। রান্নাঘরে চলছে ব্যস্ত হাতে কাজ। সোফাটায় বসে ছিলো টুইংকেল। হাতে ফোন। তার থেকে একটু দূরেই নুরুল সওদাগর দাঁড়িয়ে রইলেন। বেশ অনেকটা সময় কিছু না বলেই। এরপর ধীরে ধীরে গিয়ে বসলেন টুইংকেলের পাশে। টুইংকেল পাশে তাকিয়েই প্রসারিত ঠোঁটে হাসলো। তার হাসির বিপরীতে নুরুল সওদাগরও হাসলেন। স্নেহ ভরা বুকে ওর মাথায় হাতও বুলিয়ে দিলেন।
চিত্রা সবটা দেখলো নিজের দরজা থেকে দাঁড়িয়ে। আজ সারাদিন তার ভীষণ মন খারাপ ছিলো। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ চলেছে। শেষমেশ যুদ্ধ শেষে সে ঠিক করল টুইংকেলের সাথে আজ থাকে একটু মনমতন মিশবে। ভালো আচরণ করবে। টুইংকেল খুবই স্বল্প সময়ের জন্য এসেছে তাদের কাছে। শুধু শুধু মেয়েটা চিরটা কাল জানুক- চিত্রা ভীষণ অপছন্দের মেয়ে.. তা সে চায় না।
কিন্তু যখনই নিজেকে সামলে সে বের হলো তখনই বাবার এই আহ্লাদ দেখে তার বুকটা কেঁপে উঠল। বুকের কোথাও একটা জেগে উঠল ঈর্ষা। সে খেয়াল করেছে, টুইংকেল আসার পর বাবা ওর খুব আদর করেন। খেয়াল করেন। অবশ্য বাড়ির সকলেই তা করেন কিন্তু বাবারটা বড্ড চোখে লাগে তার। কারণ তাকে বাবা কখনো এমন করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেননি। কখনো এমন হাসিমুখে কথাও বলেননি।
আবার যখন দেখেছে বাহার ভাইও মেয়েটাকে বেশ যত্ন করে তখন আর সে কি নিজেকে ধরে রাখতে পারে?
তার জীবনে বাবার এমন কাছে টেনে নেওয়া আদরের বড়ো অভাব। ছোটোবেলা থেকেই সে বাবার থেকে দূরে দূরে থাকে। একটু ভয় পায়। বাবাও বিশেষ কাছাকাছি আসেননি। কিন্তু টুইংকেলের ক্ষেত্রে বাবা সেটা করেন। খুব আদর করেন। যে আদর চিত্রার স্বপ্ন ছিলো বরাবর।
ছোটো শ্বাস ফেলে ড্রয়িং রুমে চিত্রা উপস্থিত হতেই নুরুল সওদাগর একবার চোখ উঠিয়ে তাকান। তেমন কিছুই বলেন না মেয়েকে। খুব নীরবেই আবার চলে যান নিজের রুমে।
চিত্রা সেই যাওয়ার মানে কিছু সেকেন্ড তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করে। যা তার পাওয়ার কথা নয় তা মেনে হতে হবে ভাগ্যে নেই। অমুক, তমুককে তো আর নিজের ভাগ্যের দোষ দেওয়া উচিত নয়।
নিজেকে শান্ত করেই আগ বাড়িয়ে টুইংকেলের সাথে কথা বলল,
“তোমাদের ওখানে সবসময়ই ঠান্ডা থাকে তাই না বলো?”
চিত্রার আগ বাড়িয়ে কথা বলায় মেয়েটা বোধহয় ভীষণ খুশি হয়ে উঠে। যা তার ঝলমলে করা চোখ-মুখ দেখেই আন্দাজ করা যায়।
চঞ্চল কণ্ঠে জবাব দিল, “ হ্যাঁ। বরফের দেশ তো। বেশিরভাগ সময়টাই বরফ পড়ে।”
“আমার ইচ্ছে একবার যাওয়ার। বরফের দেশের প্রতি আমার ভীষণ টান।”
টুইংকেল আরও আগ্রহী হয়ে পড়ল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল,
“অবশ্যই যাবে। তুমি আর বাহার ভাই একসাথে আসবে। আমি তোমাদের নিয়ে ঘুরবো, আনন্দ করবো। কবে যাবে বলো।”
চিত্রা এবার কিছুটা সংকুচিত ভাবে বলল,
“আমি যাবো তা নাহয় ঠিক আছে। কিন্তু এখানে বাহার ভাই এলেন কোথা থেকে?”
টুইংকেল হাসল, “কেন? উনি ছাড়া চিত্রা কি আর নিজেকে কল্পনা করতে পারে? পারে না তো মোটেও।”
চিত্রা ভেবেছিল তার আর বাহার ভাইয়ের বিষয়টা বোধহয় টুইংকেল তেমন আঁচ করতে পারেনি। কিন্তু টুইংকেলের বর্তমান কথা শুনে সে তাজ্জব হয়ে গেলো। বিস্মিত স্বরে বলল,
“তোমায় এসব কে বলল?”
“যে-ই বলার, বলেছে। এবং আমি জানি তুমি কী কী ত্যাগ করেছো বাহার ভাইকে পেতে। তোমার মতন চিত্রা কি আর কেউ হতে পারবে বলো? আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি। এবং এজন্যই করি কারণ এমন ভালোবেসে চিত্রা হওয়ার মতন ক্ষমতা সবার নেই।”
চিত্রার একদিকে কৌতূহল অন্যদিকে কিছুটা দ্বিধা হলো। আরও প্রশ্ন করার আগেই একে একে চাঁদনী আপু, চেরি, তুহিন ভাইজান হতে বড়ো আব্বু, আব্বু সবাই চলে এলেন। সন্ধ্যার নাস্তাটা তারা একত্রেই করেন যে তাই।
চিত্রা আর কিছু বলতে পারল না। খচখচানি থেকে গেলো তার ভিতরেই।
ড্রয়িং রুমে সবাই খেতে ব্যস্ত থাকলেও একজন বের হলেন না। তিনি হলেন আমজাদ সওদাগর। দিনে দিনে মানুষটা যেন একা থেকে অধিকতর একা হয়ে উঠছেন। কারো সাথে তেমন কথা বলেন না, বিশেষ দেখাও মেলে না তার।
নিজের স্বামীর অনুপস্থিতি ঠিক অবনী বেগম খেয়াল রাখলেন। নাস্তা নিয়ে তাই ব্যস্ত হাতে ছুটলেন ঘরে।
আমজাদ সওদাগর বসে আছেন কাঠের চেয়ারটায়। চোখগুলো বন্ধ। মাথার নিচে দু-হাত রাখা। ঘুমিয়ে পড়েছেন কি-না কে জানে?
অবনী বেগম তাই কিছুটা ইচ্ছেকৃত শব্দ করে ঘরে প্রবেশ করলেন। তাতেও নড়চড় নেই মানুষটার।
তাই অবনী বেগম নিজেই মুখ ফুটে বললেন,
“নাস্তার প্লেটটা রেখে গেলাম। খেয়ে নিও।”
আমজাদ সওদাগর এবার নড়লেন। ধীর গতিতেই সেই নড়চড় ঘটল। অবনী বেগম বের হয়ে আসার আগ মুহূর্তে তিনি ডাকলেন,
“তুমি খেয়েছ?”
অবনী বেগম একবার চোখ ঘুরিয়ে হালকা ভাবে তাকালেন। কড়া উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। মানুষটার বিমর্ষ মুখটা দেখলে আজও বুকের ভেতর যে খারাপ লাগা জন্মে!
তাই কড়া বাক্য গিলে, মোলায়েম স্বরে বলল,
“খাবো। সবাইকে দিয়েই।”
“তোমরা কি এ মাসেই চলে যাবে, অবনী?”
অবনী বেগম পাথরের মতন কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। আগে আমজাদ তাকে অবু ডাকতো। কিন্তু অবনী কিছু মাস আগেই নিষেধ করেছেন এই নামে ডাকতে। কারণ আদুরে ডাকনাম তো ভালোবাসার লোককে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি তো আমজাদের জীবনে কখনো ভালোবাসার মানুষ ছিলেনই না। তাহলে আর কীসের জন্যই বা নামটুকুতে আদর থাকবে?
অবনী বেগম তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন,
“হ্যাঁ। বড়ো ভাইজান বলেছিলেন চাঁদ, চিত্রার বিয়ে অব্দি থাকতে। কিন্তু চাঁদ তো এখন বিয়ে করবে না আবার বাহিরে চলে যাবে। আর চিত্রার বিয়ের এখনো খবর নেই। তাই কী লাভ অকারণ অপেক্ষার! চাঁদনীরা চলে গেলেই আমিও নতুন বাড়িতে উঠবো।”
আমজাদ সওদাগর আর কিছু বললেন না। অবনী বেগম তা-ও একটু অপেক্ষা করেছিলো যদি মানুষটা ভুল করেও বলতো থেকে যাওয়ার কথা! কিন্তু তার আশা অপেক্ষাতেই থেকে গেলো। মানুষটা কিছুই আর বললেন না।
অবনী বেগম আশাহত হয়ে বেরিয়ে গেলেন। বিয়ের এতবছর পর হয়তো ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন তিনি। সংসার হয় ভালোবাসার, সেটাই যদি না থাকে কবে আর সেই সংসারের কী মূল্য রইল!
ড্রয়িং রুমে সবাই যখন খাওয়াতে মগ্ন তখন হনহনিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলেন বাহার ভাই। চোখে-মুখে নির্লিপ্ত ভাব।
কোনো কথাবার্তা ছাড়াই তার আগমন। এবং এসে সোজা দাঁড়ালেন ড্রয়িং রুমের মধ্যিখানে। নুরুল সওদাগরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।”
বাহার ভাইয়ের হঠাৎ আগমনে থতমত খেয়ে গেলো সকলে। চিত্রাও বুঝে উঠতে পারল না কিছু।
নুরুল সওদাগরের মুখটি হলো গম্ভীর। শুধালেন,
“কী বলতে এত তাড়া? কী বলবে?”
যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৩৯
“আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।” কী নির্লিপ্ত ভাবে বিয়ের প্রস্তাবটা দিয়ে দিলেন মানুষটা! যেন গাছের আম পেড়ে খেতে চাচ্ছেন।
সবাই অতি বিস্মিত হলেও মিটমিট করে হাসল চাঁদনী, টুইংকেল, চেরি, তুহিন।
চিত্রার তো মাথা ঘুরে উঠল। এই বুঝি তার বাবা বাড়ি মাথায় তুললেন!