রাজবধূ পর্ব ৫৯
রেহানা পুতুল
“একটা বিলবোর্ডে আপনার ছবি দেখলাম। দুই কাঁধে দুটো মেয়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আপনি মডেল? বলেন?”
অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়ভরা চোখে রাজের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো শিখা।
রাজ মনে মনে উচ্চারণ করলো,
” যেখানে বাঘের ভয়,সেখানে রাত হয়। হায় খোদা! সহায় হও।”
“বলেন না? সেই ছেলেটা আপনি?”
অস্থির গলায় আবার প্রশ্ন করলো শিখা।
রাজ না শোনার ভান করলো। কাঁচের বাইরে সতর্ক দৃষ্টি রেখে জিপ ড্রাইভ করতে করতে সাবধানী ভঙ্গিতে বলল,
” ও হ্যাঁ। শোন, তুমি বাড়িতে গিয়ে কাউকেই বলবে না ডাক্তার কি বলেছে। শুধু বলবে ডাক্তার মেডিসিন দিয়েছে। দেখা যাক। আল্লাহ ভরসা।”
“না শিখিয়ে দিলেও এটাই বলতাম আমি। সেই মডেল আপনি?”
রাজ বুঝলো নিস্তার নেই আজ। তবুও বলল,
“না আমি নই। একই চেহারার আদলে অন্য কেউ হতে পারে। সামান্য একটা ছবি নিয়ে এমন হাপিত্যেশ করছ কেন?”
“কিছুই করছি না। জাস্ট জানতে চাচ্ছি।”
“তোমার কি ডাউট হচ্ছে আমি মনে করে?”
“খুব হচ্ছে।”
“কারণ?”
“কারণ, শুরু থেকেই আপনার হাঁটাচলা,কথা বলার ধরণ,
দুস্টামি,রোমান্টিকতা,পোশাক, সবই অনেকটা টিভির মানুষের মতো। তাই এখন এই মডেলরূপে আপনাকে দেখে সন্দেহ ও বিশ্বাসটা বেড়ে গেলো।”
“যদি আমি হই,কি করবে বা কি বলবে?”
ধীর গলায় জিজ্ঞেস করলো রাজ।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“কিছুই করবো না। কিছুই বলব না। তবে ব্যথা পাবো অন্তরে।”
“কেন? তুমি মডেল রাজের বউ। এটা ত আরো আনন্দের!”
“সবসময় সবার জন্য সবকিছু আনন্দের হয় না। নিরানন্দেরও হয়। লুকালেন কেন? এটা জানতে চাই।”
” খুব লজিক্যাল কথা শিখে যাচ্ছো। শান্ত হও। কুমিল্লা রেস্টুরেন্টে খাওয়ার জন্য গাড়ি থামাবো। তখন বলছি। নয়তো বাড়িতে গিয়ে বলবো।”
শিখা মধ্যদুপুরের উদাস পাখির ন্যায় আনমনে বাইরে চেয়ে রইলো। রাজের পানে ভুলেও দৃষ্টি নিক্ষেপ করল না। অষ্টাদশী শিখার তরুণী মনে অস্থিরতা বিরাজ করছে রাজকে নিয়ে। রাজ চুপচাপ জিপ ড্রাইভ করে যাচ্ছে। ক্যাসেট প্লেয়ার অফ করলো। ‘সোলস’ ব্যন্ডের ‘এ এমন পরিচয়’ অডিও ক্যাসেটটি প্লে করে দিলো।
“এ এমন পরিচয় অনুমতি প্রার্থনা..
সবিনয় নিবেদন কিছুই যে লাগে না।
নিজেরই অজান্তে, হৃদয়ের অনন্তে
কিছু কথা ভালোলাগা, করে যায় রচনা।
নিরালায় একা একা, এলোমেলো ভাবনায়, কত কথা বলে যাই, শুধু তারই সাথে।
এ যেন কল্পনা, মিলন মোহনা…”
” পার্থ বড়ুয়ার স্মার্ট ভরাট কণ্ঠে গানটা দারুণ না?”
শিখার দিকে চেয়ে মন ভুলানো হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো রাজ।
“হুম দারুণ।”
মৌনতা ভেঙ্গে ছোট্ট করে বলল শিখা।
“মন খারাপ অগ্নিশিখা?”
“বাড়িতে গিয়ে শুনবো। বাইরে লোকালয়ে নয়। তাহলে আপনি একজন মডেল, এটা স্বীকার করলেন অবশেষে?”
“আমি এ নিয়ে এখন একটি কথাও বলব না তোমার সঙ্গে। যা বলার বাড়িতে গিয়ে বলবো।”
“মিথ্যার আশ্রয় কেন নিলেন?”
শাণিত গলায় জিজ্ঞেস করলো শিখা।
রাজ গাড়ির ব্রেক কষলো। শিখার উরুর উপর হাত রেখে বিগলিত স্বরে বলল,
“তোমাকে পাওয়ার জন্য এমন বহু মিথ্যার আশ্রয় নিতে আমি সদা প্রস্তুত।”
শিখা মৌন রইলো। সারামুখ জুড়ে তার বিচলিত ভাব। রাজ পূনরায় গাড়ি স্ট্রাট দিলো। পিচঢালা পথ মাড়িয়ে দুর্বার গতিতে সাঁই সাঁই করে চলে গেলো কুমিল্লা খাবারের রেস্টুরেন্টের সামনে। শিখাকে নিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। মহিলা ওয়াশরুম দেখিয়ে বলল,
“যাও। হাতমুখ ধুয়ে এসো।”
শিখা ওয়াশরুমে গেলো। বের হয়ে বেসিনের বড় আয়নায় নিজের প্রতিকৃতির দিকে চেয়ে তীর্যক হাসি হাসলো। মনে মনে বলল,
হতচ্ছাড়ি মেয়ে কোথাকার। কুঁড়েঘর থেকে রাজপ্রাসাদে চলে গেলি। ঝিলের ধারের কুড়ানো লোনা শাক,তিতা ডিমা,হেলেঞ্চা শাক, বইতার শাকের বদলে এখন প্রতিবেলায় খাস কত রকমের সুস্বাদু মাছ, গোশত,নারকেলের ঝোল, রাজহাঁসের ডিম আরো কত কি! এর বিনিময়ে দূর্গতি না পোহালে জীবনের মর্ম বুঝবি?
মুখের উপরে পানির ঝাপটা মারে শিখা। সাদা তাওয়েলটা নিয়ে ভালো করে মুখ ঢলে মুছে নেয়। গিয়ে এদিক ওদিক চেয়ে রাজকে খোঁজে। রাজ আগেই ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে। শিখার জন্য অপেক্ষা করছে। শিখাকে দেখেই হাত তুলে ডাক দিলো,
“এই শিখা, এইযে, এদিকে এসো।”
শিখা রাজহংসীর ন্যায় ছন্দপায়ে এগিয়ে যায় রাজের টেবিলে। তার পছন্দ ভাত। রাজ দুই প্লেট ভাতের অর্ডার দিলো। শিখার পছন্দের মেন্যুগুলো দিয়ে দুজনে পেটপুরে খেয়ে উঠে।
শিখা বলল,
“কেমন বমি বমি লাগছে,একটু আঁচার কিনে দেন। ওই যে দোকানে দেখা যাচ্ছে।”
“তুমি গাড়িতে গিয়ে বসো। আমি নিয়ে আসছি। নাকি একটু হাঁটবে এখানে? হাওয়া আছে বেশ।”
“নাহ। হাঁটব না।”
শিখা গাড়িতে গিয়ে বসে। পিছন দিয়ে রাজও গাড়িতে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে। শিখার হাতে বড় একটি তেঁতুলের টক, ঝাল, মিষ্টি আচারের প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। শিখা তব্দা খেলো।
বলল,
“আল্লাহ! এত বড় আচারের প্যাকেট কবে শেষ করবো? দু’ চারটা হলেই হতো। কেমন জানি গা গুলিয়ে আসছে।”
“আমার বউয়ের জন্য দু চারটা কিনলে মন ভরবে না আমার। কিন্তু বমি বমির ভাব হওয়ার কোন কারণ ত নেই। তবুও এমন লাগছে কেন তোমার?”
ঈষৎ হেসে বলল রাজ।
“আজব! বমি কি শুধু ওই এক কারণেই হয়?”
লাজুক স্বরে বলল শিখা।
রাজ শিখাকে নিয়ে বাড়ি চলে গেলো। দোতলায় চলে গেলো দুজন। শিখা পালংকের উপরে উঠে শুয়ে পড়লো। লং জার্নির অভ্যাস নেই। তাই বেশ কাহিল লাগছে তার। রাজ খুব ফুরফুরে আছে। এমন জার্নি তার কাছে কিছুই না। রাজ ফ্রেস হয়ে এলো শাট প্যান্ট চেঞ্জ করে। সটান হয়ে শিখার পাশে শুয়ে পড়লো।
শিখা বলল,
“কাল আমাদের বাড়িতে যাবো। আম্মার জন্য মন পুড়ছে।”
“যেও। আমিও সকালে চলে যাবো। কাজ ফেলে আসছি।”
“বলেন আপনার মডেল হবার ইতিকথা?”
রাজ শিখাকে বুকের ওমে মিশিয়ে নিলো পাখির ছানার মতো করে। হাতের পিঠে ঠোঁট ছোঁয়ালো। শিখা হাত সরিয়ে নিলো। রাজ শিখার মাথায় নিজের একহাত রেখে বলল,
“এই তোমার মাথা ছুঁয়ে বলছি, আমি কোন টিভি তারকা বা টিভি মডেল নই। কিছুই না। এরকম বিলবোর্ডগুলোর মডেল হই মাঝে মাঝে কোম্পানির পণ্যের বিজ্ঞানের সুবিধার্থে। একবার এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে তার অফিসে গেলাম। সেখানে এক বড় ব্যবসায়ী বসা ছিলেন। তো পরিচিত হওয়ার পর প্রসঙ্গক্রমে উনি বললেন,
” বাহ! তোমার ত দারুন ফিগার। দেখতেও হ্যান্ডসাম তুমি। আমার তো গার্মেন্টস রয়েছে। পোশাকের বলেন বিজ্ঞাপনের জন্য আমরা মডেলদের নিয়ে কাজ করি। বিনিময়ে তাকে যোগ্য পারিশ্রমিক দিই। তুমি চাইলে মডেল হতে পারো আমার পোশাকের।”
আমি দোনোমোনো শুরু করলাম। সেই বড় ভাইও আমাকে অনুরোধ করলো কাজ করার জন্য। এভাবেই মাঝে মাঝে কিছু কাজ করি এদিকে। আর যেই মেয়ে দুটো দেখলে। তারা কোম্পানির প্রচারের স্বার্থে ও তাদের নির্দেশেই এভাবে পোজ দেয়। দিতে হয়। তাদের বিজনেস বলে কথা। এটা আমাদের পরিবারে কেউই জানে না জুবায়ের ছাড়া। সেখানে কিভাবে বিয়ের আগে তোমাদের শুনাবো? তারপরে কয়েকবার বলতে চেয়েছি তোমাকে। কিন্তু নার্ভাসনেস কাজ করেছে শিখা। যদি তুমি ভুল বুঝো। এভাবে বলি বলি করে আর বলা হয়নি। তুমি পড়াশোনায় ভালো ছাত্রী। বুদ্ধিমতী। আশাকরি সহজ বিষয়টা সহজ করেই দেখবে। এই যে মিডিয়াতে এত শ’য়ে শ’য়ে নারী,পুরুষ অভিনয় করে। রোমান্টিক দৃশ্যগুলো করে। এগুলো প্রফেশনালিজম। তাদের কি ঘর সংসার,স্ত্রী,স্বামী,মা,বাবা,সন্তান নেই? তারা যদি ভুল বুঝতো তাহলে কাজ করতে পারতো? পারতো না।”
শিখা রাজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, হারিয়ে ফেলা প্রিয় মানুষকে খুঁজে পাওয়ার মতো করে। কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
“আপনি শুধু আমার। শুধুই আমার। এই পৃথিবীতে আপনি কেবল শিখার ভালোবাসায় সিক্ত হবেন। আপনার কাঁধে অন্য মেয়েদের হাত দেখে আমার ভিতরটা পুড়ে খাঁক হয়ে গিয়েছে। বোঝাতে পারব না।”
রাজ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। গোপনে তপ্তস্বাস ফেলে স্রস্টাকে স্মরণ করলো করুণ গলায়। শিখার সারাশরীরে অগনিত চুমু খেলো বুভুক্ষুর ন্যায়। বুঝিয়ে দিলো তারকাছে শিখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই থ্রিলারের লেখিকা রেহানা পুতুল। যারা লেখিকার আইডি বা পেইজ থেকে গল্প পড়তে চান তারা রেহানা পুতুল লিখে সার্চ করলেই আইডি/পেইজ পেয়ে যাবেন। রেহানা পুতুল ছাড়া অন্য আইডি,পেজ থেকে গল্প পোস্ট করলে সেটা প্লিজ এড়িয়ে চলুন। প্রকৃত রাইটারের শ্রম,মেধার মূল্য দিন।
রাজ নিচে নেমে গেলো বিকেলে। সবার সঙ্গে দেখা করলো। রাতে থেকে পরেরদিন সকালে চলে গেলো। শিখা তারমতো করে ভাত খেয়ে কলেজে চলে গেলো। সেদিন রাতে জুবায়ের ঢাকা থেকে চলে এলো। তার ব্যবসা আছে। সে আর কত থাকবে। এখন একটা অবস্থায় চলে এসেছে রানি। ডলিকে রেখে আসলো রানির কাছে। রানির কাটা কবজি হাতের সাথে সাকসেসফুলি জোড়া লাগানো গিয়েছে। রাজের অফিসের স্টাফরা রোজ গিয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছে। রিলিজ দিবে আরো একসপ্তাহ পরে।
সকালে জুবায়েরের সঙ্গে উঠানে শিখার দেখা হয়। জুবায়ের নরম হাসলো শিখার দিকে চেয়ে। দুষ্ট গলায় বলল,
“আম খায় কেউ পানি খায় কেউ।”
শিখা ধুম করে হেসে ফেলল। নাক কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“বুঝিনি?”
“বুঝোনাই বধূ? এটা আমাদের গ্রামের এক পাগলের প্রলাপ। তার নাম স্প্রিং পাগলা। তার ছিলো ভাঙ্গা একখান ঘর। টিনের মরচে ধরা পুরোনো চালটায় ছিলো স্থানে স্থানে ফুটো। তার ঘর লাগোয়া পিছনে ছিলো বিশাল এক আমগাছ। সেই আমগাছের বড় বড় কয়েকটি শাখা স্প্রিং পাগলার ঘরের চালের উপর ঝুঁকে থাকতো। গাছ মালিক সেই বাড়ির অন্য পরিবার। তো বর্ষাকাল এলেই সেই আম গাছের শাখার পাতাগুলো থেকে বৃষ্টির পানি চুইয়ে চুইয়ে তার ঘরের মাটিতে পড়ে। তার দুর্দশা দিগুণ হয়। তখন সে কাঁচা বাজারের সব দোকানের সামনে গিয়ে একটু দাঁড়ায়। পান খাওয়া দু’পাটি দাঁত বের করে স্বতঃস্ফূর্ত গলায় বলতে থাকে,
আম খায় কেউ পানি খায় কেউ। এই হলো বিষয়। ক্লিয়ার?”
শিখা কপাল ভাঁজ করে বলল,
“আপনি ফাজিল, পঁচা।”
“আমি এমন বলেইত পানি খাই শুধু। রাজ আম খায়।”
শিখা বিনয়াবত হয়ে বলল,
“আসলে কি বলব জুবায়ের ভাই। এই কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। কবজি কাটল উনি। কারণটা আমি। কিন্তু যত ঝক্কিঝামেলা পোহাচ্ছেন আপনি। আসলেই অনেক কষ্ট, ত্যাগ, দিয়ে দিতেছেন আমাদের দুজনের জন্য।”
“হুম। আমি মনে হয় জগদ্বিখ্যাত হয়ে যাবো এত ত্যাগ তিতিক্ষা দিতে দিতে কারো জন্য।”
বলে জুবায়ের অন্যদিকে চলে যায়। শিখা ঘরে চলে আসে। তার পরেরদিন বিকেলে শিখা তাদের বাড়িতে যাবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। ঠিক তখন আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লো তালুকদার। বুকে ব্যথা আরম্ভ হলো উনার। সীমান্ত ছিলো তখন নানার বাড়ি। সে আগেরমতো আসতে পারে না। তার মা তাকে আসতে বারণ করে চোখ রাঙিয়ে। কেননা তার ভাষ্যমতে সীমান্ত শিখার সংস্পর্শে থেকে আরো বেশি দূর্বল হয়ে যাবে কুসুমের প্রতি। শিখা তাকে প্ররোচিত করবে তার বান্ধবীর প্রতি।
সীমান্ত, বরকত, আদুরী,সুফিয়া,সবাই জয়নুল তালুকদারকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলো। জুবায়েরকে খবর দিলো বরকত। সে এলো হসপিটালে। ভর্তি করলো। কেবিন নিলো। যেহেতু ডাক্তার বলছে থাকতে হবে দু’তিনদিন। বুকের ব্যথাটা কি দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস্ট্রিক থাকার ফলে হচ্ছে,নাকি হার্টে ব্লক পড়লো। এটা এনজিওগ্রাম করলে জানা যাবে। এমতাবস্থায় বাবার বাড়ি যাওয়া স্থগিত হলো শিখার। তার বিবেক সায় দিচ্ছে না যাওয়ার জন্য। বাড়িও খালি। আদুরি,সুফিয়া হাসপাতালেই আছে। শিখা এখনো যেতে পারেনি। সুমনাও গিয়ে দেখে আসলো। শিখার কলেজের জন্য সে দিনে যেতে পারছে না প্রচন্ড ইচ্ছে থাকা সত্বেও।
একরাতে জুবায়েরের বাড়ি এলে আমেনা তাকে বলল,
“শিখা আফসোস করতাছে খালি, ভাইজানরে দেখতে যাইতে পারতেছে না বইলা। হাসপাতাল ম্যালা দূর বাড়ি থেইকা। ছেমরি সকালে যায়,বিকালে আসে কলেজ থেইকা। কারে নিয়া যাইবো।”
“এখন যাবে কিনা জিজ্ঞেস করেন? আদুরীও আমাকে বলল শিখাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।”
” মাগো। কয় কি। যাক তাইলে আদুরীর গলার সুর পাল্টাইলো শিখার লাইগা। আদুরী মনে হয় বাকি জিন্দেগীর লাইগা টাইট হইয়া গ্যাছে। খাড়া শিখারে জিগাই। তুই ভাত খাইয়া নে টেবিলে গিয়া।”
জুবায়ের ভাত খেয়ে নেয়। আমেনা গিয়ে শিখাকে বলে জুবায়ের সঙ্গে যাবে কিনা। শিখা একবাক্যে রাজী হয়। তার ভালো স্বশুরটাকে না দেখতে পেরে তার মন আনচান করছে শুধু।
শিখা চটজলদি করে নতুন একটা সেলোয়ার কামিজ পরে নেয়। চোখে একটু কাজল টেনে দেয়। গোলাপি অধরযুগলখানিকে আরো গোলাপি করে তোলে হালকা নেচার কালারের লিপিষ্টিকের প্রলেপ এঁকে। চুল আঁচড়িয়ে এক ঝুঁটি করে বেঁধে নেয়। হাতে নতুন ভ্যানিটি ব্যাগটা নিয়ে নেয়। ভালো করে মাথাকে ওড়না দিয়ে ঢেকে নেয়।
জুবায়ের উঠানে গিয়ে বাইক স্টাট দেয়। শিখা গিয়ে বাইকের পিছনে চড়ে বসে। জুবায়ের শিখার দিকে আকুল চোখে চায়। তার বুকের বাঁ পাশটা টনটন করে উঠে। রাতের আলো আঁধারের বুক চিরে জুবায়ের শিখাকে নিয়ে যাচ্ছে। একটা স্থানে গিয়ে উঁচুনিচু মেঠোপথে মোটর বাইকটি একটু ধাক্কা খেলো। অমনি শিখার শরীর ঝুঁকে পড়লো জুবায়েরের পিঠের উপর। জুবায়েরের মস্তিষ্কের কোষে কোষে বিদুৎ শকের মতো তীব্র ঝাঁকুনি হলো। সে নিরিবিলি দেখে একটু সামনে গিয়ে বাইক থামিয়ে নেয়। নেমে দাঁড়ালো।
“কি ব্যাপার জুবায়ের ভাই? কোন সমস্যা হয়েছে হোন্ডার? থামলেন কেন আর নামলেন কেন?”
“হোন্ডার সমস্যা হয়নি। আমার সমস্যা হয়েছে। তুমি বসো এক মিনিট।”
শিখা বসে রইলো। জুবায়েরকে সুক্ষ্ম চোখে দেখছে আবছায়ার মধ্যে। জুবায়ের কয়েক পা এগিয়ে রাস্তার পাড় ঘেঁষে দাঁড়ালো। পকেট থেকে সিগারেট ও দিয়াশলাই বের করলো। সিগারেট জ্বালিয়ে নিলো। দ্রুততার সঙ্গে কয়েক টান দিলো। হৃদয়ের গিরিখাদে পুঞ্জীভূত বিরহের নীল বেদনাগুলো সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে মিশিয়ে দিলো। উড়িয়ে দিলো শূন্যের মাঝে। আধখাওয়া সিগারেটটা মাটিতে ফেলে স্যান্ডেল দিয়ে চ্যাপ্টা করে পিষে ফেলল। যেনো খুব ক্রোধ ঝাড়লো সিগারেটের উপর দিয়ে। ফিরে এসে বাইকে বসলো।
শিখা বলল,
“কি হয়েছে? সিগারেটে টানলেন যে? হোন্ডার ক্ষতি হয়েছে নাহ?”
জুবায়ের শিখার জিজ্ঞাসার উত্তর দিলো মনে মনে।
“নাহ। আমার ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে শিখা। যেটা সারানো সম্ভব নয়।”
জুবায়ের বাইকে চড়ে বসলো। কোন কথা বলল না। ফুল স্পিডে বাইক চালিয়ে হাসপাতালের মূল ফটকে থামলো। শিখাও নেমে গেলো। জুবায়ের আগে হাঁটছে। তাকে অনুসরণ করে শিখা হাঁটছে। হাসপাতালের তিনতলায় চলে গেলো শিখাকে সঙ্গে নিয়ে। কেবিনে প্রবেশ করলো। জুবায়ের চাচার শারীরিক খোঁজ খবর নিলো। নিচে গিয়ে পরপর কয়েকটি সিগারেট টানলো। শিখা আধ ঘন্টার মতো থাকলো স্বশুরের কাছে।
পরে তারাই বলল,
“তুমি চইলা যাও। রাইত বাইড়া যাইতাছে। জুবা মনে হয় নিচেই আছে।”
সুফিয়া,আদুরী শান্ত ভঙ্গিতে শিখার সঙ্গে কথা বলল। শিখার ভালোলাগলো। আহা! সবাই মিলেমিশে থাকলে জীবন কত সুখের! পরিতৃপ্তির! উপভোগের!
জুবায়ের উপরে উঠে আসে। শিখাকে নিয়ে বিদায় নেয় সবার থেকে। হাসপাতালের নিচে গেটে গিয়ে শিখা কিঞ্চিৎ অভিমানী স্বরে বলল,
“আপনি চলে যান। আমি আলাদা একটা ট্যাম্পু নিয়ে যাবো।”
জুবায়ের বিষম খাওয়া কণ্ঠে শুধালো,
“কেন? যার সঙ্গে এলে তার সঙ্গে যেতে এখন আপত্তি হচ্ছে কেন?”
“আপনি চক্ষুলজ্জায় দায়ে পড়ে আমাকে নিয়ে এসেছেন। এদিকে পথে কি জানি আপনার কি হলো,মেজাজ গরম করে সিগারেট টানলেন। তাই আলাদা যাবো।”
“তুমি একা গেলে তোমার উপর গুণ্ডাদের আক্রমণ হতে পারে। ট্যাম্পু চালকদের সাথে তাদের যোগসাজশ থাকে। তোমার মতো মোহনীর রূপের একা তরুণী যাত্রীকে চালক তাদের হাতে তুলে দেয়। বিনিময়ে চালক পায় মোটা অংকের ক্যাশ। চাইলে এবার যেতে পারো আলাদা। পরিবারের মানুষ হিসেবে তোমাকে জানানো আমার কর্তব্য।”
শিখা একচুলও নড়ল না। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। জুবায়ের বাইকে চড়ে বসলো। পুরু গলায় বলল,
“পিছনে এসে বসবে? নাকি চলে যাবো?”
শিখা ইতিউতি চেয়ে বাইকে গিয়ে বসলো। জুবায়ের মুচকি হেসে বাইক স্ট্রাট দিলো।
তার পরেরদিন ছিলো শুক্রবার। বাড়িতে তেমন কেউ নেই। সবাই হসপিটালে। ভরদুপুরে শিখা হেলেদুলে পুকুরপাড় ধরে এগিয়ে গেলো বাগিচার ভিতরে। পুরো বাড়ি ফাঁকা। এই সুযোগে বাগিচার ভিতরে কি কি ফলগাছ আছে সে দেখবে। তার পছন্দমতে কিছু পেলে কুড়িয়ে নিবে বা ছিঁড়ে নিবে লবন মরিচ দিয়ে মেখে খাওয়ার জন্য। যেমন, বেতফল,বুতি জাম,গোলাপজাম
এসব। শিখা সেই বাগিচা অতিক্রম করে ভিতরে আরেকটি পরিত্যাক্ত বাগিচায় ঢুকলো। মুখ বাড়িয়ে দেখলো একটি গোলাপজাম গাছ ও একটি বেতফল গাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে দুই বন্ধুর মতন।
থোকায় থোকায় পাকা বেতফলও দেখা যাচ্ছে। ওহ! শিখার লকলকানো জিভে পানি এসে গেলো। সে সোজা গাছদুটোকে দৃষ্টির নিশানায় রেখে এগিয়ে যেতে লাগলো। সেগুলোর কাছাকাছি হতেই লতায় পাতায় আচ্ছাদিত উঁচু ঢিবির মতো একটি স্থানে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো। শিখা বিরক্ত হয়ে ঢিবির দিকে তাকালো। ঢিবির উপরের কিছু লতাপাতা দুহাত দিয়ে টেনে সরিয়ে নিলো।
রাজবধূ পর্ব ৫৮
তাতেই দৃশ্যমান হলো আস্ত একটি কবর। তালুকদার বাড়ির কবরস্থান সে দেখেছে। তার স্বশুর তাকে দেখিয়েছে। তাহলে এখানে বিচ্ছিন্ন এই কবর কার হতে পারে?
ভাবতেই প্রখর রোদ্দুরের মাঝেও শিখার সমস্ত শরীর হিম হয়ে গেলো কনকনের শীতের রাতের ন্যায়। তবে এই কবরের রহস্য সে আবিষ্কার করেই ছাড়বে।