রাজবধূ পর্ব ৩৯

রাজবধূ পর্ব ৩৯
রেহানা পুতুল

সে হেঁটে পথের একপাশ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তখনই তার পাশে এসে দাঁড়ালো জুবায়ের। শিখা পা থামালো। থতমত গলায় সালাম দিলো তাকে।
“ভাইয়া আসসালাম আলাইকুম। কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম শিখা। ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? এই কলেজে তুমি ভর্তি হলে?”
” হ্যাঁ ভাইয়া। এইতো আছি মোটামুটি। আপনে এইখানে ক্যান?”
জুবায়ের প্রাণখোলা হাসি ছড়িয়ে বলল,

“এই জায়গায় আসলে তোমার সমস্যা?”
“না তাই হইবো ক্যান? এই জায়গা কি আমার নাকি? এইটা সরকারি রাস্তা। সবাই চলাচল করতে পারে।”
“তোমার হলে কি আমার প্রবেশ নিষেধ?”
শিখা ঠোঁট কামড়ে ফেলল নিজের কথার জন্য। বলল,
“আরেহ না। তা হইবো ক্যান।”
“হুম। আসো তোমাকে রিকশায় তুলে দিই। একাই যাতায়াত করো? আমি এদিকে এক বন্ধুর বাসায় আসছিলাম। তোমাকে দেখেই এগিয়ে এলাম। খালাম্মা কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আম্মা ভালো আছে। আমি একাই আসি, যাই।”
“কখনো কোন সমস্যা হলে বলবে। রাজের চেয়ে এদিকে আমার পরিচিত বেশি। ধরো সেতো থাকে ঢাকায়। আসে ছয়মাস পরে। যদিও সামনের দিকে তার ব্যতিক্রম হবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শিখা মৌন রইলো। সে ও জুবায়ের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। শিখাকে রিকশায় তুলে ভাড়া মিটিয়ে দিলো জুবায়ের। শিখা মানা করা সত্ত্বেও সে শুনল না। জুবায়ের দাঁড়িয়ে রইলো শিখার চলে যাওয়া রিকশার পিছন পানে চেয়ে।
রিকশায় যেতে যেতে শিখার মনে হলো, রাজের মতো জুবায়েরও মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ভালো। সেদিন তার একটা নিরপেক্ষ বাক্যের জন্যই সে নিদোর্ষ প্রমাণিত হলো সবার কাছে। তার জন্যই এই বয়সে ছোট চাচী তালাকপ্রাপ্তা হলো। জুবায়ের ত্যাজ্যপুত্র হলো। যদিও তা অনানুষ্ঠানিকভাবে মুখের কথাই ছিলো ছোট তালুকদারের। অল্প ক’দিনের জন্য হলেও জুবায়ের বাড়ি ছাড়া হলো। তাই সবকিছুর জন্য জুবায়েরকে ব্যক্তিগতভাবে একটা বিশেষ ধন্যবাদ দেওয়া উচিত ছিলো তার। কিন্তু ইতস্তততার জন্য পারেনি শিখা। উল্টো বলল,এটা কি আমার জায়গা নাকি।
বাড়ি গিয়ে শিখা রাতে চিরকুটটি আবার পড়লো। সহজ বাক্যগুলোর মানে বুঝতে তার দ্বিতীয়বার ভাবতে হলো না। আগের চিরকুটগুলো আর এই চিরকুটের লেখার মর্মাথ পুরোপুরি ভিন্ন। আগেরগুলো ছিলো একজন নিঃস্বার্থ মানুষ বা বন্ধুর মতো। এই চিরকুটের কথাগুলোর মানে সে শিখাকে ভালোবাসে। চায়। হাতের লেখার ধরনও অমিল। তারমানে কি দুজন আলাদা মানুষ?

শিখার মনে রাজের সঙ্গে দেখা হওয়ার অপেক্ষা। তারপর বেচারা প্রেমিককে গণধোলাই খাওয়াতে হবে।
একদিন পোস্ট অফিসে গিয়ে শিখা অন্যদের অনুরোধ করে এলো ডাক পিয়ন আতাহার আলী যেন তাদের বাড়ি যায়। জরুরী কাজ আছে। এই সংবাদ পেয়ে পরেরদিন বিকেলেই সেই ডাক পিয়ন শিখাদের বাড়ি যায়। নূরী বলল,
“আমার মেয়ে ম্যাট্রিকে খুব ভালো ফলাফল করছে। জামাই উপহার দিতে চাইলো। সে উপহার নিজের জন্য নিল না। আপনার জন্য একটা সাইকেল নিলো। জামাই টাকা দিয়া গ্যাছে। আপনেরে লগে নিয়া যাই কিনা দিতে কইছে।”
শুনে একজন আতাহার আলীর চোখ ভিজে উঠলো। আনন্দে তার বুক ভরে গেলো। তার ভাষারা নির্বাক! আবেগের ফল্গুধারায় ভেসে গেলো তার কোমল অন্তরখানি।
শিখা তাকে বলল,

“দাদা আমি কাইল কলেজ শেষে চারটার দিকে সাইকেলের দোকানে চইলা যামু। আপনে চইলা আইসেন। দুজনে দেইখা পছন্দ কইরা নিমু।”
তিনি প্রসন্ন চিত্তে শিখার পত্রপল্লবের ন্যায় কচি মুখখানার দিকে চেয়ে রইলেন। পরেরদিন নিদিষ্ট সময় গিয়ে শিখা তাকে সুন্দর একটি সাইকেল কিনে উপহার দিলো। তিনি শিখার মাথায় আশীর্বাদের পরশ বুলিয়ে দিলেন। আদ্রকন্ঠে বললেন,
“তোমার কল্যাণ হোক বোন। সফলতা ছুঁয়ে যাক তোমায়। পড়াশোনা করো মন দিয়ে।”
তিনি সাইকেল চালিয়ে চলে গেলেন তার গন্তব্যের দিকে। শিখার চোখের কোণ আনন্দাশ্রুতে ভরে উঠলো।
তার কয়দিন পর এক বিকেলে বেতের পাটি বুনতে বুনতে নূরী মেয়েকে বলল,

“কিরে তুই না কইলি জামাই কইলো তাগো বাড়িতে চইলা যাইতে?”
“আমি তোমার কান্ধের বোঝা আম্মা? তাড়ায়া দিতে চাও?”
আহ্লাদী কণ্ঠে বলল শিখা।
” হ চাই। মেয়েদের স্বশুর বাড়িই হইলো আসল ঠিকানা। সেই ঠিকানায় তোর পায়ের তলার ভূমি শক্ত করতে হইবো। এইখানে মায়ের আঁচলার নিচে পইড়া থাকলে এইটা হইবো মাইয়া? দেহস না আমি বিধবা হইয়াও স্বামীর ভিটা ছাইড়তে পারিনাই।”
গম্ভীর সুরে আদেশ করে বলল নূরী।
“হ বুঝছি। চইলা যামুনি সামনের সপ্তাহে। থাইকো তুমি একেলা।”

নূরী মুচকি হাসে ঠোঁট ভিড়িয়ে। শিখা ধুপধাপ পায়ে উঠে চলে যায় অন্যদিকে। মায়ের আদেশ শিরোধার্য শিখার কাছে। তাই সে কয়দিন বাদেই সবকিছু নিয়ে মায়ের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলো। নূরী মেয়েকে তালুকদার ঘরে পৌঁছে দিয়ে কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে এলো। ভদ্রতার খাতিরে মতির মায়ের পরিবেশন করা সামান্য কিছু নাস্তা মুখে দিলো।
শিখা পূর্বেকার ন্যায় নিজ থেকে যেচে গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করলো। সালাম দিলো। কুশলাদি বিনিময় করলো। মতির মা, বরকত, জয়নুল, আমেনা,হারিছা ছাড়া বাকিরা দায়সারাভাবে তার কথার জবাব দিলো। শিখা হতাশ হলো। আক্ষেপের সুরে মনে মনে বলল,

ওমা! উনি যাওয়ার সময় সবাইকে কি বলে গেলো। অথচ হেরা মাথায় রাখল না। পাত্তাও দিল না। নষ্ট পরিবার। এগোরে ক্যামনে সাইজ করন যায়। শিখা তার রুমে চলে গেলো। বড় অগোছালো হয়ে আছে তার রুম। স্পষ্টত যে এই রুম,এই বিছানা কেউ ব্যবহার করেছে। সে আলনায় তার নিত্য ব্যবহার্য জামাকাপড়গুলো গুছিয়ে রাখলো। তার বই খাতা ছোট্ট টেবিলটার উপরে রাখল। খাটের চাদর ও বালিশের কভার খুলে ফেলল।
সুফিয়া বিবির কাছে গিয়ে বলল,
“মা, আমার খাটের জন্য একটা চাদর দেন। বিছামু।”
“আগের চাদরে কি হইছে?”
গলা তুলে বলল সুফিয়া।
“এটায় ময়লা আম্মা। কেউ ঘুমাইছে তাই। কারো ব্যবহারের জিনিস কেউ ব্যবহার করন ভালো না। এতে রোগ জীবাণু ছড়ায়।”

“কেউ ঘুমাইলে কি হইছে? কারো গায়ে বিচি পাঁচড়া আছে? চাদর নাই। এতই পরিষ্কারওয়ালীর মাইয়া হইলে কাইল ওইটা ধুইয়া বিছাইয়ো আবার। আর আমার খাট কি? ওইটা সবার খাট। সবার গণরুম। তোমার খাট,রুম হইলো দোতলায়। রাজের টা। একজনের রুম কয়টা হয়?”
নাক সিঁটকে গজগজ সুরে বলল সুফিয়া।
শিখা বরাবরের মতো মার্জিতভাবে চুপ রইলো। শাশুড়ীর মুখে তর্ক করল না। এই শিক্ষাও তার মা দিয়েছে তাকে। বড়রা বহুসময় অন্যায়ভাবেও জেদ করে ছোটদের বকুনি দেয়। ধৈর্য ধরে থাকতে পারাটাও একটা গুণ। তবে বাড়াবাড়ি করলে প্রতিবাদী হতে হবে। প্রতিবাদ করতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আপোষ করা হবে নিজের সঙ্গে অপরাধ। কারণ যে অন্যায়কে,ভুলকে প্রশ্রয় দেয়,সেও সম অপরাধী।
শিখা পা ঘুরিয়ে চলে গেল বড় জা রানীর রুমে।

“ভাবি একটা নতুন চাদর হইবো?”
“আমি চাদরের ব্যবসা করি?”
মুখ কালো করে বলল রানী।
সে মেজো জা সুমনার কাছে গিয়ে,
“ভাবি একটা ভালো চাদর হইবো?”
“আছে। সেগুলা ত আমার। অতিরিক্ত নাই।”
বিরক্ত মুখে জানালো সুমনা।
শেষে গেলো ডলির কাছে।
“ভাবি একটা চাদর হইবো বিছানোর জন্য?”
“ঘরের মহাজন সুফিয়া বিবি। আমি নই। সবকিছু উনার কাছে আছে।”

শিখা একবার ভাবলো,মতির মা বা আমেনার কাছে চাইবে। কিন্তু ভেবে দেখলো এটা উচিত হবে না। এদের ছোট করা হবে। তাই আর চাইল না। রাতে নিজের একটা বড় সুতী ওড়না তোষকের উপরে বিছিয়ে ঘুমালো। পরেরদিন সকালে সে নিজেই পুকুর ঘাটে গিয়ে চাদর ধুয়ে রোদে শুকিয়ে দিলো। সকালে রান্নাঘরে গিয়ে মতির মায়ের কাছ থেকে ভাত চেয়ে খেয়ে নিলো।
তাকে বলল,
“খালা কলেজে যামু। দোয়া কইরেন।”
“তোমার লাইগা আমার দিলের ভিতর থেইকা দোয়া সক্কল সময়ে আছে মা। তোমার হড়ির কাছে বইলা যাইও।”
সুফিয়া তার কক্ষে নেই। তাকে খুঁজে বের করলো শিখা। মোলায়েম গলায় বলল,
“মা কলেজে যাইতাছি আমি।”

সুফিয়া বিবি না শোনার ভান করে অন্যমনস্ক হয়ে রইলো। এটা শিখা খুব জানতো। তবুও সে তার স্থানে শাশুড়ীকে সম্মান ও গুরুত্ব দিতে ভুল করল না। জয়নুল ঘরে ছিলো না বলে বলতে পারেনি তার কাছে। সেদিন শিখা কলেজ থেকে বিকেলে আসলো। কেউ তাকে ভাত খেতে বলছে না। অথচ তার মা মুহূর্ত দেরী না করেই ভাত খেতে তাগিদ দিতে থাকে তাকে। মায়ের উপর রা* গ হলো শিখার। সে এখন এই বাড়িতে আসতে চায়নি। তার ইচ্ছে ছিলো নানান অজুহাতে রাজ আসার কাছাকাছি সময় পর্যন্ত নিজের বাড়িতে থাকবে। কিন্তু মায়ের জন্য পারেনি। চলে আসতে হলো। এতে নাকি তার ভালো হবে ভবিষ্যতের জন্য। কি ভালো সে দেখবে সময় হলে। বিয়ের রাত থেকে আজ অবধি সে এই পরিবার থেকে উপেক্ষা,অসম্মান, জ্বালা পেয়ে আসছে। এভাবে পেতেই থাকবে বোধহয়।
শিখা রান্নাঘরে গিয়ে মতির মায়ের কাছে ভাত চাইলো। মতির মা তাকে বলল,

“চৌকিতে বও। ভাত, সালুন একলগে দিয়া দিতাছি। ঝটপট খাইয়া উঠো। তুমি যাওনের পরে ঘরে তোমারে নিয়া ভাবি,বউরা উত্তেজিত হইলো। ঘরের কাম বাদ দিয়া তুমি মাষ্টার সাব হইলে হেগো কি লাভ? কোন শরমে আইসা ভাতের লোকমা মুখে দিবা। এইসব।”

শিখা একমনে ভাত খেয়ে উঠলো। ক্ষুধার জন্য ভাত রেখেও উঠতে পারেনি। মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। সে তার মতো করে নিত্যকার জীবন যাপন করতে লাগলো। কলেজে যাচ্ছে, আসছে,পড়াশোনা করছে, কিছু খেতে চাইলে চেয়ে নিয়ে খাচ্ছে মতির মায়ের থেকে। কেউ তার সঙ্গে যেচে কথা বলে না। খাওয়ার সময় ডাইনিং টেবিলে কেউ তাকে ডাকে না। আগের মতই তাকে রুমে ভাত দিয়ে আসে মতির মা।

দিনে দিনে এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপমান,অবজ্ঞা শিখাকে পীড়া দিতে লাগলো। তার আত্মসম্মানে কাঁটার মতো বিধঁতে লাগলো। তার বাড়িতে,কলেজে, অন্য সব জায়গায় সবাই তাকে কত ভালোবাসে। কত গুরুত্ব দেয় তার কথাকে। অথচ সে সবচেয়ে যেখানে বেশী গুরুত্ব ও ভালোবাসা পাওয়ার কথা,সেখানেই সে দারুণভাবে অবহেলিত।
সেদিন ছিলো শুক্রবার। সবাই একসঙ্গে বিশাল টেবিলে ভাত খেতে বসলো। পরিবারে যেহেতু সদস্য কমে গিয়েছে। তাই ঘরের নারীরাও একসঙ্গে বসে খেতে। শিখাকে সুফিয়া বিবির নির্দেশে তাররুমে ভাত দেওয়া হয়। এটা সবাই জানে। তালুকদারও। সে সুফিয়াকে বারবার বলেও কাজ হলো না। কিন্তু এই বিষয়টা জানত না জুবায়ের। কারণ সে বাড়িতে থাকে না শুক্রবার ছাড়া। রাতে সে লেটে আসে বলে তার ভাত বাদশা তার রুমে রেখে আসতো।
মতির মা হঠাৎ বলে উঠলো,

“ভাবি ছোট বউরে চিংড়ি মাছ ভাজা দেওয়া হইনাই। দিয়া আসুম একটা?”
“তুই কথা কম ক। যতগুলা তার থালায় দিলি, অতগুলা আইটেম তার চোদ্দগুষ্টি জিন্দেগীতে চউক্ষে দেখছে?”
“বড় মা রাজের বউ কবে আসলো? জানিও না।”
আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলো জুবায়ের।
“এত জাইনা কি করবেন দেওরা? সে কি জানার মত কেউ নাকি।”
ব্যঙ্গ করে বলল সুমনা।
“তালুকদার ঘরের বউরা আবার কবে থেকে এত সস্তা হলো?”
“সে ছাড়া সবাই দামী।”
“তাইনাকি মিসেস সুমনা?”
তীর্যক করে বলল জুবায়ের।
জয়নুল তালুকদার লম্বা করে স্বাস ছেড়ে উঠে গেলেন খাবার খেয়ে।
“বড় মা, সবাই এখানে। সে আলাদা কেন খায়? বুঝলাম না? সবাই চিংড়ি মাছ ভাগে পায়। যে পাবে না কেন?”
“ওরে বাবারে তুই খাইয়া যাতো। বেডিগো বিষয়ে নাক গলাইস না। ইছা মাছ আর নাই।”
জুবায়ের নিজের প্লেটের বড় একটা চিংড়ি মতির মায়ের হাতে দিয়ে বলল,

“এই চিংড়ি তাকে দিয়ে আসেন চাচী। আমি বাকিটা খাচ্ছি। আমরা দুটো করে খাচ্ছি। আর সে একটাও ভাগে পেল না। এটা ঠিক হয়নি।”
মতির মা দাঁড়িয়ে আছে। জুবায়ের বুঝলো। সে নিজেই উঠে গেলো শিখার রুমে। শিখার প্লেটে চিংড়িটা দিয়ে ভারি গলায় বলল,
“এটা খাও বলছি।”
শিখা কিছু বলতে পারল না। জুবায়ের লম্বা লম্বা পা ফেলে ফের চলে এলো ডাইনিংয়ে। শিখা হা হয়ে গেলো জুবায়েরের কাণ্ড দেখে। খেয়ে নিলো চিংড়ি মাছটা। জুবায়েরের উপর সবাই বেশ রাগান্বিত হলো। সুফিয়া বিবি তাকে মেঘমুখে বলল,

“বউরে তোর এই লায় দেওয়াটা ঠিক হয়নাই।”
“বড় মা,এটা লায় দেওয়া নয়। এটা বিবেকের তাড়না। কাল থেকে শিখা সবার সাথে একসঙ্গে সব খাবার খাবে। এটা নিশ্চয়ই রাজ জানে না। আমি তাকে জানাতেও চাই না। সবাই ভুলে গেলে চলবে না রাজ ও আমি একই সত্তার দুটি আত্মা।”
জুবায়ের চলে যায় নিজের রুমে। তার মা, নানীও চলে গেলো। জুবায়েরের জন্য শিখার উপর সবার আক্রোষ বৃদ্ধি পেলো। পারে তো শিখাকে মেরে ফেলে। সেদিন বিকেলে জুবায়েরের কানে কিছু কথা এলো শিখাকে নিয়ে। রানী,সুমনা,ডলি বলাবলি করছে,
“দেখলি জুবার কামটা। আম্মারে ছোট কইরা দিলো দুই টাকার সস্তা,মাইয়াটার কাছে।”
“আর কি কইলো হুনলি না? রাজ আর সে একই। মানে রাজ থাকলেও আইজ এগুলা কইতো। সেইটাই বুঝাইলো তিনি!”

“তাইলেত কইতেই হয়,রাজের বউ মানে তার বউ। শিখার বাসর দুইদিন হওয়া দরকার। একদিন জুবায়েরের বিছানায়। আরেকদিন রাজের বিছানায়। রাতে দুজনের লগে সমান ভাগে শিখা শুইবো।”
বলেই তিন জা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। জুবায়ের দাঁতে দাঁত পিষে চুপ রইলো। একদিন সকালে শিখা উঠানে কাজ করছে। দেখলো জুবায়ের অন্যঘর থেকে একটা মোটরবাইক বের করলো উঠানে। শিখা একদৃষ্টিতে মোটরবাইকের দিকে চেয়ে রইলো। গদগদ সুরে বলল,
“ওমা! জুবায়ের ভাইয়া আপনার হোন্ডা আছে? জানিও না।”
” এখন তো জানলে। দেখলে।”
“আমার কাছে বাইকে চড়া রীতিমতো উপভোগের! ইসসইরে!”
” তুমি চড়বে আমার বাইকে? আগে কখনো চড়েছো?”
” ছোটকালে এক মামার বাইকে উঠছি একদিন। আর উঠিনাই কোনদিন। লোভ হইতাছে চড়তে। কিন্তু এইটা অসম্ভব! জামাইয়ের বাড়ি এইটা আমার।”

” জামাইয়ের বাড়ির বাইরের সীমানায় চড়বে। তোমার আগ্রহ থাকলে সম্ভব করার দায়িত্ব আমার। বলো রাজী?”
বাইকে, রিক্সায়,নৌকায় চড়া শিখার ভীষণ শখ। সে সাতপাঁচ না ভেবে বলল,
“হুম। উনার বাইক নাই?”
“নাহ। সে বেশী ধনী। তার গাড়ি আছে। আমি তারচেয়ে নিচে আছি। তাই আমার গাড়ি নেই। বাইক আছে।”
“কিন্তু আমার মোটরবাইক বেশী প্রিয়। গাড়ি নয়। গাড়িতে অস্বস্তি লাগে। মাথা ঘুরায়।”
জুবায়ের হেসে বলল,
“কাল কলেজ ছুটির পর মাঠে থেকো। আমি বাইক নিয়ে আসবো।”
“কাইল যামু না কলেজে। আমি জানামু আপনারে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। সমস্যা নাই।”

জুবায়ের বাইক চালিয়ে, চুল উড়িয়ে শিখার সামনে দিয়ে চলে গেলো।
আদুরী বিষাদগ্রস্ত মুখে বাবার বাড়ি চলে এলো। তাকে নিয়ে এলো তার জামাই। কিন্তু তার জামাই বসলো না। থমথমে মুখে বেরিয়ে গেলো। সুফিয়া বিবি কারণ জিজ্ঞেস করলো।
তার জামাই বলল,
“কি হয়েছে তা আপনার মেয়ের থেকেই জেনে নিয়েন। আপাতত সে এখানে থাকুক। যেদিন ভালো হবে স্বভাব চরিত্র। সেদিন তাকে পাঠাবেন।”

রাজবধূ পর্ব ৩৮

সুফিয়া বিবির উজ্জল মুখচ্ছবি চুপসে অনুজ্জ্বল হয়ে গেলো নিমিষেই। আদুরীকে জিজ্ঞেস করে কোন জবাব পেল না। বড় বউ রানীকে আদেশ দিলো আদুরীর থেকে কারণ জানার জন্য।
একদিন শিখা পুকুর থেকে গোসল করে উঠার সময় আড়চোখে খেয়াল করলো বাগানের ভিতর থেকে একজোড়া পুরুষ চোখ লুকিয়ে তার গোসল করা দেখছে। তারমানে সে যতদিন গোসল করেছে এই ছেলে তাকে দেখেছে। কিন্তু কে? তারপর অন্য একদিনও শিখা গোসল করে ঘাটের সিঁড়িতে উঠে দাঁড়ালো। ভেজা জামা লেপ্টে আছে তার শরীরে। হুট করেই চঞ্চল পায়ে সেই চোখজোড়ার মালিক ঘাটের নিচের সিঁড়িতে নেমে গেলো।
শিখা তাজ্জব হয়ে গেলো চেনা মুখটা দেখে। সে দপ করে জ্বলে উঠলো। ফুঁসে উঠলো। মনে মনে শপথ করলো,
ইয়েস! তোকে দিয়েই শুরু করবো অগ্নিশিখার প্রলয়ঙ্কারী মিশন।

রাজবধূ পর্ব ৪০