রাজবধূ পর্ব ৫২

রাজবধূ পর্ব ৫২
রেহানা পুতুল

“শিখা, দোতলায় আসো জলদি।”
শিখা অফুরন্ত সাহস নিয়ে রাজের পিছু পিছু সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠে গেলো। তার মাঝে কোন ভীরুতা নেই। আড়ষ্টতা নেই। নেই কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব। কেবল আছে মজবুত হয়ে ঘুরে দাঁড়াবার প্রত্যয়।
শিখা পালংকের এককোণে বসলো। রাজ ব্যক্তিত্বপূর্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? ডিটেইলস শুনতে চাই?”
শিখা তার বন্ধু কুসুম ও রাজের ফুফাতো ভাই সীমান্তের সম্পর্কের বিষয়ে এ টু জেড় সব বলল রাজকে।
“এখানে তোমার দোষ কোথায়? ফুফু তোমাকে ব্লেইম দিলো কেন?”
“একই প্রশ্ন আমারো। তবে উত্তরও আমি বের করেছি।”
“কিহ? বলো?”

” আপনাদের পরিবারে অন্যদের মতো উনিও আমাকে পছন্দ করেন না। বরাবরই নাক উঁচু করে কথা বলে আমার সঙ্গে। নিচু চোখে দেখে আমাকে। এখন যখন শুনলো কুসুম ও আমি ক্লাসমেট ও ক্লোজফ্রেন্ড। তাই উনি বুঝেই নিয়েছে আমিই কুসুমকে উৎসাহিত করেছি সীমান্ত ভাইয়ের সঙ্গে প্রেম করার জন্য। যেহেতু কুসুমদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত উনারা ধনী। কুসুম তাদের গ্রামেরই মেয়ে। সীমান্ত কুসুমকে আগে থেকেই ফলো করে আসছে। আমার পরিচয় জেনেছে বহুপরে।”
রাজ একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“তুমি কি চাও সীমান্ত কুসুমকে বিয়ে করুক?”
“হাজারবার চাই তাদের প্রেম পূর্ণতা পাক।”
“মহা গ্যাঞ্জাম লেগে গেলো যে। আচ্ছা, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। আমি সীমান্তের সঙ্গে কথা বলে বাকিটা ডিল করবো।”
“ধন্যবাদ আপনাকে,আমাকে ভুল না বোঝার জন্য।”
“দেখো অবস্থা। অচেনার মতো জামাইকে ধন্যবাদ দিলে হবে?”
“তো কি দিবো ফড়িং ভাই?”
দুষ্টমিষ্ট হেসে বলল শিখা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপনার রাজ কোষাগার হতে সামান্য নজরানা পেলেই এই অধম ধন্য হয়। অঢেল প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য দিয়েছে স্রস্টা আপনাকে। সুবহানাহু! উদার হস্তে উনি আপনাকে দান করেছে রাজকীয় সব মহা মূল্যবান ধন সম্পদ।”
শিখা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। ছুটে পালানোর মতো করে রুম হতে বেরিয়ে গেলো। জানালা দিয়ে ভেংচি কেটে বলল,

“হিঃহিঃহিঃ এই যে নিন,বেলী ফুলের হাসি নজরানা দিলাম। এটা নিয়েই তৃপ্ত হউন মিস্টার অধম ভাই।”
রাজ দরজায় গিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়েও পারল না। শিখা নিচে উঠানে চলে গেলো। রাজ দোতলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে শিখার দিকে তাকিয়ে শিহরিত হাসি হাসলো।
রাজ সীমান্তের সঙ্গে দেখা করলো। নিশ্চিত হলো যে শিখার কোন ভূমিকা নেই কুসুম ও সীমান্তের গভীর প্রণয়ে।
তারপর তার বড় ভাবি রানীর থেকে ঠিকানা নিয়ে আদুরীর প্রাক্তন প্রেমিক শোয়েবের সঙ্গে দেখা করলো। বিস্তারিত জানায়। বলল,

“আমি তোমাদের বিষয়ে সব শুনেছি। এখন কি তুমি আদুরীকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক?”
“ভাইয়া,আমি আদুরীকে বিয়ে করতে চেয়েছি। সে মানা করেছে আপনাদের পরিবারের কথা ভেবে। এখন ত তালাকপ্রাপ্তা মেয়েকে আমার পরিবার কিছুতেই মেনে নিবে না। আমাকেও ত্যাজ্যপুত্র করে দিবে। আমি আদুরীকে ভালোবাসি। কিন্তু পরিস্থিতির কাছে আমি অসহসায়।”

রাজ বিমর্ষ মুখে বাড়ি ফিরে আসে। রানিকে দিয়ে আদুরীকে বিষয়টি জানায়। আদুরী পাথর হয়ে গেলো। কিছুই বলল না। কেননা বলার কিছুই নেই। তার এই নিদারুণ জীবনের জন্য দ্বিতীয় কেউই দায়ী নয়। দায়ী হয়তো তার নিয়তি।
তারপর হতে আদুরীকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে। সুমনা রানীর সঙ্গে চিরতরে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। শিখার উপর তার মন বসলো কিছুটা। আগে নিজের দুই সন্তান সবুজ ও আঁখিকে শিখার থেকে দূরে রাখতো। এখন আর তাদের মানা করে না। আটকায় না। শিখাও তাদের বেশ আদর,স্নেহ করে।
রানীর বহুক্রোধ শিখার উপর স্তুপাকার হয়ে আছে৷ কারণ শিখার জন্যই সেদিন সবার সামনে তার মুখে চুনকালি লাগলো। শিখা কি চাইলেই অন্যকিছু বলতে পারতো না তখন? পারতো। কিন্তু সে ইচ্ছে করেই সত্যিটা বলে দিয়েছে। সততা দেখায়। নাহ? এর ফল বের করা হবে তার থেকে।হুহ!
তালুকদার তার কক্ষে ঘরের সবাইকে ডেকে বসলো এক রাতে নৈশভোজের পর। নিজের শরীর ভালো যাচ্ছে না। সেজন্য সবার সম্মুক্ষেই তিনি রাজ,জুবায়ের ও শিখাকে সব দলিল ও কাগজপত্র মেলে মেলে বুঝিয়ে দিলেন। তারা তিনজন ভালো করে বুঝে নিলো।

জুবায়ের বলল,
“আমি সকালে যাই রাতে আসি। শুক্রবার ছাড়া বাড়িতে থাকা হয় না। শিখা সব বুঝে নিক ভালো করে। সে এই পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।”
পাশ থেকে রাজ বলল,
“আমারও একই কথা বাবা। আমি থাকি দূরে। পরিবারের বাকিদের মধ্যে শিখা এগিয়ে সর্বদিক দিয়ে। শিখা বুঝে নিলেই চলবে আমাদের। নাকি বলো শিখা?”
“আমার কোন সমস্যা নেই। এসবে আমার অভিজ্ঞতা টুকটাক এমনিতেই রয়েছে। আম্মা যে একা হাতে সব সামলাতো,সেসব দেখে দেখে জায়গা জমির অনেক কিছুই আমি বুঝি।”

মিষ্টি হেসে সুমিষ্ট স্বরে জানালো শিখা।
আলহামদুলিল্লাহ বলে স্রস্টার নিকট
শুকরিয়া জ্ঞাপন কররলো জয়নুল তালুকদার।
ডলি মুখ কালো করে বলে উঠলো,
” ছোট ভাইয়া এটা কি বললেন? ক্যামনে শিখা সবার চাইতে আগায়া আছে? আদুরী আপা আমি আই.এ পাশ করছি। শিখা এখনো আমাদের থেকে পিছায়া আছে। দ্বিতীয় বর্ষেই ত এখনো উঠেনাই।”
রাজ, ডলির দিকে ঠাট্টা করে বললো,
“হ্যাঁ, তোমরা ননদ ভাবি কলেজ পাশ। কিন্তু কলেজ বানান পার না। শিখা পারে। তাহলে কে এগিয়ে? শিখা না তোমরা? ”
জুবায়ের হেসে উঠলো রাজের দিকে চেয়ে। এবং ট্যারা চোখে ডলির দিকে তাকিয়েও। ডলি উঠে চলে গেলো বিরক্তিভরা মুখে।
সুফিয়া বিবি কত্রীভাব দেখিয়ে স্বামীকে বলল,

“আমার বড় দুই পোলা উপস্থিত নাই। এতো তাড়া কিসের পরের মাইয়ারে সব বুঝায়া দেওনের? কি এমন বুঝনেওয়ালী, দেখুমনি আমি সুফিয়া বিবি বাঁইচা থাকলে।”
জুবায়ের বলল,
“বড় মা,খালেদ ভাই,আসলাম ভাইর চেয়েও শিখার নলেজ ও বুদ্ধি ভালো।”
সুফিয়া বিবি জ্বলে উঠলেন এক লহমায়। কথার তোড়ে জুবায়েরকে মেঘমুখে শাসিয়ে বললেন,
“তোর সমস্যাটা কি জুবা? এই মাইরা তোর বউ না রাজের বউ? এতই দরদ হইলে নিয়া যা তোগো ঘরে তারে।”
শিখা লজ্জায় মরে যাচ্ছে। ত্বরিত গতিতে অবনত মস্তকে সবার সম্মুখ হতে চলে গেলো। তালুকদার ক্ষেপিয়ে উঠলেন সুফিয়ার উপরে। বললেন,

“নাউজুবিল্লাহ! নাউজুবিল্লাহ! তওবা করো কইলাম। জিদ্দের বশে এমন কথা মুখে আনাও হারাম। গুনাহ! একজনের বউ ক্যামনে আরেকজনের বউ হয়। ফালতু মহিলা কোথাকার।”
রাজও মাকে ধমকে উঠলো।
“কি যা তা বলছেন মা। মুখের লাগাম টানুন বলছি।”
” যুবা যেমন করে তারে নিয়া। ঠিকই কইছি আমি। বউ হইলো আমগো ঘরের। কিন্তুক কিছু হইলেই এই পোলা নাক গলানো শুরু করে। মাথা ঠিক আছে আমার? আমার যন্ত্রণা আমি বুঝি। তোরা কি বুঝবি? গুয়ের মাছি যখন হাতির ইজ্জত পায়, তখন হাতির জ্বলুনি উঠবোই। হাতির তখন মন চাইবো, সেই গুয়ের মাছিরে পিষা মাইরা ফালাইতে। ল্যাদা মাইয়ারে সবাই কি তোষামোদ করতাছস। কি তেলান তেলাছ। সক্কল কিছুই ঠাহর করতাছি দুইটা বছর ধইরা।”
সুফিয়া বিবি থামলে রাজ বলে উঠলো,
“জুবায়ের শিখার পক্ষ কখনোই নেয়নি মা। নিরপেক্ষ বিচার করতে গেলেই আপনারা দোষী হয়ে যান। এইই। আমাদের যৌথ পরিবার। সবই এক। জুবায়েরের স্থানে আমি হলেও তার বউকে নিয়ে প্রতিবাদ করতাম। ঠিক আছে মা। এতই যখন শিখাকে সহ্য হয় না আপনাদের কারোই। আমি তাকে সবসমযয়ের জন্য আমার কাছে নিয়ে যাবো। তার ফাইনাল পরিক্ষাটা হয়ে যাক কেবল।”

জুবায়ের উঠে দাঁড়ালো। উত্তেজিত গলায় সুফিয়া বিবির দিকে চেয়ে বলল,
“নিজের সুবিধামতে কিছু হলে বলেন,বাবা ভালো করছিস। তুই আর রাজ তো একই। আবার নিজের ইচ্ছের বাইরে কিছু হলে বলেন,আমাদের বিষয়ে নাক গলাস কেন? আপনি বড় স্বার্থবাদী। আমার মাকেও কম জ্বালান নি আপনি বড় জায়ের দাপট নিয়ে। আমি কি শুধু শিখার হয়ে কথা বলি? এই ঘরে আর কারো কিছু নিয়ে কথা বলি না? প্রতিবাদ করি না? সেসব আপনার চোখে পড়ে না? যান, আমি আর কোন কথাই বলব না কারো বিষয়ে। সবাইকে মুক্ত করে দিবো। সবাই খুশী থাকবেন তখন।”

কথাগুলো বলে জুবায়ের লুঙ্গির এক পাশ ধরে নিজের রুমে চলে গেলো। সিগারেট ও গ্যাসলাইট হাতে নিয়ে ফের বেরিয়ে পড়লো। রাজ মায়ের দিকে ধারালো চাহনি ফেলে জুবায়েরের রুমে গেলো। তার পিছন দিয়ে অন্যরাও উঠে গেলো। রাজ দেখলো জুবায়ের নেই। এদিক সেদিক খুঁজেও পেল না। টর্চ লাইট মেরে বাইরে খুঁজলো। তাও জুবায়েরের দেখা মিলল না। ছাদে গিয়ে দেখা পেলো জুবায়েরের। সিগারেট ফুঁকছে সে।
“মায়ের কথায় রাগ করিস না জুবায়ের। শান্ত হ। আমিতো তোকে কিছু বলিনি। একটা বিয়ে করে নে তুই। দেখবি মন মেজাজ ভালো থাকবে। দে, এক টান দিই।”
“আমারটা নিবি কেন? ধর, পুরো একটা টান। দেখি। হয়তো করবো। বড় মা মানুষটাই সুবিধার নয়। বুঝলি।”
রাজ সিগারেট জ্বালিয়ে নেয়। মুখ উঁচিয়ে দীর্ঘস্বাস ছেড়ে বলে,
“কপাল! আমার বাবা ভালো। মা একটু সুবিধাবাদী। তোর মা ভালো। বাবা ছিলো নষ্ট।”
নিচে শিখা এতক্ষণ সবার কথাগুলো আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনে নিলো মনোযোগের সহিত। মনে মনে শপথের মতো করে বলল,

আমি গুয়ের মাছি? আপনারা হাতি নাহ? একদিন আমিই হাতি হয়ে উঠবো। তখন আপনারাই গুয়ের মাছি হয়ে ত্রাহি ত্রাহি রবে চিৎকার করবেন বাঁচার জন্য। কিন্তু বাঁচার ও পালানোর পথ কিছুই পাবেন না। কেবল সময়ের অপেক্ষা।
তার পরেরদিন হতে তালুকদার শিখাকে সাথে করে নিয়ে বের হয়। শিখাও নিজকন্যার মতো মাথায় ওড়না দিয়ে স্বশুরের সাথে সাথে হাঁটে৷ তালুকদার, বাড়ির আনাচে কানাচে তাদের সব ঘরোয়া সম্পত্তির সীমানা শিখাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়ে দেয়। এভাবে আস্তে আস্তে শিখা সব চিনে যায়। বুঝে নেয়।
এক বিকেলে শিখা রাজকে বলল,
“আপনিতো মনে হয় চলে যাবেন নাহ?”
“হ্যাঁ। যেতে ইচ্ছে করেনা তোমার আঁচলতল ছেড়ে। তবুও যেতে হবে। নয়তো সেদিকে ঝামেলা হয়ে যাবে। পাক্কা দুই মাস শেষ হয়ে গিয়েছে।”
“তাহলে আমাকে একটা সিনেমা দেখাবেন হলে গিয়ে?কোনদিন দেখিনি আমি। ক্লাসের প্রায় সব বান্ধবীরাই শুনি সিনেমা দেখতে যায়।”
“আচ্ছা। খোঁজ নিতে হবে কোন সিনেমা চলছে এখন। সেদিন আমার পছন্দের একটি শাড়ি পরো তাহলে।”
“আচ্ছা। পরবো।”

তার একদিন পর বিকেলে রাজ শিখাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যায়। শিখার পরনে রাজের পছন্দের একটি জর্জেট শাড়ি। কপালের ছোট্ট একটি কালো টিপ ও কাজল কালো আঁখি দুটোর জন্য শিখার রূপ লাবণ্যের স্নিগ্ধতা বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ। স্ক্রিন থেকে বিশাল পর্দা সরে গেলো। লাইট অফ হয়ে গেলো। শুরু হয়ে গেলো ১৯৯২ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘অন্ধ বিশ্বাস’। শ্রেষ্ঠাংশে রাজ্জাক, শাবানা,আলমগীর ও নতুন।
রাজ ও শিখা পিছনের স্পেশাল সিটে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে। আবছায়া আলোতে শাড়ি পরিহিত শিখাকে বেশ আবেদনময়ী লাগছে রাজের চোখে। শিখার কাছেও বেশ রোমাঞ্চিত অনুভব হচ্ছে এডভেঞ্চারের মতো। তার লাইফে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা এই প্রথম।

সিনেমার একটি রোমান্টিক গান শুরু হলো।
“ভালোবাসা তুমি আমার/যুগে যুগে আমি তোমার।”
ঠোঁট মেলাচ্ছে আলমগীর ও সাবানা। রাজ মোহিত চোখে নায়ক নায়িকাকে দেখছে। নিবিষ্টচিত্তে গান শুনে যাচ্ছে। আস্তে করে শাড়ির ফাঁক দিয়ে শিখার পেটে মৃদু চাপ দিলো। শিখার পিঠ হতে চুল সরিয়ে ঘাড়ে চিবুক ঠেকিয়ে ধরলো। শিখাকে আকুতি স্বরে বলল,
“চুমু দাওতো চঞ্চল প্রজাপতি। কুইক।”
শিখা লাজুক চোখে রাজের দিকে চাইলো। রাজের মুখ ঘুরিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাক করিয়ে দিয়ে বলল,
“সিনেমা দেখুন। সময়ের কাজ অসময়ে নয়।”
“স্বামী স্ত্রীর জন্য অসময় বলতে কিছুই নেই। চব্বিশ ঘন্টাই উম্মুক্ত।”
রাজ নাছোড়বান্দা। শিখা জানে। তাই আলতো করে রাজের গালে চুমু খেল কয়েকটি। রাজ গালে হাত বুলিয়ে শিখার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

“আহ শান্তি! দিল শান্তি ত দুনিয়া শান্তি। আজ রাতে ব্যথা একটু বেশিই দিব। চলে যাবো যে। সমস্যা নেই। সব মেডিসিন মজুদ আছে রুমে।”
শিখা রাজের হাতে কামড় সিয়ে বলল,
“আমাকে সেই ব্যথা দিলে,আমিও এই ব্যথা দিবো।”
“সেই ব্যথা সুখের ব্যথা। এই কামড় সুখের কামড়। যত ইচ্ছে দাও। তোমার বত্রিশ দাঁতের আঘাতে আঘাতে আমাকে অনন্ত ব্যথা দাও।”
সিনেমা শেষ হয়ে গেলে দুজন হল থেকে বেরিয়ে আসে। রাজ গুনগুন করে গাইতে থাকে, কিছুক্ষণ আগে চলা গানটি। তিনতলা থেকে নিচে নেমে এলে শিখা বলল,
“জুবায়ের ভাইয়ার দোকান কোন মার্কেটে?”
“ভালো কথা মনে করেছো। চলো যাই তার দোকানে। এইতো কাছেই। ডালিয়া মার্কেটে। ‘আমেনা বস্র হাউজ।’ চাচীর নামেই দোকানের নাম।”

জুবায়ের দোকানের ক্যাশেই বসা ছিলো। অকস্মাৎ রাজ ও শিখার আগমনে সে ভিমরি খেয়ে গেলো। কিঞ্চিৎ এলোমেলো সুরে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
“কিরে তুই? শিখা? কোন অনুষ্ঠানে গেলি দুজন? ”
“নাহ। ওকে সিনেমা দেখালাম। কোনদিন দেখেনি। এখন বলল তোর দোকানে আসবে। তাই নিয়ে এলাম।”
“খুব ভালো করেছিস। তা কেমন উপভোগ করলি সিনেমা?”
“অস্থির।”

শিখা ও রাজ টুল টেনে বসলো। জুবায়ের নাস্তা আনালো দোকানের স্টাফকে পাঠিয়ে। নাস্তা খেয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে জুবায়ের থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো রাজ ও শিখা।
সেই রাতে জুবায়ের বাড়ি যায়নি। ক্লাবে চলে যায়। একের পর নেশার বোতল খালি করে নেশাতুর অবস্থায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে। সকালেও বাড়ি যায়নি। কোনভাবে যদি রাজ তাকে সন্দেহ করে। তাহলে শিখাকে ভুল বুঝতে পারে। তারজন্য শিখার জীবনে এতটুকু সমস্যা হোক,তা সে কখনোই চায় না। সে অন্যভাবে রাজকে বলবে তাও প্রসঙ্গ এলে। নয়তো কখনোই বলবে না। তার অপ্রাপ্তির দহনের আঁচ কেন রাজ শিখার জীবনে প্রভাব ফেলবে।
সেইরাতেই রাজ শিখাকে নিয়ে দ্বিতীয় বাসরের মতোই উম্মাতাল সুখে মেতে উঠলো। কামাতুর চাহনিতে গিলে নিলো শিখার অঙ্গ সুরভি আর সত্যি সত্যিই শিখা প্রচুর ব্যথা পেলো বারবার। চেয়েও রাজকে থামানো যায়নি।
সবার থেকে বিদায় নিয়ে রাজ পাড়ি জমায় শহরে। শিখার ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরিক্ষাও শেষ হয়ে গেলো। শিখা যতটুকু পারে নিজ হাতে ঘরের কাজ করে সবার সাথে। বাড়ির চারপাশেও তদারকি করছে মতির মা,বরকতকে সঙ্গে করে।

একদিন সে ভোরে কাচারি ঘরের পাশে গেলো কোন এক প্রয়োজনে। কাচারির উঠানে রোজ মক্তব বসে। আশেপাশের কয়েকবাড়ির ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বেতের পাটি নিয়ে আরবী পড়তে আসে হুজুরের কাছে। আলাউদ্দিন নামের একজন যুবক হুজুর তালুকদার বাড়িতে জায়গির থাকে। কাচারি ঘরে আলাদা চৌকিতে সে ঘুমায়। মিহি সুরে বাচ্চারা সূরা, কায়দা,আমপারা,কোরান তেলওয়াত করতে থাকে।
শিখা হুজুরের একটা ভুল ধরিয়ে দিলো এগিয়ে গিয়ে। তালুকদার দেখে শিখার উপর খুশী হলেও সুফিয়া বিবি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। সে বলল,
“কি বের্ত্তুমিজ মাইয়া। হুজুরের ভুল ধরতে আসে। এমন ভাবে চলে যেন এই গোটা তালুকদারি তার বাপের কিনা সম্পত্তি।”

শিখা কিছু বলল না। চুপচাপ রইলো।
রাজ চলে যাওয়ার পর হতেই সুফিয়া বিবি ও রানীর আলাদা আলাদাভাবে বাইরে চলাচল বেড়ে যায় রাতে বিরাতে।
সেদিন ভীষণ গরম পড়েছে। সময় মাঝরাত। বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। জুবায়ের ছাদে গিয়েছে হাওয়ায় একটু গা জুড়ানোর জন্য। সে দেখলো কালো বোরকা পরা কোন এক একাকী নারী তাদের ঘরের ভিতরে প্রবেশ করছে। সে বিড়াল পায়ে সেই নারীর গতিবিধি লক্ষ্য করলো। দেখলো আর কেউ নয়। সুফিয়া বিবি। জুবায়ের সাতপাঁচ ভেবেও কারণ উদঘাটন করতে পারল না। নিজের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। তার কি। যা ইচ্ছা ঘটুক। সে আর কিছুতেই কথা বলবে না কারো জন্য।

রাজবধূ পর্ব ৫১

তার পরেরদিন শিখা কলেজ থেকে এসে রোজকার মতো রান্নাঘরে যায়। ভর্তা তার অতি প্রিয়। লোভ সামলাতে পারেনি দেখে। গাপুসগুপুস করে দুই রকমের ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে নেয়।
সেই সন্ধ্যায় শিখার প্রচন্ড পেট ব্যথা আরম্ভ হয়। সে আম্মাগো! বাঁচান বলে চিৎকার করতে থাকে। মতির মা, সুমনা,আদুরী ছুটে যায়। তাদের হায় হুতাশে সময় অতিক্রম হয়। শিখা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে।

রাজবধূ পর্ব ৫৩