রাগে অনুরাগে পর্ব ১৭

রাগে অনুরাগে পর্ব ১৭
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি

সফেদ রঙা পাঞ্জাবীতে গৌর বর্ণের সুঠাম দেহি জাওয়াদকে বেশ আকর্ষণীয় লাগছে। নজর ফেরানো দায়। মালিহা এক ধ‍্যানে নিজের পুরুষটির দিকে তাকিয়ে রইলো। জাওয়াদের কোলে ছোট্ট এক জীবন্ত পুতুল। তুলতুলে ছোট্ট ছোট্ট হাত নাড়িয়ে বাবার চোখমুখ স্পর্শ করছে। জাওয়াদ মেয়েকে নিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলছে। অদূরে দাড়িয়ে এহেন স্বর্গীয় দৃশ্য অবলোকন করছিল মালিহা। জাওয়াদ হাঁটা থামিয়ে পিছন ফিরে তাকায়। দাড়িয়ে থাকা মালিহার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, “কি হলো? দাড়িয়ে আছো যে? এসো!”

মালিহার ধ‍্যান ভাঙে। সে পা চালিয়ে এগিয়ে যায় স্বামী সন্তানের দিকে। জাওয়াদের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে গিয়ে মালিহার মনে হলো পূর্ণতা বুঝি একেই বলে! এ মুহূর্তে পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষটি মনে হচ্ছিলো নিজেকে।
জাওয়াদ হাঁটতে হাঁটতেই জিজ্ঞাসা করলো, “এক ধ‍্যানে কি দেখছিলে বলো তো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মালিহা প্রতিত্তোরে এক গাল হাসি ফিরিয়ে দেয়। পরক্ষণেই এক কথায় জবাব দেয়, “আমার জীবনের পূর্ণতাকে।”
মালিহার কথায় জাওয়াদের ঠোঁট কোলে মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে। এক হাত দিয়ে মেয়েকে বুকের সাথে মিশিয়ে অন‍্য হাতটি বাড়িয়ে দেয় মালিহার দিকে। জাওয়াদের পুরুষালি লম্বা হাতটি গিয়ে থামে মালিহার বাহুতে। হাঁটতে হাঁটতেই বলে ওঠে, “তোমরাও যে আমার জীবনের শ্রেষ্ট পূর্ণতা। তোমাদের নিয়ে আজীবন থাকতে চাই।”
জাওয়াদের গা ঘেঁষে হাঁটতে থাকে মালিহা। মুখ দিয়ে আর একটি বর্ণও উচ্চারণ করে না। জাওয়াদও আর কিচ্ছুটি না বলে দু হাত দিয়ে জীবনের শ্রেষ্ট পূর্ণতাকে নিয়ে পা চালিয়ে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে।

জাওয়াদ মালিহার ছোট্টমনি ছোট ছোট নরম তুলতুলে পা বাড়িয়ে হাঁটতে শিখেছে। পার্কের বিস্তৃত মাঠঠি যেন সবুজ ঘাসের গালিচা। ছোট ছোট পা বাড়িয়ে মা-বাবার সাথে লুকোচুরি খেলছে মেয়েটি। খেলতে খেলতে একপর্যায়ে মালিহা মেয়েকে কোলে তুলে নিলেও জাওয়াদকে দেখতে পেল না কোথাও। পুরো পার্ক খুজেও জাওয়াদের দেখা পেল না মালিহা। এক অস্পষ্ট ধোয়াশার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে জাওয়াদ।
ছোট্ট মেহরিমা তার নরম ঠোঁট নাড়িয়ে মাকে শুধালো, “মামনি, বাবা কোতায়?”
মালিহা হারিয়ে যায় প্রশ্নের রাজ‍্যে। মেয়েকে যুক্তিযুক্ত কোন উত্তর সে দিতে পারে না। উত্তর যে তারও অজানা! চোখ হয় সজল, দৃষ্টি হয় ঝাপসা। ঠোঁট দুটো যেন একে অন‍্যের সাথে লেগে থাকে আজীবনের জন্য!

মাঝ রাতে দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে যায় মালিহার। শরীর ঘেমে চটচটে হয়ে গিয়েছে। আজকাল স্বপ্নেও জাওয়াদকে দেখছে মেয়েটি। আজকের স্বপ্নটিতে তাদের ছোট্টমনিও ছিল। মালিহা মৃদু আলোয় ফোন হাতড়ালো। ফোনটি মুঠোয় নিয়ে মাঝ রাত্তিতেই জাওয়াদের নাম্বারে কল করলো। একবার, দুবার, তিনবার কল দিয়েও ওপাশ থেকে কাঙ্খীত মানুষটিকে পেল না। বারবার যান্ত্রিক কল রেকর্ডটি ভেসে আসছে, “কাঙ্খীত নাম্বারে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছেনা। একটু পরে আবার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ।”
চোখ ভেঙে জল গড়িয়ে পড়ে মেয়েটির। চিনচিন করে ব‍্যাথা হয় বুকে। আজ কতদিন হয়ে গেল মানুষটার ভালো মন্দ কোন খবর তার জানা নেই।

বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসার পরে ভার্সিটি গিয়ে জানতে পেরেছিল পরিক্ষা অতি নিকটে। অথচ প্রস্তুতি একেবারেই নেই। মাথায় আকাশ ভাঙার জোগাড়। তারই ফলশ্রুতিতে বই পত্তর নিয়ে বিছানায় পড়তে বসেছিল মালিহা। পড়তে পড়তে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছিল মেয়েটি। ঘুম ভাঙলো সুখময় এক দুঃস্বপ্নে। আজকাল তার মনটা ভারি হয়ে থাকে। কারণে অকারণে মন খারাপ হয়। ঘন ঘন মুড সুয়িং হয়। মন চায় হুটহাট চকলেট, আইসক্রিম, ফুসকা খেতে। মালিহার অবচেতন মন বলে ওঠে, “জাওয়াদ থাকলে নিশ্চয় তার আবদারগুলো পূরণ করতো।” পরক্ষণেই মস্তিষ্ক জানান দেয়, “যার সাথে ভাব ভালোবাসাই হতে পারলো না। তার কাছে কি আবদার মাথায়?”

অথচ এই ভাব ভালোবাসাহীন সম্পর্কেই নিজের মধ্যে একটি ভ্রুণ বেড়ে উঠছে। বাচ্চার কথা মনে উঠতেই চার মাসের বাড়ন্ত ছোট্ট পেটে হাত বুলায় মালিহা। অজানা শিহরণ বয়ে যায় শরীর জুড়ে। একটি নতুন প্রাণ। ছোট্ট গাল, কমলার কোয়ার ন‍্যায় নরম ঠোঁট এলিয়ে হাসবে। ছোট্ট তুলতুলে হাত পা নাড়িয়ে খেলবে। এ দৃশ্য ভাবতেই আনন্দে শরীরের প্রত‍্যেকটা লোমকূপ জেগে ওঠে। ভাবতেও যেন ভালো লাগে।
মালিহা সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করে, “হে আমার রব, তাকে ভালো রাখুন। শীঘ্রই আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনুন। নতুন প্রাণের আগমনে আমাদের ভাঙাচোরা সম্পর্কে যেন নতুন প্রাণ জোগায়। আপনি আমাদের সহায় হোন। যাবতীয় খারাপ চিন্তা ভাবনা যেন ভালোর মধ্যে দিয়ে অবসান হয়। সব বিষয়ে আপনি আমাদের জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। আল্লাহুম্মা আমিন।”

মাইন্ড ফ্রেশ করতে মোবাইলের ডাটা অন করে ফেসবুকে ঢোকে মালিহা। টুংটাং শব্দে মেসেঞ্জার অপশন ভরে ওঠে। বান্ধবীদের নিয়ে গড়া গ্রুপে তখনও ম‍্যাসেজ দেওেয়া নেওয়া চলছে। মেয়েরা বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথাবার্তা বলছে। হঠাৎ করে মালিহা আর গ্রুপে ঢুকলো না। ফেসবুক লগইন করে ঢুকে পড়লো। নিউজফিড স্ক্রল করতে করতে ফ্রেন্ড সাজেশনে হঠাৎ আরহাম আহমেদ নামের একটি আইডি চোখে পড়ে। চিনতে খুব একটা ভুল হয় না মালিহার। আরহামের পছন্দের মোটর বাইকটির ওপরে বসা একটি ফটো ডিপিতে দেওেয়া। মালিহা একরাশ কৌতূহল নিয়ে আইডিতে ঢুকলো। রিসেন্ট একটি জব পোস্ট করেছে আরহাম। একটি মাল্টি ন‍্যাশনাল কোম্পানিতে তার চাকরি হয়েছে। জানতে পেরে মালিহারও ভালো লাগলো। জগত সংসার হতে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন ছেলেটির একটি গতি হলো তবে।

আরহামের জন্য মালিহার মনে একটি সফ্ট কর্ণার ছিল। একথা সে অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু সফ্ট কর্ণারকে পুজি করে সে আরহামকে পাত্তাও দেয়নি কখনও। আরহাম পছন্দ হওয়ার মতোই ছেলে। শ‍্যাম বর্ণের লম্বাটে গড়নের যুবা পুরুষ। মুখভর্তি খোচা খোচা চাপ দাড়ি। চটপটে তার কথার ধরন। পড়াশোনাতেও বরাবর মেধাবীদের আসন ধরে রেখেছে। বহুদিন মালিহার পিছনে ঘুরেছে ছেলেটি। মালিহাও মার্জিত ভাবে এড়িয়ে গিয়েছে। সৃষ্টিকর্তা তাদের মিলন লিখেননি। নাহলে প্রণয় হওয়ার আগেই বিচ্ছেদ রচিত হতো না।

বেশ রাত হওয়ায় মালিহা ফেসবুক থেকে বেরিয়ে আসে। ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটা বাজে। মালিহা ওজু করে এসে তাহাজ্জুত নামাজ পড়তে দাড়িয়ে গেল।
রাতের শেষ তৃতীয় অংশে মহামহিম রব তার বান্দাকে ডাকতে থাকেন। মালিহা আজ বহু আর্জি নিয়ে সৃষ্টিকর্তার দরবারে হাজির হয়েছে। জায়নামাজ হলো মুসলমানের গুপ্ত ডায়েরি। যেখানে সেজদায় মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে কিছু চাইলে তিনি ফেরান না।

মায়া বেগমের মন ভালো নেই। মেয়ে তার ভালো নেই। সেখানে মা কি করে ভালো থাকবেন? মেয়ে জামাইয়ের চিন্তায় এখন আর সংসারের কোন কাজে তার হাত চলে না। শাশুড়ি মাও নেই যে দুটো মনের কথা ভাগ করে নেবেন। মায়া বেগমের সময় যাচ্ছে ছটফট করতে করতে। মেয়েকে কিছু জিজ্ঞাসা করতেও ভয় পান। মালিহা যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

যে ভেঙে পড়ে তাকে নাহয় দুটো বুঝের কথা বলা যায়। ভরসা বাক‍্য শোনানো যায়। কিন্তু যে ভাঙে কিন্তু মচকায় না তার সাথে তো অ থেকে আ টাও করা যায় না। মায়া বেগম ঠিক করলেন আজ তিনি আবার শাশুড়ি মায়ের কাছে যাবেন। বারবার গেলে নিশ্চয় তিনি ফিরিয়ে দেবেন না। পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলবেন। মায়া বেগমের মনে হয় সেদিনের পরে মেয়ের থেকে তিনি বেশ দূরে সরে গিয়েছেন। মেয়েটা আর তাকে আপন ভাবে না। নাহলে সবসময় মন খারাপ করে থাকা মেয়েটা মায়ের বুকে মাথা রেখে একটু মনের কথা বলবে না? চোখ সজল হয় মায়া বেগমের। একদিনের করা ব‍্যবহারে রাতারাতি তিনি মা থেকে ভিলেন হয়ে গিয়েছেন।

মালিহার পরিক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে। আজ ছিল প্রথম পরিক্ষা। ক্লান্ত শরীরে চোখমুখ লাল করে বাসায় ফিরেছে মেয়েটি। মায়া বেগম মেয়ে আসার অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনি জোহরের নামাজ শেষে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে তসবিহ পাঠ করছিলেন।

মালিহা বাড়িতে প্রবেশ করে মাকে সামনে পেয়ে সালাম দিয়ে তড়িঘড়ি করে নিজের রুমে ঢুকে গেল। মায়া বেগম আর বসে রইলেন না। সালামের জবাব দিয়ে দ্রুত কিচেনে ঢুকলেন। আগে থেকে বানিয়ে রাখা লেবু চিনির শরবত আর দুধ ডিমের পুডিং ট্রেতে সাজিয়ে মেয়ের রুমে নিয়ে চললেন। মালিহা তখন হিজাবের পিন খুলছিল একটা একটা করে। খাবারে ট্রেটা বিছানায় রেখে মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলে মায়া বেগম। আলতো হাতে হিজাবের পিন, ব্রুজ খুলে দিলেন। হিজাবটা কাপড় রাখা আলনায় ছড়িয়ে রাখলেন। তারপর বললেন, “এগুলো খেয়ে তারপর গোসলে যা। খেতে খেতে শরীরের ঘাম টেনে যাবে। ঘর্মাক্ত শরীরে গোসল করলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
মালিহার মায়ের কথার পিঠে একটি কথাও বললো না। ড্রেসিং টেবিলের আয়না থেকে সরে এসে শরবত মুখে দিলো। মায়া বেগম যান্ত্রিক পাখার ভলিউম বাড়িয়ে দিলেন।

খেতে খেতে মায়ের দিকে আড়চোখে তাকায় মালিহা। মা তখন মালিহার এলোমেলো ব্রুজ, পিনগুলো বক্সে গুছিয়ে রাখছিলেন। মায়ের জন্য খুব মায়া হয় মেয়েটির। মালিহার খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো, “আম্মু তোমার গা থেকে কেমন আদুরে মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসছে। আমি কি একটু তোমার বুকে মাথা রাখতে পারি?”
কিন্তু সংকোচ আর অভিমানে মনের কথা মুখে আর উচ্চারণ করা হয়ে ওঠে না।
সূর্য মামা দিবালোকে আর বেশিক্ষন থাকবেন বলে মনে হয় না। রোদের তেজ কমে গিয়েছে। মায়ের সাথে মালিহা চলেছে অজানা গন্তব্যে। মা তাকে কিছুই জানাননি। শুধু বলেছেন, “এক জায়গায় যাব।”
মালিহা ও কিছুই জিজ্ঞাসা করেনি। গেলে তো দেখতে পাবেই। আজকাল মুখ নাড়িয়ে কথা বলতেও তাকে ক্লান্তি এসে চেপে ধরে।

ছোট চাচার বাসার গলির দিকে রিকশা এগোলেই মালিহার বুঝতে বাকি রইলো না তারা কোথায় চলেছে। দাদুকে ফিরিয়ে আনতে মায়ের এই তোড়জোড়। মালিহাও ঠিক করলো দাদুকে আজ বাড়ি নিয়েই ফিরবে। অভিমানে জমে অভিযোগ। আর দূরত্বে কমে গুরুত্ব। দুদিনের দুনিয়ায় এত রাগ অভিমান জমিয়ে রেখে কি লাভ? বরং সবাই মিরাটাই আসল সাফল্য।

রাগে অনুরাগে পর্ব ১৬

পরদিন শশুর বাড়ি থেকে ফোন এলো। মায়া বেগম কথা বলছেন ফোনে। মালিহার মুখ অজানা শঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়ে। জাওয়াদের কোন খবর এলো না তো? সে ভালো আছে তো? নিজে কথা বলার জন্য মায়ের দিকে এগিয়ে গেল। পা দুটো যেন কাঁপছে কৌতূহলে!

রাগে অনুরাগে পর্ব ১৮