রং পর্ব ৬০ (৩)
তন্নী তনু
শিকল জুরে দিয়ে শিশির গাড়িতে গিয়ে বসে, অতঃপর গাড়ি স্টার্টট দেয় ইরফাদ। পাশে বসে জাবির, পেছনে শিশির। পিচঢালা পথে ছ্যাচড়াতে ছ্যাচড়াতে নিয়ে যায়। পিঠের ছাল উঠতে থাকা প্রভাতরঞ্জন চিৎকার করে বলে,
— ঐ হা*রা*মির বা*চ্চা! হা*রা*ম খো*ড়। মা!তা!ল,লুছিফার! ছাড় আমাকে।
প্রভাতরঞ্জনের তীব্র ছটফটানির তালে তালে শিশির গান ছাড়ে। তবে গালাগালি শুনে শিশির মুখে উচ্চারণ করে “চ্চ”। এরপর বলে,
— স্যার! এই সং মানাচ্ছে না আপনার সাথে । ওয়েট নতুন গান দিচ্ছি।
এরপরেই প্রভাতরঞ্জনের চিৎকারের তালে তালে বেজে ওঠে,
—আই”ম আ সাইলেন্ট কিলার!!!!
আই”ম আ…… সা…….ই…..লে…ন্ট কি..লা..র!!!
ইরফাদের অন্দরমহলে তার ই অগ্নীশর্মা, প্রখরমূর্তি ধারণকারী প্রিয়তমার একগুচ্ছ চুল ভয়ংকর রূপধারী মাফিয়ার হাতের কব্জায়। শক্তিশালী হাতের মুঠোয় চুলগুলোর শক্ত টান, সিনথিয়ার চোখমুখ জুড়ে ব্যাথার ছাপ, চুলের টানে চোখ দেখে পড়ছে তপ্ত জল, নরম বিধ্বংসী সিনথিয়ার হাতজোড়া কড়া পড়া মাফিয়ার হিংস্র থাবায় বন্দি। টেনে হিচড়ে সিনথিয়াকে রান্নাঘরের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে মাফিয়া, সিনথিয়া পিচ্ছিল মেঝেতে পায়ের গতি রোধ করতে চেয়েও পারছে না। শক্তিধর হাতের দাপটে ছ্যাচড়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিচতলায় অতি সুক্ষ, কৌশলে পা ফেলছেন রিদুয়ানুর রহমান। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অস্ত্রধারী রিদুয়ানুর রহমান এই বয়সেও তাগরা যুবকের ন্যায়, রক্ত যেনো টগবগে ফুটছে। তিনি কাজ চালাচ্ছেন কৌশলে! এই বাড়ির আনাচে কানাচে তার চেনা। অন্ধকারে মিশে থেকে এক এক করে সরিয়ে দল পাতলা করছেন মাফিয়াদের। ইতিমধ্যে একাংশ উপরের কক্ষের সামনে। ইভার কক্ষের ভারী তালা ভাঙা চেষ্টায়। অন্যদিকে শক্তিধর, হিংস্র মাফিয়া কোমল সিনথিয়াকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে উপর তলার রুমের দিকে। সিনথিয়া গলা ছেড়ে ডাকছে,
— বাবা!
সিনথিয়ার আকুতি, ভয় মিশ্রিত গলার স্বর। এর আগেও মেয়েটা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলো। তেজস্বী মেয়েটা কি এইবার ভয় পাচ্ছে? রিদুয়ানুর রহমান কোনোকিছু না ভেবেই নিচ থেকেই গলা উচিয়ে উত্তর দেন।
— বাবা, ভয় পাস না আছি আমি, আমি আছি ।
সে গলার স্বরে ভরসা, আশ্বাস। সিনথিয়ার ভয়ার্ত চোখ দুটো শীতল হয়ে আসে। বাবা আছেন! তার মাথার উপর ছায়া আছে।
মাফিয়া দলের আরেকজন ছুটে আসে মাফিয়া দলের বসের দিকে। তার গলায় ভয়ের ছাপ,
— বস! মেয়েটা এসপির বউ। অন্যকিছুর চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। যে কাজে আসছেন ঐটা করেন। সময় কম। এসপি খুব ক্ষ্যাপাটে। একবার চলে আসলে সবাইকে মেরে দিবে বস মেরে দিবে।
–চুপ শা!লা!
— বস! আপনি বুঝতে পারছেন না। এ!স!পি সম্পর্কে ধারণা নাই আপনার।
— তোর এতো ধা!র!ণা তাহলে তার বাড়িতে ভক্ষক হয়ে ঢুকেছিস। ভয় করছেনা?ওদের মেরে ফেলার জন্য এসে আবার হাদিস দিচ্ছিস!
— আমাদের হাতে সময় কম।এসবের চক্করে পড়ে সময় ফুরাবে,এসপি যদি কোনো ভাবে চলে আসেন?
— ও আর এই রাতে ফিরবে না। এই রাত তোমার আমার তাই না সুন্দরী! তোরা কেউ আসতে চাইলে আসিস। তবে সিরিয়াল আমার পরে। এবং আমার শখ মেটার পরে।বুঝলি টাকলা?
ভারী রিভলভারটা সিনথিয়ার মাথায় ঠেকায় মাফিয়া বস। বাকিদের নির্দেশ দেয়,
–নিচে বুইড়া ব্যাটারে সাইজ কর। আমি আসতাছি।
এদিকে রিভলবার হাতে নিচতলার সব উপেক্ষা করে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে আসেন রিদুয়ানুর রহমান! তার হাতের রিভলভারের দাপট, অতঃপর রিভলভারের ধাতুর বুলেট চওড়া কপালে সুক্ষ ছিদ্র করে বেড়িয়ে যায় মাফিয়া দলের একজনের। মাফিয়া বস সিনথিয়াকে ঠেলে সামনে দেন। এদিকে রিদুয়ানুর রহমানের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হাত কি লক্ষভ্রস্ট হতে পারে! পর পর আরো দুটো বুলেট বের হয়ে যায় রিভলভারের নল থেকে, গরম নল জুড়ে উত্তপ্ত ধোঁয়া এ যেনো রিদুয়ানুর রহমানের ভেতরের ক্রোধ, রাগের আগ্নেয়গিরি। সামনের জন মেঝেতে ধপাস করে পড়ে। মাফিয়া বস সিনথিয়াকে সামনে দিয়ে নিজেকে বাঁচায়। সিনথিয়ার চুলের মুঠি ছেড়ে কড়া পড়া হাতে পেছনের পকেটে হাত দেয়। রিভলভার সিনথিয়ার দিকে তাক করতেই রিদুয়ানুর রহমানের রিভলভারের ধাতব বুলেট এসে লাগে মাফিয়ার বাহুতে।আহত হাতটি সরে যায় সিনথিয়াকে বন্দি রাখা হাত থেকে। তবে সাথে সাথেই অপর হাতে ঠিকই রিভলভার চেপে ধরে সিনথিয়ার পেছনে। মাফিয়ার গলায় ক্রোধ, ভয়ংকর সে গলার স্বর,
— আমার জানের ভয় নাই! আমার পিছুটান নাই। আমি মরলে তোদের নিয়েই মরবো। এ আমার ওয়াদা।
রিদুয়ানুর রহমানের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হাতটাও হালকা কাঁপে। তবে মনের জোর, আত্মবিশ্বাসের সাথে তাকে লড়তেই হবে। বাড়িতে দু”টো মেয়েকে নিরাপদ রাখা তার দায়িত্ব। রিদুয়ানুর রহমান রিভলভার নামায় না। বরং লক্ষের দিকে স্থির করেন তার রিভলভার। মাফিয়া বস ভারী রিভলভারটা সিনথিয়ার মাথায় চেপে চেপে ধরে। এরমধ্যেই আরোও কয়েকজন মাফিয়া রিভলভার নিয়ে চারপাশে ঘিরে ধরে। চোরাবালিতে ফেঁসে যান রিদুয়ানুর রহমান। ঐদিকে একদল ইভার কক্ষের ভারি তালা কেটে ফেলে। আতঙ্কিত ইভার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে সে এক অযোগ্য নারী! অযোগ্য মা।বয়স কম থাকতে ছিলো ক্রিকেটের প্রতি নেশা,সারাদিন ক্রিকেট খেলা দেখেই পার করে দিতো, এরপর পড়লো এক ক্রিকেটারের প্রেমে! তারপর জীবনে নামলো আধার!কখনো আত্মরক্ষামূলক কিছুই তার শেখা হয়নি, কখনো ধরা হয়নি রিভলভার। এতে তার ভিষণ রকম অনিহা! এইসকল অস্ত্র তো তাকে টানতোই না। এখন মনে হচ্ছে — এই মূহুর্তে সে কতোটা নিরুপায়। মা হিসেবে সন্তানকে নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। কিছুই নেই।
দরজা ভেঙ্গে তেড়ে আসছে হায়েনার দল। বুকের মধ্যে তপ্ত ওমে মেয়েকে শক্ত আলিঙ্গনে চেপে রাখে ইভা। শিয়রে জেগে ওঠা ভয়েরা তাকে দাপিয়ে বেড়ায়, চিৎকার দিয়ে ওঠে ইভা,
— ভাইয়া! বাবা! আমার মেয়েটাকে বাঁচাও। আমার ভয় করছে বাবা।
রিদুয়ানুর রহমান নিরুপায়, একদিকে সিনথিয়া অন্যদিকে ইভা, টুম্পা। কি করবেন তিনি? সিনথিয়ার চোখ দুটো স্বপ্নে ভাসছে! ঐ যে নিরাপদ জায়গা আরেকটু সংগ্রাম আরেকটু টিকে থাকতে হবে শুধু।
মাফিয়াদল ঘিরে ধরে রিদুয়ানুর রহমানকে। অস্ত্র নামানোর জন্য তীব্র ঝংকার,
— অস্ত্র ফেল অথবা মর তুই! নিজের মাথায় নিজে শ্যুট করে দে। সবগুলোকে ছেড়ে দিবো।
রিদুয়ানুর রহমান সিনথিয়ার চোখের দিকে তাকায়, সিনথিয়ার চোখ দুটো ছলছল। রিদুয়ানুর রহমানের কানে ভেসে আসছে ইভার আকুতি ভরা কন্ঠ। বাচ্চা মেয়েটাকে কি শয়তানরা আঘাত করছে?মেরে ফেলবে? সাজানো গোছানো ভালোবাসায় গ ড়া পরিবারটা শেষ হয়ে যাবে। এই ন্যায় অন্যায়ের যুদ্ধে কি তিনিই হেরে যাবেন। এই দেশে কি অন্যায়ের জয় হয়? অপরাধী মাথা উচু করে নির্ভয়ে বেঁচে থাকে, অপরাধির শিড়দাড়া টানটান আর নিরপরাধ, আইনের লোকদেন মাথা নিচু থাকে। জয় পরাজয়ের যুদ্ধে পরিবারকে বাঁচাতে কি হেরে যাবে এক বিধ্বংসী, তেজী, অন্যায়কে বেরিক্যাড দেয়া রিদুয়ান!!মুছে যাবে তার নাম,সত্যের লড়াই থেকে? জয়ের মুখ তিনি দেখবেন ই না!
–শু্যট কর!
মাফিয়ার তীব্র ঝংকারে ভাবনার ইন্দ্রজাল থেকে ছিটকে পড়ে ন রিদুয়ানুর রহমান। ঐদিকে ইভার চিৎকার,
— আমাকে মেরে ফেলুন! আমার বাচ্চাকে ছেড়ে দিন। ও ছোট বাচ্চা,এইটুকু বাচ্চা ও কিছু বোঝে না। কাউকে বলবে না কিছু! ছেড়ে দিন ওকে।
ঘুমন্ত টুম্পা মাফিয়ার কোলে। কানে এখনো সূরা চলছে। মাফিয়ার কোল সমান উচ্চতায় বাচ্চাটাকে ধরে ঝংকার দিয়ে ওঠে,
–তাইলে তুই ওড়না খোল।
বুকের ভেতরে জলোচ্ছাস! ইভা শিউরে ওঠে,
–ওড়না খোল! না হয় ছুড়ে ফেলে দিবো এই বাচ্চাকে। এরপর এই যে বন্দুক দেখছিস না। বুক ঝাঝড়া করে দিবো এই ছোট্ট বুকটা।
পায়ের তালু থেকে মাথা অবধি ঘেমে ওঠে ইভার। এ কোন চোড়াবালিতে পড়লো সে?
রিদুয়ানুর রহমান হাত থেকে ফেলে দেন রিভলভার! উপর থেকে রিভলভারটা মেঝেতে কয়েকবার ডিগবাজি দেয়। দূরে ছিটকে পড়ে।
— ওদের ছেড়ে দে! আমাকে মেরে ফেল।
মাফিয়া বস পৈচাশিক হাসিতে ফেটে পড়ে,
— কি ভালোবাসা! জান দিয়ে ছেলের বউ কে ভালোবাসিস! বাবাহ! সত্যিই তুই ভালো মানুষ। কিন্তু কি করবো বল! নির্দেশ যে আছে, না হলে তো মোটা অংকের টাকা আসবে না। তুই কি জানিস কতো মোটা অংকের টাকা পাবো?– তোর র!ক্তের দামে আমরা জীবনে উল্লাস করবো উল্লাস!
রিদুয়ানুর রহমানের চোখ দুটো নিরব! যেনো হারজিতের খেলায় তিনি হেরে গেছেন। জীবন সংগ্রামে সত্যের পথে থেকে তিনি সব হারিয়ে ফেলেছেন সব! মাফিয়ার পৈচাশিক হাসিতে তার রক্ত আগ্নেয়গিরির মতো টগবগ করে ফুটছে। তবে উপর দিক থেকে তিনি নিরব, নিশ্চুপ, স্থির!
মাফিয়া বস কড়া পড়া হাতে সিনথিয়ার মাথায় রিভলভার আরেকটু শক্ত করে ধরে। মাফিয়া বস ঝাকি দিয়ে ঠেসে ধরে রিভলভার সিনথিয়ার মাথায় সাথে ঝংকার তুলে মাফিদের বলে,
— ঐ বুইড়া ব্যাডারে নিয়ে খেল তোরা, আমি ওর ছেলের বউ রে নিয়ে একটু খে__________লি !
কক্ষের ভেতর থেকে শোনা যায় আরেকটি পৈচাশিক স্বর,
— বস!! আমরা কি এসপির বোনের সাথে খে!লা!র অনুমতি পাবো?
–সময় কম! আগে বুইড়া ব্যাডারে সাইজ কর।
–তাহলে আগে কোনটা বস! ঘরের ডা নাকি বাইরের ডা।
মাফিয়ার কড়া আদেশ,
— বাইরে আয়!
রিদুয়ানুর রহমানের রক্তচক্ষু, ক্রুব্দ গলার স্বর,
— ওদের যদি ফুলের টোকাও লাগে আমি সব ধ্বংস করে দিবো।
–ওরে বুইড়া বয়সে কি ত্যাজ রে। বউ টা কি ঐ ত্যাজেই গেলো নাকি ঐদিকে আন্ধার!
সিনথিয়া অগ্নিশর্মা, আগুনের স্ফুলিঙ্গ তার দুটো চোখ। অপেক্ষা সুযোগের। তীক্ষ্ণ কনুই, সময় ন্যানো সেকেন্ড, গতি,ঝড়! পেছন দিকে চোখ বরাবর গেঁথে দেয় নিজের কনুই। নিজের প্যান্টের পকেট থেকে রিভলবার টেনে বের করে সিনথিয়া, এক দুই তিন– তিনটা বুলেটে তিনটা তাজা প্রাণ। পেছনের জন চোখে হাত দিয়ে দক্ষ হাতে রিভলভার তাক করে রাখে। বাকিরা তেরে আসে। স্বপ্ন ভালোবাসায় ঘেড়া শান্তির নীড় রণক্ষেত্র। বুলেট বর্ষণ, বর্ষণের তালে তালে উঁচু নিচু হয়ে বসছে সিনথিয়া। রিদুয়ানুর রহমান বুলেট থেকে নিজেকে বাঁচায়,তুলে নেন রিভলভার। ইভার কক্ষে মাফিয়ার দল পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ছুড়ে দেয় টুম্পাকে, ছোট্ট মেয়েটা ছিটকে পড়ে মেঝেতে। সাথে সাথে মাফিয়ারদল বেড়িয়ে আসে কক্ষ থেকে। ইভার বুকের মধ্যে থেকে কিছু একটা শূন্য হয়ে যায়। টুম্পা ঘুমের ঘোরে তীব্র চিৎকার দেয়। সে চিৎকার পৌঁছায় সিনথিয়ার হৃদয়ে। হৃদয়ে শুরু হয় ভয়ানক জলোচ্ছাস! চোখে আগ্নেয়গিরি! সিদ্ধহস্ত, প্রখরমূর্তি সিনথিয়ার রিভলভারের বুলেট এক এক করে মাফিয়া দলের বুকে, মাথায় লাগে। সময়ের ফাঁকে এক পা দু পা করে পিছিয়ে যায় সিনথিয়া। ইভার দরজায় দাড়িয়ে বলে,
–ইভা আপু! ঠিক আছে টুম্পা?
স্তব্ধ,নিরব ইভার চোখ বেয়ে নোনাজল পড়ছে,– বাচ্চাটাকে এভাবে ছুড়ে ফেললো? আচ্ছা!ওদের কোনো সন্তান নেই?
— আর ইউ ওকে আপু! টুম্পা ঠিক আছে?
ইভা কান্নারত টুম্পাকে বুকে জ ড়ি য়ে বলে,
— ঘুমের ঘোরে পড়ে গেছো মা! কিছু হয়নি। সব ঠিক হয়ে যাবে। মা আছি না।
— পা পা ল কাছে যাবো।
— মা তো আছি সোনা!
— আমি পা পা ল কাছে যাবো।
— কাল যাবো! তুমি কোথায় কোথায় ব্যাথা পেয়েছো মা। কোথায়?
— এথানে, এথানে, এথানেও…
সিনথিয়া চিৎকার দিয়ে বলে,
–আপু!
— ওরা আমার মেয়েটাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। সব ধ্বংস করে দে।
–ঠিক আছে তো টুম্পা?
-হুম
–বাইরে এসো না তুমি। দরজা বন্ধ করো।
চলন্ত গাড়িতে স্ট্রিয়ারিং এ হাত রেখে অন্যহাতে ফোন বের করে ইরফাদ। একটা মিসড কল! কল ব্যাক করে ইরফাদ। বন্ধ? ইভার ফোনে একটা কল দেয়। বন্ধ! সিক্সথ সেন্স নাড়া দেয় তাকে। একে একে সবার ফোনে কয়েকবার কল। সবগুলো ফোন বন্ধ! সব বন্ধ? ড্রাইভিং সিট ছেড়ে দেয় ইরফাদ।
ইরফাদের অন্দরমহল, গরম পরিবেশ! চিৎকার, ঘর জুড়ে অসংখ্য জিনিস ভাঙছে, ছিটকে পড়ছে, সেই তালে বাজছে তীব্র শব্দের সাউন্ড বক্স। একপ্রান্তে সিনথিয়া, ঐপ্রান্তের একপাশে রিদুয়ানুর রহমান। তার ঠিক মুখোমুখিতে মাফিয়া দল! চলছে জয় পরাজয়, টিকে থাকার লড়াই। ঐ মূহুর্তে মাফিয়া বসের তীব্র ঝংকার,
— সবগুলো কে ঝাঝড়া করে দে। ওদের র!ক্তে গোসল করবো আমি।
এক সাথে অসংখ্য গুলিবর্ষণ,দরজার আড়ালে সিনথিয়া কেবল নতুন রিভলভার তাক করে দাঁড়িয়েছে। সুক্ষ ধাতব বুলেট, গরম উত্তপ্ত পরিবেশ,রিভলভারের নল ভেদ করে ধেয়ে আসছে রিদুয়ানুর রহমানের দিকে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। সময় কম,গলায় দম নেই। একধাক্কায় সরিয়ে দেয় সিনথিয়া। সুক্ষ ধাতব বুলেট রিদুয়ানুর রহমানের বুক ছেড়ে সিনথিয়ার হাতের বাহুতে ঢুকে যায়। অতঃপর গরম,ধূলোময় পরিবেশে এক প্রগাঢ় নৈঃশব্দ! কান জুড়ে শব্দ পুউউউউউউউউউ
রিদুয়ানুর রহমান স্তব্দ, শোক করারও সময় কম।ভাবনার সময় নেই। একাধারে গুলিবর্ষণ করে যান দুহাতে। গলায় শুধু একটাই কথা,
— দরজার ওপাশে দাড়া সিনথি!
সিনথিয়া ছুটে দরজার আড়ালে দাঁড়ায়। ওপাশে মাফিয়ার দল তেড়ে আসে। একার পক্ষে এতোগুলো শয়তানের সাথে পেরে ওঠা দুষ্কর।
হৃদয়ের টান! সমস্ত কাজ শিশির, জাবিরের উপর দিয়ে দেয় ইরফাদ, কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে বাড়ির দিকে টানছে। গুপ্ত অপারেশনে আসার সময় যে হেলিকপ্টারে তারা এসেছিলো সেই হেলিকপ্টারে অল্প সময়ের ব্যবধানে বাড়ির পথে ইরফাদ। হৃদয়ের ভেতরে অজান্তেই চলছে জলোচ্ছাস, তুফান! সব উপেক্ষা করে ছুটে আসে ইরফাদ। বাড়ির পথ অন্ধকার আচ্ছন্ন! প্রগাঢ় নিরব চারপাশ! একটা সিকিউরিটি গার্ড নেই। দূর থেকে ভেসে আসছে উচ্চ শব্দের গান! বুকের ভেতরে মোচড়াতে থাকে? সব হারিয়ে বসলো সে? সব শেষ হলো! এমন অশান্ত কেনো হৃদয়!তেড়ে আসা ভয়ানক দুশ্চিন্তা তার পায়ের গতি বাড়ায়। বুক জুড়ে উথালপাতাল ঝড়। বাবা ঠিক আছে তো? ইভা? টুম্পা?
তার প্রিয়তমা? সব ঠিক আছে তো……!
লোহার ভারী দরজায় কলিংবেল! শব্দ নেই! বিদ্যুৎ নেই? এরপরে ইরফাদের হাতের ভারী ধাক্কা। গলার স্বরে প্রিয়তমার নাম,
— সিনথি!!
আবারো জোড়ালো ধাক্কা!
— সিনথিইইইই..
— ইভাআআ… বাবা….
–সিনথিইইই…..এইইই সিনথি!!
ইরফাদের অন্দরমহলে রক্তের খেলা। সিনথিয়ার হাত,পা ক্ষতবিক্ষত! টুম্পাকে সেইভ করতে হকিস্টিকের শক্ত আঘাত তার পিঠে, পেটে আর একটা কপালেও। পায়ে আরো দুটো বুলেট। র!ক্ত ঝড়ছে অনবরত। র!ক্তের ফোয়ারায় ভিজছে সাদা রঙের টাইলস। রিদুয়ানুর রহমানের সাদা পাঞ্জাবী জুড়ে র!ক্ত। সবার কাছেই বুলেট শেষ! এখন চলছে ছু!ড়ি, চাপাতির আঘাত। ধারালো ছু!ড়িতে ক্ষত বিক্ষত রিদুয়ানুর রহমানের শরীর। তবে চোখ দুটোতে স্বপ্ন– নিঃশেষ হতে দিবেননা তিনি তার পরিবারকে।
এমন সময় বাইরে থেকে দরজার ভারী ধাক্কা!! ফিরে তাকায় সিনথিয়া!! ছলছল চোখ দুটো, আহত হৃদয়ে এক সিক্ত অনুভূতি ভেসে আসে–ইরফাদ!! ইরফাদ এসেছে?রুদ্ধ হওয়া গলাটা ছিড়ে বেড়িয়ে আসে বাঁচার আকুতি। তবে সে ডাক দরজা ভেদ করে না। মাফিয়া দল চেপে ধরে সিনথিয়ার মুখ। রিদুয়ানুর রহমান দরজার আড়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। আহত কন্ঠস্বরে চিৎকার করে ওঠে– আমার ইরফাদ এসে গেছে! ও বিধ্বংসী! ও ধ্বংস! ও মহাপ্রলয়! সব শেষ করে দিবে। সব! ধ্বংস করে দিবে!
সিনথিয়া উঠে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই, নেই শরীরে শক্তি। তবে ঐ লোহার ভারী পাল্লা তো খুলতেই হবে। খুলতেই হবে। শেষ চেষ্টা। সিনথিয়ার অক্ষত পায়ের শক্ত আঘাত মাফিয়ার ঠিক চোখে। কেড়ে নেয় ছু!ড়ি। এলোপাথাড়ি আঘাত। অতঃপর উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা। রিদুয়ানুর রহমান বাইরে চলে আসেন। হাতে বড় চাপাতি। এলোপাথাড়ি আঘাত। অল্প একটু ফাঁক। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে সিনথিয়া। সমস্ত সিঁড়িপথ র!ক্তে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মাফিয়া দলের একজন সে পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। অগ্নীমূর্তি সিনথিয়া ধারালো ছু!রি র আঘাতে র!ক্তা!ক্ত করে মাফিয়ার বুক। অতঃপর বিধ্বংসী সিনথিয়া খুলে দেয় ভারী পাল্লার দাড়। সামনে দাঁড়ানো প্রলয়! বিধ্বংসী ইরফাদ। একঝাপটা শুভ হাওয়ায় পুরো অন্দরমহলে প্রাণ ফেরে। আধভাঙা র!ক্তা!ক্ত শরীরে দাঁড়িয়ে সিনথিয়া, আহত!ব্যাথায় কাতর শরীর, এলোমেলো চুল গুলো উড়ছে। ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি। ভয়গুলো বুক ছেড়ে উড়াল দিয়েছে। ঢুলুঢুলু চোখটা হাসে। মুখে বলে,
রং পর্ব ৬০ (২)
— ওরা বাঁচতে দিচ্ছে না আর। দিচ্ছেই না।
ধারালো মগযাস্ত্রের অধিকারী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ক্ষ্যাপাটে ইরফাদ চোখ বুলিয়ে নেয় চারপাশ। হাতবাড়িয়ে সিনথিয়ার র!ক্তা!ক্ত কপালের ভেজা চুলগুলো সরিয়ে দেয়।টেনে নেয় বুকের কাছে,একবাহুডোরে আবদ্ধ করে রক্তাক্ত কপালের কোণে সিক্ত চুমু দেয়। বুকে চেপে ধরে কয়েকসেকেন্ড।ইরফাদের গলার স্বর কিছুক্ষণ কোমল। পরেরটুকুতেই প্রলয়,
— আমি আছি সিনথি!এইতো চলে এসেছি। ভয় পেয়ো না!
একটাকেও বাঁচতে দিবো না। এক…টা….কে….ও না।