রাজবধূ পর্ব ২৯(২)

রাজবধূ পর্ব ২৯(২)
রেহানা পুতুল

খেয়া ভিডিও ক্লিপ অন করলো। দেখেই সে স্তম্ভিত! বাকরুদ্ধ! তার নাকমুখ দিয়ে তপ্ত ধোঁয়া নির্গত হতে লাগলো।
এই ভিডিও নেহাল রিমুভ করেনি? সে মিথ্যা বলেছে আমাকে? কিন্তু কলি কিভাবে পেলো এটা? এবার?
খেয়া মুহূর্ত দেরী করল না। কলি তার মাথা পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে। সে সদ্য দেশ ছাড়া তার কাজিন নেহালকে মেসেজ দিলো। ভয়েজ নোট দিলো একাধিক। কিন্তু নো রেস্পন্স। খেয়ার মরি মরি দশা। সে কলির হোয়াটসঅ্যাপেও ভয়েজ নোট দিলো। কলি ননদ আনুশকার রুমে পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে। রুমের দরজা চাপানো। খেয়ার ভয়েজ নোটটি প্লে করে হেডসেট দিয়ে শুনলো।
“কলি প্লিজ, বল তুই এই ভিডিও ক্লিপ কোথায় পেলি? কে দিলো?”
কলি ঠোঁট ভিড়িয়ে হাসছে।
খেয়ার গলার স্বর দুর্বল! নিরীহ! মিনমিনে! মনে হচ্ছে জেলখানার পালানো আসামি। কলি রিপ্লাই দিচ্ছে না খেয়ার। কারণ সে প্রয়োজন মনে করছে না। তার কাজ শেষ। এবার ডাঙায় তোলা মাছের মতো খেয়ার তড়পানো দেখবে সে। খেলারাম খেলে যা।

কলির হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জারে খেয়া ফোন দিয়ে বসলো। কলি রিসিভ করলো। নয়তো বজ্জাতটা দিতেই থাকবে। নেট অফ করারও সুযোগ নেই। নেটে তার কাজ আছে। কলি রিসিভ করে আনুশকার বারান্দায় গেলো। গ্রিল ধরে বাইরে দৃষ্টি রেখে খেয়ার সঙ্গে কথা বলছে। মাহমুদ বোনের রুমে গিয়ে দেখলো কলি নেই। বারান্দা হতে তার কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। মাহমুদ বারান্দার দরজায় গিয়ে একটু চেপে রইলো। যেন কলি টের না পায়। কলি কার সঙ্গে কথা বলছে?
“কলি প্লিজ তুই এই ভিডিও ক্লিপ কোথায় পেলি?”
“আমি যেখান থেকেই পাই। মেয়েটাতো তুই। নাকি বলবি এটা প্রযুক্তির ভেলকিবাজি?”
” বল না কে দিলো?”
“যার সঙ্গে তুই প্রতারণা করেছিস। যাকে ঠকিয়েছিস। যার বিশ্বাস নষ্ট করেছিস। যার ইমোশন নিয়ে খেলেছিস। যার সময়,অর্থ ও শরীরের ক্ষতি করেছিস। সেই দিলো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“নেহাল? আমার কাজিন?”
“ইয়েস সিস। ইয়েস।”
সপ্রতিভ কন্ঠে বলল কলি।
“সে তোকে কেন দিলো?”
“সেটা তোর পাক্তন বয়ফ্রেন্ড নেহালকে আস্ক করিস।”
“ওকেহ। বাট তুই আমাকে দিলি কেন?”
“এইতো। জায়াগামতে এসে গেছিস। এটাই টু দ্যা পয়েন্ট। আমি দিয়েছি তুই মাহমুদ স্যারকে যেন আর বিরক্ত না করিস।”
“এতে তোর এত লাগে কেন কলি?”
অবিনীত স্বরে জিজ্ঞেস করলো খেয়া।
“মাহমুদ স্যার আমার ক্রাশ। আমি মাহমুদ স্যারকে ভালোবাসি এবং অনন্তকাল ধরে বাসবো। তার ছায়ায় আমি কোন মেয়ের ছায়াও দেখতে চাই না।”

“মাহমুদ স্যার কি তোকে বিয়ে করবে?”
“শত কোটি বার করবে৷ করতে বাধ্য তিনি।”
“আমার মতো স্যারকেও ব্ল্যাকমেইল করেছিস মনে হয়? তুই তো দেখি ঠান্ডা মাথার ক্রিমিনাল। ”
অবজ্ঞার স্বরে বলল খেয়া।
কলি চট করে ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো। মাহমুদ খেয়ার কথা না শুনলেও কলির প্রতিটি রিপ্লাই সে শুনতে পেলো। কলি রুমে ঢুকতেই মাহমুদকে দেখে ভূত দেখার মতো ভড়কে গেলো। মাহমুদ পুরো দরজা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। কলি যেতে পারছে না।
মাহমুদ কলির একহাত ধরে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

“আমি তোমার ক্রাশ? আমাকে নিয়ে এত জেলাস? কই ভুলে কখনো একবারও তো বলনি আমাকে ভালোবাসো? অথচ খেয়াই হবে হয়তো, তাকে বললে আমার ছায়াতে কারো ছায়াও তোমার সহ্য হয়না। নাহ?”
কলি তীব্র সংকোচে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে পড়লো। চোখ মেলে তাকাবার জো নেই তার। মাহমুদ কলির হাত ধরে দাঁড় করালো। প্রায় টেনে নিয়ে গেলো নিজেদের বেডরুমে। কলির মাঝে পালাই পালাই ভাব। কলি দেয়াল চেপে দাঁড়ালো। মাহমুদ কলির দুহাত দেয়ালের উপর মেলে ধরলো। আঙ্গুলে আঙ্গুল গুঁজে নিলো। দুই জোড়া হাত, এক জোড়া হয়ে গেলো চোখের পলকেই। কলির স্বাস প্রশ্বাস বেড়েই চলছে।
“স্যার ছাড়ুন না। আর ইউ ক্রেজি? ক্রেজি ফর মি?”
“ইয়েস মাই লাভ! ক্রেজি ফর ইউ। আমাকে তুমি করে বলবে এবং ভালোবাসি বলবে। এক্ষুনি। এই মুহূর্তে। আমিও আর আপনি সম্বোধন করে কথা বলব না। ভার্সিটি গেলে একটু কেয়ারফুল্লি থাকলেই হবে দুজনের। সেমিস্টারও আর বেশি নেই।”

“পারব না।”
“নোও কলি। একবার বল, মাহমুদ আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
“স্বামীর নাম মুখে আনা নিষেধ। মুরুব্বীরা বলেছে।”
দুষ্টমিষ্ট কন্ঠে বলল কলি।
মাহমুদ কলির ঘাড়ে নিজের দু’ঠোঁট চেপে ধরলো। পেটে মৃদু চাপ দিয়ে বলল,
“ঠোঁট কিন্তু বেপরোয়া হয়ে উঠবে। এবং ক্রমশ নিচে নামতে থাকবে। সো বলো বলছি।”
“বাকি থাকুক স্যার। পরে বলব।”
“বাকির নামে ফাঁকি। আজ থেকে নো স্যার,নো আপনি। মাহমুদ এবং তুমি বলবে।”
কলি হাত ছাড়াতে পারছে না। মাহমুদ কলির পেটে, পিঠে সুড়সুড়ি দিতে লাগলে কলির হাসি চলে আসে৷

“বল, মুক্ত হতে হলে?”
“আহু! উঁহু! ছাড়েন না বলছি।”
মাহমুদ ছেড়ে দেয় কলিকে। কলি বিছানায় উঠে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে যায়। মাহমুদ লাইট অফ করে বেডে উঠে যায়। কলির কাঁথার নিচে ঢুকে পড়ে। কলি পিটপিট চোখে চায় মাহমুদের দিকে। মাহমুদ কলিকে জড়িয়ে ধরে। কলিই নিজ থেকেই মাহমুদের কানের কাছে হিসহিসিয়ে বলল,
“ভালোবাসি মাহমুদকে। জীবন দিয়ে ভালোবাসি।”
ওরেহ! আমার ফুটন্ত গোলাপ কলি। যেই ঠোঁট দিয়ে এই ভালোবাসি শব্দটি উৎসারিত হয়েছে। সেই মিষ্টি ঠোঁটজোড়াকে নিবিড়ভাবে আদর করে দিতে চাই। কলি বলল,
“উঁহু! নাহ ব্যথা!”
” ব্যথা দিব না। যত্ন করে আদর করবো। ”
বলে কলির অধরযুগল মাহমুদ নিজের মুখে পুরে দিলো। তার অবাধ্য হাত উম্মাতাল খেলা করে যাচ্ছে কলির বুকের উপরে। কলি, উঁহু ব্যথা পাচ্ছি তো বলে উঠলো। মাহমুদ হাত থামিয়ে দিলো। নিজের ঠোঁটজোড়া সরিয়ে নিলো।
কলিকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার ডায়াবেটিস আছে কলি?”
“নাতো।”
ভ্রু কুঁচকে বলল কলি।

“তাহলে ডায়াবেটিস রোগীর মতো এত ব্যথা ব্যথা করে কেনো? হাতটা দিব কই? বলে দাও?”
“কোথাও দিতে হবে না। বেশরম পুরুষ আপনি।”
” লজ্জা নারীর ভূষণ। পুরুষের নয়৷ লক্ষ বার হাত দিতে হবে৷ কি সুন্দর রজনী। একই কাঁথার নিচে মিশে আছে দুটো হৃদয়। দুটো শরীর। অথচ সেই দুটো দেহের আলিঙ্গন হবে না। আঙ্গুল আঙ্গুলে ঠোকাঠুকি হবে না। তা হয় না।”
বলে মাহমুদ কলির পেটের উপর হাত বুলাতে লাগলো আলতো করে। বলল,
” আচ্ছা কলি, আমরা বাবু নিবো কবে?”
কলি লজ্জায় উপুড় হয়ে মুখ বালিশে গুঁজে ফেলল।
“ওরে লজ্জাবতীরে। ওকে টপিক চেঞ্জ।খেয়া কেন ফোন দিলো কলি?”
কলি বলল,
“একটা নোটের বিষয়ে হেল্প চেয়ে ফোন দিলো।”

মাহমুদ কথা বাড়ালো না। কারণ সে বুঝলো, কলি তার কাছ হতে কিছু গোপন রাখতে চায়। কলির চাওয়া,ইচ্ছার গুরুত্ব তার কাছে অধিক।
ভার্সিটিতে কলির ক্লাস থাকে তিনদিন মাত্র। তাই সে বাকিদিনগুলোতে প্রায় পুরোদিন সময় দিতে পারে তাদের দোকানে। যদিও এতে বাসায় টুকটাক হলেও সমস্যা হচ্ছে। এসব কলি বুঝে। তবুও তার কিছুই করার নেই। তার বাবা,মা,বোন,পরিবারের ঢাল হয়ে তাকে দাঁড়াতেই হলো।
এমন এক বিকেলে কলি শ্বশুর, শাশুড়ী, ননদকে নিজেদের দোকানে নিয়ে গেলো। ইচ্ছেমতো খাওয়ালো। আবদুর রহমান পিতৃসুলভ কন্ঠে বললেন,
“হয়েছে মা। এভাবে নিজের মানুষদের খাওয়াতে থাকতে ব্যবসা চলবে না মা।”
কলি আন্তরিক হাসলো। কন্ঠে কৃতজ্ঞতা ঢেলে বলল,
” বাবা,আপনারা সবাই আমার পরিবারের জন্য যেই সাপোর্ট দিয়েছেন, তার ঋণ অপরিশোধযোগ্য।”
“এত নমনীয় করে বলতে হবে না ভাবি। এটা আমাদের কর্তব্য। তুমি আমাদের পরিবারের একজন। তো সেই একজনের ভালোমন্দ আমরা দেখব না। বলো?”
বলল আনুশকা।
কলি আনুশকাকে জড়িয়ে ধরলো ভালোবাসায়।

সেদিন রাতে কলি একথা ওকথা প্রসঙ্গে মাহমুদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। মাহমুদ কলির দু-চোখের পাতায় কোমল চুমু খেলো। উদাস গলায় বলল,
“#তোমার_জন্য_সব করতে পারি আমি কলি। সব। যেদিন বাইক এক্সিডেন্ট করেছি। সেদিনই আমি টের পেলাম, এই কলি মেয়েটাই আমার একলা জীবনের সঙ্গী হওয়ার জন্য যথেষ্ট। নিকষ কালো আঁধারেও যার হাত ধরে আমি পৌঁছে যাব দূর দিগন্তে। পাড়ি দিতে পারি সাত সমুদ্র তেরো নদী। অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করলে ভার্সিটিতে জানাতাম। স্যারদেরকে ইনভাইট করতাম অবশ্যই। কিন্তু তুমি চাও না বলেই হাইড করে যাচ্ছি।”
স্যার, বলে কলি মাহমুদের হাঁটুর নিচে বসে পড়ল। কপাল ঠেকিয়ে ধরলো মাহমুদের হাঁটুতে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। বলল,
“আমিও আপনার জন্য সব করতে পারি। সব।”
“সব লাগবে না। উঠো। আপাতত রাতের আনন্দটুকু দাও। এই প্রমাণ পেলেই আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখি মানুষ। আজ কোন ব্যথা শুনব না।”
মুচকি হেসে বলল মাহমুদ।

সেই নিস্তব্ধ নিশিতে কলি মাহমুদের সুখের বাধা হয়ে রইল না। সমস্তই উজাড় করে দিলো। যেমন করে অকাতরে সব বিলিয়ে দেয় প্রকৃতি মানুষকে। মাহমুদও সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে এতটুকু পিছপা হলো না।
নিসংকোচে, নিলজ্জায়, নিদ্বিধায় সারারাত্রি ধরে কলির সবটুকু নির্যাস আস্বাদন করলো মধুপিয়াসী ভ্রমরের ন্যায়।
তার পরের একদিনের ঘটনা। কলি ভার্সিটিতে গেলো। খেয়াও এলো। গত সপ্তাহে খেয়া ভার্সিটিতে এল না । কলি তাকে এভাবে জব্দ করবে এটা তার কল্পনাতীত ছিলো। তাই তার গোটা শরীর ও মন অসাড় হয়ে ছিলো। ক্লাস শেষে খেয়া কলিকে ডাকলো। বলল,
“নেহালকে পাচ্ছি না জানতে। তুই বল কখন,কিভাবে, কেন সে এই ভিডিও ক্লিপ তোকে দিলো?”
“এটা বলার মুড নাই এখন। পরে অবশ্যই বলল। ডোন্ট ওরি।”
“তাহলে এটা বল,আমাকে যে মাহমুদ স্যারের পিছু ছাড়তে বললি,তুই কি সত্যি স্যারকে লাভ করিস? সেদিন রাতে তোর বলাগুলো মনে হলো মিথ্যা।”

“সত্যি হলে কি করবি?”
আত্মবিশ্বাসী সুরে বলল কলি।
“তুই প্রমাণ দিতে পারলে স্যারকে আর চাইব না।”
“আয় আমার সঙ্গে”
মাহমুদ চেয়ারে বসে আছে। রুমের ভিতরে এলো কলি ও খেয়া। কলি দরজা চাপিয়ে দিলো।
“কি ব্যপার কলি, খেয়া? আপনারা দুজন একসঙ্গে?”
খেয়া চুপটি করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। কলি মাহমুদের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাহমুদের গলা পেঁচিয়ে ধরলো দুহাত দিয়ে। মুখ ঝুঁকিয়ে মাহমুদের একগালে গাঢ় চুমু খেলো। বলল,
“স্যার, আমি আপনাকে ভালোবাসি, এটার প্রমাণ পেলেই খেয়া আপনাকে ভুলে যাবে।”

রাজবধূ পর্ব ২৯

মাহমুদ নিমিষেই উঠে দাঁড়ালো। কলির দু’গাল চেপে ধরে ঠোঁটে চুমু খেলো। খেয়ার দিকে মুখ তুলে চাইল মাহমুদ।
খেয়ার মুখাবয়বে একরাশ কাঠিন্যতা ও অসিহষ্ণুতা ভর করলো। তার কর্ণকুহরে যেন উত্তপ্ত সীসা ঢেলে দিলো মাহমুদ নিজের হাতেই। সে দুপদাপ পায়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে।
কলি মনে মনে বলল,
ভালোবাসা সত্যি হলে প্রয়োজনে অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয়। আশাকরি আমার কড়াডোজে এবার তুই খেয়া সিধা হয়ে যাবি। হৃদয় দিয়ে হৃদয় কিনেছি। কারো ছিনিয়ে নেওয়ার সাধ্যি নেই।

রাজবধূ পর্ব ৩০