রাগে অনুরাগে পর্ব ১১
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি
মালিহার ঘুম ভাঙলো ভোর বেলায়। প্রকৃতি যখন ঘুমন্ত আধারিয়া থেকে সদ্য ফোঁটা আলো মাখতে থাকে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যায়। মালিহা চোখ মেলে তাকাতেই অপ্রত্যাশিত দৃষ্টি থমকে যায়। জাওয়াদ তার মুখের দিকে তাকিয়ে ঝুকে আছে। মালিহা তাড়াতাড়ি করে শোয়া থেকে উঠতে নিলে খাটের পিছন সাইডে আঘাত পায়। ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে ফেলে। ঝিমঝিম করে ওঠে মাথা।
জাওয়াদ মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে মালিহার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল এক ধ্যানে। আজ তার চলে যাবার দিন। বেলা গড়াতেই তাকে তার গন্তব্যে বেরিয়ে পড়তে হবে। তাই তো মেয়েটিকে শেষ বারের মতো ভালো করে দেখছিল সে। মালিহার কাণ্ডে অবাক হয়ে ছেলেটি। তড়িঘড়ি করে উঠে বসে খাটে। ব্যাথা পাওয়া স্থানে হাত দিয়ে ডলে দেয়। ব্যাকুল স্বরে বলে, “আমি বাঘ না ভাল্লুক বলো তো? এভাবে উঠতে গেলে কেন? আস্তে ধীরে ওঠা যেত না? পেলে তো ব্যাথা!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে ছেলেটি। মালিহা ভ্রু কুচকে তাকায়। পরক্ষণেই মুখ বাকিয়ে বলে, “আপনি উল্লুক।”
জাওয়াদ উল্লুক কথার অর্থ বুঝতে পারে না। অবুঝ বালকের ন্যায় তাকিয়ে থাকে বউয়ের মুখের দিকে। তা দেখে মালিহা মনে মনে হাসে। বলে, “দেখি সরুন। ওয়াস রুম যাব।”
জাওয়াদ বাধ্য ছেলের মতো সরে দাড়ায়। মালিহা ওড়না জড়িয়ে ওয়াশ রুম গেল।
সারাটা সকাল জাওয়াদ আজ বাড়িতেই থাকবে। অন্যদিনের মতো সকালটা দৌড়াদৌড়ি করে পাড় করবেনা। কর্মসূত্রে দৈনিক এক্সাসাইজ করতে হয়। তাইতো স্বভাবসুলভ বাড়িতে এসেও জগিং সুট পড়ে বাড়ির সামনের পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে থাকে। কখনও ব্যায়াম ট্যায়াম করে।
খানিক বাদে টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মালিহা ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে আসে। কপালের চুলগুলো ভিজে গিয়েছে। লেপ্টে রয়েছে মুখের সাথে। ভ্রু দুটোর লোমগুলোও এলোমেলো হয়ে আছে। সদ্য ঘুম ভাঙা মেয়েদের মুখ বুঝি এত সুন্দর লাগে? জাওয়াদ কিছুক্ষণ মোহগ্রস্ত মানুষের ন্যায় তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, “আজ চলে যাচ্ছি।”
“শুনেছি।” মালিহা এককথায় উত্তর দেয়।
জাওয়াদের কিঞ্চিৎ মন খারাপ হয়। কিন্তু মুখ ভঙ্গিতে প্রকাশ করে না। আশা করাই বোকামি। যেখানে সম্পর্ক এখনো তিক্ততায় ভরপুর। হঠাৎ মালিহা জিজ্ঞাসা করলো, “সকালে কি খাবেন?”
“হালকা কিছু।”
“সেই খাবারের নাম বলুন?”
“আমার জন্য তোমার কিছু করতে হবে না। আম্মাই করবেন।”
“কেন? আমার রান্না খেতে ইচ্ছে করে না? মুখে দেওেয়া যায় না?” মালিহার কন্ঠস্বর কিছুটা তেতে উঠেছে।
জাওয়াদ বুঝতে পারে তার স্ত্রী সাহেবা রাগ করেছে। আরেকটু রাগীয়ে দিতে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় , “আমি কে? আমার জন্য হাত পুড়িয়ে রান্না কেন করতে হবে?”
মালিহা থতমত খায়। আয়নার সামনে দাড়িয়ে মাথায় ওড়না পেচিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। মালিহা চলে যেতেই জাওয়াদ শব্দ করে হেসে ওঠে। মেয়েটি নিজের অজান্তেই তার ওপর অধিকার খাটাচ্ছে। ভালো লাগে তার। ক্যান্টনমেন্টে ফেরার সময় এলেই মন খারাপ হয়ে থাকে। আজ মালিহা একটু যত্নে মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে মন খারাপ। মালিহা নামক মিষ্টি মুখের মেয়েটিকে ছেড়ে থাকতে হবে। ভাবতেই বুকে চিনচিন ব্যাথা হয়।
আজকের সকালটাও কিচেন ছাড়তে হয় জাওয়াদের আম্মার। সকালের রান্না রিপ্তি করে না। সে মেয়েকে সামলায়। সকালটাই তার মেয়ে খুব বিরক্ত করে। এজন্য সে একেবারে খাওয়ার সময় আসে। বাড়িতে স্থায়ী কাজের লোক রাখা নেই। একজন আসেন, যিনি তার দায়িত্বরত কাজ সেরে আবার চলে যান। ফলে রান্নাঘরে নিজের ইচ্ছেমতো রান্না করা যায়। আজও মালিহা কোমরে ওড়না গুজে রান্না করতে লাগলো।
ব্যালকনির গোলাপ গাছ দুটোতে ফুল ফুটেছে। একটা টকটকে লাল, অন্যটা হালকা গোলাপি। টবের মাটি শুষ্ক দেখে জাওয়াদ গাছদুটোতে পানি দিলো। মেয়েদের মতো করে চুমুও খেল। নিজেকে নিজেই বলতে লাগলো, “বউয়ের চুমু তো ভাগ্যে জোটে না। ফুলে চুমু খা বেদ্দপ ছেলে!”
ব্যাগপ্যাগ গুছিয়ে রাগে। ঘরটায় চোখ বুলায়। বুকের পাশটায় কেমন খাঁ খাঁ করে ওঠে। চেনা রুম, আরামের বিছানা ছেড়ে ছেলেদেরও চলে যেতে হয়। থাকতে হয় ধরাছোঁয়ার বাইরে। খারাপ তো পুরুষ মানুষেরও লাগে। কেবল তারা নারীদের মতো আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। কারণ পুরুষের আবেগ সমাজ দেখতে চায় না। এ সমাজ কঠোর পুরুষে অভ্যস্ত।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে কিচেনে গিয়ে হাজির হয় জাওয়াদ। মালিহা তখন রুটির জন্য আটা মাখছিল। জাওয়াদ পিছন থেকে বলে ওঠে, “কি রান্না হচ্ছে?”
হঠাৎ জাওয়াদের কন্ঠে চমকে ওঠে মালিহা। পিছন ঘুরে তাকায়। মেয়েটির কপালে অল্প ঘাম জমেছে। তেলতেলে হয়ে আছে মুখটা। জাওয়াদের মালিহার ঘামে ভেজা রূপটিও ভালো লাগে। যাকে প্রকৃত অর্থে ভালো লাগে বা ভালোবাসে তাকে বোধহয় সব অবস্থাতেই ভালো লাগে। যেমন জাওয়াদের এখন খুব করে মন চাইছে কপালে একটা চুমু দিতে।
ওড়না দিয়ে কপাল মুছে মালিহা প্রতিত্তোরে বললো, “রুটি করবো। দেশি মুরগির ঝোল করেছি আলু দিয়ে। আর ডিম পোস। চলবে না?”
“অবশ্যই চলবে বিবিজান।”
জাওয়াদের মুখ থেকে ‘বিবিজান’ শব্দটি মালিহার হৃদয় এফোর ওফোর করে দিলো। জোরেশোরে ধাক্কা লাগলো বুকে। দৃষ্টি স্থির হলো সুন্দর পুরুষটির চোখে। জাওয়াদ সুযোগে অসৎ ব্যবহার করলো। টুপ করে চুমু একে দিলো কপালের মাঝখানটায়। তারপর চটপট করে বললো, “সরি!” আর একটি সেকেন্ডও দাড়ালো না। দ্রুত পা চালিয়ে কিচেন ছাড়লো। বলা তো যায় না মালিহা যা মেয়ে হয়তো দেখা যাবে গরম খুন্তি মুখে চেপে ধরেছে।
মালিহা হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। সৎবিৎ ফিরে আসতেই রুটির খামির তৈরি করতে মনোযোগী হলো। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে সে রাগ করতে চেয়েও রাগতে পারছে না। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে। নাকের পাটাও ফুলে ফুলে উঠছে।
নিচে অপেক্ষা করছে সবাই। জাওয়াদ এখনই চলে যাবে। জাওয়াদের আম্মা বারবার ওড়না দিয়ে চোখ মুচছেন। বুকটা পুড়ে যাচ্ছে তার। ছেলের বিদায় মায়ের মন বড় কষ্ট দেয়। নারী ছেড়া ধনকে চোখের আড়াল করতে মন চায় না। তার ওপর যাবে মিশনে। মিশনে নিশ্চয় খেতে পড়তে আরাম, আয়েশ করতে নিয়ে যাবে না। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসাবে দায়িত্ব কত। কত প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। মায়ের মন খচখচ করতে থাকে।
জাওয়াদ গায়ে শার্ট চাপিয়ে আয়নায় দাড়িয়ে বোতাম আটকাতে থাকে। মালিহা চুপটি করে বসে আছে বিছানায়। তার অভিব্যাক্তি কেমন হওয়া উচিত বুঝতে পারছেনা।
জাওয়াদের প্রতি তার রাগ, ঘৃণা অস্বীকার করতে পারে না। প্রথম দিনের করা ঘৃণ্য আচরণ মনে গেথে থাকবে যুগের পর যুগ। কিন্তু এরপরও কি কিছু এসে যায় না? এতগুলো দিন এক ছাদের নিচে থেকেও সামান্য আবেগ জন্ম নেয়নি? বসে বসে ভাবে মেয়েটি। হঠাৎ জাওয়াদ মালিহার বাহু টেনে দাড় করায়। বলতে শুরু করে, “আমি চলে যাচ্ছি মালিহা। আমার দেওয়ার শপিং ব্যাগ দুটো তুমি আজও খুলে দেখলে না। সময় সুযোগ করে দেখ। ফোনটা আমার তরফ থেকে উপহার। ব্যবহার করিও প্লিজ! আমি জানি, যে অন্যায় করেছি তার ক্ষমা এত সহজে হয় না। এতগুলো দিন এক বিছানায় থেকেও দূরত্ব ছিল মাইল ক্রোশ। জানো তো, দুই অবস্থায় মানুষ অন্যের মনে থাকে।
এক, ভালোবাসলে আরেক, ঘৃণা করলে। তুমি আমাকে ঘৃণা করার জন্য হলেও মনে রেখেছো। কাউকে ঘৃণা করতে হলেও মনে রাখতে হয়। মনের বাইরে বের করে ঘৃণা বা ভালোবাসা হয় না। আমি এতেই খুশি। সে অবস্থায় হোক মনে তো রেখেছো। চাইলেও মন থেকে দূর করতে পারবেনা। যতবার এ রুমে তোমার পদছাপ পড়বে ততবার জাওয়াদ নামক খারাপ মানুষটিকে তোমার মনে পড়বে। শোন মেয়ে, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করে দাও। জ্বলতে, পুড়তে আমি রাজি। কিন্তু মন থেকে বের করে দিও না। পারলে কোন এক কোণায় ঠাঁই দিও। যাচ্ছি দেশের হয়ে দায়িত্ব পালন করতে। ভাগ্যে থাকলে সুস্থ শরীরে ফিরে আসব। না থাকলে বুলেট বিদ্ধ কফিন বন্দি হয়ে দেশে আসব….”
মুখের কথা শেষ হতে না হতেই মালিহা জাওয়াদের মুখ চেপে ধরে হাত দিয়ে। কাঁপা কন্ঠে বলে, “ফিরে আসবেন।”
মুখ থেকে হাত সরায় জাওয়াদ। প্রশান্তি ছুয়ে যায়। কোমর জড়িয়ে ধরে মালিহার। চেপে ধরে নিজের সাথে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, “একটা চুমু দিতে পারি? বিনা অনুমতিতে নয়। অনুমতি নিয়েই তবে।”
রাগে অনুরাগে পর্ব ১০
মালিহা মুখে কিছু বলে না। চোখে চোখ রাখে জাওয়াদের। গালের একপাশে দেবে গিয়ে হাসি ফুটে ওঠে জাওয়াদের। স্ত্রীর কপালে দীর্ঘ এক চুমু দিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। একটিবার পিছন ফিরে তাকায় না। মালিহা দৌড়ে বেরিয়ে আসে পিছু পিছু। চোখের কোনে অশ্রু জমা হয় নিরবে। ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন মা। মায়ের কপালে চুমু দেয় জাওয়াদ। ছোট্ট ভাতিজিকে আদর করে কোলে নিয়ে। এরপর বাবার সাথে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। সিড়িতে দাড়িয়ে দেখতে থাকে মালিহা। বুকটা কেন যেন ব্যাথা করতে তার। আশ্চর্য!