রং পর্ব ৩১
তন্নী তনু
রাত নয়টা বেজে পঁচিশ মিনিট। সন্ধ্যার আগে সিনথিয়ার বাবা আর চাচা মিলে থানায় ইনফর্ম করে এসেছে। গত দিনের তুলনায় আজ থানায় তিনি খুব ভালো ব্যবহার পেয়েছেন। থানার রিজভী শিকদার পূর্ববর্তী ঘটনার জন্য অনুতপ্ততা প্রকাশ করে আশ্বস্ত করেছেন -তারা বিষোটি অবশ্যেই দেখবেন। সিনথিয়ার বাবা বেডরুমে বসে আছে। সিনথিয়ার মা কান্না করছেন। দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র মেয়ে। তার উপর এতো ঝড় তুফান। মুগ্ধ ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। এই মূহুর্তে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। কি করা উচিত! বোনের বিপদ জেনে এখনো চুপ থাকবে সে? চোখের সামনে মা”য়ের কান্না আর দেখা যাচ্ছে না। ঘরে বাইরে দু-চারবার পায়চারী করে। পেটের তলায় ভয় জমে পেট চিটে হয়ে আসছে। ছোট বেলা থেকেই সিনথিয়া তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। চুপি চুপি কতো শখ পূরণ করেছে। সে তো সিনথিয়ার চোখের মণি। অপ্রকাশিত হলেও বোনের প্রতি তো তার মায়া,ভালোবাসা আকাশ ছোঁয়া। তাই কথা গুলো আর চাপিয়ে রাখে না সে,
— আম্মু একটা কথা বলার ছিলো। আপু রাত বারোটার দিকে বাইরে গিয়েছিলো।
কথা শুনে বাকি দু”জন যেনো আকাশ থেকেই পড়ে। চোখের অগোচরে মেয়ে বাড়ির বাইরে অথচ তারা জানেই না। সিনথিয়ার বাবা হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ান। দুচোখে যেনো সত্য জানা ছাড়া আর কিছু নেই। মুগ্ধকে বাচ্চা ছেলের মতো কাছে টেনে নেন। তারপর বলেন,
— কেনো কারণ জানিস?
— না বাবা।
— তবে এর আগেও গিয়েছিলো। তবে ভোর হওয়ার আগেই চলে এসেছে।
সানজিদা বেগম যেনো তেড়ে আসেন। সজোরে থাপ্পর বসান ছেলের গালে। যেনো সব দোষ মুগ্ধ”র। চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকে মুগ্ধ। সানজিদা বেগম রেগে গিয়ে বলেন,
— এতোক্ষণে বলছিস?ভাই বোন মিলে লুকোচুরি শিখছো? পড়াশুনা জেনে মূর্খ হচ্ছো। বিয়ের বয়সী বোন রাত বিরেতে বাইরে যায় আর তুমি সাহায্য করো। খোঁজ এখন যাহ– কিছু হলে বুঝবি।
মুগ্ধ চুপচাপ থাকে। কারণ ভুল হয়ে গেছে। মুগ্ধ”র বাবা রাগে আগুন হয়ে আছে। তবে দোষ সবার ই। মেয়েকে আরও চোখে চোখে রাখা দরকার ছিলো। তিনি রাগ সংযত করে বলেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো?? আবার রাফি এসেছিলো?
— নাহ! তবে আমি না করায় একবার বলেছিলো,” ভয় পাস না এসপি সাথে থাকবে।”
এসপির কথা শুনেই সিনথিয়ার বাবা সিনথিয়ার মায়ের দিকে তাকায়। বিস্ময়ে দুজনের চোখেই প্রশ্ন। কিন্তু উত্তর কোথায়? সব কিছুর অন্তরালে কি চলছে? কি হচ্ছে?
ঘড়ির কাটা হাওয়ার চেয়েও বেগে চলছে যেনো। এখন পর্যন্ত সিনথিয়ার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। গতরাত থেকে নির্ঘুমে কাটছে সময়। পাগলা ঘোড়া মতো এদিক থেকে সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে ইরফাদ। ক্লান্তিতে চোখের পাতা ক্রমশ ভার হচ্ছে। তবে তার ক্লান্ত হওয়া বারণ। জাবিরের কল,
— স্যার! সিনথিয়ার বাসা থেকে দুই কি.মি দূরে পরিত্যাক্ত বাড়ি আছে। একবার ঐ বাড়ি চেক করা উচিত।
জাবিরের কথা শুনেই ইরফাদের মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে,” তাইতো! যেহেতু চেকপোস্টে কোনো গাড়ি চেকিং ছাড়া ক্রস করেনি তাহলে তারা খুব বেশী দূরে যায়নি। সব হোটেল চেক করলেও ঐ বাড়ির কথা তো তার মাথায় আসেনি।” ইরফাদ হাত শক্ত মুষ্টি পাকিয়ে বলে,– “শীট!”
ইরফাদ জাবিরকে বলে,” চলে আসুন,হারি আপ!”
পরিত্যাক্ত বাগান বাড়ি। লোহার মজবুত আঁটষাট করা গেইট। তালা দেয়া নেই। ভুতুড়ে বাড়ি বলে আখ্যায়িত বাড়ির তালার প্রয়োজন নেই। এমনি-ই আশেপাশে আসে না কেউ। ভারী দরজা খোলে ইরফাদ। ঘন অন্ধকার। পাশে থেকে ফ্ল্যাস জ্বালায় জাবির। গেইট থেকে ইটপাথরে বাঁধানো রাস্তা।দু”পাশে অযত্নে বেড়ে ওঠা ঘাস লতা পাতা। বহু আগে শখ করে বাগান করেছিলো মনে হয়। শুকনো মরা পাতায় রাস্তা দেখা যায় না। অদূরে মাথা উচুকরে দাঁড়িয়ে আছে তিনতলা ভবন। দেয়ালে চির ধরা, বৃষ্টি বাদলের স্পর্শে শেওলা জমে গেছে। হাতে রিভলবার, তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে এগিয়ে যায় ইরফাদ। পিছনে জাবির। একের পর এক সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে চলে যায়। মাকড়শার জাল অর ধূলোবালিতে ঘেরা প্রত্যেকটা কক্ষ। তবে দোতালার দুটো কামড়া একটু অন্যরকম। যেনো মানুষের স্পর্শ পেয়েছিলো। ইরফাদ রুমের ভেতরে যায়। একটা খাটে বিছানা পাতা। নতুন চকচকে চাদর। চাদর কুচকে আছে। মনে হচ্ছে কেউ একটু আগেও শুয়ে বসেছিলো। জাবির এগিয়ে যায়। বিছানার মাঝখানে চকচক করছে রূপালী চেইন। জাবির একপ্রান্ত ধরে। লম্বাটে আকার রুপালী চেইন চোখের সামনে ঝুলতে দেখে ইরফাদ বলে,
— এটাতো নূপুর!
— স্যার মিস সিনথিয়া কি কাল নূপুর পড়েছিলো?
–অদ্ভুত প্রশ্ন আমি কি করে জানবো।
— সরি!
স্যার আরোও কিছু থাকতে পারে। খুঁজে দেখা যাক।
সারাঘর তন্নতন্ন করে খোঁজে দুজন।বিছানা উল্টে পাল্টে ফেলে। ইরফাদ হাঁটতে হাঁটতেই পায়ের তলায় কিছু আটকে যায়। হাত দিয়ে চিকন শেকল ধরে চোখের সামনে তুলে ধরে ইরফাদ। জাবির বলে,
— কি এটা?
— কোনো অর্নামেন্টস হবে।
গোলাপ আর বেলির কলিতে সাজানো গাড়ি।অফহোয়াইট কালারের শেরওয়ানি পড়ে পাশে বসে আছে বর।গাড়ির জানালার কাচ খোলা। টানা টানা দুটো লম্বা চোখ। কারো দক্ষ হাতের সাজের ছোঁয়ায় সে চোখ মুখ যেনো অপরূপা লাগছে। গায়ে মেরুন কালারের লেহেঙ্গা, ভারী গহনা। চোখ দুটো কালো কালিতে টেনে ঢেলে দিয়ে পৃথিবীর সমগ্র মায়া। একদম সোজা পুতুলের মতো বসে আছে মেয়েটি। মুখে একটা পাতলা নেটের মুঁখোশ। পাশে বসে আছে বর। দুজনের মুখে মিষ্টি হাসি। সামনের টেকপোস্টে কারো ছবির সাথে মিলিয়ে দেখছে কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে দায়িত্বরত পুলিশ। পুলিশের সংকেতে থামলো সাজসজ্জা ফুলের ঢাকা গাড়িটি। মেয়েটির মায়াবী মিষ্টি হাসি। পেছন থেকে মেরুদন্ড বরাবর ধরা রিভলবার।পাশে বরের মিষ্টি হাসি ইঙ্গিত দিচ্ছে হাসো। মেয়েটি আরেকটু ঠোঁট ছড়ায়।দু”জন ট্রাফিক পুলিশ ছবির সাথে মিলিয়ে দেখলেন মেয়েটিকে। “না মিল নেই।” তাদের মধ্যে একজন বয়স্ক পুলিশ বললেন,
–মাশাল্লাহ্! পুতুলের মতো মেয়ে। নাম কি মা?
পেছন থেকে রিভলবার নল তার পিঠ স্পর্শ করলো। মেয়েটি মিষ্টি হেঁসে উত্তর দিলো,
— নীলা….
— তুমি দেখতে পুরোই আমার মেয়ের মতো মা! আমার মেয়েকে অনেক আগেই বিয়ে দিয়েছি। বিদেশে সেটেল। তোমাকে দেখে মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল। সুখি হও মা…
মেয়েটি মিষ্টি হাসলো। জলে ভোরে উঠলো দুচোখ।
গাড়ি পাড় হয়ে গেলো। মেয়েটির টানা টানা চোখ বেয়ে টুপ করে একফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। পেছনের শীরদ্বারা বরাবর তাক করাধ রিভলবার তাকে মিথ্যা বলালো? নাকি প্রিয়জন হারানোর ভয়ে সে মিথ্যা বললো। সিনথিয়া দীর্ঘ করে শ্বাস ফেলে। এর শেষ কোথায়? ইরফাদ কি কখনো জানবে? তাকে অনেক দূর নিয়ে যাচ্ছে। অনেক দূরে……..
সব গুলো জায়গায় একের পর এক খরব নিয়ে যাচ্ছে ইরফাদ। পরপর সাতটা জায়গায় ফোন করে খবর নিলো। এটা আট নম্বর কল,
–কোনো নিউজ?
— না স্যার! ওরকম কোনো গাড়িই এদিকে ঢোকে নি। বেশীর ভাগ মালবাহী ট্রাই। বাস গুলো চেক করা হয়েছে। বোরকা পড়াদের মুখ দেখে চেক করা হয়েছে। এই পথে একটা প্রাইভেট কার গিয়েছে। তাও বিয়ের গাড়ি।
–ওকে!
ফোন রেখেই গাড়িতে বসে ইরফাদ। গাড়ি ঘোড়াতেই তার মাথায় একটা অদ্ভুত চিন্তা আসে। প্যান্টের পকেটে রাখা অর্নামেন্টস আরেকবার বের করে। ত্রিকোন আকার স্টোনের ভারী জিনিসটির মাথায় ছোট্ট চিকন শিকলটা ধরে। জিনিসটা শূন্য দোল খায়। ইরফাদ ভাবুক দৃষ্টিতে বলে,
— এটা কি বলতে পারবেন? আই মিন কোন কাজে ইউজ হয়?
— মেয়েদের জিনিস তো আইডিয়া নেই তেমন!
— এটাকে বিয়ের সাজে কণে ইউজ করে??
–হতে পারে স্যার!
মনে পড়েছে স্যার…. এটাকে বলে ঝা…. ওহ হ্যা ঝাপটা । আমার ভাবীকে পড়তে দেখেছিলাম।
দূরে কোথাও থেকে অদৃশ্য একঝাঁক কাক এসে যেনো কু কু করে মাথা খেয়ে ফেলে ইরফাদের। পার্লারে সাজগোজ করে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো ক্রিমিনাল। বাকিরা আঁচ ও করতে পারলো না।
সাথে সাথে কল ব্যাক করে ইরফাদ,
রং পর্ব ৩০
— গাড়িটি কখন গিয়েছে?
— কোন গাড়ি
–বিয়ের গাড়ি
— ঘন্টা একটা হয়ে গেছে স্যার!
ইরফাদ স্ট্রিয়ারিং সজোরে আঘাত করে। তারপর আবারো বলে, “শীট!”