রং পর্ব ২৬

রং পর্ব ২৬
তন্নী তনু

— আর একবারও এসব টলারেট করবো না। এই কঠিন হৃদয়, পাথরের মন কোনো কিছু দিয়েই তুমি স্পর্শ করতে পারবে না। শুধু শুধু বৃথা চেষ্টা করে নিজেকে কষ্ট দিও না।
— ভুল মানুষের আঘাতে যে হৃদয় পাথরে পরিণত হয়েছে আমার হৃদয়ের শুদ্ধতম ছোঁয়া দিয়ে সে পাথরে আমি ফুল ফুটাবোই। ইটস মাই চ‍্যালেঞ্জ।
— বাসায় চলো…..
— আমার ট্রিট??
ইরফাদ কোনো কথাই যেনো শোনে না। সোজা বাইকে বসে।আর সামনে তাকিয়ে থাকে। না বলে কথা না দেয় ইশারা। সিনথিয়া বাচ্চা বেড়ালের মতো ভয়ে সিটিয়ে গিয়ে বাইকে বসে। ধরে বসার সাহস নেই। ইরফাদের চোখ মুখ শক্ত। কাঠকাঠ গলায় সে বলে,

— ধরতে নিষেধ করিনি।
সিনথিয়া বিষ্মিত চোখে তাকায়।এই মূহুর্তে তার উপর রুষ্ট হওয়া ইরফাদ তাকে ধরে বসতে বলছে। তার কল্পনার মধ‍্যে ইরফাদের কঠিন উত্তর,
— ইটস জাস্ট আ ফর্মালিটি।নাথিং টু বি হ্যাপি ফর দিস।
সিনথিয়ার প্রশস্ত হওয়া ওষ্ঠ পূর্বের জায়গায় ফেরে।এই লোক তাকে উঠতে বসতে অপমানিত করবে। এর চেয়ে চুপ থাকা ভালো। ফেরার পথ মনটা ক্রমশ খারাপ হয়ে আসছে তার। এর চেয়ে ভালো ছিলো কিছু না বলা। আরেকটু সময় অন্তত পাশে থাকতে পারতো। খোলা আকাশে নিজের অনুভূতির ডায়েরিটা না মেলে ধরলেই হতো। জোর করে কি ভালোবাসা হয়। অপর প্রান্তের মানুষটাকে যদি অনুভূতিই স্পর্শ না করে। নিজেকে নিজের মধ‍্যে গুটিয়ে নেয় সিনথিয়া। তারপর বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— একটা পারসোনাল কোয়েশ্চেন করা যাবে??
ইরফাদ একটা শব্দ উচ্চারণ করে,
–বলো..
সিনথিয়া সামনের দিকে মুখ বাড়িয়ে বলে,
— আপনি কি আপনার এক্সকে এখনো ভালোবাসেন? না মানে আপনি কি কখনো বিয়ে করবেন না??
— আমি একবারো বলেছি? বা কোথাও এটা লেখাছিলো! তাকে ভালোবেসে আমি সন‍্যাসী হতে চাই!
— তা নেই… তাহলে…
— তাহলে কিছু না। ইমোশন দিয়ে বিচার করার বয়স আমার নেই। বিয়ে অবশ‍্যেই করবো। তবে এইসব পাগলামির কোনো জায়গা নেই। এই জন‍্যে হাই এলার্ট তোমার জন‍্য—

— সত‍্যি!
— “ইটস আ লং টার্ম, লং প্রসেস।” একদিনে এখানে আসিনি। দিজ আনব্রেকেবল,মেটাল হার্ট কান্ট টাচ বাই এনিথিং। যদি আমি না চাই।
–ভালোতো বেসে ফেলেছি। ভালোবাসা তুলে নিবো কি করে…. এটা কি সম্ভব?
— ঐটা ভালোবাসা না। সিমপ‍্যাথি। ডায়েরি পড়ে তোমার মনে সফট কর্ণার তৈরী হয়েছে। ঐজন‍্যে মনে হচ্ছে এইসব।
— তাহলে যারা জানে না তারা কি আপনাকে ভালোবাসেনি??
— কেউ আমার পজিশন আর কেউ আমার ক্ষমতাকে ভালোবাসে। বাকি সব পাগলামি। আর এসব আমার মানতে গেলে- দেশের অর্ধেক মেয়েকেই আমার বিয়ে করতে হবে।
— তাহলে কেমন মেয়ে বিয়ে করবেন?
–সে সব তোমার জানতে হবে না।নিজের লিমিটের মধ‍্যে থাকো। তোমাকে ট্রমা থেকে দূরে রাখার জন‍্যে আমি অলওয়েজ ফ্রেন্ডলি তবে আ”ম নট ইউর ফ্রেন্ড।
সিনথিয়া পরের প্রশ্ন করতে ভয় পায়।তাই নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখে। এখন প্রশ্ন করলে বলা যায় না মাঝরাস্তায় ফেলেও রেখে যেতে পারে।

সকাল সকাল শুভ্র সতেজ অনুভূতি। সিনথিয়া মিষ্টি মিষ্টি অনুভূতি নিয়ে ঘরে ফিরেই ঘুমে ডুবে যায়। ঐদিকে তিথির চোখে রাজ‍্যের ঘুম।শরীর দূর্বল লাগছে খুব। তবে ঘুমানোর উপায় নেই। রাজ‍্যের কাজ জমে আছে। হাতে হাতে কাজ করে দিয়ে আজ একবার সিনথিয়াকে দেখে আসবে। মনের দুটো কথাও বলা দরকার। সাগর পরিমাণ কথা জমে গেছে।
রিমা ঘুম থেকে উঠে ঘর গোছায়। ভাঙা হৃদয় জোড়ালাগা এতো সহজ না। রাত দিন চোখ ভিজে থাকে। আর পারা যাচ্ছে না। যে মানুষটা তাকে ঠকিয়েছে। তাকে এই দূর্দশার দিকে ঠেলে দিয়েছে। যার জন‍্যে এই করুণ পরিণতি তবুও তার কথাই মনে পড়ে। আসলে না পাওয়া জিনিসের প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা বেশী। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রিমা। আর পারা যাচ্ছে না। নিজেকে গুছিয়ে না নিতে পারলে নিজের সাথে বাচ্চাটার জীবন হুমকির মুখে পড়বে।বাঁচতে যখন হবেই শক্ত হতেই হবে।

সিনথিয়া গভীর ঘুম।পাশে বসে আছে তিথি। আলতো হাতে সিনথিয়ার মাথায় আঙুলি চালাচ্ছে তিথি। তবুও ডাকছে না। অনেকটা সময় খুব যন্ত্রণায় কাটিয়েছে মেয়েটা। তারা মেয়েটার জন‍্যে কিছুই করতে পারেনি। তিতা হলে সত‍্য কারো জন‍্যে কারো জীবন থেমে থাকে না।একই পৃথিবীতে একই সময়ে কারো জীবন সুখময় আর কারো জীবন কষ্টে জর্জরিত। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। এই নিয়ম উপেক্ষা করার সাধ‍্য কারো নেই। সিনথিয়া ঘুমের ঘোরে চোখ আলতো করে চোখ খোলো। তারপর লাফিয়ে উঠে বসে বলে,
— তুই??
— আস্তে….
–কখন এলি??
— বেশীক্ষণ না পাখি। কেমন আছিস বল।
— আলহামদুলিল্লাহ্! আলহামদুলিল্লাহ্! আলহামদুলিল্লাহ্।
— আরে এতো খুশি যে??
— কেনো শোক করে মরে যেতে বলিস?
— মোটেও না পাখি! যত তাড়াতাড়ি রিকভার করবি ততোই ভালো। ভুল আকড়ে বেঁচে শুধু সময় নষ্ট।
— হুমমম! স‍্যার না বুঝালে বুঝতাম ই না?
— কোন স‍্যার??
— এসপি সিনহা…
— ওহ! মাই গড… সে তোরে মোটিভেশনাল স্পিচ দেয়। দেখে তো মনে হয় গম্ভীর,রাগী! কথাই বলে না।
— প্রয়োজনের চেয়ে বেশী বলে না। তবে আমাকে খুব সাপোর্ট দিয়েছে।
— স‍্যারের কথা সবাই জানে। তিনি খুব অনেস্ট একজন পুলিশ অফিসার। তার পারসোনালিটি চোখে পড়ার মতোই।
সিনথিয়া মাথা ঝাকায়। আর বলে,

— হুমম
তিথি দুটি ভ্রু কুচকে নেয়। তারপর বলে,
— কথা বলতে ব্লাস হচ্ছিস কেনো?? এমন তো তুই ছিলি না। সামথিং ইজ রং…
–ভালোবেসে ফেলছি।
–মানে?
— মানে ভালোবেসে ফেলছি তারে।
— আর ইউ সিরিয়াস??
— ইয়েস! হান্ড্রেড পার্সেন্ট।
— জানে?
— হুমম। কিন্তু পাত্তা দেয় না।
— এসপির সাথে প্রেম এটা একটু কেমন না?? এটা কি সম্ভব?
— অসম্ভবের কি আছে?
— না! তবে স‍্যার সহজে মেনে নিবে না। তার উপর এইজের একটা গ‍্যাপ।
— তাতে কি! ভালোবাসা দিয়ে এই গ‍্যাপ পূরণ করে নিবো।
–আরেএএএএ তুই তো এমন ছিলি না।রাফি ভাই কে এত দ্রুত কি করে ভুলে গেলি??
— একটা বিবাহিত প্রতারকের জন‍্যে জেল খেটেছি। আরও ধরে রাখতে বলিস?? রিপ্লেসমেন্টের জন‍্যেও কাউকে বসিয়েছি। আমার শান্তি দরকার।
— যা হয়েছে ভালো হয়েছে পাখি। জীবন সুন্দর। কষ্ট খামছে ধরে থাকা একটা ভুল।ভুল থেকে যতো দ্রুত রিকভার করা যায় ততো ভালো।

— রাফির কথা কখনো উচ্চারণও করবি না। ভুলে যেতে চাই। মুছে ফেলতে চাই ভুল।জীবন সুন্দর। জীবনকে সুযোগ দেয়া প্রয়োজন।
–ঠিক পাখি। এতো দ্রুত তুই বুঝবি ভাবিনি।
–বুঝে কি হবে বল,” আবার নতুন করে পুড়ছি।”
–কেনো??
— “সে কথা বলতে চায় না আমি কথা না বলে থাকতে পারিনা।”
— সব ঠিক হয়ে যাবে পাখি। একদিন তার জীবনের সবচেয়ে মূল‍্যবান সময় তোর জন‍্যে তোলা থাকবে।
— আশা দেখাস না। পরে কষ্ট পাবো।
— মানুষ যদি সঠিক হয় তার প্রতি আশা রাখা ভালো। সবাই তো আর কাপুরুষ না। সবাই ঠকাবে এমন ও না।
— বাহ বাহ তিথি! এতো চেঞ্জ। তাও প্রেম নিয়ে মোটিভেশন? চিনতে পারছি না।
তিথি নিজের হাত দুটোর মধ‍্যে সিনথিয়ার একহাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। তারপর বলে,
— আমার জীবন বদলে গেছে। সব পালটে গেছে পাখি।
সিনথিয়া এগিয়ে বসে।কৌতুহল দৃষ্টি ফেলে তাকায়।
— আমার জীবনটা স্বপ্নের মতো হয়ে গেছে। শিশির আমাকে বিয়ে করেছে।
সিনথিয়া হা হয়ে যায়। “কি করে সম্ভব?” কৌতুহলে সিনথিয়া তিথিকে ঝাপটে ধরে,

— আল্লাহ্! এ আমি কি শুনছি…
— তোরা দু”জন ই ট্রমাটাইজ তাই বলার সাহস পাই নি।
— যতো কষ্ট, যন্ত্রণার মধ‍্যে থাকি তোর খুশিতে আমরাও খুশি। নজর না লাগুক।
–কিন্তু বিয়েটা তো লুকিয়ে করেছি পাখি।
— তোর যে মামি জানলে কি হবে??
— ঐটাই ভয়।
–পুরুষের বহুরূপ আমার ভয় করছে।
— শিশির সত‍্যিই ভালোবাসে। আর অনেক ভালোবাসে।
— ভালো তো রাফিও বাসতো…. না জেনে না বুঝে পা বাড়িয়ে কি ফাঁসা টা না ফাঁসলাম।কতোগুলো দিন গারদে ছিলাম।
— মন খারাপ করিস না। পৃথিবীর সব পুরুষ কাপুরুষ নয়। কিছু পুরুষ সুপুরুষ ও হয়।
–যাই হোক!তোর জীবনের ভালোবাসার মানুষটা সঠিক হোক।ভালোবাসায় সিক্ত করে রাখুক তোকে।

ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে শিশিরের নাম। তিথি রিসিভ করে সালাম দেয়। এর পরের কথোপকথন,
— কোথায় তুমি??
— সিনথিয়ার বাসায়।
— চলে আসো। আমি আশে পাশেই আছি। পাঁচ মিনিটে চলে আসো।
তিথি সিনথিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। শিশির বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিথি উঠে বসে নির্দ্বিধায়। শিশিরের আদুরে গলা,
— সাবধানে বসো।
কঠিন জীবনে একটু আদুরে সুর পেয়ে মাখনের মতো গলে যাচ্ছে তিথি।শিশিরের পেটের কাছে একহাতে শার্ট আলতো করে ধরে তিথি। শিশির মৃদু হাসে। হাতের মধ‍্যে হাতটা নিয়ে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। তারপর নিজের পেটের সাথে চেপে ধরে। ভালোলাগার একটা অনুভূতি নিয়ে একটা শ্বাস টেনে নেয় শিশির। তারপর বলে,
— বউ তুমি আমার। এতো সংকোচ কিসের আমাকে ধরতে।
বউ শব্দটা অন্তর থেকে বার বার বেজে ওঠে। কি যে স্নিগ্ধ অনুভূতি। “বউ” শব্দটায় মোহনীয় কিছু আছে। শিশিরের মুখে বউ শব্দ শুনে শরীরে কেমন অসাড় হয়ে আসে। তিথি শিশিরের গায়ের উপর নেতিয়ে পড়ে। মাথা ঠেকিয়ে রাখে শিশিরের পিঠে। অনেকটা দূরে চলে যাওয়ার পর যখন রাস্তা প্রায় ফাঁকা। চারপাশে চোখ বুলায় তিথি। শিশিরের ঘামে ভেজা পিঠ। টি-শার্ট টাও ভিজে গেছে প্রায়। তিথি পিঠের মাঝখানে গাঢ় করে চেপে ধরে রাখে নিজের ওষ্ঠাধর।মেরুদন্ধ বরাবর শীতল স্পর্শে বাইকের ব্রেক চাপে শিশির। পৃথিবীর সবচেয়ে কোমল,স্নিগ্ধ, মোহনীয় স্পর্শ যেনো এটিই।

সিনথিয়া শাওয়ার নিয়ে হেয়ার ড্রায়ারে চুল গুলো শুকিয়ে নিচ্ছে। মন শুধু ইরফাদর দিকেই পড়ে থাকে। পাগলামি,ছেলেমানুষি দিয়ে কখনোই তাকে আটকানো যাবে না। এটা সে নিশ্চিত। তাহলে কি করে তার মন পাবে। মানুষের ভালোবাসা অর্জন করা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। সিনথিয়ার ফোনে কল আসে। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— কে আপনি??
— ভাইয়া বলছি….
— কেমন আছো??
— তোর কি অবস্থা আগে বল।
— নরমাল। ভাইয়া নতুন ফোন এসেছে একটা।
— আমি পাঠিয়েছি।
— কিভাবে?
— এতো কথা বলার সময় নেই। দুদিন রেস্ট। এর পর প্ল‍্যান জানাবো।
— কিসের প্ল‍্যান ভাইয়া…
— সময় হলেই জানবি রাখছি…
সিনথিয়া ফোন রেখেই ইরফাদকে কল দেয়। সালাম দেওয়ার পর কথোপকথন,
— ভাইয়া ফোন দিয়েছিলো।
–দ‍্যান…
— বললো- দুটো দিন রিল‍্যাক্স করতে। এরপর প্ল‍্যান জানাবে।
–ওকে সে প্ল‍্যান বানাতে থাকুক। তুমি নিউজ নিতে থাকো। পয়েন্ট টু পয়েন্ট জানাবে
— রাখছি…
— স‍্যার!
— কাজের বাহিরে একটা কথাও না।

সিনথিয়া ড্রয়িং রুমে বাবার পাশে বসে আছে। টিভি চলছে। তার বাবা নিউজের চ‍্যানেল ঘাটছে। ঠিক সে সময়েই নিউজ।
“গত দিনের মতো আজকেও আরেকটা খু*ন। মা*ডা*র হয়েছে বিশিষ্ট শিল্পপতির একমাত্র ছেলে। বিষক্রিয়ার মাধ‍্যমে তার মৃত‍্যু হয়েছে। আর এতো সুক্ষ সুনিপুণ পরিকল্পনা কারীদের দেশ চোষে বেড়াচ্ছে পুলিশ। কিন্তু মা*র্ডা*রার ধরা ছোঁয়ার বাইরে।”
এমন নিউজে কপাল কুচকে আসে সিনথিয়ার। মাথাটা টনটন করে ওঠে। এতোগুলো খু*ন, নিঁখোজ। এসবের পেছনে আছে কারা?
ঠিক সে সময় সিনথিয়ার বাবা মেয়েকে একপলক দেখেন। তারপর বলেন,

রং পর্ব ২৫

— তোকে আজ একটা গল্প শোনাবো।
— কিসের গল্প বাবা?
— ধরে নে তোর জীবনের গল্প….

রং পর্ব ২৭