রং পর্ব ৬২ (২)

রং পর্ব ৬২ (২)
তন্নী তনু

ধরণীতে নেমে গেছে অন্ধকার, ধূসর রঙের আকাশে শতশত তারা। কেবিনের ডান পাশের বিছানায় শুয়ে আছে সিনথিয়া,বাম পাশেই টুম্পা। ইভা ফেরার পর থেকে নিরব,নিস্তব্ধ পাথরের মতো সেই এক জায়গায় বসে আছে। সিনথিয়া ভাইয়াকে একপলক দেখার জন‍্য ব‍্যকুল থাকলেও সে সময় সমস্ত শরীর ব‍্যথা আর ঘুমের ঘোরে তাকানোর উপায় ছিলো না। আর এখন চুপচাপ চিন্তা করার ছাড়া তারও আর উপায় নেই। নরম আলোর কক্ষে প্রবেশ করে ইরফাদ। চোখ মেলে দেখে সিনথিয়া। ভাঙা গলায় সিনথিয়ার প্রথম শব্দ,
–বাবা কেমন আছে?
— বেটার নাউ।
— আমার বাবা মা কে একটু জানাবেন না?
— বলেছি, চলে আসবে।
এতোটুকু বলেই টুম্পার বেডে বসে ইরফাদ। ইভার চোখ দুটো শূন‍্যতায় শূন‍্য। ইরফাদের কঠিন হৃদয় উপেক্ষা করে সে শূন‍্যতা। আধঘুমে থাকা টুম্পার চুলের মধ‍্যে নরম করে হাত বুলায়। এরপরেই কপালের এককোণে চুমু খায়। জ্বর কমেছে। ইরফাদ আদুরে গলায় বলে,

–আর ইউ ওকে, মা?
টুম্পা কোমল করে তাকায়। কি যে সে চাহুনি। সব দুঃখ ভুলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে ঐ বাচ্চার মায়াবী দু’চোখ। কোমল, নরম তুলতুলে হাতটা ইরফাদের গালে ছোঁয়ায় টুম্পা। অস্পষ্ট স্বরে বলে,
— হুউউ।
— তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যা। তুই চুপ থাকলে আমার হৃদয় থমকে যায়। তুই তো আমার মা। তোর গা’য়ে আমি মা’য়ের গন্ধ পাই।
— তোমাল যেমন আমাল জন‍্য কষ্ট হয়, আমালো তো পাপা’ল জন‍্য কষ্ট হয়। তুমি কেনো তাহলে বুঝলে না। কেনো আমাকে নিয়ে এলে।
খানিকটা সময় থেমে থাকে ইরফাদ। এই ধারালো মস্তিষ্ক কখনো কখনো কাজ করে না, থেমে যায়। মৃদু একটা শ্বাস টেনে ইরফাদ বলে,
–যদি তোর মামা’ই এর ক্ষমতা থাকতো পৃথিবীর সমস্ত কিছু তোর হাতে দিয়ে দিতাম। এতো ক্ষমতা তো উপরওয়ালা আমাকে দেননি।
এরপরেই ইরফাদ ইভাকে বলে,–আমাকে যেতে হবে। ইভা দেখে রাখিস বাবুকে।
নির্জীব,নিরব ইভা বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— আজ’ না গেলে হয় না ভাইয়া। বাবা, সিনথি, টুম্পা সবাই অসুস্থ। আমি একা কি করে সামলাবো।
–ভোরেই চলে আসবো।
বলেই উঠে দাঁড়ায় ইরফাদ। তবে কঠিন হাতটা কোমল হাতের স্পর্শে অজান্তেই তার সমস্ত শরীরকে বাঁধা দেয়। টুম্পা নরম হাতে আলতো করে ছুঁয়েছে ইরফাদের আঙুল,
–মামা’ই তুমি কষ্ট পেয়েছো? আমি কষ্ট দিতে তাইনি।আমি তোমাকেও ভালোবাসি মামা’ই। আদোল,আদোল, আদোল।
বলেই ইরফাদের আঙ্গুলের কোণে চুমু খায় মেয়েটা। তারপর বলে,
— আই’ল মিস ইউ মামাই, তালাতালি চলে এসো।টা টা।
— আদোর বাবা। অনেক আদোর।

ধবধবে সাদা বেডের এককোণে শুয়ে আছে সিনথিয়া। ইরফাদ বসে সিনথিয়ার পাশেই। ফ‍্যাকাশে মুখ, বিনুনি দুটো দু’দিকে। ইরফাদ সিনথিয়ার হাতের তালুতে হাত বুলায়। ধীর গলায় বলে,
–ভোরেই চলে আসবো।এমন অবস্থায় আমি ফেলে যেতাম না সিনথি। আমাকে যেতেই হবে। একদম চিন্তা করবে না। ফিরে আমি তোমাকে তোমার ভাইয়ার কাছে নিয়ে যাবো কথা দিচ্ছি। খুশি?
ফ‍্যাকাশে মুখ,ব‍্যথা জর্জরিত শরীর, নিরব, নিস্তব্ধ হৃদয়ে একটুখানি ভালোলাগা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সিনথিয়া’র ওষ্ঠজোড়া প্রশস্ত হয়। সিনথিয়া’র কোমল হাতটা ইরফাদ বুকের বা পাশ ছুঁইয়ে রাখে কিছুক্ষণ। এরপরেই বলে,
— আসছি হুম?
এরপরেই এক মিনিটের মধ‍্যে ইরফাদ চলে যায়।

অকস্মাৎ ঝড়ের গতিতে ছুটে আসে সাজিদ। কক্ষে থাকা ইভা কয়েক সেকেন্ডের জন‍্য হতভম্ভ হয়। টুম্পার গলায় স্বরে খুশি,
— আংকেলললললল….!
ফিরে তাকায় সিনথিয়া,দরজা থেকে অনুমতি ছাড়াই সাজিদ ছুটে আসে। ঘটনা এতো দ্রুতই ঘটে ইভা থমকে যায় কিছু সময়ের জন‍্যে।
— আর ইউ ওকে সোনা?
উঠে বসে টুম্পা। হাত ছড়িয়ে দেয়। ছো মেরে কোলে নেয় সাজিদ,
— ঠিক আছিস, পুচকি?
— হুউউম আংকেল। জ্বল কমেছে আমাল।
টুম্পাকে কোলে রেখে ইভার দিকে দৃষ্টি রাখে সাজিদ। তারপর বলে,
–ঠিক আছো….!
ইভা মাথা নাড়ায়। সিনথিয়া অন‍্যপাশ ফিরে চুপ করে থাকে। সাজিদ ভারাক্রান্ত হয়ে বলে,
— আমি তোমার ডিসিশনের উপর কোনো একটা কথাও বলিনি। ফোর্সও করিনি। ভালোবাসা জোর করে হয় না। জোর করে কিছু চাই ও না আমি। কিন্তু মেয়েটার উপর দিয়ে এতোকিছু হয়ে গেলো আমাকে একবার জানালে না। তোমার কি কখনো মনে হয়নি আমি কষ্ট পেতে পারি।
নিরব থাকে ইভা। সাজিদ আবার বলে,

–কাজ টা ঠিক করোনি। বন্ধু হিসেবেও তো বলতে পারতে।
–সরি। আমার মাথা ঠিক নেই।
–কি হয়েছে…?
মুখের কথাটুকু কেড়ে নেয় টুম্পা। এরপর নিজেই বলতে শুরু করে,
— তুমি জানো আংকেললল…! পাপা এসেছে। আমাল পাপা। আমাকে আদোল দিয়েছে।
টুম্পার মুখ পানে চেয়েই ইভার মুখের দিকে তাকায় সাজিদ। ইভা নিরব, নিস্তব্ধ।
— আমিও আদোল কলেছি পাপাকে।
বাবা মেয়ে’কে ভালোবাসবে, আদোর করবে এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বিষয়। তবে সাজিদের প্রশ্ন তো অন‍্য জায়গায়,
— ইভা…! তুমি কি একারণেই কনফিউসড? তুমি ব‍্যক করতে চাও?
কথার মাঝখানে টুম্পা আবারো বলে,
–আমলা তো আজকেও দেকা কলেছি পাপাল সাথে। জানো পাপা’ল অসুখ কলেছে। ঘুমিয়ে গেছে।
সাজিদ টুম্পার কপালের কোণে চুমু খায় এরপর ভরসা দিয়ে বলে,
— সব ঠিক হবে মা। সব।
পরক্ষণেই ইভার দিকে তাকায় সাজিদ,

— তোমাকে একারণেই বিধ্বস্ত লাগছে ইভা? তুমি কি চাও? তুমি তাকে ভালোবাসো ইভা? একারণেই…
–টুম্পা আছে প্লিজ,রুমে আরো মানুষ আছে। এসব কথা থাক প্লিজ।
–ইয়েস অর নো?
— জীবন কখনো কখনো এমন জায়গায় দাঁড় করায় তখন পেছনেও ফেরা যায় না, সামনেও আগানো যায় না। শুধু থেমে থাকতে হয়। আমি কাউকেই চাই না। একা আমার মেয়েকে নিয়ে বাকি জীবন চলে যাক।
— তাই…….
অকস্মাৎ ইরফাদের প্রবেশ। হঠাৎ ইরফাদকে দেখেই চমকে ওঠে ইভা। তাহলে কি কোনো খারাপ খবর….! ইভা গলা শুকিয়ে আসে। গলা চেপে ধরে অদৃশ‍্য ব‍্যথা। ছলছল চোখে ইভা বলে,
— সব ঠিক আছে ভাইয়া।
ফিরে তাকায় সাজিদ।
— রাফসানের জ্ঞান ফিরেছে। টুম্পাকে দেখতে চাচ্ছে। যেতে হবে। কিন্তু তুই যাবিনা। সিনথিয়া আর টুম্পা যাবে।
ইভা নিরব থাকে। কোনো কথা বলে না। তবে টুম্পা টুম্পা সাজিদের কোল থেকে নেমে ইভার কোলে ওঠে,
— মামনি না গেলে আমিও যাবোনা।

নরম আলোর কক্ষ, রাফসানের ঠোঁটের কোণ ছুঁয়ে বেরিয়ে আসা শব্দ কেবল, টুম্পা। আত্মা ছিড়ে আসা আকুতিতে কেবল টুম্পার নাম। কাচের ভারী পাল্লা ছুঁয়ে কক্ষে প্রবেশ করে সিনথিয়া। তার পেছনে হুইল চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে ইরফাদ,তার কোলে টুম্পা। টুম্পা দূর থেকেই ফিসফিসিয়ে ডাকে,
— পাপাহ, পাপাহ…! ও পাপা, পাপা,পাপা।
ইরফাদ ধীর গলায় বলে,
— রিলাক্স, রিলাক্স, রিলাক্স বেইবি।
টুম্পা ফিসফিসিয়ে বলে,
— ওকে….শশশ…
বেডের কাছে বসা সিনথিয়া, ইরফাদের কোলে টুম্পা। সিনথিয়া রাফসানের পালস অক্সিমিটার লাগানো হাতের নিচে হাত রাখে। ভেতর উগলে কান্না আসলেও চেপে যায় সিনথিয়া। নিরবে ভাইয়ের হাতে নরম করে চুমু খায়। মূহুর্তেই রাফসানের বন্ধ চোখ থেকে একফোটা উষ্ণ জল গড়িয়ে পড়ে চোখের কোণ ছুঁয়ে। সিনথিয়া অন‍্যহাতে মুছে দেয় বেদনার তপ্ত জল। ঐদিকে টুম্পা বিরবিড়িয়ে শব্দ করে,

— পাপাহ! পাপাহ!
ইরফাদ হাত বাড়িয়ে ছোট্ট বাবুর মতো করে রাফসানেন মুখের দিকে টুম্পাকে ধরে রাখে। বাচ্চা টা ফিসফিসিয়ে ডাকে,
— পা….পা…
ডাকের সাথে অস্পষ্ট স্বরে রাফসান বলে,
— হুউউউম পা পা।
ছোট্ট টুম্পা খুশিকে দমিয়ে রাখতে না পেরে জোরে ডেকে ওঠে,
— ও পাপা। দেখো আমি এসেছি। তাকাও, তাকাও। দেখো পাপা।
রাফসানের বন্ধ চোখ দুটো থেকে জল গ ড়িয়ে পড়ে। লেগে থাকা চোখ দুটো মিটমিটিয়ে তাকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টায় সে। চোখ ফেটে র!ক্ত লাল অশ্রু বেড়িয়ে আসে। টুম্পা একপাশের ভেজা চোখে চুমু খায়। হাত বাড়িয়ে মুছে দেয়,
–কেনো কাঁদছো পাপাই। কেঁদোনা। আমি মা হইতো তোমাল, আমি ভালোবাসবো, আমি আদোল কলবো। তুমি ঠিক হয়ে যাবে পাপাই।
আধখোলা র!ক্তচক্ষুতে আবছা করে ভেসে ওঠা মেয়ের মুখ দেখে হৃদয় প্রশান্ত হয় রাফসানের। তিক্ত গলাটা ফেঁড়ে বের হয় হৃদয়ের করুণ সুর,
— আ.মা.র মা। আমার পাপা।

পৃথিবী যে এতো সুন্দর, রঙিন হয় আমি তোমাকে না পেলে বুঝতাম না। বাবা হলে এতো শান্তি লাগে তোমাকে না পেলে আমি জানতাম না। কিন্তু তোমার পাপা যে সব বোঝার আগেই ভুল করে ফেলেছে। তাইতো এতো দূরে থাকতে হচ্ছে। আমি তোমাকে পেয়েও পেলামনা।আমার এ অপূর্ণ, ভুলে ভরা জীবনে তুমি একমাত্র রঙের ছোঁয়া। এক অশুভ উপাখ‍্যানের শেষ সমাপ্তিতে তুমি এসে গল্পের নতুন মোড়ে নিলে। পুরো উপাখ‍্যানের পাপ টুকু তুমি তোমার নিষ্পাপ ছোঁয়ায় মুছে দিলে। গল্পের নতুন অধ‍্যায়ে মনে হয় আমি থাকতে পারলাম না পাপা। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। পাপাই তোমাকে ভিষণ ভালোবাসে। জীবন শেষ ইচ্ছে বলো, পরজীবনের ইচ্ছেই বলো। আমি যদি কখনো সুযোগ পাই, আমি সবকিছুর বিনিময়ে তোমাদের চাইবো।
আফসোস!তোকে আঙুল ধরিয়ে হাঁটানো হলো না, বুকের উপর রেখে ঘুম পাড়ানোও হলোনা। দু’জন বসে গল্প করাও হলো না। তুই কখনো দূর থেকে তুই ছুটে এসে পাপা বলে আমার বুকে ঝাপিয়েও পড়লিনা বাবা, তোকে কাঁধে করে পুরো পৃথিবী ঘুরে দেখা বাকি। সব সব সব কিছু বাকি রেখেই হয়তো এই জীবনের সমাপ্তি ঘটে যাবে মা। আমার যে তোকে ছাড়তে ভিষণ কষ্ট হয়। ভিষণ যন্ত্রণা হয় মা। এই পৃথবীর সবচেয়ে বড় মায়া তুই। তোর জন‍্য আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে, ভিষণ বাঁচতে ইচ্ছে করে। টুম্পা!

— হুউউ
–বুঝতে পারিস তুই?
— হুউউউম।
— পাপা’কে একটু আদোর করো তো।
টুম্পা রাফসানের মুখের একপাশে টুপটুপ করে কয়েকটা চুমু খায়। রাফসান অন‍্যহাতে সরিয়ে নেয় অক্সিজেন মাস্ক। শুকনো, চিটচিটে ঠোঁটটা জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নেয় রাফসান। দম ফুরিয়ে আসতে চায়। শ্বাস টেনে মেয়ের কপালে, চোখ মুখে অজস্র চুমু খায়।
–পাপা তোকে ভিষণ ভালোবাসে, ভিষণ। হয়তো তোকে আর দেখা হবে না এই দুচোখে। আমার মা নেই, বাবাও নেই। কেউ নেই আমাকে মনে রাখার।তুই কিন্তু আমাকে ভুলে যাস না মা। একটু মনে রাখিস একটু? একচিমটি পরিমাণ!!!
এতোটুকুতেই শ্বাসে টান পড়ে রাফসানের। দম ফুরিয়ে আসতে চায়। মনিটরে এলার্ম বেজে ওঠে। সাথে সাথেই ইরফাদ অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দেয়। পর্যবেক্ষণকারী নার্স মনিটরে খেয়াল করেন। অক্সিজেন স‍্যচুরেশন কমে যাচ্ছে। নার্স দ্রুত ডক্টর ডাকেন এবং ইরফাদের উদ্দেশ‍্য বলেন,

— প্লিজ স‍্যার!এখন আপনাদের বাইরে যেতে হবে। সিনথিয়ার চেয়ার ঠেলে বাইরে পাঠিয়ে দেয় নার্স। হৃদয় উগলে কান্না আসে সিনথিয়ার। টুম্পাকে কোলে নিয়ে বাইরের উদ্দেশ্য পা বাড়ায় ইরফাদ। মূহুর্তেই কেঁদে ওঠে টুম্পা,
–ও… পা..পা। আমাকে নিয়ে যাচ্ছো।পাপা আমার সাথে কথা বলো। আমাকে ধরো। পাপা।
ইরফাদ শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নেয় টুম্পাকে। কানের কাছে এসে বলে;
— আবার আসবো,পাপা একটু অসুস্থ। একটু পরে কথা বলবে।
— না আমি যাবো না।
–পাঁচটা মিনিট দাও। আমি আবার নিয়ে আসবো।
ডক্টর তাড়া দেন,
–প্লিজ বাবুকে বাইরে নিয়ে যান।
টুম্পা চিৎকার দিয়ে ওঠে,

–পাপা আমাকে আদোল দিচ্ছিলো, আমি যাবোনা।পাপা আমাকে ভালোবাসি বলছিলো। আমি ভালোবাসি বলতে পারিনি। আমাকে নিয়ে যাও পাপার কাছে।
হাত পা ছুটাছুটি করানো টুম্পাকে শক্ত করে ধরে বাইরে নিয়ে আসে ইরফাদ। ইভা ছুটে এসে কোলে নেয়। টুম্পা হাত পা নাড়ে। ইভার মুখে, চোখে লাগে এলোমেলো হাত পায়ের আঘাত। সামলাতে পারে না ইভা। চোখের উপর শক্ত আঘাতে ইভা ছেড়ে দেয় টুম্পাকে। ইরফাদ হাত বাড়ালেও ফসকে যায় টুম্পা।সাদা টাইলসের উপর পড়ে যায় টুম্পা। গলা কাটা মুরগির মতো তরপাতে থাকে বাচ্চা মেয়েটা। ঘেমে নেয়ে একাকার। চোখের জলে ভাসতে থাকা মেয়ে চিৎকার দিয়ে বলে,
–পাপা! আমাকে ওরা তোমার কাছে দিচ্ছে না। আমিও ভালোবাসি পাপা। আমিও তোমাকে ভালোবাসি।
ইরফাদের কঠিন হৃদয়ে একপ্রকার ঝড় বয়ে যায়। ছটফট করতে থাকা বাচ্চা মেয়েকে বুকের পাজরে ঠেকায় ইরফাদ। শক্ত আলিঙ্গনে চেপে ধরে রাখে ইরফাদ। একনাগাড়ে জপে যায়,
–একটু সহ‍্য করো মা।আমি নিয়ে যাবো, নিয়ে যাবো। একটু সময় দাও একটু।
বাচ্চা মেয়েটা একমনে জপে যায়,
— ও পাপা, আমিও তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। পাপা! পা…পা.. ও পাপা।
বাচ্চার হৃদয়বিদারক ডাকে বাকি সবার হৃদয় ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম। ইরফাদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরোও। চোখের মধ‍্যে র!ক্তের খেলা। মস্তিষ্ক জুড়ে তান্ডব। আজ ধ্বংস করে দিবে সে সব।

মাঝরাতে হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম পৌঁছায় ইরফাদ। ভাঙা গুপ্ত দালানের আন্ডারগ্রাউন্ডে আবছা আলো। মশাল হাতে গুপ্ত সিঁড়ি দিয়ে নামে ইরফাদ। শিশির, জাবির পেছনে হাঁটে। আন্ডার গ্রাউন্ডে পৌঁছে ইরফাদ জাবিরকে বলে,
–ওদের হাতের বাঁধন খুলে দিন।
–কেনো স‍্যার!
— খুলে দিতে বলেছি খুলে দিন। ওহ সাথে একটা তাল মিলিয়ে গান ছাড়বেন।
— আচ্ছা স‍্যার।
দেয়ালের সাথে দাঁড় করানো হকিস্টিক তুলে নেয় ইরফাদ। বাঁধন মুক্ত কালো জগতের অধিপতি প্রভাত রঞ্জনের সামনে দাঁড়ায় ইরফাদ। চোখে বাচ্চা মেয়ের চিৎকার,” পাপা আমি তোমাকে ভালোবাসি।” কানে প্রতিধ্বনি হতেই সটান করে বারি দেয় প্রভাতরঞ্জনের মুখে। মুখ ভর্তি রক্ত ছিটকে বেড়িয়ে আসে। চোখে ভেসে ওঠে আবারো সেই ডাক,” পাপা।” ইরফাদ বিগড়ে যায়, হিংস্র হয়ে ওঠে। এলোপাথাড়ি আঘাত করতে থাকে প্রভাতরঞ্জনের চোখে মুখে। প্রত‍্যেক আঘাতে মাংস ফেটে র!ক্ত বেড়িয়ে আসতে চায়। চোখে আবারো ভেসে ওঠে টুম্পার হৃদয়বিদারক কান্না। হকিস্টিকের ইউ আকৃতি মাথা দিয়ে সটান করে বারি দেয় প্রভাত রঞ্জনের চোখে। চোখ গলিয়ে র!ক্ত গড়িয়ে পড়ে।
পেছন থেকে জাবির ছুটে আসে,

রং পর্ব ৬২

–স‍্যার কি হয়েছে আপনার। প্ল‍্যান কিন্তু এটা ছিলো না।
— আগুন জ্বালিয়ে দিবো আমি। সব ধ্বংস করে দিবো।
সে কি গলার স্বরের দাপট। মেঘের গর্জনকে হার মানায়। জাবির পরিস্থিতি সামলে নিতে বলে,
— কনট্রোল স‍্যার কন্ট্রোল।
— আমি যা দেখেছি আপনি তা দেখেন নি। আমার বুকে যে আগুন জ্বলছে সে আগুনে আমি ওকে জ্বালিয়ে মারবো।

রং পর্ব ৬৩