রাগে অনুরাগে শেষ পর্ব
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি
আজ বড় আনন্দের দিন মালিহার। মন সমুদ্রে চলছে সুখের ঢেউ। জীবদ্দশায় যতগুলো সুখময় দিন কেটেছে তার মধ্যে আজকের দিনটি অন্যতম সুন্দর।
মনে মনে জাওয়াদের সৌন্দর্যের প্রশংসা করছিল মালিহা। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল ঠিক করছিল জাওয়াদ। মালিহার অভিভূত মুখটি নজর এড়ায় না। গায়ে পারফিউম মাখিয়ে, কনুই অবদি পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে যায় প্রিয়তমা স্ত্রীর দিকে। কাছে গিয়ে মালিহার থুতনি উচিয়ে বলে ওঠে, “তুমি আরও সুন্দর। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মানুষটিই তুমি মালিহা।”
স্বামীর মুখ থেকে নিজের রূপের প্রশংসা শুনতে কোন স্ত্রীর না ভালো লাগে! মালিহাও তেমনি। লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে শুভ্র মুখটি। ছোট্ট করে শুধু বলে, “ধ্যাত!”
এরপর আর নিজেদের নিয়ে সময় নষ্ট করে না মালিহা-জাওয়াদ। কাধে হাত রেখে যত্ন ও সাবধানের সাথে মালিহাকে নিয়ে নিচে নামে জাওয়াদ।
বাড়ির প্রত্যেকটি মানুষের মুখের হাসি চওড়া হয় তাদের দেখে। এমনই একটি খুশির দিনের জন্য বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে তাদের। এরপর শুরু হয় কেক কাঁটার পালা। ফোন হাতে সবকিছু ভিডিও কলে ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিল জাওয়াদের বোনকে তার ফুফাতো বোন ইমা। প্রবাসে থাকায় দেশের আত্মীয়স্বজনের কোন অনুষ্ঠানে স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে পারে না। এ নিয়ে দুঃখ এবং আক্ষেপ কোনটার ই শেষ নেই সকলের।
জাওয়ার মালিহার হাত ধরে স্টেজে নিয়ে বসায়। কেক কাঁটা হয়। কেকের পিসটি সর্বপ্রথম মালিহার মুখে তুলে দেয় জাওয়াদ। এরপর বেবি সাওয়ার এর অনুষ্ঠনে সকলের সামনে মালিহা কে উৎসর্গ করে জাওয়াদ একটি কবিতা আবৃত্তি করে__
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“রাগে অনুরাগে মন বলে কথা,
ভালোবাসা জ্বলে, জ্বলে রাগের বৃথা।
কখনো অভিমানে দূর হয়ে যায়,
আবার নীরবতায় কাছে টেনে চায়।
রাগের ঝড়ে ভাঙে সব বাঁধ,
অনুরাগের স্রোতে হয় মন শান্ত।
হৃদয় কী চায়, বোঝা বড়ো কঠিন,
রাগে অনুরাগে বয়ে চলে দিন।
মেঘ যেমন আসে, তেমনি সরে,
রাগের আকাশে ভালোবাসা ঝরে।
একটুখানি ছোঁয়ায় ভাঙে সব দ্বিধা,
রাগে অনুরাগে আঁকা প্রেমের নীড়।”——–(উপহার)
আয়োজিত অনুষ্ঠানকে আরও সুন্দর ও বিশেষ করে তোলে জাওয়াদের অনুরাগে মাখা কবিতাটি। জাওয়াদের উপস্থিতির মতো তার মুখ থেকে শোনা কবিতাটিও মালিহার কাছে অপ্রত্যাশিত, বিস্ময়কর! আজ যেন সব ভালো হওয়ার দিন। সুখ আর খুশিরা ঝুলি বেধে তার কাছে বসত গেড়েছে। মালিহার খুশি যেন ধরে না। তেমনই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে মেয়েটি। সুখময় মুহুর্তেও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে সে। সকলে বিস্মিত হলেও কান্নার কারণ বুঝে নিরব থাকে। বিয়ের পরে এক দীর্ঘমেয়াদী বিরতির পরে প্রথম দেখা তাদের। এ দেখা না দেখায় যেন বহু রাগ অনুরাগ মিশে আছে।
জাওয়াদ এবং মালিহার আজ যেমন আনন্দের দিন। তেমনি আনন্দের মালিহার মা মায়া বেগমের। এই শশুরালয়ে ফিরতে তিনি মেয়েকে বাধ্য করেছিলেন। শুনিয়েছিলেন বহু কঠিন কথা। যেসময় মেয়েকে বুকে জড়িয়ে দুটো সান্ত্বনা বাক্য শোনানোর কথা ছিল। সেসময় তিনি দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলা যায়। মায়ের মত শাশুড়ির সঙ্গেও দূরত্ব তৈরী হয়েছিল। সে নিয়ে মনের মধ্যে সবসময় যুদ্ধ চলতে থাকতো। নিজের সন্তানকে কষ্ট কোন মা ই বা দেখতে পারেন? রেগে, বেখেয়ালে মেয়েকে কথা শুনিয়ে তিনিও শান্তিতে থাকতে পারেননি একদণ্ড। নিজের মনের মধ্যে চলা বিগ্রহ কারো সঙ্গে ভাগ করেও নিতে পারেননি চল্লিশ পেরনো এই মধ্যবয়স্ক মহিলা। আজ মেয়ে এবং জামাইয়ের মিলনামেলায় সাক্ষী হয়ে নিজেও অনেকটা ভার মুক্ত হলেন। নিজেকে বুঝ দিলেন, “মেয়ের প্রতি অন্যায় তিনি করেননি।” আদৌ কী তাই? কিছু সময় মায়েরাও কিন্তু সন্তানের ভালো চাইতে গিয়ে খারাপের দিকে ঠেলে দেয়। যে সময়টাতে সন্তানের সবচেয়ে কাছের মানুষ হিসাবে আদর যত্ন দিয়ে বোঝাতে হয়, প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে চলার শিক্ষা দিতে হয় ঠিক সেই সময়গুলোতে মা-বাবারা সন্তানকে ছেড়ে দেন। তাদের মানসিক পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন না। অভিভাবক হিসাবে নিজেদের মত প্রতিষ্টা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। তাতে সন্তানের যা হয় হোক। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব কারণেও আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
টেবিল ভর্তি নানান পদের সুস্বাদু সব খাবারের সমাহার। জাওয়াদ আর মালিহা পাশাপাশি বসেছে। শাশুড়ি মা পরম আদরে মালিহার পাতে রুই মাছের মাথা তুলে দিলেন। মাঝখান থেকে মালিহা বাধ সাধলো। সে বলে উঠলো, “এত বড় মাছের মাথা খেতে পারবো না আম্মা।”
“তা বললে কি করে বলো তো? তোমার জন্যই তো সব আয়োজন। মাছের মাথা তো খাবেই। সঙ্গে, তোমার প্লেটের আশেপাশের সবগুলো খাবারও তোমার জন্য বাড়া। সেগুলোও টেস্ট করতে হবে।”
মালিহা টেবিলে নজর বুলিয়ে দেখলো কম করে হলেও দশ পদের খাবারের আয়োজন। পোলাও, রোস্ট, কাবাব, ডিমের কোরমা, ইলিশ মাছ ভাজা, বেগুন ভাজি, খাসির গোসত আলু দিয়ে ঝোল, গরুর গোসতের কালা ভুনা, মুগ ডাল দিয়ে খাসির চর্বিযুক্ত মাংস রান্না আর বোরহানী। ডেজার্ট আইটেমে ছিল পুডিং, পাউরুটির শাহী টুকরা, জর্দা, লাচ্ছা সেমাই আর দই।
মালিহা ডেবিলে বসা বাকি সদস্যদের দিকে একবার তাকালো। তারপর শাশুড়ি মায়ের উদ্দেশ্যে বললো, “এত খাবার তো আমি একা খেতে পারবো না। সঙ্গে আপনার ছেলে খেলে আপত্তি আছে?”
উপস্থিত সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠলো মালিহার কথায়। রিপ্তি যেন তৈরীই ছিল। সে বড় সাইজের একটি প্লেট এনে বললো, “একটাতেই খাও। শেয়ারে কেয়ার বাড়ে। জানো তো?”
জাওয়াদের গালের একটি ছোট্ট একটি গর্ত তৈরি হলো। ছেলেটি হাসলেই এই সুন্দর দৃশ্যটি চোখে পড়ে। মালিহা সেদিক ফিরে মুগ্ধ হয়। রিপ্তি ফট করে বলে উঠলো, “দেখার অনেক সময় পাবে বোন। খাবার যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আগে খেয়ে নাও।”
লজ্জা পায় মালিহা। আশেপাশে নজর বুলিয়ে লজ্জা যেন গাঢ় হয় মেয়েটির। টেবিলে শাশুড়ি মা ছাড়া সবাই ছোট। বড়রা এবং মেহমানেরা সবাই আগে খেয়ে গিয়েছে। এবারে তাদের পালা। শাশুড়ি মা গুটি গুটি পায়ে কিচেনে চলে গেলেন। এসময় থাকা যায় না। রিপ্তি সব বেড়ে দিয়ে মেয়ের জন্য খাবার বেড়ে তাকে খাওয়াতে চলে গেলো। রইলো বাকি জাওয়াদ মালিহা। জাওয়াদ মালিহার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, “আমি খাইয়ে দিতে পারি বউজান?”
মালিহা প্রতিত্তোরে লজ্জামাখা মুখে বললো, “অবশ্যই স্বামীজান।”
অতঃপর একটি সুন্দর মুহুর্তের সৃষ্টি হলো। দূর থেকে তা মুঠোফোনে ক্যাপচার করলো জাওয়াদের ফুফাতো বোন ইমা। সুন্দর সুখময় স্মৃতি হিসাবে থেকে যাবে।
এরপর কেঁটে গিয়েছে আরও অনেকগুলো দিন। পড়ন্ত এক বিকেলে মালিহা ব্যালকনিতে বসে ছিল। দেখছিল বাহিরের প্রকৃতি। আজকাল মন বড় ভারি হয়ে থাকে। অজানা আতঙ্কে মন ভরাক্রান্ত হয়ে পড়ে। এক শূন্যতা এসে গ্রাস করে নেয় দেহ মন। জাওয়াদ নিঃশব্দে পিছনে এসে দাড়ায়। জড়িয়ে ধরে পিছন থেকেই। মালিহা একটি টু শব্দও করে না। চোখ বুজে সুখ খুজতে থাকে। খানিক বাদেই জাওয়াদের হাতের বাধন আলগা হয়। সে ব্যালকনি থেকে রুমে ফিরে আসে। পরক্ষণেই কিছু নিয়ে আবার ফিরে যায়। এক প্লেট ফুচকা এগিয়ে দেয় মালিহার দিকে। ফুচকা চোখে পড়তেই যারপরনাই অবাক হয় মালিহা। মন তার ফুচকা ফুচকা করছিল। কিন্তু সে তো কাউকে বলেনি। তাহলে? বিস্মিত নজরে জাওয়াদের দিকে তাকায় সে। জাওয়াদের হাসি হাসি মুখ। একটি ফুচকা মালিহার মুখে তুলে দিয়ে বললো, “না বউজান। আমি সেইসব প্রেমিক পুরুষের ক্রেডিট নিতে চাই না, যারা প্রিয়জনের মন পড়তে পারে। আমার মন বললো, এ সময় ফুচকা তোমার পছন্দ হতে পারে। এজন্যই নিয়ে আশা। হতভাগা স্বামী আমি। তোমার পছন্দ অপছন্দ কিছুই জানি না। আর না পেরেছি তোমার এমন সময়ে কাছে থাকতে। একটু সেবা যত্ন করতে। কেমন দূরের মানুষ হয়েই রয়ে গেলাম। অথচ আমারই সন্তান গর্ভে ধারণ করে কি নিদারুণ কষ্টের দিন কাটাচ্ছো। একেকটি দিন হয়ে উঠছে যন্ত্রণা দায়ক।”
শেষের কথাগুলো বলার সময় জাওয়াদের হাসি মিলিয়ে যায়। আধারে ঢেকে যায় সুন্দর মুখখানা।
মালিহা এক এক করে সবগুলো ফুচকা তৃপ্তি সহকারে খেয়ে খালি প্লেটটা জাওয়াদের হাতে ধরিয়ে দেয়। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায় জাওয়াদের মুখোমুখি। জাওয়াদের খালি হাতটা ধরে শুধু বলে, “এভাবেই যদি ভালো কিছু বয়ে আনে ক্ষতি কী? আমি মানিয়ে নিয়েছি। শুধু অপেক্ষায় আমার সোনা বাবার।”
ঠিক তখনই সুন্দর সময়টাকে আরেকটু সুন্দর করে তুলতে মালিহার গর্ভের সন্তানটি নড়েচড়ে ওঠে। অভ্যন্তরীন কম্পন শুধুমাত্র টের পায় মালিহা। জাওয়াদের হাতটা চেপে ধরে অনাগতের নড়েচড়ে ওঠার জায়গাটায়। জাওয়াদ অবাক দৃষ্টিতে মালিহার দিকে তাকায়। আনাড়ি অনুভূতি হবু পিতা জাওয়াদের। এক কঠোর ব্যাক্তিত্বের পুরুষের চোখদুটোও যেন সজল হয়ে ওঠে। ওই চোখে সন্তানকে সচক্ষে দেখার আকুলতা, মায়ের গর্ভে থাকাকালীন তার স্পর্শে সুখ খুজে পাওয়া, স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা।
শেষ রাতে মালিহার ঘুম ভাঙে অপরিচিত ব্যাথায়। সহনীয় কিন্তু যন্ত্রণা দায়ক। ফোন হাতরে সময় দেখে। সময় তখন পৌনে পাঁচটা। ফজরের আজানের সময়। পাশে বেঘোরে জাওয়াদ ঘুমিয়ে। চারিদিক থেকে ফজরের আজানের সুমিষ্ট ধ্বনি ভেসে আসে। মালিহা উঠে বসে। সে অবস্থাতেই অজু করে এসে নামাজের প্রস্তুতি নেয়। জাওয়াদকে ডেকে তোলে। মালিহা নামাজে বসে পড়ে। জাওয়াদ অজু করে এসে পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়ে টুপি হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে। অনেকটা ধৈর্যের পরিক্ষা দিয়ে ফজরের চার রাকআত নামাজ মালিহা শেষ করতে পেরেছে।
জায়নামাজ গুটিয়ে ধীরগতিতে পা ফেলে বিছানায় গিয়ে বসে। পেটের ব্যাথাটা এতক্ষণ সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও ক্রমেই তা বাড়তে লাগলো। চোখে আধার দেখতে পেল মালিহা। ডেলিভারি ডেলের এখনো বারোদিন বাকি। মালিহা প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরক্ষণে ব্যাথা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলো এ ব্যাথা তার সন্তান আগমনী বার্তা। এ অবস্থায় নীচে নামার রিস্ক নেয় না সে। অসহ্য বেদনা সহ্য করে অপেক্ষা করে স্বামী ফেরার। সঙ্গে এ ও বুঝতে পারে দোতলায় তার এ সময়ে থাকাটা মোটেও ঠিক হয়নি।
জাওয়াদ কিছুক্ষণ পরেই বাড়ি ফিরলো। রুমে ঢুকে বিধ্বস্ত মালিহাকে দেখে যারপরনাই অবাক হলো। শীতের সকালেও মেয়েটি ঘামছে। কাছে গিয়ে শুধালো, “কি হয়েছে মালিহা? শরীর খারাপ লাগছে কী?”
মালিহা নরম কন্ঠে জবাব দিল, “শরীর ভালো লাগছেনা। আম্মা বা ভাবিকে ডেকে দিতে পারবেন?”
জাওয়াদ আর কোন বাক্য ব্যায় করে না। দোতলায় রিপ্তিরাও থাকে। কিছু সাত সকালে বড় ভাইয়ের বউয়ের রুমের দরজা নক করা যায় না। জাওয়াদ সোজা চলে গেল মায়ের কাছে। মাকে ড্রয়িং রুমেই পেল।
“মালিহার শরীর ভালো না…”
জাওয়াদের পুরো কথাটাও শুনলেন না। অভিজ্ঞ চোখ জাওয়াদের চোখমুখ দেখে বাকিটা আন্দাজ করতে পারলেন। দ্রুত পায়ে দোতলায় ছুটলেন। মালিহা তখন প্রসব বেদনায় ছটফট করছে। কাছে ছুটে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, “কেমন লাগছে মা?”
মালিহা অস্পষ্ট কন্ঠে বললো, “তলপেটে ভিষন ব্যাথা আম্মা। কোমর ভেঙে আসছে।”
শাশুড়ি মা মালিহার কথা শুনে বললেন, “মনে হয় সময় এসে গিয়েছে। তুমি একটু হাঁটাহাঁটি করো মা। জানি কষ্ট হবে। কিন্তু শুয়ে থাকলে ব্যাথা কমে যেতে পারে। হাঁটলে বোঝা যাবে এটা আসল ব্যাথা না ফলস পেইন।
মালিহা পা টিপে টিপে হাঁটতে থাকে। অন্যদিকে মায়ের নির্দেশে জাওয়াদ মালিহার বাবা মাকে সবটা জানায়। ফোন করে নিজের ফুফুর কাছেও। তিনি সরকারি হাসপাতালের নার্স এবং তার মেয়ে সেখানকার জুনিয়র গাইনি কনসাল্টেড।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রসব বেদনা বাড়তে থাকে। ক্রমেই মালিহার মুখচোখের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। দেরি না করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা করে সবাই।
বহু কষ্ট এবং ত্যাগের বিনিময় কোলে আসে মালিহার পুত্র। ওটি রুম থেকে নার্সেরা যখন টাওয়েলে মুড়িয়ে বাচ্চা তার স্বজনের কাছে নিয়ে জাওয়াদ সর্বপ্রথম যে বাক্যটি উচ্চারণ করে তা হলো, “আমার স্ত্রী কেমন আছে?”
মধ্যবয়স্ক নার্স মহিলাটি হেসে জবাব দেন, “ভালো। একটু পরেই কেবিনে শিফট করা হবে।”
বাচ্চাকে তার বাবার কোলেই দেওেয়া হয়। নিজের বংশধরকে প্রথম কোলে নেওয়ার অনুভূতি হয় দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি। জাওয়াদ দু চোখ ভরে নিজের সন্তানকে দেখতে থাকে। এরপর একের পর দাদা-দাদু, নানা-নানু, চাচা-চাচি সকলের কোলভরে ঘুরে বেড়ায় সদ্য জন্ম নেওয়া নবজাতক শিশু ছেলেটি।
নার্সিং হোক থেকে ফেরার পরে মালিহার দিন কাটে জাওয়াদের অপ্রত্যাশিত কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে। মালিহার কাছে সবসময় তার নিজের মা এবং শাশুড়ি মা কেউ না কেউ থাকেনই। তাদের ছাপিয়ে জাওয়াদ একাই একশো। ছেলের কাথা ধোয়া, রাত জাগা, মালিহাকে সর্বক্ষণ এটা সেটা এগিয়ে দেওেয়া। ওয়াসরুম যেতে সাহায্য করা, সময়মতো খাবার এবং ওষুধ খাওয়ানো সব সেই করছে। বাকিরা মুখ টিপে হাসছে আর অবাক চোখে দেখছে। মালিহার মা হওয়ার পরের দিনগুলো অনেকটা সহজ হয়েছে এতে। দুজনের সম্পর্কটাও মজবুত হচ্ছে। সুন্দর বোঝাপড়া তৈরী হচ্ছে দুজনার মধ্যে।
বাবু তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। জাওয়াদ মালিহার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছিল। দুপুরে চুলে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে দিয়েছে। মালিহা হঠাৎ প্রশ্ন করলো, “আপনার কষ্ট হয় না জাওয়াদ?”
জাওয়াদের নির্বিকার উত্তর, “তুমি যদি নয় মাস গর্ভে ধারণ করে কষ্ট না পাও। আমি এইটুকুতে কি করে কষ্ট পাই বলো?”
প্রতিত্তোরে মালিহা কিছু বলে না। শুধু মনে পড়ে যায় হুমায়ুন আহমেদের বলা একটি বাক্য, “পৃথীবিতে একটিও খারাপ বাবা নেই।”
মালিহা এখন সুস্থ। বাচ্চাও কিছুটা বড় হয়েছে। প্রায় দুইমাস বয়স তার। হাত পা ছড়িয়ে খেলা করে। বড় বড় চোখ মেলে ভুবন দেখে। ইতিমধ্যেই বাবাকে চিনে ফেলেছে। মায়ের পরে বাবাকেই সে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে এবং তার কোলেই থাকতে পছন্দ করে।
জাওয়াদের ছুটি শেষের দিকে। কর্মজীবনে ফিরে যেতে আর বেশি দেরি নেই। শশুর বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ এসেছে। এবার তাকে যেতেই হবে। খুব করে বলেছেন মালিহার বাবা মা। অগ্যতা স্ত্রী সন্তান নিয়ে শশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় জাওয়াদ।
শশুর বাড়িতে একটি দিন কাটাতে না কাটাতেই দাওয়াত আসে চাচা শশুর বাড়ি থেকে। জামাই হিসাবে এবারই তার প্রথম আশা। মালিহার চাচা নিজে এসে অনুরোধ করে গিয়েছেন জামাইকে। এ নিমন্ত্রণ এড়িয়ে যাবার উপায় নেই জাওয়াদের। শাশুড়ি মায়ের হাতের ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচু শাক ঘন্টো, ইলিশের দোঁ পেয়াজা আর দেশি মুরগির ঝোল দিয়ে ভরপেট খেয়ে বিকালের দিকে স্ত্রী পুত্র নিয়ে রিকশায় করে চাচা শশুরের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
মালিহা নিজের ছোট্ট মফস্বল শহরে বহুদিন বাদে আসে। রিকশায় করে স্বামীর সঙ্গে পাশাপাশি গা ঘেঁষে বসে কোলে ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে ঘোরার আনন্দটাই আলাদা। জাওয়াদের সঙ্গে কাটানো প্রতি মুহুর্ত মালিহার কাছে ভিষন সুখের। এই সুখকে দ্বিগুণ করতে এসেছে তাদের সন্তান।
হঠাৎ মালিহার চোখ যায় সাদা শার্ট কালো প্যান্ট পরিহিত এক যুবকের দিকে। চারিদিক দেখায় ব্যাস্ত চোখদুটো সেখানেই স্থির হয়। মস্তিষ্কের ভাবনা চিন্তা যেন স্থগিত হয়ে আসে। মনে প্রশ্ন জাগে, “মানুষটা ভালো আছে তো?”
রাগে অনুরাগে পর্ব ১৯
ইঞ্জিন চালিত রিকশা দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায়। কিন্তু চোখাচোখি হয় মালিহার সঙ্গে আরহামের।
শেষ বিকালে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে ফিরছে যুবক। মালিহার মতো তারও দৃষ্টি স্থির হয়। সঙ্গে চলমান দুটো পাও থেমে যায়। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। চোখ দুটোতে বহু প্রশ্ন! কত অব্যাক্ত বেদনা নিয়ে তাকিয়ে থাকা দুটো চোখ।
মালিহা-জাওয়াদ গল্পে বাস্তবতার করাঘাতে পিষ্ট হওয়া আরহামদের কোন জায়গা হয় না। সৃষ্টিকর্তার দয়ায় হয় তারা নতুন আলোর সন্ধান পায়। নতুবা আধারের অতল গভীরে হারিয়ে যায়।