রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ১৬
সিমরান মিমি
দিনের শুভ্র আলো ধীরে ধীরে তার অস্তিত্ব হারাচ্ছে।সাথে সাথে ধরণীতে প্রবল হচ্ছে এক অভিশপ্ত অন্ধকার।যার তীব্র এই কালোছায়া শহরে প্রতিটা প্রান্তে এক নতুন অঘটনের জন্ম দিচ্ছে।এ যেন প্রকৃতির’ই নিয়ম।রাতের আধার শুরু হওয়া মাত্রই অলিতে গলিতে বেড়ে যায় পৈশাচিক কিছু কালো হাতের বিচরণ।যেগুলো ধীরে ধীরে প্রকট হয় শরীরে।দেবে যায় কিছু কামুক চামড়ার উপর।পিঠের উপর আলতো বিষধর ছোঁয়া’টা হুট করে নিচে নামলো।
কোমড় জরিয়ে পেটের কোণে যেতেই খুপ করে ধরে ফেললো সেই হাত। এটার’ই অপেক্ষা করছিলো স্পর্শী।কখন হাতটা নিচে নামবে আর কখন সেটা সে নিজের থাবার মধ্যে পাবে।অস্ফুট স্বরে ছেলেটি আর্তনাদ করে উঠলো।উঠবেই তো।এটা তো থাবা নয়;এ যেন কোন ভয়ংকর সাপের বিষদাত।হাতের প্রতিটা লম্বা নখের কোন ঢুকিয়ে দিয়েছে চামড়ার মধ্যে।প্রত্যেক ক্রিয়ার’ই বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে।হাতের নখ ঢুকানোর ফলে নিজেও আঙুলে ব্যাথা স্পর্শী।কিন্তু সেটা প্রতিপক্ষের থেকে কম।তুমি অপরপক্ষকে গুলি ছুঁড়ে প্রতিহত করবে ;অথচ দগ্ধ মেটালে হাতের তালু পুড়াবে না। এটাতো হতে পারে না।
খাঁমচে ধরা অবস্থাতেই পেছনে ফিরলো স্পর্শী।পায়ের হিল দিয়ে চেপে ধরলো ছেলেটার পায়ের পাতা।আলতো হেসে জিজ্ঞেস করলো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“এতোক্ষণ তো ভালোই লাগছিলো।এখন লাগছে না?
জোয়ান ছেলেটা ভয়ার্ত চোখে তাকালো।বাস ভরা যাত্রী।কোনোভাবে স্পর্শী চিৎকার মারলেই সে গণধোলাই খাবে।এর থেকে এমন যন্ত্রণা’ই ভোগ করা উত্তম।পুরো ধামড়াই ন্যাশনাল কলেজ থেকে রেডিও কলোনী পর্যন্ত এই বিষযন্ত্রণার স্বীকার হলো ছেলেটি।বাস থামাতেই একে একে বের হয়ে গেল অধিকাংশ।হাত পা ছেড়ে কিছুটা দুরে সরে দাঁড়ালো স্পর্শী।এরপর বললো,
” আপনার ভালো লাগে নি।আমার কিন্তু মজাই লেগেছে।যাই হোক,এরকম মজা প্রতিদিন পাওয়ার জন্য বাসে প্রতিটা মেয়েকে উত্ত্যক্ত করবেন।কেমন?
বলেই নেমে গেল।তীব্র ঘৃণায় চোখে পানি এসে গেল।কেন তার জীবনটা এমন হলো?কেন এতো সংগ্রাম তাকেই করতে হবে?একটা মেয়ে যতই সাহসী, সচেতন হোক না কেন ;এই রাতের আধারের কাছে তো হার মানতেই হবে।কেন তার একটা সুন্দর পরিবার হলো না।যেখানে সে হতো রাজকন্যা।আর বডিগার্ড হিসেবে চারপাশে থাকতো বাবা, ভাই।কেন তার বাবা মারা গেল?কেন তার ভাই নেই।কেন কোনো পরিবার নেই?না আছে মামা-নানা,আর নাতো আছে বাবা-দাদা।আচ্ছা সে কেন পরগাছা?এই পৃথিবীতে শুধু মা ছাড়া আর কেন কেউ নেই।বাবার কূলের ও নেই,মায়ের কূলের ও নেই।সবাই কি একসাথে মারা যায়?আচ্ছা বাবার বাড়িটাও কি একসময় অস্তিত্বহীন হয়ে যায়?জানে না সে?উত্তর নেই তার কাছে।উত্তর দেয় নি পিপাসা।সব সময় এড়িয়ে গেছে।না হয় রেগে গেছে।মায়ের রাগকে ভয় পেয়ে আগ বাড়িয়ে আর জিজ্ঞেস করতে পারেনি তারা।আজ বাবা-কাক-ভাই থাকলে কেউ কি এভাবে তাদের ঠুনকো ভাবতো?গায়ে হাত তোলার আগে একশো বার ভাবতো”অমুকের বোন,টোকা লাগলেও ওর ভাই তুফান বয়ে আনবে।”
কিন্তু না । নেই এমন কেউ।থাকলে কি আজ এতটা ছুটতে হতো?কেউ কি পারতো আর্শিকে এভাবে তুলে নিতে?
ভাবতে ভাবতেই গেটের সামনে চলে এলো।রাতের টিউশন আজ থেকে বাদ।এতটা সাহসীও হতে চায় না স্পর্শী;যেখানে সম্ভ্রম নিয়ে টানাপোড়ন হয়।আজ তার কিছু হলে ফ্যামিলিতে এমন কেউ নেই যে খুঁজবে।হ্যাঁ পারবে।শুধু মা আর ছোট্ট বোনটা পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে পারবে আর রাস্তায় পড়ে মাথা ঠুকতে পারবে।
গেটে টোকা মারতেই খুলে দিলো পিপাসা।থমথমে মুখে ভেতরে ঢুকলো। মাকে পাশ কাঁটিয়ে চলে গেল রুমে।আর্শি ফোন টিপছে উপুড় হয়ে।ধীর পায়ে তার পাশে গিয়ে বসলো।পিপাসা চিন্তিত ভংগিতে রুমে ঢুকলো।বললো,
“বেতন কি দেয় নি?তোর কি টাকাটা খুব প্রয়োজন?আমার থেকে নিয়ে নে।কত টাকা লাগবে?”
স্পর্শী পার্স থেকে টাকাটা বের করে বললো,
“দু মাসের ষোল হাজার পেতাম।দিয়েছে পনেরো হাজার।ওরা মনে করে আমি উড়ে উড়ে গিয়ে স্টুডেন্ট পড়াবো।আরে আমার যে গাড়ি ভাড়া লাগে সেটাও মাথায় রাখে না ওরা।আর পড়াবো না।এমনিতেও রাতের বেলা আর কোনো টিউশন নেব না।”
সায় দিলো পিপাসা। মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
“তোকে তো কতবার বলেছি দরকার নেই এসব টিউশনের।আমি কি কম ইনকাম করি?তোর যদি একান্তই নিজে র কাজ করতে ইচ্ছে হয়, তাহলে পার্লারে গিয়ে দু ঘন্টা সময় দে।তোর হাতের সাজানোর ধরণ তো বেশ সুন্দর।আর আমারো বাড়তি লোক রাখা লাগবেনা।এমনিতেও দুজন নিতে হবে সামনে মাসে।”
মাথা নাড়ালো স্পর্শী।মায়ের মুড আজকে ভালো।তাকে আরেকটু খুশি করতে বললো,
“ঠিক আছে।তা না হয় করলাম।”
খুশি হয়ে গেলেন পিপাসা।আর্শি উৎফুল্ল হয়ে বললো,
“আমিও তোমার পার্লারে পার্ট টাইম জব নিবো আম্মু।আমার সব খরচ তো তুমিই দিবা।কিন্তু বেতন টা আমার পার্সোনাল থাকবে।ওকে।
হেসে দিলো পিপাসা।উঠে রুমের বাইরে বের হবার প্রয়াস করতেই স্পর্শী ডাকলো।বললো,
মা,একটু শুনবা।
পেছনে তাকালো পিপাসা।আলতো হেসে মেয়ের পাশে বসে বললেন,
” কিছু বলবি?”
খানিকটা ভয় পেল আর্শি।মা রাগ করবে না তো?নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো,
“তুমি কি ব্যস্ত?মায়ের দিকে তাকিয়ে আলতো কন্ঠে বললো,
” মা, আমাদের দাদাবাড়ি কোথায়?এখানে তো আমরা ভাড়া থাকি কিন্তু আমাদের তো গ্রামের বাড়ি আছে।ওটা কোন জায়গায়?”
থমকে গেল পিপাসা।আমতা-আমতা করে বললেন,
“হুট করে এসব কথা বলছিস কেন?আমার রান্না করতে হবে।তোরা পড়তে বোস।”
মুহুর্তে’ই হাত টেনে ধরলো স্পর্শী। উঠে দাঁড়ালো মায়ের সামনে।চোখে চোখ রেখে বললো,
“আর কতদিন পালাবে? আজীবনেও কি জানতে পারবো না নিজের জন্মপরিচয়? ”
আর্শি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো।উফফফ!আপু কেন এই কথা আবার তুলে ধরলো?এখন’ই তো মা রেগে যাবে।
পিপাসা অসস্তিতে পড়লো।হাতে ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে বললো,
“তোকে একশোদিন বলেছি এসব ফালতু কথা আমাকে কোনোদিন জিজ্ঞেস করবি না।”
তেঁতে উঠলো স্পর্শী।চিৎকার করে বললো,
“ফালতু!আমার জন্মপরিচয় তোমার কাছে ফালতু?আমার বাবা-দাদার পরিচয় জানতে চাওয়াটা তোমার কাছে ফালতু মনে হয়।আর কত লুকাবে আমাদের থেকে।জন্ম থেকে জেনে এসেছি বাবা নেই।মারা গেছে।ভালো কথা।মেনে নিয়েছি।দাদা-দাদি,নানা-নানি,কাকা-মামা তো আছে।আচ্ছা সেটাও বুঝলাম নেই।কিন্তু আমাদের তো একটা স্থায়ী ঠিকানা থাকবে?সেটা কোথায়?আমাদের জন্মস্থান কোথায় মা?আমরা কি সারাজীবন বাসা ভাড়াই থাকবো।সারাজীবন পরিচয় হিসেবে জেনেছি বাবা শামসুল সরদার।কোথায় তিনি?কোথায় সেই সরদার বাড়ি?আদোও কি এই নামের কোনো অস্তিত্ব আছে?নাকি বানোয়াট।আচ্ছা মা,আমরা কি তোমার অবৈধ সন্তান?যার কারনে তুমি পরিচয় দিতে পারছো না।সেটা হলেও তো বলবে;তাহলে আর কখনো জিজ্ঞেস করবো না।কিন্তু এভাবে ধোয়াশায় রাখছো কেন?”
পিপাসা বেগম মেয়ের অশ্লীল শব্দোচ্চারণে বাকহারা হয়ে গেলেন।রাগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছে ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় মারতে লাগলেন।স্পর্শী নির্ভীক।কোনো বাধাই দিচ্ছে না।আর্শি কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে।ছুটে গিয়ে মাকে বোনের থেকে ছাড়ালো।ভীষণ অসহায় লাগছে পিপাসার।ছুটে গিয়ে নিজের রুমের দরজা আটকালো।দুহাত দিয়ে মুখ চেপে কান্না করতে লাগলো অবিরত।এই মেয়েদের জন্য আজ অবধি নতুন কারো সাথে সংসার সাজায় নি।একা এক চড়ুই পাখির মতো উড়ে এসে ছিটকে পড়েছে এই অচেনা শহরে।দেড় মাসের অন্তসত্বা, কোলে সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা নিয়ে ভিখারিনীর মতো দিন কাটিয়েছে।দিনের পর দিন সংগ্রাম করে নিজের ভিত শক্ত করেছে মাত্র।আর সেই মেয়েরাই তার চরিত্রে কলংক লেপতে দুইবার ভাবলো না।কি লাগবে ওদের?একটা নিজের বাড়ি।দেবে তো পিপাসা।এই তো আর কটা মাস।টাকা জমিয়েছে সে।একটু জমি কিনে বাড়ি বাঁধবে।মেয়ে বিয়ে দিবে।কিন্তু মেয়েরা আজ পরিচয় খুঁজছে।সে কি যথেষ্ট নয় ওদের আশ্রয়স্থল হিসেবে।
কেটে গেছে প্রায় তিন ঘন্টা।ঘড়ির কাটায় সাড়ে এগারোটা। আলতো পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে পিপাসা।মেয়েদের রুমে ঢুকতেই দেখলো ফ্লোরে বসে খাটের সাথে হেলান দিয়ে স্তব্ধ বসে আছে স্পর্শী।তার সাথে লেপ্টে শুয়ে আছে আর্শি।
অনেক ভেবেছে পিপাসা।আর কোনো লুকাচুরি নয়।সবাই বড় হয়েছে।আজ নয়,কাল নয় জানতে পারবেই।তার থেকে তার মুখ থেকে শোনাই ভালো।সব শোনার পর যদি মেয়েরা তার কাছে থাকে তো ভালো।আর যদি বাপের কাছে চলে যায় তাও আটকাবেনা সে।
ধীর পায়ে স্পর্শীর পাশে গিয়ে বসলো।থমথমে কন্ঠে বললো-
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ১৫
কি জানতে চাস?বল।
স্পর্শী তড়িৎ গতিতে উঠলো।মায়ের দিকে তাকিয়ে সরাসরি বললো,
আমার বাবা বাড়ি কোথায়?
শান্ত কন্ঠে পিপাসা শুধালো,
“পিরোজপুর।”