রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৪৫

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৪৫
সিমরান মিমি

“এক্সকিউজ মি!ঘন্টাখানেকের মধ্যে কি স্পর্শীয়া সরদার নামে কোনো পেসেন্ট এডমিট হয়েছে এখানে?”
রিসিপশনের মেয়েটি সুচালো দৃষ্টিতে তাকালো।যেন এই মুহুর্তে বিরক্ত সে।পরক্ষণেই সামনে দাঁড়ানো লোক দুটোর বেশ-ভূষণ থেকে স্বাভাবিক ভাবে হাসলো।এরা নিশ্চয়ই কোনো নামী-দামী লোক হবে।বিনয়ী স্বভাব নিয়ে বললো,
“একটু অপেক্ষা করুন স্যার।”
এরপর পেসেন্টদের এন্ট্রি লিস্ট টা মনযোগ সহকারে দেখে বললো,

“দুঃখিত!এই নামের কোনো পেসেন্ট সকাল থেকে ভর্তি হয় নি।”
চিন্তিত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো সোভাম।মেয়েটির উদ্দেশ্য পুনরায় বললো,
“আশেপাশে ভালো কোনো হস্পিটাল আছে যেখানে যেতে পারে?আসলে আমরা তাকে হারিয়ে ফেলেছি।”
মেয়েটি কিছুক্ষণ ভাবলো।”হ্যাঁ, আশেপাশে বলতে এখানে একটা ভালো হস্পিটাল আছে।’এনাম মেডিকেল হল’।তবে এটা এখান থেকে সোজা ব্যাংক কলোনি পেরিয়ে থানা স্ট্যান্ডের ওদিকে যেতে হবে।ওখান কার ওভারব্রিজ টা বেরিয়েই হাতের ডান দিকের রোড টায় যেতে হবে।মিনিট দুয়েকের মধ্যেই পেয়ে যাবেন।কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দিবে।”
“থ্যাংক ইউ।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তৃষ্ণা।”
চমকে পেছনে তাকালো পিপাসা।সেকেন্ড খানেক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো।পরক্ষণেই প্রেসক্রিপশন হাতে ছুটলো নিচের দিকে।শামসুল সরদার আশাহত হলেন।এগিয়ে এলেন স্পর্শীর কেবিনের দিকে।দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই আর্তনাদ করে উঠলেন।স্পর্শী জ্ঞানহীন শুয়ে আছে বেডে।হাতে স্যালাইন লাগানো।শুকিয়ে আগের থেকে কি হয়ে গেছে।চেহারায় সেই আগের উজ্জ্বলতা নেই।মলিনতায় ছেয়ে গেছে মুখশ্রী।চোখের নিচটাতে পানির শুষ্ক আস্তরণ লক্ষ করা যাচ্ছে।মেয়েটা যে তার কেঁদেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে।শক্তপোক্ত মেয়েটার এমন করুন অবস্থা দেখে ভেতর টা হুঁহুঁ করে উঠলো।আদুরে হাত মেয়ের মাথায় বুলিয়ে দিয়ে দিয়ে চুমু খেলেন কপালে।কি ভাগ্য তার?আজ এতোগুলো বছর পর মেয়েদেরকে কাছে পেয়েও আগলে রাখতে পারলো না।সেই চলেই গেলো।হয়তো দোষ টা তারই ছিলো।
“আন্টি, আপনি স্পর্শীর কাছে যান।আমি ওষুধ নিয়ে আসছি।”

ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো পিপাসা।শান্ত স্বরে বললো,”কোনো প্রয়োজন নেই।”
বলে ফার্মেসীতে ঢুকলেন।সোভাম পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।টাকা দেওয়ার সময় আসতেই ওয়ালেট বের করলো।লোকটির হাতে টাকা দিতেই সেটা নিয়ে নিলো পিপাসা।দোকানদার কে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে সোভামের হাতে দিয়ে দিলো।বিরক্তিকর কন্ঠে বললো,
“বললাম না,প্রয়োজন নেই।আমার মেয়ের চিকিৎসা করার জন্য যথেষ্ট সামর্থ্য আছে আমার।”
মেডিকেলের পাশেই ফার্মেসী।দ্রুতপায়ে পুনরায় হস্পিটালের দিকে ছুটলো পিপাসা।দায়িত্বরত নার্সের হাতে ওষুধ টা দিয়ে কেবিনে ঢুকলো।তৃষ্ণা কে দেখতেই দাঁড়িয়ে পড়লেন শামসুল সরদার।প্রশ্ন করলেন,
“কি হয়েছিলো ওর?”

উত্তর দিলো না পিপাসা।মেয়ের মাথাটা টাকে আরেকটু উঁচু করে দিয়ে চুলগুলো খোঁপা বাঁধলেন।সোভাম আবারো পিছু পিছু এলো।কেবিনের এক কোনায় দাঁড়িয়ে বাবার দিকে চাইলো।শামসুল উত্তর না পেয়ে পুনরায় বললো,
“বললে না যে,ওর কি হয়েছিলো?”
“জ্বর ছিলো দু দিন ধরে।বারবার বমি করছিলো, অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলো বলে এডমিট করেছি।”
হতবাক হয়ে গেলেন শামসুল।খানিকটা রাগত স্বরে বললো,
“দু দিন ধরে জ্বর আর তুমি আজ ভর্তি করেছো হস্পিটালে?”
ফুঁসে উঠলো পিপাসা। ঝাড়ি মেরে বললো,

“হ্যাঁ, করেছি।তো?আমার কাজ নেই?পার্লারে যেতে হয় না?নাকি বসে বসে টাকা দিয়ে যাবে আমাকে।যখন সময় পেয়েছি তখন ভর্তি করেছি। আপনার কোনো সমস্যা?”
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল শামসুল।লজ্জাও পেল। সোভামের দিকে তাকাতেই সে মাথা নিচু করে ফেললো।এরপর না শোনার ভান ধরে চলে গেল রুম থেকে।
“অন্তত আমাকে জানাতে পারতে।মেয়েটা কে দু দুটো দিন ধরে জেদ করে কষ্ট দিয়েছো।আমাকে ফোন করলে কি এমন হতো?”

পিপাসা সুচালো দৃষ্টিতে তাকালো।কন্ঠে ক্ষোভ নিয়ে বললো,
“আপনার ফোন নাম্বার আমার কাছে থাকার কথা না।আর বাদবাকি রইলো জানানো।আপনাকে স্পর্শীর ওতটাও আপন মনে হয় নি আমার।হলে নিশ্চয়ই জানাতাম। ”
অপমানে থমথমে হয়ে গেল শামসুল।ক্রোধ নিঃসরণ করে চেঁচিয়ে বললো,
“স্পর্শী আমার মেয়ে। ”
“সেটা আমিও জানি, স্পর্শী আপনার মেয়ে।শুধু স্পর্শী কেন আর্শিও আপনার’ই মেয়ে।এই বিষয়গুলো আপনার বা আপনার বোনের কোনো রকম সন্দেহ থাকলেও আমার নেই।”
থেমে,

“একদম চেঁচাবেন না।এটা হস্পিটাল।আর মেয়ে অসুস্থ।ডাক্তার এখানে বেশি মানুষ এলাও করতে বারণ করেছে।মেয়েকে দেখেছেন,এবারে আসুন।”
মাথা নিচু করে ফেললো শামসুল।বেশ কিছুক্ষুণ ওভাবেই চুপ করে রইলো।এরপর গমগমে কন্ঠে বললো,
“আমার মেয়েকে আমি এক্ষুনি নিয়ে যাবো।ওখানে নিয়ে ভালো হস্পিটালে চিকিৎসা করাবো।”
ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো পিপাসা।মিনিট খানেক নিশ্চুপ থাকার পর বললো,
“আপনি আপনার মেয়েকে নিতেই পারেন।এ বিষয়ে আমি কোনো বাঁধা না আগে দিয়েছি আর না তো এখন দিবো।তবে কথাটা হচ্ছে স্পর্শী যাবে তো?”

নিশ্চুপ রইলো শামসুল।পিপাসা ও বসে রইলো মেয়ের পাশে।এক হাত দিয়ে চুলে বিলি কাঁটতে লাগলো।কিছুক্ষণ পরপর আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে নিজস্ব লোকটাকে।
“ও উঠবে কখন?এখনো কি জ্ঞান ফেরেনি?”
স্বামীর কথায় চমকে উঠলেন পিপাসা।স্যালাইন প্রায় শেষ।এক্ষুনি নার্সকে ডাকতে যেতে হবে।
“অজ্ঞান হয়নি।বমি করছিলো বার বার।তাই ডাক্তার স্যালাইনের সাথে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছে।একটু পরেও ওষুধ খেতে উঠাবো।”
বলে হনহন করে এগিয়ে গেল কেবিনের বাইরে।পিপাসা কে বাইরে বের হতে দেখে এগিয়ে এলো সোভাম।বাবার কাছে এসে বললো,
“রাজি হয়েছে?”

মাথা নাড়িয়ে না স্বরুপ উত্তর দিলো শামসুল সরদার।আশাহত হলো সোভাম।বললো,”আমিও ওষুধের টাকা দিতে চেয়েছিলাম। আন্টি নেয় নি।কি করবে এবার?ওদের দেখে মনে হচ্ছে না রাগ ভেঙেছে।আমাদের সাথে যাওয়া তো দুরের কথা।”
“দুপুর হয়ে গেছে।একটু পরেই হয়তো স্পর্শীয়াকে ওষুধ খাওয়ানো হবে।তুই বরং কিছু খাবার নিয়ে আয় সবার জন্য।”

ঠোঁট কামড়ে নিঃশ্বব্দে হাসলো সোভাম।আশেপাশে তাকিয়ে চাপা স্বরে বললো,
“তুমি কি খাবার দিয়ে ওদের পটাতে চাইছো?মানতেই হবে রাজনীতি করতে করতে তোমার ভেতর থেকে রোমান্টিকতার ‘র’ ও হারিয়ে গেছে।”
চোখ গরম করে তাকালেন শামসুল।পাত্তা দিলো না সোভাম।বললো,
“এই জন্যই যেচে আসা কোনো কিছু অবহেলা করতে নেই।আন্টি তো গেছিলোই বাড়িতে।কি এমন হতো একটু কথা বললে?যদি আগেভাগে সবটা মানিয়ে নিতে তাহলে আবার এমন পিছু পিছু ঘুরতে হতো না।”
আর দাঁড়ালো না।হেটে গেলো বাইরে।নার্স নিয়ে ভেতরে ঢুকলো পিপাসা।স্যালাইন শেষ হয়ে গেছে প্রায়।সুই উঠিয়ে কপালে হাত দিলো নার্স।এরপর ওষুধ বের করে বললো,

“ওনাকে কি কিছু খাইয়েছেন?”
“নাহ,খাওয়ানো হয়নি।”
বিরক্ত হলো নার্স।ওষুধ দেখিয়ে দিয়ে বললো,
“কিছু খাইয়ে এই দুটো খাওয়াবেন। প্রতি চার ঘন্টা পর পর।ওনার শরীর খুবই দুর্বল।খাওয়া-দাওয়ার দিকে ঠিকমতো নজর রাখবেন।আর উনি হয়তো রাত জাগেন বেশি।এটা ঠিক নয়।পারলে কয়েক দিন এখানেই রাখেন।আমরা খেয়াল রাখবো।”
মাথা নাঁড়ালো পিপাসা।কি খাবার আনা যায় ভাবতেই দুহাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে ভেতরে ঢুকলো সোভাম।স্পর্শীর বেডের পাশে ফলের ব্যাগ গুলো রাখলো।এরপর পিপাসার হাতে বিরিয়ানির প্যাকেট গুলো দিয়ে বললো,
“আন্টি, ওকে খাইয়ে চলুন আমরাও খেয়ে নেই।”

অসস্তিতে পড়লো পিপাসা।ছেলেটাকে আগেও দু চারবার ধমক দেওয়া হয়েছে।তারপরেও নির্লজ্জ হয়ে খাবার এনেছে।এবারে যদি আবারো অপমান করে তাহলে সেটা সীমার বাইরে চলে যাবে।কোনো কথা না বলে ব্যাগ গুলো সিটের এক কোনায় রাখলো।পাতলা একটা রুমাল ভিঁজিয়ে স্পর্শীর মুখ গলা মুছিয়ে দিলো।জ্বরের তপ্ত দেহে এমন ঠান্ডা স্পর্শ পেতে ভালো লাগলো স্পর্শীর।হাতটা সরাতেই চেপে ধরলো।জড়ানো কন্ঠে বললো,
“ভাল্লাগছে।”

হাসলো পিপাসা।ভেঁজা কাপড় টা দিয়ে মুখ,গলা,হাত মুছতে লাগলো।কতক্ষণ পরপর আদুরে গলায় বললো,
“আম্মু ওঠো,ওষুধ খেতে হবে।দেখিতো,ওঠ।
মাথা ধরে তুলে নিজের গায়ের সাথে হেলান দেয়ালো।ভীষন ওজন হয়ে আছে মাথাটা।শামসুল সরদার এগিয়ে এলেন।মেয়ের কাছে আসতে আসতে বললেন,
“মামুনি,এখন শরীর কেমন লাগছে?”
দুম করে সামনে তাকালো স্পর্শী।মায়ের কাঁধ থেকে মাথা টা তুলে রাগত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো।তাকে ছুঁতে আসতেই চেঁচিয়ে বললো,

“ছোঁবে না তুমি।দূরে থাকো।”
এরপর মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“তুমি ডেকেছো ওনাদের?”
দ্রুত মাথা নাড়িয়ে না স্বরুপ উত্তর দিলো পিপাসা।বললো,
“নাহ!আমি কেন ডাকবো?”
“এক্ষুণি যেতে বলো।আমার ভাল্লাগছে না। ”
বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন শামসুল।মেয়ের হাত ধরে অসহায় কন্ঠে বললেন,
“মামুনি এরকম করে না।শান্ত হও।তুমি অসুস্থ।আর বাবা দেখতে আসবে না?”
ফুঁসে উঠলো স্পর্শী।অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,

“কিসের বাবা?কার বাবা?কই আমি তো আপনার সন্তান নই।আপনার বোন যখন আমার জন্মপরিচয় নিয়ে কথা বললো,আমাকে চরিত্রহীন বললো তখন তো আপনি মুখ বুঝে ছিলেন।একবার ও বললেন না ” আমার সন্তান আমি বুঝে নিবো।”

কিসের সন্তান আমি আপনার?স্ত্রী থাকলে তো সন্তান পাওয়া যায়।কই আপনার তো কোনো স্ত্রী নেই।তাহলে সন্তান পেলেন কোত্থেকে?দিনের পর দিন নির্লজ্জের মতো মা আমাদের দুবোনের জন্য আপনার বাড়িতে বেহায়ার মতো পড়েছিলো।অথচ আপনি তাকে মিনিমাম সম্মান টুকুও দেন নি।বরং আপনার বোনকে দিয়ে অপমান করিয়েছেন।কি ভেবেছেন?আমার মা অসহায়? গত উনিশ টা বছর একা কাঁটিয়েছে সন্তানদের নিয়ে।বাকি জীবন টাও পারবে এবং পারতো।শুধুমাত্র আমার বোকামির জন্য এতো অপমান সয়ে পিরোজপুর গিয়েছিলো।আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভুল ছিলো পিরোজপুরে যাওয়া।ওখানে আপনার খোঁজে না গেলে আমার সাথে এতকিছু কখনোই ঘটতো না।আপনার জন্য আমার লাইফ টা শেষ হয়ে যাচ্ছে।শুধুমাত্র আপনার জন্য।এখন কেন এসেছেন? আপনার বোন নেই? যান, বোনকে তোষামোদ করে থাকুন।স্ত্রী সন্তানের কোনো দরকার নেই আপনার।আর সন্তান তো আছেই আপনার।এই যে ছেলে।ছেলে থাকলে কি আর কাউকে লাগে?ছেলেই তো সব।আমাদের দিয়ে কি করবেন?আর আমাদের জন্য নিজের বোনের সাথেও বা সম্পর্ক কেন নষ্ট করবেন?

থেমে,
আম্মু,ওনাদের যেতে বলো।আমার সহ্য হচ্ছে না।যতক্ষণ ওনারা থাকবেন আমি ওষুধ তো দুরের কথা দানা-পানিও মুখে দিবো না।”
চোখ দুটো ভরে এলো শামসুলের।মাথা নিচু করে দ্রুত বের হয়ে গেল কেবিন থেকে।ক্রোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সোভাম।কয়েক পা সামনে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“কাজ টা তুমি মোটেও ভালো করো নি।অসুস্থ,বৃদ্ধ মানুষ টা সারাটা দিন জার্নি করে শুধুমাত্র তোমাকে দেখার জন্য এসেছিলো।আজ এতোগুলো দিন ধরে তোমাদের অনুপস্থিতিতে অন্ধকার রুমে বিষন্নতায় ভূগেছে।প্রতিনিয়ত ছটফট করেছে।আর তাকে এইভাবে অপমান করলে।তোমার লাইফ শেষ করে দিয়েছে আব্বু?কার রাগ কার উপর দেখাচ্ছো তুমি?

যার সাথে প্রেম করেছো সে ধুমধাম করে বিয়ে করছে।আর নিজে হস্পিটালের বেডে শুয়ে শুয়ে নিজের বাবার উপর রাগ ঝাড়ছো,তাকে অপমান করছো।লজ্জা হওয়া উচিত তোমার।”
অপমানে থমথমে হয়ে গেল স্পর্শী। মস্তিষ্কের মধ্যে পুরোনো ক্ষতটা আবার সতেজ হয়ে উঠলো।যতই ভুলতে চাচ্ছে ততই সবটা মনে করিয়ে দিচ্ছে।উফফফ!যন্ত্রণার পোকা টা আবারো চিবোচ্ছে মস্তিষ্ক ।চিৎকার করে উঠলো।
“আমি কারো সাথে প্রেম করি নি।পরশ শিকদারের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই আমার।সে বাঁচলো কি মরলো,বিয়ে করলো কি করলো না এতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।বুঝতে পেরেছেন আপনি?”
শুনলো সোভাম।স্পর্শী ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে উঠছে।বুঝতে পেরে হনহন করে বেরিয়ে গেল।দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে শুয়ে পড়লো।একটু শান্তি নেই।কেউ থাকতে দিচ্ছে না একটু শান্তিতে।পিপাসা মেয়েকে ধরলো। বুঝানোর স্বরে বললো,
“সব কথায় এমন চেঁচিয়ে উঠিস কেন?ক্ষতিটা তো সেই তোর ই হয়।”
“আম্মু খুব মাথা ব্যাথা করছে।একটু ঠান্ডা কাপড় টা ভিজিঁয়ে কপালে দাও।মেয়ের কথামতো ভেঁজা কাপড় টা দিয়ে সারা গা মুছে দিলো পিপাসা।
” ওঠ,ওষুধ টা খা।মাথা ব্যাথা কম বে।”
“বিরিয়ানি আনলে কখন?ভালো করেছো।এমনিতেই জ্বর।এর মধ্যে ওইসব তেল-ঝাল ছাড়া খাবার ভাবতেই বমি পাচ্ছে।এর চেয়ে বিরিয়ানিই বেটার।”
থেমে,
এতো চার প্যাকেট!

“হুম,তোর ভাই এনেছে।ওষুধের টাকাও দিতে চাইছিলো।আমি নেই নি।এরপর আবার এসব কিনে এনেছে।কিন্তু খেয়ে যেতে পারলো না।এবার কি করবি?ফেলে দিবি।”
শান্ত দৃষ্টিতে প্যাকেটের দিকে তাকালো স্পর্শী।চার প্যাকেট বিরিয়ানি,কেজি পাঁচেক মালটা,আঙুর,আর রসগোল্লা।নড়েচড়ে বসলো এবার।আঙুর মোড়ানো কাগজ ছিড়ে এক ছড়ি ছিড়লো।মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বললো,
“ফেলে দেওয়ার কি আছে?টাকার জিনিস।এমনিতেও রোগী দেখতে এলে এসব তো আনেই।”
মুখ টিপে হাসলো পিপাসা।বললো,
“কি করবি এখন?”
চমকালো স্পর্শী।বললো,
“কোন বিষয়ে।”

“এই যে তোর বাবার বিষয়ে।লোকটা বারবার আসছে আর অপমানিত হচ্ছে।কি চাইছিস?সম্পর্ক টা আদৌ কি রাখবি নাকি বাবা নামক কাউকে ভুলেই যাবি।”
বিরিয়ানির প্যাকেট খুললো স্পর্শী।উফফফ!কি সুগন্ধ!মায়ের এনে দেওয়া পানিতে ধুয়ে এক লোকমা মুখে নিলো।”সম্পর্ক নষ্ট করার কি আছে?আগেই তো বলেছি স্ত্রী থাকলেই সন্তান পাবে।যদি দেখি তারা স্বামী-স্ত্রী ঠিক, তবেই আমি ঠিক।”
“যদি বলি আমি তোর বাবাকে ক্ষমা করে দিয়েছি, তখন?”
বিরক্ত হলো স্পর্শী।”উঁহু!তুমি ক্ষমা করলে তো হবে না।তোমাকে দিয়ে কি আসে যায়?তোমায় তো খেলায় নেই নি।তুমি দুধভাত!যেদিন ওই শামসুল সরদার তার বোন শান্তি রহমান কে দিয়ে তোমার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চাওয়াবে সেদিন’ই যাবো।”
বিস্মিত হলো পিপাসা।

“ছিঃ!ছিঃ!উনি আমার বয়সে কত্ত বড়।এসব কি বলিস?”
বিরক্ত হলো স্পর্শী।খামখেয়ালী করে বললো,
“উনি তোমার বয়সে বড় হলে তো কিছু আসে যায় না।সম্পর্কে তোমার ছোট ননদ।শামসুল সরদারের ছোট বোন।ক্ষমা তো উনাকে চাইতেই হবে।নইলে আজীবন শামসুল সরদারকে স্ত্রী-সন্তান হীন ভূগতে হবে।ইট’স লাউড এন্ড ক্লিয়ার।”

“ভাই খুঁইজা পাইছি।”
শোয়া থেকে উঠো বসলো পরশ।আজকাল ঘুমটা একটু বেশিই ধরেছে।যখন তখন, সময় নেই, অসময় নেই ঘুম এসেই থাকে।এখনো শরীর টা ঘুমে টলছে।অন্ধকার রুম হাতরে লাইট জ্বালালো।মুহুর্তেই বন্ধ করে নিলো চোখ টা।এতোটা কড়া আলো ভীষণ ভাবে চোখে লাগছে।ফোন হাতে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্ক্রিনের দিকে চাইলো। পরিচিত নাম্বার টা দেখতেই কানে নিলো।বললো,
“ওহ, তুই।কোনো খবর পেয়েছিস?”

“হ্যাঁ, ভাই।কালকেও কয়েকবার ফোন দিলাম।আপনার ফোন বন্ধ।তাই কন্টাক্ট করতে পারি নাই।ওরে খুঁইজা পাইছি।আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে।সমাজবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টে পড়ে।কালকেই চোখে পড়লো।”
মস্তিষ্ক উদাম গতিতে ছুটতে শুরু করেছে পরশের।বাম হাতটা নিশপিশ করছে।দ্রুতকন্ঠে বললো,
“তুই শিউর তো?ওটাই।মুখ ভালো করে দেখেছিস?”
“হ্যাঁ ভাই।নাম রাহুল,২১-২২ সেশনের।ওর কলেজ ও সাভার। ”
সময়ের দিকে চাইলো পরশ।বিকেল পাঁচ টা বাজে।
“আধঘন্টার মধ্যে ধরে আনতে পারবি?ব্যাস!মারার দরকার নাই।শুধু ভয় দেখালেই চলবে।কেউ যেন টের না পায়।আনার পর দ্রুত আমাকে ভিডিও কল দিবি।প্রয়োজনে আরো লোক লাগাবি।খরচ যা পড়বে আমি পাঠিয়ে দিবো।
ওপাশের ছেলেটি খুশি হলো যেন।উৎফুল্ল হয়ে বললো,

” ওকে ভাই।আপনি চিন্তা করবেন না।গুণতে থাকেন।মাত্র ত্রিশ মিনিট।”
নানা ভাবনা চিন্তা এই মুহুর্তে পরশকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।বিছানার উপর বসে ডান পা ক্রমাগত নাঁড়াতে নাঁড়াতে কল লিস্ট চেক করছে।নাহ!এখনো ফোন আসে নি সুমনের।চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট সে।ওর ভাই পরশের খুবই কাছের।সেদিন রাহুলের কথা শোনা মাত্রই ওকে কল করেছিলো।ছবি পাঠিয়ে খোঁজ নিতে বলেছিলো।কিন্তু মাঝখান থেকে নানা ঝামেলায় একপ্রকার ভুলেই গেছিলো এর কথা।
ভাবনার মধ্যভাগেই কল এলো ওপাশ থেকে।ভিডিও তে আবছা অন্ধকারে চেয়ারের সাথে বাঁধা রাহুলকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।উনিশ-বিশ বছরের ছেলের সাথে চব্বিশ-পঁচিশ বছরের ছেলের চেহারার পার্থক্য স্বাভাবিক ভাবেই থাকবে।চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ভয় এবং অবাক দুটো মিলিয়ে আছে।পরশ নাম ধরে ডাক দিলো।তাকালো রাহুল।সাথে সাথে সুমন এসে মোবাইলে একটা ছবি দেখালো।পরশ বললো,

“মেয়েটা কে?”
হতবাক হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো রাহুল।বললো,
“এটা তো স্পর্শী।”
রাগ লাগলো পরশের।আসন্ন প্রশ্নের উত্তর ঠিক কি হতে পারে ভাবতেই গা জ্বলে যাচ্ছে।আলতো চেঁচিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, আমি জানি এটা স্পর্শীয়া সরদার।কিন্তু তুই চিনিস কিভাবে?কি সম্পর্ক ওর সাথে?”
ছেলেটা সামান্য অসস্তিতে পড়লো।আমতা-আমতা করে বললো,
“ও আমার কলেজ ফ্রেন্ড ছিলো।আমরা একসাথেই পড়েছি।তাই চিনি।আর কি সম্পর্ক থাকবে?”
এই উত্তর পছন্দ হলো না পরশের। “ওর সাথে কতদিনের সম্পর্ক তোর?”
এবারে সুমন এসে একটা পিস্তল ঠেকালো কপালে।বললো,
“সোজাসাপটা ভাই’র প্রশ্নের উত্তর দে।”

ঘাবড়ে গেল রাহুল।এই গ্যাং ভার্সিটিতে তার সিনিয়র।ভীষণ ভয়ানক দল এরা।সে বরাবরই এসব ঝই-ঝামেলা এড়িয়ে চলে বিশেষ করে বিয়ের পর থেকে।শান্ত কন্ঠে আমতা আমতা করে বললো,
“দেখুন ভাই,স্পর্শীর সাথে গত তিন বছর ধরে আমার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই।আর ওর সাথে কোনো সম্পর্ক ও ছিলো না।ওই কলেজে থাকতে ওকে পছন্দ করতাম। কিন্তু ও ডেঞ্জারাস ছিলো ভীষণ।প্রপোজ করায় আমাকে ক্লাসরুমের সবার সামনে বসে মেরেছিলো।এরপর থেকে একটু ঝামেলা হয়।তারপর ফ্রেন্ডশিপ টাই নষ্ট হয়ে যায়।আমি জানিনা ও এখন কোথায় আছে।শুধু শুনছিলাম জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।আর কিচ্ছু না।বিশ্বাস করুন,আমি বিবাহিত।এই তো পনেরো দিন আগেই বিয়ে করছি।স্পর্শীর সাথে আমি সম্পর্ক রাখবো কেন?এই ছবিটাতো একটা অনুষ্ঠানের সময় তোলা।”

হতভম্ব হয়ে গেল পরশ।শান্ত কন্ঠে বললো,
“তুই যে বিয়ে করছিস তার প্রমাণ কি?”
“আমার ফোনে ছবি আছে আমাদের বিয়ের।হাত টা খুলে দিতে বলেন।দেখাচ্ছি আমি।”
খুলে দিলো বাঁধন।রাহুল সদ্য বিয়ের ছবি বের করে ল্যাপটপের সামনে ধরতেই ঠোঁট চওড়া করে নিঃশব্দে হাসলো।বললো,
“বাহ দারুন!আগে ভাগে বিয়ে করা ভালো বিষয়।ফরজ কাজ যত দ্রুত সম্ভব আদায় করা উচিত।হানিমুনে তো যাওয়া হয়নি নিশ্চয়ই।তোমাকে ট্রিট দেওয়া দরকার।কোথায় যেতে চাও বউ নিয়ে?”
“কোনো প্রয়োজন নেই ভাই। থ্যাংক ইউ।আমাকে ছেড়ে দিতে বলেন। আমার ওয়াইফ টেনশন করবে।”
মাথা নাড়ালো পরশ।এরপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতেই পায়ের বাঁধন খুলে দিলো একজন।

“এইই তোমাকে কি মেরেছে?
গালে হাত দিয়ে সুমনের দিকে তাকালো রাহুল।সুমন এখনো চোখ রাঙিয়ে না স্বরুপ উত্তর দেওয়ার জন্য বলছে।আলতো হেসে পরশের দিকে তাকিয়ে বললো,
” জ্বি না ভাই।
থেমে পুনরায় বললো,
“আপনি স্পর্শীর কি হন?”
চমকালো পরশ।আমতা-আমতা করে বললো,
“আমি ওর…..হাসবেন্ড হই।”
বিনয়ী হেসে ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।বিল্ডিং এর নিচে নেমে বুকে ফুঁ দিয়ে রাহুল বললো,
“দুজনেই ভয়ংকর।পার্ফেক্ট জুটি।এদের দুজনের মিলনে একজন বক্সার জন্ম নেওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।এটা নিতান্তই স্বাভাবিক।”

কল কেটে বিছানায় শুয়ে পড়লো পরশ।গা ছেড়ে দিয়েছে তার।অদ্ভুত এক প্রশান্তি পাওয়া যাচ্ছে।চোখ বন্ধ করে স্পর্শীর কথা ভাবতে লাগলো।একটা মেয়ে ঠিক কতটা বাটপার হলে ঠিক এভাবেই ঘোল খাওয়াতে পারে।একদম ছবিসহ প্রেমের দিন-তারিখ,বিয়ের দিন-তারিখ এমনকি কে কোথায় পড়ছে এসব সম্পুর্ণ ডিটেইলসে মিথ্যা বলেছে শুধুমাত্র নিজের জেদ কে বজায় রাখার জন্য।এতটা বোকা হয়েছে ভাবতেই গা জ্বলছে পরশের।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

“স্পর্শীয়া সরদার,তোমার জেদের শেষ অবধি দেখতে আমি প্রস্তুত।”
দরজায় ধুড়ুম করে ধাক্কার আওয়াজ এলো।কন্ঠে কাঠিন্যতা এনে ধমক দিয়ে পরশ বললো,
“ওখানে কে?”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৪৪

উৎফুল্ল প্রেমা যেন কথা বলতেই ভুলে গেছে।চিৎকার করে বললো,
“ভাইয়া,ছোট ভাইয়া আর ভাবি আসছে।তাড়াতাড়ি আসো।”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৪৬