রাজবধূ পর্ব ৪

রাজবধূ পর্ব ৪
রেহানা পুতুল

এই খবর পৌঁছে গেলো শিখার কানে। শিখা সজোরে কেঁপে উঠলো। শুকনো ঢোক গিলে ভীরু কন্ঠে বলল গোপনে,
“ওহ আল্লাহ! উনিতো তাইলে সবার চাইতে বিপজ্জনক! আমার কি হইবো? কোন ভুল হইলে আমারেও কি মারবো উনি? উনার সঙ্গে আমার সহসা দেখা না হউক।”
খবর শুনতে পাওয়া সবাই হাতের কাজ ফেলে হুড়মুড় করে বাগানের দিকে ছুটে গেলো। কৌতুহল না দমাতে পেরে বাদশাও যেতে লাগলো তাদের সঙ্গে।
আদুরী তাকে ধমকে উঠলো।
“তুই আসিস কেন? তোর কাজে মন দে।”
বাদশা তাদের গৃহ কর্মচারী। সে পা পিছিয়ে চলে এলো।
সবাই গিয়ে দেখলো রাজ বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছে। সীমান্ত তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের মুখশ্রী ক্ষ্যাপাটে। রাজ বিরক্ত হলো। বলল,

“সবাই কেন এলেন? সার্কাস হচ্ছে নাকি এখানে ?”
তার দুই ভাবি ও মতির মা চলে গেলো। কেবল আদুরী, সুফিয়া বিবি, জাহানারা রইলো। ছেলেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো জাহানারা। প্রায় কান্নাজড়িত স্বরে,
” কি হইছে রাজ? তুই নাকি ওরে লাথি উষ্ঠা মারতাছিস? কি ভুল করছে তোর ভাই?”
রাজ কিছু বলার আগে তার মা গিয়ে ভাগিনাকে ধরলো। আদ্রকন্ঠে রাজকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হইছে? ওরে ছোটবেলা থেইকা আমি কত মহব্বত করি। এরজন্য তোর ফুফু আমার সুফিয়ার স দিয়া তার নাম রাখলো সীমান্ত। আইজ এমন দিনে তুই আমার ভাইগনার গায়ে হাত দিলি ক্যান?”
“আপনার মহব্বতের সীমান্তকেই জিজ্ঞেস করেন। কেন তার গায়ে হাত তুলছি।”
বাঁকা স্বরে বাক্যটি আওড়ে ভারি ভারি পা ফেলে চলে গেলো রাজ। জাহানারা ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“বেশি লাগছে বাপ?”
” না আম্মা। লাগেনাই।”
সীমান্তকে জাহানারা ও সুফিয়া জড়িয়ে ধরলো। “কি হইছে? কবি তো?”
সীমান্ত আক্রোশে ফেটে পড়ছে। গমগমে স্বরে বলল,
“বড় মামী শুনবেন আপনার ছোট ছেলের কাণ্ড?”
” হ্যাঁ। ক বাপ?”
“সীমান্ত ভাইয়া বলো।”
“এখানে নয়। ঘরে আয়। সবার সামনেই বলব।”

সবাই বাড়ির অন্দরে চলে গেলো। রান্নাঘরের উঠানে গিয়ে থামলো। সীমান্ত তিন মামাতো ভাইয়ের বউকে জড়ো করলো। পাশে দাঁড়িয়ে আছে সুফিয়া,তার মা জাহানারা,আদুরী। রাজ মামাতো ভাবিদের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল,
“ভাবি, আমি তোমাদের সঙ্গে ফাজলামি করি না? মা,মামী,মতির মা খালা,ভাইয়াদের সামনে করিনা দুষ্টামি?”
“হ্যাঁ করস। তো হইছে টা কি?”
বলল রানী।
“কখনো খারাপ কিছু দেখেছো আমার মাঝে?”
“কই নাতো।”
বলল সবাই।
“রাজ ভাই আমার কলার চেপে ধরে চড় মেরে শাসালো আমাকে। আমি নাকি তার বউয়ের সঙ্গে ইয়ার্কি করার চেষ্টা করছি।”

“তুমি কি করছ সীমান্ত ভাইয়া? ছোট ভাইয়া এমনি তোমাকে চড় মারবে কেন?”
“উনি নাকি দেখেছে আমি তার বউয়ের চুলে হাত দিয়েছি। শাড়ির আঁচলে হাত দিয়েছি। ”
“ভাইয়া মিথ্যা বলছে? তুমি শিখার চুলে,আঁচলে হাত দাওনি?”
“দিয়েছি মজা করে। মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে নাকি? নিচু ঘরের সামান্য একটা পিচ্চি মেয়ের জন্য আমি চড় খেলাম। এর প্রতিশোধ আমি নিবই। সবাইকে জানিয়ে রাখলাম। এই আম্মা আমি বাড়ি চলে গেলাম। থাকো তুমি তোমার বাপের বাড়ি।”

সীমান্ত তার মোটর বাইক চালিয়ে চুল উড়িয়ে চলে গেলো। চেষ্টা করেও তাকে আটকানো গেলনা। সবাই হতবিহ্বল হয়ে গেলো শুনে। এত মামুলি বিষয়ের জন্য রাজ আপন ফুফাতো ভাইয়ের গায়ে হাত তুলতে পারলো? এটা কোন কথা? গায়ে হাত দেয়নাই। হাত ধরেনাই। কিচ্ছুনা। চুল আর শাড়িতে তার হাত লাগলো বলে এই কাহিনী। এ দেখি লঘু পাপে গুরুদণ্ড হয়ে গেলো।
জাহানারা রেগে আগুন। ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
“ভাবি এইটার বিচার চাই আমি। বিয়া বাড়ির খাওন রাইখা আমার ছেলে চইলা গ্যালো। কেমনডা লাগে কন তো?”
“কে করবে ছোটো মিয়ার বিচার?” বলল রাজের বড় ভাবি রানী।
আদুরী বলল,

“সেটাই। কে তাকে কি বলার সাহস রাখে।”
সুফিয়া বিবি ফুঁসে উঠছে। উগ্র কন্ঠে বলল,
“বুজান। মন বেজার কইরেন না। আমি এর একটা বিহিত করমুই। কিন্তু ভাবতাছি অন্য কথা?”
“কি আম্মা?” উৎসুক হয়ে বলল আদুরী।
“পরে কইতাছি। আইজকার ঝামেলা মিটুক আগে। আমার মাথা চক্কর মারতাছে। ফুলবানুরে ক আমারে লাল চিনি দিয়া এক গ্লাস কাগুজি লেম্বুর শরবত বানায়া দিতে।”
ফুলবানু হাতের কাজ রেখে উঠে যায়। গাছ থেকে তাজা একটা কাগুজি লেবু ছিঁড়ে নেয়। ঠান্ডা পানি দিয়ে ঝটপট শরবত বানিয়ে সুফিয়াকে দেয়। সুফিয়া জলচৌকিটা টেনে আতাফল গাছের ছায়ায় বসলো। আস্তে আস্তে লেবুর শরবত খেতে লাগলো অসহিষ্ণু মেজাজে।

বিকেল ফুরিয়ে আসছে। বাইরের অতিথিরা সবাই চলে গিয়েছে। সবাই বাড়ির কাজ গোছানোয় হাত লাগালো। জয়নুল আদুরীকে আদেশ দিয়ে বলল,
“আম্মা বধূরে ঘরে নিয়া যাও। স্টেজে আর বইসা থাকনের কাজ নাই।”
“আব্বা উপহারগুলি কার রুমে রাখবো?”
মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েও পারল না জয়নুল তালুকদার। সুফিয়া বিবির পা পড়লো বড় উঠানে। থমথমে গলায় বলল,

“এই মাইয়া, তোর বাপে কি জানে এইসবের? ঘর, অন্দরের রাজত্ব আমার। আমি রাজবিবি। উপহার সামগ্রী সব আমার রুমে নিয়া রাখ। আর হের হাতের মুঠি খুইলা দেখ কত টাকা পাইছে। সোনাপাত্তি কিছু পাইছে নি। ”
জয়নুল তালুকদার মলিন মুখে চলে গেলো অন্যকাজের দিকে। সুফিয়া বিবি তেতে আছে। ঘাটানো যাবে না এখন। সময় হোক। সুফিয়া নিজের রুমে গিয়ে শাহী স্টাইলে বসল পানের বাটা নিয়ে।
জাহানারা উঠানে এসে বলল,
” উপহারের লিস্ট কার কাছে? তাইলেই বুঝা যাইবো কে কি দিলো।”
” ঠিক কইছেন ফুফুজান। চাইলেই সরাতে পারব না সে। নয়তো ছোটলোকের ছোটনজর থাকেই।”
তিরস্কার করে বলল রাজের মেজো ভাবি সুমনা। শিখা চকিতে চাইলো তার মুখপানে। স্টেজে বসা থেকে সে সবার কথাই শুনতে পেলো। সুমনা গজগজ করে বলে উঠলো,
“অমন চাইয়া কাম নাই সখী। আমার পদ অনেক ভারী। দুই সন্তানের মা আমি। এক ছেলে এক মেয়ে। দুইটাই দিছে আল্লায় আমারে।”

রাজের বড় ভাই রাশেদ নিজের রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। সবার কথা তার কর্ণগোচর হলো। সে জানালার ফাঁকে মুখ রেখে বলল,
“বাড়িতে নতুন বউ আসার সঙ্গে সঙ্গে সবার কদর্য রূপ প্রকাশ হইতাছে মনে হয়।”
“আপনারা মনে হয় বেশী ভালো মানুষ ভাইজান? এই ভিতরে কি ঘটছে জানেন কিছু?”
“জানিনা।”
“আরাম করেন। পরে হুনবেন।”
রাশেদ ঘুমিয়ে পড়লো ছোট ভাইয়ের বউয়ের কথায় পাত্তা না দিয়ে।
আদুরী,ডলি,জোছনা মিলে সব উপহার সামগ্রী সুফিয়ার রুমের পালংকের উপরে রাখলো। আদুরী শিখার হাত খুলে টাকা ও সোনার আংটিগুলো নিয়ে নিলো। তাতে শিখা কিছুই মনে করেনি। আদুরী শিখাকে নির্দেশ দিলো ঘরে চলে আসতে। শুরু থেকেই সবাই রুক্ষ আচরণ করছে শিখার সঙ্গে। এখন সেটা দিগুণ হয়ে গিয়েছে। সীমান্ত তার জন্য চড় খেলো বলে।

শিখা সাবধানে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ভারী শাড়ির জন্য ইজিভাবে পা ফেলতে পারছে না। পেটিকোটসহ শাড়ির কুচি পায়ের ভাঁজে আটকে সে উপুড় হয়ে পড়ে গেলো। আম্মাগো বলে ভয়ে, যন্ত্রণায় কুঁকিয়ে উঠলো। জোছনা দৌড়ে এসে তাকে ধরে উঠালো। মতির মা, ফুলবানুও এগিয়ে এলো। শিখাকে তার থাকার রুমে নিয়ে গেলো তারা ধরাধরি করে। শিখার পায়ের গোড়ালি ধীরে ধীরে ফুলে যাচ্ছে। শিখার পায়ের পাতাকে বরফ পানিতে চুবিয়ে রাখলো জোছনা। তার মা নিজের অভিজ্ঞতার ঘরোয়া টোটকা প্রয়োগ করলো শিখার পায়ে। হলুদ, ফিটকারি মিক্স করে পুরনো কাপড় দিয়ে পা পেঁচিয়ে বেঁধে রাখলো। শিখা বসে আছে চুপটি করে। মা নূরীকে তার ভীষণ মনে পড়ছে।
কিছুক্ষণের ভিতরেই উঠানে শিখার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার বিষয়টা চাউর হয়ে গেলো। সবাই আফসোসের বদলে ঠাট্রা শুরু করলো।

“এই দেখি পুরাই আনাড়ি। কাঁচা বাঁশ। হাঁটতেও পারেনা। কেবল চামড়া সাদা হইলে হয়। বিলাই, কুত্তারওতো চামড়া সাদা। কুত্তা ঘেউ ঘেউ আর বিলাউ ম্যাও ম্যাও ছাড়া আর কি করতে পারে।”
সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পড়তে গিয়ে জয়নুল তালুকদার ফার্মেসীতে বলে শিখার পায়ের ব্যথার জন্য ট্যাবলেট এনে দিলো। তিনি শিখাকে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আর্শীবাদের সঙ্গে।
সবাই হুড়মুড় করে সুফিয়া বিবির রুমে একত্রিত হলো। তার তিন ছেলের বউ, ননদ জাহানারা,ছোট জা আমেনা বেগম ও তার মা হারিছা খাতুনও উপস্থিত আছে। লিস্ট দেখে দেখে উপহারগুলো বাছাই করলো সবাই। সুফিয়া বিবি নিজের মর্জিমতো সবাইকে যা দেওয়ার দিলো। ছোট জাকে সুন্দর দেখে একটা শাড়ি দিলো।
“নে ধর। পরিস। পছন্দ হইছে তোর?”
” পছন্দ হইছে ভাবি।”

নরম হেসে বলল খায়রুল তালুকদারের স্ত্রী আমেনা বেগম।
আরেকটা যুতসই শাড়ি সুফিয়া বিবি জুবায়েরের নানীর দিকে এগিয় দিলো।
“কইগো ধলা বেডি। নেন। এইটা আপনারে মানাইবো। আবার বিয়া দেওন যাইবো।”
আদুরী হেসে বলল,
“নানুরে জুবায়ের ভাইয়া ও সীমান্ত ভাইয়ার লগে বিয়ে দিবো। শাদী মোবারক বাদ। আমার চার ভাইতো বিয়ে করে ফেলল। নাকি বলো হারিছা খাতুন?”

হারিছা খাতুন কিছু বলল না। ঘোলাটে শান্ত চোখে আদুরীর দিকে মুখ তুলে চাইলো।
সুফিয়া বিবি টাকাগুলো নিজের আঁচলের কোনায় বেঁধে নিলো। আংটি সাতটা। জাহানারা,তিন বউ,মেয়ে,ও নিজে ভাগ করে নিলো। বাকি একটা আংটি শিখার জন্য রেখে দিলো। তাও না পারতে। নয়তো সবার কথার সম্মুখীন হতে হবে।
রাতে খাওয়ার পরে ট্যাবলেট খেয়ে শিখা ঘুমিয়ে পড়লো। ক্লান্তিতে ভারি ঘুম নেমে এলো তার আঁখিকোণে।
গভীর নির্জন নিশুতি রাত। একজন আগুন্তক শিখার রুমে প্রবেশ করলো খুব সন্তপর্ণে। শিখার পায়ের নিকট হাঁটু গেড়ে বসলো। ধবধবে সরু পায়ের গোড়ালির অংশটা উদাম করে নিলো। একটা মলম হতে কিছুটা নিজের আঙ্গুলের ডগায় তুলে নিলো। লাগিয়ে দিলো যত্ন করে। শিখা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে অচেতন হয়ে।

ঘুমন্ত শিখার মুখখানা তাকে নেশাতুর করে চলছে। ভীষণ ইচ্ছে করছে তার মায়াবী বদনখানিতে নিজের হাতের উষ্ণ পরশ বুলিয়ে দিতে। কিন্তু সে চাইলেও এর বেশি ছুঁতে পারছে না শিখাকে। নিষেধ আছে। কঠিন নিষেধ। আগুন্তক মলমটি রেখে চলে যায়।
কাক ডাকা ভোরে শিখার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মলমটি তার চোখে পড়লো। সে হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো। পায়ে হাত দিয়ে ব্যথা অনুভব করতে গেলেই দেখলো মলম শুকিয়ে লেগে আছে পায়। শিখা বিস্মিত হলো। কে আনলো মলম? কে তার পায়ে লাগিয়ে দিলো মলম? এই বাড়িতে তাকে ভালোবাসার কেউ আছে নাকি?
জোছনা ঘর ঝাড়ু দিতে এলে সে মলমটি দেখিয়ে তাকে বলল,

রাজবধূ পর্ব ৩

“এই মলম কে আনলো জানেন? আমার পায়ে কে লাগিয়ে দিলো?”
” ওমা! কন কি! কে করলো এই কাম?গায়েবী কাণ্ড মনে হইতাছে।”
জোছনা ঝাড়ু রেখে মলমটি নিয়ে বের হয়ে গেলো। সবাইকে জানালো। শুনে তালুকদারের সেজো ছেলের বউ ডলি বলল,
“আমি জানি কে মলম কিনে আনলো? কে তার পায়ে লাগিয়ে দিলো।”
অন্যরা তার দিকে তাকিয়ে রইলো বিভ্রান্তি চোখে।

রাজবধূ পর্ব ৫