রাগে অনুরাগে পর্ব ৮
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি
বেশ অনেকটা সময় পরে মালিহার জ্ঞান ফিরে। রুমে তখন মালিহার শাশুড়ি মা এবং জা বসে ছিল। শোয়া থেকে উঠে বসতে গেলে রিপ্তি গিয়ে ধরে বসিয়ে দেয়। শরীরে তখনও দূর্বলতার ছাপ স্পষ্ট। শাশুড়ি মা বড় বউমার উদ্দেশ্যে বলেন, “ওর তো জ্ঞান ফিরেছে। জাওয়াদ যে ওষুধ গুলো এনে দিয়েছে সেগুলো খাওয়াতে হবে। তাতে দূর্বলতা, ক্লান্তি ভাব কমবে। তুমি ওর জন্য খাবারটা বেড়ে নিয়ে এসো। এই শরীর নিয়ে নিচে গিয়ে কাজ নেই।”
রিপ্তি মাথা দুলিয়ে বললো, “জি আচ্ছা মা।”
তারপর দ্রুত পা চালিয়ে রুম ত্যাগ করলো। রিপ্তি মেয়েটির মধ্যে হাসিখুশি চঞ্চলতা বিরাজমান। মালিহা তাকে যতবার দেখেছে ততবারই মুখে স্বভাবসুলভ মিষ্টি হাসিটা লেগে থাকতে দেখেছে। শাশুড়ির আচরণও বেশ কোমল। বাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও সবার দিক থেকে ভালোই। শুধু ভালো না মালিহার সবথেকে কাছের মানুষটা। মেয়ে মানুষের সংসার জীবন কখনও সহজ হয় না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শশুরালয়ে প্রতি পদক্ষেপে মেনে নিয়ে মানিয়ে চলার যুদ্ধ করে যে তে হয়। যে সবকিছু মেনে নিয়ে চলতে পারে দিন শেষে সেই সুখী হয়। এ তো আজীবনের সংসার মন্ত্র! শশুর বাড়িতে স্বামীর ভালো ব্যবহার, সাপোর্ট, ভালোবাসা হলো একজন নারীর জন্য মূখ্য। বাকি সদস্য যেমন, শাশুড়ি ; ননদ; জা এরা সব গৌণ। এরা ভালো না হলেও নির্দিধায় সংসার করা যায়। এ দেশে একশ ভাগের মধ্যে আশি ভাগ নারীর জীবন কেঁটে যায় শাশুড়ি, ননদ, জায়ের কটুক্তি হজম করতে করতে।
কিন্তু দিন শেষে যদি স্বামী নামক মানুষটা বুকে স্থান পাওয়া যায়, শান্তিতে তার বুকে মাথা রেখে রাত্রি যাপন করা যায় তাহলে নারী তার সারাদিনের লাঞ্ছনা গঞ্জনা ভুলে থাকতে পারে। মনে জমা হওয়া কষ্ট স্বামীর আদুরে স্পর্শে ঝরঝর করে ঝরে পড়ে। মালিহার অভিমান হয়। সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার অভিমান জমে। কেন তার জীবনে জাওয়াদের মতো মানুষ আসলো?
মাথায় ঠান্ডা তরলের অস্তিত্ব অনুভব করতেই মালিহার ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে। শাশুড়ি মা মাথার তালুতে নারকেল তেল দিয়ে দিচ্ছেন। উত্তপ্ত মাথাটা কিছুটা শীতল হলো। আবেশে মালিহা চোখ বন্ধ করে ফেললো। ততক্ষণে রিপ্তি খাবার নিয়ে চলে এসেছে। বিছানার একপাশে খাবারের ট্রেটা রাখলো। মাথায় তেল দেওেয়া শেষ হলে শাশুড়ি মা ওয়াশ রুম থেকে হাত ধুয়ে এলেন। তরকারির ঝোল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে মালিহার উদ্দেশ্যে বললেন, “দেখি মা হাঁ করো তো!”
মালিহা বিনাবাক্যে মুখ খুললো। আলু দিয়ে গরুর পাতলা ঝোল করা হয়েছে। সাথে সাদা ভাত। শাশুড়ি মা বেশ যত্ন নিয়ে খাবার খাইতে দিতে লাগলেন। মালিহা সবটা খেল। পেটে ক্ষুদা জমে ছিল। গতকাল থেকে তার পেটপুড়ে খাওয়া হয়নি। দুশ্চিন্তা, ভয়, অস্তিত্ব আরও কাবু করে ফেলেছিল মেয়েটিকে।
খাবার খাওয়ানোর পাঁচ মিনিট পরে দুটো ওষুধ খাওয়ানো হলো মালিহাকে। ততক্ষণে দেয়াল ঘড়ির দিকে মালিহার নজর পড়লো। ঘড়িতে তখন সময় নয়টা বেজে পাঁচচল্লিশ মিনিট। বেশ অনেকটা সময় ব্যায় করেছে এই মানুষগুলো তার পিছনে। রিপ্তি এটো থালাবাসন গুছিয়ে শাশুড়ি মায়ের উদ্দেশ্যে বললো, “আম্মা আমি বাবুকে খাইয়ে দিয়ে আসি। নাহলে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বে।”
শাশুড়ি মা প্রতিত্তোরে বললেন, “আচ্ছা যাও।”
অল্প সময়ের মধ্যে সামান্য হলো একটু দূর্বলতা জেগেছে শাশুড়ি মায়ের জন্য মালিহার। নারী মন সবসময় একটু আদর ভালোবাসা কাঙাল। নিজের মা যখন দূরে ঠেলে ফেলে দিয়েছে সেখানে শাশুড়ি মায়ের এমন কোমল আচরণ মালিহার কাছে অপ্রত্যাশিতই বটে। কৃতজ্ঞতায় দৃষ্টি নুয়ে আসে মেয়েটির। হঠাৎ এক অদ্ভুত আবদার করে ওঠে। বলে, “আজকে আমার পাশে থাকবে মা?”
মা শব্দটি উচ্চারণ করতেই কন্ঠনালি কেঁপে ওঠে মালিহার। সে জানে এমন কিছু বলা ঠিক হয়নি। কিন্তু এমতাবস্থায় কিছুতেই সে জাওয়াদের সম্মুখীন হতে পারবে না। ওই মানুষটাকে দেখলেই তার ঘৃণায় শরীর কাপতে থাকে। হয়তো আগের মতো হলে শক্ত কিছু দিয়ে পিটিয়ে মে’রেই ফেলতো।
মালিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। ঝনঝন শব্দ হয় হাতের চুড়িগুলোতে। মুখে সবসময় মৃদু হাসি লেপ্টে থাকে ভদ্রমহিলার। শুধালেন, “মায়ের কথা মনে পড়ছে?”
জমে থাকে আবেগ অশ্রু হয়ে ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়ে মালিহার। ঠোঁট চেপে কান্না আটকাতে চাইলেও ব্যার্থ হয় মেয়েটি। মাঝেমধ্যে চোখের পানিও বড্ড অবাধ্য হয় পড়ে। মালিকের মন মর্জি বোঝে না। মায়ের কথা খুব মনে পড়ে মালিহার। পৃথিবীর একমাত্র আপন ব্যাক্তিই হন মা। যিনি কোনরকম স্বার্থ ছাড়াই সন্তানের জন্য জান প্রান বিলিয়ে দিতেও কার্পণ্য করেন না। নয়টা মাস কষ্টের ওপর কষ্ট সহ্য করে সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখান। পেট থেকে বুকে নিতে একজন মায়ের যে কষ্ট সহ্য করতে হয় তা যদি কোন সন্তান আগে বুঝতে পারতো তাহলে হয়তো পৃথিবীতে ওল্ড কেয়ার নামের কোন আবাসন তৈরি হতো না।
মা হওয়ার কষ্ট মালিহা অনুভব করেনি সত্য। কিন্তু মায়ের ভালোবাসা সে অস্বীকার করতে পারেনা। কতটা যত্ন নিয়ে মায়া বেগম তাকে বড় করে তুলেছেন সেই দিনগুলোও তো ভুলবার নয়। মেয়েটির চোখ থেকে নিরব অশ্রু বর্ষিত হয়। শাশুড়ি মা আর কোন প্রশ্ন করেন না। বলেন, “তোমার শশুরের রাতের খাবারটা দিয়ে আসি। আমি দেখিয়ে না দিলে ঠিকমতো ওষুধগুলোও খেতে পারে না মানুষটা। মাঝেমাঝে ভাবি, আমি না থাকলে কি হবে মানুষটার! তুমি বিশ্রাম করো। আমি ওদিকটা গুছিয়ে আসছি। ভয় পেও না। ততক্ষণে জাওয়াদ থাকবে তোমার কাছে।”
মালিহার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, “জাওয়াদের ছায়াটি যেন এই রুমে না আসে। তাকে আমার সহ্য হয় না। ঘৃণা হয়!”
বলা হয় না সে কথা। মুখের কথা মনের মধ্যেই চেপে রাখতে হয় মেয়েটির। শাশুড়ি মা উঠে পড়েন। ঝলমলে আলো নিভিয়ে মৃদু আলোর লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে যান। শাশুড়ি মা চলে যেতেই খোলা জানালায় চোখ যায় মালিহার। জানালার গ্রিল গলিয়ে চাদের আলো এসে পড়েছে। হাওয়ার তালে পর্দাগুলো চঞ্চল কিশোরীর ন্যায় দুলতে লাগছে। মালিহা সেদিকে মনযোগ দেয়। রুমে পরিচিত ঘ্রাণের উপস্থিতিতেও নজর সরায় না। সে এক ধ্যানে রাতের আকাশ দেখতে ব্যাস্ত।
চেয়ার টেনে বিছানার কাছাকাছি এসে বসে জাওয়াদ। শুধায়, “শরীর এখন কেমন লাগছে?”
মালিহার জবাব দিতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু কথা না বললে হয়তো মানুষটা আরও কিছু বলার সুযোগ পাবে। সে জন্যই মালিহা ছোট্ট করে জবাব দেয়, “ভালো।”
পিনপতন নিরবতা চলে অনেকটা সময় ধরে। ইতস্তত করে জাওয়াদ বলে, “দেখ মালিহা আমি জানি আমার উপস্থিতি তুমি একদমই সহ্য করতে পারছো না। দোষ করেছি এখন শুধরাতে তো আমাকেই হবে। তুমি হয়তো জানোনা আমাদের কর্মজীবন ঠিক কতটা কঠিন হয়। যতক্ষণ ব্যাটালিয়ানে থাকি ততক্ষণ নিজেকে যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে আমাদের তৈরি করে ফেলে স্পাতে। এমনকি সে**ক্স দমিয়ে রাখার জন্য আমাদের শরীরে বিশেষ ইনজেকশন পুশ করা হয়। বুঝতেই পারছো আমাদের জীবন ঠিক কতটা নিয়মতান্ত্রিক। তোমাকে একটা রাত কেন দশটা রাত সময় দিতেও আমার আপত্তি ছিল না। সেদিন রাতে আমি আমার মধ্যে ছিলাম না। একেবারেই না।
সারাদিনব্যাপী বিয়ের ব্যাস্ততা। তোমাদের বাড়ি থেকে ফিরে বন্ধুর শোকবার্তায় আমি আরও চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। ছাত্র জীবনে আমার এই বন্ধু আমাকে কত সাহায্য করেছে বলে শেষ করা যাবে না। ক্যাডেট কলেজের ছাত্রাবাস থেকেই বিভিন্ন বিপদ আপদে ছায়ার মতো থেকেছে ও। আমারই বিয়ে খেতে এসে এমন বিপদে ওর বউ বাচ্চা যে একসময় আমার নিজেরই দোষী মনে হচ্ছিলো। ওর ছেলের অবস্থা ভালো ছিল না। আমি দ্রুত ছুটে যায় হসপিটালে। সারাদিনের ক্লান্তি, রক্ত দানে আমার শরীর দূর্বল হয়ে পড়েছিল।
ওর ছেলের কান্ডিশন ভালো হতেই আমি চলে আসে বাড়িতে। ততক্ষণে রাতের শেষ প্রহর চলে। বাড়িতে এসে তোমার কাটখোট্ট কথায় আমার মস্তিষ্ক বিষিয়ে ওঠে। না চাইতেও তোমার সাথে অশালীন আচরণ করে ফেলি। চৈতন্য ফিরে আসতেই এতটা আপসেট হয়ে পড়ি যে তোমার সামনে দাড়ানোর সাহস টুকুও আমি হারিয়ে ফেলি। আমি বুঝে উঠতে পারি না আমার ঠিক সে অবস্থায় কি করণীয়! সব ছেড়ে তুমি যে আমার ভরসাতেই এবাড়িতে এসেছো সেটা আমি বেমালুম ভুলে বসেছিলাম। দুনিয়ার সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা সবচেয়ে কাছের মানুষটা দ্বারাই হয়েছে। আমার দোষ আমি স্বীকার করছি। এবং বাকি জীবন তোমার রাগ, জিদ সবটা সহ্য করার প্রতিজ্ঞাও করছি। কিন্তু প্লিজ! ভুল বুঝে দূরে সরে যেও না।”
জাওয়াদের কন্ঠস্বরে আকুলতা। মালিহা তখনও কঠিন। শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো, “ধরুন, কোন এক ধর্ষক আটক হয়েছে। আপনি দেশের একজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন হয়ে কি শাস্তি নির্ধারণ করবেন?”
জাওয়াদ বোকা ছেলে নয়। মালিহার কথার তেজ তার ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিলো। মুষড়ে পড়ে ছেলেটি। জবাব আসে না মুখ থেকে।
মালিহা আবারও বলে, “আচ্ছা বাইরের কথা বাদ দিলাম। আপনার বোনের সাথে যদি তার হাসবেন্ড এমন করতো এমতাবস্থায় আপনি কি করতেন? বোনকে সব ভুলে ভালোবাসতে বলতে পারতেন? ইসলাম যেখানে স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া তার গায়ে স্পর্শ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন সেখানে আপনি সম্পূর্ণ হিংস্র রূপে নিজের লালসা মিটিয়েছেন। এই আপনার নিয়মতান্ত্রিক জীবনের উদাহরণ?
হ্যাঁ ভুল আমিও করেছি। সে রাতে কঠোরভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। এর জন্য আপনিও আমাকে কটা কঠিন কথা বলে দিতেন। কিংবা রাগ করে বেরিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু আপনি কি করলেন? নিজের সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে বৈধভাবে ধর্ষণ করলেন। মুখের মিষ্টি কথায় বুঝি এর ক্ষমা হয়? আমি তো শেষ হয়ে গিয়েছি। আমার আর কি রইলো। নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে আবার এখানেই ফিরে আসতে হলো। যেখানে কিনা চরম বাজেভাবে হেনস্থা হতে হয়েছে আমাকে। আমি তো সেদিনই ম”রে গিয়েছি। ম-“রা মানুষের আবার আবেগ অনুভূতি বলে কিছু হয় মিঃ জাওয়াদ?”
রাগে অনুরাগে পর্ব ৭
মালিহার এক একটি বাক্য তীরের ফলা হয়ে বুকে বিধছে জাওয়াদের। সে শপথ করেছিল অন্যায় আচরণ করবে না। অথচ একটি মেয়ের মনে সে ঠিক কতটা নিচে অবস্থান করছে। তাও মেয়েটি কিনা তার বিবাহিত স্ত্রী! অনুতপ্তয় আকাশ ছুই ছুই তখন। কিন্তু মুখ ফুটে আর একটি বাক্য উচ্চারণ করতে সাহস হয় না শক্ত পোক্ত দেহি জাওয়াদের।