রাগে অনুরাগে পর্ব ৬

রাগে অনুরাগে পর্ব ৬
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি

রিকশার চলমান তিনটি চাকা এসে থামলো ভার্সিটির গেটের সামনে। মালিহা ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল। চারিদিকে নজর বুলিয়ে কাঙ্খীত মানুষটিকে খুজলো কিছুক্ষণ। পেয়েও গেল। রোদের উত্তপ্ত তেজ সরাসরি এসে মুখে লাগছে। চামড়া ঝলসে যাবার জোগাড়! মালিহা ক‍্যাম্পাসের দিকে না গিয়ে কাঙ্খীত মানুষটির দিকে এগিয়ে গেল। হতে পারে এটাই তাদের শেষ সাক্ষাৎ!

আজকাল আরহামকে আর বাইকে উড়ে বেড়াতে দেখা যায় না। সিনিয়র হিসাবে বেশ কদর তার। কিন্তু ইদানিং সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। যেদিন মালিহার বিয়ে হলো ঠিক সেদিনই তার ঠোঁট দুটো প্রথমবারের মত সিগারেটের ছোঁয়া পেয়েছিল। সে কি খেল, কোথায় গেল এসবের কোন খোঁজখবর রাখেন না তার পরিবার। কোন এক অজানা কারণে তার বাবাও তার ওপর থেকে স্নেহের নজর সরিয়েছেন। হয়তো মা না থাকার জন‍্যই। সেই জন‍্যই তো কথায় বলে, ‘মা না থাকলে বাপ হয় তালয়।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিজ পিতার সামনে সৎ মা যেদিন যা নয় তাই বলে অপমান করেছিল ঠিক সেদিনই আরহামের মনে হয়েছিল এ বাড়িতে তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। বাবার নিরব অভিব‍্যাক্তি বড্ড কষ্ট দিয়েছিল সেদিন। তাই তো এক এক করে অধিকার ছেড়ে দিচ্ছে ছেলেটা। বাইকে ধুলো জমে অথচ যত্ন নিয়ে মোছা হয় না। খাবারের টেবিলের তার বসার চেয়ারটাও শূন্য পড়ে থাকে। মাথা গোজার একটা ঠাঁই হলে একেবারে সরিয়ে ফেলবে নিজেকে।

চাকরির ইন্টার্ভিউ যেদিন না থাকে সেদিন ভার্সিটির সামনের চায়ে ছোট্ট টংয়ের দোকানে আধ খোলা শার্টে, এলোমেলো চুলে সিগারেট ফুঁকতে দেখা যায় আরহামকে। ভার্সিটিতে তার কাজ নেই। মাস্টারস শেষ হয়েছে আরও কয়েক মাস আগে। অর্থাৎ এখানেও তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তবুও আসে। যদি তার জ্বালাময়ীকে দেখা যায় এক পলক! মস্তিষ্ক বলে, ‘সে অন‍্যের।তাকে দেখা তোমার জন্য পাপ!’ কিন্তু অবুঝ মন বলে ওঠে, ‘ভালোবাসায় আবার কিসের পাপ!’

একটু দূরত্ব রেখে মালিহা সোজা গিয়ে আরহামের পাশে বসলো। দোকানিকে দুধ চায়ের অর্ডার দিলো। তারপর আরহামের দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুধালো, “ভালো আছেন আরহাম ভাই?”
আরহাম বিস্ময়ভরে দেখছে মালিহাকে। পরিচয়ের পরে কখনও মালিহা নিজ থেকে তার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসেনি। আর না পাশাপাশি বসা হয়েছে কখনও। মেয়েটিকে দেখেই বুকে চিনচিন ব‍্যাথা হতে লাগলো আরহামের। মালিহার জবাবের আশায় তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিজের বিস্ময় কাটিয়ে জবাব দিলো, “ভালোই। তুমি?”

”আলহামদুল্লিল্লাহ ভালো। আজ চলে যাচ্ছি।”
“কোথায়?”
“শশুরবাড়িতে।”
“ওহ।”

চুপ রইলো আরহাম। বলার মতো কিছু খুজে পেল না ছেলেটি। শশুর বাড়ি যাবে তাকে কেন বলতে এসেছে? নাকি তাকে জ্বালাতে এসেছে মেয়েটি? মনের মধ্যে যে তুষের আগুন জ্বলছে তাতে আরেকটু খুচিয়ে দিতে এসেছে সে?
নিরবতা গ্রাস করে নিলো মালিহা আরহামকে। দোকানি চা বানিয়ে দিলে আগ্রহ নিয়ে পুরোটা চা খেল মালিহা। চায়ের বিল দিয়ে দুটো ব্রেড কিনে নিলো। বেঞ্চ ছেড়ে ওঠার সময় আরহামের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, “ভালোবাসতে হলে সাহসী হতে হয় আরহাম ভাই। নানান প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তবেই না পূর্ণতা পায়। কেন সেদিন আরেকটু শক্ত হয়ে বললেন না, আমার জন্য অপেক্ষা করো। কেন থেকে যেতে বললেন না আরহাম ভাই? তাহলে আজ হয়তো সম্পর্কের হিসাবটা অন‍্যরকম হতো। চলি।”

আরহামকে এক আকাশ দ্বিধায় রেখে হেলেদুলে ক‍্যাম্পাসের দিকে এগিয়ে গেল মালিহা। প্রতিটা শব্দ উচ্চারণের সময় কেঁপে কেঁপে উঠছিল তার কন্ঠনালি।
বেকারত্বের বেড়াজালে আটকে থাকা যুবকদের হতাশা বিষণ্ণতার শেষ থাকে না। গোটা দুনিয়ার কাছে তারা হয়ে যায় আবর্জনা। ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে, ভাগ‍্যের অন্বেষণে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে পৃথিবীতে সবচেয়ে অসহায় মানুষ বলে মনে হচ্ছিলো নিজেকে আরহামের।

মালিহার বলা কথাগুলো ঠিক হৃদয়ের মাঝ বরাবর গিয়ে আঘাত হেনেছে। সত্যি কি তার ত্রুটি ছিল? আরেকটু শক্ত হওয়া উচিত ছিল? আরহামের খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো, “যাদের পায়ের তলার মাটি থাকে না, তাদের শক্ত হতে নেই। তারা ভেসে বেড়ায় জনপদের আনাচকানাচে। কোথাও স্থির হবার অধিকার তাদের নেই।” মনের কথা মনেই পড়ে রইলো। ততক্ষণে মালিহা তার চোখের আড়াল হয়েছে। ফের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। তার জীবনে কিছুই রইলো না। কিচ্ছু না।

পকেট থেকে সিগারেট বের করে লাইটার দিয়ে আগুন ধরালো। ফুঁকতে ফুঁকতে এগিয়ে গেল অজানা কোন এক গন্তব্যে। হঠাৎ আরহামের মস্তিষ্কে এক অজানা চিন্তা এসে হানা দিলো। ভাবতে ভাবতে চলমান পা দুটোও থেমে গেল। তবে কি তার জ্বালাময়ী ভালো নেই? সুখে থাকলে তো এসব বলতে আসতো না। নাহ! মস্তিষ্ক এত প্রেশার নিতে পারে না। ঝিমঝিম করে ওঠে মাথা। চোখে অস্পষ্ট দেখে চারিপাশ।

বান্ধবীদের বিদায় দিয়ে সময়ের আগেই ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে পড়ে মালিহা। আজও বেশ গরম পড়েছে। পড়বেই তো। আবহওয়া এখন উষ্ণ। একটু বেশিই উষ্ণ। উষ্ণ মালিহার মন মেজাজও। তেজি রোদ মুখে এসে পড়ছে। কপালে হাত ঠেকিয়ে রোদ আটকানোর চেষ্টা করলো। এদিক ওদিক খুজেঁ একটা রিকশাও পেয়ে গেল। কিন্তু মুশকিল হলো ভাড়া দিতে গিয়ে। রিকশাওয়ালা দিগুণ ভাড়া চাইলো। অন‍্য সময় হলে ঝগড়া বেধে যেত মালিহার। কিন্তু আজ চুপচাপ ভাড়া মিটিয়ে দিলো। তার সাজানো গোছানো ছোট্ট জীবনটায় যেখানে ভেঙেচুড়ে শেষ হতে বসেছে সেখানে রিকশাওয়ালার আর দোষ কোথায়?

গেটের ধারে একটি বেওয়ারিশ বয়স্ক কুকুর বসে থাকে। বাড়ি পাহারা দেয় সে। মালিহা ব‍্যাগ থেকে ব্রেড দু পিস বের করে এগিয়ে দেয় কুকুরটির দিকে। খাবার দেখে চকচক করে ওঠে চোখদুটো। মুখ দিয়ে কিসব শব্দ করে কুকুরটি। হয়তো কৃতজ্ঞতা জানান দিচ্ছে সে। মালিহা হাসে। হয়তো এটাই তাদের শেষ দেখা। মৃত্যুর যে ধরাবাধা কোন সময় নেই। যখন তখন হানা দিতে পারে।

সদর দরজা দিয়ে ড্রয়িং রুমে স্পষ্ট দেখা যায়। দরজার সামনে একটু ঝুকে জুতা খুলতে গিয়ে মালিহার চোখ পড়ে গেল সিঙ্গেল সোফায় বসা সফেদ রঙা পাঞ্জাবীতে আবৃত জাওয়াদকে। সে একমনে ফোন স্ক্রল করতে ব‍্যাস্ত। টে টেবিলের ওপর হরেকরকম নাস্তা সাজানো। অর্থাৎ তাদের আগমনের বেশিক্ষণ হয়নি। জাওয়াদকে দেখা মাত্রই ক্রোধ, ঘৃণায় চোখ বন্ধ করে ফেলল মালিহা। লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলালো। এগিয়ে গেল বাসার ভেতরে।
মায়া বেগম ও তার ছোট জা মিলে ছোটাছুটি করে নাস্তার আইটেম গুলো এনে মেহমানদের সামনে রাখছেন।

পথিমধ‍্যে মালিহাকে আসতে দেখে মেজাজ তেতে উঠলো মায়া বেগমের। মেয়ের দিকে চোখ গরম করে তাকালেন। মালিহা পাত্তা দিল না মায়ের উষ্ণ চাহনীর। নিজ মা যখন মেয়েকে সংসার বাঁচানোর খোরাক মনে করে অপমানিত স্থানে মেয়েকে পাঠাতে পারে। সেই মায়ের নরম কিংবা গরম কোন চাহনীর কদর নিশ্চয় মেয়ের তোয়াক্কা করা উচিত নয়। ছোট চাচি মালিহাকে দেখে আলতো হাসলেন।

মালিহাও একটু হাসি ফিরিয়ে দিলো প্রতিত্তোরে। সামনে এগোতেই চোখে পড়ল শশুর, ভাসুর, জা ও তাদের তিন বছরের মেয়েকে। রিপ্তি এসে জড়িয়ে ধরলো মালিহাকে। বাকিরা সকলে কুশর বিনিময় করলেন। কেবল চুপ রইল জাওয়াদ। অবশ‍্য মালিহাও আশা করেনি জাওয়াদ তার সাথে কথা বলবে। মালিহা নিজের রুমের দিকে না গিয়ে দাদুর রুমে গেল সোজা। জামিলা বেগম ব‍্যাগে কাপড় গোছাচ্ছেন। তাহলে সত্যি তিনি নির্বাসনে যাচ্ছেন।
মালিহা দাদুর রুমে থাকা হাতল দেওেয়া চেয়ারটাতে বসলো। হিজাব খুলে পাশে রাখলো। দাদুকে জিজ্ঞাসা করলো, “তাহলে চলেই যাচ্ছো?”

চোখ তুলে একবার দেখলেন নাতিকে। হাসলেন একটু। প্রতিত্তোরে বললেন, “মেহমানের বেশি দিন এক জায়গায় থাকনোরে নিয়ম নাই বুবু। দুদিন থাইকা চইলা যাইতে হয়। না হলে কথায় আছে কুটুম বাড়ি মধুর হাড়ি, দুইদিন পর ঝাটার বাড়ি। ওই ঝাটার বাড়িই খাইতে হয়।”
দাদুর চোখের দিকে তাকানোর সাহস হয় না মালিহার। শেষ বয়সে এসে থাকা খাওয়ার খোটা শুনার মতো দূর্ভাগ‍্য হয়েছে তার। এ দুঃখ বোঝা বইতে না পারলেও আন্দাজ করতে পারে মালিহা। আজ তার জন্য দাদুকে তার চেনা স্থান ছাড়তে হচ্ছে। নিজের ছেলের বাসাকে পরের বাড়ি মনে করছেন। সবকিছুই তো তারই জন‍্য। অপরাধবোধে ভোগে মালিহা। দাদু কিংবা পরিবারের অন‍্য কোন সদস্য, কাউকেই কষ্ট দিতে চাইনি সে। প্রসঙ্গ বদলে মালিহা ফের জিজ্ঞাসা করলো, “আবার কবে আসবে?”

জামিলা বেগম প্রতিত্তোর করলেন না। তসবিহ, হাদিসের বইগুলো ব‍্যাগের সাইড পকেটে ভরে বললেন, “ঘাম গতরে বসে থাইকো না। মা বকবো পরে। গোসল দেও। সকলে আইছে তাদের কাছে কাছে থাকো। খারাপ দেখাবো।”
মালিহা উঠে দাড়ালো। যাওয়ার আগে দাদুর দুঃখি, বিষণ্ণ মুখখানার দিকে তাকালো। শেষ বয়সে মানুষটা দারুণ দুঃখ পেল।

গোসল সেরে ছোট ছোট গোলাপ ফুলের এমব্রয়ডারি করা সুতির কামিজ সেট পড়লো মালিহা। কপাল পযর্ন্ত ওড়না টেনে ড্রয়িং রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। রিপ্তি মালিহাকে দেখা মাত্রই কাছাকাছি এসে দাড়ালো। চোখাচোখি হলো জাওয়াদের সাথে। নিঃসন্দেহে জাওয়াদ অসম্ভব সুন্দর। চেহারায় যতটা না মুগ্ধতা। ঠিক ততটাই কলুষিত তার ব‍্যবহার। চোখ নামিয়ে নেয় মালিহা।

রাগে অনুরাগে পর্ব ৫

খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে রিপ্তি মালিহার হাতে একটি শপিং ব‍্যাগ ধরিয়ে দিলো। বললো, “শাড়িটি পড়ে যাবে।”
মালিহা জানালো, “আমি শাড়ি পড়তে পারি না।”
“আচ্ছা বেশ, আমিই পড়িয়ে দিব। এখন যাও তো জাওয়াদের পাশে বসো। কতদিন বাদে দুজনের দেখা।”
জাওয়াদ কিছুটা চেপে বসলো। জায়গা করে দিল মালিহাকে। অবাক হলো মালিহা। লোকটা কি চাইছে তাহলে?

রাগে অনুরাগে পর্ব ৭