রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৮
সিমরান মিমি
রাত তখন এগারোটা।সদ্য ছেলের সাথে আলাপ আলোচনা সেরে রুমে এসেছেন শামসুল।চোখ তার নিদ্রা আকাঙ্ক্ষায় ঢুলুমুলু করছে।ক্লান্ত শরীর টাকে বিছানায় টেনে শুয়ে পড়লেন সেখানেই।আজকাল পিপাসা আর্শির সাথে ঘুমায়।মেয়েটার মাঝরাতে ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠে।কখন কি-না লাগে ভেবে পিপাসা আর কাছ ছাড়া করেনি মেয়েকে। শামসুল ঘাড় ঘুরিয়ে কাঁত হয়ে শুলেন।চোখ দুটো বন্ধ করে নিলেন তন্দ্রার ঘোরে।কিন্তু ঘুম আর দিতে পারলেন না।এরমধ্যেই কর্কশ শব্দে বেজে উঠলো ফোনের রিংটোন।বালিশের পাশ থেকে বিরক্তি নিয়ে ফোনটাকে হাতে নিলো।কিন্তু নাম্বার যে অচেনা।
এতো রাতে অচেনা নাম্বার থেকে কে ফোন দিয়েছে তাকে?মস্তিষ্কে প্রশ্ন আসলেও তার উত্তর খুঁজে পেলেন না।একবার ভাবলেন ফোন ধরবেন না।পরক্ষণেই মনে হলো কোনো জরুরি ফোন হতে পারে।ভাবনা চিন্তার মধ্যভাগেই রিসিভড করলেন ফোন।সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো বিনয়ী সালাম।কন্ঠ টা ভীষণ চাপা।মনে হচ্ছে কারোর থেকে লুকিয়ে খুব-ই সন্তোর্পণে তাকে কথাগুলো বলতে চাইছে।শামসুল সালামের জবাব দিলেন।পরিচয় জানতে চাইলেই ওপাশের পুরুষ কন্ঠটি কাতর কন্ঠে মিনতি করলেন।শোনা গেল তার কাঁপা কন্ঠস্বর।বললেন,_”চাচা,আমি আপনেরে পরিচয় দিয়াই কথা কইতাছি।কাপুরুষ না আমি যে পরিচয় লুকামু।চাচা,আমি সুজন।সুজন মির্জা।চিনছেন?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
নামটা শুনতেই ভ্রু-যুগল কুঁচকে গেলো শামসুলের।কপালের মাঝখানে দুই-তিনটা ভাঁজ পরে গেল।অবিশ্বাসের সুরে বললো,_”তুই?আমার কাছে কেন ফোন দিয়েছিস?”
_”এইডা কি কইলেন চাচা?আমি আপনেরে ফোন দিমু না তো ওই পরশ শিকদার দেবে?
সাবধান হলেন শামসুল।কটাক্ষ করে বললেন,_”হুট করে এভাবে উলটো গান গাইছিস কেন?কি হয়েছে?”
ফোনের অপর প্রান্তে থাকা সুজন নিঃশ্বব্দে হাসলো।বিশ্রী রকমের সেই হাসি রুমের ওপাশ থেকে দেখছে রাকিব।গায়ের মধ্যে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ ফুঁটছে।সুজন আবার কন্ঠকে আহত করলো।করুন কন্ঠে বললো,_”চাচা,দেখেন আমরা এক-ই প্লার্টফর্মের।সবাই-ই রাজনীতি করি।
হয়তো রাজনীতি, দলের কারনে অনেক বিরোধিতা করছি আমরা।মারামারি , কোঁপাকুপি অনেক করা হইছে। কিন্তু তাই বইলা কিন্তু আমি আপনার পরিবারের কারো ক্ষতি চাই না।আপনাদের সাতগে যত দৌড় ওইডা হইবে ভোটকেন্দ্রে,কিন্তু সেইখানে যদি ব্যক্তিগত ভাবে আপনেরে দূর্বল করার চেষ্টা করে তাইলে আমি হেই খেলায় নাই, চাচা।আপনি সাবধান হোন,অনেক বড় ভুল করতেছেন।পরশ শিকদার রে আপনে চেনেন না।আমি চিনি।এতো বছর একদম কাছ থেইকা দেখছি।আমি জানি ও নিজের স্বার্থের জন্য কত কিছু করতে পারে।চাচা,মেয়েটারে ওর সাথে বিয়া দিয়েন না।অনেক পস্তাইবেন।ও অনেক বড় চাল চালতেছে।এখন আপনি হয়তো কইবেন,আপনের ছোট মাইয়া ও তো ওই বাড়িতে।তাহলে তো ওরে দিয়াও চাল চালতে পারে। কিন্তু আপনি এইডা বিশ্বাস করেন পাভেল ওর বউরে অনেক বেশি যত্ন করে।এই পাভেলের কারনে আপনার ছোট মেয়েটার ধারে আছে পরশ যাইতে পারতেছে না।এইজন্য পরবর্তী শিকার আপনার বড় মেয়ে।যে কিনা ওর খাঁচায়-ই থাকবে।আপনে কি বুঝতে পারতেছেন আমি কি বলতাছি?”
শামসুল সরদার বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলেন।আদৌ কথাগুলো বিশ্বাস যোগ্য কি- না বুঝতে পারলেন না। শামসুল সরদারের নিরবতা বুঝতে পেরে সুজন কিছুটা নড়েচড়ে বসলো।এরপর পুণরায় নিজেকে সাজিয়ে বললো,_”পরশ শিকদারের উদ্দেশ্য হইছে আপনেরে রাজনীতির মাঠ থেইকা পুরাপুরি সরাইয়া দেওয়া।বলতে গেলে একপ্রকার পঙ্গু কইরা দেওয়া।যাতে আর ঘুইরা না দাঁড়াইতে না পারেন।
থেমে আবারো বললেন,_”সে যাই হোক,আমি আপনেরে সাহায্য করলাম।বাকিটা আপনার মর্জি।বিশ্বাস -অবিশ্বাস সম্পুর্ন আপনার মধ্যে। তবে সাবধানে থাকবেন।রাখি।আল্লাহ হাফেজ!”
ফোন কেটে গেল।তবে কাটলো না শামসুল সরদারের ঘোর। তিনি থম মেরে বসে রইলেন বিছানায়।নিদ্রারা সেই কখন পালিয়েছে।ক্লান্তির ছিটেফোঁটা ও আর নেই।হঠাৎ -ই মেয়ের অমঙ্গলের চিন্তায় বিষিয়ে উঠলো মন।কি করছেন তিনি?সুজনের কথা তো ফেলে দেওয়ার মতো-ও নয়।সত্যিই তো বিয়ে হতে না হতেই তিনি রাজনীতি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।সেক্ষেত্রে বিয়ের পর তো একদম শূণ্য হয়ে যাবেন।পরবর্তীতে মেয়েকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে তখন কি করবেন?উফফ!আর ভাবতে পারলেন না।এই মুহুর্তে ছেলের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করা উচিত।ভাবতেই জোড়পায়ে উঠে দাঁড়ালেন।দ্রুতগতিতে হেঁটে গেলেন সোভামের রুমের সামনে।
দরজায় দুটো টোকা মারতেই ত্রস্ত হাতে দরজা খুললো সোভাম।বাবাকে দেখতেই অবাক হলো।বললো,_”এতো রাতে তুমি?কি হয়েছে?কিছু কি বলবে?”
মাথা নাড়ালেন শামসুল।রুমে প্রবেশ করে সকল বৃত্তান্ত খুলে বলতেই চমকালো সোভাম।প্রথমেই বাবার হাত থেকে ফোন টা নিলো।নাম্বার- টা দেখতে দেখতে বললো,_”তুমি কি নিশ্চিত এটা সুজন-ই ছিলো?অন্যকেউ ও তো ওর নাম ধরে কথা বলতে পারে।”
দুপাশে মাথা নাড়লেন শামসুল।বললেন,_”হ্যাঁ! এটা সুজন-ই।এ ব্যাপারে তো আমি নিশ্চিত।কিন্তু ওর গলা খুব কাঁপছিলো।মনে হচ্ছে ভয় পেয়ে আছে।”
সোভাম বাবার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো।তার চোখে-মুখে লেপ্টে আছে বিস্তর সন্দেহ।কিছুক্ষণ ভেবে বাবার উদ্দেশ্যে বললো,_”আব্বু,আমার মনে হচ্ছে না পরশ শিকদার এমন কিছু করার জন্য স্পর্শীয়াকে বিয়ে করছে।ও তো ক্ষমতা-ই আছে।তারপরেও কি দরকার এসবের?যদি ক্ষমতায় না থাকতো সেক্ষেত্রেও কথাটা বিশ্বাস করা যেত।কিন্তু এখন এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।এমন টা করলে উলটো ওর-ই ক্ষতি হবে।তবে আমি ভেবে পাচ্ছি না সুজন এমনটা কেন করলো।ওতো পরশের খাস লোক।হুট করেই এমন উলটো গান কেন গাইছে।আর যদি পরশ এরকম পরিকল্পনা করেও থাকে তাহলে সেটা সুজন-ই বা কেন আমাদের জানাতে যাবে।ওর সাথে তো পরশের সম্পর্ক ও খারাপ না।এমনকি ধর্ষণ মামলা থেকে ওদেরকে বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।জনগণের কাছে ও এটা পরিস্কার যে পরশ শিকদার তার দলীয় ছেলে-পেলে বাঁচাতে পুরো থানা থেকে শুরু করে কমিশনার কেও কিনে নিয়েছে।তুমিই ভাবো,যেখানে ওর জন্য এতোকিছু করছে সেখানে ওই কেন পরশের বিরুদ্ধে কথা বলবে?”
অত্যন্ত মনযোগের সহিত কথাগুলো শুনলো শামসুল। চিন্তিত কন্ঠে বললো,_”আমিও সেটাই ভাবছি।এমন-টা কেন হতে যাবে?”
পরক্ষণেই সোভাম বললো,_”হতেও পারে জনগণের চাপ সহ্য না করতে পেরে পরশ সুজন আর ওর দলের বাকি ছেলেদের গ্রেফতার করতে বলেছে।যার কারনে শত্রুতা বাড়িয়ে দিচ্ছে তোমার মধ্যে।আবার এ-ও হতে পারে যে সুজন কোনো কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছে আমাদের।
থেমে,আসলে আব্বু আমি ব্যাপার’টা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।এসব রাজনৈতিক প্যাঁচগোছ বোঝা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।এখানে নতুন নতুন রুপ সৃষ্টি হয়।আজ এই পক্ষ তো কাল ওই পক্ষ।তবে আমি তোমাকে একটু সাবধান করতে পারি।”
_”কোন বিষয়ে?”
অসস্তিতে পড়লো সোভাম।এমনিতেও সে এসব বিষয়ে কথা বলতে অনাগ্রহী।তাও বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
_দেখো,স্পর্শীয়া আর পরশের বিয়ে ধরতে গেলে অর্ধেক শেষ। যাবতীয় গোছগাছ সব-ই করা আছে।সহস্র অতিথি আপ্যায়ন করা ইতোমধ্যে।হুট করেই বাইরের কারো কথা শুনে বিয়ে বন্ধ করে দেওয়া বোকামি হবে।এরা পা-চাঁটা লোক।নিত্যনতুন রঙ পালটায়।তবে এটা বলেছি বলে যে আমি ওদের বিয়েটা দিতে বলছি সেটাও না।আমার মতে তোমার সময় নেওয়া প্রয়োজন।ওরা তো পালিয়ে যাচ্ছে না।আর স্পর্শীয়া ও কোনো বোঝা না যে বিয়ে দিতে পারলেই বেঁচে যাবে।তুমি সময় নাও আরো।সবাই কে দেখো,সবটা বোঝো,সচেতন হও।এরপর বিয়ে দাও।আমি আসলে আর যা-ই পারি,কিন্তু রাজনীতিবিদ দের গ্যারান্টি দিতে পারবো না।এদের চেনা যায় না।”
সবটা মনযোগ দিয়ে শুনে মনস্থির করলেন শামসুল।সাথে সাথে-ই ফোন দিলেন ও বাড়িতে।আলতাফ শিকদার রিসিভড করলেন।হাস্যরস করে সালাম দিলেন বেহাই কে।কিন্তু সেটাকে গ্রহণ করলেন না শামসুল।বরং রোবটের মতো সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,
_”আপনার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।বুঝতে পারছি না কথাটা কি এসে বলবো নাকি ফোনেই।”
আমজাদ শিকদার অবাক হলেন।সাথে চিন্তিত-ও।বললেন,_”কি হয়েছে?স্পর্শীয়া মা কি বেশি অসুস্থ?”
_”নাহ!আসলে ফোনে-ই বলি।হয়তো যাওয়ার সময় হবে না।আসলে আমি বিয়েটা পেছাতে চাইছি।আমাদের ফ্যামিলিতে একটু প্রবলেম হয়েছে।আমার বোন বিয়েতে অনুপস্থিত থাকলে বিষয়টা খারাপ দেখাবে।ও এখানে নেই।কিছুদিন আগে কাশ্মীর গিয়েছে।ভাবছি শান্তি এলেই বিয়েটা হবে।এতে কি তোমাদের কোনো আপত্তি আছে?”
বিচক্ষণতার দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলেন আমজাদ।নিজেকে ধরা দিলেন না কভু।শামসুল সরদারের সাথে তাল মিলিয়ে বললেন,_”আরে নাহ!আপত্তি কেন থাকবে?তবে তোমার বোন কবে আসবে?”
শামসুল সরদার ভাবলেন।বললেন,_”ওর আসতে দেরি হবে।এক বা দেড় মাস লাগতে পারে।তবে ওকে বলবো যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে।”
এবারে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না আমজাদ।চিৎকার করে উঠলেন।বললেন,_”এটা কোনো কথা হলো?আরো দুদিন আগে হয়ে যাওয়া বিয়ে নিয়ে এতো পেঁচাচ্ছো কেন?এই সমস্যা তো ওই সমস্যা।তাহলে বিয়ের ডেট ফিক্সড করেছিলে কেন?বাড়ির ডেকোরেশনের কাজ ক-দিন ঝুলিয়ে রাখবো?মেয়ে নিয়ে কি গেম শুরু করেছো নাকি?”
নিজেকে দমাতে পারলেন না শামসুল।তিনি নিজেও চিৎকার করে উঠলেন।বললেন,_”গেম তো তোমার ছেলে শুরু করেছে।তাকে জিজ্ঞেস করো উদ্দেশ্য টা কি?শামসুল সরদারের মেয়ে নিয়ে ছলনা করলে কল্লা দুভাগ করে ফেলবো।”
বলে আর অপেক্ষা করলেন না।কেটে দিলেন ফোন।সোভামের উদ্দেশ্যে বললো,_”দেখেছিস?ওদের মনে ময়লা।না হলে বিয়ে পেছানোর খবর শুনে এভাবে ক্ষেপে যেতো না।ওরা পারলে ধরে-বেঁধে দিনের মধ্যে বিয়ে করতে চায়।”
সোভাম বিরক্ত চোখে বাবার দিকে তাকালো।বললো,_”ওদের ক্ষেপে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না আব্বু।তুমি আর তোমার মেয়ে যেভাবে পল্টি খাচ্ছো এতে তো ক্ষেপবেই।”
থেমে আবারো বললো,_”এভাবে ফোনে না বলে সকালে ওদের বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে বললেই তো হতো।”
পাত্তা দিলেন না শামসুল।গটগট পায়ে চলে গেলেন রুমের ভেতর।কত বড় সাহস!তার মেয়েকে গুটি বানিয়ে দাবা খেলায় মেতে উঠেছে।
রৌদ্র প্রজ্জ্বলিত সকাল।শীত আসার পূর্বের এই আবহাওয়া টা বড্ড মিশ্র।হুটহাট মাঘ মাসের ন্যায় শীত, আবার বসন্তের মতো বাতাস,কখনো আবার গ্রীষ্মের মতো গরম।আজকের সকাল টা যেন বসন্তের রুপ।যেমন শীতের আবছা আমেজ ঠিক তেমনি ভাপসা গরম।সব মিলিয়ে চমৎকার এক আবহাওয়া।ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটা-কে ছাড়িয়ে যাবে প্রায়।স্পর্শী বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে আছে।রুমের এই পাশ টা আরো চমৎকার।সূর্যমুখী ফুলের বাগান টা স্পষ্ট দেখা যায়।চারপাশ টা শক্ত ইটের দেয়ালে বাঁধানো।তার পাশেই ঘুরিয়ে রোপান করা আছে আম গাছ, সুপারি গাছ,জাম্বুরা এবং পেয়ারা গাছ।
সেই সারি পেরিয়ে গন্ডির একদম ভেতর টাতে বিভিন্ন ফুল গাছের বাগান।স্পর্শীর এদিক টায় ফুল হিসেবে রয়েছে সূর্যমুখী এবং সন্ধ্যামালতী।গাছ গুলোকে হেলিয়ে দুলিয়ে আসছে ঠান্ড বাতাস, তার উপর বিদ্যমান মিষ্টি রোদ যেন মন টাকে নিমিষেই সতেজতা দিয়ে দেয়।প্রকৃতি উপভোগ্য সময়েই আসে ফোন কল।ঘাড় ঘুরিয়ে রুমের দিকে তাকালো।তার ফোন বাজছে।নিরলস ভঙ্গিতে বেলকুনি ছেড়ে রুমের দিকে গেল।ফোনের স্ক্রিন দেখতেই চমকালো।এমপি ফোন দিয়েছে।কিন্তু কেন?কাল রাতেই তো রেগেমেগে ফোন বন্ধ করে দিয়েছিলো।তাহলে হুট করেই আবার এখন কেন?তাহলে তার রাগের সীমাবদ্ধতা এতটুকুই?ভাবতেই ঠোঁট এলিয়ে হেসে দিলো।রিসিভড করে সতেজতা মাখানো কন্ঠে বললো,_”বলুন!”
পরশ কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই বললো,_”কেএফসি তে আসো।দ্রুত!আমি অপেক্ষা করছি।”
স্পর্শী আর কিচ্ছু বললো না।সম্মতি জানিয়ে রেখে দিলো ফোন।রাতের সব প্রশ্ন এখন জানা যাবে।সরাসরি জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয়ই এড়িয়ে যেতে পারবে না।
দুপাশে ঘন জঙ্গল।মাঝখান থেকে চলে গেছে পিচ ঢালাই দেওয়া রাস্তা।সদর থেকে কিছুটা দুরে-ই রাস্তাটা অবস্থিত।দিনের বেলায়-ও গা ছিমছিমে পরিবেশ।নিস্তব্ধতা যেন এই রাস্তাটিকে ঘিরে রেখেছে অবিরাম ভাবে।গাড়ি টা ড্রাইভ করছে সোভাম।হুট করেই চোখ গেল দর্পনের দিকে।মুহুর্ত কয়েক ঝলক দেখতে পেল স্কুল ড্রেস পড়ুয়া মেয়েটাকে।সাথে সাথে-ই গাড়ি থামিয়ে দিলো।জানালা খুলে উঁকি দিলো পেছনে।মেয়েটির পিঠ অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছে।সে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে ঘন জঙ্গলের দিকে।কিছুক্ষণ পর পর তাকাচ্ছে চারি পাশে।এইসব মেয়েদের জন্য আজকাল এলাকা গুলো রসাতলে গিয়েছে।
ইচ্ছে করে বয়ফ্রেন্ড দের সাথে দেখা করতে আসবে চিপা গলিতে, নিস্তব্ধ জঙ্গলে।অথচ একা পেয়ে উল্টাপাল্টা কিছু হলেই দোষ হয় শাসক দের।তারা রক্ষা করতে পারেনি জনগণকে।মেয়েটা হুট করেই দাঁড়িয়ে পড়লো।ভয়কাতুরে চোখ নিয়ে তাকালো পেছনে।মুহুর্তেই থমকে গেল সোভাম।মুখ দেখেছে সে মেয়েটার।এটা প্রেমা।হ্যাঁ, এটা পরশ শিকদারের বোন।কিন্তু সে এই ঘন জঙ্গলে কি করছে?ভাবতেই মনে পড়লো চিঠির কথা।ভরা জনসম্মুখে প্রেমপত্র দেওয়ার সাহস যে মেয়ের আছে সে যে একাকী বয়ফ্রেন্ডের সাথে জঙ্গলে আসতে পারবে না সেটার কি নিশ্চয়তা।ঘৃনায় গা ঘিন ঘিন করে এলো সোভামের।পুণরায় গাড়ি স্টার্ট দিতে গিয়েও থেমে গেল।ওর মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে ভয় পেয়ে আছে।কিন্তু কেন?তড়িৎ গতিতে গাড়ি থেকে নেমে গেল সোভাম।ধীর পায়ে পিছু নিতে লাগলো।ইতোমধ্যে জঙ্গলের প্রায় মাঝামাঝি চলে এসেছে। প্রেমা এখনো হাঁটছে।চারদিকে তাকাচ্ছে আর থেমে থেমে হাঁটছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কাউকে খুঁজছে।আর সামনে গেলো না সোভাম।বরঞ্চ সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো।বুকে হাত বেঁধে গম্ভীর কন্ঠে বললো, _”কাকে খুঁজছো?”
চমকে গেলো প্রেমা।থমকে দাঁড়িয়ে গেলো।পিছু ফিরে সোভামকে দেখতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো।ভয়ের তোড়ে কাঁপা-কাঁপি লাগিয়ে দিলো।বললো,_”কাউকে না।”
বলেই সোজা রাস্তার দিকে হাঁটতে লাগলো দ্রুতপায়ে।খপ করে হাত ধরলো সোভাম।টেনে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে এক ভ্রুঁ উঁচিয়ে বললো,_”বয়ফ্রেন্ড কে খুঁজছো?”
অন্য যেকোনো সময় হলে প্রেমা হয়তো পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতো।কিন্তু এই মুহুর্তে সেটা সম্ভব না।চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে।ভয়ে হাত পা হিম হয়ে এসেছে।কান্না করতে করতে বললো,_”হাত ছাড়ুন।আমি কাউকে খুঁজছি না।বাড়ি যাবো।”
_”তোমার ভাইদের কে কি জানাবো যে তাদের বোন ক্লাস রেখে বয়ফ্রেন্ডের সাথে জঙ্গলে এসেছো?”
এ পর্যায়ে কেঁদে দিলো প্রেমা।দুপাশে মাথা নাড়িয়ে অনবরত কাঁদতে কাঁদতে বললো,_”না না প্লিজ!কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।কাউকে খুঁজছি না আমি।আমাকে যেতে দিন।”
সোভাম চিন্তিত হলো।কন্ঠে শীতলতা এনে বললো,_”আচ্ছা কেঁদো না।বলবো না কাউকে।আমাকে বলো কি হয়েছে?এখানে কি করছিলে?ক্লাস বাদ দিয়ে এই জঙ্গলে কেন এসেছো?
প্রেমা নিজের কথায় অটল।সে অনবরত কাঁদছে আর হাত ছেড়ে দিতে বলছে।এদিকে সোভাম ও নাছোড়বান্দা। সে না জেনে প্রেমাকে যেতে দেবে না।ভয় দেখিয়ে বললো,_”দেখো,তুমি যদি ভালোয় ভালোয় সব বলো তাহলে যেতে দেব।আর না হলে এখানে গাছের সাথে বাঁধবো।এরপর তোমার ভাইদের ডাকবো।এটা কি ভালো হবে?”
চোখ দুটো বড় বড় করে তাকালো প্রেমা।দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বললো,_”না না ভালো হবে না।”
হাত ছেড়ে দিল সোভাম।পুনরায় বুক বেঁধে বললো,_”তাহলে বলো।”
অসস্তিতে পড়লো প্রেমা।কিন্তু না বলেও কোনো উপায় নেই।আমতা-আমতা করে বললো,_”একটা ছেলে আমাকে গত সাতদিন ধরে বিরক্ত করে।ও বলেছে ওর কাছে আমার গোসলের ভিডিও আছে।দেখা করে টাকা না দিলে সেটা ছেড়ে দেবে নেটে।”
কপাল কুঁচকে ফেললো সোভাম।বললো,_”তুমি কি বোকা?আজকাল এরকম কত ফ্রড আছে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য।এরকম বিভিন্ন হুমকি দিয়ে টাকা নিতে চায়।আর তুমিও বিশ্বাস করলে?”
_”ফ্রড না।ও ভিডিও দিয়েছে আমাকে।আমি দেখেছি।”
_”আচ্ছা,তা তোমার বাড়িতে বসে ও ভিডিও করলো কিভাবে?”
ক্লান্ত কন্ঠে প্রেমা বললো,_”জানিনা।”
সোভাম সন্দেহী চোখে তাকালো।বললো,_”কই দেখি।ভিডিওটা দেখাও তো।”
চমকে উঠলো প্রেমা।দুহাত পেছনে সরে গিয়ে বললো,_”না।আপনাকে কেন দেখাবো?ছিহঃ!”
ভ্রুঁ কুঁচকালো সোভাম।বললো,_”তাহলে কি ওটা তোমার ভিডিও -ই ছিলো?বয়ফ্রেন্ড কে দিয়েছিলে নাকি?”
চিৎকার করে উঠলো প্রেমা।বললো,_”না!ওটা আমার ভিডিও কেন হতে যাবে?ওটা অন্য কেউ ছিলো।আমার বাথরুম এমন না।আর আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।আপনার ভাবনা চিন্তা এতো কুৎসিত কেন?আমি কোন গোসলের ভিডিও করতে যাবো?”
_”তাহলে তো বুঝতেই পারছো ওটা কেউ এ-আই দিয়ে বানিয়েছে। তারপরেও এখানে কেন এসেছো?”
প্রেমা মাথা নিচু করলো।ক্লান্ত কন্ঠে বললো,_”আমি জানি ওটা আমি না।কিন্তু অন্যসবাই তো আর বুঝবে না।আর ক-জন-ই বা বুঝবে ভিডিও টা ফেক।বুঝলেও সেই মজাই করবে এটা নিয়ে।ও তো মাত্র দশ হাজার টাকা-ই চেয়েছে।তাই সেটা দিয়েই মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিলাম।কিন্তু লোকটা তো এলো না।”
হাসলো সোভাম।কটাক্ষ করে বললো,_”বাহ!দারুন সাহস।মুখ বন্ধ করতে একা একা জঙ্গলে এসেছো।বাহবা পাওয়ার যোগ্য।”
পরক্ষণেই ধমক দিয়ে বললো,_”ও আর আসবে না।আসলেও হয়তো এখন পালিয়েছে।দ্রুত আমার পেছনে আসো।জঙ্গল টা ভালো না।আর বাড়ি গিয়ে ভাইদের বলো এই বিষয়ে। তারা যথেষ্ট ক্ষমতাশালী।”
প্রেমা স্পষ্ট বুঝতে পারলো সোভাম সরদার তাকে এবং তার ভাইদের নিয়ে কটাক্ষ করছে।কিন্তু তারপরেও মেনে নিলো।বললো,_”নাহ!ভাইয়াকে বলা যাবে না।কি বলবো আমি?যে আমার গোসলের ফেক ভিডিও কেউ বানিয়েছে।এরপর জানাজানি হয়ে গেলে ঐ লোক যদি রেগে নেটে ছেড়ে দেয়।তখন?”
শুনলো সোভাম।বললো,_”ঠিক আছে।আমাকে দাও ফোন নাম্বার টা।আমি দেখছি।”
চমকে দুহাত পেছনে গেল প্রেমা।বললো,_”কেন?সেই আপনাকে দিলেও তো এক’ই প্রবলেম হবে।তাহলে ভাইয়াকে দিতে বারন কোথায়?”
থামলো সোভাম।গম্ভীর কন্ঠে বললো,_”আমি তোমার ভাইয়ের মতো বোকা নই যে চিল্লিয়ে সারা এলাকা এক করবো।চাইলে দিতে পারো।আর না চাইলে পরেরবার আবার কোনো জঙ্গলে যেতে পারো।”
প্রেমা মাথা নিচু করে নিলো।সম্মতি দিয়ে সোভামের সাথে সাথে চলে এলো।নিচ টা পুরো ঢালু।সেই ঢাল জায়গা বেয়ে রাস্তায় উঠতে হচ্ছে।ইতোমধ্যে রাস্তা থেকে চলমান দুটো গাড়ি থেমে গেছে।তারা দূর থেকেই একটা ছেলে এবং স্কুল ড্রেস পড়ুয়া মেয়ে দেখে আরো ছেলেপেলে ফোন করে এনেছে।ক্ষমতাশীল দলের লোক তারা।নিশ্চয়ই খোট মারতে পারবে।
বিরাট অংকের টাকা না পেলেও অন্তত পক্ষে হাতের ফোন নেওয়া যাবে।ছোট ছোট কয়েকজন কিশোর এবং দুটো সিএনজি তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।কিশোর দের বয়স খুব বেশি হলে আঠারো।এর বেশি নয়।সোভাম’রা কাছে আসতেই অবাক হলো।একে।অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো।ইতোমধ্যে গাড়ির মধ্যে ফিসফিস আওয়াজ শুরু হয়ে গেছে।সোভাম সেদিকে তাকিয়ে কিছুটা চমকালো।এরপর প্রেমাকে পিছু আসতে বলে সন্তর্পণে গাড়ির দিকে চলে গেল।তাদেরকে পাত্তা দিচ্ছে না দেখে সিএনজি তে থাকা বয়োজ্যেষ্ঠ এক লোক বললেন,
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৭
_”কি এক জমানায় আইলাম।পোলা-মাইয়া দিনের আলোয় অকাম/কুকাম করে জঙ্গলের মধ্যে যাইয়া।বড়লোকের পোলা মাইয়া বইলা ছাড় পাইলো।আমগো তা হইলে জুতাপিটা করতো রাস্তার মধ্যে।”