রাজবধূ পর্ব ২৬
রেহানা পুতুল
আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি আদুরীর বিয়ের। এমন এক সকালে তার শরীর গোলাতে লাগলো। দৌড়ে গিয়ে উঠানের একপাশে সে হড়বড় করে বমি করে দিলো।
বরকত সবাইকে ড়াক দিলো। ঘরের জানালা দিয়ে সে দৃশ্য দেখে রানী ফিচলে হেসে উঠলো। অন্যদের সঙ্গে সেও বের হয়ে গেলো ঘরের পিছনের প্রাঙ্গণে। মতির মা আদুরীর মাথা টিপে ধরলো। বরকত পানি এগিয়ে দিলো ঘটিতে করে। বমি শেষে আদুরীকে ধরে নিয়ে ঘরের সিঁড়িতে বসালো। সুফিয়া বিবি অস্থির হয়ে উঠলেন। ব্যাকুল স্বরে,
“দুইদিন বাদে মাইয়ার বিয়া। আচম্বিতে এমন বমি ছুটলো ক্যান? ওই ফুলবানু, বয়াম থেইকা জলপাইয়ের আঁচার আইনা দে৷ মুখে লাড়ুক।”
পাশ থেকে সেজো বউ ডলি বিষম খাওয়া কন্ঠে বলল,
“কাইল মনে হয় উলটা পালটা কিছু গিলছে আপায়।”
“সেইটাই হইবো। নইলে শীতকালে কেউ বমি করে? গরমের সিজন হইলে এককথা আছিলো।”
বলল মেজো বউ সুমনা।
সুফিয়া চ্যাত করে উঠলো।
“যাওতো দুইটা আমার চউক্ষের সামনে থেইকা। কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা মারতে আসো। শীতে কেউ বমি করে না? খালি গরমেই গা গুলায়? বমি ঢালে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সুমনা ও ডলি ঠোঁট ভেংচিয়ে চলে গেলো।
আদুরী বিপুল উৎকন্ঠা নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। রানী অবোধের ভাব ধরে শাশুড়ীর পাশে বসে রইলো। ভাবখানা এমন তার, যেন ভাজামাছটিও উল্টে খেতে জানে না। জগতের সব সরলমনা নারীদের মধ্যে সে অন্যতম না হলেও দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় তো হবেই।
ফাঁদ পাতা শিকারির ন্যায় রানী সুযোগের অপেক্ষায়। ব্যস্ত দুপুরে সবাই ঘরের বাইরে এদিক সেদিক রইলো। কেউ গেলো পুকুরঘাটে গোসল করার জন্য। পুরো ঘর খালি। রানী চুপিচুপি আদুরীর রুমে গেলো।
“আদুরী কিরে? প্যাট ত বাজাইলিরে। এবার বাঁচবি ক্যামনে? নাগর রে কইলি না ক্যান পি* ল আইনা দিতো?”
আদুরী করুণ চাহনি নিক্ষেপ করলো বড় ভাবির দিকে। ক্ষীণ স্বরে বলল,
“ভাবি দুইজন দুইজনরে একান্তে পাইয়া ধৈর্য ধইরা রাখতে পারিনাই। হ্যারে কইছি। কইলো একরাতের কাজে কিছুই হইব না। আর ভাবি তুমি হইলা বিধবা। ভাইয়া থাকতেও পি* ল খেতেনা। তোমার ত এমনিতেই বাচ্চা হতো না। নয়তো তোমার কাছ থেকে চাইয়া নিতাম। এখন কি করুম ভাবি? ”
আবার বলে উঠে আদুরী।
“ভাবি আরেকটা বিষয়ও আছে একটু। আমি শোয়েবরে ছাড়া থাকতে পারুম না। তাই একবার হইলেও ভাবছি,কিছু একটা হোক। তাহলে আব্বা নিরুপায় হইয়া শোয়েবের সাথেই বিয়া দিবো আমাকে। বুঝলা।”
“এইটা তোর এক্কেবারে ভুল ধারণা। আসল কেচ্ছা জানতে পারলে তোর বাপ, চাচায়, শোয়েবের গলা কাটবো। তোরেও টুকরা করবো। তবুও তারা তাগো নিয়ম ভাঙ্গব না। তার চাইতে তুই অন্যের ঘরণী হইলে মাঝেসাঝেও তোর শোয়েবরে দেখতে পারবি। কোনটা ভালো? ভাইবা দেখ।”
আদুরী কেঁদে ফেলে।
“ভাবি তাইলে এখন উপায়? বমি কি আর অফ করা যাইবো?”
” রানি থম মেরে রয়। উপায় ভেবে নেয় নিজের বুদ্ধিনুযায়ী। মাষ্টারের মতো আদেশ করে বলে আদুরীকে,
“সাতদিন পর বিয়া। বমি বন্ধ করার উপায় নাই। বিয়ার পর বমি করা আর তোরে দেখলেও মুরুব্বীরা বুইঝা যাইবো। গাইনি ডাক্তার দেখায়া সিউর হইতে হইবো। এরপর বাচ্চা ফালাইতে হইবো। এই ছাড়া তোর বাঁচনের উপায় নাই। বমি বন্ধ করনেরও উপায় নাই।”
“শোয়েবের নিশানা বুঝি আমি উপরে ফেলব ভাবি?”
“তয় কি করবি। শোয়েবের লগে সংসার না করতে পারলে তার নিশানা দিয়া কি করবি? কেমন পালবি? ”
“ভাবিগো..” বলে আদুরী মৃদু আর্তনাদ করে উঠে।
“সমাজ বড় কঠিন। বড়ই নিষ্ঠুর! এই নিষ্ঠুর সমাজে নিজের অস্তিত্ব নিয়া টিকা থাকতে হইলে নিজেরও নিষ্ঠুর হইতে হয়। নিজে ভালো থাকলে বাপের নাম। এটা হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাইছি সংসার জগতে আইসা।”
“আচ্ছা ভাবি তাই হোক। ব্যবস্থা করো। তুমি আমার ধর্মের বইন। তুমি ছাড়া আমার এই কলংকের কথা যেন কেউ কোনদিন না জানে। শোয়েবের জানা দরকার। পত্র দিয়া জানামু।”
ভিখারির মতো অনুনয় করে বলল আদুরী। রানী বলল,
“তুই ভাবিস না। আমি বাচ্চা ফালানোর বন্দোবস্ত করতাছি। তবে আমারেও তোর একটা সাহায্য করা লাগবো।”
“কি কও ভাবি?”
“এখন না। সময় হোক। তোর বিয়া চুকায়া যাক। তারপর।”
তারপরের দিনই রানী শাশুড়ির কাছে যোক্তিক কিছু বলে আদুরীকে নিয়ে সদরে গাইনী চিকিৎসকের কাছে যায়। পরিক্ষা করে দেখে আদুরী কনসিভ করেছে। রানী সব খুলে বলে ডাক্তারকে। তারপর টাকা দিয়ে বাচ্চা ওয়াশ করে ফেলে দেয়। ডাক্তার জানায় কিছুই হয়নাই এখনো। রক্তের চাকা একটা। মাত্র তিন সপ্তাহ চলতাছে। আদুরিকে ব্যথার ট্যাবলেট দেয়। আদুরী তিনদিনের মাথায় সুস্থ হয়ে উঠে। ঘরের কেউই কিছু বুঝল না। কারণ আদুরীর আর বমি হলো না। সবাই ধরে নিলো বিয়ের সময় ঘনিয়ে এলো। তাই আদুরী খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বলে কিছুটা দুর্বল হয়ে গিয়েছে।
এদিকে একমাস ব্যাপী শিখার এস.এস.সি পরিক্ষা চলল। পরিক্ষা কেন্দ্রে যাতায়াতের জন্য মাসব্যাপী একটা রিকশা কন্ট্রাক করে দিলো তার মা। শিখা ও তার আরেকটি ক্লাসমেট মেয়ে একই রিকশায় যাওয়া আসা করতো। সেও তাদের মধুপুর গ্রামেরই মেয়ে। মূল পরিক্ষা শেষ। রিকশা চুক্তির নির্ধারিত সময়ও শেষ। শিখার প্যাক্টিকেল পরিক্ষা চলছে। বিভাগ ভিন্ন হওয়ার ফলে তখন শিখার একাই যেতে হতো। একদিন শিখা কেন্দ্র থেকে পরিক্ষা শেষে বের হলো। কেন্দ্রের বিশাল সবুজ মাঠ পেরিয়ে মূল সড়কের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বাড়িতে যাওয়ার জন্য রিকশা দরদাম করছে। তখন কোথা হতে যেন সীমান্ত উল্কার বেগে তার সম্মুখপানে এসে উপস্থিত হলো। শিখা হকচকিয়ে গেলো। তবুও সে সীমান্তকে না দেখার ভান করে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো। সীমান্তকে তার ভালো লাগে না। সীমান্ত কেবল নামেই সুন্দর। কাজে নয়। খুব যৎকিঞ্চিত হলেও সীমান্ত তার সঙ্গে অশালীন ফাজলামো করার চেষ্টা করেছে। শেষের দিনেরটা ত বিশ্রী বিষয় করে ফেলল। সীমান্ত শিখাকে আন্তরিকতাপূর্ণ গলায় ডেকে উঠে।
“ভাবি একটু শোন। দাঁড়াও। আমার কথা আছে।”
শিখা চরণগতি মন্থর করলো। যত যাইহোক তার স্বশুরবাড়ির ঘনিষ্ঠজন সীমান্ত। তাদের একমাত্র বোনের ঘরের একমাত্র ভাগিনা।
“কেমন আছো ভাবি?”
“ভালো আছি। আপনে এইখানে কি করেন?”
“আমি এখানে মার্কেটে আসছি এককাজে। পরিক্ষা কেমন হলো তোমার?”
“হুম ভালোই।”
“ভাবি আমার একটু জরুরী কথা ছিলো।”
“বলেন,কি বলবেন?”
সীমান্তর কন্ঠে অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো। বলল,
“কুসুম, তোমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী কয়দিন আগে জানলাম।”
শিখা চকিতে চাইলো সীমান্তর মুখের দিকে। কুসুমকে সে চিনে? জিজ্ঞাসু চোখে সীমান্তের পানে ফের চায়।
“কুসুমের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাবি। কুসুম একদিন কথায় কথায় বলল,তুমি তার ক্লোজ ফ্রেন্ড। তখন আমি নারভাস হয়ে যাই। অন্যভাবে কুসুমকে মানা করি কাউকেই যেন আমার কথা না বলে। সে বলল তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় করায়া দিবে। তাই আমি চিন্তা করলাম কুসুম তোমাকে কিছু বলার আগে, আমি তোমার সাথে দেখা করি। কারণ তুমি যদি আমার কথা উলটা পালটা কিছু বলে দাও কুসুমকে,তাহলে সে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমি কুসুমরে ছাড়া বাঁঁচব না ভাবি। আমি মন্দ ছেলে নই। কসম আল্লার! ”
বলতে বলতে সীমান্ত আপ্লুত হয়ে যায়৷ দু’হাত জোড় করে ধরে শিখার সামনে। শিখা অবাক হয়ে যায় কুসুমের প্রতি সীমান্তের অনুভূতি দেখে। সে সীমান্তকে বলে,
“আপনে এখন যান। আমি কুসুমেরে আপনার বিষয়ে নেগেটিভ কিছু কমুনা।”
সীমান্ত অত্যন্ত খুশী হয় শিখার উপরে। কৃতজ্ঞতার চোখে তাকায় শিখার দিকে। পরক্ষণেই তার পরনের নীল সাদা চেকের লুঙ্গিটার এক অংশ কয়েক আঙ্গুলের ডগা দিয়ে একটু উপরে তোলে নেয়। এই লুঙ্গি মার্কেটে তখন ট্রেন্ডি। গ্রামের পড়ালেখা করা যুবক ছেলেদের হাল ফ্যাশন এই লুঙ্গি ও এভাবে হাঁটা। স্কুল, কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা এমন ছেলেদের উপরে ক্রাশ খেতো রিতীমতো। লুঙ্গি ধরে লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে চলে যায় সীমান্ত। শিখা আশ্চর্যের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায়। বলল মনে মনে,
তলে তলে কুসুম এতদূর সাইকেল চালায়া চইলা গ্যালো। আমি কিছুই কইতে পারুম না? সীমান্তর পরিক্ষা নিমু আমি। যাচাই করতে হইবো সেই কি আসলেই অন্তর দিয়া কুসুমেরে ভালোবাসে। তার পরেরটা পরে দেখা যাইবো।
শিখা কুসুমকে ভুল বোঝে না। সে জানে ভালোবাসার আরেক নাম আবেগ। পাগলামি। প্রেমিক যা শিখিয়ে দিবে তাতেই মস্তিষ্ক সায় দিবে। জগতের বাকি সব মিথ্যা! ভ্রম! কেবল ভালোবাসাই সত্যি। মনের মানুষটা সত্যি। পরেরদিন কেন্দ্রে দেখা হলেও শিখা কুসুমকে কিছুই বলে না। সে অপেক্ষা করে দেখতে চায় কুসুম কবে, কিভাবে তাকে শোনায় তার হৃদয়ের গল্প।
তালুকদার পরিবারের একমাত্র মেয়ের বিয়ে কৃষ্ণনগর গ্রামের সওদাগর বাড়ির তালেব সওদাগরের একমাত্র পুত্র মেরাজ সওদাগরের সঙ্গে। তাই তালুকদার বাড়িতে সাজ সাজ রব। শহর হতে চলে এলো জয়নুল তালুকদারের তিনপুত্র। বাড়িভর্তি অতিথিদের সমাগম। নিকটাত্মীয়ের নিকটাত্মীয়ও বাদ যায়নি দাওয়াত পেতে ও আসতে।
তালুকদার নিজে গায়ে হলুদের দুইদিন আগের এক বিকেলে মধুপুর গ্রামে চলে গেলো। নূরীকে দাওয়াত দিলো আলোর পরিবারসহ। ছোট পুত্রবধূ শিখাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো।
শিখা শ্বশুর বাড়িতে গিয়েই শাশুড়ী,ফুফু শাশুড়ী, চাচী শাশুড়ী, ও নানী শাশুড়ীকে পা ছুঁয়ে সালাম দিলো। বাকি সবার সঙ্গে নিজ থেকে যেচে যেচে গিয়ে কথা বলল।
সুফিয়া বিবি তাকে দেখেই তাচ্ছিল্যভরা কন্ঠে শুধালো,
“আইছ নি মাষ্টারি পাশ কইরা জমিদারের বেটি। ”
রানী ভাবমিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“হইছে যাও যাও। তোমার ইজ্জতের লাইগা রানী কান্দে না। এমনিতেও রানীর গুরুত্ব তোমার অনেক উপরে।”
সুমনা শাড়ির আঁচলে চাবির গোছা বাঁধতে বাঁধতে বলে উঠলো,
“আইছে এখন ভালো ভালো বিয়ার খাওন খাইতে। ফকিরনী! ”
ডলি বলে উঠল,
“যতই পড়াশোনা করো। তালুকদার ঘরে তোমার আগে আমি আইছি। কদর আমার নিচেই তোমার।”
আদুরীও তাকে দেখে নাক সিঁটকালো। বলল,
“হইছে। যাও। আমার বিয়া বইলা এত ভাব নেওনের কিছুই নাই আমার লগে। সওদাগর বাড়ির একমাত্র বউ হইতে যাইতাছি। বুইঝো।”
ফুফু শাশুড়ী জাহানারা উচ্চগলায় বলে উঠলো,
“কই থেইকা আইলা তুমি ব্যারিষ্টারি পাস কইরা? ঘরের কামে হাত লাগাইওয়ো বান্দিগো লগে।”
চাচা শ্বশুরকে সালাম দিতে গেলে সে মৃদু ধমকে উঠলো শিখাকে। এক লহমায় দুই পা লুঙ্গির নিচে আড়াল করে ফেলল। বলল,
” আমার সামনে যেনো তোমারে না দেখি। তুমি একটা ছোট জাতের মাইয়া। আমার পা ছোঁয়ার যোগ্যতা তোমার নাই।”
শিখা নির্বাক হয়ে গেলো। তার সঙ্গে সবার আচরণ ঠিক ছয়মাস আগের মতো রুক্ষ ও উপেক্ষিত। নিমিষেই শিখার বুক ভেঙ্গে কান্না এলো। সে ঘরের বাইরে চলে গেলো। রান্নাঘরের পিছনে বসে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো। না চাইতেও তার মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো,
“আম্মাগো…এরা খুব খারাপ। আম্মা তুমি না জ্ঞানী? বুদ্ধিমান? চালাক? তাইলে ক্যান এগো ঘরের বেডিগোরে চিনলা না আম্মা?এরা নিজেরা যত দুঃখ, যন্ত্রণার মধ্যেই থাউক না ক্যান, এদের মনের অহংকার টলে না আম্মা। এরা কোন মানুষের ব্যবহার দেয়নাই আমারে আম্মা। কীট প্রতঙ্গের মতন অবহেলা, অনাদর কইরা আচরণ করছে। একজন ত সালামও নেয়নাই। এই ঘরে টিকন যাইব না আম্মা। আমি চইলা আসুম একবারে। এর চাইতে আমার আলো আপায় অনেক ভালো আছে। শান্তিতে আছে। মায়াদয়ায় আছে। এরা প্রতি বাক্যে,ইশারায়, ইঙ্গিতে আমারে বুঝায়া দেয়,আমি গরিবের মাইয়া, ছোটলোক,নিচু। ফকির!”
রান্নাঘর থেকে শিখার কথাগুলো শুনতে পেলো মতির মা। সে বের হয়ে গেলো।
“রাজের বউ উইঠা আসো। মচকাইয়া গ্যালেত তোমার চলব না।”
শিখা হতভম্ব চোখে চায় মতির মায়ের দিকে। অশ্রুভেজা কন্ঠে বলে উঠে,
“খালা আপনে?”
“হ আমি। সব দেখছি ও শুনছি। বিষয়গুলা এমন, তুমি যে তালুকদারের কাছে নালিশ করবা, সে সুযোগ নাই। তখন হেরা কইবো, হ্যার কি পাতের ভাত কাইড়া নিছি? পিন্দনের শাড়ি খুইলা নিছি? ঘর থেইকা তাড়ায়া দিছি? কোন দুর্ব্যবহার করছি? চোখ মোছো মা। পুকুরে গিয়া হাতমুখে পানির ঝাপটা মাইরা দাও।”
রাজ বাজার থেকে সন্ধ্যার পর এলো। শিখা এসেছে এ খবর সে আগেই পেয়েছে। শিখাকে একটু দেখার জন্য সে উম্মনা হয়ে আছে। এদিক সেদিক খুঁজে পরে দেখলো শিখা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে উঠানের এককোণে।
“আমার প্রজাপতি কেমন আছো?”
শিখা চমকালো। জবাব দিল না। মুখ ফুটে কিছু বলল না। আরক্ত চোখে রাজের মুখপানে এক পলক চাইলো। পরক্ষনেই লাজরাঙা মুখটি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। রাজ বুঝে নিলো তাকে দেখেই শিখা আপ্লুত হয়ে গেলো। রাজ এক আঙুলের ডগা দিয়ে শিখার চোখের কোণ হতে এক ফোঁটা অশ্রু তুলে নিলো। বলল,
“অশ্রুটুকু মুছে ফেলো। বিরহের সময় কমিয়ে এক বছর করে ফেলব।”
রাজ দপদপ পায়ে চলে গেলো অন্যদিকে সাহেবি ঢংয়ে। শিখার মৌনোবেদনা কিছুটা লাঘব হলো রাজের মুখখানি দেখে ও কথা শুনে।
রাতে খেয়ে সবাই সবার মতো ঘুমিয়ে গেলো। শিখা কোথাও ঘুমানোর জায়গা পেল না। বিয়ের পর ঘুমানো রুমটায় গেলো। দেখলো সেখানে কয়েকটি মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। মতির মাকে বলল,
“খালা আমি কই ঘুমামু? এগোরে জিগানের সাহস পাই না? ”
“হায়রে কিসমত তোমার। কত মানুষ ঘুমাইলো। আর ঘরের বউ ঘুমানোর জায়গা নাই। আগাছারেও মানুষ একটু দাম দেয়। আর এইটাতো মানুষ। তুমি আগে যেই রুমে ছিলা,সেই রুমের খাটের এক চিপায় ঘুমায়া যাও। কি করবা। কও।”
শিখা খাটের একপাশে জানালা বরাবর চাপাচাপি করে শুয়ে পড়লো। ক্লান্তিকর চোখে ঘুম নেমে এলো। শেষরাতে শিখা তার বুকের উপর কোন পুরুষের বলিষ্ঠ হাতের স্পর্শ টের পায়। শিখা প্রথমে ভাবলো রাজ। তাই চিৎকার দিল না। আর ভয় পেল না পাশে আরো তিনজন ঘুমিয়ে আছে বলে। পরক্ষণেই সেই হাত বাজেভাবে স্পর্শ দিতে লাগলো শিখার বুকের উপরে। শিখা মুরগী ধরা চোরের ন্যায় খপ করে সেই হাত ধরে ফেলল। হাতের একটি আংটি খুলে নিলো নিজের হাতে। ছেড়ে দিলে হাতটি বাইরে চলে যায়। সে মাথা তুলে চাইলো। কিন্তু জানালার বাইরে কাউকে দেখতে পেলনা। শুধুই আবছায়া।
রাজবধূ পর্ব ২৫
পরেরদিন সকালে শিখা আংটির মালিককে গোপনে খুঁজতে লাগল। যখন আবিষ্কার করলো তাকে। তখন শিখা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। পিতার বয়েসী একজন মানুষের চরিত্র এত কদর্য! এত ভয়ানক!
কে এই পুরুষ? সে কি আদৌ বেঁচে থাকবে? নাকি খু*ন হবে? কে হবে সেই খু* নী? শিখা? রাজ? জুবায়ের? বাদশা? আমেনা? নাকি এর বাইরেও অন্যকেউ?