রং পর্ব ৪৬ (২)

রং পর্ব ৪৬ (২)
তন্নী তনু

বিকেল বেলাটা ধূসর মেঘের আড়ালে তলিয়ে আছে স্বর্ণালী সূর্য, ঝিরিঝিরি কোমল বাতাস বইছে। কেবিনে একের পর এক ফাইলে চোখ বুলাচ্ছে ইরফাদ। টেবিলের পাশে অবহেলায় পড়ে থাকা নতুন ফোনটা কেঁপে কেঁপে উঠছে একটু পর পরই, সেদিকে ভ্রু ক্ষেপ নেই তার। ইচ্ছেকৃত উপেক্ষা নাকি অন‍্যমনস্ক তার চোখ দেখে বোঝার উপায় নেই। ঠিক সে সময় ই লম্বা তড়িঘড়ি হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে প্রবেশ করে প্রভাত রঞ্জন সরকার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিধারী ইরফাদ চোখ তুলে তাকায়। অতঃপর সহজ স্বাভাবিক কথোপকথন,

— ইরফাদ!
— স‍্যার বলুন…
— আই থিংক তুমি আমাকে ইগনোর করছো, কতো গুলো কল দিয়েছি, ইউ হ‍্যাভ এনি আইডিয়া!
— ইয়েস স‍্যার! আই হ‍্যাভ নো আইডিয়া। কজ আ’ম সো বিজি।
— তুমি আমাকে ইনসাল্ট করছো ইরফাদ!! তুমি কি ভুলে যাচ্ছো হু আই এম?
–নো নো স‍্যার। আই নোউ হু আর ইউ।
–ইগনোর করার কারণ?
— এক কথা দু”বার বলা আমার পছন্দ না স‍্যার, ইউ নোউ দ‍্যাট।
–ইরফাদ!
— বলুন…
— কোনো মিস আন্ডারস্ট‍্যান্ডিং হচ্ছে হয়তো। তুমি আমাকে বলতে পারো প্রবলেম কি…..
— এভরিথিং ইজ গোয়িং পার্ফেক্টলি এন্ড স্মুথলি…
— আমার সিক্সথ সেন্স রং গেজ করে না ইরফাদ!!
— হাহা!আই সি..
এতটুকু বলেই প্রভাতরঞ্জন সরকারকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে যায় ইরফাদ। প্রভারঞ্জন সরকার হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মোটামুটি বড় ধরনের লোহার শেল, আলো আধারের মাঝামাঝি দুটো চেয়ার পাতা। প্রভাতরঞ্জন সরকারকে জাবির ডেকে এনেছেন মিনিট পাঁচেক আগেই। তিনি পায়ের উপর পা উঠিয়ে চেয়ারে শরীর হেলিয়ে রাজা-বাদশার মতো বসে আছেন। বলিষ্ঠ শরীরের অধিকারী সিংহের বেশে শেলে প্রবেশ করে, ইরফাদকে দেখে প্রভাত রঞ্জনের গলা,
–ইরফাদ!! মাই বয়, কি জন‍্য ডেকেছো!! নতুন কেস নিয়ে কথা বলবে?? আই নোউ মাই সান তুমি বেশীক্ষণ আমার সাথে রাগ করে থাকতে পারবে না।
নিরব, নিস্তব্ধ চারপাশ শুধু পায়ের দাপটে কেঁপে উঠছে মাটি, শক্ত পায়ের দাপটে কয়েক সেকেন্ডে চেয়ারে শীরদাড়া টানটান করে বসে ইরফাদ। পায়ের উপর তুলে দেয় পা। হাতের রিভলভারের নলে সরায় কপালে লেপ্টে থাকা চুল। পায়ের উপর পা তুলে বসার ভঙ্গিতে হালকা কেঁপে ওঠে প্রভাতরঞ্জন সরকার। তিনি নিজেই পা নামিয়ে বসেন। দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতায় তিনি ইরফাদকে ভালোভাবেই চেনেন। ইরফাদের ভঙ্গিমা অশনী সংকেত দিচ্ছে। তবুও তিনি নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলেন,

— হোয়াট হ‍্যাপেন্ড ইরফাদ? এনিথিং রং?
রিভলভারের ট্রিগারে গোল অংশ আঙুলে রেখে ঘুরাচ্ছে ইরফাদ। অতঃপর তার বিধ্বংসী রূপ, অগ্নীমূর্তী ধারণকারী ইরফাদের ক্রুদ্ধস্বর,
— চেক দিজ পেপারস। দ‍্যান ইউনিফর্ম খুলে ফেলুন!
— হোয়াই ইরফাদ! আর ইউ সিরিয়াস। তুমি কি বলছো বুঝতে পারছো?
— ইউ নোউ দ‍্যাট হু আই এম? আপনার থেকে ভালো আমাকে কেউ চেনে না।
— আমি কেনো ইউনিফর্ম খুলবো…
–যারা ইউনিফর্মের যথার্থ মূল‍্যায়ন করতে জানেন না তাদের শরীরে ইউনিফর্ম থাকা মানে পুরো আইন ব‍্যবস্থাকে অসম্মান করা। সো হারি আপ…
–ইরফাদ! তুমি আমাকে ইনসাল্ট করছো। এর পরিণাম ভালো হবে না। প্রুভ ছাড়া কারো দিকে আঙুল তোলা অন‍্যায়।
রিভলভার শক্ত হাতে তাক করে প্রভাতরঞ্জন সরকারের কপাল বরাবর তারপর অগ্নীমূর্তি ধারণ করে বলে,

— ইরফাদ ডোন্ট থ্রো স্টোনস এট গেসেজ! এতো বছরেও আমাকে চিনলেন না?
এমন কথায় শক্ত ঢোক গেলেন প্রভাতরঞ্জন সরকার। এতো বছরের অভিজ্ঞতায় তিনি তো ইরফাদকে ভালোভাবেই চেনেন। বিচক্ষণ, ধারালো মস্তিষ্কধারী ইরফাদ একাই আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে তা তিনি ভালো করেই জানেন। তবে এই মূহুর্তে স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি,আচরণ স্বাভাবিক থাকা প্রয়োজন। তিনি স্বাভাবিক গলায় বলেন,
— দেখো বাবা!
— রুলস ভুলে যাবেন না মিস্টার প্রভাত রঞ্জন সরকার।এখানে আমি সম্পর্ক পাতাতে আসিনি। চেক দিজ পেপার্স, ইউনিফর্ম ছাড়ুন…..
— ইরফাদ শোনো আমার কথাটা!
–ডোন্ট কল মি ইরফাদ। আই সে এগেইন ইউনিফর্ম ছাড়ুন।
— তুমি আমাকে ফোর্স করতে পারো না ইরফাদ। প্রুফ ছাড়া আমাকে ফোর্স করা আইনত অপরাধ।
— আমাকে আইন শেখাতে আসবেন না। আইজিপি রুস্থান কবির ত্রিশ সেকেন্ডেই কক্ষে প্রবেশ করবেন। তার নির্দেশ, আপনার হাতে আগেই পেপার্স পাঠানো হয়েছে। চেক দিজ পেপারস।
ঠিক ঐ মূহুর্ত্তেই কক্ষে প্রবেশ করেন রুস্থান কবীর। ইরফাদ উঠে দাঁড়ায়,উঠে দাঁড়ায় প্রভাত রঞ্জন সরকার। রুস্থান কবীরের হাঁকডাক গলা,

— অপরাধীর শরীরে পুলিশের ইউনিফর্ম???
বিধ্বংসী গলায় এক মূহুর্তেই গরম হচ্ছে পরিবেশ, গলার হুংকারে ফুটে উঠছে ধ্বংসলীলা। প্রভাতরঞ্জন সরকার সবটা উপেক্ষা করে নিজেও হয়ে ওঠেন অগ্নিমূর্তী। দু”জনের মধ‍্য চলে ক্ষুদ্র যুদ্ধ। অতঃপর ইরফাদের হাতের ইশারায় আলোর দ‍্যুতি পড়ে ফাঁকা দেয়ালে। ইরফাদের হাতে রিমোর্টে বাটন চেপে দেয়ালে প্রতিচ্ছবির দিকে তাকায়, মুখে বাকা হাসি। প্রভাত রঞ্জন সরকার ইরফাদের দৃষ্টির দিকে তাকায়।দেয়ালে প্রতিচ্ছবি দেখে ভেতর থেকে হালকা কেঁপে ওঠেন তিনি। ইরফাদ মৃদু হাসে। প্রভাত রঞ্জনের মুখটা কালো আঁধারে ঢেকে যায়। ইরফাদ তেরছা গলায় বলে– চিনতে পেরেছেন?প্রভাত রঞ্জন সরকার স্বাভাবিক গলায় বলেন– হ্যাঁ ওনাকে কে চিনবো না।
অতঃপর চালানো হয় কাঙ্ক্ষিত ভিডিও। প্রভাতরঞ্জন সরকার নড়েচড়ে বসেন। দেয়ালে ভেসে ওঠা চিত্রে দেখা যাচ্ছে –“একটা আবছা আলোর কক্ষে ক্রিকেট বোর্ডের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বসে আছেন সোফায়। মুখোমুখি বসে আছেন প্রভাতরঞ্জন সরকার। সাথে আছেন দেশের রাজনৈতিক এমপি মন্ত্রী।একটা ক্ষুদ্র আলাপচারিতার সাক্ষী স্বরূপ রেকর্ডের ভিডিও। একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে দেখায় ইরফাদ। গুটিকয়েক ভিডিও দেখিয়ে পজ দেয় ইরফাদ। সহসাই গুরুগম্ভীর রুস্থান কবীরের গলার স্বরে উঠে ঝড়,

–ইউনিফর্ম খোল!!!
প্রভাত রঞ্জন সরকার হো হো করে হেসে ওঠেন। নিজের হাতের রিভলবারের নল তাক করেন নিজের কপালের দিকে। অতঃপর রুস্থান কবীর বলেন,
— সাইকোটাকে তুমি দেখো । আমি আসছি….
বেড়িয়ে যান রুস্থান কবীর, ঐ সময়ে প্রভাতরঞ্জন সরকার হাসেন আবার,
–বেশী বাড় বেড়ো না ঝড়ে পড়ে যাবে…. আমার হাত কতো লম্বা তুই জানিস ও না। তোর বাপকে আমার নখের ইশারায় তুলে আনবো। এই নখের ইশারায় দেখবি তুই?
ইরফাদ পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে শরীর এলিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে। রকিং চেয়ার হলে একটু দোল খেতো। এক সেকেন্ডে লন্ডভন্ড সব কিছু। আয়েশি ভঙ্গিতে বসেই চোখের পলকে আঘাত হানে ইরফাদ। বলিষ্ঠ শক্তিশালী পায়ের আঘাতে প্রভাতরঞ্জনের হাত থেকে পড়ে যায় রিভলবার। মেঝেতে ঝনঝন করে ওঠে। অন‍্য পায়ে লাথি মারে চেয়ারে। প্রভাতরঞ্জন তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায় মেঝেতে। নিজের হাতের রিভলভারের নল তাক করে দু”পায়ে ফটাফট দুটো শ‍্যুট করে দেয়। অতঃপর রিভলবারে ধোঁয়া ওঠা গরম নলে নরম ওষ্ঠ গোল করে ফুঁ দেয় ইরফাদ। তারপর হাসতে হাসতে বলে,

— দ‍্যা এন্ড…. ধূর্ত চালাক বাঘ একদিন বেড়ালের মতো ধরা পড়ে। বলেছিলাম না?? তুই যদি হোস মাইন্ড গেইমের মাস্টার প্ল‍্যানার!! আমি হলাম সাইল‍্যান্ট কিলার।
— ইরফাদ!!
— আরে চেঁচাস না। তোকে সন্দেহের তালিকায় ফেলেছি সেদিন-ই যেদিন থানায় চিঠি এসেছে। তবে দু”য়ে দু”য়ে চার মেলাতে অনেক দূর যেতে হয়েছে আমাকে। কোল্ড ওয়ার এর কিং আমি। কে কখন কোন মূহুর্তে আমার হাতে ধরা পড়বে, আগের সেকেন্ড অবধি সে টের পাবে না।
প্রভাত রঞ্জন সরকার মেঝেতে শুয়ে শুয়েও হাসে। তারপর বলে,
–আমার হাত যে কতো দূর যেতে পারে তুই ভাবতেও পারছিস না। খেলাতো কেবল শুরু। দেখি কে জেতে? পারলে তুই আটকে দেখাস!!
— ইরফাদ কখনো কাউকে আটকে রাখে না সোজা উপরে পাঠিয়ে দেয়। ভুলে যাস না ইরফাদ নিজের রক্তকে ছাড় দেয় নি।

সিনথিয়া টুম্পাকে নিয়ে বসে আছে। বাবা-মা চলে যাওয়ার পর থেকে মনটা ব‍্যাকুল হয়ে আছে। টুম্পাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে সিনথিয়া। রাতের খাবার বানাচ্ছে ইভা। ঠিক ঐ সময়েই পরিচিত সাইরেন বেজে ওঠে। ইভা হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে যায় সিনথিয়ার কাছে। তারপর কোলে তুলে নেয় টুম্পাকে। সিনথিয়া কিছু বুঝতে না পেরে ইভার কাজকর্ম গুলো চুপচাপ দেখছে। ইভার ঠোঁটের কোনে হাসির ঝিলিক। সে হাসি হাসি মুখে বলে,
— আরে বোকা মেয়ে। ভাইয়া এসেছে বোঝনা?
সিনথিয়ার টনক নড়ে। দূরে কোথাও থেকে ঠান্ডা বাতাসের আবহে বুকটা শীতল হয়ে আসে। ইরফাদ এসেছে!!! তার ভালোবাসা!!
ইভা হেসে হেসে বলে,

— তুমি তো ভারী বোকা। বর আসছে তোমার। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকো যাও….
সিনথিয়া লজ্জায় মাথা নামায়। ইভা সিনথিয়ার থুতনিতে হাত দিয়ে বলে,
— ওরে আমার লজ্জাবতী রে। লজ্জার কিছু বলিনি সোনা। দরজা খুলে দিলে বর খুশি হয়। এই যে তোমার দু”চোখ সারাদিন আমার ভাইটাকে খুঁজে বেড়ালো দাঁড়িয়ে না থাকলে সে বুঝবে? তুমি কতো অপেক্ষা করেছো। যাও…
— টুম্পাকে নিয়ে যাই?
— বর বউ এর মধ‍্যে কারো যেতে নেই সোনাপাখি। তাতে অনুভূতি নষ্ট হয়। তুমি দেখা করে আসো। টুম্পার মামাই ভেতরে এসে টুম্পাকে কোলে নিবে। যাও যাও….

ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সিনথিয়া। ক্ষণে ক্ষণে পিছু ফেরে তাকায়। ইভা চোখের ইশারা দেয়। তারপর বলে,
— একটু জড়িয়ে ধরো কিন্তু। আমার ভাই খুব টায়ার্ড হয়ে ফেরে বউ এর ভালোবাসা দরকার।
সিনথিয়া লজ্জায় লাল হয়ে যায়। ইভা খুব বন্ধুত্বপূর্ণ পুরোই ভাইয়ের মতো। তবে মনটা একটুও শক্ত না। খুব নরম। সিনথিয়ার পরনে কালো কালারের লং কূর্তি। চুলে লম্বা বিনুনি করে দিয়েছে ইভা। নিচে যায় সিনথিয়া। উপর থেকে ইভা ডিরেকশন দিচ্ছে। ঠিক সে সময়ে রিদুয়ানুর রহমান ঘর থেকে বের হন। উপর থেকে নিচের দিকে না তাকিয়েই ইভার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলেন,
— আম্মা! দরজা খুলে দিচ্ছিস না যে? ইরফাদ আসছে তো..
ইভা আলতো করে নিজের জিহ্বায় কামড় দেয়। মনে মনে ফলে,– এই খেয়েছে। তারপর বলে,–এই তো যাচ্ছিলাম বাবা।

— থাক তোকে যেতে হবে না। আমি ই যাচ্ছি।
ইভার চোখ গোল গোল করে। যা ভেবেছিলো তাই। এখন না ছেলে বউ এর রোমান্স এর মাঝখানে পড়ে যান তিনি। ইভা তড়িঘড়ি করে বলেন,
–বাবা মনেই ছিলো না। সিনথি গেছে নিচে। তুমি রুমে যাও বাবা।
–আমি বাইরে যাবো একটু। কাজ আছে…
এতোক্ষণে কাজ, কি একটা অবস্থা।
মনে মনে বুলি আওড়ায় ইভা। কিভাবে থামাবে বাবাকে। ইভা ক্ষুদ্র চেষ্টা চালায়।
— বাবা! আমি একটা খাবার বানিয়েছি। একটু টেস্ট করে দেখো।
–ফিরে খাবো আম্মা। তুমি রেখে দাও…
— এখন একটু খাও…
— আমার কাজ আছে ইভা। ইমারজেন্সি!
–“এতোক্ষণে ইমারজেন্সি কাজ! বুরো হয়েও ছেলে মেয়ের ক‍্যামিস্ট্রি বুঝে না। অবুঝ নাকি? কখনো বিয়ে করেনি নাকি?”
মনে মনে বুলি আওড়ায় ইভা। বাবার হাঁটার গতিতে বাঁধা দিয়ে দাঁড়ায় ইভা। তারপর হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে,

— বাবা তুমি কি বিয়ে করেছিলে?
— কি বলিস মা।
— আমার তো মনে হচ্ছে বিয়েই করোনি কখনো। আর না হলে — মা তোমার জন‍্য অপেক্ষা করেনি।
–না না। আমি বাসায় ফিরলে তোর মা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতো…. বাতাস করতো..
–তোমার ছেলের বউ ও বাতাস করতে গেছে বাবা। তুমি সেখানে কাবারের হাড্ডি হতে যাচ্ছো। পাঁচ মিনিট ঘরে বসে দ‍্যান যাও…..
রিদুয়ানুর রহমান ইভার দিকে তাকিয়ে বলেন,
— আমার মেয়ে কতো বুদ্ধিমতি। আল্লাহ্ তোমার মন বরফ শীতল করে দিক মা।
বলেই তিনি রুমের দিকে ফিরে যান। সিনথিয়া দরজার পেছনে দাঁড়ায়। ভারী পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢোকে ইরফাদ। সিনথিয়া লজ্জায় কুকড়ে যায়। দরজার পেছনে মিলিয়ে যায় যেনো। ইরফাদ পা ফেলেই ধীর গলায় বলে,
— বাইরে এসো। লুকাচ্ছো কেনো?

সিনথিয়া নিজের দিকে তাকায়। তাকে না দেখেই কি করে বললো!! সে তো লুকিয়ে আছে। তাহলে বুঝলো কি করে!! ইরফাদ দরজার ভারী পাল্লা টেনে সরায়। ভেসে আসা ইরফাদের শরীরের ঘ্রানে মাতোয়ারা হৃদয়ের উল্লাসে চোখ বন্ধ করে সিনথিয়া। একহাতে চেপে ধরে নিজের চোখ। অধর যুগল অযথাই কাঁপছে। ইরফাদের জন‍্য অপেক্ষা করেছে সারাদিন,পথ চেয়ে থেকেছে, ফোনের অপেক্ষা করেছে সে। ইরফাদ কি সব বুঝতে পেরেছে? চোখ খিচে বন্ধ করে থাকে সিনথিয়া। যেনো সমস্ত পৃথিবীর লজ্জা তার উপর ঢেলে দেয়া হয়েছে। ঠিক ঐ মূহুর্ত্তে ইরফাদ কোমল পাতল ওষ্ঠাধরে টুক করে ছুঁইয়ে দেয় বরফ ঠান্ডা ওধর। অতঃপর প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা….

পৃথিবী থমকে গেছে, থমকে গেছে সিনথিয়ার অন্তর, হৃদয় আত্মা। কি হলো এটা? খানিকটা থেমে হৃদপিণ্ড দাপিয়ে ভাঙচুর করে করে নেয় সিনথিয়াকে। পায়ের তলার শিরশিরানিতে দেয়ালে পিঠ ঠেকায় সিনথিয়া। চোখের উপর হাত সরিয়ে মিটিমিটি চোখ খোলে সিনথিয়া। শূন‍্য…… চোখের সামনে সব শূন‍্য। তবে কারেন্টের গতিতে অঘটন করার ক্ষমতাধারী রাজা গেলো কই?
আশে পাশে উপরে তাকিয়ে দেখে ইরফাদ উপরে চলে গেছে,
ইরফাদ উপরে এসে গলা ছেড়ে ডাকে,

— আমার জান বাচ্চাটা কই….. টুম্পা….
দূরন্ত টুম্পা এক ছুটে বেড়িয়ে যায়। লাফিয়ে ওঠে হরিণের মতো। ইরফাদ হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নেয় টুম্পাকে। ছোট্ট ছোট্ট হামি দেয় টুম্পার কপালে। এগিয়ে আসে ইভা চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলে,
— আরে বউ কই?
— কেনো? ও তো বাসায়!! আমি কি ওকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম?
–কিন্তু ও তো নিচে গেলো…
তখন ই ধীর পায়ে উপরে আসে সিনথিয়া। ইভা সিনথিয়ার থমথমে মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করে। তবে কিছু না বুঝতে পেরে বলে,
— আর ইউ ওকে বউ।
সিনথিয়া চোখ নিবদ্ধ রেখেই মাথা কাত করে।

কফি মেকার থেকে কফি ঢেলে একটা ছোট্ট ট্রে তে দেয় ইভা। তারপর সিনথিয়াকে বলে,
— ভাইয়া ফিরে শাওয়ার নেয়।এরপর কফি খায়।নেক্সট ডে থেকে মনে রাখবে। নিজ হাতে কফি বানিয়ে দিবে। নরমালি বর বউ এর হাতের কফি খেতেই পছন্দ করে। আর ও নিট এন্ড ক্লিন। নিজের কাজ নিজেই করে। তবে ট্রাই করো ওর সব কিছু নিট এন্ড ক্লিন রাখতে। প্রতিদিনের জামা কাপড় ওয়াশ করে দিবে,আইরন করবে…. যখন যেটা চায় বের করে দিবে…
চাইলে আমি আগের মতো সব করে দিতেই পারি। তবে বরের কাজ করার মধ‍্যে মজা আছে। আমি চাই তুমি এগুলো ফিল করো ভেতর থেকে…
এতোটুকু বলেই তারা দেয় ইভা। যাও কফি দিয়ে এসো।
সিনথিয়া চুপচাপ বাধ‍্য মেয়ের মতো ট্রে হাতে নেয়। বুকের মধ‍্যে দিরিম দিরিম বাজছে। ইভা সিনথিয়ার হাঁটার ভঙ্গিতে বলে,
— তুমি কি ভয় পাচ্ছো?
সিনথিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ইভা এগিয়ে এসে বলে,
— সব ঠিক হবে। ভয় পাচ্ছো কেনো। যাস্ট ফিল করো…..

দরজায় দাঁড়িয়ে মিনমিনে স্বরে বলে সিনথিয়া,
–আসবো!!
ভেতর থেকে ভেসে আসে ঠান্ডা শীতল গলা,
— কাম..
সিনথিয়া ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে। বুকের মধ‍্যে কাঁপুনি বাড়ছে। ধীর পায়ে হেঁটে যায় সিনথিয়া। রকিং চেয়ারে দুলছে ইরফাদ।সিনথিয়া হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দেয় কফির মগ। অযথাই কাঁপছে হৃদয়, হাত, পা। কাঁপা গলায় বলে,
— আপনার চা….
বন্ধ চোখ খুলে তাকায় ইরফাদ। হৃদয়ের কাঁপন পাল্লা দিয়ে বাড়ে সিনথিয়ার। ইরফাদ শীতল গলায় বলে,
— এটা চা নয়! কফি….

রং পর্ব ৪৬

সিনথিয়ার সবটা গুলিয়ে আসছে। ভিষণ এলোমেলো লাগছে। কফির মগ এগিয়ে দেয় সিনথিয়া। সাথে সাথে বলিষ্ঠ হাতে মুঠিতে বন্ধি হয় তার হাত। ইরফাদ কফির মগ অন‍্যহাতে নিয়ে শক্ত করে ধরে সিনথিয়ার হাত। উঠে আসে ধীরে ধীরে। সিন কপালের চুলগুলো একহাতে সরিয়ে দেয় ইরফাদ। সিনথিয়া পালাতে চায়। তার আগেই ইরফাদ বলিষ্ঠ আঙ্গুলে চেপে ধরে সিনথিয়ার গাল। একহাতে তিক্ত কফির মগে প্রগাঢ় চুমুক দেয় ইরফাদ। অতঃপর তিক্ত ওষ্ঠাধর নিয়ে মিষ্টির খোঁজে ডুব দেয় সিনথিয়ার অধরে……..

রং পর্ব ৪৬ (৩)