রাজবধূ পর্ব ৪২

রাজবধূ পর্ব ৪২
রেহানা পুতুল

সেই রাতেই নিজামের লা* শ উদ্ধার হলো বাগানের ভিতর হতে। তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে গেলো ও হায় – হুতাশ শুরু হলো তালুকদার বাড়ির অন্দরমহলে।
সবাই বিশ্বাস করলো সেই শক্তিশালী জ্বীন আবার শিখার উপর ভর করলো। এবং শিখাই নিজামকে মেরে ফেলল।
সেদিন সন্ধ্যার বেশকিছু সময় পার হয়ে গেলো। তবুও নিজাম কাচারি ঘরে গেল না। বরকত অপেক্ষা করে বের হলো কাচারি ঘর হতে। উঠানের এদিক সেদিক খুঁজলো। পেল না। বড় ঘরে গিয়ে সবাইকে জানালো। সুফিয়া বলল,
“কই আর যাবে। হারামজাদা বিড়ি টানে। হয়তো কোন গাছের তলায় খাড়ায়া বিডি ফুঁকতাছে। তুই গিয়া শুইয়া থাক। আইয়া পড়বো।”
বরকত অপেক্ষা করে। রাত বেড়ে যাচ্ছে। নিজামের আসার নামগন্ধ নেই। মতির মা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে কাচারি ঘরে যায়। বরকতকে তাড়া দেয়। বলে,

“কিরে ভাতের হাঁড়ি ধইরা কতক্ষণ বইসা থাকুম? নিজাইমনা কই? ভাত খাইবি না?”
“নিজাম ভাইরে ত পাইতাছি না।”
এভাবে জানাজানি হয়। সবাই উঠানে বের হয়ে আসে। জুবায়ের, আমেনাও বের হয়। শিখা বের হয় না। নিজের রুমে বসে পাঠ্যবই নাড়াচাড়া করছে।
জুবায়ের বরকতকে বলল,
“বাজারে গিয়ে দেখে আয়। চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে কিনা। বাজারের একটা দোকানে রাতে তাস খেলার আসর জমে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বরকত হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে বাজারে যায়। নিজাম নেই। সে শুন্যমনে বাড়ি ফিরে আসে। জুবায়ের, বরকত, সুমনা,জোছনা, আদুরী,ডলি মিলে তল্লাসি চালায় বাড়ির চারপাশ। খুঁজতে লাগলো বাগিচার ভিতরেই। তারা কয়েকজন আছে একসঙ্গে। তাই নির্ভয়ে টর্চ লাইট,হ্যাজাক বাতির আলো ফেলে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগলো।
আচমকা আদুরী মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠলো নিজাম বলে। এভাবেই আবিষ্কার হলো নিজামের মৃতদেহ। ধরাধরি করে কাচারিঘরের ভিতরে নিয়ে গেলো তাকে। সবাই চলে এলো কাচারিতে। শিখাও এতক্ষণে শুনে গিয়েছে নিজাম মারা গিয়েছে। সে স্তব্দ! নির্বাক! তার পুরো পৃথিবী দুলে উঠলো। জুবায়ের ভাই মারলো নিজামকে? আমি ত মারতে দেখিনি। অন্যকেউ মারলো? কিন্তু অন্যকাউকে ত দেখলাম না। এখন কি হবে? হায় আল্লাহ গো। শিখা পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে রইলো খাটে দুই পা ঝুলিয়ে।
সুফিয়া বিবি আতংকিত গলায় বলে উঠলো,

“এহন কি হইবো জুবায়ের? হেরা ত আমগো নামে কেইস দিবো। অসুখ না। বিসুখ না। শক্ত সামর্থ্য হৃষ্টপুষ্ট জোয়ান পোলা। তাগড়া পোলা। কে মারলো? ক্যামনে মরলো? রাজের বউর লগের জ্বিন মারল নাকি?”
জুবায়ের থমথমে মুখে বসে আছে। একটু পর অবসাদজনিত কণ্ঠে বলল,
“বড় মা। কে মারলো,কিভাবে মরলো এসব নিয়ে আমরা পরে ভাবি। আগের কাজ হলো নিজামের লা * শ তার বাড়িতে পৌঁছাতে হবে। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে আমাদের। বিশ্বাসযোগ্য কিছু বানিয়ে বলতে হবে। তারা নিরীহ মানুষ। কোর্ট কাচারির ঝামেলায় যাবে না আর। টাকা দিলেই মুখ বন্ধ হয়ে যাবে চিরদিনের জন্য। টাকার শক্তি অনেক। কথায় আছে না ‘টাকার নৌকা পাহাড়েও চলে।’ বুঝেন। আর গরিবের কাছে টাকাই সব। টাকাই জীবন।”
“হ ঠিক কইছিস ভাই। যা ভালো মনে হয় সেইটাই কর।” বলল সুমনা।
“এই রাতেই যেতে হবে তাদের গ্রামে। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা বোকামি হবে। জানাজানি হবে। এতে সমস্যা জটিল আকার ধারণ করবে।”

বলল জুবায়ের।
“আইচ্ছা তাই কর বাপ। আর দেখ পোলার শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন নাই। তারমানে জ্বিনে গলা টিপা মারছে তারে।”
সুফিয়ার কথার সঙ্গে বাকিরাও তাল মিলালো।
“বড় মা, আমি দশ হাজার দিচ্ছি। আপনি দশ হাজার দেন। বিশ হাজার তাদের হাতে দিতে হবে।”
সুফিয়া বাধ্য ছাত্রের মতো ঘরে গিয়ে দশহাজার টাকা নিয়ে আসে আলমারি থেকে। জুবায়েরের হাতে গুঁজে দেয়।
জুবায়ের তার বাইক নিয়ে বের হয়ে গেল চৌরাস্তায়। একটা মাইক্রো ভাড়া করে তাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিলো। মাইক্রোর পিছন পিছন সে আসলো বাড়িতে। নিজামের লা* শ নিয়ে জুবায়েত,বরকত তার বাড়িতে চলে গেলো। বিদ্যুৎ শক খাওয়ার মতো তার পরিবারের লোকজন কেঁপে উঠলো। শুরু হলো এক মর্মন্তুদ দৃশ্য। নিজামের মা, বাবা নেই। বড় ভাই ভাবি আছে। জুবায়ের তার বড় ভাইয়ের হাতে চকচকে পাঁচশো টাকার একটা বাণ্ডেল ধরিয়ে দিলো।
সহমর্মিতা প্রকাশ করে দুঃখিত গলায় বলল,

“ভাই মাফ করে দিবেন। আমাদেরও বুক ফেটে যাচ্ছে নিজামের জন্য। খুব বেশি মাস হয়ওনি সে আমাদের বাড়িতে কাজ করতেছে। তবুও এই কয়মাসে সে সবাইকে নিজগুণে আপন করে নিয়েছে। বড় মা নিজামকে পছন্দ করতো। বলতে গেলে উনার হাতের লাঠি ছিলো। স্রস্টা হয়তো নিজামের মৃত্যু এভাবেই লিখে রেখেছে। সবাই ধারণা করতেছি ওকে জ্বিন, ভূতে মেরে ফেলেছে। হয়তো ওর দ্বারা ওরা কোন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
ব্যাস। কাজ হয়ে গেলো। নিজামের ভাবি মনে মনে বেজায় খুশী। সম্পত্তির ভাগে আর কোন অংশীদারিত্ব রইল না বলে। সে অভিনয় করে বলল,

“থাক ভাই সাহেব। আপনাদের উপর আমাদের কোন অভিযোগ নাই। আপনারা দিলদার মানুষ বলে স্বসম্মানে নিজামের মরাদেহ আমাদের কাছে হস্তান্তর করছেন। অন্যলোক হইলে এটাও করত না। শুকরিয়া,আমার দেওরার মরণ হইছে এক জমিদার বাড়িতে। এমন নবাবী মরণ কয়জনের কপালে জুটে।”
জুবায়ের, নিজামের অধ্যায় সমাপ্ত করে বরকতকে নিয়ে চলে আসে।
এদিকে জুবায়ের যাওয়ার পর সবাই বেশ কিছুক্ষন কাচারি ঘরেই বসে রইলো। নিজামের মৃত্য রহস্য নিয়ে সবার জল্পনাকল্পনার অন্ত নেই। মতির মাও গালে হাত দিয়ে জরাজীর্ণ মুখে বসে রইলো। প্রত্যেকে ভিন্ন-ভিন্ন মত প্রদান করছে নিজামকে নিয়ে।

মতির মা ও তার মেয়ে জোছনা রসুইঘরের চৌকিতে গিয়ে শুয়ে পড়লো। কারণ কাজ করার তাগিদে প্রত্যুষকালেই তাদের উঠতে হয়। ফুলবানু চলে যাওয়ার পর সুফিয়ার অনুরোধে জোছনাকে নিয়ে আসে তার মা জামিলা।
বাকিরা ঘরের ভিতর প্রবেশ করলো। এবং সবাই উড়ে গিয়ে শিখার রুমে ঢুকলো। শিখা নেত্রপল্লব উল্টিয়ে হতবিহ্বলের ন্যায় সবার মুখপানে দৃষ্টিপাত করলো। শিখা নিজ থেকেই বলল,
“নিজামের লা* শ নিয়ে গেছে মা?”
অমনি সুফিয়া বিবি মুখে ঝামা ঘষে বলল,

“এহন ত আমরাই ডরে আছি,নিজামের মতন কখন না জানি আমগোরে তুমি মাইরা ফালাও। তুমিতো মারনাই। মারছে তোমার লগেরটা। সেদিন লালচাঁন পীরের কড়া চেঁচা খাইয়াও খবিশ জ্বীনের হুঁশ হইল না।”
“কি বলছেন মা? আন্দাজে এমন অপবাদ দিবেন না আমাকে। আমার সঙ্গে কোন জ্বীন টিন নাই। আমি বাগানের সেদিকে এখনো যাইনাই। জানিও না সেদিকটা সম্বন্ধে।”
আদুরী বিক্ষিপ্ত গলায় বলল,
“তাহলে কে মারছে নিজামরে? আমরা? বরকত? জুবায়ের ভাই? আছো ত আরামে। আবার পড়াশোনাও করো। দেখবো কি হও তুমি। তিনবেলা না খেতে পারতা,সকাল বিকাল লাথি উষ্ঠা খাইতা। বুঝতা স্বামীর সংসার কারে কয়?”

“আপনি বুঝি সকাল বিকাল স্বামীর ঘরে লাথি উষ্ঠা আর জুতার চাবকানো খান? তাই বাপের বাড়ি চলে এলেন আপা?”
শান্ত সুরে বলল শিখা।
শিখার আওড়ানো বুলিতে আদুরীর কান ঝনঝন করে উঠলো। তার নাকের অগ্রভাগ লাল আভা ধারণ করলো। তাতানো মেজাজে বলল,
“আম্মা,চাচী, সবাই শুনলেন ত কি বলল সে আমারে? এর দুঃসাহস দেখলে আমার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকে। স্বামীর সঙ্গে এখনো শোওয়াশুইয়ি হয়নাই। মেশা হইনাই। এখনো সে নতুনের মতই বলতে গেলে। এতেই তার কথাবার্তা লাগামছাড়া হয়ে গেলো। আর সেসব হলে ত আমাদের এ কি করবে,একবার চিন্তা করেন সবাই।”
“স্বামীর সঙ্গে শুইলে সাহস, অধিকার বাড়ে জানতাম না। জানলে দেড়বছর আগেই শুইতাম আপা।”
চনচনে সুরে কন্ঠকে খাদে নামিয়ে বলল শিখা।

” মনে রাখলাম তোমার আজকের কটু ব্যবহার। ”
“আপনার ত আজকে মনে রাখার কারণ ঘটছে। আমি ত বিয়ের দিন রাত থেকেই মনে রাখতেছি। সুতরাং মনে রাখাটা পাল্লাটা আমার অনেক ভারি। সেই হিসেবে আপনারটা মনে রাখার মতো কিছুই না।”
আদুরী ফোঁস করে স্বাস ছাড়ল।
“না বাপু। মাফ চাই। দোয়াও চাই। তোমারে আমি আমার ঘরে রাখুম না। তুমি তোমার মার কাছে চইলা যাইয়ো। আর এইখানে থাকতে হইলে লেহাপড়ি বাদ। বাড়ি ঘরের সব কামকাইজ করতে হইবো।”
“আমি সব কাজ করতে রাজী আছি মা। তবুও আমার পড়াশোনা বন্ধ করবো না।”
স্পষ্ট করে সবাইকে শুনিয়ে বলল শিখা।

সুফিয়া, আদুরী নাক মুখ বিকৃত করে শিখার রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। অন্যরাও চলে গেলো। সবাই বৈঠকখানায় গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসলো। বিপন্ন মনে দোয়া দুরুদ পড়ছে আল্লার নাম জপতে জপতে। রাত বেড়ে দিগুণ হলো। জুবায়ের ঘরে আসলো। বরকত কাচারিতে ঢুকে গেলো। লাইট জ্বালিয়ে সে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
জুবায়ের ক্লান্ত দেহে ঘরে ঢুকলো। সবাইকে নিজামের বাড়ির বিষয় জানালো। শুনে সবাই কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তবে উদ্বিগ্নতা ও প্রশ্ন রয়েই গেলো নিজামের মৃত্য রহস্য নিয়ে। তন্দ্রাঘোরে আচ্ছন্ন থাকা আঁখিযুগল নিয়ে টলতে টলতে তারা যার‍যার রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।
আমেনা ও জুবায়ের তাদের রুমে চলে গেলো। সে ছেলেকে বলল,

“আল্লাগো আল্লা। যদি দেখতি বাপ। শিখার লগে তোর বড় মা, আদুরী কি দুর্ব্যবহারটাই না করলো। তবে মাইয়াও ট্যাটনা আছে। ভালই বাত্তি হইছে আইজকাইল। তাদের প্রতিটা কথার উপযুক্ত জবাব দিছে। ”
” আর কত চুপ করে থাকবে সে মা? কলেজে পড়ে। জ্ঞান বুদ্ধি তারও আছে।”
” হ। তাও কথা। এই মাইয়া যে লেখাপড়া জানা,কথা শুনলেই বুঝা যায়। এগো ঘরে অশান্তির আখড়া। তারাও জ্বলতাছে শিখাও জ্বলতাছে। ”

“শিখার কাজই ত হলো প্রতিমুহূর্তে জ্বলজ্বল করে জ্বলা। নিভে থাকা নয়।”
“আগে সন্ধান পাইলে এই মাইয়ারে তোর বউ বানাইতাম আমি। মাশাল্লাহ। মাইয়া একখান চিজ। যেমন ফুলের মতো রূপ,তেমন নুনের মতন গুন। রাজের ও রাজকপাল কওন যায়।”
জুবায়ের মায়ের সামনে থেকে উঠে যায়। নিজের রুমে কপাট চাপিয়ে দেয়। রাজ্যের আলস্যতা নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়লো। শিখাকে নিয়ে বলা তার মায়ের কথাগুলো তার হৃদয়ভূমিতে হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ করছে। সে তার মাথার চুলগুলোকে খামচি মেরে ধরলো। গলা কাটা মুরগীর মতো ছটপটাতে লাগলো খালি বিছানায়।
মধ্যরাতে ঘুমাতে গেলো বলে পরেরদিন সবাই বেশ বেলা করে উঠেছে। বিশাল জায়গা জুড়ে একাকী তালুকদার বাড়ি। এই বাড়ির অন্দরের খবর সহজে কেউ টের পায় না। তাই রাতের আঁধারের সঙ্গে সঙ্গে নিজামের বিষয়টা অনায়াসেই ধামাচাপা হয়ে গেলো। বরকত একটা খামবন্দী চিঠি এনে দিলো শিখার হাতে।
“ভাবি নেন। পিয়ন আমার হাতে দিয়া গেলো।”

শিখা নাম জিজ্ঞেস করলো ডাকপিয়নের। নাম শুনে বুঝলো এই ডাকপিয়ন তার চেনা সেই ডাকপিয়ন দাদা নয়। সেই আবেগাপ্লুত হয়ে নিজের রুমে গিয়ে চিঠির মুখ ছিঁড়ে নিলো। আগেরকার চিঠিগুলোর চেয়ে এই চিঠির শব্দসংখ্যা অল্প। শিখার বুকের ভিতর কেমন যেন টিপটিপ করছে। পাগল পাগল চোখে সে রাজের চিঠিখানা পড়লো বার দুয়েক।

“জানি ভালো নেই আমার উড়ন্ত প্রজাপতিটা। আমিও একদম ভালো নেই। মনটা বিষাদে ও তীব্র যন্ত্রণায় ছেয়ে আছে। নিজেকে বড় বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে। এতকিছু ঘটে গেলো, অথচ আমি তোমার পাশে নেই। লক্ষিটি আমার,পরাণ আমার, সবুরে মেওয়া ফলে এটাতো তুমি জানই। যেই ধাক্কাগুলো তোমার অল্প বয়সে বিবাহিত জীবনের সূচনালগ্নেই খেলে, আমার অপার বিশ্বাস, এই ধাক্কাগুলোই সময়ের পরিক্রমায় একদিন তোমাকে পাহাড়ের মতো মজবুত ও অবিচল করবে। তখন অনেক বড় ধাক্কাও তুমি সামলে নিতে পারবে। কেননা তখন সেই ধাক্কাগুলোকে তোমার কাছে ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো মনে হবে।

জুবায়ের থেকে কিছু সারমর্ম শুনলাম। বিবরণ তোমার মুখ থেকে শুনবো। আমার উচিত ছিলো সেদিনই আসার। কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি প্রিয়া। এই ভিতরে আসার উপলক্ষ তৈরি করেছি। এই চিঠির জবাব দিতে হবে না তোমাকে। আমি সেই সময়ের আগেই তোমার কাছে চলে আসবো। সাবধানে থেকো। নিজের যত্ন নিও।
ইতি….
তোমার অপরাধী রাজ।”
রাজের চিঠি পড়ে শিখার দুচোখ গড়িয়ে অবিশ্রান্ত ধারায় নোনাজল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এই পরিবারে কেউ এত ভালো কেউ এত মন্দ কেন? কেন এই বৈপরীত্য? এই জন্যই বুঝি বলা হয় হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন সমান নয়। যেমনিভাবে এক মায়ের জন্ম দেওয়া সব সন্তানও একরকম নয়।
ঘরের পরিবেশ হয়ে আছে ঝিমিয়ে আসা বিকেলের মরা রোদের মতো। শিখা মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে দিয়ে বের হয়ে উঠানে গেলো। নিজের চোখে যতটুকু কাজ দেখলো, করে নিলো। মতির মায়ের কাছে গিয়ে পিঁড়ি টেনে বসলো দুই হাঁটু ভাঁজ করে। এবং আরো কাজ করতে চাইলো।
মতির মা বলল,

“ঘরের কাম তুমি কি করবা? ঘরের কাম নিয়া ত সমস্যা নাই। আমি,জোছনা,বরকত আছি না। বউরাও হাত লাগায়। সমস্যা হইলো যেগুলো বাদশা সামলাইতো। তার বদলে নিজাম করতো। হেই কামগুলা নিয়া।”
“বাদশা ভাই,নিজাম কোন কাজ,কি কাজ করতো আপনি জানেন খালা?”
“অনেকটা জানি। সব না। তয় বাদশা,নিজামের বাড়ির অন্দরের কাজগুলা আমি বরকত,জোছনা মিলা করাইছি। বিপদ হইলো বাইরের জায়গা,জমি, ধান,চালের আড়ত,গদি, এসব আরো কায়কারবার দেখাশুনা করতো হেরা। এখন ক্যামনে কি হইবো মাথায় ধরতাছে না। ভেজাল হইয়া গ্যালো। তুমি এসব ব্যাপারে জানতে হইলে,তোমার স্বশুর ও জুবায়েরের লগে আলাপ পাড়তে পারো।”

“আচ্ছা খালা বুঝলাম। তাই করবো। আমার জন্য দোয়া করবেন খালা।”
“দোয়া তোমার লাইগা আমি সকল সময়েই করি। আইচ্ছা বউ, নিজামরে কি তুমিই মারছিলা? আসলে সবার মতন আমারো মনে হয় তোমার লগের জ্বিনেই আক্রোশের বশবতী হইয়া নিজামরে মারছে। কারণ নিজামের লাইগা তুমি মানে সেই জ্বিন কি মাইরটা না খাইলো।”
“খালা কসম খেয়ে বলছি, আমি মারিনাই নিজামরে।”
তারপর শিখা উঠে চলে যায়। বাড়ির এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে দেখলো ভালো করে। শিখা নিয়মিত কলেজে যাচ্ছে। পড়াশোনা করছে। ঘরের টুকটাক কাজকর্মও করে সবার সাথে। তার দু’দিন পরের এক গভীর রাতে রাজ বাড়ি চলে এলো। ঘরের মেইন লোহার দরজায় জোরে আওয়াজ করলো সে। জুবায়ের হাই তুলতে তুলতে উঠে এসে তালা খুলে দিলো।

“কিরে রাজ এলি?”
” সরি,তোর ঘুম থেকে উঠতে হলো আমার জন্য। এখন ঘুমা গিয়ে। সকালে মার্কেটে যাওয়ার আগে উপরে আসিস। জরুরী কথা আছে।”
বলেই রাজ ঠাসঠাস পায়ে দোতলায় চলে গেলো হাতের ব্রিফকেসটা নিয়ে। জুবায়ের গিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। রাজ ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেস হয়ে নিচে নেমে এলো। পুরো ঘরে সবার রুমের সামনে এক চক্কর মেরে নিলো। শিখার রুমের সামনে গিয়ে দরজার কপাটে আস্তে করে হাত রাখলো। বুঝলো ভিতর থেকে বন্ধ। পরে সে মায়ের রুমে উঁকি দিলো।

“কে রাজ?বাবা কখন আইলি? ডাকলি না ক্যান মায়েরে? আয় ভিতরে।”
রাজ বিমর্ষ মুখে রুমে গিয়ে মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম দিলো। বলল,
“এতরাত বলে ডাকিনি মা। আপনি ঘুমাচ্ছেন তাই।”
“ঘুমেই ছিলাম। তোর পায়ের শব্দ শুইনাই জাইগা গেছি। ভাত খাইবি না? টেবিলে আয়।”
“নাহ মা। আমি কুমিল্লা খেয়েছি। ঘুমাবো। উপরে যাই আমি।”
রাজ চলে গেলো। সুফিয়া বিবির কলিজা মোচড় মেরে উঠলো কলার মোচার মতন। এই প্রথম রাজ খালি হাতে বাড়ি এলো। তাকেও ডাকল না। যা এর আগে আর কোনদিন হয়নি। অথচ ঘরে বউ আছে। নয়তো রাজ বাড়ি আসতে দুইহাত বোঝাই করে বহুকিছু নিয়ে আসে সবার পছন্দের। রাজের মুখাবয়ব সুফিয়া বিবির অন্তরে অশনি সংকেত বাজিয়ে দিলো।

সকালে জুবায়ের ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করেই উপরে চলে গেলো। দেখলো রাজ এখনো বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।
“আয় বোস। জ্বীন তাড়ানো ফকিরের বাড়ি চিনিস?”
“নাহ। বরকত চিনে।”
“আচ্ছা। তাহলে এই বিষয় আমি দেখতেছি। নিজাম কাচারিঘরে আছে?”
“নাহ। নিজামের বিষয় পরে শুনিস। সব একসঙ্গে শুনলে তোর মাথা নষ্ট হয়ে যাবে। নষ্ট মাথা নিয়ে বাসর করবি কিভাবে?”
“আরেহ বল বলছি?”
“নিজামের মৃতদেহ গত শুক্রবার রাতে উদ্বার হলো বাগানের ভিতর থেকে। লা* শা তার বাড়িতে দিয়ে আসছি। ক্যাশ বিশহাজারসহ। আমি দশ তোর মা দিলো দশ। সবাই ধারণা করছে শিখার সঙ্গের জ্বীনর এই কাজ।”

সেদিন বিকেলে বাগানে শিখা গিয়েছিলো, এই বিষয়টা জুবায়ের গোপন রাখলো রাজের কাছে।
“হোয়াট!” বলে রাজ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। দেয়ালে পা দিয়ে আঘাত করলো। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল। তর্জন গর্জন শুরু করে দিলো বনের বন্য পশুর ন্যায়। জুবায়ের, রাজকে অনেক বুঝিয়ে স্থির করলো। রাজ বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল,
“বাসরের কথা যেহেতু বললি,তাহলে একটা গুরু দায়িত্ব দিতে চাই তোকে। সব কাঁচা ফুলের দোকানে লাল গোলাপের অর্ডার দিয়ে রাখবি। এবং পরশু রাতের জন্য বাসর ঘরটা সাজিয়ে দিবি লোক দিয়ে। গোলাপাচ্ছাদিত বাসর হবে। অন্য কোন ফুল নয়।”

“আমি?”
ভিরমি খাওয়া গলায় বলল জুবায়ের।
“অবাক হলি কেন? মনে হচ্ছে তোকে হাত দিয়ে পাহাড় ঠেলতে বলছি। এতো আরো আনন্দের কাজ।”
“সেটা ত তোর আনন্দ। আমার কি?”
মুচকি হেসে বলল জুবায়ের।
“তোর জন্য পাত্রী খুঁজতেছে আমার আগ থেকে। তুই করছিস না কেন বিয়ে?”
“আচ্ছা বাসর ঘর প্রস্তুত করে দিবো। আর কিছু?”
“আপাতত নয়।”
“গেলাম আমি। থাক তুই।”

জুবায়ের রেডি হয়ে বাইক নিয়ে বেরিয়ে যায়। শিখাও কলেজে চলে যায়। রাজ দোতলায় দাঁড়িয়ে শিখাকে দেখলো। শিখা রাজকে দেখেনি। কারণ রাজ দেখা দেয়নি। নিচে নেমে গেলে সে আদুরীকে দেখলো। আদুরী ছোট ভাইয়া বলে রাজকে জড়িয়ে ধরলো।রাজ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই কবে থেকে?”
“এইতো কয়দিন হবে।”
“ওহ আচ্ছা। থাক।”
আদুরীর বিষয় রাজের অজানা। তাই ছোট বোনের প্রতি এখনো তার ভালোবাসা, স্নেহ অপরিসীম!
বিকেলে রাজ বরকতকে নিয়ে লালচাঁন ফকিরের বাড়ি গেলো। তারসঙ্গে যায় এলাকার আরো দুজন ছেলে। যাদেরকে গ্রামে মাস্তান হিসেবে সবাই চিনে। তুলে আনে লালচাঁনকে। পিছমোড়া করে কাঁঠাল গাছের সাথে তার দু’হাত বেঁধে নিলো। মশা মারার সুযোগও নেই লালচাঁন পীরের। শিখা কলেজ থেকে এসে রান্নাঘরে গিয়ে ভাত খেয়ে নিলো। নিজের রুমে এসে পরিক্ষার জন্য নোট করছে। ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরিক্ষা সন্নিকটে।
“শিখা…বেরিয়ে আসো উঠানে।”

রাজের ভরাট কন্ঠস্বর শিখার অন্তরে সুখের প্রতিধ্বনির মতো বেজে উঠলো। সে প্রায় দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে পা রাখলো। চকিতে চাইলো রাজের মুখপানে। ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। অদ্ভুত গলায় বলল,
“আ..আ..আপনি কখন এলেন?”

রাজবধূ পর্ব ৪১

“আমি কখন এলাম সেটা পরে জানলেও চলবে। এই ঘুষখোর, ভণ্ডর থেকে তোমাকে অন্যায়ভাবে টর্চার করার প্রতিশোধ নাও। ঠিক তোমাকে যেভাবে আঘাত করেছে একইভাবে তুমিও তাকে মারবে এখন।”
বরকত চেয়ার এনে দিলো রাজকে। রাজ পায়ের উপর পা তুলে বসলো।
রাজকে দেখেই শিখা নিজেকে আর সংবরণ করতে পারেনি। নিরবে কেঁদে ফেলল।
“শিখা প্রজ্বলিত হও। এখন কান্নার সময় নয়। আমি এই মুহূর্তে তোমার লেলিহান শিখা দেখতে চাই।”
বজ্রকণ্ঠে শিখাকে হুকুম করে বলল রাজ।

রাজবধূ পর্ব ৪৩