যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৪১
মম সাহা
সওদাগর বাড়ির ড্রয়িং রুম জুড়ে থমথমে আবহাওয়া। একটি অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবেই সকল হৈচৈ থেমে গিয়েছে আচমকা। যদিও সকলে ভেবেছিল নুরুল সওদাগর হয়তো রেগে যাবেন, তেড়েমেরে আসবেন বাহার ভাইয়ের শার্টের কলার টেনে ধরতে… কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে লোকটার কণ্ঠস্বর রইল যথেষ্ট ঠান্ডা।
শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
“তুমি কি মজা করছো?”
বাহার ভাইয়ের চোখ-মুখ একেবারেই স্বাভাবিক। যেন এমন করে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াটা নিতান্তই স্বাভাবিক বিষয়। তিনি সরল কণ্ঠে উত্তর দিলেন,
“মজা করে কখনো লোকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়?”
নুরুল সওদাগর থমথমে মুখে তাকালেন মানুষটার দিকে। তাতে বিশেষ কোনো হেলদোল হলো না মানুষটার। আগের মতন ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন।
আফজাল সওদাগর মাঝে একবার বসতে বললেও মানুষটা বসেননি। তার যেন বড্ড তাড়া। কোনো রকম প্রস্তাব দিয়ে ছুটতে হবে রাজকার্যে।
চিত্রার মুখটি তখনো ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মানুষের মতনই বিস্মিত।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“বিয়ে করবে চিত্রাকে, তাই তো?”
নুরুল সওদাগরের প্রশ্নে অকপটে মানুষটা বললেন, “হ্যাঁ, সেটাই তো বললাম।”
“আচ্ছা, বেশ। তা না-হয় করবে। তবে, আমার মেয়েকে কী খাওয়াবে তার কথা কি একটিবার ভেবেছো?”
মুনিয়া বেগম স্বামীর প্রশ্ন-উত্তরে কিছুটা বিরক্তবোধ করলেন। কারণ সওদাগর বাড়ির মানুস থেকে শুরু করে ভিটেমাটি, ছাদ সবাই জানে চিত্রা কার জন্য পাগল ছিল, উন্মাদের মতন জীবন কাটিয়ে ছিলো।
চিত্রা শেষ অব্দি এই ছেলেকেই চাইবে তাহলে এসব কথোপকথনের কী মানে? যেখানে তাদের মেয়েটাই খুলে রেখেছে সকল সীমানা?
মুনিয়া বেগম এগিয়ে দাঁড়ালেন। স্বামীর প্রতি বিরক্তি নিয়ে বললেন, “আহ্! এগুলো কেমন ধরণের প্রশ্ন? তোমার মেয়ে এবং বাহার নিশ্চয় ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
নুরুল সওদাগর স্ত্রীকে খানিক চোখ রাঙালেন, “কথা তো আমি বলছি। তুমি এখানে কথা বলছো কেন?”
বাহার ভাই হাসিমুখে সাঁই দিয়ে বললেন, “আন্টি, আমি উত্তর দিতে প্রস্তুত আছি। তাছাড়া উনি মেয়ের বাবা। মেয়ের ভালোমন্দ দেখা উনার দায়িত্ব। আমি প্রস্তুত আছি। এক বাবার সারা জীবনের সম্বল তার আদরের মেয়ে, তাকে নিতে হলে দু একটা উত্তর আমি দিতে পারব।”
বাহারের কথায় শিথিল হয়ে এলো মুনিয়া বেগমের মুখটি। উনি জানেন ছেলেটি অসম্ভব গুছিয়ে রাখবেন তার মেয়েকে। হয়তো কোনো কারণবশত দূরে গিয়েছিলো কিংবা বাধ্য হয়েছিলো দূরে যেতে কিন্তু এই যে, ঠিক সে ফিরে এসেছে! যদি ভালোই না বাসতো তবে কি ফিরে আসতো?
মুনিয়া বেগমের ভাবনার মাঝে বাহার ভাই নুরুল সওদাগরের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
“আমি চিত্রাকে ডাল-ভাতটুকু খাওয়াতে পারব। ওর যতটুকু যত্ন দরকার ততটুকু দিতে পারব। বিলাসবহুল জীবন দেওয়ার সাধ্য আমার নেই তবে সুখ দেওয়ার সর্বস্ব চেষ্টা করব।”
“ডাল-ভাতটাই কীভাবে খাওয়াবে? সারাজীবন টিউশনি করে? ভালো কোনো চাকরি তো পাবে না। জেলের সিল পড়ে যে গেছে তোমার নামের পাশে।”
বাহার ভাই বিভ্রান্ত হলেন না মোটেও। মাথা নাড়িয়ে বললেন, “শহরের বাহিরে আমি একটা নিজ উদ্যোগে ফার্ম দিয়েছি। সবজি বাগান করেছি। ফুলের নার্সারি করেছি টুকটাক টাকা মিলিয়ে। এতটুকু থেকে যা ইনকাম হবে তাতেই আপনার মেয়ে সুখে থাকতে পারবে। তাছাড়া ওর তো ভাত-কাপড়ের চিন্তা ছিলো না কোনোকালেই। ও কেবল আমাকে পেলেই সুখী হবে বলেছিল।”
মানুষটা সকলের অগোচরে এতটা পরিশ্রম করে ফেলেছে তা শুনে সকলই বিস্মিত হলো।
নুরুল সওদাগরের মুখে গম্ভীর গম্ভীর ভাবটা নেই। বেশ কোমল হয়ে এসেছে কণ্ঠ।
জিজ্ঞেস করলেন,
“আমার মেয়েকেই কেন বিয়ে করতে হবে? ও তোমাকে ভালোবাসে বলে? ওর ভালোবাসার মান রাখতেই?”
মানুষটা হাসলেন প্রশ্ন শুনে।
কী স্নিগ্ধ হাসি! মুগ্ধতায় ছেয়ে গেছে চারপাশটা। হাসি মুখে বললেন,
“উহু, চিত্রার মতন আমার জন্য কেউ কখনো অপেক্ষা করতে পারবে না বলেই ওকে আমি চাই। আমি রাগ করেছি ও বলেছে রাগ ভাঙার অপেক্ষা করবে। আমি অভিমান করেছি ও মান ভাঙার অপেক্ষা করেছে। আমি ওকে উপেক্ষা করেছি তাও ও অপেক্ষা করেছে। ওকে আশা দেখিয়ে, স্বপ্ন দেখিয়ে আমি চলে গিয়ে ছিলাম। তা-ও ও অপেক্ষা করেছিল। আমি যদি ফিরে না-ও আসতাম তবুও এতটুকু আমার মন চিরজীবন জানতো যে- আমার জন্য একটি মেয়ে অপেক্ষা করবে চিরটা কাল। এই যে সব আত্মসম্মান, আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে ও এতকাল যে কেবল আমার জন্য অপেক্ষা করে গেলো, তার বদলে আমি কীই-বা দিয়েছি? ওকে কিছুই দেওয়ার ক্ষমতা কিংবা সাধ্য আমার নেই। কেবল সাধ্য আছে ওর বহু বছরের অপেক্ষা প্রাপ্তিতে রূপান্তর করার। আমি সেটাই চাই। আমি অনুরোধ করবো আপনি আমার চাওয়াটা পূরণ করার অনুমতি যেন দেন।”
“যদি না দিই?”
নুরুল সওদাগরের কাঠ কাঠ কণ্ঠে বাহার ভাই তাকালেন সরাসরি। সকলের এবার মনে হলো নুরুল সওদাগর এবার প্রচণ্ড বাড়াবাড়ির শুরু করেছেন। বাহার ভাইয়ের মতন কাঠখোট্টা মানুষ কতটা নরম স্বরে এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। তারপরেও এসব প্রশ্ন সাজে?
সবাইকে তাজ্জব করে দিয়ে বাহার ভাই হাঁটু মুড়ে বসলেন। দু’হাত মেলে পৃথিবীর সবচেয়ে করুণ স্বরে বললেন,
“না দিলে আপনার পায়ের কাছে পড়ে থাকবো। আমাকে একটু ভালো থাকতে দেওয়ার দাবীতে আমি মাথা নোয়াবো আপনার কাছে। আমাকে কি দিবেন চিত্রাকে? ওকে পেলে আমি ভালো থাকবো। ভীষণ ভালো। ও মায়ের মতন আগলে রাখতে জানে, বন্ধুর মতন কাঁধ হয়। ওকে দিবেন? আমাকে আগলানোর কেউ নাই। আমার মাথা রাখার কাঁধ যে নাই। দিয়ে দেন না ওকে।”
মানুষটার কণ্ঠ কাঁপছে। পরাজিত সৈনিকের মতন ভঙ্গুর লাগছে তার দেহ।
চিত্রা সোফাতে বসেই চোখ নামিয়ে ফেলল। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তার। কীভাবে এই মানুষটাকে সে মাঝে মাঝে অবিশ্বাস করে ফেলে কে জানে? তাকে পাওয়ায় জন্য মানুষটা তার বাবার পায়ের কাছ অব্দি এসে বসেছে।
নুরুল সওদাগর মুচকি হাসলেন। নিজের বড়ো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“বড়ো ভাইজান, বিয়ের তারিখ ঠিক করেন। ঘরোয়া ভাবেই দিবো। আমার মেয়ে জামাইয়ের যতটুকু ক্ষমতা ততটুকুতেই বিয়েটা হবে। কী বলেন?”
অপ্রত্যাশিত এই কথায় ড্রয়িং রুম জুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো। টুইংকেল করে বসল অপ্রত্যাশিত কাজ। মুখ দিয়ে সিটি বাজালো।
সকলে হেসে উঠল এক সাথে। এই সুখের ধারায় মলিন হয়ে গেলো চিত্রার সকল দুঃখ।
মাথার উপর ঝাঁকড়া রৌদ্দুর। উষ্ণতায় পুড়ে যাচ্ছে চারপাশটা। ঘেমে-নেয়ে একাকার চিত্রার শরীরটা। বিরক্ত কণ্ঠে বাহার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
লোকটা মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। চিত্রার শ্যামলাটে মুখটার দিকে তাকিয়ে মায়া হলো বোধহয়। দ্রুত পকেট থেকে রুমাল বের করে যত্নে মুছিয়ে দিলেন মুখটা।
চিত্রা সাবধানী চোখে চারপাশে তাকালো। বিড়বিড় করে বলল,
“লোকে দেখবে তো না-কি!”
ভ্রু কুঁচকে মানুষটা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “তো? দেখলে দেখবে।”
চিত্রা মুখ ভেংচালো। কিছুটা এগুতেই একটি ছোটো প্রাইমারি স্কুলে চোখ গেলো তার। শহর থেকে বেশ আলাদা জায়গা। কিছুটা গ্রাম্য ভাব আছে।
চিত্রা কৌতুক করে বলল, “আবার স্কুলে ভর্তি হবেন নাকি?”
“না, তোমাকে করব। যদি এবার বুদ্ধিটা হয় আরকি!”
সেই প্রথম দিনের মতনই মানুষটা রয়ে গেছে। আজও মনে হয় না যে, এতটা বছর কেটে গেছে তাদের জীবনে। কতকিছু ঘটে গেছে বেনামি ঝড়ে। সৃষ্টিকর্তা সবকিছু যেন আগের চেয়ে আরও পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। জীবনের ঝড় যে সাময়িক। সৃষ্টিকর্তার এই পরীক্ষায় উতরে গেলেই সবচেয়ে ভালো ফলাফলটা পাওয়া যায়। কিন্তু বোকা মানুষ কখনো কখনো এই ঝড়ে টিকতে না পেরে হারিয়ে যায় বহুদূর।
বাহার ভাই চিত্রার হাত ধরেই ঢুকলেন স্কুলের ভেতর। দারোয়ান তাকে দেখে হাসলেনও। চিত্রার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। লোকটাকে এত মানুষ চেনে কীভাবে?
একটি আধ খসা বিল্ডিং এর নিচ তালার একটি রুমের জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা দু’জন। চিত্রা তখনো বুঝতে পারছে না লোকটা করতে চাচ্ছেটা কী আসলে!
কিন্তু পরিচিত একটি মেয়েলি কণ্ঠস্বর পেতেই চিত্রার টনক নড়ে গেলো। বিস্মিত হয়ে তাকালো ক্লাসের ভেতর। অস্ফুটস্বরে বলল,
“এটা, এটা নোঙর আপু না? অনেক বছর আগে আপনাদের বাড়িতে এসেছিলো যে?”
বাহার ভাইও ক্লাসের দিকে তাকিয়ে আছেন। চিত্রার উত্তরে মাথা নাড়ালেন। এরপর চিত্রার চোখে চোখ রাখলেন। বললেন,
“তোমার মতনই আরেকজন, তীব্র যুদ্ধে টিকে থাকা মানুষ।”
চিত্রা কৌতূহলী কণ্ঠে শুধাল, “যুদ্ধে টিকে থাকা?”
“হ্যাঁ, যুদ্ধে। আমার জীবনে গত আড়াই তিন বছরে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে। নোঙর না থাকলে কী হতো জানা ছিলো না।”
বাহার ভাইয়ের আধা কথায় চিত্রার বোধগম্য হলো না। আগ্রহী কণ্ঠে বলল,
“আপনি তো জানাননি। কী হয়েছিলো আপনার সাথে?”
বাহার ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শক্ত করে চিত্রার হাতটা ধরলেন,
“আমি একটা ছোটো ছেলের দোকান থেকে চা খেতাম। বহু দিন আগের কথা। একদিন চা খাচ্ছিলাম আর ওর দোকানেই গিটার বাজাচ্ছিলাম। ও নাচছিলো। কোথা থেকে একটা দানবীয় ট্রাক এসে উড়িয়ে দিলো ওকে। ও কীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো আমার সামনে তা আমি আজও ভুলতে পারি না! রক্তে ভিজে গিয়েছিল চারপাশটা!”
চিত্রার বিস্ময়ের সীমা রইল না। বাহার ভাই এসব কী বলছেন? ও তো কিছুই জানতো না!
বাহার ভাই একটু থামলেন। অতঃপর আবার বলতে শুরু করলেন,
“আমি তখন পথিমধ্যে থেকে ওকে তুলে নিয়ে পাগলের মতন হসপিটালে ছুটে যাই। দোকানের পাশেই ওদের ঘর ছিলো বিধায় ওর বোনটাও সবই দেখে। এ-ও আমার পেছন পেছন ছুটে যায়। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয় না। ছোটো বাচ্চাটা আমার হাতেই তড়পাতে তড়পাতে মরে যায়। রাগে, ক্ষোভে আমার সেদিন সব ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে হয়। ঠিক সেদিনই গিয়ে আমি সেই ট্রাকের নামে মামলা দিই। ছেলেটার বোনটাও আমার সাথে ছিলো। অতটুকু মেয়ে কিন্তু সাহস করেছিলো। এরপরই এই দেশের সিস্টেম সবটা উল্টেপাল্টে দেয়, রঙ্গনা। সাথে উল্টে যায় আমার জীবন। নয়তো তোমাকে এত অপেক্ষায় আমি রাখতাম না। পাগলের মতন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হতো না আমার।
এই ট্রাকটা যার ছিলো সে ছিলেন বিশাল মাপের মানুষ। উনার ট্রাকের নামে মামলা হওয়াতে উনি আমাকে প্রথমে টাকার অফার দেন। আমি রাজি হই না মামলা তুলতে, সাথে ছেলেটার বোনটাও। মেয়েটাকে হুমকি-ধমকিও দেয়, আমাকেও দেয়। শেষ পর্যন্ত না পেরে একদিন নোঙরকে এত মারধর করে যে নোঙরের ওভারি ফেটে যায়। আমি সে খবর পেয়েই নোঙরকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাই। নিরাপত্তা সাথে চিকিৎসার জন্য। কিন্তু আমাদের জীবন কঠিনতর হয়ে উঠে। বনফুলকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। আমি সমস্তই পুলিশকে জানাই কিন্তু অর্থের কাছে সবই যে নত!
যখন পালিয়ে যাবো ঠিক করলাম ভাবলাম তোমাকেও সাথে নিবো। তাই তোমাকে বিয়ের কথা বলেছিলাম। আমার জীবন ছিলো অনিশ্চিত। তবুও তুমি ভেঙে পড়বে আমার অনুপস্থিতিতে, সেটা ভেবেই তোমাকে বিয়ের কথা বলি। কিন্তু, কিন্তু সেদিন সব বদলে যায়!
আমি তোমাকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে টাকা নিতে এসে শুনি ওরা আমার নামে ভুয়া মামলা দিয়েছে। এবং এই খবরটা কে দেয়, জানো?”
চিত্রা স্তব্দ। কোনো মতে উচ্চারণ করে,
“কে?”
“তোমার বাবা। উনিই জানান আরেক থানার পুলিশ আমাকে খুঁজছেন। আমি তখন কোনোরকমে আমার বাড়ির লোকদের নিয়ে পালিয়ে যাই। কেস কী জানো? নোঙরের ভাইয়ের মৃত্যুর কেস! ভাবতে পারছো? নোঙরকে ওরা মেরে ফেলতো পেলে সাথে আমার পরিবারকে। এমন ভাবে সবটা সাজাতো যে সারাজীবন জেলেই আমার জীবন কাটতো। আমরা পালিয়ে নকুলতলা বস্তিতে আশ্রয় নিই। কিন্তু ঐ যে কপাল খারাপ! শেষ রক্ষা হয় না৷ একদিন লুকিয়ে নোঙরের চিকিৎসার জন্য আসতেই আমাকে ধরে ফেলে। আড়াইটা বছর আমি সেই কেসের আসামি হয়ে ঘুরি।
আমার ঘর, মা, বোনকে তখন সামলেছে নোঙর। স্কুলে চাকরি নিয়েছে। ততদিনে তো বনফুল ড্রাগও নিয়ে ফেলেছিলো আমাদের অগোচরে। তুহিনকে না পাওয়ার কষ্ট, নেশার জগত ওকে ধীরে ধীরে মানসিক ভাবে অসুস্থ করে দেয়। ওদিকে আমার এই দশা, মেয়ের এই দশা সহ্য করতে না পেরে একদিন আম্মা ইন্তেকাল করেন। আমাদেরকে একা করে দিয়ে চলে যান মানুষটা দূরে, বহুদূরে। আমি একটু দেখার সৌভাগ্য পাইনি। মায়ের বিদায় বনফুলকে শেষমেশ পাগল করে দেয়। নোঙর একা হাতে সবটা সামলেছে। জানি না কীভাবে সব করেছে! আমার উকিল খরচ, বনফুলের খাবার খরচ, চিকিৎসা সব স্কুল, টিউশনি করে চালিয়েছে। শেষমেশ বনফুল জানের আশা ছেড়ে দিয়ে সামনে আসে, স্টেটমেন্ট দেয়, কোনক্রমে রোড সাইডের সিসিটিভি ফুটেজেও ট্রাকের হদিস পাওয়া যায় এবং আমাকে মুক্তি দেয়। কিন্তু আমার আড়াইটা বছর শেষ। আমার মা শেষ। আমার বোন ততদিনে ভারসাম্যহীন। আমাদের দেশের চৌদ্দ শিক বড়োই দীর্ঘস্থায়ী বস্তু। একবার গেলে সহজে কি আর ছাড় পাওয়া যায়?
তবুও উপরওয়ালা মুখ তুলে চাওয়াতে বেকসুর খালাস পাই। এবং পরেরদিনই পৌঁছাই শহরে। নির্বাচনে নতুন দল আশায় আপাতত ঐ বড়ো মাপের মানুষ লুকানো আছেন। কেসও ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। এজন্য স্বস্তির শ্বাস নিই। এখানে সত্যির বিচার চাইলে এভাবেই নিঃস্ব হতে হয়। শূন্য হতে হয়, রঙ্গনা। আমিও হলাম। আমার মা’কে হারিয়ে ফেললাম। শেষবার একটু দেখতেও পেলাম না! কী নিষ্ঠুর ভাগ্য ছিলো আমার! ভাবতে পারো?”
বাহার ভাইয়ের কথা থামলেও চিত্রা আর প্রশ্ন করার ভাষা পায় না। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষটা এত ঝড় সহ্য করল অথচ কিছুই সে জানতে পারলো না? উল্টো কত অভিযোগ করল সে! কত অভিযোগ!
এই থমথমে আবহাওয়ার ভেতর ঘন্টা পড়ে স্কুলের। ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসে নোঙর। চিত্রা, বাহার ভাইকে দেখে অতি আশ্চর্য হয়। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে চিত্রাকে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে,
যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৪০
“কত বছর পর তোমাকে দেখলাম, চিত্রা। চিত্রা, চিত্রা, চিত্রা, জানো না তোমাকে দেখার জন্য কতটা মুখিয়ে ছিলাম! তোমাকে ভীষণ মনে পড়েছে এতটা দিন। কেমন আছো তুমি? নিজের মানুষকে পেয়ে আজকাল সুখে আছো তো?”