রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৩২
সিমরান মিমি
সময় তার নিজস্ব গতিতে চলছে।রাতের সেই নিকষ কালো অন্ধকার ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।ধরা দিচ্ছে শুভ্র আলো রুপে।চলমান গাড়িটার কাচ নামিয়ে বাইরে তাকালো স্পর্শী।রাস্তার দুপাশের গাছগুলো ছুটছে তার’ই সাথে সাথে।পাতা গুলো এখনো পুরোপুরি সবুজ নয়।এগুলো স্পষ্ট আলোর অভাবে কালচে সবুজ বর্ণের দেখাচ্ছে।আকাশে এখনো লালচে আভার অস্তিত্ব নেই।মাত্র’ই ফজরের আযান দেওয়া হয়েছে।হয়তো আরো কিছুক্ষণ পর পূর্ব দিক থেকে সেই আভা উঠবে।সামনের ব্রিজটাতে লাগানো সাইনবোর্ডের দিকে তাকাতেই নড়েচড়ে বসলো স্পর্শী।ঝাপসা অক্ষর গুলো মিলিয়ে বুঝতে পারলো তারা পিরোজপুরে পৌছে গেছে।মায়ের দিকে ফিরে তাকাতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো।সারাটা পথ জুড়ে পিপাসা কান্না করতে করতে এসেছে।শেষে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে স্পর্শী।এরপর শব্দ করে না কাঁদলেও নিরবতায় চোখের জল ফেলেছেন পিপাসা।একপর্যায়ে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।
মিনিট দশেকের মধ্যেই গাড়ি থামলো গেটের সামনে।সরদার মঞ্জিল।দারোয়ান গাড়ির আওয়াজ পেতেই ছুটে আসলো।গেট খুলে দিলো দ্রুত।রিজার্ভ করা গাড়িটিকে নিত্যদিনের ভাড়ার তুলনায় দেড়গুণ বেশি দিতে হয়েছে।কিন্তু এতে টু শব্দটিও করেনি স্পর্শী।ভাড়া চুকিয়ে গাড়ি বিদায় করে দ্রুতপায়ে চলে এলো বাড়ির মধ্যে।সদর দরজা খোলা।মা ক্লান্ত পায়ে পেছন পেছন আসছেন।স্পর্শী ভেতরে ঢুকতেই শামসুল সরদার করুন চোখে সেদিকে তাকালেন।স্পর্শী বুঝলো সেই চোখের ভাষা।আশাহত হয়ে নুয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো,
“এখনো পাওনি আর্শিকে?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
রক্তিম বর্নের অশ্রুসিক্ত চোখ দুটোকে নিচে নামিয়ে অসহায় ভাবে মাথা নাড়ালো।সারারাত খুঁজেছে তারা।তবে এখনো কোনো প্রশাসন কে জানানো হয়নি।বিশ্বস্ত কিছু দলীয় লোককেও নামানো হয়েছে।তারা এখনো খুঁজছে।কিন্তু পায় নি।স্পর্শী হতাশ হয়ে সোফায় বসলো।মেঝো কাকির উদ্দেশ্যে নিচু গলায় বললো,
“কাকি,একটু পানি নিয়ে আসো।আর মাকে প্লিজ রুমে দিয়ে আসো।”
সোনালী যাওয়ার আগেই জিহান দৌড়ে গেল।পানি খাওয়ার পর পুনরায় সোজা হয়ে দাঁড়ালো স্পর্শী।আশপাশ টা অনেক টা স্পষ্ট হয়ে গেছে।হাতের ব্যাগ রেখে বাবার উদ্দেশ্যে বললো,
“চিন্তা করো না।এখন সবাই বিশ্রাম নাও।আমি আসছি।”
বাঁধ সাধলেন শামসুল। বললেন,
“তুমি কোথায় খুঁজবে মামনি।সারা পিরোজপুরে খুঁজেছি আমরা।লোক লাগিয়ে দিয়েছে।কেউই কিচ্ছু জানে না।”
“যারা জানে তাদের কাছেই যাচ্ছি।প্লিজ আমায় বাঁধা দেবে না।আর আমার সাথেও আসবে না।একটু একা ছাড়ো।”
দ্রুত পায়ে হেটে বাইরে বের হলো।গেরেজে গাড়ি রয়েছে। দারোয়ান কাকাকে পাঠিয়ে ড্রাইভার কে ঘুম থেকে উঠাতে পাঠালো।
গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে।গন্তব্যস্থল শিকদার বাড়ি।মিনিট পঁচিশের মধ্যেই গাড়ি এসে থামলো বিশালাকৃতির এক বাড়ির সামনে।আশেপাশে তাকালো না স্পর্শী। গাড়ি থেকে নেমেই গেটের দিকে এগিয়ে গেল।ভেতর থেকে তালা দেওয়া।অথচ আশেপাশে কোনো দারোয়ান নেই।নিশ্চয়ই রাত শেষে ঘুমোতে গেছে।পরোয়া করলো না স্পর্শী।শরীর তার কাঁপছে।অনাকাঙ্ক্ষিত উত্তেজনা,ক্ষোভ,ভয়,শঙ্কা তাকে দুর্বার ভাবে গ্রাস করেছে।সূর্য ওঠেনি এখনো।কন্ঠে কাঠিন্যতা এনে চিৎকার করে বললো,
“এইইইই গেট খুলুন।তাড়াতাড়ি খুলুন।”
আশেপাশে নেই কোনো সারাশব্দ।স্পর্শী এবারে গেট ধাক্কাতে লাগলো শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে।অনবরত করতে লাগলো চিৎকার।’গেট খুলুন।’
সারা রাত পাহারা দিয়ে সদ্য ঘুমাতে যাওয়া পাহারাদার থমকে গেল।বিছানা থেকে নেমে দ্রুত ছুটে এলো গেটের কাছে।অপরিচিত মেয়ের এমন তেজস্বী প্রতিক্রিয়ায় দ্রুত খুলে দিলো গেট।পিছু ফিরলো না স্পর্শী।এগিয়ে গেল সদর দরজায় দিকে।
কিন্তু আফসোস!এই দরজাও ভেতর থেকে আটকানো।অবশ্য থাকবেই তো।তারা তো শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।তাদের তো আর বাড়ির মেয়ে হারিয়ে যায় নি।ক্ষোভে ভেতর টা ফেটে যাচ্ছে স্পর্শীর।পুনরায় দরজা ধাক্কাতে লাগলো।’দরজা খুলুন ‘বলে চেঁচাতে লাগলো অনবরত।
নামাজ পড়ে আবারো ঘুমাতে গিয়েছিলো পিয়াসা।এমন গগনবিদারী চিৎকার শুনে আতংকে মুখ নীল হয়ে গেল।দ্রুত উঠে নিচে নেমে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।আমজাদ শিকদার নিজেও অবাক।স্ত্রীয়ের পিছু পিছু নেমে এলো নিজেও।দরজা খুলতেই অপরিচিত মেয়ে দেখে স্বামীর দিকে তাকালো পিয়াসা।রাত জাগা ফোলা মুখ,এলোমেলো চুল, চোখ গুলো অশ্রুসিক্ত কাঠিন্যতে ছেঁয়ে যাওয়া মুখখানিতে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো।নরম গলায় বলল,
“কে তুমি?এভাবে চিৎকার করছো কেন?”
উত্তর দিলো না স্পর্শী।এই শান্ত মানবী’র সাথে সে মোটেও উচ্চস্বরে কথা বলতে পারবে না।কিন্তু এই পরিস্থিতিতে শান্ত ভাবে কথা বলাও তার পক্ষে অসম্ভব। যার কারনে পুরোদমে পিয়াশার প্রশ্ন এড়িয়ে গেল।ড্রয়িং রুমের মাঝখানে গিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে ক্ষোভমিশ্রিত কন্ঠে বললো,
“পরশ শিকদার কোথায়?ওনাকে ডেকে দিন।”
আমজাদ শিকদার ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালেন।এই মুহুর্তে তার মনে অসংখ্য প্রশ্ন দাঁনা বাঁধছে।একবার মনে হচ্ছে মেয়েটি পরশের গার্লফ্রেন্ড,যাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে যার কারনে মেয়ে বাড়িতে চলে এসেছে।পরক্ষণেই মনে হলো,মেয়েটি পরশের গোপনে বিয়ে করা বউ যার সাথে হয়তো তার ছেলের ঝগড়া বেঁধেছে।কিন্তু পরশ তাদের থেকে লুকাবে কেন?না না তার ভাবনা ভুল।স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“পরশের কাছে কি দরকার তোমার?এই ভোরবেলায় এমন ভাবে চিৎকার করে দরজা ধাক্কাচ্ছিলে কেন? এটা কি কারোর বাড়িতে আসার সময়।আর তুমি কে?মুখ টা বেশ চেনা চেনা লাগছে।”
রুমের বাইরে এমন চেঁচামেচি শুনে বাইরে বেরিয়ে এলো পরশ।দরজা খুলে সিঁড়ির কাছে আসতেই ভ্রুঁ কুঁচকে গেল।স্পর্শী মাত্রই তাকে লক্ষ করেছে।পরশ খানিকটা থমকালো।মেয়েটার পুরো মুখটা লাল হয়ে গেছে।চুলগুলো অগোছালো সাথে অশ্রুসিক্ত চোখ। এই মেয়েটা যদি আপাতত কয়েক ঘন্টার জন্য মুখ টা বন্ধ রাখে তাহলে পরশ শিউর এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবথেকে ইনোসেন্ট, সাদাসিধা, ভোলাভালা,কিউট চরিত্রের অধিকারিণী হবে স্পর্শীয়া সরদার।কিন্তু এটা সম্ভব নয়।ওমন কিউট ফেসটার হুট করেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।কন্ঠে কাঠিন্যতা এনে সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে থাকা পরশকে হুমকি দিয়ে বললো,
“আপনি কি নিচে আসবেন নাকি আমি উপরে আসবো।”
খুঁক খুঁক করে কাঁশি দিলো পরশ।মা-বাবার দিকে তাকিয়ে অসস্তিতে ভেসে গেল।এই মেয়ে তাকে হুমকি দিচ্ছে তাও তার বাড়িতে।আজ এখানে মা-বাবা উপস্থিত না থাকলে সে নির্ঘাত বলতো,
“হ্যাঁ,তুমিই উপরে এসে।আমার ঘরে ঢুকে বসো।তারপর কোল্ড ড্রিংকস খেতে খেতে শান্ত কন্ঠে তোমার এই উত্তেজিত হওয়া কথা জানাও।”
কিন্তু এই মুহুর্তে এটা বলা সম্ভব না।গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে নিচে নামতে নামতে বললো,
“তুমি তো ঢাকায় ছিলো।এখানে কিভাবে আসলে?”
ফুঁসে উঠলো স্পর্শী।তেজ নিয়ে বললো,
“হ্যাঁ আমি জানি তো।আমি ঢাকায় ছিলাম এটা আপনি জানতেন।আর আমার এই অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়েই তো ঘটনাগুলো ঘটিয়েছেন।”
অবাক হলো পরশ।কিছু বলার আগেই পুনরায় ক্ষোভ ঝেড়ে বললো,
“দেখুন,আপনাকে আমি সাবধান করছি।আমার বোনকে দিয়ে দিন।এখনো পুলিশ কে জানাই নি আমি।বিশ্বাস করুন আগামী এক ঘন্টার মধ্যে ওকে না দিলে আমি প্রেস কনফারেন্স করবো।আপনার এই মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ওই কুৎসিত চেহারা টা পিরোজপুর বাসীকে দেখাবো।আমার বোন কে কোথায় রেখেছেন?”
কপালে ভাঁজ ফেললো পরশ।গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“সংযত হয়ে কথা বলো।এটা আমার বাড়ি।আর একবার উঁচু গলায় কথা বললে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে গেটের বাইরে বের করে দেব।তোমার বোন কোথায় সেটা আমি কিভাবে বলবো?আমি কি তোমার বোনের বডিগার্ড?কিছু হলেই আমার কাছে ছ্যাঁচড়ার মতো চলে আসো কেন?নিজের বোনকে সামলে রাখতে জানো না?”
বাক্যহারা হয়ে গেল স্পর্শী।দুপাশে ফিরে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আমজাদ শিকদার এবং পিয়াশা শিকদারকে দেখলো।এরপর পুনরায় পরশের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
“আমি ছ্যাঁচড়া?আপনি ছ্যাঁচড়া,গুন্ডা,সন্ত্রাসী,মেয়ে পাচারকারী।আমার বোনকে কিদন্যাপ করে এখন সাধু সাজছেন?চোরের বাপের বড় গলা।”
থেমে আমজাদ শিকদার এর দিকে তাকালো স্পর্শী।ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো,
“আপনার ছেলে এর আগেও আমার ছোট বোনকে কিডন্যাপ করেছে।পুরো তিন তিনটা দিন আটকে রেখেছে,অত্যাচার করেছে।কাপুরষ একটা।কিছু হলেই আমার বোনের উপর আক্রোশ মেটায়।অসভ্য।আমার বোনকে দিয়ে দিতে বলুন।নাহলে গলায় গামছা পেঁচিয়ে সদরে নিয়ে ব্রিজের খাম্বার সাথে বেঁধে রাখবো।”
চোখ দুটো বড় বড় করে ফেললেন আমজাদ।কি বলবেন ভেবে পেলেন না।একবার পরশের দিকে তাকাচ্ছেন তো আরেকবার স্পর্শীর দিকে তাকাচ্ছেন।
সারা শরীরের রক্ত গুলো টগবগ টগবগ করে ফুটছে পরশের।নিজেকে শান্ত রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“দেখো,আমি তোমাকে লাস্ট বারের মতো বলছি।আমি তোমার বোনের ব্যাপারে কিচ্ছু জানি না।ফার্দার আর একটাও লেইম ওয়ার্ড ইউজ করবে না। নইলে ঠাটিয়ে গাল ফাঁটিয়ে দিবো।অসভ্য”
ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিলো স্পর্শী।দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে সোফায় বসে পড়লো।লাস্ট ভরসা ছিলো শিকদার বাড়ি।কিন্তু এখানেও নেই।ভাবতেই কান্না পাচ্ছে।হুট করেই সতর্ক হলো।বললো,
“আপনার ভাই কোথায়?ওর সাথে কথা বলবো আমি।কোথায় উনি?উনি অপহরণ করেছে আমার বোনকে।তাও আপনার কথায়।”
পরশ বিরক্ত হলো।’পাভেল’ বলে বার কয়েক ডাক দিলো।কিন্তু ফলাফল শূন্য।কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।পরশ ত্রস্ত পায়ে রুমের দিকে গেল।স্পর্শী বিশ্বাস করতে পারলো না।সে নিজেও পিছু পিছু গেল।রুমের দরজায় টোকা মারতেই মড়মড় শব্দে খুলে গেল দরজা।অবাক হলো পরশ।দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখলো রুম ফাঁকা।আশেপাশের জিনিসপত্র গতকাল সকালের মতোই সব অগোছালো।ভাঙা ফোন টাও পরে আছে অযত্নে।মস্তিষ্কের ভেতরে নানা রকম অঘটনের আশংকা বেড়েই চলেছে।একে একে বারান্দা,বাথরুম,ছাদ দেখার পড়েও পাভেলের খোঁজ পেল না।স্পর্শী নিজেও অবাক।কিন্তু পরশ শিকদার নামক অসহ্যকর লোককে বিশ্বাস করা তার পক্ষে অসম্ভব। সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।পরশ ফোন করতে লাগলো অনবরত। কিন্তু সিম বন্ধ। হতাশ হয়ে বিছানায় বসতেই টেবিলের দিকে নজর গেল।সেখানে থাকা ছোট্ট কাগজের টুকরোটা হাতে ধরতেই বাকহারা হয়ে গেল।
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৩১
“ভাই,জীবনে অনেক মেনেছি তোকে।কিন্তু আর পারবো না। আমি আমার ওই ছোট্ট পাখিটাকে ঠকাতে পারবো না।ও যে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি জানি,ওর পরিবার ও আমায় মানবে না।সেজন্যই যাচ্ছি আমরা।এই রাজনৈতিক গন্ডি পেরিয়ে অনেক দূরে।যেখানে কেউ আমাদের বাঁধা দেবে না।
ক্ষমা করিস।”