রং পর্ব ৬৩ (২)
তন্নী তনু
ইভা ফিরে তাকায়। চোখের দৃষ্টিতে কেবল যন্ত্রণা, হাহাকার। সে আঙুল ছোঁয়ায় ওষ্ঠের মাঝে। ফিসফিসিয়ে বলে,
–শশশশ! বাবু ঘুমাচ্ছে তো।
যন্ত্রণা মিশ্রিত নিরব, নিস্তব্ধ স্বর জুড়ে হাহাকার। ফ্লোরে দুমড়েমুচড়ে একাকার হওয়া অন্তর জর্জরিত নারীর হৃদয়ের নিরব,নিদারুণ অনুভূতি তারহীন, সেতুহীন তবুও অদৃশ্য মায়ার টানে সাজিদের হৃদয়ে ঠিকই পৌঁছে যায়; মন্থর হয় পায়ের গতি। ভালোবাসার এক নিদারুণ মেলবন্ধন; এ করুণ দৃশ্যের সে একমাত্র সাক্ষী।-সব সমাধান হলো, তবে মৃ!ত্যু!র পরে….!!!
মর্মস্পর্শি,হৃদয়বিদারক দৃশ্য;মৃত বাবা’র হৃদয়ে এক অবুঝ বাচ্চা’র শেষ ঘুম! শেষ আদর, শেষ স্পর্শের জন্য এক মায়ে’র নিরব,কোমল আকুতি। শেষ ইচ্ছে, শেষ চাওয়া, শেষ পাওয়ায় যেনো কোনো কিছু বাঁধা না হয়ে দাঁড়ায়। কোনো পিতা’র জীবনে অসংশোধনীয় কোনো ভুল না হোক, অথবা কোনো ভুল পথে তলিয়ে যাওয়া পুরুষ কখনো পিতা না হোক। পৃথিবী’তে আর একবারো এমন নির্মম, মর্মান্তিক, হৃদয়স্পর্শী ঘটনা না ঘটুক। “বেঁচে থাকতে যদি ভালোবাসা নাই পাওয়ার হয় তাহলে সে ভালোবাসা’র শুরু না হোক। প্রত্যেক ভুল সংশোধনযোগ্য হোক, অথবা অসংশোধনীয় ভুল কেউ না করুক।”
আধারে ডুবানো কক্ষে’র চারদেয়ালে ধবধবে বিছানায় বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সিনথিয়া। আধারের শেষ প্রান্ত একদলা আলো ঠেলে কেউ দাঁড়িয়ে। হাঁটু গেঁড়ে বসছে মেঝেতে। পেছনের বাধাপ্রাপ্ত আলো বিচ্ছুরিত। হাত বাড়িয়ে ডাকছে কেউ,
— ছোট পাখি!! এই ছোট পাখি! আয়! কোলে আয়।
একটু থেমে আবার সুরে সুরে ডাকে,
— পাখি… আয়! আয়! ছোট পাখি! কোলে আয়। একটু আয়না। শেষ বার!
একটা ছোট্ট মেয়ে, পরণে লম্বা গাউন, লম্বা চুল গুলো উঁচু করে ঝুটি করা। ভাইয়ের বাড়ানো হাতের দিকে ছুটছে….ছুটছে…ছুটছে…
অকস্মাৎ ভালোবাসা, মায়া নিয়ে বাড়ানো হাত দুটো অন্ধকারে তলিয়ে গেলো। বাচ্চা মেয়েটা এদিক সেদিক ছুটছে, খুঁজছে। আর কান্নারত গলায় ডাকছে– ভাইয়া!! ও ভাইয়া! কোথায় তুমি! ভাইয়া……!
সহসাই ঘুম ছুটে যায় সিনথিয়া’র। কপাল বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম ঝড়ছে,বুক কাঁপছে। চোখ দুটো রক্তলাল হয়ে উঠছে ক্রমেই। অজানা আশঙ্কা’য় হৃদয়ে টান পড়ছে। শিরায় শিরায় রক্তবিন্দুতে টান লাগছে।
নার্সের সাহায্যে আইসিইউ কক্ষ অবধি যায়। অতঃপর–
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিরব, নিস্তব্ধ, নিস্তেজ কক্ষ। ফ্লোরে এলোমেলো হয়ে বসে আছে ইভা। সাজিদ দাঁড়িয়ে। আরেকটু এগিয়ে যায় সিনথিয়া। নিরব চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। নিরব, নিস্তেজ রাফসানের বুকের উপর টুম্পা। ভ্রু জুগলের মাঝখানে কিঞ্চিৎ ভাজ পড়ে সিনথিয়া’র।
–আরে আপু ভাইয়ার বুকের উপর টুম্পাকে শুইয়ে রেখেছো কেনো? ভাইয়া তো অসুস্থ! কষ্ট হবে ভাইয়ার।
ইভা’র বিধ্বস্ত চাহুনিতে কেবল নিরবতা, অশান্ত হৃদয়ে নিরব ঝড়। সে শুধু তাকিয়েই রইলো। সিনথিয়া চেঁচিয়ে ওঠে,
–আরে অক্সিজেন মাস্ক কই? খুলে দিলো কে?
এরপরেই থেমে যায় সিনথিয়া। অকস্মাৎ একটুকরো নির্মম, কঠিন সত্য মাথায় এসে বারি খায়। পায়ে’র ব্যথা বেমালুম ভুলে যায় সিনথিয়া। থেমে যায় তার হৃদস্পন্দনের গতি। কন্ঠজুড়ে নামে যন্ত্রণা,
— আরে আমার ভাই! আমার ভাই শ্বাস নিচ্ছেনা কেন? কি হয়েছে?
নিস্তব্ধতায় ডোবা ইভা ধীর গলায় বলে,
— ঘুমাচ্ছে। শান্তি পেয়েছে! মুক্তি পেয়েছে!
সিনথিয়া’র বুকে’র মধ্যে তান্ডব শুরু, ভাঙচুর, লন্ডভন্ড। ভেঙ্গেচুড়ে উঠে দাঁড়ায় সিনথিয়া। কাঁপা কাঁপা হাত পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে রাফসানের নিস্তেজ হাতের উপর। কাঁপা কাঁপা হাতে রাফসানের নিস্তেজ হাতটা ধরে সিনথিয়া। চোখ থেকে খসে পড়ে গরম তপ্ত জল। গলায় কষ্টের তিক্ততা চেপে ধরে। সিনথিয়া রাফসানে পালস চেক করে,মুখে হাত বুলায়। সব নিরব! নিস্তেজ।গলা চিড়ে বেড়িয়ে আসে কান্না,
–তুমি আমাকে ফাঁকি দিয়ে গেলে? তুমি আমার সাথে কথা না বলে গেলে? তুমি আমাকে একবারো ডাকলেনা? তুমি ছোট পাখি বললে না আমাকে। শেষ বারের জন্য তুমি আমাকে একবারো ডাকলেনা। তুমি এভাবে ফাঁকি দিতে পারো না ভাইয়া। পারো না।
বিধ্বস্ত ইভা দাঁতে দাঁত চেপে থাকে। হৃদয় ছেড়া রক্ত চোখ দিলে গলগলিয়ে পড়ে। গলায় তিক্ত ব্যথায় কথা আটকে যায়। তবুও গড়া ফেড়ে বলে,
— ঘুমাতে দাও, একটু শান্তিতে থাকুক।
সিনথিয়া বিধ্বস্ত, এলোমেলো, ইভার দিকে একবার তাকায় আরেকবার টুম্পার দিকে। ঝড় বয়ে যাওয়া লন্ডভন্ড জীবন গুলো আর কোনো দিন স্বাভাবিক হতে পারবে? পারবে এই ক্ষত মুছতে। সেসব দূরে ঠেলে সিনথিয়া’র চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়া অশ্রুতে ঝেকে ধরে কেবল একই আফসোস,
— আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে ভাইয়া? একবার! শেষবার কথা বলতে!এভাবে সবার জীবন তুমি জলোচ্ছাসে ভাসিয়ে দিয়ে গেলে। ফাঁকি দিয়ে গেলে। এই তো একটু আগেও তুমি হাত বাড়িয়ে ডাকলে! আমাকে এখন ছোটপাখি কে ডাকবে ভাইয়া। কেনো চলে গেলে আমাকে ফাঁকি দিয়ে। আমার সাথে কোনো কথাই বললে না? তোমার একবারো আমার কথা মনে পড়লো না? ধরা ছোঁয়া’র বাইরে গেলে ভাইয়া। তুমি চিরকালের জন্য স্বপ্ন হয়ে গেলে ভাইয়া?
সহসাই একজন নার্স ভেতরে প্রবেশ করেন। তিনি বলেন,
— আপনাদের বাইরে যেতে হবে।কিছু ফর্মালিটিস আছে। শেষ করে লাশ হস্তান্তর করা হবে। ফ্যামিলি আগ্রহী থাকলে তাদের কাছেই দেয়া হবে। প্লিজ বাইরে যান।
বিধ্বস্ত ইভা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,
— পরিবার! ও তো আমার বাচ্চার বাবা। এই যে বাবু ঘুমায়, ওর মেয়ে, ওর মেয়ে, ওর পরিবার। রাফসান আমাদের কাছে থাকুক?
–বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় যাবে মিস. আপনারা সবাই বাইরে যান।
— কিন্তু….
— রুলস ইজ রুলস। প্লিজ…
সাজিদ এগিয়ে আসে। বাধ্য হয়েই হাত বাড়িয়ে দেয় টুম্পা’র দিকে। রাফসানের পাজর থেকে ছিন্ন করে শেষবারের মতো তুলে নেয় টুম্পাকে। ইভা দাঁড়িয়ে যায়। নিরব, নিস্তব্ধে শুধু বিরবিড়িয়ে বলে,
— ওকে নিবেন না সাজিদ ভাই!ওর ঘুম ভেঙ্গে যাবে। ওর ঘুম ভেঙে যাবে। ঘুম ভেঙ্গে যাবে।
নীলচে আধার কেটে যাচ্ছে… আকাশের এককোণ ফেঁড়ে রক্তিম আলো দেখা দিতেই শুরু ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ইরফাদ লম্বা পা ফেলে ছুটে আসছে, শ্বাস ওঠানামা করছে বেগতিক। দু’টো ভাঙা হৃদয়ের মানুষ নিরবে আরো একবার ভাঙছে তাদের পাশে কেউ নেই, এই চিন্তা তাকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। একসারি চেয়ারে টুম্পাকে কোলে নিয়ে বসে আছে সাজিদ। কয়েকটা চেয়ার ফাঁকা এরপর সিনথিয়া,ইভা। বরফের ন্যায় জমে গেছে যেনো। ইরফাদ প্রবেশ করা মাত্র’ই দুজন হু হু করে কেঁদে ফেলে। এটাই বাকি ছিলো ইরফাদ তা জানে। কোমল হৃদয়ের অধিকারী দুটো মেয়ে যে এতোক্ষণ সব সহ্য করে গেছে এই অনেক। ইরফাদ সামনে দাঁড়াতেই কান্নারত দুটো অবয়ব ইরফাদের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। যেনো সকল দুঃখ, কষ্ট জমা দেওয়ার জায়গা এইখানেই। দু’হাতে দুজনকে বুকে আগলে নেয় ইরফাদ। দু’জন দু’দিক থেকে সমান তালে দুঃখ উগলে দেয় ইরফাদের কাছে। সিনথিয়া’র হেচকি ওঠা স্বর,
— আমার সাথে একবারো কথা বলে গেলো না। একবারো ডাকলো না ছোটপাখি বলে। ভাইয়া কি অভিমান করে গেলো? আমার সাথে একবারো কথা বললো না। ভাইয়া চিরতরে স্বপ্ন হয়ে গেলো। ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেলো।
এইবার ইভা,
— টুম্পা’কে ঘুমাতে দিলাম একটু বুকে, শেষ বার। ওরা এতততো কঠিন, পাষাণ!! ওরা আমার মেয়েটাকে বের করে দিলো।
আবার সিনথিয়া বলা শুরু করে,
— আমি আমার ভাইয়াকে কোথায় পাবো? কে আমাকে আদর করবে?কে ছোটপাখি বলবে। আমার তো কিচ্ছু রইলো না?
এরমধ্যে আবারো ইভার গলা,
— আমি মেয়েটা’কে কি জবাব দিবো। ও কাঁদবে আমি ওর বাবাকে কোথা থেকে এনে দিবো ভাইয়া। মেয়ে’কে কি বুঝ দিবো। ও তো ছোট। কিচ্ছু বোঝেনা।
আবার সিনথিয়া, এরপরে ইভা এভাবেই চলছে চলছে….
একই বুকের মধ্যে দুজনের কতো দুঃখ, কতো কষ্ট জমা দিতে চাচ্ছে। ঐ কঠিন বুকে এতো কষ্ট, দুঃখ জমা, দুঃখে দুঃখে সে বুকটাও যে ঝাঝড়া। ইরফাদ দম নেয়। সিনথিয়ার মাথায় হাত বুলায়, কপালে আলতো করে চুমু খায়। তারপর বলে,
— শান্ত হও প্লিজ।
ইভার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নিগূর গলার স্বর কোমল,
— কখনো কখনো জীবন অভিশপ্ত হয়ে যায় নিজের জন্য, পরিবারের জন্য। তখন মৃত্যু হয় একমাত্র বাঁচার রাস্তা। রাফসান ছোট খাটো কোনো গ্যাং এর সাথে যুক্ত ছিলো না। ওর অন্যায় বড়, ছোট এটা বিষয় না। কখনো কখনো জীবন এমন জালে জড়িয়ে যায় সেখান থেকে নিজেকে মুক্ত করা যায় না। এসব অপরাধের এসব শেকল কতোদূর তা কেউ জানে না। এসব গোড়া থেকে উপড়ে ফেলাও সম্ভব না। একটা র্যাকেটের গুটিকয়েক জন কে শাস্তির আওতায় এনে কখনো পৃথিবী, দেশ সংস্করণ সম্ভব না। ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে কতোজন কতো অপরাধ করে বেড়ায়, সবার মুখোশ উন্মোচন সম্ভব না। তাই ও বেঁচে থাকলেও কখনো স্বাভাবিক জীবন যাপন সম্ভব ছিলো না। ওদের টিম এর বাকি গুলো প্রায় নাগালের মধ্যে এলেও রাফি পলাতক। সে হয়তো বাইরেও চলে গেছে। তোর কি মনে হয় এসব চক্র ছোট? বাইরের দেশের হাত নেই? রাফসান কখনো নরমাল লাইফ লিড করতে পারতো না ইভা। উপরওয়ালা উত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনি যা করেন সব ভালোর জন্য করেন। ধৈর্য্য ধরতে হবে শান্ত থাকতে হবে। ওকে?
ইভা ঢুকরে কেঁদে ওঠে,বুকে যন্ত্রণা বাড়ে, গলা ধরে আসে,ব্যথা জমে, দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করতে চায় ইভা, থুতনিতে জমে বিন্দু বিন্দু কষ্ট, হাত জমে যায় ঠান্ডা বরফে,বুকের মধ্যে চিনচিন করে ওঠে, তারপর জ্বলে আগুন,
— আমি সহ্য করতে পারছি না ভাইয়া। ” শব্দ ভান্ডারে এতো শব্দ কিন্তু আমার হৃদয়ের যন্ত্রণা বোঝানোর মতো একটা শব্দও নেই। একটা শব্দও নেই ভাইয়া। বিশ্বাস করো একটাও নেই।”
ব্যথায় মোড়ানো এই ভারী বাক্যটুকু একদম হৃদয় ফুটো করতে চায় ইরফাদের। আপাদমস্তক কঠিন আবরণে মোড়ানো ইস্পাতকঠিন হৃদয় যে ভালোবাসার মানুষদের জন্য গলে যায়,ভেঙে যায় তা কি কেউ জানে, কেউ বোঝে। বুকের পাজরে দু’জনকে চেপে ধরে রাখে ইরফাদ। আর ধীর গলায় শুধু বলে যায়,
— প্লিজ কাম ডাউন প্লিজ…..
কিছুক্ষণ পরে,
ইভা কান্নারত স্বরে বলে,
–ভাইয়া ওরা বলছিলো — বাবুর আব্বুকে পরিবারের মানুষ ছাড়া দিবে না। ওর তো কেউ নেই। তাহলে?
–আমি কথা বলেছি। দাফন হবে আমাদের কাছে থেকেই।
ইভা থমকে যায়। হৃদযন্ত্রটা আর যেনো চলে না। ইভা ধীর গলায় বলে,
— মানুষ মরে গেলে তার অপরাধের ক্ষমা হয়ে যায়। অথচ জীবিত থাকলে আমাদের কতো অভিযোগ, কতো অভিমান, কতো কি? ও বেঁচে থাকলে কখনো আমাদের বাড়ির ত্রি-সীমানায় নিতে ভাইয়া।
রং পর্ব ৬৩
— এটাই চিরন্তন সত্য। মানুষ মানুষকে মূল্য দেয় কেবল হারিয়ে যাওয়ার পরে, ভালোবাসে মৃত্যুর পরে। সব দোষ ভুলে যায় কেবল মৃত্যুর পরে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম।
–তাহলে কি আমি ওকে ক্ষমা করে দিবো? আরেক বার ভালোবাসবো?