রাজবধূ পর্ব ১
রেহানা পুতুল
প্রায় মধ্যরাতের দিকে শিখাকে পুরোনো একটি খাট ও বিছানা দেখিয়ে সুফিয়া বিবি বলল,
“এই মাইয়া, তুমি এইখানে ঘুমাও।”
শিখা হতভম্ব হয়ে গেলো। বিস্মিত ও ভীতু চোখে চেয়ে নিচু স্বরে বলল,
“এইখানে ঘুমামু?”
“তো কই ঘুমাইবা? আসমানে?”
” না মানেএএ.. রুম ফুল দিয়া সাজানো নাই তো?”
বাসর ঘর শব্দটা উচ্চারণ করতে শিখার লজ্জা লাগলো। তাই ওভাবে জানতে চাইলো।
“ফুল দিয়া কি হইবো? ফুল খাইবা? বইসা থাকো।”
“একলা থাকুম? আমার ডর লাগতাছে।”
“পুরা ঘর ভর্তি মানুষ। কিসের ডর? কথা কম কইবা। হুনবা বেশী।”
কঠিন গলায় বলল সুফিয়া।
শিখা আৎঁকে উঠে। সরু ঠোঁট দুটি কাঁপতে থাকে। ভয়ার্ত স্বরে বলে,
“উনি আসার আগ পর্যন্ত নইলে যে কেউ একজন থাকুক আমার লগে।”
শিখার কথার জবাব দিল না সুফিয়া। হনহন পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। শিখা মাথায় ঘোমটা টেনে পুষ্পহীন শয্যায় বসে রইলো। সুফিয়াকে নিয়ে তার মাঝে কোন হেলদোল দেখা গেলনা। বেশভূষায় বুঝে নিলো হয়তো কোন নিকটাত্মীয় হবে। তা না হলে নতুন বউয়ের উপর এত খবরদারি করে কেউ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বালিকা নববধূ শিখা হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলো। মনটা ভীষণ খারাপ। কিছুই বুঝতেছেনা সে। বিয়ের দিন রাতে কেউ নতুন বউয়ের সঙ্গে এমন নির্দয় ভাষায় কথা বলে? চিন্তা করতেই তার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। অবসাদগ্রস্ত শরীরে তন্দ্রা নেমে এলো। বালিশে হেলে পড়লো সে। ঘুম ভেঙ্গে গেলো শেষরাতের দিকে। সন্তপর্ণে বিছানা থেকে নামলো। দেখলো রুমে দ্বিতীয় কেউই নেই। পুরো রুমে সে নজর বুলিয়ে নিলো। আশ্চর্য হয়ে গেলো শিখা। মায়ের কথার সঙ্গে এই রুমের কোন মিল খুঁজে পাচ্ছে না সে। মা কি তাহলে মিথ্যে বলে বিয়ে দিলো তাকে। মায়ের উপর গাঢ় অভিমানে বুকটা ভেঙ্গে গেলো তার।
চাপানো কাঠের দরজাটি ফাঁক করলো শব্দহীনভাবে। মাথা বাড়িয়ে উঁকি মেরে দেখলো কেউ আছে কিনা।
একজন মাঝবয়েসী নারীকে দেখতে পেলো শিখা। ইশারায় কাছে ডাকলো। নারীটি সাবধানী ভঙ্গিতে শিখার কাছে এলো।
“কি হইছে নয়া বউ?”
শান্ত সুরে জিজ্ঞেস করলো সেই নারী।
“আপনে কে খালা?”
” আমি মতির মা।”
“এইখানে আপনের কি পরিচয়?”
“এই তালুকদার বাড়ির বহুত পুরানা বান্দী। সক্কলের হুকুম মান্য করাই আমার কাম।”
শিখা আকুল হয়ে জানতে চাইলো,
” তাইলে ত আপনে সব কইতে পারবেন। খালা বাসর ঘর সাজানো নাই ক্যান? আর আমার বিয়া হইছে কার সঙ্গে?”
“বাসর ঘর প্রথম দিন হয়না তালুকদার পরিবারে। এইটা হেগো নিয়ম। আর তোমার বিয়া হইছে তালুকদারের ছোড পোলার সঙ্গে।”
“তাইলে উনি আসেনা ক্যান?”
কৌতুহল থেকে জানতে চাইলো শিখা।
“আহ! কি কইলাম একটু আগে? বিয়ার পরথম দিন এই বাড়িতে বাসর হয়না। দ্বিতীয় দিন হয়। কাইল দেইখবা জামাইরে। টেনশনের কিছু নাই। যাও। ঘুমাইয়া থাহো।”
মতির মা দপদপ পায়ে চলে যায়।
আশাহত শিখা একবুক আশা নিয়ে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুম আর এলনা দু’চোখজুড়ে। উঠে গিয়ে লাগেজ থেকে একটা সুতী শাড়ি বের করে নিলো। না পরতে পারলেও কোনমতে পেঁচিয়ে নিলো পরনে শাড়িটি।
বিয়ের রাতে বাসর হয়না তালুকদার পরিবারে, মতির মায়ের এই বাক্যটি শিখার হৃদয়ে কুঠারাঘাত করতে লাগলো। কি অদ্ভুত কথাবার্তা। তার জীবনেও শুনেনি এমন কথা। তাই বলে বিয়ের রাতে জামাই দেখাও দিবেনা।
শিখা বিতৃষ্ণা নিয়ে মনে মনে উচ্চারণ করলো,
“কি হারামি জামাই। এই ব্যাডার লগে জিন্দেগী কাটামু ক্যামনে আমি। আম্মা এইটা কি করলেন আমার লগে? আমারে কই বিয়া দিলেন আম্মা? এরা আমারে রাইতে পুরানা একটা রুমে ঘুমাইতে দিছে। এর চাইতে আমাগো বাড়িই ভালো। আমি চইলা আসুম আম্মা।”
পনেরো দিন আগের কথা। এক বিকেলে গলা হাঁকিয়ে শিখাদের ঘরে ঢুকলো ঘটক ছেরু মিয়া।
“কইগো মকবুলের বউ,ঘরে আছো নি?”
“হ কাকা। আছিতো। বসেন।”
মাথায় কাপড়ের আঁচল লম্বা করে টেনে দিয়ে বেতের মোড়াটা এগিয়ে দিয়ে বলল নূরী।
“পান দাও এক খিলি। খাইতে খাইতে আলাপ করি।”
নূরী একটি পিরিচে করে পান বানিয়ে দিলো ছেরু মিয়ার হাতে। বলল,
“চাচা কি অন্যদিকে যাইতাছেন? না আমগো ঘরেই আইলেন?”
“না। তোমাগো ঘরেই আইলাম। তা ক্যামন যাইতাছে তোমার দিনকাল? সবকিছুর যেই হারে দাম বাড়তাছে। চলন মুশকিল।”
” ঠিক কইছেন চাচা। আর আমার মতন তিনকূল হারা নারীর ত সমস্যার শ্যাষ নাই।”
“তুমি জাতের মাইয়া বইলা স্বামীর ভিটায় ইজ্জতের সহিত পইড়া আছো। আলো কেমন আছে জামাইর বাড়ি? আমার কথা জিগায় নি তোমার ঝিয়ে?”
“আলহামদুলিল্লাহ চাচা মিয়া। আপনার উছিলায় আমার আলো মা ভালো আছে। জিগায় আপনার কথা। দাদা কেমন আছে আম্মা? আমার সালাম দিও দেখা হইলে।”
ছেরু মিয়ার মুখের হাসি প্রশস্ত হয়। উৎফুল্ল মনে নূরীকে বলে,
“তোমার ছোড ঝিয়েরে বিয়া দিবানি?”
“শিখা সেইভাবে এখনো লায়েক হয়নাই চাচা। তারে বিয়া দিলে আমি একলা হই যামু। তাই এখন এসব ভাবতাছি না।”
ছেরু মিয়া মেহেদী দেওয়া আধপাকা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে নেয়। ঘরের দাওয়ার গিয়ে পানের পিক ফেলে নেয়। আবার এসে মোড়ায় বসে। উৎসুক চোখে নূরীকে বলল,
“শোন মকবুলের বউ। তোমার ঝিয়ের রাজ কপাল। আল্লার দান করা সৌন্দর্যের বড়ই দাম। বুঝলা। নইলে ক্যামনে এতবড় ঘর থেইকা তোমার ঝিয়ের লাইগা বিয়ার সম্বন্ধ আসে। আমার হাত দিয়া তোমার বড় ঝিয়েরে বিয়া দিলাম। এইবার এইটারেও দিমু। ভরসা রাখো আমার উপরে। এমন সুযোগ হাতছাড়া করন বোকামি হইবো।”
নূরী বোকা বোকা চোখে ছেরু মিয়াকে জিজ্ঞেস করে,
“কোন গ্রাম চাচা? বড় ঘরের ছেলের জন্য ছোড ঘরের মেয়ের বিয়ার প্রস্তাব ক্যামনে আসে? কে দিলো এই প্রস্তাব?”
“আমাগো পাশেই। উজানপুর গেরামের তালুকদার বাড়ির থেইকা সম্বন্ধ আসলো। জয়নুল তালুকদারের ছোড পোলার জন্য।”
সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে নূরীর। বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“এইটা কি কন চাচা? এত বড় জমিদার ঘরের বউ ক্যামনে আমার মাইয়া হয়। এত উঁচা নিচায় আত্মীয় করা কি শোভা পায়?”
” একশোবার পায়। তোমার যেই রুপসী মাইয়া।”
ছেরু মিয়া নূরীকে বিস্তারিত বলে। নূরী কিছুটা নরম নয়। গলে যেতে থাকে। ছেরু মিয়া দুই এক দিন পরপর ঘুরেফিরে আসে মীর বাড়িতে। নূরীকে বোঝাতে সক্ষম হয়। নূরী বাড়ির মুরুব্বিদের ও কাছের মানুষদের জানায় বিষয়টা। সবাই সহমত জানায়।
এবার শিখাকে বুঝানোর পালা। শিখা স্কুল থেকে আসে। ভাত খেয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসে। নূরী পাটির মুড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে মেয়েকে বিয়ের কথা জানায়।
শিখা ফ্যালফ্যালিয়ে কেঁদে ফেলে জেদী স্বরে বলে,
“আমি আর স্কুলে যামুনা তাইলে আম্মা?”
“তোর ফাইনাল হওনের পরেই বিয়া। দশ কেলাস ত পড়ছোত। আর পড়া লাগব না।”
এই বলে নূরী বুঝিয়ে বলে সব শিখাকে।
“তাল্লুক মানে হইলো জায়গা জমি। আর অনেকগুলা জমি জিরাতের মালিক যে, তারেই কয় তালুকদার বা জমিদার।”
“এটা কে কইছে আম্মা?”
“তোর ছেরু দাদায় কইছে আমারে। খাওয়া,পরার কোন অভাব নাই। কামও বেশি করন লাগব না। হেগো নাকি কয়েকজন কাজের বেটি আছে। তুই ত থাকবি স্বামীর আদরে সোহাগে। দেহিস।”
কিশোরী শিখার আবেগী মনে ছাপ পড়ে মায়ের কথাগুলো। চোখের কোন চিকচিক করে উঠে। মন কিছুটা সায় দেয়। লাজরাঙা মুখে উঠে যায় মায়ের সামনে থেকে।
বিয়ের আয়োজন হয় সাদামাটা। তা নিয়ে কনে পক্ষের কারোই কোন খেদ নেই। কোন প্রশ্ন নেই। নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়ের বিয়েতে এইই যথেষ্ট।
ভোর হলে শিখা পা টিপে টিপে বের হয়ে যায়। বাথরুম খুঁজে বের করে। হাতমুখ ধুয়ে আবার নিজের রুমে ফিরে আসে। তার অনেক ক্ষুধা লাগছে। ঘরের এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখল শিখা। একরাশ বিরক্তি নিয়ে মনে মনে বলল,
“এইটা তালুকদার পরিবার না বেক্কল পরিবার। নতুন বউয়ের ক্ষুধা লাগছে কিনা জিগাইব না? কত বড় ঘর এদের। কতগুলা রুম। তাইলে আমারে অমন খুপরি ঘরে থাকতে দিলো ক্যান?”