রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৪

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৪
সিমরান মিমি

জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি। আকাশ ভীষণ গুরুগম্ভীর।বিশালাকৃতির আসমানের ফাঁকে ফাঁকে ধোয়ার মতো বিচরণ করছে মেঘেরা।থমকানো এই দিনে লোকজনের আমেজে ভরপুর হয়ে উঠেছে সদর হাসপাতাল।আশেপাশে প্রচুর লোকেরা ভীড় বেঁধে জানার চেষ্টা করছে ঘটনাগুলোকে।সাবেক এমপির গাড়ি হস্পিটালের সামনে। নিশ্চয়ই কোনো অঘটন ঘটেছে।হস্পিটালের তিনতলার তিনশো বারো নম্বর কেবিনে স্পর্শী দাঁড়িয়ে আছে।পাশেই বেডে শুয়ে আছে দুর্বল আর্শি।নিভু নিভু চোখগুলো দিয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে সে।আবারো কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে অনুভব করে নিলো সবার উপস্থিতি।পাশেই টুলে বসে ফুঁপিয়ে কান্না করছে পিপাসা।সোনালী বেগম সান্ত্বনা দিচ্ছেন জা কে।

ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলো স্পর্শী।শুকনো মুখখানি নিয়ে দাঁড়িয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে।মাথার আঘাত টা খুব জোড়ালো ভাবে লেগেছে।উপুড় হয়ে পড়ার কারনে ঠোঁট ফুলে গেছে।ডাক্তার দেখে গেছে কিছুক্ষণ আগেই।সেলাই করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে ক্ষত স্থানে।শামসুল সরদার আলতো পায়ে কেবিনে ঢুকলেন।মেয়ের পাশে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে আদুরে স্বরে বললেন,
“মামুনি।আট’টা বেজে গেছে।খিদে পেয়েছে না?তোমার বোন এখন সুস্থ হয়ে যাবে। বাড়ি চলো।খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে তারপর আবার এসো।”
স্পর্শী কোমল নয়নে বাবার দিকে তাকালো।বোনের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ কন্ঠে বললো,
“ও তো এখনো কথা বলে নি আব্বু।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শামসুল সরদার আর কিচ্ছু বললেন না।ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।যাওয়ার আগমুহূর্তে আর্শির দিকে তাকাতেই দেখলো সে ছলছল নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছে।এই দৃষ্টির কারন খুঁজে পেল না শামসুল।বের হয়ে গেল কেবিন থেকে। আর্শি আবারো আশাহত হলো।ঠোঁট কামড়ে মাথা কাত করে কান্না করে দিলো।স্পর্শী অবাক হয়ে গেল।বোনের গাল ধরে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“এই আর্শি।কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?ব্যাথা হচ্ছে?কোথায় বুনু?”
আর্শি হাত সরিয়ে দিলো স্পর্শীর।তার দিকে ফিরেও তাকালো না।মায়ের দিকে তাকিয়ে তার হাত ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো।ঠোঁট ভেঙে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

“আম্মু,আব্বু আমাকে একটুও ভালোবাসে না। আমার সাথে কথাও বলে না। একটু তাকায় ও না।সব আপুকে ভালোবাসে।ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে।আমি রুমের সামনে গেছিলাম কিন্তু আমাকে একটু ডাকেও নি।”
স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো স্পর্শী।মাথায় হাত দিয়ে বললো,
“তুই আমাকে হিংসা করছিস? ”
ক্ষেপে গেল আর্শি।ঝামটা মেরে বোনকে বললো,
“তো তোমাকে একা কেন আদর করবে?”
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো পিপাসা।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শামসুল সরদার। মাত্রই এসেছে সে খাবার হাতে।দলের এক ছেলেকে দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা আনিয়েছে।প্যাকেটগুলো স্পর্শীর হাতে দিয়ে থমথমে কন্ঠে বললো,

“এরকম হিংসা বা মন খারাপ করা অহেতুক। এর কোনো কারন নেই।তুমি তোমার মাকে নিয়ে তোমার বাবার কাছে চলে যাও।আমি কখনোই তোমার মাকে আটকাবো না।আমার মেয়েকে পেয়ে গেছি।স্পর্শীয়া আমার কাছেই থাকবে।”
স্পর্শী অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো।আশ্চর্যের রেশ ধরে বললো,
“আব্বু, আপনি এসব কি বলছেন?আম্মুর প্রতি আপনার রাগ থাকতে পারে তাই বলে আর্শিকে কেন অবহেলা করছেন? ও আমার বোন।আমি যেমন আপনার মেয়ে, ও আপনার মেয়ে।আমি যদি আপনার কাছে থাকতে পারি তাহলে ও কেন পারবে না?”

শামসুল অন্যদিকে ঘুরে তাকালো।স্পর্শীর উদ্দেশ্যে বললো,
“মুখের কথাতেই মেয়ে হয়ে যায় না মামুনি।ওসব তুমি বুঝবে না।
পরক্ষণেই কিছু ভাবনাতে আসতেই পিপাসার দিকে তাকালো।তীর্যক হেসে বললো,
” কেন?তোমার যার কাছে ছিলো সে বুঝি তাকে আর মেনে নিচ্ছে না?”
কান গরম হয়ে গেল পিপাসার।স্পর্শী হতাশ হয়ে বসে পড়লো টুলে।ক্ষুব্ধ পিপাসা টলমল চোখ নিয়ে স্বামীর দিকে তাকালো।রাগে সারা শরীর তার ফেঁটে যাচ্ছে।ঘৃনার দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকিয়ে স্পর্শীকে বললো,

“তোর বাবা কি সব মেয়েকে তার প্রথম স্ত্রীয়ের মতো মনে করে নাকি?যে চলে গেলেই অন্য একটা পুরুষের সাথে সংসার বাঁধবে।সতীনের সংসার করবো ন বলেই বাড়ি ছেড়েছি।ঘর ছেড়েছি।সাধের সংসার ছেড়েছি।তাই বলে অন্য কোথাও গিয়ে আবার নতুন কারো সাথে ঘর বাঁধবো এতটা নিচু মনমানসিকতা অন্তত আমার মধ্যে নেই।তোর বাবা কি ভেবেছে?যে সবাই তার মতো ডজন খানেক বিয়ে করে বসে থাকবে নাকি।এতটাও দুর্বল ভাবতে বারন কর।

পিপাসার যথেষ্ট যোগ্যতা আছে তার মেয়েদের নিয়ে একা থাকার।এতে ভরণপোষণের জন্য অন্য কারো পায়ের তলায় অনুগ্রহ করতে হবে না।যদি অন্যকোথাও সংসার করার ইচ্ছেই থাকতো তাহলে তার প্রথম স্ত্রীয়ের মতো বাচ্চা-কাচ্চা ফেলে রেখেই চলে যেতাম।এভাবে কোলে সাড়ে তিন বছরের মেয়ে, পেটে পনেরো দিনের সন্তান নিয়ে যেতাম না।যদি এতটাই দুর্বল হতাম তাহলে কোলের ওতটুকু মেয়ে,তার উপর গর্ভবতী অবস্থায় কাজ করে আজ মেয়েদেরকে গ্রাজুয়েশন পর্যন্ত পড়াতে পারতাম না।আল্লাহ আমাকে যথেষ্ট সামর্থ্য দিয়েছে।দু দুটো মেয়ের দায়িত্ব নিয়ে এতটা দূর এসেছি।আর তো ক’টা দিন।এরপর বিয়ে দিয়ে দিলেই তো আমার কাঁধ হালকা হয়ে যাবে।তোর বাবাকে এটা ভাবতে বারণ করিস যে ভরণপোষণের অভাবে তার কাছে মেয়েদের এনে পরিচয় করাচ্ছি।যদি তার আমার আর্শি কে মানতে এতোটাই কষ্ট হয়,সন্দেহ হয় তাহলে আমি আমার মেয়ে নিয়ে সকাল দশটার বাসে উঠবো।তুই থাক তোর বাবার কাছে।”

কান চেপে ধরলো স্পর্শী। চিৎকার করে বললো,
“উফফফ বাবা!তোমরা আমাকে মাঝখানে জড়াচ্ছো কেন?আমি কি তোমাদের বিয়ে দিয়েছিলাম?নিজেদের ঝামেলা নিজেরা মেটাও না।এমন করতে থাকলে আমি আমার বোনকে নিয়ে সন্ধ্যায়’ই লঞ্চে উঠবো।”
স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন শামসুল সরদার। শরীরের শিরায় শিরায় রক্তের সাথে এক ঠান্ডা তরল স্রোত বয়ে যাচ্ছে যেন।এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো আর্শির দিকে।কানের ওই পাশের পরিচিত তিল টা খুব চোখে বাঁধছে।অবিকল তার ও এমন’ই একটা তিল রয়েছে এক’ই জায়গায়।এটা তার মেয়ে।তার’ই ছোট মেয়ে।যার অস্তিত্ব সম্পর্কেই অজ্ঞাত সে।ভাবতেই বুকের ভেতর টা কেমন দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে।আর্শি এখনো নিচু তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।ক্লান্ত পায়ে হেটে পিপাসার সামনে গেলেন সরদার।শান্ত কন্ঠে বললেন,

“আমি তোমাকে সারা জীবনেও ক্ষমা করবো না।তুমি….তুমি শুধু আমাকে আমার মেয়েদের থেকে দুরেই রাখো নি।বরং তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কেও জানতে দাও নি।তোমার কারনে পদে পদে আমি আমার মেয়েদের সামনে লজ্জিত হচ্ছি।তাদের পরিচয় টাও আজ আমায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে হচ্ছে।ক্ষমা করবো না। কক্ষনো না।”
বলেই কেবিন ত্যাগ করলেন।কেবিনে এখন পিনপিনে নিরবতা।বোবা কান্না করছে তিনজন’ই।সামান্য কিছু ভুল মানুষের জন্য,কিছু ভুল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক কতটা বাজে পরিস্থিতির স্বীকার হতে হচ্ছে প্রতিটা মুহুর্তে। করিডোরে আসতেই বেঞ্চে বসলো শামসুল সরদার। দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো।এরইমধ্যে এগিয়ে এলেন খলিলুর রহমান।ত্রস্ত গতিতে ভাইয়ের কাছে এসেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন।

“ভাইজান,হস্পিটালের নিচে তো প্রেসের লোক আসছে।এছাড়া আমাদের দলের ও প্রচুর সমর্থক রা নিচে দাঁড়িয়ে আছে।সবার’ই একই কথা।হস্পটালে কেন এসেছি?অসুস্থ মেয়েটা কে?আর কিভাবেই বা মাথা ফাটলো।কিভাবে এদের উত্তর দিবো?আর কিইবা বলবো যে মেয়েটা আপনার সৎ মেয়ে হয়।”
মাথা নাড়িয়ে না বললো শামসুল। চোখ খুলে ভাইয়ের দিকে চাইলো।চোখের সাদা অংশ গুলো প্রায়শই লাল হয়ে গেছে।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

“তৃষ্ণা বিয়ে করে নি খলিল।আর আর্শিও আমার সৎ মেয়ে না।ওর যখন পনেরো দিন বয়স তখনই তৃষ্ণা পালিয়েছে।কিন্তু স্পর্শীর পরেও যে ওর গর্ভে আবারো সন্তান এসেছে এ ব্যাপারে আমাকে জানায়’ই নি।রাগ করে ওই অসুস্থ অবস্থাতেই বাড়ি ছেড়েছে।আমি ভাবতে পারছি না।সবার আড়ালে এভাবে একটা কোলের বাচ্চা তার উপর আবারো পেটে বাচ্চা এসব নিয়ে কিভাবে ওই সময় টা পেরিয়েছে ও।আমি ভেবে পাচ্ছি না।আমার যে একটা নয় দু দুটো মেয়ে আছে এসব ক্ষুনাক্ষরেও টের পাইনি।কেন আমি ঢাকায় খুঁজলাম না ওকে?কেন মনে হলো না ও ঢাকায় থাকতে পারে।”
উত্তেজিত হয়ে গেল শামসুল।খলিল ভাইকে বোঝানোর স্বরে বললো,

“ভাইজান,প্রেশার হাই হয়ে যাবে।এতটা টেনশন করবেন না।উনিশ বছর হয়ে গেছে এসবের।এখন ওরা আবার ফিরে আসছে।এসব নিয়ে আর ভাববেন না।আমি নিচে যাচ্ছি। সবটা সামলাতে হবে।সোভাম মনে হয় এখনো ঘুম থেকেই ওঠেনি।উঠলে নিশ্চয়ই এতোক্ষণে চলে আসতো।রিহান নিচে আছে।আমি যাচ্ছি। নইলে উপরে চলে আসতে পারে।”
বড় ভাইকে সামলিয়ে নিচে নেমে গেল খলিলুর সরদার।ত্রস্ত পায়ে হেঁটে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“আপনাদের কি জানার আছে দ্রুত বলুন।”

বিরক্ত হলো সাংবাদিক।এতোক্ষণ বসিয়ে রেখে এখন এসেছে প্রশ্নের উত্তর দিতে।কিন্তু সাবেক এমপির ভাই বলে সেই বিরক্তিতা আর প্রকাশ করতে পারলেন না।নিজের পেশাদার ভঙ্গিতে বললেন,
“আমরা অনেকক্ষণ আগেই দেখলাম সাবেক এমপি মি: শামসুল সরদারের গাড়িতে করে একজন আহত মেয়েকে আনা হয়েছে।তিনি কে?এবং কিভাবে রক্তাক্ত হলো?আমরা জানি সাম্প্রতিক কালে নির্বাচনে তিনি হেরেছেন।আপনাদের কি মনে হয় ক্ষমতা হাতে না থাকায় দুর্বল ভেবে বিরোধী পক্ষের কেউ আপনাদের উপর হামলা করেছে?”
হা হয়ে গেলেন খলিল।মেজাজ কে যথেষ্ট সং যত রেখে বললেন,

“যে মেয়েটা আহত ছিলো সে আমাদের সরদার বাড়ির মেয়ে।সাবেক এমপি শামসুল সরদারের ‘ই ছোট মেয়ে।অসতর্ক হয়ে চলাফেরার কারনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায়।যার কারনে মাথা ফেটে গেছে।এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।এটার সাথে রাজনৈতিক কোনো সংঘর্ষ জড়িত নেই।আশা করছি আপনারা আপনাদের উত্তর পেয়ে গেছেন।এবারে দ্রুত হস্পিটালের গেট ফাঁকা করুন।প্লিজ!

বলেই সেখান থেকে উঠে এলেন উপরে।ভীড়ের এক কোনে দাঁড়িয়ে রইলো সাস্থ্যবান বিশালকৃতির এক পুরুষ। পাশেই তার হুন্ডা।আর্শিকে এমন আহত অবস্থায় তাও আবার শামসুল সরদারের গাড়িতে দেখেই চমকে গেছিলো সে।পুরো ঘটনা টা বুঝে ওঠার জন্যই অপেক্ষা করছিলো।কিন্তু সবটা শোনার পর আর পা চলছে না।ক্রমে ক্রমে ভয় গুলো জড়ো হচ্ছে মনে।মস্তিষ্কে প্রবলভাবে ধাক্কা দিচ্ছে একের পর এক চিন্তা।তাকে খুব ভালো করেই চেনে আর্শি।কেননা কিডন্যাপ করার পর পুরো দু দিন সেই আর্শিকে পাহারা দিয়েছে বন্ধ ঘরের বাইরে।মাঝেমধ্যে হুটহাট বিরক্ত হলে স্প্রে করে অজ্ঞান করে দিয়েছে।কিন্তু সেই সময় সে কোনো মাস্ক পড়েনি।এবারে কি করবে সে?দ্রুত হুন্ডা চালিয়ে এক টানে চলে এলো পার্টি অফিসের সামনে।বাইক থামিয়ে চাবি হাতে নিয়ে দ্রুতপায়ে ছুটলো কাঙ্ক্ষিত রুমের দিকে।

পরশ চেয়ারে বসে কিছু ফাইল হাতে বসে আছে।কয়েকদিন আগেই চর এলাকার রাস্তা মেরামতের জন্য সরকারের থেকে বাজেট এসেছে।এটা আলতাফ শিকদার’ই পাশ করে রেখেছিলেন।যেটার অনুমতি পত্র এসেছে কিছুদিন আগেই।এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।গদিতে বসা মাত্রই দুর্দশাগ্রস্ত চর এলাকাগুলোর রাস্তা মেরামত করলে জনগণ খুশি হবে।ফলস্বরূপ তার সমর্থকের দল ও ভারী হবে।পাশেই ডাবল সোফায় চিৎ হয়ে শুয়ে ফোনে গেমস খেলছে পাভেল।উপরের রুমগুলোতে দফায় দফায় কিছু ছেলেপেলেরা দাবা,তাস খেলছে।তবে পার্টি অফিসে আপাতত সিগারেট থেকে শুরু করে যাবতীয় নেশাদ্রব্য,মদ্যপান নিষিদ্ধ করে দিয়েছে পরশ।

তবে সে সিগারেট খেতেই পারে।রাজার জন্য কোনো নিষেধ নেই।সে নিজেই রাজা,নিজেই সর্বেসর্বা। যাবতীয় হুকুম তার আদেশে চলে।
রাফাত হাওলাদার দ্রুতপায়ে ভেতরে ঢুকলো।ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিলো। পরশ একবার তাকিয়ে আবার ও ফাইলে মনযোগ দিলো।পাভেলের ডিস্টার্ব হলো খেলতে।দাঁত খিচিয়ে বললো,
“তোরে কি পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে নাকি?এমন দৌড়াস কেন?”
চমকে উঠলো পরশ।মুহুর্তেই মনে পড়ে গেল সেদিন স্পর্শী বলা বাক্য।দাঁতে দাঁত পিষে পাভেলের দিকে তাকালো বললো,

“এই ওয়ার্ড আর দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করবি না।আমার গা জ্বলে যায় শুনলো।”
ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো পাভেল।কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
“কেন রে এটা কি ওই ডেঞ্জারাস মেয়েটা বলছিলো নাকি?”
পরশ সাড়া দিলো না।চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।দু হাত দিয়ে মাথার চুল গুলো পেছনে নিলো।এসব বিদঘুটে কথাবার্তা সে মাথাতেও আনতে চায় না।রাফাত ঢকঢক করে পানি খেল।এরপর বললো,
“ভাই,আমি জেলে গেলে আমারে দুই দিনের মধ্যে ছাড়াইবেন। আমি এর চেয়ে বেশিদিন জেলে থাকতে পারমু না।”
অবাক হয়ে গেল পরশ।পুণরায় চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
“তোকে জেলে ঢুকাবে কে?আর কি ঝামেলা পাকাইছিস আবার?”

রাফাত ক্ষান্ত হলো না।চিন্তিত কন্ঠে কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
“ঝামেলা তো সব আপনিই পাকাইছেন।আমি আর কি পাকামু।আরে ঐ মাইয়াডা,যেইটারে কিডন্যাপ কইরা আনছিলেন।আমি যে পাহারা দিলাম।মনে আছে?”
চমকে উঠে বসলো পাভেল।সন্দেহী চোখে বললো,
“হ্যাঁ মনে আছে।আর্শীর কথা বলছিস।কি করেছে ও?কেস করেছে তোর নামে?”
মাথা নাড়িয়ে না সুচক উত্তর দিলো রাফাত।এরপর ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বললো,

“আরে ধুর। তেমন কিছু না।তবে ওই মাইয়া কেডা জানেন?শামসুল সরদারের ছোট মাইয়া।একবার যদি ওর বাপ বা ভাইরে বলে আমি ওরে আটকাইয়া রাখছিলাম তাইলে আমার কি অবস্থা হবে বুঝতে পারতেছেন?”
কলম থেমে গেল পরশের।তড়িৎ গতিতে রাফাতের দিকে তাকালো।বললো,
“সকাল সকাল কি খেয়ে আসছিস তুই?উলটা পালটা বকিস না।যা এখান থেকে।ওই মেয়ে সাভারে থাকে।বাপ-ভাই কিচ্ছু নাই, শুধু মা আছে।ওর মায়ের পার্লার আছে ওখানে।মে বি স্থানীয় মেয়ে।ও এখানে আসবে কোত্থেকে?”
পাভেল সতর্ক হলো।ওই দুই বোনই যে এখন পিরোজপুরে আছে এ ব্যাপারে ভাইকে এখনো জানায়নি সে।জানালেই প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে কোনো না কোনো ঝামেলা করবে।নিজেকে শান্ত করে রাফাতকে বললো,
“তুই কিভাবে জানলি ও সরদার বাড়ির মেয়ে?”

“আরে এইতো কিছুক্ষণ আগে সরদার বাড়ি বইসা মাথা ফাঁটাইছে সিঁড়ি দিয়া পইরা।শামসুল সরদার,রিহান,খলিল সরদার সবাই গাড়ি ভইরা নিয়া আসছে।আমরা তো প্রথমে অবাক হইয়া গেছিলাম।আগে তো জানতাম খালি একটা ছেলে ওনার।কিন্তু মেয়ের কথা তো জানতাম না।সাংবাদিক জিগানোর পর খলিল সরদার কইছে।আপনে আমার কথা বিশ্বাস না করলে পিরোজপুর সমাচারে ঢোকেন।লাইভ চলছে এতোক্ষণ।দেখেন”

লাইভ দেখতেই গলা শুকিয়ে গেল পাভেলের।মারামারি,কাটা কাটি, দু-পক্ষের মধ্যে ঝামেলা এসব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।এসবে ভয় নেই।কিন্তু বিপত্তি ঘটবে সাংবাদিক, নিউজ চ্যানেল গুলো নিয়ে।সদ্য এমপি হয়েছে ভাই।এর মধ্যেই যদি তার বিপক্ষে বিরোধী দলের মেয়েকে অপহরণের দায় পড়ে সেটা ক্যারিয়ারে খুব বাজেভাবে প্রভাব ফেলবে।পরশ ও খানিকটা চিন্তিত হলো।ড্রয়ার থেকে কিছু টাকা বের করে দিয়ে বললো,
“আগামী এক মাসের মধ্যে যেন তোকে পিরোজপুরের মধ্যে না দেখি।ঘুরে আয় কক্সবাজার। ”
রাফাত যেন খুশিই হলো।এমনিতেও এসব ঝইঝামেলার মধ্যে না থাকাই ভালো।রাফাত চলে যেতেই চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো পরশ। চিন্তিত কন্ঠে পাভেলের দিকে তাকিয়ে বললো,

“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না একটুও।যদি এমন কিছুই হতো,তাহলে এতোদিনে ওই মৌমাছির বা’চ্চা কতবার যে হুল ফোটাতো গুণে শেষ করতে পারতি না।আর বড় মেয়ে জেলে, ছোট মেয়ে দুদিন ধরে নিখোঁজ আর সরদার বাড়ির কেউ খুঁজবে না এটাতো হতে পারে না।যাই হোক,খোঁজ নে।”
দিনের প্রথমাংশের শেষ প্রহর।কেবিন জুড়ে পিনপিনে নিরবতা।শুধু মাঝেমধ্যে নাক টানার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।শামসুল সরদারের বুকের সাথে লেপ্টে রয়েছে আর্শি।নানা আদুরে কথা বলে ছোট মেয়ের অভিমান ভাঙাতে ব্যাস্ত
শামসুল।পাশেই উদাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে স্পর্শী।দু মেয়েকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে ক্রমান্বয়ে পাথরের সত্তাটাকে গলিয়ে এক বাবার রুপ ধারণ করছে।স্পর্শী মুচকি হেসে আর্শিকে বাবার থেকে ছাড়িয়ে দিতে দিতে বলছে,
“তোকে তো আব্বু ভালোবাসে না।ছাড় তুই।একটু পর মা তোকে নিয়ে ঢাকা চলে যাবে।আমি একা থাকবো আব্বুর কাছে।ছাড় এখন।”

একটুও ছাড়লো না আর্শি।বরং পূর্বের থেকেও হাতের বাধঁন শক্ত করে ঝাপটে ধরলো।শামসুল সরদার হেসে ফেললেন।দূর থেকে লুকিয়ে চোখ ভরে দেখতে লাগলো পিপাসা।হায় সংসার!কোন পাপ সে করেছিলো যার কারনে আজ এতোগুলো বছর পস্তালো।ইশশ!এই সুখ,এই শান্তি থেকে আজ কতবছর বিচ্ছিন্ন সে।কেন হলো এমন?ভাগ্যটা কি এমনভাবেই লেখা ছিলো।আদোও কি আর তাকে মেনে নেবে উনি?পারবে কি এই বৃদ্ধ বয়সে স্বামী-সন্তান নিয়ে একসাথে থাকতে।নাকি পুণরায় যেতে হবে যানজটের ঘেরা ইট-পাথরের শহরে।

বিকেলবেলা।ঘড়ির কাঁটা তখন চারটায় স্থির হয়ে আছে।সূর্য তার উত্তপ্ততা কমিয়ে দিয়েছে ধীরে ধীরে।হালকা রোদ,আবছা ছায়া, আবার কিছুক্ষণ পর পর ঠান্ডা দক্ষিণা হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।স্পর্শী বাড়ির প্রাচীর ঘেরা পুরো বাগান টাতে ঘুরে ঘুরে দেখছে।পিছনেই নেওটা বেড়ালের মতো আর্শি লাফাচ্ছে।কপালের ব্যান্ডেজ খুলে ফেললেও স্টিচ খোলা হয় নি এখনো। সামনে রবিবার খোলা হবে।হাসপাতাল থেকে সেদিন’ই বাড়ি নিয়ে এসেছে শামসুল।মেয়েদেরকে তার রুমের পাশের রুমটাই দিয়ে দিয়েছে।কিন্তু পিপাসার সাথে এখনো কোনো রকম বনিবনা হয়নি।প্রথম দিন থাকার পরে লজ্জায় পড়ে গেছিলো পিপাসা।পুণরায় ঢাকা যেতে চাইলেও যেতে দেয় নি স্পর্শী।আগামী নয়দিন পর তার সেকেন্ড সেমিস্টার।একসাথেই যাবে বলে মাকে আটকে রেখেছে।মস্তিষ্ক বারবার যেতে বললেও মন মানছে না পিপাসার। সম্পর্কটা গোছানোর খুব সাঁধ তার।সে জন্যই বেহায়ার চরম পর্যায়ে পৌছে বসে আছে এই বাড়িতে।আর বাগানে ঘুরতে ভালো লাগছে না স্পর্শীর।এবারে এই গ্রামটা ঘুরতে হবে।পা বাড়ানোর সাথে সাথেই আর্শি তার হাত খপ করে ধরে ফেললো।বললো,

“আমিও যাবো তোমার সাথে।দেখো ডাক্তার বলছে হাটাহাটি করতে নইলে মাথা ব্যাথা করবে।নিয়ে যাও না প্লিজ!”
স্পর্শী বিরক্ত হলো।কিন্তু কিচ্ছু বললো না।গেটের সামনে আসতেই থমকে দাঁড়ালো। সামনেই বাইক নিয়ে গেটের বাইরে বের হচ্ছে সোভাম।এই একটা মানুষ কেই ভীষণ অদ্ভুত লাগে স্পর্শীর।বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য তাদের মেনে নিলেও এই লোক এখন পর্যন্ত টু শব্দটিও করেনি।সেদিনের পর খুব একটা ডাইনিং এ ও দেখা যায় না তাকে।সকালে বের হয়, একদম রাত দুটোয় বাড়ি ফেরে।এতে মোটেও রুষ্ট না স্পর্শী।সেতো সৎ বোন।মানতে কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক।দীর্ঘশ্বাস ফেললো স্পর্শী।মাঝেমধ্যে খুব অদ্ভুত অদ্ভুত ইচ্ছে হয় তার।এই যেমন হুটহাট বাবা-মাকে বলতে ইচ্ছে করে”তোমরা আমাকে একটা ভাই এনে দাও।খুব প্রয়োজন।এই সোভাম ভাইকে দিয়ে মোটেও হবে না।একে জ্বালানো যায় না একটুও।কেমন গম্ভীর মুডে থাকে।দরজা বন্ধ করে বসে থাকে।”কিন্তু তখন’ই জিভ কামড়ে ধরে হেসে দেয়।কিসব অবাস্তব চাওয়া তার।
সোভাম প্রায় গেট ছাড়িয়ে বাইরে বের হয়েছে।স্পর্শী জোরে চেঁচিয়ে বললো,

“সোভাম ভাই,একটা স্কুটি তো গিফট দিতে পারেন।এইযে আপনি শান্তিতে ঘুরতে বের হচ্ছেন বাইক নিয়ে।কিন্তু দেখুন,আমাদের হেটে হেঁটে যেতে হচ্ছে।”
বলেই জিভ কাটলো।সোভাম গাড়ি থামালো।কিন্তু পেছনে ফিরলো না।সেকেন্ড খানেক সময় ব্যয় করতেই আবার চলে গেল সদরের দিকে।
স্পর্শী হাঁটছে।এক পর্যায়ে বাড়ির রাস্তা ছাড়িয়ে চলে এলো মেইন রাস্তার দিকে।বিশালাকার প্রশস্ত রাস্তা।এপাশে বিভিন্ন গ্রামের রাস্তা চলে গেছে।আর ওপাশে বিশাল ধানক্ষেত।সবুজ বীজগুলোর উপর দিয়ে বাতাসের চাপ পুরো সবুজ সাগরের মতো ঢেউ বুনে যাচ্ছে।স্পর্শী ফোন বের করে ছবি তুলতে লাগলো।এরমধ্যেই কানে এলো আর্শির চিৎকার।সে খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে চেঁচিয়ে বললো,
“পাভেল ভাই,হাই! এই যে আমি আর্শি।

চকিতে তাকালো স্পর্শী।সামনেই ধীর গতিতে একটা কালো গাড়ি চলে যাচ্ছে।জানালা খোলা।সেখান থেকে স্পষ্ট পাভেল শিকদার কে দেখা যাচ্ছে।মুহুর্তে’ই দুম করে পিঠের উপর কিল মারলো স্পর্শী।পাভেল অবাক হয়ে গেল।জানালা থেকে মাথা বের করে স্পর্শীর উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললো,
” এইইইই মেয়ে?তুমি বাচ্চা মেয়েটাকে মারলে কেন?”
আশ্চর্য হয়ে গেল পরশ।এক হাত দিয়ে ব্রেক ধরে অন্যহাত দিয়ে পাভেলের কান টেনে ধরে গাড়ির ভেতরে ঢূকালো।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“তাতে তোর সমস্যা কি?পুড়ছে টা কোথায়?”
বিরক্ত হলো পাভেল।ভাইকে বললো,

“তুমি যে ওর বোনের সাথে লেগে থাকো তাতে সমস্যা নেই।আর আমি কিছু বললেই দোষ?”
গাড়ি চালাতে চালাতে পরশ বললো,
“আগের ব্যাপার আলাদা।আর এখনকার পরিস্থিতিও আলাদা।আর আমার ওই মেয়ের সাথে কোনো শত্রুতা নেই।যা ছিলো ওটা সাভারের মধ্যে।এসব চুনোপুঁটি ধরে হাত নষ্ট করতে চাইনা আমি।আর তোকেও যেন এসবের মধ্যে না দেখি।”

অনবরত কাঁদছে আর্শি।রাস্তার পাশে পা বিছিয়ে কাঁদছে।চিৎকার করে বলছে,
“তুমি আমাকে ওর সামনে বসে কেন মারলা?আমার কোনো প্রেস্টিজ নাই?এখন ওরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে না?এতো বড় হয়েছি আমি তাও অন্যসব ছেলেদের সামনে বসে তুমি আমাকে মারো।আজকে আমি আব্বুর কাছে নালিশ দিবো।”
স্পর্শী চোখগুলো ছোট ছোট করে বললো,
“ঠিক আছে,আমিও আব্বুকে ‘ বলবো তুই পাভেল শিকদারকে ডেকে ডেকে হায় বলছিলি যে কিনা আমাদের৷ শত্রু।”
ক্ষেপে গেল আর্শি।বললো,
“তো কি হইছে।উনি কি আমার কোনো ক্ষতি করছে?বরং তোমার ওই এমপির থেকে আমাকে ছাড়াইয়া সাভারে দিয়া আসছে।”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৩ (২)

থমকে তাকালো স্পর্শী।আর্শির দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই এক মিনিট,আমার এমপি মানে কি মিন করতে চাইছিস?”
আর্শি ছুটে বাড়ির রাস্তার দিকে গেল।বললো,
” তুমি আব্বুকে আমার নামে কিছু বললে আমিও আব্বুকে বলে দিব তুমি ওই এমপির সাথে প্রেম করো।
স্তব্ধ হয়ে গেল স্পর্শী।সে আর ওই এমপি।তাও আবার প্রেম।এটা কি আদোও সম্ভব?

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৫