রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৫৮

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৫৮
সিমরান মিমি

_”ভেতরে আসবো?”
চমকে পেছনে তাকালো স্পর্শী।দরজার সম্মুখে আর্শি দাঁড়িয়ে আছে।মুখ তার মলিন।গায়ের শাড়িটা চেঞ্জ করে নিয়েছে এসেই।এই মুহুর্তে সে গোল জামা পড়ে আছে।স্পর্শী কিঞ্চিৎ অবাক হলো।এরপর কোনোরুপ রিয়াক্ট না করে ফোনের দিকে নজর দিলো।শান্ত কন্ঠে বললো,
_”আয়।”

মলিন হাসলো আর্শি।ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো বিছানার দিকে।বোনের পাশে শান্ত হয়ে বসে রইলো কিছক্ষণ।স্পর্শী এখনো ফোনের দিকে তাকিয়ে।তার চোখ দুটো মোবাইলের স্ক্রিনে থাকলেও পুরো মনযোগ আর্শির দিকে।কান পেতে বসে রইলো ওভাবেই।আর্শি মলিন মুখে তাকিয়ে রইলো বোনের দিকে।লজ্জা করছে ভীষণ। আসার সময় উৎফুল্ল হয়ে আসলেও ঠিক সেভাবে মন খুলে কথা বলে নি কেউ।পিপাসা নিজেও টেনশনে ছিলো পুরোটা সময়।স্বামীকে নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই তার।কখন কি না বলে বসে।ফোন রাখলো স্পর্শী।আধশোয়া থেকে উঠে বসলো।পুরো পুরি দৃষ্টি ফেললো আর্শির দিকে।সে এখনো নির্জীব।কেমন থমথমে মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।কতক্ষণ পর পর আবার আড়চোখে তাকাচ্ছে বোনের দিকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

_”কিছু বলবি?”
চমকে তাকালো আর্শি।মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে সায় দিলো।কম্পনরত কন্ঠে বললো,
_”হুম।”
স্পর্শী স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো।আর্শির চোখমুখ শুকনো।পুরো মুখশ্রী জুড়ে ভয়,লজ্জা আর অসস্তির ছড়াছড়ি।মেয়েটা অসুস্থ,তার উপর সবার এই অবজ্ঞা নিতে নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে।সুস্থ-সবল থাকার পরিবর্তে এতে আরো গম্ভীর হয়ে যাবে।গুমরে মরবে একা একা।ডান হাত বাড়িয়ে আলতো হেসে আর্শির হাত ছুঁলো।বললো,
_”কিছু বলবি সোনা?”

থমকে গেল মেয়েটা।এই এতোক্ষণ যে কান্নাটাকে চাপিয়ে রেখে গম্ভীর হয়ে ছিলো সেটা ক্রমশই বরফশীতল হওয়ার পরিবর্তে বোনের আলতো উষ্ণতায় গলতে শুরু করলো।অশ্রুগুলো জমাট বাঁধার পরিবর্তে প্রবল গতিতে হাজির হলো চোখের কার্নিশে।হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো বোনের গায়ে।ঝাপটে ধরে কাঁদতে লাগলো অনবরত।নাক টেনে বললো,

_”তোমরা কেউ আমার সাথে কথা বলো না কেন?আমি কি এতটাই খারাপ।আব্বু তো আমার দিকে চেয়েও দেখে না।তুমি কথা বলো না।কেউই আমাকে দেখে একটু হাসে না।আগের মতো কথা বলে না।মেঝো কাকির পাশে গিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম কথা বললো না।চুপচাপ রুটি বানাচ্ছিলো।আব্বুর রুমের সামনে গেলাম।আমাকে দেখেই দরজা বন্ধ করে দিলো।আমি কি খুব বেশিই খারাপ কাজ করে ফেলেছি?এতটাই খারাপ যে আমার দিকে তাকাতেও সবার এতো সমস্যা।আমার খুব কষ্ট হয় আপু।আমার ভালো লাগে না।মাঝেমধ্যে মনে হতো তোমাদের কাছে চলে আসি।আবার ভয় লাগে,তোমরা কেউই তো আমাকে মেনে নিবে না।তখন আমি কোথায় যাবো?ও বাড়িতে যাওয়ার পর কতদিন একা একা কান্না করেছি।ইচ্ছে হতো এক্ষুনি চলে আসবো বাড়িতে। কিন্তু পারতাম না।সাহস হয়নি কখনো।”

মনের মধ্যে থাকা যাবতীয় কথাগুলোকে উগ্রে দিতে লাগলো বোনের কাছে।স্পর্শী শুনতে লাগলো।এক হাত দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে অন্য হাত দিয়ে ঘুম পাড়ানোর মতো পিঠে থাপড় দিতে লাগলো।একপর্যায়ে আর্শি থামলে স্পর্শী বোঝানোর স্বরে বললো,
_”এ বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য তোকে ভালোবাসে।কিন্তু হুট করে যে কাজ টা করেছিস ওটা খুবই আঘাত করেছে সবাইকে।তার উপর ঘটনাগুলো শিকদার বাড়ির সাথে জড়িত।এই কারনেই এতোটা রিয়াক্ট করেছে।”
আর্শি মন দিয়ে শুনলো। বোনের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়।উদাস হয়ে বললো,

_”আমাদের পরিবার টা তো রাজনীতির বাইরেও হতে পারতো,তাইনা আপু?এই দেখো আজ যদি আব্বু রাজনীতি না করতো তাহলে পাভেল ভাইদের সাথে এতো বিরোধিতা থাকতো না।হয়তো এই কারনেও আব্বু আমার সম্পর্ক টা মানতে এতোটা পিছপা হচ্ছে।আজ যদি দু পরিবারের মধ্যে ঝামেলা না হতো তাহলে আমরা দুজন কত শান্তিতে আজ সংসার করতাম।”
কপাল কুঁচকে ফেললো স্পর্শী।কিছু না বোঝার ভান ধরে বললো,
_”দুজন মানে?”
মুখ চেপে হাসলো আর্শি।বিরবির করে বললো,

_”এহহহ!আমি জানি তুমি আর পরশ ভাইয়া রিলেশনে আছো।তোমরা তো কক্সবাজার ঘুরতেও গেছিলা।আমি ছবি দেখেছি তোমাদের।”
গাল টেনে ধরলো স্পর্শী।বললো,”এতো বেশি বুঝতে তোমাকে কে বলেছে?কোনো সম্পর্ক নেই আমাদের মধ্যে।আর কক্সবাজার তোদেরকে খুঁজতেই আমরা গেছিলাম।বুঝেছিস?”

_”এহহহ!আমি কিছু বুঝি না ভেবেছো?আমাকে খুঁজতে যাওয়া তো অজুহাত ছিলো।খুঁজতে গেলে কেউ একসাথে যায়,একই রিসোর্টে থাকে?কি সুন্দর সমুদ্রের পাড়ে হাঁটছিলে, ভাইয়া তোমার জুতো হাতে হাঁটছিলো।আহাহা!দারূণ সিন ছিলো।শোনো আপু,একদম আমার থেকে কোনোকিছু লুকাতে চাইবে না।ভুলে যেও না তুমি যার সাথে প্রেম করছো, সে আমার ভাসুর হয়।যাইইই হোক না কেন সব কথা আগে আমার কানে আসে।”
বাকহারা হয়ে গেল স্পর্শী।কান টেনে ধরলো মুহুর্তেই।বললো,
_”ইশশশ!নতুন নতুন বউ হয়েছেন উনি।কত্ত বাহাদুরি।এই সর তো এখান থেকে।”
_”তাও তো তোমার আগে বউ হয়েছি।বাহাদুরি তো থাকবেই।
_”এইই এইই তোর লজ্জা করছে না এসব বলতে?নির্লজ্জ মেয়ে,লাফিয়ে লাফিয়ে বিয়ে করছে আবার গর্ব করে বলে।”
শোয়া থেকে উঠে বসলো আর্শি।কৌতূহল নিয়ে বললো,

_”তুমি একবার মাথা ঠান্ডা করে ভেবে দেখো,লাফিয়ে লাফিয়ে বিয়ে করে কি আমি আদৌ ভুল করেছি নাকি তুমি শান্ত থেকে গুমরে গুমরে ক্রমশ জীবনটাকে যন্ত্রণা দিচ্ছো।”
চুপ হয়ে গেল স্পর্শী।কতক্ষণ থম মেরে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।চোখ দুটো বন্ধ করে ভাবতে লাগলো পরশের কথা।একটা রাগী পুরুষ কিভাবে দিনের পর দিন তার সামনে নিজেকে অসহায় করে দেখিয়েছে।কিভাবে একটা শক্ত খোলসের মধ্য থেকে বের হয়ে শুধুমাত্র তার সান্নিধ্যে আসার জন্য নিজেকে ভেঙেচুরে বারংবার রুপ নিয়েছে স্নিগ্ধতায়।সেও তো কম যন্ত্রণা ভোগ করেনি।নিজেকে অকপটে লুকিয়ে রেখেছে প্রেমিক পুরুষের থেকে।অনুভূতি গুলোকে প্রতিনিয়ত জাতা কলে পিষেছে পাষাণ হয়ে।ফিরিয়ে দিয়েছে অপমানের সহিত।বুক ফুলিয়ে লম্বা শ্বাস নিলো।ভালো লাগছে না।কথা এড়াতে শান্ত কন্ঠে বললো,

_”তখন যে বললি ও বাড়িতে বসে প্রায়ই কান্না করতিস।কেন?তোর শশুর-শাশুড়ী কেমন?আর ননদের সাথে কি রকমের সম্পর্ক?তাছাড়া তোর ভাসুর কি মেনে নিয়েছে?তাদের আচার-ব্যবহার কেমন তোর প্রতি?”
উৎফুল্ল হয়ে বসলো আর্শি।বললো,
_”সবাই অসম্ভব ভালো।আমার ননদ তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের মতো।আর শাশুড়িও অনেক ভালোবাসে।সমস্যা হলো আমার শশুর।উনি হ্যা ও বলেন না, না ও বলেন না।কিন্তু তাতেও কোনো সমস্যা নাই।সবাই অসম্ভব ভালোবাসে।শুধু মাত্র মাঝে মাঝে যখন সোভাম ভাই,তুমি,আব্বুকে নিয়ে ওরা বাজে কথা বলে, হাসাহাসি করে ওটা খারাপ লাগে।সেদিনকে অনেক ঝগড়াও করছি এগুলো নিয়া।”
চমকালো স্পর্শী।ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,

_”বাজে কথা বলে মানে?কি ধরণের কথা?”
_”আরে তেমন কিছু না।ওই মাঝেমধ্যে বলে আমার বাপ ডাকাত,আমার গোষ্ঠী ডাকাতের গোষ্ঠী,আবার বলে সোভাম সরদার ভালো না।সে অযোগ্য,তোমাকে বলে তুমি ঝগড়ুটে,তোমার বিয়ে হবে না। এরকম কথা।আর তুমি জানো তোমার সম্পর্কে পরশ ভাইয়াও অনেক মজা করে, হাসাহাসি করে।বলে,” তোমার বোন ডাকাতদের সর্দারনী,ডাকাত ছাড়া ওর বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনাই নেই।”
_”ওহহহ,আচ্ছা।আর কি বলে তোর পরশ ভাই?”
বোনের হুট করে এমন সন্দেহ জনক শান্ত প্রশ্নে কিছুটা ঘাবড়ে গেল আর্শি।এসব বলা কি তার উচিত হয়েছে?যদি এটা নিয়ে আপু আমার সমস্যা বাঁধায়?তখন?”মুখে বললো,
_”নাহ!আর তেমন কিচ্ছু বলে না।”

রাতের মধ্যভাগ।ঘড়ির কাঁটায় তখন মাত্র বারোটা। দূর থেকে দূর দুরান্ত পর্যন্ত নিস্তব্ধতা। শুধুমাত্র নিশাচর প্রাণীগুলো নিজেদের আওয়াজ তুলছে কিছুক্ষণ পর পর।ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই চমকালো পরশ।এই মাঝরাতে কারো ফোন আসার কথা না। টেবিল থেকে উঠে বিছানার কাছে গেল।ফোন টা হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল।স্পর্শীর ফোন।ভাবতেই এক অদ্ভুত প্রশান্তি বয়ে গেলো।নিজে থেকে স্পর্শী যে ফোন দিবে এটা কল্পনাতীত ছিলো তার।রিসিভড করে কানে তুলতেই মিষ্টি এক কন্ঠ ভেসে আসলো।
_”স্পর্শীয়া সরদার হচ্ছে ডাকাত সর্দারনী।তার বাপ-চাচা সর্দারগোছের মানুষ।তাদের গোষ্ঠী হচ্ছে ডাকাতদের।মেয়েটা খুবই ঝগড়াটে।একে তো ডাকাত ছাড়া কেউ বিয়েই করবে না।আদৌ বিয়ে হবে কি না সেটাই তো সন্দেহের বিষয়।তাই না?”

চমকালো পরশ।মুহুর্তেই মনে হলো বাক্যগুলো তার খুবই পরিচিত।আর এই কথাগুলো সেই বলেছিলো কোনো এক সময়।আর সেটাও আর্শি এবং পাভেলের উপস্থিতিতে। ঠোঁট এলিয়ে হাসলো পরশ।নিশ্চয়ই আর্শি বলে দিয়েছে।বললো,
_”ছিহঃ!সোনাপাখি। এসব উদ্ভট অযৌক্তিক কথাবার্তা কে বলেছে?আর এগুলো তুমি কানে নেও ই বা কেন?”
_”ওহহো,হ্যাঁ, এই অযৌক্তিক কথাগুলোই পরশ শিকদার বলেছে।ভাবতে পারছেন একজন এমপি কতটা মাথামোটা হলে এগুলো বলে।

_হ্যাঁ, সেটাই ভাবছি।মাথামোটা না হলে কি আর তার পেটপাতলা বোনের সামনেই কথাগুলো বলে?
_এইই একদম চুপ।কি ভেবেছেন?ও আমার বোন।ওর সামনেই আমার দুর্নাম করবেন আর আমাকে কিছু জানাবে না?তবে বলে ভালোই করেছেন।আমি খুব শীঘ্রই ডাকাত খুঁজতে বের হবো।বিয়ে করার জন্য।”
হাসলো পরশ।ফোন টাকে এপাশ থেকে ঘুরিয়ে অন্যকানে নিলো।বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো।সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বললো,
_”এই অভাগা ডাকাত হতেও রাজী।তারপরেও আপনাকে চায়।”
ভেংচি কাঁটলো স্পর্শী।পরশের অগোচরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
_”সেটা জীবনেও হবে না।না কখনো আপনি আমার ফ্যামিলিকে রাজী করতে পারবেন, আর না তো বিয়ে।শুধু শুধু ফোনেই বড় বড় কথা।”
পরশ চুপ হয়ে শুনলো।এরপর বললো,

_”আগামীকাল আসছি।তৈরি থেকো।”
বাকহারা হয়ে গেলো স্পর্শী।অবাকের সুরে বললো,
_”কাল মানে?এই না না।মাত্র আর্শি বাড়িতে এলো।সপ্তাহ খানেক এখানে থাকুক।পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক,এরপ আসেন।এখন আসলে আরো ঝামেল বাঁধবে।”
মানলো না পরশ।খামখেয়ালি করে বললো,
_”আর এক মুহুর্ত ও নয়।অনেক অপেক্ষা করেছি।যা হওয়ার হোক।কিন্তু আমি আর দেরি করছি না।আমি জানি তোমার বাবা রাজী হবে না।কিন্তু তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।
থেমে,

বাই দা ওয়ে,আমি যদি তোমায় তুলে নিয়ে যাই আর জোর করে বিয়ে করি।তাহলে কি তুমি খুব বেশি রাগ করবা?”
কপাল কুঁচকে আশ্চর্যের ন্যায় কিছুক্ষণ থমকে গেল। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো পরশের উদ্দেশ্যে। বললো,
_আপনি?আপনি আমায় তুলে নিয়ে যাবেন?আমাকে জোর করে ভয় দেখিয়ে বিয়ে করবেন?বাব্বাহ!আমি খুব বেশিই ভয় পেয়ে গেছি এমপিসাহেব।বিশ্বাস করুন, আমার হাত পা কাঁপছে।”
কথাগুলো শুনে শব্দ করে হাসলো পরশ।বললো,
_”মেয়ে তুমি নিজেকে খুব বেশি চালাক মনে করো না।স্পর্শীয়া সরদার,তুমি পরশ শিকদার কে চেনো না,জানোও না।আমি মানুষ টা ভীষণ স্বার্থপর।যে জিনিসটা আমার পছন্দের ওটা আমি নিজের করে নিতে জানি।সেটা যেকোনো মূল্যে।”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৫৭

চুপ করে রইলো স্পর্শী।হুট করেই কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি গ্রাস করলো তাকে।মুখে বললো,
_”আপনার কন্ঠটা,বলার ভঙ্গিটা হুট করেই ভীষণ অচেনা ঠেকলো আমার কাছে।এমনটা কেন হলো বলতে পারেন।”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৫৯