রাগে অনুরাগে পর্ব ৪

রাগে অনুরাগে পর্ব ৪
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি

“মালিহা দাড়াও!”
ভার্সিটি গেটের বিপরীত পাশের লাইব্রেরি থেকে ক্লাসের দুটো বই কিনতে এসেছিল মালিহা। বইদুটো কিনে ব‍্যাগে ভরে সবে হাঁটা ধরেছিল ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। এরমধ্যেই পরিচিত কন্ঠস্বরে তার চলমান পা দুটো থেমে যায়। পেছন ঘুরে তাকিয়ে আবিষ্কার করে শ‍্যামবর্ণের এক যুবা পুরুষের মুখশ্রী। বিরক্তিতে কপালে তিনটে ভাজের রেখা ফুটে ওঠে। মালিহার দিকে তাকিয়ে ছেলেটি হাসে। তবে সে হাসিতে কেন যেন বিষাদ লেগে আছে।
ছেলেটি পুনরায় বলে, “বিয়েটা তাহলে করেই ফেললে! অপেক্ষা করা যেত না আরেকটু? আমার সাথে এমন না করলেও পারতে।”

রোদের তেজে ঘেমে গিয়েছে মালিহা। ছেলেটির একনাগারে করা অভিযোগে তেতে ওঠে মেজাজ। টিস্যু কপালের ঘাম মুছে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে জবাব দেয়, “অপেক্ষা করার কথা কখনও ছিল আরহাম ভাইয়া? আমি আপনাকে বলেছি বিয়েটা আপনাকেই করব? নাকি আপনাকে ভালোবাসার কথা কখনও বলেছিলাম? আপনার সাথে কি করা উচিত ছিল বলুন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মালিহার একের পর এক প্রশ্নে ছেলেটি থতমত খেয়ে যায়। ইতস্তত করে বলে, “আসলে বিষয়টি সেরকম নয়। ভালো তো আমি তোমাকেই বেসেছিলাম মালিহা।”
“আমার কি করার থাকতে পারে আরহাম ভাই? আমি আপনাকে বলিনি আমাকে ভালোবাসতে। অপেক্ষাও করাইনি। তাহলে কেন এই মিছে অভিযোগে অভিযুক্ত করছেন? তাছাড়া আপনাকে কি সুযোগ দেওেয়া হয়নি?”
“দিয়েছিলে কিন্তু……”

“কিন্তু কি? আপনি যখন ভালোবাসার কথা জানালেন, আমি বলেছিলাম না আমার বাড়ি থেকে বিয়ের কথাবার্তা চলছে। যদি সৎ ইচ্ছা থাকে তবে আমার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সাথে কথা বলুন। বলেছিলাম না এসব?”
মালিহার একের পর শক্ত কথায় ছেলেটি মুষড়ে পড়ে। মনের প্রেমান্দোলন দেখানো হয়ে ওঠে না মালিহাকে। বলাও হয় না, সে ঠিকই বাড়িতে বিয়ের কথা বলেছিল কিন্তু তার সৎ মা মুখের ওপর বলে দিয়েছিল, “নিজে বাপের ঘাড়ে বসে খাচ্ছো। আবার বিয়েও করতে চাচ্ছো। চাকরি বাকরি কিছুই করো না। দুটো পয়সা উপার্জনের মুরদ নেই। বলি কোন মুখে বিয়ের কথা বলো? লজ্জা করে না?”

সেদিন সৎ মায়ের মুখ থেকে এহেন অপমান জনক কথা শুনে লজ্জায় ঘৃণায় নুয়ে পড়েছিল মাথাটা। সেদিন তার বাবাও ছিলেন নিরুত্তর। কয়েক জায়গায় চাকরির ইন্টার্ভিউ দিয়েও সফল হয়নি। তাদের আরও যোগ্য লোক চায়। চারিদিক থেকে হতাশা, বিষাদ ঘিরে ধরেছিল তাকে। ভাগ‍্য সুপ্রসন্ন থাকলে আজ তার মা বেঁচে থাকতেন। পরিস্থিতি তিনিই সামলে নিতে পারতেন। কিন্তু কথায় আছে না অভাগা যেদিকে যায় সেদিকই সাগর শুকায়। এমন নয় যে তাদের টানাটানির সংসার। রমরমা পাট আর মসলার ব‍্যবসার বাবার। তবুও! এসব কথা মালিহার জানা হবে না কখনও। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক চিরে। মালিহাকে জবাব দেওয়ার মত কথা খুজে পায় না ছেলেটি।

মালিহা হাত ঘড়ি চেক করে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তার। সামনে দাড়ানো ক্লান্ত মুখের ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি চলি আরহাম ভাই। আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। এভাবে যেখানে সেখানে ডাকবেন না আমাকে। আমার এসব পছন্দ নয়। ভালো থাকবেন।”

মালিহা গটগট করে হেঁটে চলে যায়। ব‍্যাথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছেলেটি। চিনচিন ব‍্যাথাও হয় বুকে। এই মেয়েটি তার হলো না। এই একটি বাক‍্য যেন তার মন মানতে নারাজ। ভাগ‍্যের ওপর তার এক আকাশ সমান অভিযোগ। কেন তাকে সৃষ্টিকর্তা সব দিয়েও দেন না!

নিজের ডিপার্টমেন্ট ভবনের কাছাকাছি আসতেই বান্ধবীদের সাথে দেখা হয় তাদের। বিয়ের পরে এটাই তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। বান্ধবীকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে মেয়েগুলো। হেসে কুশল বিনিময়ে করে। কথোপকথনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয় জাওয়াদ। মালিহার বিরক্ত লাগে, রাগ হয়। কেন অসভ‍্য মানুষটার কথা রসিয়ে রসিয়ে বলতে হবে। মেয়েগুলোর মধ্যে থেকে আসমানি নামের মেয়েটি হঠাৎ দুষ্টু হেসে শুধালো, “হ‍্যাঁরে মালিহা, কেমন কাঁটলো তোদের বাসর? দুলাভাই কি উপহার দিয়েছিল তোকে?”

মালিহার বলতে ইচ্ছে করলো, “আমার বাসর হয়েছে দুনিয়ার সবথেকে স্পেশাল বাসর। এমন বাসর চারচক্ষু লাগিয়েও খুজে পাওয়া যাবে না। আর যে উপহার তিনি আমাকে দিয়েছেন তা হয়তো খুব ভাগ‍্যবান না হলে কেউ পাই না।” মনের কথা মনেই রয়ে গেল। বলা হলো না। মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে বললো, “বাসর ঘর কেমন কাঁটে এটা জানতে হলে বিয়ে করতে হবে। বরের জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে হবে। এরপর ঘটবে আসল টুইস্ট। বুঝলি? এককাজ কর, বিয়ে করে ফেল। এরপর বুঝতে পারবি বাসরে কি হয়। এবং কি উপহার পাওয়া যায়। শুনে মজা পাবি না।”

মালিহার বান্ধবীদের মুখ হাসিহাসি। যুবতি মেয়েরা বিয়ে, বাসরের কথা শুনলে যেন লজ্জায় নুয়ে পড়ে। একমাত্র মালিহার চোখমুখ শক্ত, গম্ভীর হয়ে আছে। নতুন জীবনের প্রথম রাত তার জন্য সুখকর ছিল না। সে রাতের কথা মনে পড়লে এখনো শরীরের লোমকূপ দাড়িয়ে যায়। কি বিভীষিকাময় রাত ছিল তার জন্য! অথচ জাওয়াদ চাইলে সে রাতটি হয়তো মধুর রজনীতে পরিণত হতে পারতো। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মালিহার। এক নিমিষেই জীবনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। আদৌ ঠিক হবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই।

ঘন্টার আওয়াজে সবাই ক্লাসের দিকে এগোয়। তাদের থার্ড ইয়ারের নতুন ক্লাস টিচার ভারি রুক্ষ মানুষ। স্টুডেন্টদের অনিয়ম একদম পছন্দ করেন না। বেশ কায়দা করে অপমান করেন। তাই প্রথম ক্লাসটা সবাই সময়মতো পৌছানোর চেষ্টা করে। কার ই বা ইচ্ছে থাকে বুড়ো বয়সে টিচারের থেকে অপমানিত হওয়ার।
ক্লাস শেষে দ্বিপ্রহরের তপ্ত রোদ মাথায় করে বাড়ি ফিরলো মালিহা। ঘামে ভিজে চটচটে হয়ে আছে শরীর। মন, মেজাজও বেশ উত্তপ্ত!

জামিলা বেগম ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে তসবিহ পড়ছিলেন। মুখজুড়ে কেমন বিষণ্ণতা বিরাজমান। মালিহা বাড়িতে ঢুকে সোজা এগিয়ে গেল দাদু দিকে। মুখে হাত ছুইয়ে শুধালো, “কি হয়েছে বুড়ি? মন খারাপ? পুত্র বউয়ের সাথে একদফা ঝগড়া হলো নাকি?”
মালিহার একের পর এক প্রশ্নে উত্তর দেওয়ার কোন তাড়া দেখা গেল না জামিলা বেগমের মধ্যে। তিনি বিরবিরিয়ে দোয়া পড়ছিলেন।

মালিহা ফ‍্যানের ভলিউম বাড়িয়ে দাদুর পাশে বসে পড়লো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে।
নিরবতার অবসান ঘটিয়ে জামিলা বেগম জিজ্ঞাসা করলেন, “তোর মাথার এক গোজা চুল কিভাবে উঠলো?”
মালিহা জানতো দাদু এমন কিছুই জিজ্ঞাসা করবেন। লুকিয়ে রাখার প্রশ্নই ওঠে না। স্বামী ভালো হলে দিন শেষে একবেলা খেয়ে কাটিয়ে দেওেয়া যায়। কিন্তু স্বামীর অত‍্যাচার মেনে নেওয়া যায় না। অন্তত তার মতো মেয়ের পক্ষে তো নয়ই। দাদুর প্রশ্নের প্রতিত্তোরে বললো, “জাওয়াদ ছিড়েছে।”

“সেকি কেন?” বিস্ময় জামিলা বেগমের কন্ঠে!
“আমি দোষ করেছি তাই।”
“একদিন যাইতে না যাইতেই কি এমন করেছোস যে চুল ছিরে ফেলতে হইবো? হেয়ালি করবি না। সবটা ক।”
এরপর মালিহা এক এক করে বলতে শুরু করে। কিছুই লুকায় না। সে নিজেও যে দুটো কঠিন কথা শুনিয়েছিল জাওয়াদকে সেটাও বলে। বিনিময়ে জাওয়াদ তার সাথে কেমন ব‍্যবহার করেছিল সেটাও বললো। সব শুনে স্থির হয়ে বসে রইলেন জামিলা বেগম। হাত থেকে তসবিহ খসে পড়ল। তার এত আদরের নাতনির কপালে এই ছিল?
নিজেকে ধাতস্থ করে ফের প্রশ্ন করলেন, “এত কিছু হইয়া গেল অথচ কাউকে কিছু জানাস নাই কেন? এইখান থেইকা যখন ফোন দেওেয়া হইলো কিছুই তো বললি না।”

“কি করে বলতাম আমি? সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছি সেখানে থাকব না আমি। তাই আর ওখানে বসে ঝামেলা বাড়াতে চাইনি। তাছাড়া যা হয়েছে লোক সম্মুখে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলা যায়? বাড়িতে জানালে নিশ্চয় কেউ মুখে কুলুপ এটে বসে থাকতে না। দুপক্ষের জানাজানি, রেষারেষিতে লোক জানাজানি হতো। এজন্য আমি তখন কোন ঝামেলায় জড়াতে চাইনি। তাছাড়া শরীরও ভালো ছিল না। মন মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিল। ওই সময় কোনো স্টেপ নেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলাম না। তাছাড়া যে অন‍্যায় করেছে সেই তো লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।”

জামিলা বেগম কিছু বলার আগেই মালিহার আম্মু মেয়ের জন্য ঠান্ডা লেবুর শরবত করে নিয়ে আসেন। মেয়ের পাশে বসে গদগদ কন্ঠে বলে ওঠেন, “ও বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। ওরা বললো জাওয়াদ আজ বাড়ি ফিরছে। কাল তোকে নিতে আসবে।”

মায়ের হাত থেকে সবে শরবতের গ্লাসটি নিয়েছিল মালিহা। পেটে চালান করার আগেই হাত থেকে ছিটকে পড়লো মেঝেতে। রক্তশূন্য মুখে দাদুর দিকে তাকালো।
বউমার ওপর রাগ হয় জামিলা বেগমের। তিনি রাগী কন্ঠে বলে উঠলেন, “মনে কি উৎসব লাগছে বউমা? মাইয়াডা সবে আইলো। নিতে আসার খবরে এত খুশি হওনের কি আছে?”

রাগে অনুরাগে পর্ব ৩

“কি যে বলেন না আম্মা! বিয়ের পরে স্বামীর ঘরই তো মেয়েদের আসল ঠিকানা। শশুর বাড়িতে ফিরে যাবে অবশ্যই মা হিসাবে খুশি হবো। রাগের কি আছে এখানে!”

রাগে অনুরাগে পর্ব ৫