রাজবধূ পর্ব ৩৫

রাজবধূ পর্ব ৩৫
রেহানা পুতুল

তারপর এক সন্ধ্যায় মতির মা কন্ঠকে খাদে নামিয়ে সুফিয়া বিবিকে বলল,
” ভাবি অভয় দিলে কিছু কথা কইতাম বাদশার হইয়া।”
“বাদশার হইয়া তুই কিছু কইতে হইবো ক্যান? বাদশা কইলে সমস্যা কি?”
চমকিত চোখে অবাক কণ্ঠে বলল সুফিয়া বিবি।
“বাদশা কইতে পারব না দেইখাই তার বদলে আমারে কইতে অনুরোধ করলো।”
“ওরে বাবুরে! কি এমন অমূল্য কথা বাদশার, লোক লাগাইয়া কইতে হয়। হুনিতো।”
তখন মতির ঠান্ডা গলায় বলল,

“ভাবিসাব আগে আমার সকল কথা হুনেন বাদশার তরফ হইতে। পরে আপনে যা কওনের কইয়েন। বাদশা ও ফুল দুইজন দুইজনরে বেবাক পছন্দ করে। বাদশা মা হারাইয়া রাতদিন শোকে ডুইবা থাকে। এদিকে ফুল মাইয়াটারও বলার মতো দুনিয়ায় কেউ নাই। আপনাদেরও লোকবল কইমা গ্যাছে। ছোট তালুকদার মরণ মানে আপনাদের অর্ধেক মনোবল নষ্ট হইয়া গ্যাছে। বাদশা ফুলেরে বিয়া করলে তার মনমেজাজও ভালো থাকবো। আপনাগো উপর ম্যালা খুশী হইবো। তখন বাড়ির অন্দরে বাহিরে সকল কাজ সে ভালোমতে করবো। নয়তো আপনারাই লোকসানে পইড়া যাইবেন। বাদশা শরম পায় বইলা তার মায়ের বদলে আমারে কইতে কইলো আপনারে। আর আমিও চিন্তা কইরা দেখলাম ব্যাপারটা মন্দ হয় না। ওই দেরী করতে চায় না। আপনাগো মত থাকলে সামনের সপ্তাহে বিয়ার কাজ সাইরা ফেলতে চায়। আপনে ভাইসাহেবের লগে আলাপ পাইড়া দেইখেন। এই ভিতরে আরেকটা কথা স্মরণ কইরা দিই ভাবি। আপনাগো পরিবারে পিরিতের বিয়া নিষেধ। কিন্তু বাদশা, ফুল আপনাগো কামের ঝি,পোলা। ঘরের কেউ না। পর কেউ।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বাদশার মতো তালুকদার পরিবারের বিশ্বস্ত আরেকজন হলো মতির মা। বিয়ে নিয়ে তার যুক্তিখণ্ডন সুফিয়ার মনঃপূত হলো। সে বলল,
“বিবাহ সাদী ফরজ কাম। উপযুক্ত পোলা মাইয়া বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হইতে চাইলে তাতে সায় দেওন উচিত,যদি অন্যগো কোন ক্ষতির সম্ভাবনা না থাকে। তুই বাদশারে পাঠা আমার কাছে। যা।”

মতির মা যুদ্ধ বিজয়ী সেনার মতো হাসিমুখে সুফিয়ার কক্ষ ত্যাগ করলো। বাদশা কাচারি ঘরের চৌকিতে শুয়ে আছে। তার সিদ্ধান্তের একটা বিষয় হলো যত দ্রুত ফুলকে তার ঘরে তোলা যায়। বাকিটা হলো সে যতদিন বাঁচবে তালুকদার বাড়ির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। এবং তাকে দেওয়া দুটো জমির একটা বিক্রি করে দিবে। তবে এখন নয়। আগে বিয়েটা হয়ে যাক। জমি দেখিয়ে বিয়ের জন্য সে আরো ঋণ করবে। পরে জমি বেচা টাকা দিয়ে মায়ের অসুখের সময় করা দেনা শোধ করবে। বাড়িতে বেড়ার ঘর ভেঙ্গে নতুন ফুলটিনের চৌচালা ঘর তৈরি করবে। সেখানে তার আর ফুলের ছোট্ট একটি সংসার হবে। বাকি জমিতে সে নিজেই তদারকি করে ইরি ধান ফলাবে। সেই ধানের চাল দিয়ে তাদের টোনাটুনির বছর কাবার হয়ে যাবে। ফুল ঘরের আঙিনায় নানারকম টাটকা শাকসবজি ফলাবে। সে পুকুর থেকে জাল দিয়ে মাছ ধরবে। সেই মাছ দিয়ে ফুলের হাতে করা সবজির সালুন হবে। ফুলকে মেলা থেকে কিনে দেওয়া তালপাতার পাখাটা দিয়ে তাকে বাতাস করবে। সে প্রাণ জুড়িয়ে খাবে। মাঝে মাঝে ফুলকেও খাইয়ে দিবে তার হাতে।

মতির মা কাচারি ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে পা রাখলো।
“বাদশা কইরে, তোর দরখাস্ত পাশ কইরা দিয়া আইলাম। তোরে ডাকছে ভাবি। উইঠা যা।”
বাদশা বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে আনন্দে। উৎসুক গলায় বলল,
“চাচী সত্য কইতাছো? কিছুই কইনাই বড় চাচী? নারাজ হয়নাই? ধমক দেয়নাই?”
“এসবের কিছুই হয়নাই। আমি পরিষ্কার কইরা সব বুঝায়া কইলাম আর বুঝলো। কইলো তোরে পাডাইতে তার কাছে। আমি যাই। কাম আছে আমার।”
মতির মা চলে যায় রান্নাঘরে। চৌকিতে বসে সব ফুলকে জানায়। ফুল লজ্জাবনত হয়ে মাথা ঝুঁকে থাকে।
বাদশা অপ্রস্তুত হলেও উৎফুল্ল মনে সুফিয়ার কক্ষে যায়। সুফিয়া বাদশাকে জিজ্ঞেস করে সত্যতা যাচাই করে নেয়।
সে বাদশাকে আস্বস্ত করে বলে,

“ঠিক আছে, ঘরের বাকিগোরে আমি জানামুনি। তুই বিয়ার প্রস্তুতি নে। দুলহা সাইজা তোর বাড়ি থেইকা আইবি। এই বাড়ি থেইকা বউ নিয়া যাইবি তোর বাড়ি। তাইলে বিয়া বিয়ার মতই সোন্দর হইবো।”
বাদশা সুফিয়াকে কদমবুসি করলো। তার চরণধূলিও মাথায় নিতে ভুল করল না। কৃতজ্ঞতার চোখে চেয়ে পিছন হেঁটে বিদায় নিলো সে। উঠানে আবছায়ায় দাঁড়িয়ে নিজের কাঁধ ঝাঁকায় বাদশা। চলে যায় কাচারি ঘরে তার বিছানায়। বরকতকে নিজের বিয়ের কথা জানায় সগৌরবে।
বরকত সহজ গলায় বলল,
“বিয়া মানেই অশান্তির আখড়া! মারামারি! ঝগড়াঝাটি। এমনকি খু * না * খু * নিও। কত দেখছি এমন।”
“আইচ্ছা। তাইলে তুই আমার আর ফুলের বিয়া খাইস না।”

মুখ টিপে একটু হেসে বলল বাদশা।
“বিয়া খাইতে মানা নাই। বিয়া খামু।”
সেইরাতে বাদশা সোনালী স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায় তার ফুলকে নিয়ে।
রাজের অফিসের ঠিকানায় শিখার চিঠি পোঁছে যায়। রাজ হাতের কাজ রেখে চিঠির খামের মুখ ছিঁড়ে নেয়। দু’চোখ ভর্তি আকুলতা নিয়ে চিঠি পড়তে থাকে,
“আসসালামু আলাইকুম,

কেমন আছেন আপনি? আমি আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। আম্মা, আপা দুলাভাইও ভালো আছে। আপনাদের বাড়ির সবাই কেমন আছে জানাবেন? বাদশা আর ফুলবানুর বিয়ার দাওয়াত পাইলাম। সামনের শুক্রবার বিয়া। সে নিজে আইসা বইলা গেলো। কোনরকম বিয়ার কাজ সারছে। সারুক। তাই আমি ও আম্মা কেউই যামু না। যদিও বিয়াসাদিতে ফূর্তি করতে আমার ম্যালা শখ। আপনেও মনে হয় আইবেন না। আপনার মতো আমি চিঠির ভাষা জানিনা। কবির ভাষাও জানিনা। এখন ব্যাকরণ দেখে দেখে শেখার চেষ্টা করতাছি। কোনরকম একটা কবিতা লিখছি। হাসবেন না কিন্তু।

“তুমি ভ্রমর আমি ফুল/ তুমি ছাড়া নাই কূল।
তুমি মেঘ আমি বৃষ্টি /তুমি আমায় করো সৃষ্টি।
তুমি ভোর আমি কুয়াশা/তুমি আমার ভালোবাসা।
তুমি শীত আমি ফাগুন/তুমি বরফ আমি আগুন।”
ওহ! আরেকটা খবর, আমার একটা সাদা মুরগী আছে। সে ফুটফুটে অনেকগুলো বাচ্চা জন্ম দিয়েছে। অনেক সুন্দর। আপনার মতো আমার ক্যামেরা থাকলে ছবি তুলে পাঠাইতাম। ভালো থাকবেন। নিজের যত্ন নিবেন। সময়মতো খাওয়া দাওয়া করিবেন। বেশীরাত বাইরে থাকবেন না। জেগেও থাকবেন না। যদিও আমি আপনার ব্যবসা সম্পর্কে কিছুই জানি না। আর বিশেষ কি লিখবো। বাড়ি আসলে দেখা হবে।
ইতি ____কারো দুষ্ট প্রজাপতি ”

চিঠি পড়া শেষে রাজের মিশ্র অনুভূতি হলো। মুরগীর বাচ্চার গল্প শুনে সে হাসলো আপন মনে। এটাও চিঠিতে বলতে হয়? বড্ড ছেলেমানুষ তার বালিকাটা। সাধু ও চলিত ভাষার রূপ দেখেও হাসলো সে।
বাদশার বিয়ের বিষয়ে ইতঃপূর্বেই সে অবগত হয়েছে। এতে তার কোন আপত্তি নেই। তার দেয়া প্রজাপতি নামটা শিখা সাদরে লুফে নিয়েছে। ভেবে পুলকিত হলো তার প্রেমিক হৃদয়।
কিন্তু সাবলীল শব্দের গাঁথুনিতে রোমান্টিক কবিতাখানার শেষ চরণ তার মনে ভাবান্তরের উদ্রেক ঘটালো। শিখা কি সত্যি তার জন্য কোন একদিন আগুন হয়ে উঠবে? সেই আগুনের তাপে তার জীবন পুড়ে ছাঁই হয়ে যাবে? অবশিষ্ট বলে কিছুই রইবে না? বরফ আগুনে পড়লে আগুন নিভে যায় না। ছলকে উঠে আরো। রাজ মনে মনে আরেকবার চরণটি আওড়ে নিলো,

‘তুমি শীত আমি ফাগুন/তুমি বরফ আমি আগুন।’
অফিসের পিয়নের আগমনে রাজের ভাবনা স্থায়িত্ব লাভ করল না। এবং সেটা পরে আর মনেও রাখল না সে। শিখার সুপ্ত হিয়ার অনুভূতির সুনিপুণ পংক্তিমালাকে এভাবে জটিল করে দেখা নেহাৎ অবিচার হচ্ছে।
জৈষ্ঠ্য মাস মানেই রসালো মাস। অর্থাৎ মধুমাস। নানান সুমিষ্ট বাহারি ফলের সমারোহ সবার বাগান ও ঘরজুড়ে। এমন মধুমাসের এক কড়া রোদ্দুরের ঝাঁঝকে উপেক্ষা করে বাদশা সজ্জিত বেবিট্যাক্সি করে বর সেজে এলো উজানপুর গ্রামের তালুকদার বাড়ি। মুসলিম রীতি অনুযায়ী সব আনুষ্ঠানিকতা মেনে বিয়ে করে নিলো তার ফুলকে। আয়োজন হলো ঘরোয়াভাবে। আদুরী ও তার ফুফু জাহানারা এলো বাদশার বিয়েতে। ফুলকে কনের সাজে সাজাতে কিছুই বাকি রাখলনা মতির মা,তার মেয়ে জোছনা ও অন্যরা। সাধারণভাবে হলেও বিয়ের প্রতিটি ধাপ তারা সম্পন্ন করেছে। বাটা হলুদ, বাটা মেহেদী লাগিয়ে গায়ে হলুদও করেছে ফুলের।

কাচারি ঘরের সামনের গেইট সাজানো হয়েছে। ফুলের হয়ে কনে পক্ষের খরচ সব তালুকদার পরিবার বহন করেছে। বর পক্ষের খরচ বাদশা বহন করেছে। স্বইচ্ছায় বিয়ের উকিল মা সেজেছে মতির মা জামিলা। সেদিন সন্ধ্যায় বাদশা ফুলকে নিয়ে তার গ্রামে চলে যায়। তার রুমকে সাজানো হলো কৃত্রিম ফুল ও জরির মালা দিয়ে। বাড়ির মুরুব্বিরা ফুলকে বরণ করে নিলো ধানের ঢালা ও দূর্বাঘাস দিয়ে। তখন গ্রামীন প্রথায় এটা প্রচলিত ছিলো। নতুন বউ স্বামীর ঘরে লক্ষী নিয়ে পা রাখবে।
বাদশা ও ফুলের বাসর হয়ে গেলো। ফুলের পক্ষ থেকে কোন মানা হলো না। যদিও সংকোচ ও জড়তা বিরাজ করলো তারমনে। সারা রাতভরে বাদশা তার ফুল হতে আকণ্ঠ সুধা পান করলো। নিংড়ে নিলো ফুলের সব মধু। রাত্রির শেষ প্রহরে বাদশা ফুলকে বুকে জড়িয়ে বলে,

“ফুল তোমাকে আমি পামুই। এটা নিশ্চিত ছিলাম। কেমন লাগছে?”
“আমি ডরে ছিলাম। এখনো সব কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। বাস্তব মনে হয় না। যেন নেশার ঘোরে আছি আমি। হেরা যে সহজেই মাইনা নিব আমাগোরে,এইটা চিন্তাও করতে পারিনাই।”
আদুরে গলায় নিচু স্বরে বলল ফুল। বাদশা ফুলের উদাম পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“পরিস্থিতি তাদেরকে বাধ্য করছে সহজে মাইনা নিতে। বুঝলা। নইলে জিন্দেগীতেও তারা এইটা মাইনা নিত না।”
“কোন পরিস্থিতি?”

“এই যে কর্তা মিয়া তালুকদারের বিদায়। তার আগে রাশেদ ভাইর বিদায়। তারা বিপদে পইড়া গ্যালো না?”
“ওহ বুঝলাম। আইচ্ছা কে মারলো উনার মতো বলবান ব্যাটারে? আপনে কোন ধারণা কইরতে পারবেন?”
“হ পারুম। উনার কোন শত্রু হইবো। আবার বন্ধুও হইতে পারে। স্বার্থে আঘাত লাগলে বন্ধুও বন্ধুর গলায় ছুরি চালাইতে দুইবার ভাবে না।”
“আল্লাগো কন কি? হুইনাই আমার গায়ে কাঁটা দিয়া উঠলো।”
“বাদ দাওতো ফুলবউ। বাসর রাইতে খু* ন খারাবির গল্প বাদ।”
ঢুলু ঢুলু চোখে বাদশা ও ফুল গলাগলি করে সুখনিদ্রায় তলিয়ে গেলো।

বাদশা, তার ও ফুলের জন্য তিনদিনের ছুটি নিয়েছে। তারপর হতে তারা স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে ভোরে তালুকদার বাড়ি চলে আসে। সমস্ত কাজ শেষে সন্ধ্যার পর একসঙ্গে বাড়ি ফিরে দুজন। সারাদিন আগের মতই এখানেই খায়। রাতে যাওয়ার সময় সুফিয়ার আদেশক্রমে মতির মা দুজনের ভাত দিয়ে দেয় টিফিনবক্সে।
বাদশা চুপিচুপি একটা জমি বিক্রি করে ফেলল। তার সব ঋণ শোধ করলো। মনমতো পূর্বের ঘরের ভিটায় নতুন ঘর তৈরি করলো। ঘরের সামনের ও পেছনের সিঁড়ি পাকা করলো। বাকি টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রাখলো। প্রয়োজনে কাজে লাগবে। নতুন ঘরের টাকা কোথায় পেলো? সবার এই জিজ্ঞাসার জবাব বাদশা অকপটে দিলো। তালুকদার তাকে ভালোবেসে দান করেছে। কারণ তালুকদার পরিবারের তার অবদান অনেক। সবাই বাদশার মুখের কথা বিশ্বাস করে নেয়।

পরিক্ষার তিনমাস পর ঊনিশশো একানব্বই সালের এসএসসি পরিক্ষার ফল প্রকাশ হলো জাতীয় পত্রিকায়। হকারদের পত্রিকা বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। প্রতিটি পরিক্ষার্থীর পরিবার পত্রিকা কিনছে হুমড়ি খেয়ে। নূরী এগারোটার দিকে বাড়ির এক ছেলেকে পত্রিকা কিনতে চৌরাস্তায় পাঠিয়ে দিলো।
শিখা রেজাল্ট জানার জন্য স্কুলে চলে গেলো। কুসুমও এলো। কুসুমের সারামুখ জুড়ে উৎকণ্ঠার গভীরছাপ। সব সহপাঠীরা একত্রে জড়ো হলো লাইব্রেরীর সামনে। মাষ্টারদের বড় টেবিলের উপরে একাধিক জাতীয় পত্রিকা রাখা। শিখা ইনকিলাব পত্রিকাটি টেনে নিলো। কুমিল্লা বোর্ডের মানবিক বিভাগের রেজাল্ট দেখতে লাগলো সে রোল নাম্বার মিলিয়ে। শিখা হায়ার সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছে এক বিষয়ে লেটারসহ। নিমিষেই তার মুখ দ্বীপশিখার ন্যায় প্রজ্বলিত হয়ে উঠলো।

কজন শিক্ষক গর্বের সুরে বলে উঠলেন,
” অত্যন্ত ভালো রেজাল্ট করেছো তুমি। সামান্য মার্কের জন্য প্রথম হওনি। ব্যাপারনা। তোমার বরকে বলবে আমাদের মিষ্টি খাওয়াতে। তোমার আম্মাতো মিষ্টি না খাইয়ে ফাঁকি দিলো আমাদের। কলেজে ভর্তি হয়ে যেও। তুমি আমাদের একানব্বই ব্যাচের ভালো ছাত্রীদের একজন। মানবিক বিভাগেই থেকো। তাহলে ভালো করবে।”
শিখার চোখ ভিজে উঠলো। নিমিষেই সবচেয়ে রা* গী কাশেম মাষ্টার শিখার কাছে এগিয়ে এলেন। মাথায় আশীর্বাদের পরশ বুলিয়ে দিলেন। অন্য মাষ্টারদের উদ্দেশ্যে বললেন,
“শিখা নিম্নবিত্ত পরিবারে মেয়ে। ছোটবেলায় ওর বাবা মারা যায়। ওর মা বহু কষ্ট করেছে মেয়েকে এই পর্যন্ত আনতে। ক্লাস সিক্স থেকে ওর বেতন মওকূপ ছিলো।”

সবাই প্রীতচোখে শিখার দিকে চাইলো।
লাইব্রেরির বাইরের দেয়ালে রেজাল্ট শীট ঝুলানো রয়েছে। অন্য ছাত্রীরা নিজেদের রোল নাম্বার খুঁজছে পাশ তালিকায় দুরুদুরু বক্ষে। কুসুমও তার রেজাল্ট দেখছে প্রবেশপত্রের রোল নাম্বার মিলিয়ে। কুসুম ৩য় স্থান লাভ করেছে। মানে থার্ড ডিভিশন। তবুও তার খুশীর সীমা নেই। কারণ সে পড়াশোনায় ভালো ছাত্রী নয় শিখার মতো।
কুসুম শিখাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলো।
“শিখা, সই, আমি পাশ করছি রে। আমি পাশ করছি।”
“দেখলাম। একটু মন দিয়া পড়লে ত সেকেন্ড ডিভিশন পাইতি।”
কুসুমের মাথায় গাট্টা মেরে বলল শিখা। কুসুমও একই কাজ করলো শিখার সঙ্গে।
“তুইও আরেকটু মনোযোগী হইলে প্রথম স্থান অধিকার করতি।”

“আমি ত পারি নি বিয়ার লাইগা?”
“আমিও পারিনি প্রেমের লাইগা। প্রেমের মরা জলে ডুবে না।”
শিখার কৌতুহলপূর্ণ চাহনি নিবদ্ধ হয় কুসুমের মুখের উপরে। কুসুম শিখাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় মাঠের শেষপ্রান্তে। বসে পড়ে একটি প্রাচীন বটবৃক্ষের ছায়াতলে। শিখার কিছুই জিজ্ঞেস করতে হলো না কুসুমকে। কুসুম নিজ থেকে হড়বড়িয়ে সব উগরে দিলো শিখার কাছে।
শিখা চমকিত চোখে বলল,
“ডুবে ডুবে এত জল খাইলি, আমারে কইলি না ক্যান?”
“আরেহ সই, তার ভালোবাসা কতটা বিশুদ্ধ, এটা বুঝার অপেক্ষায় ছিলাম। তাই কইনাই তোরে।”
“কতটুকু বিশুদ্ধ কুসুম?”

এই প্রশ্নের প্রতুৎত্তরে সীমান্তর প্রতি কুসুমের যেই প্রেম উপলব্ধি করলো শিখা। তাতে সে স্তম্ভিত! তার সঙ্গে করা ভুলের জন্য সীমান্তকে অল্পস্বল্প শিক্ষা দেওয়ার যে অভিপ্রায় পুষেছিলো এতদিন। তা নিমিষেই কর্পূরের ন্যায় উবে গেলো। ক্ষমা মহৎগুন। তার বাল্যকালের বন্ধু কুসুমের দিকে চেয়ে সীমান্তকে ক্ষমা করে দিলো শিখা।
“তুই আমার ফুফাতো জা হইবি।”
অকস্মাৎ শিখার এমন বাক্যে কুসুম তব্দা খেয়ে গেলো। শিখা কুসুমকে সীমান্তের সঙ্গে তার সম্পর্কের পরিচয় তুলে ধরলো। এতে কুসুম প্রায় লাফিয়ে উঠলো। শক্ত করে শিখার গলা পেঁচিয়ে ধরলো খুশিতে আত্মহারা হয়ে।
“যাইরে কুসুম। আমার আম্মা অপেক্ষা কইরা আছে আমার জন্য। তুইও বাড়িত যা। কোন কলেজে ভর্তি হইবি জানাইস।”

দুই বান্ধবী চলে যায় দুই গ্রামের দিকে।
শিখার রেজাল্ট অফিসে বসেই পত্রিকার মাধ্যমে জেনে গিয়েছে রাজ। এর আগে বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় সে রোল নাম্বার নিয়ে গিয়েছিলো শিখার। সে শিখাকে সারপ্রাইজড দিতে চায়। কিভাবে দিবে এমন জল্পনা কল্পনা শেষে মনঃস্থির করলো স্বশরীরে শিখার সামনে চলে যাবে। তাই আজ রাতেই গ্রামে গিয়ে পৌঁছাতে চায় সে। যেই ভাবা সেই কাজ। ব্যস্তসমেত হয়ে গ্রামে আসার প্রস্তুতি নিতে লাগলো অফিসের কাজকর্ম গুটিয়ে।
ঠিক সেদিন বিকেলেই তালুকদার বাড়ির ঘরের সামনে অনেকটা হুমড়ি খেয়ে পড়লো এক কিশোর ছেলে।
হাঁফাতে হাঁফাতে সে বলল,

“চাচী, ও চাচী.. মীর বাড়ির লগে আপনাগো ধানের জমি দখল দিতাছে কারা জানি।”
সুফিয়া বেগম ঝাঁঝালো ও বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“ওই পোলা তোর কি মাথা নষ্ট হইছে? কয়দিন আগেই ত আমাদের ধান কাইটা আনলো এই জমি থেইকা? খালি জমিন কোন জানোয়ারের দল দখল দেয়?”
“চাচী আল্লার কিরা। বাদশা ভাইরে পাঠান আমি মিছা কইলে।”
তখন বাদশা এগিয়ে এলে সুফিয়া তাকে বলল,
“ওই বাদশা, এ কি কয়? যাতো। কি সমস্যা দেইখা আয়।”

রাজবধূ পর্ব ৩৪

“আমি যাইতাছি বড় চাচী। আপনে মাথা ঠান্ডা রাখেন। সমস্যার সময় মাথা গরম করলে ফলাফল ভালো না হইয়া খারাপ হয়।”
আত্মবিশ্বাসী সুরে দৃঢ় গলায় বলল বাদশা।

রাজবধূ পর্ব ৩৬