রাজবধূ পর্ব ২

রাজবধূ পর্ব ২
রেহানা পুতুল

ঘরের এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখল শিখা। একরাশ বিরক্তি নিয়ে মনে মনে বলল,
“এইটা তালুকদার পরিবার না বেক্কল পরিবার। নতুন বউয়ের ক্ষুধা লাগছে কিনা জিগাইব না? কত বড় ঘর এদের। কতগুলা রুম। তাইলে আমারে অমন খুপরি ঘরে থাকতে দিলো ক্যান?”
শিখার পানির পিপাসা পেয়েছে। রোজ খালি পেটে পানি খাওয়া তার অভ্যাস। রুমে কোন পানির মগ নেই। বাড়িতে থাকলে এতক্ষণে নলকূপ চেপে খালি পেটে এক গ্লাস পানি পান করে ফেলতো। এভাবে পানি খাওয়ার অভ্যাস হয়েছে তার অভাবের জন্য। ভোর হলেই ক্ষুধা লাগতো। মা নূরী নিরুপায় হয়ে চাপকল থেকে এক মগ তাজা পানি নিয়ে শিখাকে বলতো,

” নে খা আম্মা। খালি পেটে পানি খাইলে শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে। অনেক ব্যারাম কাছে আইতে পারে না।”
শিখা দরজায় দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে থাকে। কাউকে দেখতে পেলনা। পিপাসায় তার চোখে পানি এসে গেলো। পেটে হাত দিয়ে চেপে রেখেছে সে। কিছুসময় পর রুমে নাস্তা নিয়ে প্রবেশ করলো একটি মেয়ে। শিখার বয়েসী হবে।
“নেন ভাবি। নাস্তা লন।”
“কে আপনে?”
“আমি মতির বইন। খালুগো ফুট ফরমায়েস খাটি।”
ট্রে রেখে মেয়েটি চলে চায়। শিখা নাস্তাগুলোর দিকে নিষ্প্রাণ চোখে চাইলো। তিনটে আটার রুটি ও এক বাটি বাসি বুটের ডাল। হাড়, আলু মিলিয়ে গরুর মাংসের ঝোল। একটি বড় স্টিলের গ্লাসভর্তি পানি। শিখা গলা উঁচিয়ে গ্লাসের অর্ধেক পানি খেয়ে নেয়। পরে খুশিমনে সব নাস্তা খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। বাড়িতে এই হাড়,আলু ছয়মাসেও কপালে জোটেনা।
সময় আন্দাজ করে ট্রে নিতে এলো মেয়েটি। নতুন কাউকে দেখলেই তার নাম জানতে ইচ্ছে করে শিখার। ছোটবেলা হতেই মানুষের নামের প্রতি বিপুল আগ্রহ শিখার। সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপনার নাম কি?”
“আমার নাম জোছনা। নামটা কি আপনার পছন্দ হইছে ভাবিজান?”
“হ। নরম। সুন্দর। কে রাখছে নামটা?”
“আমার দাদা। হের চোখে আমি নাকি জোছনার মতন। কিন্তু আমার চোখে আপনারে জোছনার মতন সুন্দর লাগতাছে।”
শিখা জোছনার মায়ের নাম জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থেমে গেলো। যার নাম তার মুখে শুনলেই বেশি ভালোলাগবে। বলল,

“সবসময় থাকেন এই বাড়িতে?”
” নাতো। আপনেগো বিয়া উপলক্ষ্যে আছি। নইলে আমার থাকা লাগেনা। আমার মায় থাকে বান্ধা। আমগো রাজ ভাইর ভাগ্যটা ভালো। কি টুকটুকা বউ পাইছে।”
“রাজ কে?”
“ওমা! জানেন না? আপনার স্বামীর ডাক নাম।”
শিখা মুচকি হাসে। কিছু বলেনা।
” যাই। পরে চাচী বকা দিবো। এমনেই সবাই আমারে কইতর কয়। আমি নাকি কইতরের মতন হারাদিন কককক করি। আবার সুযোগ পাইলে আসুমনি।”
“আইচ্ছা যান।”
জোছনা চলে যায়। তার সঙ্গে কথা বলতে শিখার ভালোলাগলো। বাড়িতে হলে এতক্ষণে সে অনেক কথা বলতো। এখানে নতুন বউ হওয়াতে তাকে বোবা হয়ে থাকতে হচ্ছে। কেউ যেচে এসে কথা বলছে না। সেও নড়তে পারছে না। আম্মার নিষেধ। ভদ্রভাবে চুপচাপ থাকতে বলছে। অতিরিক্ত কথা বলতে মানা করেছে।
পান চিবোতে চিবোতে রান্নাঘরের উঠানে এলো জয়নুল তালুকদার। কাঁঠাল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সবাইকে বলল,
“নতুন বউয়ের সঙ্গে তোমরা সকলে পরিচিত হইছো?”
“নাহ বাবা আমি হইনাই। সময় ত পাইনাই। অন্যদের কথা জানিনা।”
বলল তার বড় ছেলের বউ রানী।

“আপনার যা উলাল। কুয়ারা দেখলে গা জ্বলে। ওই ছোটলোকের মাইয়ার লগে কি কথা কমু? আমি সুফিয়া। চাইর চাইরটা পোলার জননী। তালুকদারের বিবি। মনে রাইখেন।”
“দেমাক না দেখায়া তুমি কথা কইতে পারনা সুফিয়া বিবি? কিসের ছোটলোক? খোদার দুনিয়াতে সবাই মানুষ। সবাই সমান। সে যেহেতু এই ঘরের বউ হইয়া আইছে। তারও একটা ইজ্জত আছে। তাকে আমরা সসম্মানে নিয়া আসছি। সে নিজে পায়ে হেঁটে আসেনাই তালুকদার পরিবারে। আর রাজের অমতেও বিয়া হয়নাই।”
“স্বসম্মানে যেহেতু আনছেন,তাইলে আপনেই গিয়া ইজ্জত করেন। বউরে কোলে নিয়া বইসা থাকেন। ধইরা আনছেন এক ফকিরনির মাইয়ারে। এক রূপ দিয়া সব চলে না।”
স্বামীর মুখে ঝামটি মেরে কথাগুলো বলল সুফিয়া বিবি।
“এইটা কোন কথা? আমি নিয়া আসতাছি বউরে। আর কেন ধরে আনছি তুমি জাননা?”
সুফিয়া বিবি স্বামীকে থামায়।

” হ জানি। কিন্তু খুইলা ত কননাই। দেহা যাইবো কত ধানে কত চাইল। সুযোগ পাইলে পিঁপড়াও নিজেরে হাতি ভাবতে শুরু করে। এই হুনেন। আপনে যান। আমিই ডাইকা পাঠাইতাছি।”
জয়নুল তালুকদার জানতো এমন কিছুই হবে। তবুও সে শিখাকে বউ করে আনে তার ঘরে। প্রলম্ভিত স্বাস ছেড়ে সে ঘরের ভিতর চলে যায়। খুঁজে বের করে শিখা কোন রুমে আছে। স্টোর রুমের পর্দা ফাঁক করে ডাক দেয় শিখাকে। ঈষৎ হেসে বলে,
“বউ খারাপ লাগতাছে বাড়ির জন্য?”
শিখা নম্র হাসে।
“হ চাচাজান। আমারে নিয়া যাইব কখন?”
জয়নুল হেসে ফেলে। শিখার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে বলে,
“নিয়া যাইবো। কাল সন্ধ্যায় বা পরশু সকালে। স্বশুরকে কেউ চাচা বলে বোকা মেয়ে?”
ষোড়শী শিখা ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রয় স্বশুরের দিকে। স্টোর রুমে শিখাকে এরা থাকতে দিয়েছে। ভেবেই খারাপ লাগলো তালুকদারের।
বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেলেও সুফিয়া শিখাকে ডেকে পাঠাল না। তখন তালুকদাদের মেজো ছেলের স্ত্রী সুমনা রান্নাঘর থেকেই সুফিয়া বিবিকে বলে,

“আম্মা কি ভুইলা গেলেন? ছোড মিয়ার বউ এক রুমেই বন্দী কাইল থেইকা। ফুলবানু গিয়া ওরে ডাইকা আনুক।”
সুফিয়া বিবি হই হই করে উঠলেন। ঝাঁঝালো স্বরে বললেন,
“সব দিলদরদী আইসা গ্যাছে আমার ঘরে। আমি ভুইলা যাইনা কিছু। মনে থাকলেই কি হ্যারে আনতে হইবো ডাইকা? জমিদারের বেটিনি হেতি? এতজনের লগে কতক্ষনে পরিচয় করাইবো। হাঁটতে ফিরতে চেনা হইয়া যাইবো। নিজের চরকায় তেল মারো।তোমার স্বশুররে মিছা কথা কইছি। নইলে তারে পার করন যাইত না আমার সামনে থেইকা। ”
ফুলবানু ও জোছনা আড়ালে বিদ্রুপের হাসি হাসে সুফিয়াকে নিয়ে। তাদের কথা হয় চোখের পাতার পাতায়।
“এই বেডির এত জিদ ক্যান? জন্মের সময় হের মুখে মনে হয় মধু না দিয়া এক চামুচ লাল মরিচের গুঁড়া ঢাইলা দিছে।”

একটা কাশির শব্দ শুনে শিখা আঁখিপল্লব তুলে চাইলো। একজোড়া পুরুষ চোখ তার দিকে পলকহীনভাবে চেয়ে রইলো দরজায় দাঁড়িয়ে। শিখা সংযত হয়ে বসলো।
“হেই লাভলী! নাইস টু মিট ইউ।”
বলে যুবকটি হাত বাড়িয়ে দিলো। শিখা অচেনা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চুপ রইলো।
যুবকটি বলল,
“তুমিতো বালিকা পুরাই মাক্ষন। রাজ পরিবারে সুস্বাগতম তোমাকে।”
শিখা নির্বোধের মতো চেয়ে রইলো যুবকটির পানে। বলল,
“কে আপনে ভাইয়া?”
“ওহ শিট! কিসের ভাইয়া? জাস্ট উই আর ফ্রেন্ড। সীমান্ত আমি।”
দুষ্ট হাসি ছড়িয়ে যুবকটি চলে যায়। শিখা নিশ্চিত হলো এটা তার বর নয়।
সে রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। তার সামনে এগিয়ে এলো একটি মেয়ে। বয়সে তার বড় হবে।
“গুড নুন বললাম না তোমাকে। তোমার নাম শিখা না?”
“জ্বি। আপনে কে আপু?”
“আমি আদুরী। তোমার একমাত্র ডেঞ্জারাস ননদী। আমার তুলনায় তুমি পুঁচকি একটা মেয়ে। তাই ভাবি বলতে পারব না। তোমাকে সবসময় তুমি বলেই ডাকবো আমি।”
শিখা আলতো হাসলো। বলল,

“কোন সমস্যা নেই আপু। চাইলে নাম ধইরাও ডাকতে পারবেন।”
“হেসোনা। আমি রসিকতা করে বলিনি। আমাদের দুই যৌথ পরিবারের একমাত্র মেয়ে আমি অনেকগুলো ছেলের ভীড়ে। তাই আদর করে আমার নাম রাখা হয়েছে আদুরী। তালুকদারের মেয়ে বলে কথা। বুঝো কিন্তু।”
দম্ভসুরে বলল আদুরী। শিখার মুখ চুপসে যায়। বলে,
“জ্বি আপু। বুঝছি।”
“শোন, আম্মা আমাকে পাঠালো। তোমাদের বাড়িতে গতকাল বরপক্ষের তেমন কেউই যায়নি। কারণ সবাইকে আতিথেয়তা করার এবিলিটি তোমাদের ছিল না। তো আগামীকাল দুপুরে তোমাদের বউভাত অনুষ্ঠান। আব্বা সবাইকে ইনভাইট করেছে। তালুকদার পরিবারের ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে গ্রামে। তাই এই আয়োজন না করলেই নয় আমাদের। তুমি ভালো করে তৈরি হয়ে নিও। সবাই তোমাকে গিফট নিয়ে এসে দেখবে। শাড়ি পরতে পারো?”

” না আপু।”
“সাজতে পারো?”
“না আপু।”
আদুরীর মুখ হা হয়ে যায়।
“তো পারোটা কি তুমি? কেবল সুন্দর হলে চলবে? স্বামীর সংসার করতে আসছো? কিছু গুন ত থাকা চাই। আচ্ছা কাল আমিই রেডি করে দিবো তোমাকে। হুহ্! ”
উপহাস করে বলল আদুরী। ঠমকিভাব দেখিয়ে কোমর দুলিয়ে চলে গেলো। শিখার চোখদুটো জলে ভরে যায়। সে ছোটমানুষ হতে পারে। তাই বলে কারো তুচ্ছতাচ্ছিল্য কথার মানে সে অনুধাবন করতে পারবেনা,এতটাও খুকী নই সে। নূরীকে স্মরণ করে বলল,

“আম্মা আমারে কই পাঠাইলেন? এটাতো দেখি কয়েদিখানা আম্মা। সবাই নির্দয় আচরণ করে। অনাদর করে। আমি বাকিজনম ক্যামনে এইখানে বাঁচুম আম্মা। আমি চইলা আসুম। এরা সবাই ম্যালা অহংকারী।”
চোখের পানি ফেলতে ফেলতে শিখার নয়ন বুঁজে আসে। সকালের অবসান ঘটিয়ে দ্বিপ্রহরের আগমন। গাছের শাখায় শাখায় এক ঝাঁক পাখির মুখরিত কলরব। শিখার ঘুম ভেঙ্গে গেলে উঠে গেলো শরীরের আড়মোড়া ভেঙ্গে। আলস্যতা ঝেঁকে বসেছে শরীরে। একটু কাজ করতে পারলে ভালো লাগতো। শিখা ধীর পায়ে রুম থেকে বের হয়। সামনের দিকে এগিয়ে যায়। পিছন হতে চুলে টান পড়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সীমান্ত। তার মুঠোবন্দী হয়ে আছে শিখার চুলের গোছা। শিখা আড়ষ্ট হয়ে যায়। ভ্রুকুটি করে চায়।

“অমন করে কি দেখছো ললনা? বাজে কি করলাম? তোমার কেশের একটু সোঁদা গন্ধ শুঁকলাম। এইতো।”
শিখা দ্রুতপায়ে সামনে চলে যায়। বিষয়টা বলার মতো কাউকেই পেলনা। কাকে বলবে? ভালো করে কাউকেই ত চিনে না সে। পিছনের উঠানে গিয়ে দাঁড়ায় শিখা। মতির মা তাকে ইশারা দিয়ে বলল,
“ওইটা তোমার শাশুড়ী। পা ধইরা কদমবুসি করো।”
শিখা সুফিয়া বিবির সামনে গিয়ে ঝুঁকে বসে। দুই পা ধরে বিনম্রভাবে সালাম দেয়। সুফিয়া বিবি পা সরিয়ে নেয়। অন্যদিকে চেয়ে মুখ গোঁজ করে থাকে।
শিখা সরে যায়। সে বুঝতে পারলো সুফিয়া তাকে পছন্দ করেনি। দুপুরের খাওয়ার আয়োজন চলছে। ডাইনিং টেবিলে একে একে সব নিয়ে রাখছে ফুলবানু ও জোছনা। কাজের লোকেরা খাবে রান্নাঘরে পাতা বড় চৌকিতে বসে। শিখা রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। ভিতরে থাকা নারীদেরকে জিজ্ঞেস করলো নমনীয় স্বরে,

“আপনারা কে আমার কি হইবেন? আমিতো কাউরেই চিনিনা।”
“এত তাড়া কিসের চেনার? কই চইলা যাইতাছো নাকি? আমি রানী। তালুকদার ঘরের বড় বউ।”
“ওহ বড় ভাবি। আসসালামু আলাইকুম। আমাকেও কোন কাম দেন ভাবি। বইসা থাকতে মন চায়না।”
“এখন করতে হইব না। কত করতে পারো দেখা যাইবো। কাম ছাড়া তালুকদার ঘরে তোমার আর কাম কি? রুমে চইলা যাও। খাওন দিয়া আইবো।”
ফোঁড়ন কেটে বলল রানী।

রাজবধূ পর্ব ১

শিখা ধরতে পারলো রানীর কন্ঠেও অহমিকা ঝরে পড়ছে। সে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে গোপনে বলে উঠে,
ধনী হইলে বুঝি সবাই গরীবের সঙ্গে এমন শক্ত আচার ব্যবহার করে? কেমন মানুষ এরা?কেউইতো আমার সঙ্গে ভালো করে কথা কয়না। রাজও কি আমার সঙ্গে নির্দয় আচরণ করবেন? তাহলে যেন উনার সঙ্গে কোনদিন আমার দেখা না হয়।

রাজবধূ পর্ব ৩