রাগে অনুরাগে পর্ব ১৯

রাগে অনুরাগে পর্ব ১৯
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি

ঘড়ির কাঁটা নড়ে। দিন গড়ায়, রাত হয়। মাসের পর মাস পেরিয়ে যায়। সময় যেন বিরামহীন এক রেলগাড়ি।
মালিহা এখন নয় মাসের গর্ভবতী। এখন আর আগের মতো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে না মেয়েটি। সিড়ির দুটো তিনটে ধাপ পেড়লেই শরীর ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ে। নিচ থেকে উপরে উঠতে বেশ বেগ পেতে হয় তাকে। শাশুড়ি মা অবশ‍্য তাকে বলেছিলেন নিচ তলার রুমে থাকতে। কিন্তু মালিহা দোতলার রুমটাতেই থাকে। তার ভাষ‍্যে, “এটুকু হাঁটাচলা তার জন্য উপকারী। এতে কিছুটা কষ্ট হলেও প্রসব পরবর্তীতকালিন সময়ে সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। শরীরটাও ঠিক থাকবে।” এরপর আর কেউ তাকে জোর করেনি।

আজ মালিহার জীবনে বিশেষ একটি দিন। আট মাস শেষ হয়ে নয়মাসের একটি সপ্তাহ পাড় করেছে সে। একটু বিলম্ব করেই তার বেবী সাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। কাছের কিছু আত্মীয়স্বজন নিয়ে অনুষ্ঠান করা হবে।
সদ‍্য দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ফজরের নামাজ শেষে মালিহা তার বিছানার কোন ঘেষা জানালার ধারে চুপচাপ বসে আছে। এই সময়টা বাইরের পরিবেশে এক অন‍্যরকম আবহওয়া তৈরি হয়। শান্ত, নির্মল বাতাসে ছেয়ে থাকে চারিদিক। সূর্য তখন সবে উঠতে শুরু করে। প্রকৃতির এমন সুন্দর রূপে যে কোন মানুষেরই মনপ্রাণ ভালোলাগায় ছেয়ে থাকার কথা। মালিহা তার অশান্ত মনটি নিয়ে বাইরের সুন্দর প্রকৃতিতে নিজেকে মেলে ধরছে। বরাবরের মতোই দৃষ্টি তার রাস্তার ওপারের মাঠটিতে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সবুজের সমারোহ যেন। জাওয়াদ প্রায় নয় মাস বাড়ির বাহিরে। সেই যে গেল এখনো এ নীড়ে ফিরলো না মানুষটা। জাওয়াদের কথা ভাবতে গিয়ে চোখ সজল হয়ে মেয়েটির। মনটা ভারি হয়ে ওঠে। মনপ্রান কেমন যেন উতলা হয়ে পড়ে। অস্থির এক শূন্যতা তাকে গ্রাস করে নেয়। যে মানুষটিকে এক সময় করেছিল প্রবল ঘৃণা। অথচ সময়ের পরিক্রমায় সেই একই মানুষকে দেখার কত আগ্রহ! মালিহা ভাবে আর হাসে। মানব মন বুঝি এভাবেই বদলায়? ওই একটি দিনে দুজনের কিছু ভুল কিছু অন‍্যায়ে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক রূপ নিয়েছিল বিষাদের এক মহাসমুদ্রে। অথচ তাদেরও একটি সুন্দর স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন হতে পারতো। এখানে আসলে ভুলটা কার? তার না জাওয়াদের? আজকাল মালিহার জাওয়াদের শূন্যতা বড় পোড়ায়। একটু কাছে পাওয়ার জন্য মন উতলা হয়ে ওঠে। মন চায়, একটু যদি জড়িয়ে ধরা যেত। তবেই যেন হৃদয়ের ছটফট কমতো!

সকালের নাস্তা খেতে নিচে নামতে হলো মালিহাকে। এখন সে একেবারে ঝারা হাত-পা। মানে কোন কাজকর্ম করতে হয় না। নিজের যত্ন, খাওয়া দাওয়া আর অবসরে বর এবং অনাগত সন্তানের কথা ভাবতে ভাবতেই দিন চলে যায়।
মালিহার বড় জা রিপ্তি তখন খাবারের ডিসগুলো এনে টেবিল সাজাচ্ছিল। তার ছোট মেয়েটি ছোটাছুটি করছিল মায়ের আশেপাশেই। মালিহা গিয়ে রিপ্তির মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলো। নয় মাসের ভারি পেট নিয়ে একটি তিন বছরের বাচ্চা কোলে নেওয়া মোটেই সহজ কথা নয়। রিপ্তি কাজ থামিয়ে চোখ গরম দেখায় মালিহাকে। কন্ঠে রাগ মিশিয়ে বলে, “এমন বাচ্চামো আর যেন কখনও না দেখি। ওকে কোল থেকে নামাও। এসো, খেতে এসো।”

মালিহা হাসে। কোল থেকে মেয়েটিকে নামিয়ে চেয়ার টেনে বসে। খাবার মাখিয়ে ভাতের লোকমা তুলে দেয় ছোট্ট রাইসার মুখে। কাকিমনির কাছে সে একদমই দুষ্টুমি করে না। চুপচাপ বাধ‍্য মেয়ের মতো খেয়ে নেয়। আজ বাড়িতে অনেক কাজ তাই রাইসাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব মালিহা নিজেই নিলো। এদিক থেকে রিপ্তির কিছুটা সুবিধা হলো।
সকালের খাওয়া শেষে মালিহা লিভিং রুমে গিয়ে বসলো। খেতে ভালোই লাগে। যত খাওয়া হয় ততই ভালো লাগে। কিন্তু সমস্যা হয় খাওয়ার পরে। পেট নিয়ে নড়াচড়া করা যায় না। মালিহা হাত পা ছড়িয়ে বসে টেলিভিশন দেখছিল। বেশকিছুদিন সে পুরোনো দিনের বাংলা নাটকগুলো দেখে। আজ চালিয়েছে হুমায়ুন আহমেদের “বুয়া ট্রেনিং সেন্টার”। হাসির নাটক। হাসতে হাসতে পেট ফেঁটে যাবার জোগাড়!

রোদ একটু তেতে উঠলে বাড়িতে মেহমানের প্রবেশ ঘটে। এসেছেন মালিহার দাদু, বাবা, মা, ছোট ভাইবোন দুটো আরও এসেছেন তার চাচা, চাচি আর কাজিনেরা। সঙ্গে এসেছে অনেক উপহারসামগ্রী। নিজের বাড়ির মানুষগুলোকে দেখে মালিহার মুখ খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে। তার ভারি শরীরটা না ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে গেল। দাদুকে ধরে সোফায় নিয়ে বসালো। মালিহার শাশুড়ি মা এবং জা এসে সকলের সাথে কুশলবিনিময় করলেন।
বাড়ির ছুটা বুয়াটা আজ সারাদিনের জন্য এ বাড়িতে আটকে গিয়েছে। ছোটাছুটি করে মেহমানদের আনা, মাছ, মিষ্টি, পিঠেপুলি আর ফলমূলের ঝুড়িগুলো নিয়ে নিয়ে কিচেনে রাখছিল আর বিড়বিড় করে বলছিল, “বড়লোকের সব বড় বড় কারবার। কপাল পোড়া হয় আমাদের মতো গরিবের। না পাই পেটপুড়ে খেতে। আর না আসে এত উপহারসামগ্রী। যেন এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই যথেষ্ট আমাদের জন্য। গরিবের ভালো মন্দ আবার কি জিনিস!”
বড় বড় রুই মাছগুলো নেওয়ার সময় বলতে লাগলো, “ইশ! কত বড় বড় মাছ। ছেলেমেয়েগুলো কতদিন বড় মাছ খায় না।”

কথাগুলো আস্তে বললেও ঠিক মালিহার কানে গেল। উৎফুল্ল মনটা ভারি হয়ে উঠলো। সকলের সাথে কথা বলা শেষে টুকটুক করে হেঁটে কিচেনে চলে এলো। শাশুড়ি মা আর ফুফু শাশুড়ি তখন রান্নাবান্নার কাজে ব‍্যাস্ত। আজ একটু কাজের তাড়া বেশিই। যেন বিশেষ কেউ আসবে। যদিও সব মেহমানই বিশেষ।
শাশুড়ি মায়ের কাছাকাছি গিয়ে মালিহা ছোট করে বললো, “আম্মা একটি আবদার ছিল। রাখবেন?”
একমাত্র মেয়ে থাকে প্রবাসে। দুই পুত্রের বউদের নিয়েই তার সংসার। মিশে থাকে যত শখ, আহ্লাদ। এমনিতেই সে বউদের বেশ আদর করেন। তার ওপর বউটি এখন পোয়াতি। তার আবদার কি ফেরানো যায়? মাংসে ঢাকনা দিয়ে পিছন ফিরে শুধালেন, “কি হয়েছে মা?”

মালিহার কিছুটা অস্বস্তি হয়। এভাবে মায়ের কাছে আবদার করা যায়। কিন্তু শাশুড়ির কাছে কি যায়? যদি মুখের ওপর না করে দেন। তবে যে লজ্জা পাবে। তবুও মুখ ফুটে বলে, “যে আপা আমাদের কাজ করে দেন ওনাকে আব্বুর আনা মাছগুলো থেকে একটি মাছ দিবেন আম্মা?”
ভদ্রমহিলা একটু অবাকই হন। মুখভঙ্গিতে বোঝা যায় তিনি ভাবতে পারেননি মালিহা এসব কিছু বলবে। কিছুক্ষণ থমকে দাড়িয়ে থাকেন।
অন‍্যদিকে মালিহার যেন প্রাণ যায় যায়! ভুল কিছু বললো কি সে?
একটু বাদেই হেসে ফেললেন তিনি। মালিহা হাফ ছেড়ে বাঁচে। বউমার কাধে হাত কাধে হাত রেখে বললেন, “আচ্ছা বেশ দিও। তুমি নিজে বেছে দিও কেমন?”

“আচ্ছা আম্মা।”
মালিহা চলে যেতেই ভদ্রমহিলা মনে মনে বলেন, “মেয়েটি ভারি সরল।”
সাত মাসের আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে ডাক্তার বলে দিয়েছেন কে আসতে চলেছে। সকলেই খুব খুশি। সে অনুযায়ী নীল সাদা বেলুন এবং ফুলের ডেকোরেশন করা হয়েছে। মালিহার জন্য রাখা হয়েছে নীল সাদার মিশ্রনে সুন্দর গাউন।

তখন মধ‍্য দুপুর। মালিহাকে সাজানোর দায়িত্ব পড়েছিল ফুফু শাশুড়ির ছোট মেয়ে ইমার ওপর। সাথে ছিল মালিহার ছোট চাচি। মালিহা তখন হিজাব বাধছিল। গাউনের সাথে হিজাব বেশ মানানসই। এতে অনেকটা শালীনতা বজায় রাখবে। ঠিক তখন গাড়ির হর্ন বেজে উঠলো। গেট পেরিয়ে একটি গাড়ি বাড়িতে প্রবেশ করলো। গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে তিনজন পুরুষ প্রবেশ করলো। নিচতলায় উপস্থিত সকলের মুখ খুশিতে ঝলমল করে উঠলো। শাশুড়ি মা জড়িয়ে ধরলেন আগান্তুককে। কতদিন দেখেন না!
সকলের সাথে কুশলবিনিময় শেষে আগান্তুক দোতলার পথ ধরলেন।

সাজ শেষ। রুমে তখন মালিহা একা। সাজানো শেষে ননদ আর চাচি চলে গিয়েছেন নিচে। মালিহা তখন ছড়ানো ছিটানো সাজের জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখছিল। হঠাৎ নজর যায় দরজার দিকে। সাদা শার্ট আর কালো প‍্যান্ট পরিহিত ফর্মাল লুকে তার চেনা কেউ দাড়িয়ে আছে। চুলগুলো ছোট করে ছেটে দেওেয়া। আপাদমস্তক একটি নিয়মে মোড়ানো ভদ্র সভ‍্য সুদর্শন পুরুষ। মালিহার যেন মাথাটা ঘুরে উঠলো। সব ফেলে দৌড়ে গেল সেদিকে। দন্ডায়মান মানুষটার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কান্নার বাধ ভেঙে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এ কান্না প্রাপ্তির, আনন্দের। কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো, “আপনার শূন্যতা আমাকে এত কেন পুড়িয়েছে জাওয়াদ? প্রতিটা মুহূর্ত কেন দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়েছে বলুন তো? আমি কিভাবে বেঁচে আছি শুধু আমিই জানি। আপনি খুব নিষ্ঠুর! কষ্ট দিয়েছেন আমাকে।”

জাওয়াদ মালিহার পিঠে হাত রাখে। আবেগে তার কন্ঠস্বরও জড়িয়ে আসে। কাধে থুতনি ঠেকিয়ে প্রতিত্তোরে বলে, “ভালোবেসে ফেলেছো যে। সরি, মাই লাভ। আর হবেনা। আমি এসে পড়েছি। এইতো তোমার সামনে।”
হাতের বন্ধন শক্ত হয়। বহুক্ষণ জড়িয়ে রাখে মালিহাকে। প্রিয়জনকে জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখাও অন‍্যরকম সুখ। এ সুখের যেন তুলনা হয় না।
চোখের পানিতে কাজল ঘেটে গিয়েছে। ঠোঁটের লিপস্টিকও ছড়িয়ে গিয়েছে। বউয়ের ঘেটে যাওয়া রূপ দেখে হেসে ফেলে জাওয়াদ। মালিহার কাধ ধরে আয়নার সামনে নিয়ে যায়। টিস্যু পেপার দিয়ে ঘেটে যাওয়া কাজল আর লিপস্টিক মুছে দিল। কপালের মাঝখানটায় পরপর তিনটে চুমু দিয়ে বললো, “আমি সাজিয়ে দিই?”
মালিহা লজ্জারাঙা মুখে মাথা নাড়ালো।

জাওয়াদ তার আনাড়ি হাতে বউকে সাজাতে লাগলো। তখনই দরজায় কড়া নড়ার শব্দ কানে এলো দুজনের। জাওয়াদ গিয়ে দরজা খুলে দিলো। রিপ্তি রুমে প্রবেশ করলো। হাতে একটি শপিং ব‍্যাগ। বিছানায় রেখে বললো, “এটা জাওয়াদের। পড়ে তাড়াতাড়ি করে তোমরা নিচে এসো। সবাই অপেক্ষা করছে।”
তারপর মালিহার কাছে গিয়ে শুধালো, “সারপ্রাইজ কেমন লাগলো মালিহা?”
মালিহা মেকি রাগ দেখিয়ে প্রতিত্তোরে বললো, “মোটেই ভালো করেননি। আগে বলে দিলে কি হতো?”
“তোমার বরের ইচ্ছে।”

রিপ্তি বেরিয়ে যেতেই মালিহা জাওয়াদকে জিজ্ঞাসা করলো, “এভাবে হঠাৎ এসে আমার হতে হতে না হওয়া হার্টএ‍্যাটাক না করিয়ে আগে জানালে কি হতো হু?”
জাওয়াদ দরজা বন্ধ করে মালিহার গাঁ ঘেঁষে দাড়িয়ে হাতের উপরিভাগে চুমু খেল। দুটো হাত মুঠোয় পুড়ে বললো, “সারপ্রাইজে আনন্দ দ্বিগুণ হয় বউ।”

রাগে অনুরাগে পর্ব ১৮

কিছুক্ষণ খুনসুটি চললো বহুদিন কাছে না পাওয়া দুজন মানব মানবীর। তারপর মালিহা শপিং ব‍্যাগ থেকে নীল রঙের একটি পাঞ্জাবী আর সাদা রঙের একটি পায়জামা বের করে জাওয়াদকে ওয়াশরুম পাঠালো। গোসল শেষে জাওয়াদ পাঞ্জাবী পড়ে বের হলো। নীল সাদা পোশাকে সুদর্শন লম্বাটে জাওয়াদকে যেন আরেকটু সুন্দর করে তুললো মালিহার চোখে। সে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো, “সুন্দর। দারুণ সুন্দর!”

রাগে অনুরাগে শেষ পর্ব