রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৭৫

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৭৫
সিমরান মিমি

কুয়াশা-মাখানো ভোর।ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে সাত’টা তে পৌছালেও নেই সূর্যের দেখা।এদিকে শীত ও ঝাপটে ধরে আছে প্রবল ভাবে। কম্বলের মধ্যে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক মুড়িয়ে উঠে পড়লো স্পর্শী।এ যাবৎ তিনবার উঠেছে সে।কম্পনরত ঠান্ডা পা নিয়ে আবারো উঁকি মারলো দরজার বাইরে।নাহ!কেউ নেই।কারো টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না।কিছুক্ষণ উঁকিঝুঁকি মেরে চোখমুখ বিকৃত করে ফিরে এলো রুমে।পুণরায় কম্বলের মধ্যে ঢুকে ঠান্ডা পা’টা পরশের পায়ের সাথে মেলাতেই ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিলো।দাঁতে দাঁত চেপে হুশিয়ারি দিয়ে বললো,_”খবরদার!এই বরফ আমার গায়ে তো দূর যেন একটা লোমের উপর ও না লাগে।যদি আর একবার লাগিয়েছো তো সোজা পুকুরে নিয়ে চুবাবো।”

এরপর কম্বল দিয়ে নিজেকে ভালোভাবে পেঁচিয়ে শুয়ে পড়লো অন্যদিকে তাকিয়ে।বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলো স্পর্শী।দুহাতে কম্বল টাকে টেনে জোর করে ঢুকে পড়লো ভেতরে।হিমশীতল পা দুটি চেপে ধরলো পরশের পায়ের সাথে।গেঞ্জির নিচ থেকে দুহাত ঢুকিয়ে পেটের উপর চেপে ধরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।দাঁতমুখ খিঁচে কিছু বলার প্রয়াস করতেই স্পর্শী শান্ত কন্ঠে জবাব দিলো।বললো,_”সাবধান!রাত মাত্র একটা গেছে।সারারাতে একটু কাত হয়েও শুতে দেননি।আর দিন হতে না হতেই পল্টি মারছেন।রাত টা আসুক আবার,সুদে-আসলে সকল রিজেকশন ফিরিয়ে দেব।”
পরশ আর কিছু বললো না।অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,_”ক্ষমা করলাম।তবে আরেকবার কম্বল থেকে বেরিয়ে দেখো,কি অবস্থা করি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

_”আমি শুনেছিলাম পুরুষ মানুষ নারীর পাশাপাশি গেলেই মোমের মতো গলে যায়।আজ নিজের চোখে প্রমাণ দেখলাম।কিভাবে পারলি ভাই?একটা দিন ও পেটের মধ্যে পঁচাতে পারলি না।সামান্য একটা রাতের মধ্যে-ই এভাবে গলে সব উগড়ে দিলি।এবার আমার কি হবে?”
ছাদের একপাশ থেকে অপরপাশে হেঁটে এলো পরশ।এখান থেকেই শিকদার বাড়ির সামনের বিশাল এড়িয়াটা স্পষ্ট দেখা যায়।আজ বউভাত।নিচে অজস্র লোক কাজে মশগুল।সেদিকে চোখ বোলাতে বোলাতে পরশ বললো,_”কেন?তোর আবার কি হবে?কিছু বলেছে নাকি?”

পাভেল অভিমানে অন্যদিকে ফিরে তাকালো।মুখ ফুলিয়ে বললো,_”নাহ!এখনো কিচ্ছু হয়নি।তবে হতে কতক্ষণ?তোর বউতো আমাকে দেখলেই চোখ দুটো কুমড়ার মতো করে তাকায়।ভয়ের চোটে দুগালে হাত দিয়ে বসে থাকি।না জানি কখন ঠাস করে শব্দ হয়।ভাগ্যিস এ যাবৎ কেউ না কেউ আশেপাশে ছিলো।কিন্তু আর কতক্ষণ?আমাকে আজ না কাল একা তো পাবেই।তখন কি হবে?”
পরশ পাত্তা দিলো না।স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,_”একটা দুটো চড়-থাপ্পড়ে কিচ্ছু হয় না।”
থেমে সন্দেহী চিত্তে জিজ্ঞেস করলো-“ও বাড়ি থেকে কি কেউ এসেছে?”
_”না।তবে সোভাম সরদার, রোহান,জিহান আর আর্শির ফুপির আসার কথা।তবে আমার মনে হয় না সোভাম সরদার আসবে।”

পরশ পিছু চাইলো।ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,_”এমনটা মনে হওয়ার কারন?”
_”আরে ও তো তোকে সহ্যই করতে পারে না।যেখানে বিয়ে ভাঙার জন্য এতো ষড়যন্ত্র করছে সেখানে তোদের নাইওর নিতে আসবে এটা তো ভাবাই বোকামি।”
থেমে পুনরায় বললো,_”আমি বুঝি না সোভাম সরদারের সাথে তোর কিসের শত্রুতা?”
পরশ দূরের উঠোনের কোনায় রান্না কর‍তে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো।লোকটা ঘেঁমে নেয়ে কাঠের খুন্তি নাড়ছে বিশাল পাতিলের মধ্যে।সেদিকে তাকিয়েই আনমনে বললো,_”কোন শত্রুতা নেই।”
পাভেল অবাক হলো।অবিশ্বাসের সুরে বললো,_”নেই মানে?তাহলে এতো রেষারেষি কেন?”

_”রেষারেষি টা আজকের নয়।সেই শৈশব থেকে।বাবা আর শামসুল সরদার ছিলো দুজনেই রাজনৈতিক নেতা।তবে বিরোধী দলের।এটাই কারন ছিলো প্রতিযোগিতার। একসাথে স্কুল,কলেক,ইউনিভার্সিটি সব কাটিয়েছি।বাবাদের মধ্যকার বিরোধিতা চলতো আমাদের মধ্যেও।একসাথে পড়ার পরেও কখনো কথা হতো না,চলতো এক নিরব প্রতিদ্বন্দীতা।একজন অন্যজনকে হারানোর জন্য উঠেপড়ে লেগে থাকতাম।এরপর বাবা পদ ছাড়তেই আমি রাজনীতিতে আসলাম।যখন সফলতা পেলাম তাও ওর বাবাকে হারিয়ে তখন বিরোধিতা আরো বাড়লো।দলের মাধ্যমে হিংস্রতা ছড়িয়ে গেল।মারামারি -কাটাকাটি চলতে লাগলো।ব্যাস এভাবেই একটা নিরব শত্রুতা হয়ে গেল আমাদের মধ্যে।তবে সারাজীবনের প্রতিদ্বন্দীর সাথে যখন ওর-ই বোনের বিয়ে তখন তো মানতে আরো কষ্ট হবেই। তবে রাজনীতিতে না জড়ালেও ওর চাল টা ভালো ছিলো।গায়ে কাঁদা না লাগিয়েও পানি ঠিক-ই ঘোলা করলো।”
কথার মাঝে হঠাৎই নজর পড়লো গেটের দিকে।সেদিক-টা এখন জনবহুল।পাভেল উঁকি দিয়ে ঘটনা টা বোঝার চেষ্টা করলো।এর মধ্যেই দৃষ্টি গেল সোভামের দিকে।গাড়ি থেকে দাম্ভিকতার সহিত পা রাখছে শিকদার মঞ্জিলে।সাথে রোহান, জিহান এবং তার ফুপি ও আছে।পরশ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো।
সোভাম কে দেখিয়ে বললো,_”বলেছিলাম না আসবে?”

পাভেল অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে রইলো।বললো,_”আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।ভাবিইনি আসবে।”
_”বাপের বাধ্য সন্তান।আসতেই হবে।চল,সমন্ধি কে একটু আপ্যায়ন করে আসি।”
এ পর্যন্ত অজস্র বার উঁকি মেরে চক্ষুশীতল করেছে প্রেমা।সোভাম সরদার এসেছে একথা শোনার পর থেকেই যেন মন-পিঞ্জর দুষ্টু শালিকের মতো উড়তে চাইছে।শালিক যেমন টা এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে বেড়ায় তেমন ভাবেই প্রেমা নিজেও লাফাচ্ছে। রুম থেকে সোভামের রুমে আবার রান্নাঘর থেকে সোভামের জন্য বরাদ্দকৃত বিশ্রাম রুমে।অনবরত সে ঘরে যাওয়ার প্রয়াস চালালেও পাচ্ছে না কোনো সূযোগ।বারংবার রান্নাঘরে এলেও মা তাকে কোনো প্রকার নাস্তাই নিতে দিচ্ছে না।এটা বড্ড অবিচার।কোনো একটা কারন তো লাগবেই সে ঘরে যাওয়ার।ভাবতে ভাবতেই ধাক্কা খেল স্পর্শীর সাথে।থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইলো ভাবীর দিকে।পরক্ষণেই কিছু ভেবে উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,_”সোভাম ভাইয়া এসেছেন।তুমি কি জানো?”

মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো স্পর্শী।সাথে সাথেই প্রেমা বললো,_”উনি ওই রুমে আছেন।চলো তোমাকে নিয়ে যাই।দেখা করে আসবে।”
বলেই স্পর্শীর জন্য আর অপেক্ষা করলো না।নিজেই এগিয়ে গেল সিঁড়ি বেয়ে।ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকালো স্পর্শীয়া।ডেকে বললো,_”আমি মাত্র’ই দেখা করে এসেছি, প্রেমা।”
চমকে পেছনে তাকালো মেয়েটা।হতাশ চোখে ভাবির দিকে তাকিয়ে রইলো।আহত স্বরে হাসার ভান ধরে বললো,_”ওহহ!তুমি দেখে এসেছো?তাহলে তো আর যাওয়ার দরকার নাই।”

বলে নিজের রুমের দিকে হেঁটে চলে গেলো।স্পর্শী সেদিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো।হঠাৎই কাঁধে কারো ছোঁয়া পেয়ে পিছু ফিরলো।আর্শি দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে।বললো,_”কিছু বুঝেছিস আপু?”
স্পর্শী পাত্তা দিলো না।গা ঝারা দিয়ে বললো,_”কি বুঝবো?”
আর্শি আর ভণিতা করলো না।সরাসরি বললো,_”সকাল থেকে কতক্ষণ পর পর আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করছে ও বাড়ি থেকে কে কে আসবে।যখন ভাইয়ার কথা বললাম,এরপর তো মিনিটে মিনিটে জিজ্ঞেস করছে কখন আসবে,কত দূর।আসার পর তো ভাইয়ার রুমের আশপাশ থেকে সরছেই না।কিছুক্ষণ পর পর বলছে,-“ভাবী,চলো ওই রুম এ যাবোনে।”

থেমে, আমার কি মনে হচ্ছে জানো আপু?
স্পর্শী স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,_”কি?”
_”এই যে প্রেমা মনে হয় সোভাম ভাইকে পছন্দ করে।”
কোনোরকম রিয়াকশন করলো না স্পর্শী।বললো,_”ভালো তো।পছন্দ করা কি খারাপ?”
_”আরে আপু তুমি কি বুঝতে পারছো না এরকম হলে ঝামেলা বাঁধবে বিশাল।একবার চিঠি নিয়ে অনেক ঝামেলা বেঁধেছিলো।ওরা দুই ভাই কখনোই এ বিষয়ে মত দেবে না।এক কথায় সোভাম ভাইয়াকে ওরা পছন্দই করে না।”
_”আমি তো শুধু সোভাম ভাই য়ের থেকে পাওয়া কোনো রিয়াকশনের আশায় বসে আছি।ওনার মনে ঠিক কি আছে সেটা বুঝতে চাই।প্রেমার অনুভূতির উপরে ভিত্তি করে কিছু করা যায় না।যদি ভাইয়ার থেকে কোনোপ্রকার পজিটিভ সিগনাল পাওয়া যায় তাহলে তো কথাই নাই।আমিও পরশ শিকদারকে বোঝাতে চাই শত্রুর হাতে বোন তুলে দেওয়া কতটা যন্ত্রণাদায়ক। আর সোভাম সরদার ও বুঝুক ভালোলাগা বা ভালোবাসা টা কতটা ভয়ংকর অনুভূতি। আর কি বললি ওরা দুভাই সোভাম ভাইয়াকে কখনোই পছন্দ করবে না?তো,দেখে নেব।ওরা কি সাধু নাকি?প্রত্যেকটাকে চেনা আছে আমার। ”

_”তাহলে তো আবার ঝামেলা বাঁধবে।”
_”তো বাঁধুক।আমিও দেখবো কে বাঁধায় ঝামেলা।অন্যের বোন নেঁচে নেঁচে আনতে রাজি, অথচ নিজের বোনের সময়-ই যত্ত সমস্যা।

_”আসবো?”
সোভাম চমকালো না।এই গলার আওয়াজ টাকে অনেকক্ষণ ধরে আশা করছিলো।কিন্তু শুনতে পায় নি।প্রেমার ডাক শুনে আর পেছনে তাকালো না।বরং গম্ভীর কন্ঠে বললো,_”কি দরকার?”
উফফফ!এটা তো প্রেমার নিজের বাড়ি।সে কেন এই লোকের কাছে অনুমতি চাইবে।আর এই লোকের-ই বা কত্ত সাহস!সে অনুমতি না দিয়ে উলটো কৈফিয়ত চাইছে।ভেতরে ঢুকে বুকে হাত বেঁধে বললো,_”কোনো দরকার-ই না।আমরা অতিথি দের সম্মান করতে জানি।কিছুক্ষণ পর পর এসে সুবিধা-অসুবিধা জানতে চাই।আপনাদের মতো কুঞ্জস না যে রুমে ঢুকতেও দেবেন না।বলুন আপনার কি দরকার?”
_”আপাতত তোমার অনুপস্থিতি ছাড়া কিছুই লাগবে না।”
নাক ফুলিয়ে ফেললো প্রেমা।এতোক্ষণ পর এসেছে।কোথায় আরো খুশি হবে তা না উলটো তাকে যেতে বলছে।মুখে বললো,_”শুনুন,যে-চে আপনার প্রয়োজন জানতে এসেছি বলে নিজেকে খুব বেশি ফ্যামাস ভাববেন না।আমি এমনিই এসেছি।আবার চলেও যাবো।”

_”তো যাও।সেটাই তো বললাম।”
রেগে গেলো প্রেমা।সে যত কথা জমাতে চাইছে সোভামের মধ্যে ততটাই বের করে দেওয়ার প্রচেষ্টা। অথচ সেদিন বয়স জানতে চাইলো।মুখ ভার করে বললো,_”শুনুন,আপনি…….না কিছুনা।আর আসবোনা।”
বলে চলে যেতে লাগলো রুমের বাইরে।সোভাম শ্বাস নিলো। এরপর শান্ত কন্ঠে ডাকলো,_”প্রেমা?”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৭৪

এই অদ্ভুত গুরুগম্ভীর পুরুষের মুখে এতটা স্নিগ্ধস্বরে মনে হয় প্রথম নিজের নাম শুনলো।বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।মায়াভরা মুখখানি নিয়ে পিছু ফিরতেই পাষাণপুরুষ বলে উঠলো,_”আর এগিয়ো না।যতটা ভেবেছো সেটাই ভয়ংকর। ফিরে যাও অনুভূতি নিয়ে।আমি কখনো সাধ দেবো না।”
ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো প্রেমা।দু- পা সামনে এগিয়ে ভাঙা স্বরে বললো,
_”আপনিই তো অনুভূতি সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছেন।”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৭৬