যতনে রাখিলাম যাতনা শেষ পর্ব 

যতনে রাখিলাম যাতনা শেষ পর্ব 
মম সাহা

চিত্রাদের বাড়িতে হালকা-পাতলা সাজসজ্জা। আনন্দে আত্মহারা চারপাশটা। ঝিমিয়ে নেই বাড়ির একটা বিন্দুও।
বিয়ের আমেজে ডুবে আছে সবাই। ছাদে বিয়ের স্টেজ হচ্ছে। ছোটোখাটো আয়োজন তবে আনন্দের কমতি নেই। টুইংকেল, চাঁদনী, তুহিন, বনফুল সবাই সাজানোতে ব্যস্ত।
অহি তো এই ব্যস্ততার ভেতরেও নিজের মেয়েকে খাওয়াতে ভুলছে না। ছুটে ছুটে মেয়ের মুখে ভাত তুলে দিচ্ছে। নওশাদ সোফাতেই বসা। মেয়ে বাবার কোলে গিয়ে বসে একবার। একবার গিয়ে জাপ্টে ধরে মা’কে।
নওশাদ তা দেখে হাসে। অহির শাড়ির আঁচল ঠিক করে দেয় যত্নে।

নিজের ঘর থেকে সবটাই দেখে আমজাদ সওদাগর। তার মেয়েটা কী ভীষণ সুখে আছে আজ! নিজের মেয়ে আর ঐ ছোট্টো হুমুর ভেতর তিনি খুঁজে পান অবনী বেগম আর ছোটো অহিকে। পরের সন্তানকেও যে স্নেহ, মায়া, ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করা যায় তা এই দুটো মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এসব এতকাল না বুঝতে পেরে তিনি হয়ে গিয়েছেন একা। আজকের পর এই একাকীত্ব রূপ নিবে বিশালতায়। এই তো বিকেল চারটার দিকে চিত্রার বিয়ে। রাতেই চাঁদনী আর টুইংকেলের ফ্লাইট। ওদের এয়ারপোর্টে সবাই পৌঁছে দিতে যাবে। এরপর বাড়িতে সকলে ফিরলেও ফিরবেন না অবনী বেগম। কারণ আজই তিনি নতুন বাসাতে উঠবেন। চিরতরে ছুটি হবে এই অবহেলার সম্পর্কের। আচ্ছা তারপর কেমন কাটবে আমজাদ সওদাগরের দিন?
চিরজীবন একাকীত্ব জোর করে বেছে নেওয়া মানুষটা যখন প্রকৃত প্রদত্ত একাকীত্ব পাবেন তখন কেমন লাগবে তার? সহ্য হবে কি সেই শূন্যতা?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বনফুল একবার এদিকে দৌড়াচ্ছে তো আরেকবার নিজের বাড়িতে। একদিকে ভাইয়ের বিয়ে আরেকদিকে বান্ধবীর। কাকে ছেড়ে যে কাকে দেখবে সে!
চিত্রার কাছে সবকিছুই এক নির্মল স্বপ্নের মতন লাগছে। বহু দিন আগে একবার বউ সাজার স্বপ্ন তার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছিলো। আজ সেই আবার এক স্বপ্ন জোরা লাগছে। বুকের ভেতর ভয়টা আজও কাটেনি। এত ভালো তার কপালে আছে দেখলেই ভয় হয় তার। কিন্তু পাওয়ার লোভও কি আর ছাড়তে পারে?
টুইংকেল আর চাঁদনী মিলে ছাঁদের চারপাশে ফুল লাগাচ্ছে। কাঁচা ফুলের ঘ্রাণে চারপাশটায় যেন পবিত্রতা ছেয়ে গিয়েছে। বনফুল আর তুহিন সাজাচ্ছে বসার জায়গাটা। আজকে বনফুলের মনে বিশাল আনন্দ।
তুহিন একবার সেই আনন্দে উচ্ছ্বাসিত মেয়েটার দিকে তাকাল। হাসিমুখে বলল, “বরপক্ষ সময়ের আগে কনের বাড়িতে চলে আসে এই প্রথম দেখলাম। এ কেমন বরপক্ষ শুনি!”

বনফুল মাথা উঁচু করে তুহিনের মুখের দিকে তাকালো। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল,
“আমি এখন বরপক্ষ নই, আমি কনেপক্ষ। আমার বান্ধবীর বিয়ে বলে কথা!”
“বান্ধবীর বিয়েতেই এত আনন্দ! নিজের বিয়েতে তো তোমাকে আনন্দের ঠ্যালায় খুঁজেই পাওয়া যাবে না।”
বনফুল এবার কিছুটা লজ্জা পেলো। ও তো বরাবরই লাজুক মেয়ে। লজ্জায় মুখটা নামিয়ে নিলো খানিকটা।
মন্থর স্বরে বলল,
“আমার বিয়ের দেরি আছে এখনও।”
তুহিন ঠাট্টা করল, “কতটা দেরি?”

“যতটা দেরিতে চিত্রার ভাইয়ের সকল দুঃখ দূর হবে, ততটা দেরি।”
তুহিনের এতক্ষণের হাসি হাসি মুখটার হাসি কিছুটা দমে এলো। মাথা নামিয়ে নিলো সে। চোখে চোখ রাখার মতন ধৈর্য আর নেই তার।
বনফুল নিজে যেচেই এই সংকোচ দূর করাতে বলল,
“আমি জানি আপনি এখনও সংশয়ে আছেন। তবে চিন্তা করবেন না, আগের পাগলাটে বনফুল আমি নেই। আমি এখন মন বুঝতে জানি। আমি জানি, জোর করে সব হয় কেবল ভালোবাসা-বাসি হয় না।”
বনফুলের বিজ্ঞ কথায় তুহিন হাসলো ফের। হাতের কাজে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,

“চিত্রা আগে তোমাদের সংসারে গিয়ে বসুক এরপর না-হয় আমাদের বিয়ের তারিখটা ঠিক হবে। কী বলো?”
তুহিন যে সরাসরি বিয়ের কথা বলবে তা বনফুলের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিলো। সে হতভম্ব হয়ে বুঝার চেষ্টা করল তুহিন এই মুহূর্তে কী বলল.
এবং বুঝার সাথে সাথে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো। লজ্জায় আরও আরও নুইয়ে গেলো। যাকে পাবে না ভেবে একদিন সে বোকামি করেছিলো তাকেই সৃষ্টিকর্তা তার করে দিয়েছেন। অথচ বোকা মেয়েটা কেঁদেকেটে জীবন নষ্ট করে ফেলেছিল কতটা!

ঢিমে শোরগোলে ব্যস্ত ছাদের চারপাশটা।
চিত্রার শরীরের জড়ানো সেই পুরোনো লাল রঙের শাড়িটা। যেটি পরে সে দাঁড়িয়েছিলো কাজি অফিসের সামনে বহুক্ষণ। কিন্তু তাকে অপেক্ষায় রেখে বাহার ভাই আর কথা রাখতে সেদিন পৌঁছাতে পারেননি।
বুকে মেয়েটার ঢিপঢিপ শব্দ। প্রবাদ বাক্য আছে না- চুন খেয়ে মুখ পুড়ে, দই দেখলেও ভয় করে? চিত্রার হয়েছে এক দশা। আশা করে এমনই আশা ভঙ্গ হয়েছে যে আজকাল সবটা পূর্ণতা পাবে জানার পরেও ভয় করে। মনে হয় কেবল কোথায়, কোন অপূর্ণতা রয়ে না যায় যেন!

মোটামুটি ছাদে সওদাগর বাড়ির প্রত্যেকে উপস্থিত। বাহার ভাইদের আসার খবর নেই। তুহিন, চাঁদনী গিয়েছে জামাই আনতে। বিকেলের মিহি বাতাস বয়ে যাচ্ছে। চিত্রা এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ছাদের দরজায়। যতক্ষণ না মানুষটা আসছে ততক্ষণ সে নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারবে না। পারছে না।
ঠিক তখনই ছাদে উঠে এলো বনফুল। সুন্দর সাজগোজে তাকে লাগছে রূপবতী। মেয়েটার ছোটো ছোটো চোখগুলো চকচক করছে। বনফুলের সাথেই এলো নোঙর। শাড়িতে তাকেও কোনো দিকে কম সুন্দরী লাগছে না।
চিত্রার বুকের ঢিপঢিপ আরও তীব্র হলো। চোখের সামনে ভেসে উঠল আগের সেই চিত্রগুলো। তার সাজগোছ, আয়োজন করে বিয়ে করতে যাওয়া, বাহার ভাইয়ের অপেক্ষায় বসে থাকা, মানুষটার অনুপস্থিতি, চিত্রার ভেঙে পড়া, চুল কেটে ফেলে, আ ত্ম হ ত্যা করার চেষ্টা… কী করেনি সে! কী করতে বাদ রেখেছিলো আর?

সেই সব স্মৃতিই আজ বড্ড মনে পড়ছে তার। কেমন দমবন্ধ লাগছে। ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে অন্তরটা।
ঠিক তখনই সে অনুভব করল তার কাঁধে কেউ শক্ত হাত রেখেছে। ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
চিত্রার শরীরটা অস্বাভাবিক ঘেমে গিয়েছে। সে ঘোর থেকে বেরিয়ে পাশের মানুষটার দিকে তাকালো। দেখলো বাবা দাঁড়িয়ে আছে তার। মেরুন পাঞ্জাবিতে কী সুন্দর লাগছে আব্বুকে!
চিত্রা চোখ ঘুরিয়ে দরজায় তাকাতেই দেখলো তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষ উপস্থিত হয়েছে। পরনে সাদা পাঞ্জাবি মানুষটার। কী সুন্দর লাগছে আজ তাকে! ছিমছাম, পোড়া ঠোঁটের পুরুষটি যেন আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম পুরুষ হয়ে গিয়েছে। হাসি ঝুলিয়েছেন মুখটায়।
এই দৃশ্য দেখে চিত্রার শরীর কেঁপে উঠলো। চোখ ঘোলাটে হলো জলে। সে বাবাকে জাপ্টে ধরল। এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ, নিজের মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হওয়া, সবই তার ভেতর এক অদৃশ্য যু দ্ধ তৈরি করেছে।

এই প্রথম সে বাবাকে জাপ্টে ধরল। এবং কেবল ধরেই শান্ত হলো না। বিড়বিড় করে বললও,
“আব্বু, আমি সত্যি দেখছি তো? আমার সাথে সব ভালো হচ্ছে?”
নুরুল সওদাগর মেয়ের আকুলতায় হাসলেন। চোখে উনারও জল এসেছে। এই বাড়ির প্রত্যেকেই চিত্রার বিভীষিকাময় দিনগুলোর প্রমাণ যে! কীভাবে মেয়েটা গুমরে মরেছে রোজ তা যেন সকলেই দেখেছে। নাক-মুখ দিয়ে অব্দি মেয়েটার গলগল করে রক্ত পড়তো এতটাই ভেঙে গিয়েছিলো। আজ সেই চিত্রার আনন্দের দিনে সবারই চোখ ছলছল করছে।
নুরুল সওদাগর মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। কোমল কণ্ঠে বললেন,
“তোমার সাথে এখন থেকে সবই ভালো হবে। ঐ দেখো বখাটে ছেলেটা চলে আসছে কেমন হাসি হাসি মুখ করে তোমাকে নিতে। আর কোনো কষ্ট পেতে দেবে না ও তোমায়। কেঁদো না। আজ তোমার আনন্দের দিন। এতদিন অনেক কেঁদেছো।”
বাহার ভাই দূর থেকে দেখলেন বোকা মেয়েটার কাণ্ড। এমন করে খুশির দিনে কে কাঁদে? মেয়েটা এত এত বোকা কেন!

বাহার ভাইদের বাড়ির গেইটটা বাহির থেকে ভালো করে আটকে দিলো চাঁদনী। বাহার ভাইকে নিতে এসেছিলো। বনফুল কিছু কাজ অপরিপক্ব হাতে করেছিলো বলে সে কাজগুলো আরেকটু গুছিয়ে দিয়েছে এতক্ষণে। এবার ব্যস্ততার সাথে ছুটছে। ওদিকে বিয়ের রীতি কতটুকু শুরু হলো কে জানে!
যেই তালা দিয়ে ফিরতে নিবে দেখল মৃন্ময় দাঁড়িয়ে আছে পথের বাঁকে। চোখে চোখ পড়ল দু’জনারই। চাঁদনী এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করেই নিজের বাড়িতে হনহনিয়ে চলে গেলো। নিজেদের বাড়ির দারোয়ানকে বলল বাহার ভাইদের বাড়ির দিকে খেয়াল রাখতে।
মৃন্ময় কিছুটা ছুটে এসেও চাঁদনীর লাগাম পেলো না।
বাড়িতে ঢুকে চাঁদনী তপ্ত শ্বাস ফেলল। একবারও তাকালো না পেছনে। বরং বিড়বিড় করে বলল,
“কোনো পিছুটান আমায় বাঁধবে না, মৃণ্ময়। আর একটি মিনিটও আমি ভুল মানুষে ব্যয় করব না।”
মৃন্ময় দাঁড়িয়ে রইল হাপুস নয়নে। বুক ভার লাগছে তার।

বাড়ির হৈচৈ কিছুটা শিথিল। নানান ঝড়ের পর অবশেষে চিত্রার বিয়েটা হয়েই গেলো। এখন সবগুলো গিয়েছে বাহার ভাইদের বাড়িতে বউ নিয়ে। সেখানেই হয়তো আনন্দের আসর বসেছে।
সওদাগর বাড়ির বয়স্করা এখন যে যার রুমে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। কেবল অবনী বেগম ব্যতীত। তিনি ব্যাগ গুলো গুছিয়ে নিচ্ছেন। আপাতত জামাকাপড় ছাড়া কিছুই তেমন নিবেন না।
আমজাদ সওদাগর শুয়ে আছেন অনেকক্ষণ ধরেই। ঘুমাননি তা অবনী বেগম বেশ জানেন। অনেকটা সময় নীরবতার পর আমজাদ সওদাগর বলে উঠলেন,
“চেরিটা এত মানুষ রেখে গিয়ে একা থাকতে পারবে?”
নীরবতার মাঝে আমজাদ সওদাগরের কণ্ঠটা ঝনঝন করে উঠল।
অবনী বেগম নিরুৎসাহী স্বরে উত্তর দিলো, “মানুষ অভ্যাসের দাস। অভ্যাস হয়ে যাবে ওর।”

“ও এখানে থাকার বায়না করেনি?”
“না। তুমি হয়তো জানো না, তোমার দু’টি মেয়েই খুব বুঝদার। ওরা আবহাওয়া দেখলেই বুঝতে পারে কার মনে কী চলে। চেরিও বুঝতে পেরেছে।”
“সব নিয়েছো ঘুছিয়ে?”
আমজাদ সওদাগরের এই প্রশ্নটির পর অবনী বেগম সরাসরি তাকালেন আমজাদ সওদাগরের দিকে। আমজাদ সওদাগরের কপালে হাত। চোখ দু’টি বন্ধ রেখেই একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন।
অবনী বেগম ছোটো শ্বাস ফেললেন। ম্লান কণ্ঠে বললেন,
“সব তো নেওয়ার অধিকার আমার নেই, আমজাদ। থাকলে সবার প্রথমে…”
থামলেন অবনী বেগম। আমজাদ সওদাগর আর পুরো বাক্য শোনার কৌতূহল দেখালেন না। জানতে চাইলেন না সবার প্রথমে অবনী বেগম কী নিতেন।
স্বামীর উদাসীনতায় অবনী বেগমের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মনে মনে বলল,
“অধিকার থাকলে সবার প্রথমে তোমায় নিতাম, আমজাদ। কিন্তু তা যে আমার নেই। সব আর নেওয়া হলো কই!”

মাথার উপর জ্বলজ্বল করছে চাঁদ। সন্ধ্যা সবে বিদায় নিয়েছে। বাড়ির সামনে রাস্তাটায় সওদাগর বাড়ির সকলে উপস্থিত। চাঁদনী ও টুইংকেলকে এয়ারপোর্ট অব্দি ছেড়ে দিয়ে আসবে সকলে। কেবল থাকবে বাহার ভাই আর চিত্রা।
চিত্রার শরীরে জড়ানো এখন গাঢ় খয়েরী রঙের জামদানী শাড়ি। শাড়িটি দিয়েছে টুইংকেল। সাথে নাকে চিকচিক করছে স্বর্ণের একটি নাকফুল। গলায়, হাতে শোভা পাচ্ছে স্বর্ণ। নতুন বউয়ের সকল চিহ্ন তার অঙ্গ জুড়ে শোভাবর্ধনের কাজ করছে।
চিত্রার চোখ ছলছল করছে। এতদিন টুইংকেলকে অপছন্দ হলেও আজকের চলে যাওয়াটা তাকে পীড়া দিচ্ছে। টুইংকেল মেয়েটার চোখেও চিকচিক করছে জল তবে মুখে বরাবরের হাসি। সে সবাইকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিচ্ছে। সবার শেষে এসেছে চিত্রার কাছে।
চিত্রা আলিঙ্গন করলো মুক্তমনে। এই প্রথম টুইংকেলকে সে স্বেচ্ছায় জড়িয়ে ধরেছে। মনে হচ্ছে কত আপনজন মেয়েটা!

টুইংকেলের এতক্ষণের চিকচিক করা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল। চিত্রা অনুভব করল মেয়েটা কাঁদছে।
চিত্রা মাথায় হাত বুলিয়ে দিল ভীষণ যত্নে। তার চোখেও জল। টুইংকেল কান্নারত অবস্থায় ঠোঁটে হাসি টানলো। চিত্রার মুখে রাখলো তার দু’হাত। চোখের মণি দুটো চিত্রার সারা মুখে ঘুরিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,
“যাই, চিত্রা। ভালো থেকো কেমন? তোমাদের সা
আমি জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটিয়েছি।”
চিত্রা টুইংকেলের দু’টো হাতই নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরল। মোলায়েম স্বরে বলল,
“যাই বলতে নেই। বলতে হয়, আসি।”

টুইংকেল হাসল। বাহার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রফুল্ল মুখে বলল,
“চিত্রাকে দেখে রাখবেন। ও যেন আর দুঃখ না পায়। আমি সব ভুললেও কিন্তু চিত্রাকে মোটেও ভুলব না।”
বাহার ভাইয়ের মুখটা মলিন। সেই মলিন মুখেই খানিক হেসে মাথা নাড়ালেন। কথা বললেন না মানুষটা।
বিদায় পর্ব শেষ হতেই সকলে চেপে বসলো গাড়িতে। পর পর দু’টো বড়ো গাড়ি বেরিয়ে গেলো তাদের চোখের সামনে দিয়ে। উড়ে গেলো তারি সাথে কতগুলো বেনামি ধূলো।
বাহার ভাই বিষন্ন স্বরে বললেন,
“চলো একটু হাঁটি। বাড়ি ফিরতে মন চাচ্ছে না।”

চিত্রা খুব ভালো ভাবে বাহার ভাইয়ের এই সুক্ষ্ম মন খারাপটি খেয়াল করলো। আজ আর সন্দেহ করল না। এগিয়ে গিয়ে ধরল বাহার ভাইয়ের হাত। মানুষটা এই হাতটির অপেক্ষাতেই ছিলেন বোধহয়। চিত্রা ধরার সাথে সাথে তিনি হাসলেন। চিত্রার হাতটি আগলে নিলেন আলগোছে।
হাঁটতে শুরু করলেন দু’জনে।
চিত্রা বাহার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার মন খারাপ হয়েছে টুইংকেল চলে যাওয়ায়?”
চিত্রার প্রশ্নে ভাবাবেগ হলো না মানুষটার। বরং স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলেন,
“এই পৃথিবীতে তোমার প্রস্থান আমাকে দুঃখ দিতে পারবে এছাড়া বাকিসবই মিছে। মন খারাপ করিনি আমি। কেবল মাঝে মাঝে সৃষ্টিকর্তার নিয়ম দেখে ভাবুক হই। তিনি সবাইকে সবটা কখনোই দেন না। প্রতিটা মানুষ কোনো না কোনো অপূর্ণতাই ঠিক ভুগে।”

চিত্রা ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করল মানুষটা কী বুঝাতে চাচ্ছে। কিন্তু সে বুঝল না মোটেও।
বাহার ভাই আর কথা আগালেন না। মুক্ত কণ্ঠে গান শুরু করলেন,
“আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়,
মনে পড়ে মোরে প্রিয় ও,
চাঁদ হয়ে রবো আকাশেরও গায়
বাতায়ন খুলে দিও।
সেথা জোছনার, আলোরও কনিকা
যেন সে তোমার, প্রেমেরও কনিকা,
কলঙ্ক সাথে, জড়ায়ে রয়েছে..
প্রেমের কলঙ্ক সাথে, জড়ায়ে রয়েছে
আঁখি ভরে নীড়ও প্রিয়ও
চাঁদ হয়ে রব আকাশেরও গায়
বাতায়ন খুলে দিও…”
বাহার ভাইয়ের কণ্ঠে গান আরও মধুময় হয়ে উঠল। রাতটা হয়ে উঠল আরও স্নিগ্ধ। এমন একটা রাতের জন্যই তো চিত্রা বেঁচে ছিলো। এমন একটা রাতের অপেক্ষায় সে কত রাত ঘুমোয়নি। মানুষ এজন্যই আশায় থাকে। আশাতে এজন্য মানুষ বাঁচে।

এয়ারপোর্টে জন সমাগম। এনাউন্সমেন্ট হচ্ছে প্লেন ছাড়ার।
আফজাল সওদাগর চাঁদনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। রোজা সওদাগর দু- এক ফোঁটা কাঁদলেন।
চাঁদনী আশ্বস্ত করল উনাদের। ফিরে আসবে বলে জানালো। তার পাহাড় চড়া শেষ হলেই সে ফিরে আসবে।
মানুষের জন সমাগম ঠেলে, সকল কাজকর্ম শেষ করে চাঁদনীরা প্লেনে উঠল। চাঁদনী আর টুইংকেলের পাশাপাশি সিট পড়েনি। চাঁদনীর পেছনের সারিতে পড়েছে টুইংকেল। চাঁদনী টুইংকেলকে বসিয়ে দিয়ে নিজে গিয়ে বসল সিটে।
জানালাে পাশেই সিট পড়েছে তার।

সিটে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে ধন্যবাদ দিলো নিজের প্রাক্তনকে। অনেক সময় জীবনে বড়ো ধাক্কা না খেলে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায় না। নিজে কী চায় সেটা বুঝে উঠতে পারে না। শাহাদাত তাকে না ছাড়লে সে কখনো স্বপ্নের পথটা খুঁজে পেতো না। পুরোটা জীবন কাটিয়ে দিতো নিজের অসম্পূর্ণ স্বপ্ন নিয়ে।
ভাগ্যিস! শাহাদাত ছেড়েছিলো তাকে। এজন্য লোকে বলে, উপরওয়ালা যা করেন, ভালোর জন্য করেন।
প্লেন ছাড়ার জন্য প্রায় প্রস্তুত। তখনই হন্তদন্ত হয়ে চাঁদনীর পাশের সিটে এসে একজন ধপ করে বসল। এমন বসার ভঙ্গিতে চাঁদনী কিছুটা বিরক্তই হলো। কপাল কুঁচকে পাশ ফিরে তাকাতেই ভূত দেখার মতন চমকে গেলো। বিস্ময় নিয়ে প্রায় চেচিয়ে উঠলো,

“আপনি, শৈল! এখানে?”
চাঁদনীর বিস্ময়ে চোখ বড়ো বড়ো করে হাসলো শৈল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“আপনি না-হয় পাহাড় দেখতে যাবেন, আমার চাঁদ দেখার শখের কী হবে শুনি? তাই চাঁদ দেখার লোভে আমিই ছুটলাম।”
চাঁদনী বিস্ময়ে হা হয়ে গেলো। কথা বলার ভাষা খুঁজে পেল না। তবে মনে মনে সে শৈলর উপস্থিতি আশা করেছিলো এয়ারপোর্টে। নিজে বার বার বলেছিলো চলে যাওয়ার তারিখের কথা, সঠিক সময় সমেত। শৈলকে দেখতে না পেয়ে কিছুটা হতাশ হলেও পরবর্তীতে নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু শৈল যে একেবারে পাশের সিটটা বুকিং করে ফেলছে সে কী আর তা জানতো!
চাঁদনীর এই বিস্ময়ে শৈল চমৎকার হাসল কেবল।

প্লেন আকাশ ছুঁয়েছে বেশ খানিকটা সময় হলো। টুইংকেল সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখল। আপনমনে চোখ দিয়ে তার জল গড়াচ্ছে। লুকানোর কোনো চেষ্টা নেই। কেবল বিড়বিড় করে বলল,
“চিত্রা, তুমি ভাগ্যবতী ভীষণ। এই দেখো, এত যুদ্ধের পর তুমি সব আবার ফিরে পেলে দ্বিগুণ ভাবে আর আমি হারানো সৈনিক। এই যে তোমাদের সাথে আমার এত ভালো মুহূর্ত কাটলো তা আমি ভুলে যাবো ভাবলেই ভেঙে যাই। মাথার ভেতর বাসা বেঁধেছে টিউমার। তাকে সরানোর বিনিময়ে মুছে যাবে কত স্মৃতি! মুছে যাবে তুমি, মুছে যাবে বাহার ভাই, মুছে যাবে তার কণ্ঠ। আমি কতটা অসহায় দেখো! আমার দুঃসময়ে আমাকে ভালোবাসে বলা দাবি করা লুসেফ আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল। আমাকে ভরসা দেওয়ার কোনো শক্ত হাত রইল না। তাই তোমাদের দেখে গেলাম। প্রথম ও শেষবারের মতন। আমি হয়তো বেশিদিন এই সাক্ষাৎ মনে রাখতে পারব না। তুমি মনে রেখো আমায়। তুমি মনে রেখো, তোমাদের প্রেম দেখে ভীষণ ভালোবাসার লোভ জন্মানো মেয়েটা চির দুঃখী। তার সাথে প্রতারণা কেবল প্রেমিক নয়, করেছে ভাগ্যও। তাকে তুমি মনে রেখো, চিত্রা।”

টুইংকেলের দীর্ঘশ্বাস কী জানি ছুঁয়ে গেলো কি-না চিত্রাকে!
তবে এয়ারপোর্টের সামনে বসে থাকা মৃন্ময় হা করে তাকিয়ে রইল মাথার উপর দিয়ে যাওয়া উড়োজাহাজটির দিকে। এইতো তার ইন্দুবালা আবার চলে গিয়েছে। তার কাছ থেকে বহুদূরে। ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে।
মৃন্ময়ের মতন চঞ্চল ছেলেটা কাঁদল আজ। ফুটপাতের কিনারায় ভিক্ষুকের মতন বসে বসে কাঁদল।
এই পৃথিবী বড়োই আজব। সকল পরিপূর্ণতার গল্পে একটা অপরিপূর্ণতায় ঘেরা মানুষকে ঠিক তৃতীয় ব্যক্তি করে রেখে দেয়।
প্রতিটা সুখী গল্পের পেছনে একটি দুঃখী গল্প ঠিক রেখে দেয়।
এজন্য লোকে বলে— তোমাকে আমার পেয়ে যাওয়া মানেই কোনো একজন তোমাকে কী বাজে ভাবেই না হারালো!
আচ্ছা,
যারা এই যে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে গল্পে দুঃখী চরিত্র হয়ে থাকে তারা এই হারানোর যন্ত্রণা কেমন করে পুষে?
নিশ্চয় ভীষণ যতনে সেই যাতনা বুকে রেখে দেয়। সবার অগোচরে। তারা ছাড়া কেউই জানে না, বুকের জমিনে প্রেমের কবরে রোজ কত কোটি গোলাপ ফোটে।

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৪১

সওদাগর বাড়ির গেইটে সকল গাড়ি এসে পৌঁছালো। একে একে সবাই গাড়ি থেকে নামলেও অনুপস্থিত রইলেন অবনী বেগম ও তার মেয়ে চেরি।
আমজাদ সওদাগর অন্ধকার বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। তিনি অপেক্ষা করেছিলেন এই বোধহয় অবনী ফিরবে। অথচ ফিরেননি।
সারাজীবন অবনী বেগম অপেক্ষা করেছিলেন। এখন থেকে তার সেই অপেক্ষার ছুটি।
এবার অপেক্ষার পালা আমজাদ সওদাগরের।
পৃথিবী যে ঋণ রাখে না। সব ঋণ শোধ করে দেয়। হয় সুদে নয়তো আসলে।

সমাপ্ত